রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সিটি নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি




ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। ঢাকাবাসী দুজন নগরপিতা পেয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্নটি অনেকে করার চেষ্টা করেন, তা হচ্ছে এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কতটুকু শক্তিশালী হলো? এটা সত্য, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, আবার এটাও সত্য, নির্বাচনে মাত্র ১৫ থেকে ১৭ ভাগ ভোট পেয়ে যারা ‘বিজয়ী’ হলেন, তাদের পেছনে পুরো জনগোষ্ঠীর সমর্থন নেই। এতে করে গণতান্ত্রিক চর্চার ত্রুটিটিই সামনে চলে এলো। শুধু তাই নয়, দৈনিক দেশ রূপান্তরের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিতর্কিতরাও নির্বাচনে কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন (৪ ফেব্রুয়ারি)। এটাও গণতান্ত্রিক চর্চার একটা খারাপ দিক। ভারতের মতো দেশেও জাতীয় পর্যায়ে দাগি আসামি, খুনি ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসেন। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাসিনোবিরোধী একটি অভিযান ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। দেখা গেছে, নির্বাচিত অনেক কাউন্সিলর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ওইসব বিতর্কিত ব্যক্তি যখন রাজনৈতিক মদদপুষ্ট হয়ে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন, তখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির কালো দিকটাই উন্মোচিত হয়। সরকারি দল তাদের মনোনয়ন না দিলেও পারত। আমাদের সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে, ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ এখন এই নির্বাচনের মাধ্যমে ‘জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত হয়েছে বটে, কিন্তু গণতন্ত্রের যে মূল স্পিরিট ‘একটি আস্থার সম্পর্ক’ তা নিশ্চিত হয়নি। গণতন্ত্রে বলা হয়, কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস, অর্থাৎ পরস্পরের প্রতি বিশ^াস ও আস্থা স্থাপন করার নামই গণতন্ত্র। কিন্তু ঢাকা সিটি করপোরেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্বাচনে সেই আস্থার সম্পর্ক কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? নির্বাচনের পরের দিন বিএনপির হরতাল ডাকা প্রমাণ করে, সেই আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর পর বিএনপি আবার হরতালের ‘রাজনীতি’তে ফিরে গেল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ ধরনের হরতালের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো যায় না। একটি ভালো নির্বাচন হয়নি, এটা সত্য কথা। কিন্তু হরতাল ডেকে বিএনপি কি খুব বেশি কিছু অর্জন করতে পারল?



একটি নির্বাচন হয়েছে। এই নির্বাচনের প্রথম পয়েন্ট হচ্ছে এটি অংশীদারত্বমূলক হয়েছে। অর্থাৎ বড় দলগুলো সবাই অংশগ্রহণ করেছে। বিশেষ করে ‘রাজপথের বিরোধী দল’ বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। দ্বিতীয় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো সহিংসতা হয়নি। খুনখারাবির ঘটনাও তেমন ঘটেনি। তৃতীয় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, বড় দলগুলো নির্বাচনে প্রচারণা চালাতে পেরেছে। কোনো ধরনের বাধা দেওয়া হয়নি। চতুর্থ প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, নির্বাচনের পর বিএনপি কোনো সহিংস রাজনীতি উসকে দেয়নি। কিন্তু মাইনাস পয়েন্ট বোধ করি অনেক। ভোটকেন্দ্রে ইভিএম মেশিন ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এটা বিতর্ক বাড়িয়েছে। অনেক ভোটার ভোট দিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন। তাদের কারও কারও ক্ষেত্রে অন্যরা ভোট দিয়েছেন, এমন খবর কাগজে ছাপা হয়েছে। গোপন কক্ষে সরকারি দলের কর্মীদের দেখা গেছে, তারা ভোটারদের নৌকা মার্কায় ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, কিংবা নিজেরাই ভোটারদের আঙুলের ছাপ নৌকা মার্কায় ‘পুশ’ করেছেন এসব পত্রিকার খবর। খোদ সিইসির আঙুলের ছাপ ইভিএম মেশিন শনাক্ত করতে পারেনি। ড. কামাল হোসেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন ওঠা কি স্বাভাবিক নয় যে, শতকরা একশত ভাগ নিশ্চিত না হয়ে ইসি ইভিএম মেশিন ব্যবহারের সিদ্ধান্তটি কেন নিল? তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? দ্বিতীয়ত, একজন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের অনেক বক্ত ব্য ইসির সভায় তিনি আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। ইভিএম মেশিন ব্যবহার (শতকরা ১০০ ভাগ) করা বা না করার প্রশ্নটিও ছিল। কিন্তু তাকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি বলে তিনি গণমাধ্যমে অভিযোগ করেছিলেন! অপর একজন কমিশনারও বলেছিলেন, ‘ভোটকেন্দ্র দখলে থাকলে’ ‘ইভিএম’ কারচুপি করা সম্ভব! সংবাদপত্রে একটি খবর বেরিয়েছিল, কিছুদিন আগে ইভিএমে কারচুপি করা সম্ভব কি না তা তদন্ত করে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ওই কমিটিতে থেকেও, তদন্ত কমিটির রিপোর্টে তিনি স্বাক্ষর করেননি। একজন সাংবাদিক এই তথ্যটি টিভি সংলাপে দিয়েছেন। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে ইভিএম নিয়ে শঙ্কা ছিল। তাহলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এত বড় ঝুঁকি কেন নিলেন? অভিযোগ আছে, ভারতে যে ইভিএম মেশিন ব্যবহৃত হয়, তার চেয়ে ১১ গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করে এই মেশিনগুলো কেনা হয়েছিল। এর পেছনে কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল?



