রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

থাইল্যান্ডে গণতন্ত্র কেন মুখ থুবড়ে পড়ল

শেষ পর্যন্ত থাইল্যান্ডে সামরিক অভ্যুত্থানই হল। দেশটির চলমান সংকট কাটাতে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল প্রাইউথ সান-ওসার উদ্যোগে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যকার আলোচনা যখন ব্যর্থ হয়, তখন সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। একই সঙ্গে সংবিধান স্থগিত করা হয় এবং সেনাপ্রধান নিজেকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন। গত ৬ মাস ধরে সেখানে সংকট চলে আসছে। এ সংকট আরও গভীর হয় যখন ৭ মে দেশটির সাংবিধানিক আদালত প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রাকে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে বরখাস্ত করে।মূলত সংকটের শুরু ২০১৩ সালের অক্টোবরে, যখন ইংলাকের বড় ভাই ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার দায়মুক্তির বিল সংসদে উপস্থাপন করা হয়। এ বিল নিয়ে দেশে বড় বিতর্কের জন্ম হয়। নভেম্বরে সংসদের নিুকক্ষে দায়মুক্তি বিলটি পাস হলেও উচ্চকক্ষে বিলটি প্রত্যাখ্যাত হয়। দায়মুক্তি বিলের প্রতিবাদে ব্যাংককে লক্ষাধিক লোকের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। সেই থেকে থাইল্যান্ডে দিনের পর দিন বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল। এমনকি বিক্ষোভকারীরা শহরের রাস্তাঘাট দখল করে অবস্থান করে আসছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই ফেব্র“য়ারিতে (২০১৪) প্রধানমন্ত্রী ইংলাক একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের ঘোষণা দেন। কিন্তু তা বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এখানে বলা ভালো, ২ ফেব্র“য়ারি (২০১৩) থাইল্যান্ডে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ক্ষমতাসীন পুয়ে থাই পার্টি বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় থেকে গিয়েছিল। প্রধান বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টি ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল।যারা থাইল্যান্ডের রাজনীতির কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৈরিতা ও দ্বন্দ্ব বারবার সেনাবাহিনীকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে। ইতিহাস বলে, ১৯৩২ সালে থাইল্যান্ডে প্রথম সেনা অভ্যুত্থান হয়েছিল। আর সর্বশেষ (১১তম) সেনা অভ্যুত্থান হয় ২০০৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। তবে এই সেনা অভ্যুত্থান একটি ভিন্ন মাত্রা দিয়েছিল। সাবেক জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার সরকারের বিরুদ্ধে সেনাপ্রধান জেনারেল সোনধি বুজিয়ারাতসিনন ওই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। অতীতে দেখা গেছে, সেনানায়করা রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে নিজেরা ক্ষমতায় থাকার জন্য একটি দল গঠন করেন। কিন্তু সোনধি তা করেননি। তিনি একটি নির্বাচনের আয়োজন করেন। কিন্তু নির্বাচন সেখানে কোনো রাজনৈতিক সমাধান বয়ে আনতে পারেনি। ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং যার তত্ত্বাবধান করেন জেনারেল সোনধি, তাতে বিজয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন সামাক সুন্দারাভেজ। কিন্তু তিনি বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হননি। তিনি পদত্যাগ করেন। তার পরিবর্তে পরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন সোমচাই ওয়াংসোয়াত। সুন্দরাভেজের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি সিনাওয়াত্রার খুব ঘনিষ্ঠ। তিনি দায়িত্ব নিলে প্রায় ৩ মাস ধরে বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবন দখলসহ সরকার উৎখাতের আন্দোলন করে আসছিল। এর নেতৃত্বে ছিল ডেমোক্রেটিক পার্টি। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেও বিক্ষোভ দমন করতে পারেননি। ওই সময় সেনা অভ্যুত্থানের একটি সম্ভাবনার জন্ম হলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। তবে সেনাপ্রধানের চাপে প্রধানমন্ত্রী সোমচাই ওয়াংসোয়াত পদত্যাগ করেছিলেন এবং বিরোধী দলের নেতা অভিজিত ভেজাজিভার নেতৃত্বে সেখানে একটি সরকার গঠিত হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি কখনও। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০০৬ সালের সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সিনাওয়াত্রার থাই রক থাই পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। কিন্তু সিনাওয়াত্রার সমর্থকরা পিপলস পাওয়ার পার্টি (পিপিপি) গঠন করে ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল এবং বিজয়ী হয়েছিল। ওই নির্বাচনে ৪৮০টি আসনের মাঝে পিপিপি ২৩২টি আসন পেয়েছিল। পিপিপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও তারা একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছিল। পিপিপি যেহেতু জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছিল, সেহেতু তাদের টার্ম পূরণ করতে দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। নির্বাচনের এক বছর পরই শুরু হয়েছিল সরকার উৎখাতের আন্দোলন। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন- সাংবিধানিক আদালত প্রধানমন্ত্রী সুন্দারাভেজকেও অযোগ্য ঘোষণা করেছিল। পরে ইংলাককেও অযোগ্য ঘোষণা করে এ আদালত।থাইল্যান্ডের রাজনীতি এখন কার্যত দুভাগে ভাগ হয়ে আছে। একদিকে রয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিনাওয়াত্রার সমর্থকরা, যারা রেডশার্টধারী হিসেবে পরিচিত। থাকসিন সিনাওয়াত্রার দল থাই রক থাই পার্টি নিষিদ্ধ হলে তার সমর্থকরা পিপলস পাওয়ার পার্টির ব্যানারে আত্মপ্রকাশ করে। পরে তারা ইংলাক সিনাওয়াত্রার নেতৃত্বে গঠন করে পুয়ে থাই পার্টি। এরা লালশার্ট পরিধান করে বিধায় তাদের আন্দোলনকে রেডশার্ট আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যদিকে সিনাওয়াত্রাবিরোধীরা ইয়েলো শার্টের ব্যানারে সংগঠিত, যে কারণে তারা ইয়েলো শার্ট আন্দোলনকারী হিসেবে পরিচিত। এভাবেই থাইল্যান্ডের রাজনীতি লাল আর হলুদ শার্টের মাঝে ভাগ হয়ে আছে। ইংলাক রেডশার্ট আন্দোলনকারীদের উসকে দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন। এটা সত্য, জনগণের ভোটে তিনি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিলেন। কিন্তু অভিযোগ ছিল, ভাইয়ের (থাকসিন সিনাওয়াত্রা) ছত্রছায়ায় তিনি ক্ষমতা পরিচালনা করে গেছেন। থাকসিন সিনাওয়াত্রা থাইল্যান্ডের শীর্ষ ধনীদের একজন। তবে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। তার দেশে আসাও নিষিদ্ধ। ফলে ইংলাক যখন ভাইকে দায়মুক্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে একটি বিল সংসদে আনেন, তখন তা বিতর্কের জন্ম দেয়। এটা স্পষ্ট, অত্যন্ত ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী এ দায়মুক্তির বিরোধী। থাকসিন সিনাওয়াত্রার সঙ্গেও সেনাবাহিনীর সম্পর্ক ভালো নয়।২০০৬ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর একাধিকবার সেনা অভ্যুত্থানের সম্ভাবনার জন্ম হলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি এবং সেনাবাহিনী ক্ষমতাও ধরে রাখেনি। সম্ভবত সেনা নেতৃত্ব এটা বোঝেন যে, সেনা অভ্যুত্থান আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই প্রচণ্ড চাপের মুখে থেকেও সেনাবাহিনী ক্ষমতা ধরে রাখেনি। তারা সরকার পরিবর্তন করিয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু ক্ষমতায় যায়নি। এখন ২০১৪ সালে এসে জেনারেল প্রাইউথ সান-ওসার ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। কারণ থাইল্যান্ডে সেনা অভ্যুত্থান এবং দীর্ঘদিন তাদের ক্ষমতায় থাকার ইতিহাস রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ থেকে আশির দশকে পৃথিবীর অনেক দেশে (আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য) সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে এবং কোথাও কোথাও সেনাশাসকরা যথেষ্ট জনপ্রিয়ও হয়েছিলেন (তুরস্কে মুস্তাফা কামাল, মিসরে নাসের, আর্জেন্টিনায় পেরেন)। নব্বইয়ের দশকের পর থেকে এ প্রবণতা কমতে থাকে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে এর কোনো সমর্থনও নেই।থাইল্যান্ডে সেনাবাহিনী মূলত একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী হিসেবে গড়ে উঠেছে। ব্যবসা, আমদানি-রফতানির সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা (মিসরে এটা নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠানগতভাবে)। আর সম্ভবত সিনাওয়াত্রার সঙ্গে দ্বন্দ্বটা তখন থেকেই শুরু। কারণ টেলিকমিউনিকেশন খাতসহ বেশ কিছু খাতের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে সিনাওয়াত্রা পরিবার। ফলে সিনাওয়াত্রা ও তার বোন ইংলাক কখনোই সেনাবাহিনীর কাছে গ্রহণযোগ্য হননি। এখানে সিনাওয়াত্রার একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, তিনি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন। তার একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল। তিনি গ্রামের মানুষের কাছে জনপ্রিয়। তিনি সাধারণ মানুষের উন্নয়ন, ব্যাপক কর্মসংস্থান, জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছিলেন। ফলে তিনি নিষিদ্ধ হলেও তার সমর্থকদের (লালশার্ট আন্দোলন) সাধারণ মানুষ বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছিল। অন্যদিকে হলুদ শার্ট আন্দোলনকারীরা যারা ডেমোক্রেটিক পার্টির ব্যানারে সংগঠিত এবং যাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সখ্য রয়েছে বলে ধরা হয়, তারা মূলত অভিজাততন্ত্র, ধনী শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে। ফলে স্পষ্টতই থাই রাজনীতি দুধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে।এটা বলতে দ্বিধা নেই, সিনাওয়াত্রার আমলে থাইল্যান্ড যে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল, তা থমকে গেছে। গত ৭-৮ বছরের রাজনীতি পর্যালোচনা করলে কয়েকটি জিনিস লক্ষ্য করা যায়। এক. আইন অমান্য করার একটা প্রবণতা। যে সরকারই গঠিত হোক না কেন, তাকে অস্বীকার করা যেন একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। নির্বাচন হলেও সরকার তার পাঁচ বছরের টার্ম পূরণ করতে পারছে না। দুই. বিক্ষোভকারীরা সরকারি ভবন দখল করে, রাস্তায় দিনের পর দিন অবস্থান করে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার যে বাজে প্রবণতার জন্ম দিয়েছে, এটা থাই গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। তিন. সেনাবাহিনীর প্রতিটি অ্যাকশন সিনাওয়াত্রা সমর্থকদের বিরুদ্ধে গেছে। এতে করে একটা ধারণার জন্ম হওয়া স্বাভাবিক- সেনাবাহিনী সিনাওয়াত্রাবিরোধীদের সমর্থন করছে। চার. সেনাবাহিনী নিজেরা ক্ষমতা ধরে রাখতে চায় না। বিরোধীদের দমাতে চায়। পাঁচ. সিনাওয়াত্রা সমর্থক ও বিরোধীদের মাঝে যদি কোনো সমঝোতা না হয়, তাহলে রাজনৈতিক সংকট থেকে যাবেই। শুধু নির্বাচন দিয়ে এ সংকটের সমাধান করা যাবে না। তাই জেনারেল প্রাইউথের দিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের- তিনি একটি দল করবেন, নাকি নির্বাচন দিয়ে বিরোধী ডেমোক্রেটিক পার্টিকে ক্ষমতায নিয়ে আসবেন?
থাইল্যান্ডের সামরিক অভ্যুত্থান যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে সমালোচিত হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেছেন, এ অভ্যুত্থান গ্রহণযোগ্য নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নও এর সমালোচনা করেছে। থাইল্যান্ড আসিয়ানের সদস্য। আসিয়ান দেশগুলো থেকেও সমর্থন পাননি জেনারেল প্রাইউথ। উন্নয়নশীল বিশ্বে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির এটা একটা বড় সমস্যা। খুব কম ক্ষেত্রেই এ দেশগুলো সত্যিকার গণতন্ত্র চর্চা করছে। কোথাও কোথাও গণতন্ত্রের নামে একদলীয় তথা গোষ্ঠীতন্ত্র চালু হয়েছে। সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রের যে স্পিরিট, তা বিকশিত হচ্ছে না। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশেও মোদির বিজয়ের মধ্য দিয়ে দেখা গেল কর্পোরেট হাউসগুলো, মিডিয়া ও অর্থ পরিবর্তনের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে। মালয়েশিয়ার মতো দেশে তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে বিরোধীদের নিয়ন্ত্রিত করা হয়। কিংবা সিঙ্গাপুরের সংসদ পরিণত হয়েছে একদলীয় সংসদে, বিরোধী দলের কোনো অস্তিত্ব সেখানে নেই। আর বাংলাদেশ কিংবা থাইল্যান্ডের মতো দেশে সরকার আর বিরোধী দলের মাঝে পারস্পরিক বিশ্বাস আর আস্থার সম্পর্ক না থাকায় গণতন্ত্র এ দুটি দেশে সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারছে না। বর্তমানে থাইল্যান্ডের গণতন্ত্র একটা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। যতদিন পর্যন্ত না জেনারেল প্রাইউথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করবেন, ততদিন থাইল্যান্ডে কোনো বিনিয়োগ হবে না। আমদানি-রফতানিতে ভাটা আসবে। আর আন্তর্জাতিক আসরে থাইল্যান্ডকে থাকতে হবে কড়া চাপের মুখে। থাইল্যান্ডে গণতন্ত্রের বিকাশ যতটুকু না রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করে, ততটুকু সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করে না। সেনাবাহিনী নির্বাচন দেবে। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট ডেমোক্রেটিক পার্টি যদি বিজয়ী হয়ও (?), তারপরও সমস্যা থেকে যাবে। কেননা লালশার্ট আন্দোলনকারীদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। আপাতদৃষ্টিতে তৃতীয় কোনো শক্তিকেও দেখা যাচ্ছে না রাজনীতির ময়দানে। জেনারেল প্রাইউথ কোনো তৃতীয় শক্তিকে সমর্থন দিয়ে তাদের ক্ষমতায় নিয়ে আসবেন, তেমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ফলে থাইল্যান্ডের গণতন্ত্র নিয়ে একটা বড় প্রশ্ন থেকে গেল। সামরিক বাহিনী ইংলাক সিনাওয়াত্রা কিংবা বিরোধী দলের নেতা সুথেপ থাউগসুবানকে গ্রেফতার করলেও থাইল্যান্ডের পরিস্থিতি শান্ত হবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। Daily Jugantor ০১ জুন, ২০১৪

