রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ইতিহাস বাগদাদিকে কিভাবে স্মরণ করবে




ইতিহাস বাগদাদিকে কিভাবে স্মরণ করবে
Share 
অ+অ-
তিনি এখন মৃত। আবু বকর আল বাগদাদি। 
ঘৃণিত একটি নাম। ২০১৪ সালে ইরাকের মসুলে একটি মসজিদে প্রথমবারের মতো তথাকথিত ‘খিলাফতের’ ঘোষণা দিলে তাঁর নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের বারিশা গ্রামে একটি সুড়ঙ্গে তাঁর মৃত্যু হয়। যদিও মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ টিমের হাতে তাঁর মৃত্যু হয়নি। দুটি শিশুসন্তানসহ তিনি নিজে নিজেকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ ধরনের সন্ত্রাসীদের এভাবেই মৃত্যু হয়। লাদেনেরও মৃত্যু হয়েছিল এভাবেই—২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে। তবে নেভি-সিলের কমান্ডো অভিযানে তিনি নিহত হয়েছিলেন। শুধু লাদেন কিংবা বাগদাদির কথা কেন বলি? আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের কাছে আবু মুসাব আল জারকাবি, আবু হামজা আল মাসরি, আবু লাইথ আল লিবি কিংবা আবু ওমর আল বাগদাদি, আবু আইয়ুব আল মিসরি—এ নামগুলো পরিচিত।
তাঁরা সবাই ছোট ছোট উপদল গঠন করে, ইসলামের নাম করে সন্ত্রাসী সংগঠনের জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁরা সবাই মারাও গেছেন। তবে আবু বকর আল বাগদাদি যেভাবে আইএসকে পরিচালনা করতেন, অন্য কেউ এভাবে এ ধরনের সন্ত্রাসী সংগঠন পরিচালনা করেননি। তিনি অত্যন্ত নৃশংস একটি বাহিনী তৈরি করেছিলেন। মানুষ পুড়িয়ে মারার কাহিনি তাঁরা নিজেরাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করতেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা একটি ভয়ের আবহ তৈরি করেছিলেন। অনেক ইয়াজিদি নারীকে তাঁরা ধরে এনে যৌন দাসীতে পরিণত করেছিলেন। এসব নারীর করুণ কাহিনি পশ্চিমা সংবাদপত্রে প্রকাশিতও হয়েছিল। তাঁরা একটি সামরিক বাহিনীও তৈরি করেছিলেন, যারা যুদ্ধে নিয়মিত অংশ নিত। আল-কায়েদার সঙ্গে তাদের পার্থক্যটা ছিল এখানেই। ইসলামের নামে তারা সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলেও, আইএসের স্ট্র্যাটেজি ছিল ভিন্ন। এখন বাগদাদির মৃত্যু ঘটল। কিন্তু রেখে গেলেন অনেক প্রশ্ন। কে এই বাগদাদি? বাগদাদির ‘আবির্ভাব’ নিয়েও নানা ‘মিথ’ আছে। আছে বিতর্ক। বলা হয় ইরাকে তাঁর জন্ম। আসল নাম ইব্রাহিম আওয়াদ ইব্রাহিম আলী আল বদরি আল সামাররাই। আবু দুয়া, আল-শাবাহ নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। বাগদাদি ছিল তাঁর প্রচলিত নাম। তবে তাঁর সঠিক পরিচয় কখনোই জানা যায়নি। এ কথাও বলা হয়েছিল যে তিনি ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার লোক এবং তাদেরই তৈরি করা। তবে একটা ‘মিথ’ তিনি তৈরি করেছিলেন। একটি ভ্রান্ত ধারণার ওপর তিনি তাঁর ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন, যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। 
অস্ট্রেলিয়ার পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য মতে, বিশ্বে মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা (২০১৭) ১.