রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বাগদাদির মৃত্যুর পর আইএসের ভবিষ্যৎ কী?

আবুবকর আল বাগদাদি
জঙ্গিবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নেতা আবুবকর আল বাগদাদির মৃত্যুর খরব যে প্রশ্নটিকে এখন সামনে আনল তা হচ্ছে- এরপর কী? বাগদাদির মৃত্যুর মধ্য দিয়েই কি অবসান ঘটবে আইএসের জঙ্গিবাদী তৎপরতা? এ প্রশ্নগুলো এখন বারবার আলোচিত হতে থাকবে।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর আগেও বাগদাদির মৃত্যুর খবর প্রচারিত হয়েছিল; কিন্তু কোনো মহল থেকেই তখন এর সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি। তবে এবারের বিষয়টি যেন একটু ভিন্ন। স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিকদের জানিয়েছেন বাগদাদির মৃত্যুর খবর।
২ অক্টোবর রাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ অভিযানের সময় সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে বাগদাদি তার নিরাপদ আস্তানা থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর আত্মঘাতী হন তিনি। সঙ্গে মারা যায় তার তিন সন্তানও! এভাবে মারা যাওয়ায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে কুকুরের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
এবার স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন তার মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন, তখন ধরে নিতে হবে এর পেছনে সত্যতা আছে। আইএসের একজন কমান্ডারও তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে বিবৃতি দিয়েছে। ইরাক ও ইরানের সূত্রগুলোও তার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
বাগদাদিকে দীর্ঘদিন ধরে খুঁজছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তার ব্যাপারে তথ্য দেয়ার জন্য ১০ মিলিয়ন (এক কোটি) ডলার পুরস্কারও ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৩ সাল থেকেই বাগদাদি আইএসের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। তবে ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো আইএসের কথা জানা যায়, যখন সিরিয়া ও ইরাকের একটা অংশ নিয়ে তিনি তথাকথিত একটি খিলাফত প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন।
কিন্তু ওই খিলাফত প্রতিষ্ঠার আগেই ২০১৬-১৭ সালে আইএসের পতন ঘটে। ধীরে ধীরে বাগদাদির ‘পৃথিবী’ ছোট হয়ে আসছিল। ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ আইএসের সর্বশেষ ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত Deir ey-Zor থেকেও উৎখাত হয় আইএস। আর এবার বাগদাদির মৃত্যুর খবর এলো।
সিরিয়াস পাঠকরা বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বরের সংখ্যাটির প্রধান স্টোরির কথা মনে করতে পারেন। অনেক গবেষকের কাছে এই সংখ্যাটি থাকার কথা। ওই সংখ্যার প্রচ্ছদ টাইটেল ছিল ‘The Caliphate Falls’, অর্থাৎ খিলাফতের পতন ঘটেছে। সিরিয়ার রাকা শহর ছিল তথাকথিত আইএসের খিলাফতের রাজধানী।
২০১৪ সালের জুন মাসে বাগদাদি তার তথাকথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে সারা বিশ্বের মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন এই খিলাফতের ব্যানারে সমবেত হতে। হাজার হাজার তরুণ বাগদাদির ওই আহ্বানে সাড়া দিয়ে আইএসের পক্ষে ‘যুদ্ধে’ যোগ দিতে সিরিয়ার রাকায় গিয়েছিলেন। তাদের অনেকেই আর ফিরে আসেননি। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক শামীমার কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে।
কিশোরী শামীমা ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘মগজধোলাইয়ের’ শিকার হয়ে আইএসে যোগ দিয়েছিল। ওই সময়ের স্কুলপড়ুয়া ১৫ বছরের কিশোরী শামীমাকে শেষ পর্যন্ত ব্রিটেন গ্রহণ করতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এভাবে শামীমার মতো শত শত তরুণ-কিশোর মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলো থেকে সিরিয়ায় গিয়েছিল।
পশ্চিমা সংবাদপত্রের মতে, সবচেয়ে বেশি ‘জিহাদি’ গিয়েছিল মধ্য এশিয়ার মুসলমানপ্রধান পাঁচটি দেশ থেকে। ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনের মিন্দানাও থেকেও প্রচুর তরুণ আইএসে যোগ দিয়েছিল; কিন্তু সমস্যাটা তখনই তৈরি হয়, যখন সিরিয়ায় আইএসের পতনের পর এসব জিহাদি নিজ নিজ দেশে ফেরত আসে।
তখন বলা হয়েছিল, আইএস মিন্দানাওয়ে বড় ঘাঁটি গড়তে যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া নিয়েও একটা শঙ্কা ছিল। এখন বাগদাদিবিহীন এসব জিহাদির কী হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
হঠাৎ করে জঙ্গিবাদী একটি সংগঠনের প্রধান হিসেবে বাগদাদির ‘আবির্ভাব’ নিয়েও নানা ‘মিথ’ আছে। কে এই বাগদাদি? বলা হয় ইরাকে তার জন্ম। আসল নাম ইব্রাহিম আওয়াদ ইব্রাহিম আলি আল-বাদরি আল-সামাররাই। আবু দুয়া, আল-শাবাহ নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। বাগদাদি ছিল তার প্রচলিত নাম। তবে তার সঠিক পরিচয় কখনই জানা যায়নি।
এ কথাও বলা হয়েছিল যে, তিনি ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার লোক এবং তাদেরই তৈরি করা! তবে একটা ‘মিথ’ তিনি তৈরি করেছিলেন। একটি ভ্রান্ত ধারণার ওপর তিনি তার ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন, যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