তৃতীয়ত, একাধিক সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, একাধিক ওয়ার্ডে ফল পাল্টানোর অভিযোগ। একাধিক সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন যে, ইসির দায়িত্বপ্রাপ্তরা এই প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। এ ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা দক্ষিণের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের ফল ঘোষণা স্থগিত রাখা হয়েছে। এ ধরনের অভিযোগে এটাই প্রমাণ করে যে, ইভিএম মেশিন ব্যবহার করার পরও ফল পাল্টানো সম্ভব! চতুর্থত, একজন কমিশনার মাহবুব তালুকদার অভিযোগ করেছেন যে, তিনি যে কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন, সেই কেন্দ্রে তিনি কোনো বিএনপির এজেন্ট দেখতে পাননি। সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে যে, প্রায় সব কেন্দ্রে বিএনপিদলীয় প্রার্থীর কোনো এজেন্ট ছিল না। এর ব্যাখ্যা কী? বিএনপির প্রার্থী কি ইচ্ছে করেই তার কোনো এজেন্ট দেননি? বাকি এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি? বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগে করা হয়েছে যে, তাদের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। ইসির উচিত এ ধরনের অভিযোগের তদন্ত করা। এটা কোনো ‘পরিকল্পনার’ অংশ কি না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কেননা, সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে ‘ভেতরে-বাইরে শুধুই আওয়ামী লীগ’। এই তথ্যই কি প্রমাণ করে না যে, ‘পরিকল্পিতভাবে ভোটকেন্দ্রগুলো’ সরকারি দলের সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল? পঞ্চমত, এই নির্বাচন কি প্রমাণ করে ভোটে এক ধরনের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে? বিএনপির সমর্থকদের কথা না হয় বাদই দিলাম, আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সংখ্যা তো কম নয়। তাহলে মাত্র শতকরা ১৫-১৭ ভাগ ভোট পড়বে (প্রথম আলো) কেন? নানা দৃষ্টিকোণ থেকে এটা বিশ্লেষণ করা যেত পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে মানুষ ভোট দেওয়ার ব্যাপারে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ‘ভোট দিলে কিংবা না দিলেও রেজাল্ট একই হবে!’ আমি অনেক সাধারণ মানুষের মুখ থেকে এ ধরনের কথা শুনেছি। নিঃসন্দেহে এটা ভোট সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। ষষ্ঠত, একটি সংবাদপত্র ভোটে কম উপস্থিতির জন্য ছয়টি কারণ দেখিয়েছে। এগুলো হচ্ছে, ধারাবাহিকভাবে নির্বাচন হওয়া, ভোটের আগেই ভয়ভীতি দেখানো, সন্ত্রাসীদের উপস্থিতির আশঙ্কা নিয়ে নীতিবাচক প্রচারণা, ভোটকেন্দ্রের মুখে জটলা, ভোটের আগেই রেজাল্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা এবং ইভিএম নিয়ে আশঙ্কা। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের আগে এ ধরনের আশঙ্কা দূর করতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেননি। উপরন্তু সিইসির বক্তব্য কখনো-সখনো মনে হয়েছে, তিনি সরকারি চাকরিজীবীর মতো আচরণ করছেন! তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও তিনি অভিযোগগুলোর ব্যাপারে সঠিক কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। একজন ‘বৈরী’ কমিশনার মাহবুব তালুকদার মাঝেমধ্যে