এ
তারেক শামসুর রেহমান | ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০
এ কোন দেশে আমরা বসবাস করছি? র্যাবের এক অভিযানে (২৫ ফেব্রুয়ারি) পুরান ঢাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই নেতার বাসায় পাঁচটি সিন্দুকে পাওয়া গেছে ২৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা এবং ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকার এফডিআর আর এক কেজি স্বর্ণ। এর আগে গেল বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান পরিচালনার সময় তার দুই কর্মচারীর বাসায় অভিযান চালিয়ে পাঁচ কোটি টাকা এবং সাড়ে সাত কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করেছিল র্যাব। ঢাকা শহরে তার অন্তত ১৫টি বাড়ির অস্তিত্বের খবর পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরা দুই ভাই এনু ভূঁইয়া ও রুপন ভূঁইয়া গেন্ডারিয়া আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা।
একজন পাপিয়ার কাহিনীও পাঠক জেনেছেন গত ২৫ ফেব্রুয়ারি। তিনি নরসিংদী জেলা আওয়ামী যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এখন অবশ্য বহিষ্কৃত। তার বিলাসী জীবনের কাহিনী মানুষ জেনেছে সংবাদপত্র পাঠ করে। সুনির্দিষ্ট কোনো পেশা ছাড়াই পাপিয়ার দৈনিক লাখ লাখ টাকা ব্যয়, নিউ অ্যান্ড সি নামে একটি ব্যক্তিগত বাহিনীর মাধ্যমে গড়ে তোলা নিজস্ব সাম্রাজ্য, অবৈধ অস্ত্র, চাকরির তদবিরের নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া অর্থ পাচার, মাদক কারবার, অসহায় নারীদের নিয়ে দেহ ব্যবসা করা ইত্যাদি কাহিনী এখন সংবাদপত্রের পাতায়। গত তিন মাসে পাপিয়া হোটেলের বিল পরিশোধ করেছেন তিন কোটি টাকা। একটি নামকরা হোটেলের প্রেসিডেনশিয়াল স্যুট ভাড়া করে তিনি থাকতেন এবং কিছু তরুণীকে দিয়ে দেহ ব্যবসার মতো অনৈতিক কাজে লিপ্ত ছিলেন। ওই হোটেলের মদের একটি বার তিনি সারা রাতের জন্য ভাড়া করে রাখতেন। পাপিয়া কোটি কোটি টাকার মালিক হলেও, তার বাবার সংসার চলে অটোগাড়ির ভাড়ায়। পাপিয়ার একটি ছবি এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। একটি অনলাইন পোর্টালের খবর পাপিয়ার কললিস্টে ১১ মন্ত্রী ও ৩৩ এমপির নাম। এই পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন এখন ১৫ দিনের রিমান্ডে। আমরা জানি না তার অবৈধ অর্থের হিসাব পুলিশ কতটুকু উদ্ধার করতে পারবে। কিন্তু যে নারী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করে, উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ রক্ষা করে অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে শত শত কোটি টাকার মালিক হন, তারা রাজনীতির জন্য আশীর্বাদ নন, বরং অভিশাপ। যারা তাকে জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক বানিয়েছেন, তারাও সমান অপরাধী।
পাঠক, জি কে শামীম ও সম্রাটের কথা নিশ্চয় মনে আছে আপনাদের। দুজনই এখন জেলে। কীভাবে রাজনৈতিক সখ্য গড়ে তুলে এবং রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ব্যবহার করে সম্রাটরা টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন, তা পাঠকরা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন। জেনে গেছেন, ক্যাসিনো-সম্রাটদের নাম, ঠিকানা ও তাদের কর্মকাণ্ড। প্রধানমন্ত্রী ক্যাসিনো-সম্রাটদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়ে বেশ প্রশংসনীয় হয়েছিলেন। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, বিশেষ করে যুবলীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে, যুবলীগকে ব্যবহার করে তারা অবৈধ টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের প্রয়োজন ছিল। সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি, ছয় মাসের ব্যবধানে পাপিয়া যখন গ্রেপ্তার হন, তখন বুঝতে হবে রাজনীতির নামে যারা অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে আরও অভিযান প্রয়োজন। সম্রাট, এনু-রুপন কিংবা পাপিয়াদের কারণে রাজনীতিটা ‘নষ্ট’ হয়ে গেছে। রাজনীতি আর রাজনীতির জায়গায় থাকেনি। সম্রাট আর পাপিয়ারা রাজনীতিকে ব্যবহার করেছেন তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে। তাদের রাজনীতি, দলের জন্য তো বটেই, জাতিরও কোনো মঙ্গল ডেকে আনছে না। অথচ এ দেশে অনেক কৃতী রাজনীতিবিদ আছেন