গণতন্ত্রের সংগ্রাম : দেশ থেকে দেশে

থাইল্যান্ডে সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র সেখানে যখন মুখ থুবড়ে পড়ল, তখন ভারতের মতো দেশে জনগণের ভোটে সরকার পরিবর্তন হল। তবে ভারতের এই গণতন্ত্র নিয়েও অনেক কথা আছে। ভারতের ৩৭ ভাগ মানুষ যেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, ৫৩ ভাগ মানুষের যেখানে টয়লেট সুবিধা নেই, সেখানে ভারতের লোকসভা ধনীদের কাবে পরিণত হয়েছে। বিজয়ী এমপিদের ৮৬ শতাংশ কোটিপতি। নির্বাচনে শুধু দলগুলোই খরচ করেছে ৩০ হাজার কোটি রুপি (প্রার্থীদের নিজস্ব খরচ আলাদা)। বিজেপির ২৮২ জন এমপির মাঝে একজনও মুসলমান এমপি নেই। জনসংখ্যার ১৮ ভাগ যেখানে মুসলমান সেখানে ৫৪৩ আসনের লোকসভায় মুসলমান এমপি মাত্র ২০ জন, অর্থাৎ মাত্র ৪ শতাংশ। আর নির্বাচিত এমপিদের ৩৪ শতাংশই দাগি আসামি। উপরন্তু ভারতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ভারতের গণতন্ত্রকে প্রশ্নের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। গণতন্ত্র নিয়ে সংকট আছে। ইউক্রেনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়ে গেল ২৫ মে। বিজয়ী হয়েছেন পেট্রোপোরোসেনকো। তার সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয় কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদী পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সে ব্যাপারেও আগ্রহ থাকবে অনেকের। ক্রিমিয়ার রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্তিতে তিনি আপত্তি জানিয়েছেন। সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপে গেল বছর দ্বিতীয় দফা ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং আবদুল্লাহ ইয়ামিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন আর ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট নাশিদ তা মেনে নিয়েছেন। গেল বছর পাকিস্তানে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং নওয়াজ শরিফ আরও একবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। একই সঙ্গে দুটো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনও সাধিত হয়েছে পাকিস্তানে। প্রধান বিচারপতি ও সেনাপ্রধান অবসরে গেছেন। প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরী নিয়মমাফিক অবসরে যাওয়ার পর তাসাদ্দুন হোসেন জিলানি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নিয়েছেন। আর জেনারেল কায়ানির টার্ম শেষ হয়ে যাওয়ার পর জেনারেল রাহিল শরিফ নয়া সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তবে চলতি বছর শরিফের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে তাহরিক-ই-তালিবানকে নিষ্ক্রিয় করা ও তাদের জঙ্গিবাদী তৎপরতা বন্ধ করা। মূলত তাহরিক-ই-তালিবান সীমান্তবর্তী থাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এ অঞ্চলে এখন ইমরান খানের দল তাহরিক-ই-ইনসাফ সরকার গঠন করেছে। ধারণা করা হয় ইমরান খানের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি দল হিসেবে পরিচিত তাহরিক-ই-তালিবানের একটা সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে সীমান্ত অঞ্চলে মার্কিন ড্রোনহামলা বন্ধ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শরিফ এ হামলা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানালেও তা রক্ষিত হয়নি। এটা খোদ নওয়াজ শরিফের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তানের জন্য একটা বড় খবর হল- একটা নির্বাচিত সরকার তার ৫ বছরের টার্ম পূরণ করেছে। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। ওবামা এই প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি এই প্রতিশ্রুতি কতটুকু রাখতে পারবেন, সেটা একটা প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে আফগানিস্তানের কারজাই সরকারের সঙ্গে একটা নিরাপত্তা চুক্তি করতে চাইলেও তা হয়নি। এক্ষেত্রে চলতি বছর আফগানিস্তানের দিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। জুন মাসে দ্বিতীয় দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। কারজাই আর তৃতীয়বারের মতো দাঁড়াতে না পারায় আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অনেকেরই ধারণা- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর একটা উপস্থিতি সেখানে থাকবেই। এক্ষেত্রে পাকিস্তানেও জঙ্গি তৎপরতা বাড়বে। পাকিস্তানের কথা শুধু নয়, খোদ নেপালও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নির্বাচন সম্পন্ন করল। এই দুটো দেশ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্পন্ন করে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। নেপালে মাওবাদীরা সাংবিধানিক পরিষদের নির্বাচনে ভালো ফল করেনি। তবে ভালো খবর হল, তারা শেষ পর্যন্ত সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছে এবং সংসদীয় কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে। কংগ্রেসের সুশীল কৈরালা এখন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী। তবে নেপালের বিকাশমান গণতন্ত্র এখন নির্ভর করে মাওবাদীদের ওপর। অতীতে গণতন্ত্রের বিকাশকে তারা বারবার ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছিল। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নেপালে মাওবাদীদের অস্ত্র ত্যাগ করা ও মূল ধারার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া নেপালের রাজনীতির জন্য একটা বড় খবর। নেপালে যে গণতন্ত্র বিকশিত হচ্ছে, তাতে নিঃসন্দেহে মাওবাদীরা একটি শক্তি। এখন নেপালের মাওবাদীদের মূল ধারায় ফিরে আসায়, ভারতের মাওবাদীদের তা কতটুকু উৎসাহিত করবে, সে প্রশ্ন আছে। ভারতের মাওবাদীরা কয়েকটি রাজ্যে বেশ সক্রিয়। গেল লোকসভা নির্বাচনও (২০১৪) তারা কোথাও কোথাও প- করার চেষ্টা করেছে। তবে সফল হয়নি। তবে একটা প্রবণতা আমি লক্ষ করেছি। আর তা হচ্ছে, মাওবাদীদের দু-একজন শীর্ষ নেতার এবার সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ (যেমন ঝাড়খ-ে)। তবে নেপালের মাওবাদীদের মতো তারা সফল হননি। লোকসভা নির্বাচনে তারা হেরে গেছেন। এখন মোদি সরকার যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলের দারিদ্র্য কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেন, তাহলে আমার ধারণা ভবিষ্যতে ভারতের মাওবাদী আন্দোলনে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। লোকসভা নির্বাচনে দেখা গেছে, একমাত্র ত্রিপুরা বাদে সর্বত্র (বিশেষ করে পশ্চিমবাংলায়) রাম সমর্থকদের ভোট কমেছে। ফলে সিপিআই পুনরায় বাম ঐক্যের ডাক দিয়েছে। ২০১৬ সালে সেখানে বিধানসভার নির্বাচন। মমতা ব্যানার্জির জনপ্রিয়তাকে চ্যালেঞ্জ করা তত সহজ হবে না। গেল বছর (২০১৩) ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজের মৃত্যু ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে হাসান রুহানীর অভিষেক আন্তর্জাতিক তথা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। দীর্ঘদিন ক্যানসারের সঙ্গে ‘যুদ্ধ’ করে এক সময় হেরে গেছেন হুগো শ্যাভেজ। তিনি যে ‘সমাজতন্ত্রের নতুন এক ধারা’ প্রবর্তন করেছিলেন তার মৃত্যুর পর সেটার স্থায়িত্ব কতটুকু থাকবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয় সে ব্যাপারেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভেনিজুয়েলা হবে একটি ‘টেস্ট কেস’। ইতোমধ্যেই সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন শুরু হয়েছে সেখানে। আর তাতে রয়েছে মার্কিনি ইন্ধন। আরব বিশ্বে আরব বসন্ত যে সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল, সে সম্ভাবনার এখন ‘মৃত্যু’ ঘটেছে। আরব বসন্ত সেখানকার দীর্ঘদিনের শাসকদের (তিউনিসিয়ায় জইন আবেদিন বেন আলী, মিসরে হোসনি মোবারক, ইয়েমেনে সালেহ, লিবিয়ায় গাদ্দাফি) ক্ষমতা থেকে উৎখাত করলেও সেখানে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেনি। উপরন্তু মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। তিউনিসিয়ায় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে। চলতি বছরে সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে ‘আরব বসন্ত’ পুরো আরব বিশ্বে জঙ্গিবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটিয়েছে। বিশেষ করে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ফলে সেখানে একটি বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে ইসলামিক জঙ্গিদের একটি কোয়ালিশন। লিবিয়ায়ও এরা শক্তিশালী। আর ইরাকে জঙ্গিদের তৎপরতা ইরাকের অস্তিত্বকে একটি বড় হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। সিরিয়ায় গেল বছর মার্কিন বিমানহামলা এড়ানো গেছে সত্য, কিন্তু যদি সেখানে কোনও সমঝোতা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বিমানহামলা হতে পারে। জেনেভা-২ আলোচনা জানুয়ারিতে শুরু হয়েছে। কিন্তু একটা প্রশ্নে কোনও সমাধান এখনও হয়নি- আর তা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট আসাদ ক্ষমতায় থাকবেন নাকি একটা নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পরিহার করবেন। জুন মাসের মাঝামাঝি সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনে তিনি আবারও প্রার্থী হয়েছেন। ফলে সমাধানের পথ বের হচ্ছে না। তাই জেনেভা-২ আলোচনার দিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। তবে চূড়ান্ত বিচারে এই আলোচনায় সিরীয় সরকারের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। কিন্তু তা কোনও ‘ফল’ বয়ে আনবে না- এমন আশঙ্কাই করা হচ্ছে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ নিয়ে আরও একটা ভয়- তা হচ্ছে প্রায় ৫৫ হাজার শরণার্থী বর্তমানে জর্ডানে আশ্রয় নিয়েছে। ওদের যদি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা না হয়, তাহলে এরা জর্ডানে অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে এবং সেখানকার সরকারের পতন ঘটাতে পারে। জাতিসংঘের এই শরণার্থীদের জন্য ৫ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার দরকার। দীর্ঘদিন জাতিসংঘের জন্য এই অর্থ ব্যয় বহন করাও সম্ভব নয়। তাই জেনেভা আলোচনায় কোনও ফল পাওয়া না গেলে সীমিত বিমানহামলার (লিবিয়ার মতো) সম্ভাবনা ২০১৪ সালে পড়বে। এর পাশাপাশি তুরস্কে কী পরিবর্তন আসে, সে ব্যাপারেও দৃষ্টি থাকবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের। আগস্টে সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই প্রথমবারের মতো সেখানে সরাসরি জনগণের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। সংবিধানে বাধ্যবাধকতার কারণে এরদোগান তিনবারের বেশি আর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। ধারণা করা হচ্ছে, এরদোগান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। তুরস্কের রাজনীতির উত্থান-পতনের সঙ্গে সিরিয়ার রাজনীতির একটা সম্পর্ক রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় স্বার্থ রয়েছে তুরস্কে। কেননা সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তনে (যা তুরস্কও চাইছে) তুরস্কের সমর্থন প্রয়োজন পশ্চিমা বিশ্বের। সুতরাং এ অঞ্চলের রাজনৈতিক উত্থানের ব্যাপারে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। সেই সঙ্গে পূর্ব চীন সাগরে উত্তেজনা কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (৯ জুলাই) দৃষ্টি পড়বে অনেকের। ব্রাজিলেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৫ অক্টোবর। ইতোমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। সংসদ সদস্যদের ভোটে জুমা পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এখানে পরিবর্তন এল না। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ নিয়েও প্রশ্ন আছে এখানে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের একটা ঢেউ বয়ে গিয়েছিল। প্রায় ২৩ বছর পর এসে দেখা গেল এই গণতন্ত্র সার্বিকভাবে বিকশিত হচ্ছে না। কোথাও কোথাও সরাসরি বিদেশি হস্তক্ষেপের (ইউক্রেনে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে উৎখাত। অভিযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে) অভিযোগ রয়েছে। কোথাও সামরিক বাহিনী তার স্বার্থ বজায় রাখার স্বার্থে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেছে (মিশর, থাইল্যান্ড)। গণতন্ত্রে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনের যে কথা বলা হয়, দেখা গেছে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সেই সম্পর্ক না থাকায় গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে (থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ)। গণতন্ত্র যে শুধু গোষ্ঠীতন্ত্রকে ক্ষমতায় বসায় না, গণতন্ত্র যে উন্নয়নকে গুরুত্ব দেয় এবং ভোটাররা যে তাতে আস্থা রাখে, আবার প্রমাণিত হল (ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া)। নতুন আঙ্গিকে এখন গণতন্ত্র বিকশিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক বিষয়াদি এখানে গুরুত্ব পাচ্ছে। সেই সঙ্গে করপোরেট হাউসগুলোর ভূমিকা, মিডিয়ার ভূমিকা (ভারত) উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতন্ত্রকে আজ নতুন এক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। খুব স্বাভাবিক কারণেই এই গণতন্ত্রের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের গণতন্ত্রকে মেলানো যাবে না।বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়েও প্রশ্ন আছে অনেক। আগামী বছর নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন বেগম জিয়া। মোজীনা ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগেও বললেন সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন। ভারতের নয়া সরকারের ভূমিকা এই মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। তবে দিল্লিতে কংগ্রেসি সরকারের মতো মোদি সরকার কোনও একটি ‘বিশেষ দলকে’ সমর্থন করবে না, এমনটাই ধারণা করা যায়। সর্বোপরি সুষমা স্বরাজের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে পারে। সারা বিশ্বেই গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে সংকট চলছে। বাংলাদেশেও এ ক্ষেত্রে পার্থক্য নেই। Daily AMADER SOMOY 29.05.14

ভারতের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়

গতকাল নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি ভারতের পঞ্চদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে মোদি নিজেকে নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী কিংবা নরসিমা রাও ও বাজপেয়ির নামের সঙ্গে নিজের নামটাও যুক্ত করলেন। ভারতের দীর্ঘ ৬৭ বছরের রাজনীতিতে কংগ্রেস এককভাবে ক্ষমতায় ছিল প্রায় ৫৪ বছর। এই ধারা ভেঙে নেহরু পরিবারকে চ্যালেঞ্জ করে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি দেখিয়ে দিয়েছেন, তিনি পারেন। সংগত কারণেই যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হচ্ছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে কী পরিবর্তন আসবে? যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের যে সখ্য, সেই বৃত্ত থেকে মোদি কী ভারতকে বের করে আনবেন? বলা ভালো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মোদির বিজয়ে তাঁকে শুভেচ্ছা জানালেও মোদি তাঁর টুইটার বার্তায় যাঁদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন, সেই তালিকায় ওবামার নাম একদম শেষের দিকে ছিল। মোদিকে ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এ ঘটনা মোটামুটি সবাই জানেন। এ ক্ষেত্রে মোদি কি যুক্তরাষ্ট্রকে এখন অস্বীকৃতি জানাবেন? নাকি দুই দেশের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্ককে অস্বীকার করতে পারবেন?
মনে রাখতে হবে, মোদি এমন একটা সময় দায়িত্ব নিয়েছেন, যখন দক্ষিণ এশিয়া তথা বিশ্ব রাজনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। ২০১৪ সালের শেষের দিকে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে এবং সেখানে একজন নয়া রাষ্ট্রপ্রধান দায়িত্ব নেবেন। এটা অনেকেই জানেন, ওবামা প্রশাসন চাচ্ছে ভারত ২০১৪ পরবর্তী আফগানিস্তানে একটা বড় ভূমিকা পালন করুক। এখন দেখতে হবে মোদি সরকার ইউপিএ সরকারের গৃহীত নীতি অনুসরণ করে কি না। আফগানিস্তানে প্রচুর ভারতীয় বিনিয়োগ রয়েছে (প্রায় ২০০ কোটি ডলার) বিশেষ করে অবকাঠামোগত উন্নয়নে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ভারতের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। এমনকি ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি দূরবর্তী ঘাঁটিও রয়েছে আফগানিস্তানে। দ্বিতীয় যেটি উদ্বেগের কারণ, তা হচ্ছে ভারত মহাসাগরে মার্কিন নৌসেনার উপস্থিতি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের ছয়টি জাহাজ আগামী ২০১৮-১৯ সালের মধ্যে ভারত মহাসাগরে মোতায়েন করা হবে। অভিযোগ আছে, এই মোতায়েনের পেছনে কাজ করছে মার্কিন দুরভিসন্ধি চীনকে ঘিরে ফেলা। এ ধরনের 'কর্মসূচিতে' মার্কিন নীতিনির্ধারকদের মোদি সরকারের সমর্থনের প্রয়োজন রয়েছে। তৃতীয়ত, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় ধরনের ব্যবসায়িক ও বিনিয়োগ সম্পর্ক রয়েছে। ওবামার ভারত সফরের পর এই বিনিয়োগ বেড়েছে। ভারতে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, তার আধুনিকায়নে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতে পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করে। অত্যাধুনিক বিমান ও সমরাস্ত্র ভারত কিনছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। ফলে এ সম্পর্কে 'ইউ টার্ন' নেওয়া মোদির পক্ষে সম্ভব হবে না। অগ্রাধিকার তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র কত নাম্বারে থাকবে- সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।