বক্তব্য দিয়ে একটা ‘আশঙ্কা’ তৈরি করেছিলেন। সিইসির উচিত ছিল তার ওইসব বক্তব্য বিবেচনায় নেওয়া এবং এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কিন্তু তা তিনি করেননি। জনপ্রিয় সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্টের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট সর্বশেষ গণতন্ত্র সূচকে বিশ^ব্যাপী গণতন্ত্রের বিকাশের ধারায় বাংলাদেশের অবস্থান (১৬৭ দেশের মধ্যে) দেখিয়েছিল ৮০ নম্বরে। বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছিল ‘হাইব্রিড, ডেমোক্রেসি’ ক্যাটাগরিতে (ইকোনমিস্ট, ২২ জানুয়ারি ২০২০) । ‘হাইব্রিড’ অর্থ অসম্পূর্ণ এবং ত্রুটিপূর্ণ। অর্থাৎ বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। এই মন্তব্যের সঙ্গে হয়তো অনেকেই একমত হবেন না। এখানে গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু তাকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বলা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, এ প্রশ্ন আছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে ঢাকার সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ইসি অনেকটা দায়সারা দায়িত্ব পালন করেছে। আমি অবাক হয়ে যাই যখন দেখি ইসি সচিব বক্তব্য দেন এভাবেÑ ‘ঘরে বসে ফেইসবুক চালানোয় ভোটকেন্দ্রে যাননি অনেকে’ (নিউজবাইবিডি)। জানি না তিনি এভাবে কথাটা বলেছিলেন কি না? একজন মন্ত্রীর ‘পোলাও-কোর্মা’ খাওয়ার কথাও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। আবার তথ্যমন্ত্রীও বলেছেন, ‘অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে।’ অতীত নির্বাচনগুলোতে ঢাকায় ভোটারের উপস্থিতির হার কি বেশি ছিল না? এ পরিসংখ্যান তো আমাদের কাছে আছে। তাহলে অতীতের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে কম ভোট পড়ে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে কি আমরা সুষ্ঠু বলতে পারব? আসল কথা হয়েছে, নিয়মমাফিক একটি নির্বাচন হয়েছে। সব দল অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু নির্বাচনটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। তবে ওবায়দুল কাদের একটি সত্য কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভোটের প্রতি মানুষের অনীহা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়’ (বাংলা ট্রিবিউন, ৪ ফেব্রুয়ারি) । এটাই হচ্ছে আসল কথা। ভোটের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেছে। ভোট উৎসবমুখর হয় এটা এখন অতীত। ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে হবে কবে উৎসবমুখর পরিবেশে এ দেশে নির্বাচন হয়েছিল। আমি ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে চাই। মানুষ ভোটের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এই আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব যেমনি রয়েছে, তেমনি রয়েছে নির্বাচন কমিশনের এবং দলগুলোর মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস যদি গড়ে না ওঠে, তাহলে ভবিষ্যতেও এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা হব। সিটি করপোরেশনের নির্বাচন তাই আমাদের জন্য একটি ‘ওয়েক-আপ’ কল
Daily Desh Rupantor
9.2.2020

0 comments:

Post a Comment