রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

যে শঙ্কা বড় হয়ে উঠল

উপজেলা নির্বাচনে দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে ২৭ ফেব্র“য়ারি ২০১৪ তারিখে। কিন্তু ব্যাপক অনিয়ম, সহিংসতা, কেন্দ্র দখল আর জাল ভোট প্রদানের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হওয়া এই ভোটগ্রহণ যেসব শঙ্কা বড় করে তুলল এর মধ্যে মুখ্য হলো, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন আদৌ সম্ভব নয়। যারা অনলাইন সংবাদপত্রের পাঠক, তারা দেখেছেন বাংলানিউজ ২৪.কমের একটি ছবি, যেখানে (মুন্সীগঞ্জ) সরকারি দলের সমর্থকরা দল বেঁধে ভোট কেন্দ্র দখল করছে। ২৮ তারিখের সংবাদপত্রেও আছে সে ছবি। ভোট কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয় ভূমিকা প্রমাণ করে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনও সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ থাকল না। যদিও বরাবরের মতো নির্বাচন কমিশন বলেছে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে! নির্বাচন কমিশনের এই বক্তব্য খণ্ডন করেছেন সাবেক এক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন ও সুজনের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ।’ বলেছেন, ‘শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন না থাকলে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তা উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আরো একবার প্রমাণিত হলো।’ আর বদিউল আলম মজুমদার বললেন, ‘দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তা আরো একবার প্রমাণিত হলো।’ গত ১৯ ফেব্র“য়ারির প্রথম পর্যায়ের নির্বাচন হয়েছিল ৯৭ উপজেলায়। কিন্তু বেশক’টি ভোট কেন্দ্রে সহিংসতার কারণে নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়েছিল। তাতে অবশ্য ফলাফলের ওপর কোনো প্রভাব পড়েনি। প্রথম পর্যায়ের উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হয়েছিল ৩৪টি আসনে। বিএনপি পেয়েছিল ৪৪ আসনে। জামায়াত পেয়েছিল ১২ আসন। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে সহিংসতা, কেন্দ্র দখল আর জাল ভোটের পরিমাণ ছিল বেশি। তারপরও দেখা গেছে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছেন। বেসরকারিভাবে ১১১ আসনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন ৫০টিতে। আর আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা বিজয়ী হয়েছেন ৪৬টিতে। এবারো জামায়াত বিজয়ী হয়েছে ৮টিতে। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় জনসংহতি সমিতির সদস্যরা (সন্তু লারমা) বিজয়ী হয়েছে এককভাবে। এদের মোট বিজয়ী প্রার্থীর সংখ্যা ৭ (জেপি, জনসংহতি ও স্বতন্ত্র বিদ্রোহী প্রার্থীসহ)।প্রথম পর্যায়ের উপজেলা নির্বাচন হয়েছিল গত ১৯ ফেব্র“য়ারি ২০১৪ তারিখে। আরো চার পর্যায়ে এই নির্বাচন সম্পন্ন হবে। শেষ হবে মার্চের শেষ সপ্তাহে। মোট ৪৮৭টি উপজেলার নির্বাচন সম্পন্ন হবে আগামী মার্চের শেষ সপ্তাহের মধ্যে। যদিও উপজেলা নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনকে মেলানো যাবে না, কিন্তু উপজেলা নির্বাচনের গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে উপজেলা নির্বাচন এমন একটি স্তর, যেখান থেকে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি হয়। বাংলাদেশেও জাতীয় পর্যায়ে এমন অনেক নেতা আছেন, যারা উপজেলা থেকে উঠে এসেছেন। স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচনে তারা বিজয়ী হয়ে ধীরে ধীরে জাতীয় পর্যায়ে এসেছেন। মন্ত্রীও হয়েছেন কেউ কেউ। যদিও বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অতীতে এই নির্বাচনকে কখনোই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়নি। ১৯৮২ সালে এরশাদীয় জমানায় দেশে উপজেলা অধ্যাদেশ বলে এই উপজেলা পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। এরশাদের আমলে দু’বার উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। একবার ১৯৮৫ সালে আর দ্বিতীয়বার ১৯৯০ সালে। ১৯৯১ সালে বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করার দীর্ঘদিন পর। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারের সময়ও (১৯৯৬-২০০১) উপজেলা নির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হয়নি। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (ডিসেম্বর) এক মাসের মাথায় শেষবারের মতো উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, যে প্রত্যাশা নিয়ে উপজেলা আইন সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। নানা কারণে ওই উপজেলা পরিষদ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। একটা প্রধান সমস্যা হলো উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্যের দ্বন্দ্ব। দু’জনই জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, কার ক্ষমতা কতটুকু, এই দ্বন্দ্ব রয়ে গিয়েছিল। ফলে সত্যিকার অর্থে উপজেলা পরিষদ কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। আইনে নির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান থাকলেও বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেছে তাদের ক্ষমতা নির্ধারিত নেই এবং তিনি নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছেন না। ফলে কাগজে-কলমে উপজেলা পরিষদ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য একটা ভিত্তি হলেও এই সংস্কৃতি বিকশিত হয়নি। উপজেলা থেকে নেতৃত্ব তৈরি হয়নি এবং আগামীতেও হবে কি-না এ প্রশ্ন রয়ে গেছে। উপজেলা চেয়ারম্যানদের সরকারি অর্থে পাজেরো গাড়ি কিনে দিয়ে ও মাসে মাসে জ্বালানি এবং বেতন-ভাতা দিয়েও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির যে ভিত্তি তা গড়ে তোলা যায়নি।এখন উপজেলা পরিষদের যে নির্বাচন হয়ে গেল তার মূল্যায়ন আমরা কিভাবে করব? প্রথমত, এটাও অনেকটা আইনগত বাধ্যবাধকতা ছিল। অনেক উপজেলা চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সুতরাং নতুন উপজেলা চেয়ারম্যানের নির্বাচন প্রয়োজন ছিল। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনে একটি ফলাফল বেসরকারিভাবে পাওয়া গেছে। দুই পর্যায়ের নির্বাচনেই বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। এতে একটা ধারণা করা স্বাভাবিক যে, স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির ভিত্তি অনেক শক্তিশালী। সুতরাং এটা বিবেচনায় নিতে হবে। তৃতীয়ত, এই নির্বাচন আবারো প্রমাণ করল বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে তো বটেই, স্থানীয় পর্যায়ে এই দুই দলের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। যদিও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনকে মেলানো যাবে না। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ে এই দল দুটির গণভিত্তি অনেক শক্তিশালী। আর এই গণভিত্তিই জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়। চতুর্থত, যেহেতু এই নির্বাচন প্রমাণ করেছে বিএনপিকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন প্রক্রিয়া চিন্তা করা যাবে না, সেহেতু এই উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলকে ধারণ করে একাদশ সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। পঞ্চমত, উপজেলা নির্বাচন বিএনপি বয়কট করেনি। এর অর্থ পরিষ্কার। বিএনপি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় থাকতে চায়। অর্থাৎ জাতীয় পর্যায়ের যে সংসদ নির্বাচন, এ ব্যাপারে বিএনপি একটি মেসেজ দিল যে, তারা এখনো জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সিরিয়াস। ষষ্ঠ, এই নির্বাচন প্রমাণ করল স্থানীয় পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামীরও একটা অবস্থান রয়েছে। জামায়াতের প্রার্থীরা বিএনপির সমর্থন নিয়ে একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে অন্য দলের সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়েছেন। সব ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেও জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীদের বিজয়কে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সপ্তম, উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের ভরাডুবি প্রমাণ করল জাতীয় পার্টির সাম্প্রতিক ভূমিকায় স্থানীয় পর্যায়ের কর্মীরা অসন্তুষ্ট। এটা জাতীয় পার্টির জন্য একটি মেসেজও বটে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় একটি শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টি বিকশিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালের পর থেকে ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের ফলাফল যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলেও এ সত্যটাই প্রমাণ করবে যে, জাতীয় পার্টি বাংলাদেশে তৃতীয় পার্টি। যদিও এর প্রায় পুরোটারই কৃতিত্ব ব্যক্তি এরশাদের। বাহ্যত বৃহত্তর উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক এই দলটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্যক্তি এরশাদের কারণে। এর বাইরে জাতীয় পার্টি কিছুটা হলেও তার প্রভাব বাড়িয়েছিল, এটা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যা ঘটল তা এই পার্টির জন্য কোনো ‘শুভ’ সংবাদ বয়ে আনেনি। একদিকে সরকারে থাকা আবার বিরোধী দলেও থাকা, এই রাজনীতি মানুষ গ্রহণ করে নেয়নি। উপজেলা নির্বাচন এর বড় প্রমাণ। অষ্টম, উপজেলা নির্বাচনেও সহিংস ঘটনা ঘটেছে। তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো এত ব্যাপকতা ছিল না। এখানে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা ছিল চোখে পড়ার মতো। নির্বাচন কমিশন সহিংসতা রোধের ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যেসব জায়গায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় সহিংসতা হয়েছে, সেসব জায়গাতেই উপজেলা নির্বাচনের সময় সহিংসতা বেশি হয়েছে। সুতরাং নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল নির্বাচনের পূর্বে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তা তারা করেনি। নবম, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ব্লেম গেম’ অর্থাৎ পরস্পরকে দোষারোপ করার যে ‘রাজনীতি’ তা উপজেলা নির্বাচনেও প্রতিফলিত হয়েছে। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের পর পরই বিএনপির মুখপাত্র বিভিন্ন কেন্দ্রে জাল ভোট দেয়া, কেন্দ্র দখল ইত্যাদি ঘটনার জন্য সরকারি দল তথা প্রশাসনযন্ত্রকে দায়ী করেছেন। ঠিক তেমনি প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা প্রথম দফা নির্বাচনের পর অভিযোগ করে বলেছিলেন, ‘বিএনপি মিথ্যা কথার জাল বুনছে।’ বিএনপির অভিযোগের পেছনে সত্যতা যে নেই, তা কিন্তু বলা যাবে না। ২০ ফেব্র“য়ারি একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় একটি ছবি ছাপা হয়েছিল। তাতে দেখা গেছে নির্বাচনের দায়িত্বে নিযুক্ত একজন কর্মকর্তা ব্যালট পেপারে সিল মারছেন। এর কোনো ব্যাখ্যা নির্বাচন কমিশন থেকে দেয়া হয়নি। আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি এই দোষারোপের রাজনীতি যদি আমরা পরিত্যাগ করতে না পারি, তাহলে আমরা গণতন্ত্রকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না। দ্বিতীয় পর্যায়ের উপজেলা নির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে। মার্চেই তৃতীয় ও চতুর্থ দফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমার ধারণা পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াই দুটি বড় দলের মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ থাকবে। নিঃসন্দেহে এটাও আমাদের নীতি-নির্ধারকদের কাছে একটা মেসেজ পৌঁছে দেবে। তবে এই ফলাফল থেকে তারা কতটুকু কী ধারণ করবেন সেটা ভিন্ন একটা প্রশ্ন। ভোটারবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আমরা সহিংসতা লক্ষ্য করেছি। একই ধারাবাহিকতায় দু’পর্বের উপজেলা নির্বাচনেও আমরা সহিংসতা দেখলাম। ভোটকেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান, নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়ভাবে পুরো ভোটদান প্রক্রিয়াকে আমরা প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিলাম। ভোটাধিকার প্রক্রিয়া একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু ভোট কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদানের যে চিত্র আমরা দেখলাম যে কোনো বিবেচনায় তা অগ্রহণযোগ্য। এই সহিংসতা গণতন্ত্রের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা এখন ঝুঁকির মুখে থাকল। আগামীতে শিক্ষিত তরুণ প্রজšে§র রাজনীতিতে আসার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল তারা এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য এটাও কোনো ভালো খবর নয়। সম্প্রতি নিউইয়র্কের ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় যারা অত্যন্ত প্রভাবশালী, তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু যে দেশটি এখন বিশ্বের কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি মডেল (শান্তি রক্ষায় অংশগ্রহণ, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, দারিদ্র্যসীমা কমিয়ে আনা, এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ইত্যাদি), সেই দেশটির সব উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা এখন প্রশ্নের মুখে পড়ল। আমাদের নেতারা এখন পর্যন্ত ব্যর্থ একটা সমঝোতায় আসতে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাকে উপেক্ষা করে