শপথ অনুষ্ঠানে সার্কভুক্ত দেশগুলোর নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে একটা বার্তা অন্তত তিনি দিতে চাচ্ছেন, আর তা হচ্ছে তাঁর বৈদেশিক নীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো গুরুত্ব পাবে বেশি। তবে সব সার্ক নেতা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী গেলেন জাপানে। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন সংসদের স্পিকার। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শরিফের আসাটাও একটা 'সিগন্যাল'। পাক-ভারত সম্পর্কের বরফ এখন কিভাবে গলবে, সেটা একটা প্রশ্ন হয়েই থাকল। ১৯৯৮ সালে বাজপেয়ি পাকিস্তান সফরে লাহোর গিয়েছিলেন, এটা স্মরণ করতে পারেন অনেকে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিতি খোদ নরেন্দ্র মোদির জন্য একটি 'রাজনৈতিক ঝুঁকি' থাকলেও মূলত শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের আগ্রহটা এখানে বেশি। শ্রীলঙ্কায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে জাতিসংঘে উত্থাপিত প্রস্তাবে শ্রীলঙ্কা ভারত সরকারের সমর্থন পায়নি। উপরন্তু তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে 'যুদ্ধ' ও 'গণহত্যার' জন্য তামিলনাড়ুতে রাজাপাকসেবিরোধী একটা জনমত রয়েছে। সেখানে ক্ষমতাসীন জয়ললিতার রাজ্য সরকার কিংবা বিরোধী ডিএমকে দল এই 'গণহত্যার' জন্য রাজাপাকসে সরকারকে অভিযুক্ত করে আসছে। এখন মোদির রাজাপাকসেকে আমন্ত্রণ খুব সংগত কারণেই দক্ষিণের রাজ্যগুলোর সঙ্গে, বিশেষ করে তামিলনাড়ুর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে পারে। জয়ললিতা ও মমতা শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যাননি। তবে গেছেন সোনিয়া ও রাহুল। বিদায়ী আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বোরিং লিওনচেন, নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কৈরালা, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের উপস্থিতি প্রমাণ করে এ দেশগুলো ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। ভারত এখন বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। ২০৩০ সাল নাগাদ দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে পারে দেশটি। ফলে এ অঞ্চলের উন্নয়নে ভারত যে একটা বড় ভূমিকা নিতে চায়, মোদি সেটা আবারও নিশ্চিত করলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মোদি কি সার্ককে গুরুত্ব দেবেন, নাকি নয়া অর্থনৈতিক জোট বা করিডর বিসিআইএমকে (বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার) বেশি গুরুত্ব দেবেন, এটা একটা বড় প্রশ্ন। সার্ক কার্যত একটি কাগুজে সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এর কারণও মূলত ভারত। ভারতের দ্বিপক্ষীয় রাজনীতি ও সার্ক ফোরামে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ আলোচনার সুযোগ না থাকা কিংবা ভারতের এক ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য সার্কের বিকাশের পথে প্রধান অন্তরায়। অন্যদিকে মোদির বিসিআইএমের ব্যাপারে আগ্রহ থাকবে নানা কারণে। প্রথমত, এর মাধ্যমে চীন, বিশেষ করে চীনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে। চীনা বিশ্লেষকরা কেউ কেউ মোদিকে 'ভারতের নিঙ্ন' হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করছেন। নিঙ্ন ১৯৭২ সালে প্রথমবারের মতো চীন সফর করে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছিলেন। এখন মোদিকে তারা 'চীনের বন্ধু' এবং চীনা বিনিয়োগের জন্য সহায়ক বলে মনে করছেন। চীন ভারতে টেলিযোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করেছে। চীন ভারতে 'বুলেট ট্রেন' চালুরও প্রস্তাব করেছে। দ্বিতীয়ত, চীন কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চায়। এতে চীনেরও স্বার্থ রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে চীন কুনমিংকে (ইউনান প্রদেশের রাজধানী) সমুদ্রপথে 'কানেক্ট' করতে পারবে। অর্থাৎ ইউনান প্রদেশ এই সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে (সাংহাই বন্দর ব্যবহার না করে) তাদের আমদানি-রপ্তানি বাড়াতে পারবে। এতে সময় ও অর্থ বাঁচবে অনেক। এই গভীর সমুদ্রবন্দর একবার হয়ে গেলে ভারতও এ থেকে সুবিধা নিতে পারবে। সাত বোন রাজ্যের পণ্য এ পথে আসা-যাওয়া করবে। এ-সংক্রান্ত একটি প্রাথমিক চুক্তি ইতিমধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে। তৃতীয়ত, এই মুহূর্তে ভারতের টার্গেট হচ্ছে আসিয়ানের পূর্ণ সদস্য হওয়া। সেই সঙ্গে ইস্ট-এশিয়া সামিটে নিজেকে জড়িত করা। ভারত ইতিমধ্যে আসিয়ানের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ভবিষ্যতে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে যে বিশাল শুল্কমুক্ত বাজার সৃষ্টি হচ্ছে, ভারতের টার্গেট হচ্ছে এই বিশাল বাজারে তার পণ্য নিয়ে প্রবেশ করা। বিসিআইএমএ ভারতের সংযুক্তি আসিয়ানে যাওয়ার পথকে আরো প্রশস্ত করবে।
মোদির শপথ অনুষ্ঠানে ওবামা তাঁর কোনো প্রতিনিধি পাঠাননি; যদিও প্রটোকল অনুযায়ী ওবামা মোদিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একটি কৌশলগত চুক্তিতে আবদ্ধ থাকলেও ক্রিমিয়া ইস্যুতে ভারত রাশিয়ার পক্ষাবলম্বন করেছে। চীনের অবস্থানও ছিল এই শিবিরে। ভারতের কুদাকুলামে ১৯৮৯ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির অধীনে রাশিয়া দুটি পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ করেছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাশিয়া আরো দুটি পারমাণবিক চুল্লি তৈরি করছে। ফলে ভারত-রাশিয়া মৈত্রী চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন থাকবে অনেক। মোদি এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন বলেও মনে হয় না। তবে মোদি ভারতের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেবেন। ফলে সংগত কারণেই অর্থনৈতিক কূটনীতি গুরুত্ব পাবে বেশি। 'ব্রিকস'-এর পাশাপাশি চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে তিনি অগ্রাধিকার দেবেন বেশি। দিল্লি-মুম্বাই অর্থনৈতিক করিডর সৃষ্টিতে জাপানের বিনিয়োগ প্রায় চার বিলিয়ন ডলার। চীনের বিনিয়োগও প্রচুর। চীন-ভারত বাণিজ্য আগের চেয়ে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ধারণা করছি, মোদি জমানায় ভারতে চীনের বিনিয়োগ আরো বাড়বে। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান হবে না। যাঁরা মোদিকে ভোট দিয়েছেন, সেই ভোটারদের ৫০ শতাংশের বয়স ২৫ বছরের নিচে। এঁদের চাকরি দরকার। তাই মোদিকে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে তার বৈদেশিক নীতির 'অ্যাপ্রোচ'-এ চীন, জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়া অগ্রাধিকার পাবে বেশি। বাংলাদেশ তার আগ্রহের তালিকায় থাকবে না।
মোদির একটি 'অ্যাপ্রোচ' হচ্ছে 'কম সরকার, অনেক বেশি প্রশাসন'। কাজপাগল মানুষ তিনি। গুজরাটকে তিনি একটি শিল্পোন্নত ও উন্নত রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। যদিও এটা সত্য, শিল্পায়ন করতে গিয়ে তিনি সামাজিক খাতগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেননি। তিনি মাথাভারী প্রশাসনে কখনো বিশ্বাস করতেন না। এখন মন্ত্রিসভা গঠনের মধ্য দিয়ে তাঁর 'কম সরকারের' ধারণার প্রতিফলন ঘটল। মন্ত্রিসভার ধরন দেখে এটা বোঝা যায়, তিনি মন্ত্রিসভার ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ রাখতে চান। ইচ্ছে করলে তিনি শুধু বিজেপি সরকার করতে পারতেন। কিন্তু শরিকদেরও তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পিকারের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে বাংলাদেশ মোদিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারতে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, বাংলাদেশের জন্য তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে ভারতের যেমন স্বার্থ রয়েছে, ঠিক তেমনি ভারতেও বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে। গত ২৩ মে বাংলাদেশের প্রায় সব পত্রিকায়ই একটা খবর বেরিয়েছে, ওই খবরে বলা হয়েছে, মোদি তাঁর প্রথম বিদেশ সফরে বাংলাদেশে আসতে পারেন এবং মোদির বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে তিস্তা পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে! দিল্লির একটি দৈনিক পত্রিকা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এ ধরনের একটি সংবাদ পরিবেশন করেছে, যা ঢাকায় একটি অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে সর্বত্র পরিবেশিত হয়েছে। এই সংবাদটির পেছনে সত্যতা যে এতটুকু নেই, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় এখন। তবে বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে মোদি সরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপ উপেক্ষা করে যদি ভবিষ্যতে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করার কোনো উদ্যোগ নেয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি বাংলাদেশের মানুষের সমর্থন ও ভালোবাসা পাবেন। কিন্তু তথাকথিত 'বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের' ঠেকাতে পৃথক একটি দপ্তর গঠন করার নির্দেশ দিয়ে তিনি দুই দেশের মধ্যে একটা আস্থার সংকট সৃষ্টি করলেন। তবে এ বিষয়টি যতটা না বাস্তবসম্মত, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। অর্থাৎ তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটা চাপে রাখতে চান। তাঁর টার্গেট বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মোদি নয়াদিল্লিতে দায়িত্ব নিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনীতিতে শুরু হলো নতুন একটি অধ্যায়।
Daily Kalerkontho
২৮ মে ২০১৪
28 May, 2014

মোদি কি শেষ কথাটা বলে ফেলেছেন

ভারতের নয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কি আসল কথাটি বলে ফেলেছেন? ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে বিজয় এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার আগেই ২০ মে তিনি তথাকথিত 'বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের' ঠেকাতে পৃথক একটি দফতর গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি এরই মধ্যে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সরকার গঠনের আমন্ত্রণ পেয়েছেন বটে; কিন্তু শপথ নেবেন ২৬ মে। কিন্তু এর আগেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিবকে ডেকে তথাকথিত 'বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের' নিয়ে একটি 'সুপ্রিন্ট' তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছেন। একটি পৃথক দফতর করার কথাও তিনি বলেছেন, যাদের কাজ হবে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরায় 'অনুপ্রবেশ' ঠেকানো! কলকাতার দৈনিক বর্তমান এ সংবাদটি পরিবেশন করেছে। এ সংবাদটি যে খোদ কলকাতাতেই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। কেননা নির্বাচনের আগে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এ ধরনের বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এমনকি তিনি প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিয়েছিলেন। এখন ক্ষমতা নেয়ার আগেই মোদি এ ধরনের একটি নির্দেশ দিলেন। এর ফলে একদিকে পশ্চিম বাংলার সঙ্গে কেন্দ্রের সম্পর্কের যেমন অবনতি ঘটবে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি হতে বাধ্য। তবে খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য আমরা এখন অব্দি পাইনি। প্রতিক্রিয়া না পাওয়ারই কথা। কেননা ভারতে কোনো বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী রয়েছে- এরকম তথ্য যেমন বাংলাদেশ সরকারের কাছে নেই, ঠিক তেমনি নেই ভারত সরকারের কাছেও। তাহলে 'বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী' চিহ্নিত হবে কীভাবে? আমরা অতীতেও দেখেছি, বাংলা ভাষাভাষীদের বাংলাদেশী হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশে পুশব্যাক করার একটি উদ্যোগ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নিয়েছিল, যা বড় বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলের মানুষ পশ্চিমবঙ্গে যান। সেখানে তাদের আত্মীয়স্বজন রয়েছেন। ১৯৪৭-পরবর্তী সময়ে অনেকে সেখানে চলে গেছেন স্থায়ীভাবে। তারা অনেক আগেই ভারতীয় নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন। তিন-চার পুরুষ ধরে তারা সেখানে বসবাস করছেন। তাদের এখন বাংলাদেশী হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে কোন যুক্তিতে? মোদি যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন, তা হচ্ছে উন্নয়ন। তার দৃষ্টি এখন এদিকে থাকা উচিত। মোদি নিঃসন্দেহে একটি ইমেজ তৈরি করতে পেরেছেন। আর তার ইমেজটি হচ্ছে তিনি সারা ভারতে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেবেন। গুজরাটে যেভাবে তিনি উন্নয়ন ঘটিয়েছেন, ঠিক একইভাবে তিনি ভারতের সর্বত্র উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেবেন। কিন্তু এতে করে কতটুকু তিনি সফল হবেন, এ প্রশ্ন আছে। কেননা এক গুজরাটকে দিয়ে সারা ভারতবর্ষকে বিচার করা যাবে না। গুজরাটের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি আর উড়িষ্যা কিংবা ঝাড়খন্ডের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি এক নয়। ভারতের দরিদ্রতা একটা বড় সমস্যা। ২০১০ সালে দরিদ্রতা যেখানে ছিল ২৭.৫০ ভাগ, এখন তা বেড়েছে ৩৭.০২ ভাগে (২০১০)। ২০১৪ সালের রিপোর্ট নিলে দেখা যাবে, এ সংখ্যা আরও বেড়েছে। প্রতি বছর বয়স ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৮ দশমিক ৩ লাখ শিশু মারা যায়। উত্তর প্রদেশে আর মধ্য প্রদেশে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি ১ হাজারে ৯১ ও ৯২টি শিশু। ভারত বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় অর্থনীতি। আগামী ৩০ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশে পরিণত হলেও ভারতে ৫৩ ভাগ মানুষের কোনো টয়লেট সুবিধা নেই। যেখানে-সেখানে রাস্তাঘাটে তারা মূত্র পরিত্যাগ করে। অথচ ৫৩ ভাগ মানুষের হাতে রয়েছে মোবাইল ফোন, ৪৭ ভাগ মানুষের রয়েছে টিভি, ৯ ভাগ মানুষের রয়েছে কম্পিউটার। শতকরা ৩৯ ভাগ মানুষের কোনো পাকঘর নেই। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন আনার কাজটি খুব সহজ নয়। মোদি কতটুকু সফল হবেন, এ প্রশ্ন থাকবেই। একটি ক্ষুদ্র পরিসরে তিনি গুজরাটের অবকাঠামোতে পরিবর্তন এনে গুজরাটের উন্নয়ন সাধন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু বৃহত্তর ভারতের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অত সহজ নয়। উপরন্তু ভারতে রাজ্যের সংখ্যা এখন ২৯টি। প্রতিটি রাজ্যেই বলা যেতে পারে আঞ্চলিক শক্তিগুলো ক্ষমতা পরিচালনা করছে। এসব দলের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক যে ভালো, তা বলা যাবে না। মোদি বিজয়ী হলেও তার সমস্যা এখন অনেক। উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় (আসন ২৫০), কংগ্রেস তথা ইউপিএর জোটের আসন ৮২। এনডিএ জোটের রয়েছে ৬১ আসন। কংগ্রেসের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় তাদের সমর্থন না পেলে তিনি কোনো বিল পাস করাতে পারবেন না। তাই কংগ্রেসের সঙ্গে তাকে সহাবস্থানে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক দল তথা বিজেপিবিরোধী (মোট ১২ রাজ্য) রাজ্যগুলো কেন্দ্রের বিরোধিতা করলে তিনি উন্নয়নের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। মুসলমানরা এক ধরনের আতঙ্কের মাঝে আছেন। তাদের আশ্বস্ত করতে হবে। এমন আইন তৈরি করার উদ্যোগ তিনি নেবেন না, যাতে মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কংগ্রেসের পরাজয় ঘটেছে। নিঃসন্দেহে এর পেছনে কারণ রয়েছে। তবে রাহুল গান্ধীর জন্য এটা একটা বড় পরাজয়। তিনি পারলেন না। তিনি তার দাদির মতো (ইন্দিরা গান্ধী) আবার কি 'লাইম লাইটে' ফিরে আসতে পারবেন? ১৯৭৭ সালে ক্ষমতা হারানো ইন্দিরা গান্ধী ফিরে এসেছিলেন ১৯৮০ সালে। তবে কংগ্রেস এখন রাহুলের পরিবর্তে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকেও নেতৃত্বের সারিতে নিয়ে আসতে পারে। ভারতের মানুষ পরিবর্তন চেয়েছে। আর ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়েই এ পরিবর্তনটুকু সাধিত হলো। কিন্তু মোদি যদি হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তাকে বিতর্কিত করবে মাত্র। রাহুল গান্ধী ও সোনিয়া গান্ধী পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। এটাই গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে ভোটাররা যদি কোনো দলকে নির্বাচনে পরিত্যাগ করে, দলের নেতারা তখন সরে দাঁড়ান। কারণ তারা মনে করেন, জনগণ তাদের প্রণীত নীতি গ্রহণ করেনি। তাই সোনিয়া-রাহুল সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দল তা গ্রহণ করেনি। এর অর্থ নেতৃত্ব সারিতে তারা থেকে যাচ্ছেন। কংগ্রেসের কাছে নেহেরু পরিবারের বাইরে কোনো বিকল্প নেই। মানুষ বারে বারে নেহেরু-গান্ধী পরিবারের ওপর আস্থা রেখেছে। মাঝখানে অতীতে কংগ্রেস ক্ষমতা হারিয়েও আবার ফিরে এসেছে। ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। ভারতের দীর্ঘ ৬৬ বছরের রাজনীতিতে কংগ্রেস এককভাবেই ক্ষমতায় ছিল প্রায় ৫৪ বছর। এ ৫৪ বছরের মাঝে নেহেরু পরিবারের তিন প্রজন্ম ক্ষমতায় ছিলেন। নেহেরু নিজে, কন্যা ইন্দিরা গান্ধী, নাতি রাজীব গান্ধী। নেহেরু ক্ষমতায় ছিলেন ১৬ বছর ২৮৬ দিন। ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় ছিলেন দু'বার, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭, আবার ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪, নিজ দেহরক্ষীদের হাতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। প্রথমবার ছিলেন ১১ বছর ৫৯ দিন, আর দ্বিতীয়বার ৪ বছর ২৯১ দিন। আর রাজীব গান্ধী ছিলেন ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত। এর বাইরে কংগ্রেসের পক্ষ হয়ে ক্ষমতা পরিচালনা করে গেছেন (প্রধানমন্ত্রী) তিনজন। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র ১ বছর ২১৬ দিন (১৯৬৪-১৯৬৬ জানুয়ারি)। আর তামিল টাইগারদের হাতে রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর হঠাৎ করেই ক্ষমতা পান নরসীমা রাও (১৯৯১-এর ২১ জুন থেকে ১৯৯৬ সালের ১৬ মে)। এরপর নেহেরু পরিবারের বাইরে তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন মনমোহন সিং ২০০৪ সালের ২২ মে। মোদির ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, ১০ বছর, দুই টার্ম। আবার নেহেরু-গান্ধী পরিবারের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার একটি সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু রাহুল গান্ধী ব্যর্থ হলেন। তবে নেহেরু-গান্ধী পরিবার ছাড়া যে কংগ্রেসের কোনো বিকল্প নেই, সেটা আবারও প্রমাণিত হলো। কংগ্রেসের বাইরে জনতা দল একবার (১৯৮৯), এর আগে জনতা পার্টি (১৯৭৭) এবং বিজেপি (১৯৯৬, ১৩ দিন, ১৯৯৮, ৫ বছর) ক্ষমতা পরিচালনা করেছে। তবে নিঃসন্দেহে এবারের বিজেপির সঙ্গে আগের বিজেপির তুলনা করা যাবে না। এবারের বিজেপি অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক। তাই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী কিংবা খালেদা জিয়ার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার পরও প্রশ্ন থাকবে অনেক বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেকের। বাংলাদেশের অনেকেই মনে করেন, বিগত কংগ্রেস সরকার ঢাকার আওয়ামী লীগ সরকারকে গুরুত্ব দিয়েছিল বেশি। এখন বিজেপি সরকার কোনো দলকে নয়, বরং রাষ্ট্র পর্যায়ে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেবে বেশি। এক কথায়, যেটা বলা যায়, তা হচ্ছে ভারতের পররাষ্ট্র নীতি পরিচালিত হয় তার জাতীয় স্বার্থের আলোকে। ফলে নয়া সরকার তাদের জাতীয় স্বার্থের আলোকেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পরিচালনা করবে। তাই সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ মুহূর্তে যা স্পষ্ট, তা হচ্ছে তিস্তার পানিবণ্টনের চুক্তিটি এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে গেল। কেননা মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে কোনো ধরনের বিবাদে যাবে না কেন্দ্র। ছিটমহল বিনিময়ের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। অতীতে বিজেপি এর বিরোধিতা করেছিল। ফলে ২০১১ সালে ঢাকায় একটি চুক্তি স্বাক্ষর, কংগ্রেসের কেবিনেটে তা অনুমোদন ও পরে ভারতীয় সংবিধান সংশোধনের জন্য তা রাজ্য সভায় উত্থাপিত হলেও বিজেপির আপত্তির কারণে তা ঝুলে গেছে। সংবিধান সংশোধন করা যায়নি। এখন বিজেপি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেবে, তা মনে হয় না। এরই মধ্যে আসামের নির্বাচিত বিজেপির সংসদ সদস্য সর্বনন্দ সোনোওয়াল জানিয়ে দিয়েছেন, বিজেপি ছিটমহল বিনিময় করবে না। বলা ভালো, ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের কথা। বাংলাদেশের ৭১১০ একর জমি ফেরত পাওয়ার কথা, যার একটা বড় অংশ আসামে। তাই আসাম সংসদ সদস্যের বিরোধিতা বোঝা যায়। মোদি অনেক কথা বলেছেন। ওটা ছিল নির্বাচনী স্টান্টবাজি। ভোট পাওয়ার জন্য তিনি এটা ব্যবহার করেছেন। এখন ক্ষমতায় যাওয়া একজন প্রধানমন্ত্রী মোদির জন্য বিষয়টা অত সহজ হবে না। বাংলাদেশে ভারতের বড় স্বার্থ রয়েছে। ভারতের সাতবোন রাজ্যের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতা তার দরকার। উপরন্তু দারিদ্র্যবিমোচন ও উন্নয়নকে গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে 'বিদ্যুৎ কানেকটিভিটি' তার দরকার। সাতবোন রাজ্যের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ তিনি দারিদ্র্যপীড়িত বিহারে নেবেন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। সুতরাং বাংলাদেশকে তার আস্থায় নিতে হবে। অহেতুক 'অনুপ্রবেশকারী' বক্তব্য তুলে তিনি দু'দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে একটি প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিয়েছেন। তবে সত্যিকার অর্থে তিনি যদি উন্নয়নকে এখন অগ্রাধিকার দেন, তাহলে তাকে বাংলাদেশকেও সঙ্গে নিতে হবে। দ্বিপাক্ষিক নয়, বরং বহুপাক্ষিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তিনি বাংলাদেশেও সমান জনপ্রিয় হবেন। এজন্য তিনি চার দেশীয় (ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান) একটি পানি ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে পারেন। যাতে করে একদিকে তিনি বাংলাদেশের পানি সমস্যার সমাধান, অন্যদিকে দেশটির বিদ্যুৎ ঘাটতি কমানোরও উদ্যোগ নিতে পারেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে একটা বড় অন্তরায় হচ্ছে সে দেশের ব্যুরোক্রেসি। ভারতের ব্যুরোক্রেসি বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে না। এখন একজন দক্ষ প্রশাসক নরেন্দ্র মোদির কাছে ব্যুরোক্রেসি কতটুকু সুবিধা করতে পারবে-এটাই দেখার বিষয়। আমার ধারণা, সারা ভারতকে একটি 'গুজরাট মডেল' (বিশাল বড় রাস্তা ও সেইসঙ্গে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিল্পায়ন, বিনিয়োগ, বিদ্যুৎ) এ পরিণত করার যে প্রতিশ্রুতি মোদি দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করতে হলে তার বাংলাদেশকে সঙ্গে নিতে হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তো অভিনন্দন বার্তায় জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশ হচ্ছে তার (মোদির) 'দ্বিতীয় বাড়ি'। এই 'দ্বিতীয় বাড়ি'র ধারণা মোদি হয়তো গ্রহণ করবেন না। তবে অতীতে ইউপিএ সরকার যেভাবে একটি বিশেষ দলকে 'প্রমোট' করত, মোদি বা তার উপদেষ্টারা এ কাজটি করবেন না। ফলে মোদির পররাষ্ট্র নীতিতে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার তালিকায় তেমন একটা থাকবে না। রাষ্ট্র পর্যায়ে যে সম্পর্ক থাকে, সেরকম সম্পর্কই থাকবে। বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো বিশেষ আগ্রহ থাকবে না মোদি সরকারের। যেমনটি ইউপিএ সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে রাখত। বলতে দ্বিধা নেই, এ সম্পর্ক অনেকটা একপক্ষীয় হয়ে গিয়েছিল। ভারতের পাল্লাটা ছিল ভারি, বাংলাদেশ পেয়েছে কম। কোনো একটি ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ তার 'প্রত্যাশা' পূরণ করতে পারেনি। এখন দেখতে হবে মোদি সরকারও তার পূর্বসূরি ইউপিএ সরকারের মতো আচরণ করে কিনা। মোদি তার শপথ অনুষ্ঠানে সার্কভুক্ত দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়ে অন্তত একটি মেসেজ দিতে চেয়েছেন-তা হচ্ছে তিনি সার্কভুক্ত দেশগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এখন দেখতে হবে তার পররাষ্ট্র নীতিতে এর কতটুকু প্রতিফলন ঘটে। বাংলাদেশের সঙ্গে বিরাজমান সমস্যার একটা সুষ্ঠু সমাধান, পাকিস্তানের সঙ্গে সন্ত্রাস দমন নিয়ে যে বিতর্ক তার অবসান কিংবা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে একটা আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি উদ্যোগ যদি মোদি নেন, তাহলে দিব্যি দিয়েই বলা যায়, আমরা আগামীতে নতুন এক দক্ষিণ এশিয়াকে দেখতে পাব। ভারতের উন্নয়নে একটি শক্তিশালী দক্ষিণ এশিয়া খুবই প্রয়োজন। কিন্তু ভারত যদি দক্ষিণ এশিয়ায় তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখে, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে মাত্র। সেক্ষেত্রে মোদির উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। মোদি দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। তার এই দায়িত্ব গ্রহণকে আমরা স্বাগত জানাই। Daily ALOKITO BANGLADESH ২৬ মে, ২০১৪