ও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শুধু রাজনীতির কারণেই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো জেলে কাটিয়েছেন। মওলানা ভাসানী রাজনীতি করে শেষ জীবন কুড়ে ঘরেই কাটিয়ে দিয়েছেন। কোনো দিন প্রয়োজনবোধ করেননি ঢাকায় প্লট ও ফ্ল্যাট নেওয়ার। আবেদনও করেননি কোনো দিন। এমন খবরও আমরা জানি, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির বিরোধিতা করলেও, বঙ্গবন্ধু তাকে নিয়মিত লুঙ্গি ও গেঞ্জি সরবরাহ করতেন। এটা ছিল নিছক ব্যক্তিগত ভাসানীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা। আজকে যারা বঙ্গবন্ধুর নামে রাজনীতি করেন, তারা কি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করেন? অবৈধ কোটি কোটি টাকা যারা সিন্দুকে রেখে দেন, তিন দিনে হোটেলে তিন কোটি টাকা ‘বিল’ দেন, তাদের আয়ের উৎস কী? তারা আর যাই হোক, তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করেন না। আমি জানি না, এসব অবৈধ অর্থ উপার্জনকারীর বিচার হবে কিনা? আশঙ্কার একটা জায়গা হচ্ছে, এসব তথাকথিত ‘রাজনীতিবিদদের’ সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের ‘যোগসাজশ’। র্যাবের কর্মকর্তারাও সংবাদকর্মীদের কাছে তা স্বীকার করেছেন। এখন এই ‘যোগসাজশ’ তাদের পুনর্বাসনের তথা মুক্তির ব্যাপারে আদৌ কোনো ভূমিকা পালন করে কি না সেটাই দেখার বিষয়।
আরও কিছু কথা। একটি জাতীয় সংবাদপত্র (বণিক বার্তা) তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে (৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০) ‘ভালোই আছেন ব্যাংক ও আর্থিক খাতের দুষ্কৃতকারীরা’। ভালো আছেন সংবাদপত্রটি আমাদের জানাচ্ছে! তিনজনের নাম সংবাদপত্রটি উল্লেখ করেছে প্রশান্ত কুমার হালদার, আবদুল আজিজ ও আবদুল হাই বাচ্চু। এই তিনজনের নতুন করে পরিচয় দেওয়ার দরকার নেই। পাঠক মাত্রেই এদের নামে চেনেন। পত্রিকার ভাষ্য মতে, প্রশান্ত কুমার হালদার কানাডায় আছেন। একই দেশে আছেন আবদুল আজিজও। আর আবদুল হাই নিউ ইয়র্ক-লন্ডনে সপরিবারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রশান্ত কুমার হালদার কানাডায় একটি কোম্পানি গঠন করে সেখানে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। বিদেশে ৯১৯ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে আজিজের বিরুদ্ধে। এটা শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের। দুদকের অভিযোগ, ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের আর জনতা ব্যাংকের অভিযোগ, ৩ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা ফেরত না দেওয়ার। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন আবদুল হাই বাচ্চু। বেসিক ব্যাংকের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৬১টি মামলা করেছে দুদক। দুদক তাকে কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। অভিযোগে আছে, বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও গ্রাহকদের মামলায় আসামি করা হলেও, অজ্ঞাত কারণে আসামি করা হয়নি পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের। দেশে লুটেরা ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কোনো বড় ধরনের সামাজিক আন্দোলন গড়ে না উঠলেও, কানাডায় এদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এদের বয়কট করার কথা ঘোষণা করেছেন। এটা নিঃসন্দেহে একটা প্লাস পয়েন্ট। কিন্তু এসব সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে লুটপাট করা অর্থ ফেরত আসবে না। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে দেশেই। গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। ইতিমধ্যে দেশ থেকে কত টাকা পাচার হয়েছে, তার একটা হিসাব বিভিন্ন সময়ে আমরা সংবাদপত্র পাঠ করে জেনেছি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার (তখনকার বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ) বিদেশে পাচার হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছিল। এর আগে আইএমএফ ২০০৯ সালে ৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হওয়ার কথা বলেছিল (সমকালে প্রকাশিত প্রবন্ধ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০)। এই যে সংবাদ, তা কোনো আশার কথা বলে না। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর অনেকেই আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। উচ্চ আদালত মাঝেমধ্যে তাদের উষ্মাও প্রকাশ করছেন। সম্প্রতি রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অর্থাৎ অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আপিল বিভাগে এক শুনানিতে মন্তব্য করেছেন, এভাবে ‘এখন অনেকেই ব্যাংক করেন জনগণের টাকা লুটের জন্য’ (যুগান্তর, ২৫ ফেব্রুয়ারি)। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা যখন এ ধরনের মন্তব্য করেন, তখন একটা হতাশা প্রকাশ পায় বৈকি! জনগণের টাকা লুটের জন্য ব্যাংক! কী সাংঘাতিক কথা? এ সরকারের সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো ঠিকমতো পরিচালিত হচ্ছে না। ব্যাংক থেকে অবৈধ পন্থায় টাকা ‘লুট’ করে নেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমরা দেখছি বিদ্যমান আইনের অসহায় আত্মসমর্পণ! আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে অভিযুক্তরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। দুদককে মাঝেমধ্যে আমরা অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে দেখি। কিন্তু তারপরও অর্থ পাচারকারীরা, ব্যাংক লুটপাটকারীরা দুদককে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে অভিযোগ থেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন! ব্যাংক নিশ্চয়ই লুটপাটের জায়গা হতে পারে না। রাষ্ট্র যদি আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, এর চেয়ে আর দুর্ভাগ্যজনক কিছু থাকতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় এখানে ত্রুটি রয়েছে বলেই মনে হয়। পড়াশোনার কাজে, গবেষণার কাজে আমি অনেক দেশে গেছি এবং এখনো যাই। ইউরোপে দীর্ঘদিন কাটিয়েছি পিএইচডি গবেষণায়। গেল ১০ বছর নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্রে যাই। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ আত্মসাৎকারীদের জন্য কঠোর আইন রয়েছে। বিচারে কঠিন শাস্তির খবরও আমরা জানি। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা কী দেখছি? রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা অসৎ পথে অর্থ উপার্জন করছেন। অর্থের পরিমাণ লাখ টাকা নয়, কোটি কোটি টাকা। আর তা ব্যাংকে না রেখে রাখা হচ্ছে কর্মচারীদের বাসায়, গোপনে সিন্দুকে। আর একজন অটোগাড়িচালকের মেয়ে শুধু সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনের সংশ্লিষ্টতা ব্যবহার করে শতকোটি টাকার মালিক হন। মাত্র তিন দিনে হোটেল ‘বিল’ পরিশোধ করেন তিন কোটি টাকা! সাধারণ একজন রাজনৈতিক কর্মীর পক্ষে এ ধরনের কাজ করা কি সম্ভব? গত কয়েক দিনের ঘটনা, যা সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে, তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সুশাসনের বড় অভাব। আমরা তরুণ প্রজন্মের ওপর আস্থাটা রাখতে চাই। এই তরুণ প্রজন্মই চীনকে বিশে^র দ্বিতীয় অর্থনীতিতে পরিণত করেছে। তরুণ রাজনীতিবিদদের কাছে আমরা বারবার ফিরে যেতে চাই। এরাই আমাদের পথ দেখাবেন। কিন্তু রাজনীতিকে ব্যবহার করে সম্রাট আর পাপিয়ারা যখন সমাজের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন, তখন ভয় হয়। আমরা এ রাজনীতি চাই না। চাই সৎ রাজনীতিবিদ। চাই যোগ্য নেতৃত্ব। বাংলাদেশ ৫০ বছরে পা দেবে আগামী বছর। এই ৫০ বছর একেবারে কম সময় নয়। দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ যদি এখনো আমরা প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, তাহলে উন্নত রাষ্ট্র গঠন করার যে স্বপ্ন আমরা দেখছি, তা কোনো দিনই বাস্তবায়িত হবে না। সম্রাটদের ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির কাহিনী যখন প্রকাশ হতে থাকল এবং প্রধানমন্ত্রী যখন কঠোর হলেন, তখন এর দায়ভার নিয়ে যুবলীগের চেয়ারম্যানকে চলে যতে হয়েছিল। এখন একজন যুব মহিলা লীগের নেত্রীর কাহিনী মিডিয়ায় ছাপা হচ্ছে। এর দায়ভার যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির। এর দায়ভার তারা এড়াতে পারে না। যুব মহিলা লীগেও নয়া নেতৃত্ব দরকার। প্রধানমন্ত্রী দলের মধ্যে তরুণ নেতৃত্ব চান। কিন্তু একজন সম্রাট কিংবা একজন পাপিয়া সেই আস্থাটা রাখতে পারলেন নাÑ দুঃখটা এখানেই।
Desh Rupantor
29.02.2020