একদলীয় নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের বক্তব্যকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। তাদের বাংলাদেশের ব্যাপারে ‘গৃহযুদ্ধের’ মূল্যায়ন আমাদের সব অর্জনকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে। বিদেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা জন্ম দিতে পারে। এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে গত ২ জানুয়ারি। ঠিক তার একদিন পর বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) বার্ষিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। বিএমবিএস বলেছে, ২০১৩ সালে দেশজুড়ে যে সহিংসতা হয়েছে তাতে মারা গেছেন ৫৭৩ জন সাধারণ মানুষ, যার মাঝে পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। আর আহতদের সংখ্যা ১০ হাজার ৪০৩ জন। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এভাবে মানুষ মারা যাবে, এটা অকল্পনীয়। ‘গৃহযুদ্ধের’ ধারণা যারা দেন, তারা এই পরিসংখ্যানকে এখন ইস্যু করতে পারেন। অনেকেই এখন জানেন ওই নির্বাচনে ১৫৩ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। শতকরা ৫২ ভাগ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদের এটা ছিল পরিপন্থী, যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর (১৯৯১) মাধ্যমে এই শব্দগুলো সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়। আমাদের সবার মাঝে একটা ধারণা রয়েছে যে, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব। কিন্তু সহিংসতা রোধে ব্যর্থতা এবং বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এত বিপুলসংখ্যক প্রার্থীর বিজয় প্রমাণ করল নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ। তাদের এই ব্যর্থতার প্রশ্নটিই তুলেছেন সাবেক এক নির্বাচন কমিশনার। বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে সরকারের প্রভাবের বাইরে কাজ করতে পারে না তা আরো একবার প্রমাণিত হলো। একাধিক ক্ষেত্রে ইসির ব্যর্থতা চোখে পড়ার মতো। সরকারের চাপ উপেক্ষা করে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা কমিশনের সফলতা হিসেবেই বিবেচিত হয়। কিন্তু সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবি না জানিয়ে ইসি বিতর্কিত হয়েছিল। কমিশন ২৮ জুলাই (২০১৩) নিজের ক্ষমতা খর্ব করার লক্ষ্যে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে প্রার্থিতা বাতিল সম্পর্কিত আরপিওর ৯১ (ই) ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও পরে প্রতিবাদের মুখে ইসি সরে আসে। মিথ্যা হলফনামা দিয়ে কেউ নির্বাচিত হলে সেই নির্বাচন বাতিল, নির্বাচনে কারচুপি হলে ফলাফল স্থগিত ও বাতিল করার ক্ষমতা ইসির নেই। নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে না, এটা যদি ইসির কাছে প্রতীয়মান হয়, তাহলেও ওই নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতাও ইসির নেই। আর্থিক ব্যাপারগুলোতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সম্পূর্ণ অবমুক্ত করার দাবিরও কোনো সমাধান হয়নি। এর মধ্য দিয়ে সরকারের প্রভাব বিস্তার করার একটা সুযোগ থেকে গেল। সুতরাং ইসির বর্তমান কাঠামোয় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা যে সম্ভব নয়, তা আবারো প্রমাণিত হলো।উপজেলা নির্বাচন দিয়ে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনকে বিবেচনা করা যাবে না এটা সত্য। কিন্তু একটা মেসেজ অন্তত আমাদের সবাইকে দিয়ে গেল আর তা হচ্ছে সংসদীয় রাজনীতিতে এই মুহূর্তে বিএনপি না থাকলেও বিএনপি একটি শক্তি। স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি। সুতরাং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করতে হলে বিএনপিকে আস্থায় নিতে হবে। আর দায়িত্বটি নিতে হবে সরকারপ্রধানকেই। দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচন সম্পন্ন হলো বটে, কিন্তু অচিরেই আমরা দেখব বড় ধরনের একটি সংকট। অর্থাৎ নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে (যেখানে বিএনপি বিজয়ী হয়েছে) স্থানীয় সংসদ সদস্যের দ্বন্দ্ব। সংসদে বিএনপি নেই। ফলে বিএনপির নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানরা কোনো সুযোগ-সুবিধা পাবেন না এটা ধারণা করা যায়। স্থানীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হবে। সুতরাং উপজেলা নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। একই সঙ্গে নতুন করে জাগল শঙ্কাও। Daily Manob Kontho 04.03.14

0 comments:

Post a Comment