উন্নয়নশীল বিশ্বের 'পপুলিজম' আর মোদির বিজয়

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি ২৬ মে শপথ নেবেন। নরেন্দ্র মোদির এই বিজয়কে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? শুধু 'হিন্দুত্ববাদ' কার্ডকে ব্যবহার করে কি তিনি বিজয়ী হয়েছেন? আমরা যদি খুব সরলরেখায় তার এই বিজয়কে চিহ্নিত করি, তাহলে ভুল করব। আসলে নরেন্দ্র মোদি ভারতে এক ধরনের 'পপুলিজম'-এর জন্ম দিয়েছেন। এই 'পপুলিজম' বা সাধারণ মানুষনির্ভর ও সাধারণ মানুষের জন্য যে রাজনীতি, এই রাজনীতি উন্নয়নশীল বিশ্বের রাজনীতির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা কিংবা জামাল আবদুল নাসের। গান্ধী কোনোদিন ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেননি। নিজে উচ্চশিক্ষিত হয়েও সাধারণ মানুষের মতো থেকে গেছেন। তাদের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদিকে মেলানো বোধহয় ঠিক হবে না। কিন্তু মোদির সাফল্য এক জায়গায়_ রাজনীতিতে সোনার চামচ মুখে নিয়ে তিনি আসেননি। অতি সাধারণ ঘরের মানুষ তিনি। বাবার সঙ্গে রেলস্টেশনে কিশোর বয়সে চা বিক্রি করা মোদি পরবর্তীকালে নিজের অধ্যবসায় আর দৃঢ়তার গুণে মাস্টার্স করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। এক সময় তার মা, যিনি এখনও জীবিত আছেন, পাশের বাড়ির বাসন-কোসন পরিষ্কার করে সংসারে সাহায্য করেছেন। এসব তথ্য তিনি লুকিয়ে রাখেননি। সাধারণ মানুষ হয়ে বড় হওয়া একজন নরেন্দ্র মোদি জানেন ভারতের মানুষের সমস্যা কোথায়। এমনকি তার আগে যারা বিজেপির নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন, বিশেষ করে বাজপেয়ি কিংবা আদভানি, কেউই নরেন্দ্র মোদির মতো দারিদ্র্যকে ধারণ করে বেড়ে ওঠেননি। মোদি তাদের থেকে ব্যতিক্রম। নিঃসন্দেহে তিনি বিতর্কিত, অভিযুক্ত এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন। কিন্তু ভারতের মানুষ এসব বিবেচনায় নেয়নি। বিবেচনায় নিয়েছে তার দৃঢ়তা, নেতৃত্বের ধরন, উন্নয়নের ধারণা এবং নতুন এক ভারতবর্ষ উপহার দেওয়ার তার চিন্তা-চেতনা। নির্বাচনী প্রচারণায় ৩ লাখ কিলোমিটার ভ্রমণ করে তিনি যে রেকর্ড করলেন, তা সমসাময়িক ভারতের ইতিহাসে বিরল। গান্ধী পরিবারকে চ্যালেঞ্জ করা অত সহজ ছিল না। যদিও করপোরেট হাউসগুলোর প্রচারণায় মোদি যেখানে ছিলেন উজ্জ্বল, সেখানে রাহুল গান্ধী ছিলেন ম্লান। কিন্তু মোদির 'পপুলিজম'-এর কাছে হেরে গেলেন রাহুল গান্ধী। এই ব্যর্থতা তার সব সম্ভাবনাকে ম্লান করে দিল। দাদির মতো (ইন্দিরা গান্ধী) ১৯৭৭ সালে ক্ষমতা হারিয়ে ১৯৮০ সালে ফিরে আসা_ বিষয়টি তার জন্য খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না এখন। বাংলাদেশের জন্য একটা বড় শঙ্কার কারণ হচ্ছে তার বক্তব্য। ভারতে বাংলা ভাষাভাষীদের বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বাংলাদেশে 'পুশব্যাক' করা খোদ পশ্চিম বাংলাতেই বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। যেখানে আস্থাহীনতা রয়েছে সেখানে কুলদীপ নায়ারের মতো ব্যক্তিত্ব ঢাকায় দক্ষিণ এশিয়ায় 'অভিন্ন বাজার' চালুর কথা বলেছেন। কিন্তু 'সাফটা' কার্যকর হয়নি। সার্কের অনুন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার কথা, তা বাংলাদেশ ভারতে পায় না। ট্যারিফ আর প্যারা ট্যারিফের কারণে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে বাজার পাচ্ছে না। অথচ চাহিদা আছে প্রচুর। এখন 'অভিন্ন বাজার' বা দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন হলে বাংলাদেশসহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় পণ্যের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রতিযোগিতায় আমরা আমাদের পণ্য নিয়ে দাঁড়াতে পারব না। ঢাকার কোনো কোনো বিশ্লেষক দু'দেশের সম্পর্ককে 'শর্ট টার্ম', 'লং টার্ম' ও 'মিডিয়াম টার্ম'-এ ভাগ করার কথা বলেছেন! অথচ তারা ভুলে গেছেন সম্পর্কের ক্ষেত্রে 'সীমিত' বা দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে কিছু নেই। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আমাদের অবস্থান স্থায়ী। এখানে মধ্যবর্তী কোনো সমাধান নেই। ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বাংলাদেশি অভিবাসীদের প্রসঙ্গটি এনেছে। অথচ ভারতীয় গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছিল বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ (জনান্তিকে ১০ লাখ) ভারতীয় অবৈধভাবে কাজ করেন (গার্মেন্ট, টেক্সটাইল, আইটি সেক্টরে)। তারা বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা পাঠান, তাও অবৈধভাবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার ১৬২টি ছিটমহলের বাসিন্দারা (১১১টি ভারতীয় যা বাংলাদেশে, ৫১টি বাংলাদেশি যা ভারতে) যে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এবং ভারতীয় ক্যাবিনেটে হস্তান্তর প্রক্রিয়া অনুমোদিত হলেও শুধু বিজেপির বিরোধিতার কারণে তা ভারতীয় সংবিধানের অংশ হতে পারেনি। এই 'মানবাধিকার লঙ্ঘনে'র বিষয়টিও নির্বাচনী প্রচারণায় উচ্চারিত হয়নি। উল্লেখ্য, ভারত বর্তমানে জাপানকে হটিয়ে দিয়ে বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তি (২০১১)। আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ভারত দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। তখন মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলার (বর্তমানে ৯৪০ ডলার)। বিশ্ব অর্থনীতিতে তখন ভারত অবদান রাখবে শতকরা ১৭ ভাগ। এ থেকে আমরাও উপকৃত হতে পারি। এ কথাটাও আমরা যেন ভুলে না যাই। ভারতে দারিদ্র্য একটা প্রধান সমস্যা। ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৭.০৫ ভাগ অথচ ২০০৪ সালে ছিল ২৭.৫০ ভাগ। অর্থাৎ দারিদ্র্য বেড়েছে। সুতরাং বাংলাদেশিদের ওই দেশে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না কাজের জন্য।

তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি বহুল আলোচিত। ফারাক্কা নিয়েও পুনঃআলোচনার সময় এসেছে। মোদি ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে তার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। টিপাইমুখ ও ফুলেরতল ব্যারাজ নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। কোনো একটি ক্ষেত্রেও আমরা পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারিনি। ভারতীয় নেতৃবৃন্দ আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। সেই আশ্বাস আশ্বাসই থেকে গেছে। বাস্তবতায় আমরা দেখেছি ভিন্ন জিনিস। সুতরাং দিলি্লতে একটি বিজেপি সরকার এই নীতিতে পরিবর্তন আনবে, এটা মনে হয় না।
নিঃসন্দেহে নির্বাচন-পরবর্তী ভারতীয় সরকারের দিকে দৃষ্টি থাকবে আমাদের। মোদি সরকার গঠন করবেন। কিন্তু আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক কী হবে? মোদি কি তাদের আস্থায় নিতে পারবেন? ভোল পাল্টে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিশেষ প্যাকেজের প্রস্তাব দিয়েছেন বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং) কিংবা জয়ললিতা যে মোদিকে সমর্থন করবেন না_ এটাও স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তাই দু'দেশের বিশ্লেষকরা যখন বলেন, 'পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ও আলোচনার মধ্য দিয়ে সম্পর্ক জোরদার করা যেতে পারে', 'তিস্তা সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত', 'রাজনৈতিক অবিশ্বাস রয়েছে', 'নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে ভারতকে', তখন এটা দিব্যি দিয়েই বলা যায়, এসব বক্তব্য কাগজ-কলমেই থেকে যাবে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা আমাদের সব সময় আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি কিছুই। মনমোহন সিংয়ের মতো একজন প্রধানমন্ত্রী যখন কথা দিয়ে যান 'কোনো সীমান্ত হত্যা হবে না', সে কথার প্রতিও সম্মান দেখায়নি ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স। ভারতীয় রাজনীতিবিদরা চাইলেও(?) ভারতীয় আমলারা বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখেন না। তারা বাংলাদেশ থেকে কীভাবে সুবিধা আদায় করে নেওয়া যায়, সেদিকেই দৃষ্টি দেন বেশি। অথচ ভারতীয় উন্নয়ন থেকে আমরাও উপকৃত হতে পারি। আমরাও হতে পারি ভারতের উন্নয়নের অংশীদার। কিন্তু ভারতের নীতিতে, মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে তাহলে দু'দেশের মাঝে সম্পর্কের যে তিক্ততা তা কাটিয়ে ওঠা যাবে না। এটা সত্য, ভারতীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বাংলাদেশি নেতৃবৃন্দের অনেকের ব্যক্তিগত সখ্য রয়েছে। এই সখ্য সম্পর্ক উন্নয়নে অতীতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে মোদির সঙ্গে বাংলাদেশি নেতৃবৃন্দের পরিচয় তেমন একটা নেই। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির নেতৃবৃন্দ অতীতে বিজেপির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একটা 'চ্যানেল ওপেন' করেছেন, এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে নিঃসন্দেহে বীণা সিক্রি, যিনি কিছুদিন আগ পর্যন্ত ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন, তিনি এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। বীণা সিক্রি মোদির পররাষ্ট্র উপদেষ্টাদের একজন। মোদির অগ্রাধিকারের তালিকায় বাংলাদেশ না থাকারই কথা। তিনি এখন গুরুত্ব দেবেন চীন ও জাপানের সঙ্গে সম্পর্ককে। কেননা উন্নয়নের যে টার্গেট তিনি নির্ধারণ করেছেন, সেখানে তার বিনিয়োগ দরকার। আর চীন ও জাপান থেকেই তার এই বিনিয়োগ আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি গুরুত্ব দেবেন কম। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি এখন ৩১ বিলিয়ন ডলার। এটা কমানোর উদ্যোগ নেবেন তিনি। এটা করতে গিয়ে নয়া অর্থনৈতিক জোট বিসিআইএমকে (বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার) গুরুত্ব দেবেন তিনি, যা কি-না ভারতকে আশিয়ানের সদস্যপদ পেতে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে 'ব্রিকস'কে (ব্রাজিল, রাশিয়া, চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা) শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেবে ভারত। তাই মোদির পররাষ্ট্র নীতিতে আপাতত বাংলাদেশ খুব একটা গুরুত্ব পাবে বলে মনে হয় না। মোদি অর্থনীতিকে গুরুত্ব দেবেন। উন্নয়নের ব্যাপারে ব্যাপক কর্মসূচি নেবেন। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে বিরাজমান সমস্যাগুলো 'ডিপ ফ্রিজে' চলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
Daily SAMOKAL
25.05.14

