রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ও আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা

গেল সপ্তাহে তিস্তা নিয়ে অনেক সংবাদ ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। দুটি উদ্বেগের খবর আমরা জেনেছি পত্রপত্রিকা থেকে। প্রথমটিতে বলা হয়েছে, যেখানে তিস্তায় পাঁচ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা, সেখানে পাওয়া গেছে মাত্র ৫০০ কিউসেক। ফলে তিস্তা ব্যারাজ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২ উপজেলার ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টরে যে বোরো আবাদ হয়, সেচের অভাবে তা এখন মরতে বসেছে। কেননা কৃষকরা সেচের জন্য পানি পাচ্ছে না। দ্বিতীয় উদ্বেগের বিষয়টি হচ্ছে তিস্তা থেকে আরো পানি সরিয়ে নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। এ খবর দিয়েছে ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া, যার সূত্র ধরে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় খবরটি ছাপা হয়েছে গত ১৩ মার্চ। সংবাদে বলা হয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতের উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কাছে তারা সেচের পানি পৌঁছে দেবে। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ও আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে যে আদৌ কোনো চুক্তি হচ্ছে না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। সদ্য সমাপ্ত বিমসটেকের নেপিডো সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এটা স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। এমনকি সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের ৫৭তম বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়নি। বলার অপেক্ষা রাখে না, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণেই এই চুক্তি হচ্ছে না এবং ভবিষ্যতে যে হবে, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কেননা ভারতে ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে যে একটি দুর্বল সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, তাদের পক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উপেক্ষা করে কোনো চুক্তি করা সম্ভব নয়। নির্বাচনী জরিপের ফলাফল যদি সত্যি হয়, তাহলে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার ক্ষমতা হারাচ্ছে! এ ক্ষেত্রে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের ক্ষমতা পাওয়ার একটি সম্ভাবনা, কিংবা মমতা-জয়ললিতার নেতৃত্বাধীন একটি তৃতীয় জোটের (ফেডারেলিস্ট ফ্রন্ট) নেতৃত্বে একটি দুর্বল সরকার যদি ক্ষমতা পায়, তাহলে তিস্তা চুক্তির সম্ভাবনা যে 'ডিপ ফ্রিজে' চলে যাবে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ক্ষেত্রে তাই যে প্রশ্নটি চলে আসে, তা হচ্ছে বাংলাদেশের করণীয় তাহলে কী? এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টি হালকাভাবে দেখেন, তাহলে এ দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে, এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এতে বাড়বে। মনে রাখতে হবে, তিস্তায় পানিপ্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকারকে নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তি- এটা আমাদের বিষয় নয়। আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় এক হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টনে ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ, ৩৯ শতাংশ ভারত ও ২৫ শতাংশ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরবর্তী সময়ে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ শতাংশ দুই দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ শতাংশ নদীর জন্য রেখে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখন যুক্ত হয়েছে মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরো একটা বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানি বণ্টনে সিকিমকে জড়িত করারও প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিন দিন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচকাজের জন্য তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা মমতার জন্য একটি 'রাজনৈতিক ইস্যু'। তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীসমূহ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এখন পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানি সম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এই 'যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তি'টি উপেক্ষিত থাকে যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিপ নীতিমালার ২ নম্বর নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ 'জলপ্রবাহ কনভেনশন' নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এই নীতিমালার ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে 'যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার' কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার, অর্থাৎ এককভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এই 'যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা'র ধারণাকে সমর্থন করে না। আমরা আরো আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশসংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ, জলাভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীসমূহের সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমন কিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই। তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ এখন মরুকরণের ঝুঁকির মুখে থাকল। আমাদের একটা বড় দুর্বলতা হচ্ছে দরকষাকষিতে আমরা কোনো শক্ত অবস্থানে যেতে পারি না। আমাদের যে পানি বিশেষজ্ঞ নেই, তা নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাঁদের শক্ত অবস্থানে যেতে দেখা যায়নি। অতি সম্প্রতি শেষ হয়েছে যৌথ নদী কমিশনের ৫৭তম অধিবেশন। ভারতের সঙ্গে যৌথ কমিশনের বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার প্রশ্নে শক্ত অবস্থান নিয়েছে, তেমনটি জানা যায় না। সুতরাং একটা প্রশ্ন থেকেই গেল, ভারত একদিকে তিস্তার পানি বণ্টনের আশ্বাস দেবে, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গকে সুযোগ করে দেবে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ার, তখন বাংলাদেশ কী করবে? এটা এখন স্পষ্ট যে মে মাসের শেষ সপ্তাহে সেখানে যে সরকারই গঠিত হোক না কেন, তিস্তার পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে কোনো বড় উদ্যোগ নেবে না। বিজেপি যদি এককভাবে সরকার গঠন করতে না পারে, সরকার গঠন করার জন্য তাদের নির্ভর করতে হবে আঞ্চলিক দলগুলোর ওপর। এ ক্ষেত্রে মমতা যে আবার বিজেপি বলয়ে ফিরে যাবে না, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। অতীতে তো মমতা বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকারে রেলমন্ত্রী হয়েছিলেন। মমতা কংগ্রেসের সঙ্গেও হাত মিলিয়েছিলেন। আবার ফিরেও এসেছিলেন। ভারতের রাজনীতির 'মোস্ট আনপ্রেডিকটেবল ক্যারেকটার' হচ্ছেন এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে বিশ্বাস করা যায় না। মমতার আদি পুরুষের বাড়ি যশোরে। তিনি যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন সব প্রটোকল ভেঙে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ফোন করে তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের প্রতি এতটুকু শ্রদ্ধা দেখাননি মমতা। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার (মনমোহন সরকার) তিস্তার পানি বণ্টনে একটি চুক্তি করতে চাইলেও শুধু মমতার আপত্তির কারণে ওই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। এমনকি বাংলাদেশে মহাজোট সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলকাতায় গিয়েও মমতাকে রাজি করাতে পারেননি। আমাদের ভারতমুখী পররাষ্ট্রনীতির একটা বড় ব্যর্থতা হচ্ছে তিস্তার পানি বণ্টনসহ বেশ কিছু ইস্যুতে আমরা স্বার্থ আদায় করে নিতে পারিনি। তাই বোধকরি সময় এসেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরশীল না হয়ে আন্তর্জাতিক আসরে তিস্তার পানি বণ্টনের সমস্যাটি তুলে ধরা। Daily KALERKONTHO 25.03.14

0 comments:

Post a Comment