৮ বিলিয়ন। প্রায় ৪৯টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে তাদের বসবাস। মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ৭৫ থেকে ৯০ শতাংশ সুন্নি সম্প্রদায়ের। আর শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত রয়েছে ১০ থেকে ২০ শতাংশ। সুতরাং এ দেশগুলো নিয়ে একটি ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার ধারণাটি ছিল অকল্পনীয় ও বাস্তবতাবিবর্জিত। এটা অনেকটা আবেগতাড়িত, মুসলমান সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করা। উপরন্তু ইরাকের মতো দেশও এই তথাকথিত খেলাফতের বিরুদ্ধে ছিল। একুশ শতকে এসে মধ্যযুগীয় ধর্মভিত্তিক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাও যুক্তিযুক্ত নয়। এ ছাড়া ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে মানুষ হত্যা, আত্মঘাতী বোমারু তৈরি করা সনাতন ইসলাম ধর্মের মূল স্পিরিটের পরিপন্থী। ইসলাম শান্তির ধর্ম। মানুষ হত্যা ইসলাম সমর্থন করে না। অনেক ইসলামিক পণ্ডিত তাই বাগদাদির খিলাফতের আহ্বানকে ‘বিভ্রান্তিকর’ বলে অভিহিত করেছিলেন। মূলত বাগদাদি ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে এক ধরনের সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিয়েছিলেন, যা কি না সারা বিশ্বে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণার জন্ম দিয়েছিল। বিশ্বজুড়েই এরপর ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে একটা জনমত তৈরি হয়। এর কারণ হচ্ছে তথাকথিত এসব জঙ্গি নেতার উত্থান, যাঁরা ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে তাঁদের স্বার্থ আদায় করতে চাইছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১-এর ঘটনা (টুইন টাওয়ার ধ্বংস ২০০১), এবং এর সঙ্গে আল-কায়েদা ও ওসামা বিন লাদেনের সংশ্লিষ্টতা, এরপর ২০১৪ সালে আইএস ও বাগদাদির উত্থান—সারা বিশ্বে অ্যান্টি মুসলমান যে ‘সেন্টিমেন্টের’ জন্ম হয়েছে, এ থেকে বেরিয়ে আসা যাচ্ছে না। 
বিশ্বের মুসলমান নেতৃত্বও এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পেরেছে বলে মনে হয় না। ওআইসি (OIC) এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ। সুতরাং বাগদাদির মৃত্যু মুসলমান সম্প্রদায়ের ভাবমূর্তি উদ্ধারে কতটুকু সাহায্য করবে—এটাই মূল প্রশ্ন এখন। তবে এদের কর্মকাণ্ড যে ইসলাম ধর্মের সঙ্গে আদৌ সম্পৃক্ত নয়, এটা নিয়ে ইসলামিক স্কলাররা কথা বলেছেন। মুসলমান সম্প্রদায়কে সতর্কও করেছেন। ইসলামিক পণ্ডিত Muhammad Tahir-ul-Qadri এ ব্যাপারে একটি ফতোয়া দিয়েছিলেন। তিনি কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন যে ইসলাম আত্মঘাতী সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে না। তাঁর একটি বই লন্ডন থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর দেওয়া ফতোয়া অনুমোদনও দিয়েছিল। মিসরের বিখ্যাত আল আজহার মসজিদের ইমাম Shaykh Muhammed Sayyid একবার বলেছিলেন, ‘Attacking innocent people is not courageous, it is stupid and will be punished on the day of judgement’ (এএফপি, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০১)। সৌদি আরবের প্রধান মুফতি Abdulaziz bin Abdullah Al-Ashaykh-এর মন্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবে, ‘The world must know that Islam is a religion of peace, and mercy and goodness; it is a religion of justice and guidance,... Islam has forbidden violence in all its forms’ (archive.org)|
 যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার Atlantic বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক Robert G. Rabil ওয়াশিংটন পোস্টে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ২০১৮ সালের ১ আগস্ট। তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট—‘The distortion of Islam that drives terrorism’। এভাবে আরো অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে, যেখানে বলা হয়েছে ইসলামের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের কোনো সম্পর্ক নেই। 