কেমন হবে মোদির ভারত

ভারতে ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির বিজয় হাজারটা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে খোদ ভারতের ভেতরে ও বহির্বিশ্বে। কেমন হবে মোদির ভারত? বিজেপি নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্র“তি দিয়েছিল, সেসব প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ কি তিনি নেবেন? কিংবা তিনি গুজরাটে যেভাবে হিন্দু ও মুসলমান সম্পত্তি আলাদা করেছিলেন, সেভাবেই কি পুরো ভারতবর্ষে এই সাম্প্রদায়িক বিভক্তি আনবেন? তার পররাষ্ট্রনীতিই বা কী হবে? অর্থনীতির ক্ষেত্রে কতটুকু সংস্কার আনতে পারবেন তিনি? এ ধরনের হাজারটা প্রশ্ন এখন মোদিকে ঘিরে। এটা সত্য, বিশাল এক প্রত্যাশা নিয়ে তিনি এসেছেন। উন্নয়ন, চাকরি, বিনিয়োগ- এসব ক্ষেত্রে তিনি যদি ব্যাপক পরিবর্তন না আনেন, তাহলে অচিরেই তিনি তার জনপ্রিয়তা হারাবেন। ঐতিহ্যগতভাবেই গুজরাটিরা ব্যবসায়ী। ভারত তথা বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় যার নাম রয়েছে সেই মুকেশ আম্বানী নিজে গুজরাটি এবং পত্রপত্রিকায় দেখলাম, তিনি মনে করেন মোদি ভারতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবেন। একটা মোদি ম্যাজিক সারা ভারতে ছেয়ে গেছে- এটা অস্বীকার করার কোনো জো নেই। মোদির রাজনীতি সাম্প্রদায়িক মানসিকতাসম্পন্ন, এটা জেনেও মানুষ তাকে ভোট দিয়েছে। তিনি একটি ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, সন্দেহ নেই তাতে। তার এ বিশাল জনপ্রিয়তাকে তিনি কতটুকু উন্নয়নের কাজে লাগাবেন, সেটাই দেখার বিষয় এখন। বিশাল ভারতে দারিদ্র্য যেখানে একটি বড় সমস্যা, কিংবা জাতপাতের সমস্যা যেখানে উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়, সেখানে মোদির সামনে চ্যালেঞ্জ একাধিক। এক. অর্থনীতিকে বাগে আনা। প্রবৃদ্ধি বাড়ানো। বিনিয়োগের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করা। তরুণ প্রজন্মের জন্য সৃষ্টি করা চাকরির বাজার এবং শত শত ‘গুজরাল মডেল’ সৃষ্টি করে উন্নয়নের জোয়ারে ‘নয়া ভারত’কে ভাসিয়ে দেয়া। দুই. মুসলমানদের আস্থায় নেয়া। যেখানে ভারতজুড়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর হার শতকরা ১৮ ভাগ, সেখানে লোকসভায় নির্বাচিত মুসলমান সংসদ সদস্যের হার মাত্র ৪ ভাগ। মোদি রামমন্দির নির্মাণ করার প্রতিশ্র“তি দিয়ে মুসলমানদের আস্থা হারিয়েছেন। এ আস্থা তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তিন. তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি মডেল। যে মডেল তরুণ সম্প্রদায়কে শুধু চাকরির নিশ্চয়তাই দেবে না, বরং একটি উন্নত ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দেবে। চার. প্রতিবেশী চীন, পাকিস্তান আর বাংলাদেশ- এই তিনটি দেশের সঙ্গে একটি আস্থা ও পারস্পরিক বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তোলা। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে, যার উন্নয়ন মডেলে তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। শ্রীলংকার সঙ্গেও সম্পর্ক বাড়াতে হবে, যা ইউপিএ সরকারের সময় ছিল উপেক্ষিত। পাঁচ. বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা। নিজেকে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।নতুন সরকারের একটা বড় জায়গা হচ্ছে তার বৈদেশিক সম্পর্ক। পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতির কারণে, বিশেষ করে ইউক্রেনের পরিস্থিতির পর নতুন করে যে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হতে যাচ্ছে, তাতে ভারতের অবস্থান মোদি নিশ্চিত করবেন। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সম্পর্ক থাকলেও ক্রিমিয়া প্রশ্নে ভারতের অবস্থান ছিল রাশিয়ার পক্ষে। সাবেক ইউপিএ জোট আমলে নেয়া এ সিদ্ধান্ত থেকে ভারত সরে আসতে পারবে না। সেক্ষেত্রে ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক আরও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির একটা বড় জায়গা হচ্ছে ভারত-চীন সম্পর্ক। ইউপিএ জোট সরকারের সময় এ সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীরা দুই দেশের রাজধানী সফর করেছেন। বাণিজ্য হচ্ছে এ সম্পর্কের মূল ভিত্তি। ২০১১ সালে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১২ সালে ছিল ৭৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন। কিন্তু ২০১৩ সালে এটা কমে এসে দাঁড়ায় ৬৫ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারে। ভারতের পক্ষে ঘাটতি ৩১ বিলিয়ন ডলার। ভারতের রফতানির পরিমাণ কমেছে (১৭ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার। শতকরা হারে কমেছে ০.৪ ভাগ হারে, আগের বছরের তুলনায়)। এ ঘাটতি কমানো হবে মোদির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। দু’দেশই অর্থনৈতিক জোট ‘ব্রিকসে’র সদস্য। ব্রিকসে রাশিয়াও আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক বিশ্ব ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেই ব্রিকসের জন্ম। ব্রিকস আগামীতে অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে এবং মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। ফলে মোদির সময়ে চীন-ভারত সম্পর্ক যে আরও জোরদার হবে, এটাই স্বাভাবিক। তিনি তিন তিনবার (২০০৬, ২০০৭, ২০১১) চীন সফর করেছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মোদির সম্পর্ক কোন পর্যায়ে যাবে, সে ব্যাপারেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, মুখ্যমন্ত্রী মোদিকে ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। আসলে ১৯৯৮ সালে মার্কিন কংগ্রেসে একটি আইন পাস হয়। ওই আইনে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি যদি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত থাকেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরে ভিসা পাবেন না। এ আইন অনুযায়ীই মোদিকে ভিসা দেয়া হয়নি। মোদি গুজরাটের দাঙ্গার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে, যে দাঙ্গায় প্রায় দুই হাজার ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছিলেন। কিন্তু এ মুহূর্তে ওবামা প্রশাসনের কাছে ভারতের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব অনেক বেশি। ভারতে বড় ধরনের মার্কিন বিনিয়োগ রয়েছে। দু’দেশের মধ্যকার বাণিজ্যের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলারের উপরে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ১১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যুদ্ধবিমান ক্রয় করছে। এর বাইরে ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করছে। ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের পারমাণবিক প্রযুক্তির বাজার। অর্থাৎ ভারতে মার্কিন বিনিয়োগ অনেক বেশি। এ বিনিয়োগকে ওবামা প্রশাসন ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবেন না। তাই ব্যক্তি মোদি এখানে ফ্যাক্টর হবেন না। মোদির ব্যাপারে যে আপত্তি ছিল, মোদিকে ওবামার আমন্ত্রণের পর সেই আপত্তিটি আর থাকছে না। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি না পেলেও সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ২০০৪ সালে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, পাকিস্তান তাদের নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নির্মূল করবে। মোদি সরকার এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরনের ‘স্ট্যাটাস কো’ বজায় রাখবে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেকের। দেশে অনেকেই মনে করেন, বিগত কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারকে গুরুত্ব দিয়েছিল বেশি। এখন বিজেপি সরকার কোনো দলকে নয়, বরং রাষ্ট্র পর্যায়ে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেবে বেশি। এক কথায় বলা যায়, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয় তার জাতীয় স্বার্থের আলোকে। ফলে নতুন সরকার তাদের জাতীয় স্বার্থের আলোকেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পরিচালনা করবে। তাই সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ মুহূর্তে এটা স্পষ্ট, তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তিটি এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে গেল। কারণ মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে কোনো ধরনের বিবাদে যাবে না কেন্দ্র। ছিটমহল বিনিময়ের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কেননা এটা করতে গিয়ে সংবিধানে যে সংশোধন প্রয়োজন, তার উদ্যোগ বিজেপি নেবে না। অতীতে এর বিরোধিতা করেছিল বিজেপি। বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর পরিবর্তে বাজার সম্প্রসারণ ঘটবে। নতুন সরকার উদ্যোগ নেবে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বাড়াতে। তবে মোদি নির্বাচনের আগে তথাকথিত ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর যে হুমকি দিয়েছিলেন, এ ব্যাপারে তিনি ইতিমধ্যেই উদ্যোগ নিয়েছেন। দায়িত্ব নেয়ার আগেই স্বরাষ্ট্র সচিবকে ডেকে অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে আলাদা একটি দফতর গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন। এটা করলে পশ্চিমবঙ্গে বড় বিতর্কের সৃষ্টি হবে এবং দেশে এক ধরনের অস্থিতিশীলতার জন্ম হবে। মূলত মমতা ব্যানার্জিকে চাপে রাখার জন্যই তিনি এই উদ্যোগটি নিয়েছেন। কারণ ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধান সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মোদির টার্গেট মূলত সেই নির্বাচন। ভোট পাওয়ার জন্যই তিনি অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়টি ব্যবহার করেছেন। এখন ক্ষমতায় যাওয়া একজন প্রধানমন্ত্রীর জন্য বিষয়টা বড় ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশে ভারতের বড় স্বার্থ রয়েছে। ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যের উন্নয়নে বাংলাদেশের সহযোগিতা তার দরকার। উপরন্তু দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়নকে গ্রাম পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে ‘বিদ্যুৎ কানেকটিভিটি’ তার দরকার। সাতবোন রাজ্যের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ তিনি দারিদ্র্যপীড়িত বিহারে নেবেন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। সুতরাং বাংলাদেশকে তার আস্থায় নিতে হবে। অহেতুক ‘অনুপ্রবেশকারী’ বক্তব্য তুলে তিনি দু’দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট করবেন না। তবে তিনি যদি এখন সত্যিকার অর্থে উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেন, তাহলে তাকে বাংলাদেশকেও সঙ্গে নিতে হবে। দ্বিপক্ষীয় নয়, বরং বহুপক্ষীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তিনি বাংলাদেশেও সমান জনপ্রিয় হবেন। এক্ষেত্রে তিনি চারদেশীয় (ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান) একটি পানি ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে পারেন। যাতে করে একদিকে তিনি বাংলাদেশের পানি সমস্যার সমাধান, অন্যদিকে দেশটির বিদ্যুৎ ঘাটতি কমানোরও উদ্যোগ নিতে পারেন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে একটা বড় অন্তরায় হচ্ছে ভারতের ব্যুরোক্রেসি। ভারতের ব্যুরোক্রেসি বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে না। এখন নরেন্দ্র মোদির আমলে ব্যুরোক্রেসি কী ভূমিকা রাখে সেটাই দেখার বিষয়। আমার ধারণা, পুরো ভারতকে একটি ‘গুজরাট মডেলে’ (বিশাল বড় রাস্তা ও সেই সঙ্গে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিল্পায়ন, বিনিয়োগ, বিদ্যুৎ) পরিণত করার যে প্রতিশ্র“তি মোদি দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করতে হলে তার বাংলাদেশকে সঙ্গে নিতে হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তো অভিনন্দন বার্তায় জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশ হচ্ছে তার (মোদির) ‘দ্বিতীয় বাড়ি’। এই ‘দ্বিতীয় বাড়ি’র ধারণা মোদি হয়তো গ্রহণ করবেন না। তবে অতীতে ইউপিএ সরকার যেভাবে একটি বিশেষ দলকে ‘প্রমোট’ করত, মোদি বা তার উপদেষ্টারা সেই কাজটি করবেন না। ফলে মোদির পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে না। রাষ্ট্র পর্যায়ে যে সম্পর্ক থাকে, সে রকম সম্পর্কই থাকবে। বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো বিশেষ আগ্রহ থাকবে না মোদি সরকারের। তেলেগু দেশম পার্টির সভাপতি (বিজেপির মিত্র) চন্দ্রবাবু নাইডু বলেছেন, মোদির নেতৃত্বে ভারত হয়ে উঠবে ‘সুপার পাওয়ার’। মিথ্যা বলেননি নাইডু। মোদির এই ‘ভিশন’ আছে। তিনি ভারতকে বিশ্বশক্তি হিসেবে পরিণত করার উদ্যোগ নেবেন। এজন্য তিনি চীনকে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখবেন প্রথমে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি একজন দক্ষ প্রশাসক। তিনি জানেন অর্থনীতিই বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তার কাছে চীনের পর জাপান ও সিঙ্গাপুর মডেল বেশি আকৃষ্ট হয়েছে। চীনের ইপিজেড (রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) মডেলে তিনি বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এখন ভারতে এই মডেলের প্রয়োগ তিনি করবেন। নতুন নতুন ইপিজেড এখন তৈরি হবে, যাতে করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। মোদি জানেন, ভারত ও চীনের যৌথ জাতীয় আয় ২০১৫ সালে জি-৭-এর একত্রিত জাতীয় আয়কে ছাড়িয়ে যাবে (২০১০ সালে ছিল অর্ধেক)। আর ২০৩০ সালে এই যৌথ আয় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের যৌথ আয়কে (একত্রিত) ছাড়িয়ে যাবে। ৪২ জাতিভুক্ত ওসিইডির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতিতে চীন ও ভারতের অবদান দাঁড়াবে যথাক্রমে ২৮ ও ১১ ভাগে (তখন যুক্তরাষ্ট্রের অবদান থাকবে ১৮ ভাগ, জাপানের ৮ ভাগ)। সুতরাং চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে যে তিনি গুরুত্ব দেবেন, এটা এক কথাতেই বলে দেয়া যায়। চীনের সঙ্গে কোনো বৈরিতায় মোদি যাবেন না। ‘হিন্দি-চীন’ ভাই ভাইয়ের যে মডেলের সূত্রপাত ঘটেছিল বান্দুং সম্মেলনে (পশ্চাশের দশকে), এক নতুন আঙ্গিকে তা আবার ফিরে আসছে মোদি জমানায়। ধারণা করছি, মোদি তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে চীনকে বেছে নিতে পারেন। অথবা জাপান। তবে অস্ট্রেলিয়ায় জি-২০ দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সেখানে তিনি অংশ নিয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে চেনা ও জানার সুযোগ পাবেন প্রথমবারের মতো।মোদি ভালো করেই জানেন, বহির্বিশ্বে তার একটি বাজে ইমেজ আছে। ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতেও নিষিদ্ধ ছিলেন। এখন অবশ্য ওবামাও তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বিশ্ব সম্প্রদায় তাদের মনোভাবে পরিবর্তন আনছেন। বোঝাই যায়, আধুনিক ভারতের অন্যতম রূপকার হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। Daily Jugantor ২২ মে, ২০১৪