অস্ট্রেলিয়ার পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্যমতে, বিশ্বে মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা (২০১৭) ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন (১৮০ কোটি)। প্রায় ৪৯টি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এদের বসবাস। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মাঝে ৭৫ থেকে ৯০ শতাংশ সুন্নি সম্প্রদায়ের। আর শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত রয়েছে ১০ থেকে ২০ শতাংশ। সুতরাং এ দেশগুলোকে নিয়ে একটি ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার ধারণাটি ছিল অকল্পনীয় ও বাস্তবতাবির্বজিত। এটি অনেকটা আবেগতাড়িত; মুসলমান সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করা।
উপরন্তু ইরানের মতো দেশও এই তথাকথিত খিলাফতের বিরুদ্ধে ছিল। একুশ শতকে এসে মধ্যযুগীয় ধর্মভিত্তিক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাও যুক্তিযুক্ত নয়। এছাড়া ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে মানুষ হত্যা, আত্মঘাতী বোমারু তৈরি করা ইসলাম ধর্মের মূল স্পিরিটের পরিপন্থী। ইসলাম শান্তির ধর্ম। মানুষ হত্যা ইসলাম সমর্থন করে না। অনেক ইসলামিক পণ্ডিত তাই বাগদাদির খিলাফতের আহ্বানকে ‘বিভ্রান্তিকর’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
মূলত বাগদাদি ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে এক ধরনের সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিয়েছিলেন, যা কিনা সারা বিশ্বে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণার জন্ম দিয়েছিল। বিশ্বজুড়েই এরপর ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে একটা জনমত তৈরি হয়। এর কারণ হচ্ছে তথাকথিত এসব জঙ্গি নেতার উত্থান, যারা ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে তাদের স্বার্থ আদায় করতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৯-১১ এর ঘটনা (টুইন টাওয়ার ধ্বংস, ২০০১) এবং এর সঙ্গে আল কায়দা ও ওসামা বিন লাদেনের সংশ্লিষ্টতা, এরপর ২০১৪ সালে আইএস ও বাগদাদির উত্থান সারা বিশ্বে অ্যান্টি-মুসলমান যে ‘সেন্টিমেন্টের’ জন্ম দিয়েছে, এ থেকে বেরিয়ে আসা যাচ্ছে না।
বিশ্বের মুসলমান নেতৃত্বও এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। ওআইসিও এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ। সুতরাং বাগদাদির মৃত্যু মুসলমান সম্প্রদায়ের ভাবমূর্তি উদ্ধারে কতটুকু সাহায্য করবে, এটাই মূল প্রশ্ন এখন।
নিঃসন্দেহে বাগদাদি ভুল করেছিলেন। ভুল করেছিলেন ওসামা বিন লাদেনও। আর তালেবানরাও ভুল করছে আফগানিস্তানে। এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এখন ছড়িয়ে পড়ছে আফ্রিকায়। নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম কিংবা সোমালিয়ায় আল-শাবাব গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কথা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে একাধিকবার ছাপা হয়েছে। বোকো হারাম আইএসের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছিল।
নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালী; কিন্তু তারপরও তারা বোকো হারামকে নাইজেরিয়া থেকে উৎখাত করতে পারেনি। আর সোমালিয়া একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ফলে একটা প্রশ্ন থাকবেই- বাগদাদি-পরবর্তী এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আদৌ বন্ধ হবে কিনা? আমরা আফগানিস্তানের কথাও বলতে পারি।
আফগানিস্তানের একটা বিশাল এলাকা তালেবানদের দখলে থাকলেও আইএস জিহাদিদের একটা অংশ সিরিয়া-ইরাক থেকে উৎখাত হয়ে আফগানিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। এদের কর্মকাণ্ডও মাঝেমধ্যে সংবাদের জন্ম দেয়। আইএসের সংবাদমাধ্যমে সংগঠনটির পাক-ভারত উপমহাদেশে শাখা গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল।
একজন আমিরের নামও (ছদ্মনাম) তারা ঘোষণা করেছিল। এখন তাদের কী হবে? বাস্তবতা হচ্ছে, আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর পর আল কায়দা বিলুপ্ত হয়নি। আয়মান আল-জওয়াহিরির নেতৃত্বে আল কায়দা তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। যদিও আগের মতো শক্তি তাদের নেই।
বাগদাদির মৃত্যুর পর নতুন আইএস নেতার নাম ঘোষণা করা হয়েছে- তিনি হচ্ছেন আবদুল্লাহ কায়দাশ। বলা হচ্ছে, কারদাশ ইরাকি সেনাবাহিনীর সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কমান্ডার। সুতরাং আইএসের ইচ্ছাটা পরিষ্কার। বাগদাদির অবর্তমানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া।
কিন্তু ওসামা বিন লাদেনের অবর্তমানে আল কায়দা যেমন ঝিমিয়ে পড়েছে, ঠিক তেমনি বাগদাদির অবর্তমানে আইএস বড় কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। ওসামা বিন লাদেনের পর বাগদাদি যুগের অবসান ঘটল। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বে সন্ত্রাসী যুগের অবসান হোক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সন্ত্রাসের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যায় না- বাগদাদির মৃত্যু এই সত্যটি আবারও প্রমাণ করল।
Daily Jugantor
02.11.2019

0 comments:

Post a Comment