কিছু কিছু ব্যক্তি আছেন, যাঁরা উগ্রপন্থী, যাঁরা ইসলামকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিয়েছিলেন। বাগদাদি এমনই এক ব্যক্তি ছিলেন। আমার ধারণা, তিনি ছিলেন মানসিক বিকারগ্রস্ত এক লোক। তবে এটা ঠিক, তিনি সন্ত্রাসবাদকে প্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বয় করে নতুন একটি রূপ দিয়েছিলেন। অনেক তরুণ বিভ্রান্ত হয়ে আইএসে আকৃষ্ট হয়েছিল। তিনি ও তাঁর সহযোগীরা ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে তরুণ প্রজন্মের ‘মগজ ধোলাই’ করতেন। শত শত তরুণ ‘মগজ ধোলাই’-এর শিকার হয়ে সিরিয়ায় পাড়ি দিয়েছিল আইএসের পক্ষে ‘যুদ্ধে’ অংশ নেওয়ার জন্য। এই বাগদাদিকে ইতিহাস এখন কিভাবে স্মরণ করবে? নিশ্চয়ই তিনি সংস্কারবাদী ছিলেন না। এক হাজার ৪০০ বছরের পুরনো ইসলাম ধর্মে তিনি কোনো সংস্কার আনতে চাননি। প্রকৃত ইসলামও তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। ইয়াজেদি মেয়েদের ধর্ষণ করা, তাদের যৌন দাসী বানানো কিংবা সাধারণ মানুষকে পশুর মতো খাঁচার মধ্যে রেখে পুড়িয়ে মারার সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি ইসলামকে ব্যবহার করেছেন মাত্র। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, তিনি কখনো আইএসের মূল নেতা ছিলেন না। যখন ইরাক যুদ্ধ শুরু হয়, তখন তিনি ছিলেন একজন একাডেমিশিয়ান। কিন্তু ২০০৩ সালে ইরাক আক্রান্ত ও দখল হয়ে গেলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। ২০০৪ সালে ফাল্লুজায় তিনি গ্রেপ্তার হন। পরে মুক্তি পান। এই সময়ে তিনি আল-কায়েদার সংস্পর্শে আসেন। ২০১০ সালে তিনি ছিলেন আল-কায়েদার তিন নম্বর নেতা। প্রথম দুজন মারা গেলে এবং আল-কায়েদা থেকে বের হয়ে আইএস গঠন করেন, তিনি হয়ে যান এর মূল নেতা। 
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁর অবর্তমানে কী হবে আইএসের? ‘ফরেন পলিসি ইন ফোকাস’-এর তথ্য মতে, ফিলিপাইন, আফগানিস্তান, সোমালিয়া, লিবিয়া, নাইজেরিয়া, ইয়েমেনে বেশ কিছু সন্ত্রাসী সংগঠন রয়েছে, যারা বাগদাদির সময়েই আইএসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল। ইউরোপে তাদের
Sleeper cells-ও আছে। একজন নতুন নেতার নামও ঘোষণা করেছে আইএস। ফলে আইএসের কর্মকাণ্ড থেমে থাকবে বলে মনে হয় না। তবে ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের একটি প্রবন্ধে দুজন গবেষক (২৮ অক্টোবর) আভাস দিয়েছেন যে ওই সব সংগঠন এখন আলাদাভাবে কাজ করতে পারে। প্রবন্ধে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে অর্থ একটি ফ্যাক্টর। এর সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাত্রা কমে আসবে। আরো একটি জিনিস লক্ষণীয়, আর তা হচ্ছে স্থানীয় জঙ্গি সংগঠনগুলো (যেমন—ফিলিপাইন কিংবা নাইজেরিয়ায়) স্থানীয় ইস্যু নিয়ে বেশি তৎপর। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদী তৎপরতায় তারা তেমন জড়িত নয়। খিলাফতের যে ধারণা বাগদাদি প্রমোট করেছিলেন, তাঁর অবর্তমানে এই ধারণারও মৃত্যু ঘটবে। তবে সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ হয়ে যাবে না বলেই গবেষকরা মনে করেন। 
বাগদাদি এখন অতীত। ওসামা বিন লাদেনও অতীত। সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যে ইসলাম প্রচার করা যায় না, সেটাই এখন প্রমাণিত। তবে লাদেন ও বাগদাদি ইসলাম ধর্মের অনেক ক্ষতি করে গেছেন। শান্তির ধর্ম ইসলামকে এখনো বহির্বিশ্বে একটু ভিন্ন চোখে দেখা হয়। এই ‘প্রবণতা’ কাটিয়ে ওঠা দরকার। এটা কিভাবে সম্ভব—বাগদাদির মৃত্যুর পর আবারও এ প্রশ্নটা সামনে এলো।

0 comments:

Post a Comment