নেহরু থেকে নরেন্দ্র মোদি

ভারতে সদ্যসমাপ্ত ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের বিজয় নেহরু সাম্রাজ্যে বড় ধরনের ধস নামিয়েছে। ইতোমধ্যে নির্বাচনে পরাজয়ের দায়ভার স্বীকার করেছেন রাহুল গান্ধি, যিনি কংগ্রেসের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি পদত্যাগের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এমনকী কংগ্রেস চেয়ারপারসন সোনিয়া গান্ধিও পদত্যাগ করতে পারেন। তবে কংগ্রেসের এই যে বিপর্যয়, এটা যে এবারই প্রথম ঘটল, তা নয়। অতীতেও কংগ্রেস ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। আবার ক্ষমতায় ফিরেও এসেছে। বরাবর কংগ্রেস নেহরু গান্ধি পরিবারের দিকে তাকিয়েছে। তবে এ পরিবারের বাইরে নরসিমা রাও কিংবা সর্বশেষ মনমোহন সিং কংগ্রেসের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ক্ষেত্রে একটা পার্থক্য রয়েছে। মনমোহন সিং সনাতন রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি ছিলেন টেকনোক্র্যাট। টেকনোক্র্যাট কোটায় তিনি নরসিমা রাওয়ের মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি নিজে কখনও লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হননি। অর্থাৎ তার নিজস্ব কোনও নির্বাচনি এলাকা নেই। আসাম থেকে তিনি রাজ্যসভার সদস্য। সেখানে এখনও তার একটি ভাড়া করা বাড়ি আছে, যেখানে একদিনের জন্যও তিনি থাকেননি। রাজ্যসভায় তার আসন আরও কিছুদিনের জন্য থাকবে। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে প্রথম লোকসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫২ সালে। আর সর্বশেষ ষোড়শ লোকসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এপ্রিল-মে মাসে। প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জওহরলাল নেহরু। সে হিসেবে আগামী ২১ মের পর ভারতের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেবেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। যদিও ১৯৪৭ সালের আগস্টে পাক-ভারত বিভক্তি ও ভারত তার আলাদা অস্তিত্ব বজায় রাখলে, প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন নেহরু। নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস লোকসভার প্রথম (১৯৫২), দ্বিতীয় (১৯৫৭) ও তৃতীয় (১৯৬২) নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। নেহরু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৬ বছর ২৮৬ দিন। তার মৃত্যুর পর (১৯৬৪) দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাত্র ১৩ দিন দায়িত্ব পালন করেন গুজরালি লাল নন্দা (২৭ মে থেকে ৯ জুন পর্যন্ত)। এরপর লাল বাহাদুর শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১ বছর ২১৬ দিন (৯ জুন ১৯৬৪ থেকে ১১ জানুয়ারি ১৯৬৬)। তাসখন্দে শাস্ত্রীর মৃত্যু হলে আবারও সাময়িকভাবে দায়িত্বটি পড়ে গুজরালি লাল নন্দার ঘাড়ে। দুঃখজনক হলেও সত্য, নন্দা তার পদে স্থায়ী হতে পারেননি। এবারও তিনি ১৩ দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বটি পালন করেন। ওই সময় প্রশ্ন ওঠে- ভারতের ঐক্যের স্বার্থে নেহরু পরিবারের কাউকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করতে হবে। কংগ্রেসের ভেতরে একটি কোঠারি স্বার্থ সব সময় চেয়েছে- ক্ষমতা নেহরু পরিবারের হাতে থাকুক। তাই কংগ্রেসের একমাত্র পছন্দ ছিল ইন্দিরা গান্ধি। জীবদ্দশায় নেহরুও এমনটি চেয়েছিলেন। তিনি বেঁচে থাকতেই ইন্দিরা গান্ধিকে কংগ্রেসের চেয়ারম্যানের দায়িত্বটি দিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধি মন্ত্রিসভায় তথ্যমন্ত্রীও ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন ১৯৬৬ সালের ২৪ জানুয়ারি। প্রথম পর্যায়ে তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১১ বছর ৫৯ দিন। তৃতীয় ও চতুর্থ লোকসভা নির্বাচনে তিনি কংগ্রেসকে বিজয়ী করেন। চতুর্থ লোকসভা (১৯৭১) নির্বাচনে কংগ্রেস ৩৫২ আসনে বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৭ সালে পঞ্চম লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি (১৫৪ আসন) ঘটে। নির্বাচনে জনতা পার্টি কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়। মোরারজি দেশাই (২ বছর ১২৬ দিন) ও চরম সিং (১৭০ দিন) ক্ষমতা ভাগাভাগি করেন। কিন্তু ৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে (১৯৮০) ইন্দিরা গান্ধি আবার বিপুল ভোটে ফিরে আসেন। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধি তার নিজ দেহরক্ষীর হাতে নিহত হলে আবারও সেই একই প্রশ্ন ওঠে, গান্ধি পরিবারের কাউকে ক্ষমতা না দিলে ভারতীয় ঐক্য টিকে থাকবে না। তাই রাজনীতিবিমুখ রাজিব গান্ধিকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বটি নিতে হয়েছিল। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত। যদিও রাজিব গান্ধি ১৯৮৩ সালে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯১ সালের ২১ মে মাদ্রাজ থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে শ্রীপেরুমপুদুরে বোমা বিস্ফোরণে রাজিব গান্ধি নিহত হলে নরসিমা রাওয়ের জন্য ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। নির্বাচনে তিনি প্রথমে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। পরে উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি সংসদে আসেন ও প্রধানমন্ত্রীর পদটি নিশ্চিত করেন। রাজিব গান্ধি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৮৯ সালের ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত, ৫ বছর ৩২ দিন। এরপর ভারতীয় রাজনীতিতে আবারও পরিবর্তন আসে। জনতা দল সরকার গঠন করে। ভিপি সিং প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু অচিরেই অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে জনতা দল। চন্দ্রশেখর সমাজবাদী জনতা দল গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হন। ভিপি সিং ক্ষমতায় ছিলেন ৩৪৩ দিন, আর চন্দ্রশেখর ২২৩ দিন (নবম লোকসভায়)। ১০ম লোকসভা নির্বাচনে আবার কংগ্রেস ক্ষমতা ফিরে পায়। নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী হন, ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৯১ সালের ২১ জুন থেকে ১৯৯৬ সালের ১৬ মে পর্যন্ত। কিন্তু ১১তম লোকসভা তিনজন প্রধানমন্ত্রীকে জন্ম দেয়।
বাজপেয়ি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাত্র ১৩ দিনের জন্য। কিন্তু আস্থা ভোটের মুখোমুখি হয়ে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর জনতা দল সরকার গঠন করে এবং কংগ্রেস তাদের সমর্থন করে। বাজপেয়ির ১৩ দিনের সরকারের স্থায়িত্ব ছিল ১৯৯৬ সালের ১৬ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত। এরপর জনতা দলের দেবগৌড়া সরকার গঠন করেন, ছিলেন ১৯৯৭ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ৩২৮ দিন। কংগ্রেস সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে গুজরাল সরকার গঠন করেন। ১৯৯৮ সালের ১৯ মার্চ পর্যন্ত কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে গুজরাল সরকার পরিচালনা করেন (৩৩২ দিন)। এরপর আবার পরিবর্তন। বিজেপি পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে। বাজপেয়ি পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন। এবার অবশ্য বাজপেয়িকে আর ক্ষমতা পরিচালনা করতে কোনও বেগ পেতে হয়নি। একটানা ৬ বছর ৬৪ দিন ক্ষমতা পরিচালনা করে গেছেন বাজপেয়ি (১৯৯৮ সালের মার্চ থেকে ২০০৪ সালের মে পর্যন্ত)। বাজপেয়ি ১২তম লোকসভা ও ১৩তম লোকসভায় কিছুদিন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু শেষের দিকে লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় সরকারের পতন ঘটে। এরপর ১৪ ও ১৫ মে লোকসভায় এককভাবে কংগ্রেস বিজয়ী হয় এবং ইউপিএ জোটের নেতৃত্বে একটি সরকার পরিচালিত হয়। দুই টার্ম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও টেকনোক্র্যাট ড. মনমোহন সিং। তিনি কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা কখনোই ছিলেন না। তবে কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন। যদিও তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তি নিয়ে কংগ্রেসে কোনও বড় ধরনের বিতর্ক হয়নি। তবে তার ক্ষমতা ছাড়ার পরই জানা যায় তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকলেও পর্দার অন্তরালে ক্ষমতা পরিচালনা করেছেন অন্য কেউ। অনেকেই সোনিয়া গান্ধির দিকে আঙুল নির্দেশ করেছেন। সোনিয়া কংগ্রেস সভাপতির বাইরেও ইউপিএ জোটেরও চেয়ারম্যান। অতীতে তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্তির একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও বিজেপির প্রচ- আপত্তির মুখে তিনি দায়িত্বটি নিতে পারেননি। বিজেপি তাকে বরাবরই ইতালিয়ান নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে। জন্মসূত্রে তিনি ইতালিয়ান হলেও রাজিব গান্ধিকে বিয়ে করার পর তিনি অনেক আগেই ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কট্টরপন্থী হিন্দুদের কাছে তিনি আজও গ্রহণযোগ্য হননি এবং আগামীতে হবেন বলেও মনে হয় না। ধর্মীয়ভাবেও তিনি হিন্দু নন। রোমান ক্যাথলিক। তার সন্তানরা (রাহুল ও প্রিয়াংকা) কেউই হিন্দু নন। তারা সবাই ধর্মীয়ভাবে খ্রিস্টান নন। রাহুল গান্ধির দাদা ফিরোজ গান্ধির জন্ম পার্সি পরিবারে ও জারাসট্রিয়ানইজম ধর্মের অনুসারী। প্রিয়াংকা যাকে বিয়ে করেছেন তিনিও হিন্দু নন। ভারতের রাজনীতিতে এই যুগেও ধর্ম একটি ফ্যাক্টর। অতি হিন্দুত্ববাদ অথবা হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথা বলে মোদি জনসমর্থন পেয়েছেন। তবে বাবার মৃত্যুর পর রাহুল গান্ধি রাজিব গান্ধির মুখে অগ্নিসংযোগ করেছিলেন। মোদি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন বটে। কিন্তু ক্ষমতা পরিচালনায় তার সঙ্গে বাজপেয়ির পার্থক্য থাকবেই। বাজপেয়ি হিন্দু জাতীয়তাবাদের রাজনীতিতে বিশ্বাস করলেও কট্টর ছিলেন না। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয় রাজনীতির যে ধরন, তা তিনি বহন করেছিলেন। তার গ্রহণযোগ্যতা সর্বমহলে ছিল। কিন্তু মোদি এক ভিন্ন জগতের মানুষ। কট্টরপন্থী সংগঠন আরএসএসের আদর্শকে তিনি শুধু ধারণই করেননি, বরং তা পদে পদে বাস্তবায়ন করেছেন। সাম্প্রদায়িকভাবে তিনি গুজরাটে মুসলমান ও হিন্দুদের আলাদা করেছিলেন। সেখানে হিন্দুরা মুসলমানদের সম্পত্তি যেমনি কিনতে পারে না, ঠিক তেমনি মুসলমানরা হিন্দুদের সম্পত্তি কিনতে পারে না। এ-সংক্রান্ত একটি আইন তিনি করেছেন গুজরাটে। ফলে গুজরাটে একদিকে যেমনি মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় জমির দাম বেড়ে ছিল, অন্যদিকে তেমনি ব্যাপক হারে মুসলমানরা গুজরাট ত্যাগ করে অন্যত্র স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেছিল। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের সঙ্গে এটি মানায় না। ভারতে বছরের পর বছর হিন্দু ও মুসলমানরা পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। এখানে অতীতে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার ঘটনা কিংবা গুজরাটে দাঙ্গা হয়েছে বটে, কিন্তু ভারতবর্ষে এরপর এক ধরনের স্থিতিশীলতাও আমরা দেখে এসেছি। এখন মোদি ক্ষমতাসীন হয়ে পুনরায় ওই সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেবেন কি না, এটাই দেখার বিষয়। এক সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় এভাবে বর্ণের ভিত্তিতে জনগোষ্ঠীকে বিভক্ত করা হয়েছিল। শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত অঞ্চলে কৃষ্ণাঙ্গদের কোনও প্রবেশাধিকার ছিল না। এই বর্ণবাদী রাজনীতির জন্য সারা বিশ্ব দক্ষিণ আফ্রিকাকে বয়কট করেছিল। নেলসন ম্যান্ডেলা ওই বর্ণবাদী রাজনীতি ভেঙে দিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে গুজরাট রাজ্যে মোদি ধর্মের নামে এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি টিকিয়ে রেখেছিলেন। এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কতটুকু উসকে দেবেন- এটাই দেখার বিষয়। তবে এটা সত্য, চাইলেও তিনি অনেক কিছু করতে পারবেন না। ভারতের রাজনীতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে আছে ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর। সংবিধান এর গ্যারান্টার। মোদির জনপ্রিয়তা আছে। কিন্তু এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে তিনি সাম্প্রদায়িক নীতির আলোকে ভারতকে পরিচালনা করবেন, এটা আমার মনে হয় না। গান্ধি-নেহরুর গড়া ভারতবর্ষ নিঃসন্দেহে নতুন এক যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। তেলেগু দেশম পার্টির সভাপতি চন্দ্রবাবু নাইডুর ভাষায় মোদির নেতৃত্বে ভারত হয়ে উঠবে ‘সুপার পাওয়ার’। ভারতের এই সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার অভিলাষ দীর্ঘদিনের। মোদি যদি এখন তার অতি হিন্দু জাতীয়তাবাদকে সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার জন্য ব্যবহার করেন, তাহলে সংঘাত অনিবার্য। মোদি সেটি করবেন না- এটাই প্রত্যাশা করেন সবাই। Daily Amader Somoy 21.05.14

মোদির বিজয় ও আমাদের প্রত্যাশা

শেষ পর্যন্ত সব জল্পনা-কল্পনার অবসান হলো। ভারতের লোকসভা নির্বাচনে পরাজয় ঘটল দীর্ঘ ১০ বছর ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটের। নির্বাচনের আগে কিংবা 'বুথ ফেরত' ভোটের সমীক্ষায় এটা পরিষ্কার হয়েছিল যে নয়াদিল্লিতে সরকারের পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। ১৬ মের ভোট গণনার মধ্য দিয়ে সেটাই প্রমাণিত হলো। চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা গেছে, এককভাবে বিজেপি পেয়েছে ২৮৪ আসন, আর এনডিএ জোটের আসন ৩৩৮। অন্যদিকে কংগ্রেস পেয়েছে ৪৪ আসন, জোটগতভাবে ইউপিএ জোট পেয়েছে ৫৯ আসন। এর বাইরে আঞ্চলিক দলগুলো পেয়েছে ১৪৭ আসন। তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে তার একক কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে। পশ্চিমবঙ্গের ৪২ আসনের মধ্যে তৃণমূলের প্রাপ্তি ৩৪ আসন। বিজেপি এখানে পেয়েছে ২ আসন। এর মধ্য দিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনল বিজেপি। বলতেই হবে এই বিজয়ের রূপকার হচ্ছেন গুজরাটের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদি। অতীতেও বিজেপি দিল্লিতে ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু এত বিপুল জনপ্রিয়তা অতীতে বিজেপি নিশ্চিত করতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে ১১তম সংসদ (লোকসভা) নির্বাচনের পর মাত্র ১৩ দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন বাজপেয়ি। কিন্তু আস্থাভোটের আগেই তিনি পদত্যাগ করেন। দেবগৌড়া এরপর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এরপর ১২তম লোকসভা নির্বাচনে (১৯৯৮) বাজপেয়ি আবার ফিরে আসেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ছয় বছর ৬৪ দিন। ১৩তম লোকসভা নির্বাচনের পরও বাজপেয়ি কিছুদিন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ওই সংসদ স্থায়ী হয়নি। ২০০৪ সালের মে মাসের ১৪তম লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে কংগ্রেস যে সরকার গঠন করেছিল, ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং, যিনি লোকসভার সদস্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন রাজ্যসভার সদস্য। এখনো তিনি রাজ্যসভার সদস্য। ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিজয়কে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। তবে বাস্তবতা এটাই বিজেপির হিন্দুত্ববাদ ভারতে মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি করলেও, ভোটাররা 'মোদি ম্যাজিকে' আকৃষ্ট হয়েছে। মোদি প্রমাণ করতে পেরেছেন তাঁর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ থাকলেও, ভারতীয় ভোটাররা তাঁর ওপর আস্থা রেখেছে। বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের কাছে তিনি এক আদর্শ। কিন্তু এখন কী হবে? মোদি নির্বাচনের আগে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিংবা বিজেপির নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা কতটুকু রক্ষিত হবে? অভ্যন্তরীণ ও বহিঃসম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি কতটুকু পরিবর্তন আনতে পারবেন? আগামী বেশ কয়েক দিন এ বিষয়গুলো বারবার আলোচিত হতে থাকবে। মোদি নিঃসন্দেহে একটা ইমেজ তৈরি করতে পেরেছেন। আর তাঁর ইমেজটি হচ্ছে তিনি সারা ভারতে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেবেন। গুজরাটে যেভাবে তিনি উন্নয়ন ঘটিয়েছেন, ঠিক একইভাবে তিনি ভারতের সর্বত্র উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেবেন। কিন্তু এতে করে কতটুকু তিনি সফল হবেন, এ প্রশ্ন আছে। কেননা এক গুজরাটকে দিয়ে সারা ভারতবর্ষকে বিচার করা যাবে না। গুজরাটের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি আর উড়িষ্যা কিংবা ঝাড়খন্ডের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি এক নয়। ভারতে দরিদ্রতা একটা বড় সমস্যা। ২০১০ সালে দরিদ্রতা যেখানে ছিল ২৭.৫০ শতাংশ, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩৭.০২ শতাংশ (২০১০)। ২০১৪ সালের রিপোর্ট নিলে দেখা যাবে, এই সংখ্যা আরো বেড়েছে। প্রতিবছর বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৮ দশমিক ৩ লাখ শিশু মারা যায়। উত্তর প্রদেশে আর মধ্যপ্রদেশে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি ১ হাজারে ৯১ ও ৯২ জন শিশু। ভারত বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। তা সত্ত্বেও ভারতে ৫৩ শতাংশ মানুষের কোনো টয়লেট সুবিধা নেই। যেখানে সেখানে রাস্তাঘাটে তারা মলমূত্র পরিত্যাগ করে। অথচ ৫৩ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে মোবাইল ফোন, ৪৭ শতাংশ মানুষের রয়েছে টিভি, ৯ শতাংশ মানুষের রয়েছে কম্পিউটার। ৩৯ শতাংশ মানুষের কোনো পাকঘর নেই। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন আনার কাজটি খুব সহজ নয়। মোদি কতটুকু সফল হবেন- এ প্রশ্ন থাকবেই। একটি ক্ষুদ্র পরিসরে তিনি গুজরাটের অবকাঠামোতে পরিবর্তন এনে গুজরাটের উন্নয়ন সাধন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু বৃহত্তর ভারতের প্রেক্ষাপটে, বিষয়টি অত সহজ নয়। উপরন্তু ভারতে রাজ্যের সংখ্যা এখন ২৯। প্রতিটি রাজ্যেই বলা যেতে পারে আঞ্চলিক শক্তিগুলো ক্ষমতা পরিচালনা করছে। এসব দলের সবার সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক যে ভালো, তা বলা যাবে না। বিজেপি-বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রের দ্বন্দ্ব শুধু উন্নয়নকেই বাধাগ্রস্ত করবে না; বরং বলা যেতে পারে, নতুন এক ধরনের 'রাজনৈতিক সংকট' সৃষ্টি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্র রাজ্যগুলোকে বিপুল আর্থিক সহযোগিতার প্রলোভন দিয়ে তাদের সমর্থন নিশ্চিত করতে পারে। প্রায় প্রতিটি রাজ্যই ঋণের ভারে জর্জরিত। এটাকে মোদি ব্যবহার করতে পারেন তাঁর স্বার্থে। নয়া সরকারের একটা বড় জায়গা হচ্ছে তার বৈদেশিক সম্পর্ক। পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতির কারণে নতুন করে যে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হতে যাচ্ছে, তাতে ভারতের অবস্থান কী হবে? ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সম্পর্ক থাকলেও, ক্রিমিয়া প্রশ্নে ভারতের অবস্থান ছিল রাশিয়ার পক্ষে। সাবেক ইউপিএ জোট আমলে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত থেকে ভারত সরে আসতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক আরো উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির একটা বড় জায়গা হচ্ছে ভারত-চীন সম্পর্ক। ইউপিএ জোট সরকারের সময় এই সম্পর্ক যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীরা দুই দেশের রাজধানী সফর করেছেন। বাণিজ্য হচ্ছে এই সম্পর্কের মূল ভিত্তি। ২০১১ সালে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১২ সালে ছিল ৭৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন। কিন্তু ২০১৩ সালে এটা কমে এসে দাঁড়ায় ৬৫ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারে। ভারতের পক্ষে ঘাটতি ৩১ বিলিয়ন ডলার। ভারতের রপ্তানির পরিমাণ কমেছে (১৭ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার। শতকরা হারে কমেছে ০.৪ হারে, আগের বছরের তুলনায়)। এই ঘাটতি কমানো হবে মোদির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। দুটো দেশই অর্থনৈতিক জোট 'ব্রিকস'-এর সদস্য। 'ব্রিকস'-এ রাশিয়াও আছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেই 'ব্রিকস'-এর জন্ম। 'ব্রিকস' আগামীতে অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে এবং মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। ফলে মোদির সময়ে চীন-ভারত সম্পর্ক যে আরো বৃদ্ধি পাবে, এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মোদির সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সে ব্যাপারেও দৃষ্টি থাকবে অনেকের। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী মোদিকে ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। আসলে ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে একটি আইন পাস হয়। ওই আইনে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি যদি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত থাকেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরের ভিসা পাবেন না। এই আইন অনুযায়ীই মোদিকে ভিসা দেওয়া হয়নি। মোদি গুজরাটের দাঙ্গার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ আছে, যে দাঙ্গায় প্রায় দুই হাজার ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছিলেন। এখন দেখার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী মোদির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কী ভূমিকা নেয়। ভারতে বড় ধরনের মার্কিন বিনিয়োগ রয়েছে। দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যের পরিমাণ ৫০ মিলিয়ন ডলারের ওপরে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ১১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যুদ্ধ বিমান ক্রয় করছে। এর বাইরে ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করছে। ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের পারমাণবিক প্রযুক্তির বাজার। অর্থাৎ ভারতে মার্কিন বিনিয়োগ অনেক বেশি। এই বিনিয়োগকে ওবামা প্রশাসন ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে না। তাই ব্যক্তি মোদি এখানে ফ্যাক্টর হবেন না। মোদির ব্যাপারে যে আপত্তি ছিল, চূড়ান্ত বিচারে সেই আপত্তিটি আর থাকবে না। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি না পেলেও, সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ২০০৪ সালে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, পাকিস্তান তাদের নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে সব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নির্মূল করবে। মোদি সরকার এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরনের 'স্ট্যাটাস কো' বজায় রাখবে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেকের। বাংলাদেশের অনেকেই মনে করেন বিগত কংগ্রেস সরকার ঢাকার আওয়ামী লীগ সরকারকে গুরুত্ব দিয়েছিল বেশি। এখন বিজেপি সরকারের ভূমিকা কী হবে? এক কথায় যেটা বলা যায়, তা হচ্ছে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয় তার জাতীয় স্বার্থের আলোকে। ফলে নয়া সরকার তাদের জাতীয় স্বার্থের আলোকেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রচনা করবে। তাই সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তিটি এখন অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে গেল। কেননা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কোনো ধরনের বিবাদে যাবে না কেন্দ্র। ছিটমহল বিনিময়ের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কেননা এটা করতে গিয়ে সংবিধান সংশোধনের যে উদ্যোগ, তা বিজেপি নেবে না। বাণিজ্য ঘাটতি কমানোরও কোনো উদ্যোগ নেবে না নয়া সরকার। তবে মোদি নির্বাচনের আগে তথাকথিত 'অনুপ্রবেশকারীদের' বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর যে হুমকি দিয়েছিলেন- এ ব্যাপারেও তিনি কোনো উদ্যোগ নেবেন না। কেননা তিনি জানেন, ওটা করলে পশ্চিমবঙ্গে বড় বিতর্কের সৃষ্টি হবে এবং দেশে এক ধরনের অস্থিতিশীলতার জন্ম হবে। তাই তিনি এ ব্যাপারে চুপ থাকবেন। মোদি বিজয়ী হলেও তার সমস্যা অনেক। উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় (আসন ২৫০), কংগ্রেস তথা ইউপিএর জোটের আসন ৮২। এনডিএ জোটের রয়েছে ৬১ আসন। কংগ্রেসের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় তাদের সমর্থন না পেলে তিনি কোনো বিল পাস করাতে পারবেন না। তাই কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁকে সহাবস্থানে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক দল তথা বিজেপি-বিরোধী (মোট ১২ রাজ্য) রাজ্যগুলো কেন্দ্রের বিরোধিতা করলে, তিনি উন্নয়নের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। মুসলমানরা এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে আছেন। তাদের আস্থায় নিতে হবে। এমন আইন তৈরি করার উদ্যোগ তিনি নেবেন না, যাতে মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কংগ্রেসের পরাজয় ঘটেছে। নিঃসন্দেহে এর পেছনে কারণ রয়েছে। তবে রাহুল গান্ধীর জন্য এটা একটা বড় পরাজয়। তিনি পারলেন না। তিনি তার দাদির মতো (ইন্দিরা গান্ধী) আবার কী 'লাইম লাইটে' ফিরে আসতে পারবেন? ১৯৭৭ সালে ক্ষমতা হারানো ইন্দিরা গান্ধী ফিরে এসেছিলেন ১৯৮০ সালে। তবে কংগ্রেস এখন রাহুলের পরিবর্তে প্রিয়াংকা গান্ধীকেও নেতৃত্বের সারিতে নিয়ে আসতে পারে। ভারতের মানুষ পরিবর্তন চেয়েছে। আর ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়েই এই পরিবর্তনটুকু সাধিত হলো। Daily KALERKONTHO 19.05.14

এবার মোদির মাইন্ডসেট পাল্টাতে হবে

ভারতের নির্বাচনে বিজেপির এই বিজয়ে আমি অবাক হইনি। নির্বাচনের আগে ও পরে যে জনমত জরিপ ছিল, সেই জরিপই সত্য প্রমাণিত হল। ভারতের মানুষ যে পরিবর্তন চেয়েছে, বর্তমান ফলাফল তারই স্বাক্ষর বহন করছে। ১৯৮৪ সালে মাত্র দুটি আসন পেয়ে যে দলটি সংসদীয় রাজনীতির দিকে যাত্রা শুরু করেছে, তারা এখন ৩১৪টির মতো আসন পেয়েছে। এখন মোদিকে সরকার পরিচালনা করতে হলে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসকে আস্থায় নিতে হবে। কেননা রাজ্যসভায় এখনও কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কংগ্রেসকে আস্থায় না নিলে কোনো আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হবে না। মোদিকে এখন মূলত উন্নয়নের রাজনীতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। তার যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি- তা পরিত্যাগ করলে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও উন্নত হবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের একাধিক সমস্যা রয়েছে, বিশেষ করে তিস্তা চুক্তি, ছিটমহল চুক্তি, বাণিজ্য ঘাটতি কমানো, সীমান্ত হত্যা বন্ধ ইত্যাদি বিষয়ের ক্ষেত্রে যত দ্রুত তিনি ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবেন, ততই তিনি ভালো করবেন। অর্থাৎ ভারতের উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশের মানুষের সমর্থন তার দরকার। তথাকথিত অনুপ্রবেশকারী বলে বাংলা ভাষাভাষিদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হলে দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয় না, তারা চায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্পর্ক আরও উন্নত হোক। এক্ষেত্রে ভারতের নেতৃবৃন্দের মাইন্ড সেটআপ পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশ ছোট দেশ হতে পারে, কিন্তু ভারতকে দেয়ার মতো অনেক কিছুই তার আছে। আজ মোদিকে এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ মনে করে, পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা থাকলে এ দুটি দেশেরই সম্পর্ক শুধু উন্নত হবে না, বরং দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে তা এক বড় অবদান রাখতে পারবে। Daily Jugantor ১৭ মে, ২০১৪

পারমাণবিক প্রকল্প কোনও সমাধান নয়

দেশের দ্বিতীয় পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র দক্ষিণাঞ্চলের কোনও এক চরে করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ৩০ এপ্রিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে পরিদর্শনে এসে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এ কথা বলেন। বাংলাদেশে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হতে যাচ্ছে রূপপুরে। রাশিয়ার পারমাণবিক শক্তি কমিশন রোসাটম-এর সহযোগিতায় এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার দুই চুল্লিবিশিষ্ট এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে। এখন পর্যন্ত রূপপুরে কাজ শুরু হয়নি। তারপরও প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দিলেন। এমনিতেই বিশ্বব্যাপী পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে এক ধরনের বিরোধিতা রয়েছে। রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারেও পরিবেশবাদীরা বিরোধিতা করেছেন। ফুলবাড়ীর ঘটনা আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ফুলবাড়ীর ঘটনা আমরা স্মরণ করতে পারি। ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করেছিলেন স্থানীয় জনগণ। তারা বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করেছিলেন। তাদের সেই আশঙ্কার পেছনে সত্যতাও ছিল। ফুলবাড়ীর জনগণ সেদিন কয়লা তুলতে দেননি। আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি চালিয়েছিল ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট। গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন ৬ ব্যক্তি। সেদিনের সেই আন্দোলন বাংলাদেশে একটি ইতিহাস রচনা করেছিল। আজ যখন রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হতে যাচ্ছে, তাতে আশঙ্কা একটা থেকেই গেল; আর তা হচ্ছে- ফুলবাড়ীর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে রূপপুরে। যদিও রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়া ও সেখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আমাদের ন্যূনতম আরও ৬ থেকে ৮ বছর অপেক্ষা করতে হবে। এখানে পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা ফুলবাড়ীর চেয়ে অনেকগুণ বেশি। এখানে নিরাপত্তা ঝুঁকিটা অনেক বেশি। রূপপুরে যেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হয়েছে, তার পাশ দিয়ে একটি নদী বয়ে গেছে। ঝুঁকিটা এ কারণেই। ফুকুসিমার পারমাণবিক বিপর্যয়ের পর রূপপুরের ব্যাপারে আমাদের একটা শঙ্কা থাকবেই। বাংলাদেশের পরিবেশবাদীরা বিষয়টি যে হালকাভাবে নেবেন, তা মনে করারও কোনও কারণ নেই। বাংলাদেশ অনেক ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। ফুকুসিমায় কিংবা চেরনোবিলের চেয়ে অনেক বেশি ঘনবসতি রূপপুরে। রাশিয়ার সঙ্গে যে ৫০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে, তা নিয়ে গবেষণা করা হবে। ধারণা করছি এই গবেষণার নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে বেশি। বলা হচ্ছে, ৫ স্তরবিশিষ্ট একটি নিরাপত্তা বলয় থাকবে এবং তৃতীয় জেনারেশনের একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানো হবে। কিন্তু নিরাপত্তার ব্যাপারে কতটুকু নিশ্চিত হওয়া যাবে- সে প্রশ্ন থেকেই গেল।জাপানের ফুকুসিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়াবহ বিস্ফোরণের (২০১১) রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই বাংলাদেশ যখন রাশিয়ার সঙ্গে রূপপুরে পারমাণবিক চুল্লি তৈরির একটি সমঝোতায় যায়, তখন সঙ্গতকারণেই এ নিয়ে বিতর্ক বাড়বেই। জাপান প্রযুক্তিবিদ্যায় শীর্ষে অবস্থান করলেও পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি দেশটি। বলা হচ্ছে-আশির দশকের মাঝামাঝি (১৯৮৬) রাশিয়ার চেরনোবিলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, এর চেয়েও ভয়াবহ ছিল ফুকুসিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিস্ফোরণ। চেরনোবিলের বিস্ফোরণের পর তেজস্ক্রিয়তা ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। গরুর দুধ, গুঁড়োদুধ, শাকসবজি, ফলমূল- সবকিছুতেই তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ প্রায় ২৬ বছর পরও চেরনোবিল ও আশপাশ এলাকা বিপন্মুক্ত নয়। ইউরোপের বেশ কিছু দেশ থেকে কৃষিপণ্য রপ্তানি বেশ কয়েক বছর বন্ধ ছিল। এখন বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে গেল। কিন্তু এর নিরাপত্তা আমরা কীভাবে নিশ্চিত করব, সে প্রশ্ন থেকেই গেল। পরমাণু প্রকল্প খুব ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণও। দক্ষিণ এশিয়ায় পরমাণু শক্তির ব্যবহার খুবই কম। ভারতে মোট জ্বালানির মাত্র ২ ভাগ ও পাকিস্তানের এক ভাগ আসে পরমাণু জ্বালানি থেকে। যদিও এ দুটো দেশ পরমাণু শক্তি উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা খোদ ভারতেও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। গেল বছর পাকিস্তান চীনের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, সেখানে চীন পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে দেবে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ তৃতীয় দেশ, যারা পরমাণু শক্তির উৎপাদনে যাবে। সাধারণত ৬০০ থেকে ১০০০ মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ৫০০ মেগাওয়াটের ওপরে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যায়। ৫০০ মেগাওয়াটের ওপরে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলে উৎপাদন খরচ কম হয়। কিন্তু এ ধরনের কেন্দ্র স্থাপনে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ খরচ হয়। প্রচলিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে প্রতি মেগাওয়াটের জন্য গড়ে খরচ হয় ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোয় পরমাণুকেন্দ্রে এই খরচ হয়েছে দেড় থেকে ২ মিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে খরচ হবে দেড় মিলিয়ন বা ১৫০ কোটি টাকা। জাপানে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় প্রতি ইউনিটে ৪ ডলার ৮০ সেন্ট। জাপানে কয়লায় খরচ হয় ৪ ডলার ৯৫ সেন্ট ও গ্যাসে ৫ ডলার ২১ সেন্ট। দক্ষিণ কোরিয়ায় পরমাণুতে ২ ডলার ৩৪ সেন্ট, কয়লায় ২ ডলার ১৬ সেন্ট, গ্যাসে ৪ ডলার ৬৫ সেন্ট। ফ্রান্সে পরমাণুতে ২ ডলার ৫৪ সেন্ট, কয়লায় ৩ ডলার ৩৩ সেন্ট ও গ্যাসে ৩ ডলার ৯২ সেন্ট। বর্তমানে বিশ্বে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তার ২৩.৫ ভাগই হয় পরমাণু শক্তি থেকে। এগুলো সবই উন্নত দেশে অবস্থিত। বিশ্বে ২৮টি পরমাণুভিত্তিক ৪২০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এর মাঝে ফ্রান্সে ৫৯টি। ফ্রান্সে মোট বিদ্যুতের ৭৯ শতাংশ উৎপাদিত হয় পরমাণু শক্তি থেকে। বেলজিয়ামে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৫৮টি। দেশটির মোট বিদ্যুতের ৫৮ ভাগই পারমাণবিক। সুইডেনে ৪৪ ভাগ, কোরিয়ায় ৪০ ভাগ, জাপানে ৫৫ ভাগ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২০ ভাগ বিদ্যুৎ পরমাণু শক্তিনির্ভর। তবে ফুকুসিমার পর জাপান নতুন করে চিন্তাভাবনা করছে এবং বিকল্প শক্তির কথা চিন্তা করছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে চীনে ৯ হাজার, ভারতে ৪ হাজার ১২০ ও পাকিস্তানে ৪২৫ মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। ২০২০ সালের মধ্যে চীন ৪০ হাজার, ভারত ২০ হাজার ও পাকিস্তান ৭ হাজার মেগাওয়াটের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে। অনেকেই জানেন, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমতি নিতে হয়। বাংলাদেশ এই অনুমতি পেয়েছিল ২০০৭ সালের জুন মাসে। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়টা হচ্ছে- এর রক্ষণাবেক্ষণ। দক্ষ জনশক্তি আমাদের নেই। এর অর্থ দীর্ঘদিন রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা আমাদের থেকে যাবে। দ্বিতীয় আরেকটি সমস্যা হচ্ছে- জনবসতির ঘনত্ব। রূপপুরে যেখানে জমি অধিকরণ করা হয়েছিল, সেখানে আশপাশে জনবসতি রয়েছে। এই জনবসতি অপসারণ করা হবে একটি বড় সমস্যা। এছাড়া বাংলাদেশে এমন কোনও বিরান এলাকা নেই, যেখানে কেন্দ্রটি স্থাপন করা যায়। আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। আগামী ২০২০ সালে বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১৬ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াটে। তখন এ চাহিদা আমরা মেটাব কীভাবে? সম্ভবত পারমাণবিক বিদ্যুৎ ছাড়া আমাদের কোনও বিকল্প নেই। আমাদের কয়লার একটা সম্ভাবনা থাকলেও সেখানে একটা রাজনীতি ঢুকে গেছে। কয়লা উত্তোলনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে স্থানীয় জনগণের স্বার্থ। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুললে কয়লাখনির সর্বোচ্চ ব্যবহার আমরা নিশ্চিত করতে পারব বটে, কিন্তু বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে স্থানান্তরিত করতে হবে। উপরন্তু ভূগর্ভস্থ বিপুল পানি অপসারণ করতে হবে। তাতে করে পরিবেশে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে। কোনও জনপ্রিয় সরকারই এই অপ্রিয় কাজটি করতে চাইবে না। দলটি স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়তা হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে। বাংলাদেশের মতো অধিক ঘনবসতিপূর্ণ ও কৃষিনির্ভর দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের একটা ঝুঁকি থাকবেই। ঝুঁকির বিষয়টি থাকা সত্ত্বেও সরকার এই সিদ্ধান্তটি নিল। কেননা আমাদের কাছে এই মুহূর্তে বিকল্প জ্বালানির কোনও উৎস নেই। গ্যাসসম্পদ সীমিত হয়ে আসার কারণে পারমাণবিক বিদ্যুৎই আমাদের ভরসা। তবে সরকারের যে কাজটি করা উচিত, তা হচ্ছে পারমাণবিক বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তার কথাটা স্থানীয় জনগণকে বোঝানো, যেন এখানে কোনও ধরনের আন্দোলনের জন্ম না হয়। উপরন্তু যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাদের চাকরির ব্যবস্থা করা এবং অন্যত্র জমি বরাদ্দের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। বাংলাদেশে জ্বালানিসম্পদের উৎস সীমিত হয়ে আসায়, বাংলাদেশ আগামী দশকে বড় ধরনের একটি জ্বালানি ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পারমাণবিক বিদ্যুৎ একটি ‘সমাধান’ হলেও সমস্যা রয়ে গেছে অনেক। তাই প্রধানমন্ত্রী যখন আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা বলেন, তখন আমাদের মাঝে নানা শঙ্কা কাজ করে। নিরাপত্তার বিষয়টি এখানে বড় গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে- এটা সত্য। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এ ক্ষেত্রে কোনও সমাধান নয়। আমাদের কয়লা রয়েছে। আমরা কয়লাসম্পদ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেতে পারি। এই বিষয়টির যত দ্রুত সমাধান করা যায়, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। Dainik Amader Somoy 15.05.14

ভারতের নির্বাচন থেকে যেসব প্রশ্নের জবাব মেলে না

ভারতে লোকসভা নির্বাচন শেষে ‘এক্সিট পোল’ বা বুথ ফেরত ভোটারদের মনোভাব শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদিকেই এগিয়ে রাখল। এতদিন ধরে বিভিন্ন জরিপে বিজেপি তথা এনডিএ জোট এগিয়ে থাকলেও বুথ ফেরত ভোটারদের ওপর পরিচালিত জরিপে তা আরও স্পষ্ট হল। সোমবার এনডিটিভি, টাইমস নাও, সিএনএন-আইবিএনসহ ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোয় প্রচারিত এক্সিট পোলে এনডিএ জোট ২৮৯ আসন (মোট আসন ৫৪৩) পাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যদিও কংগ্রেস এই এক্সিট পোলে অংশ নেয়নি। তাদের নেতৃবৃন্দ মন্তব্য করেছেন, ২০০৪ ও ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন শেষে বুথ জরিপ ফলাফল সত্য প্রমাণিত হয়নি। এবার বুথ জরিপের ফলাফল যদি সত্য হয়, তাহলে ১৯৮৪ সালে লোকসভায় মাত্র ২টি আসন পাওয়া বিজেপি এবার সর্বোচ্চ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। তবে ১৯৯৬ সালে একাদশ লোকসভা নির্বাচনের পর বিজেপি প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করেছিল। মাত্র ১৩ দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ি। তিনি ১৬ মে সরকার গঠন করে ১ জুন পদত্যাগ করেছিলেন। বিজেপি দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে ১৯৯৮ সালের ১৯ মার্চ, দ্বাদশ লোকসভা নির্বাচনের পর। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ লোকসভায় মোট ৬ বছর ৬৪ দিন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বাজপেয়ি। পরবর্তী চতুর্দশ ও পঞ্চদশ লোকসভায় কংগ্রেস বিজয়ী হয়ে ১০ বছর ক্ষমতায় থেকে গেলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। ১২ মে শেষ হয়েছে লোকসভা নির্বাচনের শেষ পর্ব। ফলাফল ঘোষণা করা হবে ১৬ মে। নানা কারণে এবারের নির্বাচন বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে শেষ হল। প্রথমত, এত বিপুলসংখ্যক ভোটার পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনে এর আগে অংশ নেননি। ভোটারদের নিয়ম-শৃংখলার মধ্যে আনা একটা কঠিন কাজ। ভারতীয় নির্বাচন কমিশন সেই কাজটি অত্যন্ত সূচারুভাবেই সম্পন্ন করেছে। অথচ ভারতে নির্বাচন কমিশনারের সংখ্যা মাত্র ৩। একটা ভয় ছিল, মাওবাদীরা কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নির্বাচন চলাকালীন বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে। সেটা ব্যাপকভাবে হয়নি। এমনকি বেশ ক’জন মাওবাদী নেতা এবার নির্বাচনেও অংশ নিয়েছেন (যেমন ঝাড়খণ্ডে কামেশ্বর বৈঠা, রঞ্জন যাদব প্রমুখ)। দ্বিতীয়ত, লোকসভা নির্বাচনে প্রায় প্রতিটি দলই সিনেমার নায়িকাদের প্রার্থী করেছে এবং নির্বাচনী প্রচারণায় এদের নিয়ে নেতারা অংশ নিয়েছেন। মজার ব্যাপার হল, নায়িকারা এবার বিজেপির দিকেই বেশি ঝুঁকেছেন। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, নায়িকারা যেখানে প্রার্থী হয়েছেন সেটা তার নিজের বা তার স্বামীর এলাকা নয়। তৃতীয়ত, এই নির্বাচনে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে। একটি গবেষণা সংস্থার মতে, এর পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি রুপির উপরে। খোদ বিজেপির নির্বাচনী বাজেট ১০ হাজার কোটি রুপি। বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যে দলগুলোকে চাঁদা দিয়েছে, তার হিসাবও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। চতুর্থত, এই প্রথমবারের মতো প্রার্থী তালিকায় কোটিপতির সংখ্যা আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ২০০৯ সালের নির্বাচনে কোটিপতি প্রার্থী ছিল মোট প্রার্থীর ১৭ শতাংশ। এবার তা বেড়েছে ২৭ শতাংশে। পঞ্চমত, বিজেপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী মোদি নির্বাচনী ভ্রমণ করেছেন তিন লাখ কিলোমিটার। অতীতে এমনটা কেউ করেননি। মোদির এ সফর শুধু মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীদের ভ্রমণের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ষষ্ঠত, এ নির্বাচনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ বারবার এসেছে, যা অতীতের কোনো নির্বাচনে দেখা যায়নি।শেষ দফা নির্বাচনের আগেও নরেন্দ্র মোদি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ভারতে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে (?) মন্তব্য করেছেন। মোদি সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের আর্থিক উন্নয়নে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক- সব দিক থেকে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা হবে। তাই বলে অনুপ্রবেশকারী আর বিদেশী নাগরিকদের রেশন কার্ড দিয়ে ভোটার তালিকায় নাম তুলতে দেয়া হবে না।’ এ ধরনের কথাবার্তা তিনি যে এই প্রথম বললেন, তা নয়। আগেও তিনি ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘শরণার্থী’- দু’ভাগে ভাগ করে তার ভাষায় বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের দেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলেছিলেন। তার এ বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।একজন সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী যখন এ ধরনের বাংলাদেশবিরোধী কথাবার্তা বলেন, তখন সঙ্গত কারণেই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নানা জটিলতায় আটকে আছে। সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ভারতের পঞ্চম বৃহৎ বাজারে পরিণত হয়েছে। সুতরাং ভারতের একটা বড় স্বার্থ রয়েছে এ দেশের ব্যাপারে। দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল বিষয় একটিই- ভারতের ‘মাইন্ড সেটআপ’। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে এ দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এটা কংগ্রেস কিংবা বিজেপি উভয় সরকারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ভারতে বিজেপি কেন, একটি ‘তৃতীয় শক্তি’ও যদি ক্ষমতায় আসে (আঞ্চলিক দলগুলোর নেতৃত্বে), তাহলেও বাংলাদেশকে ‘সমমর্যাদা না দেয়ার’ যে মানসিকতা, তাতে পরিবর্তন আসবে না। এমনকি একটি বড় দেশের পাশে একটি ছোট দেশ থাকলে, মেদভেদেভের (রাশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) ‘জোন অব প্রিভিলেজ ইন্টারেস্ট’-এর যে তত্ত্ব, সে ব্যাপারেও ভারতীয় মনোভাবে কোনো পরিবর্তন আসবে না। বাংলাদেশের বেশ ক’জন সিনিয়র কূটনীতিক রয়েছেন, যারা এখন ঢাকায় অবসর জীবনযাপন করছেন। কেউ কেউ নিয়মিত কলাম লিখছেন। তাদের অনেকে ভারতে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের প্রায় সবারই মতামত, ভারত যদি তার মানসিকতায় পরিবর্তন না আনে, তাহলে দু’দেশের মাঝে সম্পর্ক উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে একটা ভয়ের কারণ রয়েছে বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে। নির্বাচনী ইশতেহারে রামমন্দির (বাবরি মসজিদের জায়গায়) পুনর্নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। এটা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের একটা ভুল মেসেজ দিতে পারে। উগ্রবাদীরা এটাকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। বাংলাদেশে এদের সংখ্যা অনেক। যদিও প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার বলেছেন, ‘মোদি প্রধানমন্ত্রী হলেও তা বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকির কারণ হবে না’, কিন্তু তার এ বক্তব্য বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।বাংলাদেশে বিশ্লেষকদের সবাই মোদির বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। তবে এটিও বলা প্রয়োজন, ভারতে কেউ বাংলা ভাষায় কথা বললেই সে বাংলাদেশী নয়। তারা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি। বাংলা ভাষাভাষীদের বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করা যাবে না। ঢাকায় এক সেমিনারে কূলদীপ নায়ার ‘দক্ষিণ এশিয়ায় অভিন্ন বাজার’ চালুর কথা বলেছেন। কিন্তু ‘সাফটা’ আজও কার্যকর হয়নি। সার্কের অনুন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার কথা, তা বাংলাদেশ ভারতে পায় না। ট্যারিফ আর প্যারা-ট্যারিফের কারণে বাংলাদেশী পণ্য ভারতে বাজার পাচ্ছে না। অথচ চাহিদা আছে প্রচুর। এখন ‘অভিন্ন বাজার’ বা দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন হলে বাংলাদেশসহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় পণ্যের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রতিযোগিতায় আমরা আমাদের পণ্য নিয়ে দাঁড়াতে পারব না। ঢাকার কোনো কোনো বিশ্লেষক দু’দেশের সম্পর্ককে ‘শর্ট টার্ম, লং টার্ম ও মিডিয়াম টার্মে’ ভাগ করার কথা বলেছেন! অথচ তারা ভুলে গেছেন, সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘সীমিত’ বা ‘দীর্ঘস্থায়ী বন্দোবস্ত’ বলে কিছু নেই। আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আমাদের অবস্থান স্থায়ী। এখানে মধ্যবর্তী কোনো সমাধান নেই।ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বাংলাদেশী অভিবাসীদের প্রসঙ্গটি এনেছে। অথচ ভারতীয় গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছিল, বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ (জনান্তিকে ১০ লাখ) ভারতীয় অবৈধভাবে কাজ করেন (গার্মেন্ট, টেক্সটাইল, আইটি সেক্টরে)। তারা বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা পাঠান, তাও অবৈধভাবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ১৬২টি ছিটমহলের বাসিন্দারা (১১১টি ভারতীয় যা বাংলাদেশে, ৫১টি বাংলাদেশী যা ভারতে অবস্থিত) মানবেতর জীবনযাপন করছেন এবং ভারতীয় মন্ত্রিসভায় হস্তান্তর প্রক্রিয়া অনুমোদিত হলেও শুধু বিজেপির বিরোধিতার কারণে তা ভারতীয় সংবিধানের অংশ হতে পারেনি। এ ‘মানবাধিকার লংঘনের’ বিষয়টিও নির্বাচনী প্রচারণায় উচ্চারিত হল না। উল্লেখ্য, ভারত বর্তমানে জাপানকে হটিয়ে দিয়ে বিশ্বের তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তি (২০১১)। আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ভারত দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে। তখন দেশটির মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলার (বর্তমানে ৯৪০ ডলার)। বিশ্ব অর্থনীতিতে তখন ভারত অবদান রাখবে শতকরা ১৭ ভাগ। এ থেকে আমরাও উপকৃত হতে পারি। এ কথাটাও আমরা যেন ভুলে না যাই। ভারতে দরিদ্রতা একটা প্রধান সমস্যা। ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৭.০৫ ভাগ, অথচ ২০০৪ সালে ছিল ২৭.৫০ ভাগ। অর্থাৎ দারিদ্র্য বেড়েছে। সুতরাং বাংলাদেশীদের সেদেশে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না কাজের জন্য।তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি বহুল আলোচিত। ফারাক্কা নিয়েও পুনঃআলোচনার সময় এসেছে। মোদি ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে তার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। টিপাইমুখ ও ফুলেরতল ব্যারাজ নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। কোনো একটি ক্ষেত্রেও আমরা পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারিনি। ভারতীয় নেতারা আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। সেই আশ্বাস আশ্বাসই থেকে গেছে। বাস্তবতায় আমরা দেখেছি ভিন্ন জিনিস। সুতরাং সম্ভাব্য বিজেপি সরকার এই নীতিতে পরিবর্তন আনবে বলে মনে হয় না।
নিঃসন্দেহে ভারতের নতুন সরকারের দিকে দৃষ্টি থাকবে অনেকের। মোদি সরকার গঠন করতে পারবেন না (কূলদীপ নায়ার)- এ কথার পেছনে যেমন কিছু হলেও যুক্তি রয়েছে, ঠিক তেমনি ভোল পাল্টে মমতা ব্যানার্জি (পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিশেষ প্যাকেজের প্রস্তাব দিয়েছেন বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিং) কিংবা জয়ললিতা যে মোদিকে সমর্থন করবেন না- এটাও স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তাই দু’দেশের বিশ্লেষকরা যখন বলেন, ‘পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ও আলোচনার মধ্য দিয়ে সম্পর্ক জোরদার করা যেতে পারে’, ‘তিস্তা সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত’, ‘রাজনৈতিক অবিশ্বাস রয়েছে’, ‘নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে ভারতকে’, তখন এটা দিব্যি দিয়েই বলা যায়, এসব বক্তব্য কাগজ-কলমেই থেকে যাবে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা আমাদের সব সময় আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি কিছুই। মনমোহন সিংয়ের মতো প্রধানমন্ত্রী ‘কোনো সীমান্ত হত্যা হবে না’- এ আশ্বাস দেয়ার পরও সে কথার প্রতি সম্মান দেখায়নি বিএসএফ। ভারতীয় রাজনীতিকরা চাইলেও(?) ভারতীয় আমলারা বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখেন না। তারা বাংলাদেশ থেকে কীভাবে সুবিধা আদায় করে নেয়া যায়, সেদিকেই দৃষ্টি দেন বেশি। অথচ ভারতের উন্নয়ন থেকে আমরাও উপকৃত হতে পারি। আমরাও হতে পারি ভারতের উন্নয়নের অংশীদার। কিন্তু ভারতের মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে তাহলে মোদি কেন, তৃতীয় শক্তি হিসেবে মমতা, জয়ললিতা, মুলায়ম সিং যিনিই প্রধানমন্ত্রী হোন না কেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতীয় নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। কোনো একটি ক্ষেত্রে সমাধান হবে- এ আস্থাটা রাখতে পারছি না।ভারতের এ নির্বাচন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই। অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি নয়াদিল্লির দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে, যদি সেখানে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত। সরকার পরিবর্তন হলেও নীতির পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয় যে নীতি, তাতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিগত পাঁচ-ছয় বছর ভারত যে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে কিংবা যে নীতি তারা অবলম্বন করেছে, তা অব্যাহত থাকবে। Daily JUGANTOR 14.05.14

বিদ্যুৎ নিয়ে ভাবনাটা জরুরি

পুরোপুরি গ্রীষ্ম মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই বড় ধরনের বিদ্যুৎ ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশ। দিনের বেলায় একাধিকবার এখন লোডশেডিং হয়। চাহিদা বাড়ছে; কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে কম। অথচ ব্যয়বহুল ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ওপর নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে এ খাতে সরকারের দেয়া ভর্তুকির পরিমাণ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গেল বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে এটি কিছুটা কমে ২৬৭ কোটি টাকায় কমালেও ফেব্রুয়ারিতে ফের বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮৭ কোটি টাকায়। গত এপ্রিলে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪১৬ কোটি টাকা। যেহেতু বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে, সে কারণে ভর্তুকির পরিমাণ কমে যাওয়ার সম্ভাবনাও কম। কারণ জনগণের চাহিদা মেটাতে বাড়তি ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ওপর যে নির্ভরশীলতা, তা এক রকম থেকেই যাচ্ছে। বিদ্যুৎ আমাদের প্রয়োজন। সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় এখন বিদ্যুৎ শীর্ষে থাকা উচিত। গ্যাসের রিজার্ভ ফুরিয়ে আসছে এবং নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্রও আবিষ্কৃত হচ্ছে না। সুতরাং গ্যাসনির্ভর যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জাপানের ফুকুসিমার দুর্ঘটনার পর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়েও কথা উঠেছে। তাই ভরসা এখন কয়লা। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পাঁচটি কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন, যা ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য (উত্তোলনযোগ্য ২০ টিসিএফ)। এতে ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি চাহিদা পূরণ সক্ষম। উত্তরাঞ্চলের বড়পুকুরিয়ায় ছয়টি কয়লা স্তর (১১৯ থেকে ৫৬০ মিটার গভীরে) পাওয়া গেছে, যার মজুদের পরিমাণ ৬০৩ মিলিয়ন টন। বর্তমানে এ কয়লা খনিটি ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতির মাধ্যমে উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে। বড়পুকুরিয়া ছাড়াও জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে কয়লা পাওয়া গেছে। অথচ সরকার ভারত থেকে কয়লা আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশনের সঙ্গে পিডিবির চুক্তি হয়েছে। ভারতীয় কয়লায় চট্টগ্রাম ও খুলনায় দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। ব্যয় হবে ২১ হাজার কোটি টাকা। শুধু তাই নয় বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকেও যাচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ রাশিয়ার পরমাণু জ্বালানি সহযোগিতা সংস্থা রোসাটমের সঙ্গে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের একটি চুক্তি করেছে। পাবনার রূপপুরে এটি তৈরি হবে। ২০২০ সাল নাগাদ সেখান থেকে আমরা পারমাণবিক বিদ্যুৎ পাব। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশী টাকায় ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সমান। যদি রিস্ক ফ্যাক্টরকে বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ সস্তা নয়। এখানে নিরাপত্তা ঝুঁকিটা সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞান এখনও সেই নিরাপত্তার পূর্ণ গ্যারান্টি দিতে পারেনি। ১৯৮৬ সালে আজকের ইউক্রেনের চেরনোবিল পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর ২০১১ সালে জাপানের ফুকুসিমায় যখন পারমাণবিক চুলি্লতে বিস্ফোরণ ঘটে, তখন বুঝতে হবে বিজ্ঞান এখনও পারমাণবিক চুলি্লর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রযুক্তি খুঁজে পায়নি। বাংলাদেশের মতো একটি জনঘনত্বপূর্ণ দেশে, যেখানে নিজস্ব দক্ষ জনশক্তি নেই, সেখানে একটি পারমাণবিক কেন্দ্রের নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করব কীভাবে? জাপানের ফুকুসিমায় বিস্ফোরণের পর রেডিয়েশনের মাত্রা বেড়েছিল ৫-এ। চেরনোবিলের রেডিয়েশনের মাত্রা ছিল ৭, আর যুক্তরাষ্ট্রের থ্রিমাইল আয়ল্যান্ডে বিস্ফোরণের পর রেডিয়েশনের মাত্রা ছিল ৫। পরিসংখ্যান বলছে, চেরনোবিল বিস্ফোরণের পর ওই অঞ্চলে ক্যান্সারের প্রকোপ বেড়েছিল ৪০ ভাগ। শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী বেলারুশের কৃষি পণ্য উৎপাদন ও রফতানিতে মারাত্মক ধস নেমেছিল। চেরনোবিলের বিস্ফোরণের পর পুরো নিউক্লিয়ার প্লান্ট তো বটেই, ওই গ্রামের একটা বড় অংশই মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু জার্মান সাংবাদিক আন্দ্রেই ক্রেমেনশক ২০১১ সালের মার্চে চেরনোবিলের আশপাশের এলাকা সফর করে তার প্রতিবেদনে লেখেন, মাটিচাপা দেয়ার পরও সেখান থেকে তেজস্ক্রিয়তা বেরুচ্ছে। ২০১১ সালের ১৭ মার্চ ঋড়ৎবরমহ চড়ষরপু ম্যাগাজিনে চার্লস হোম্যানস যে প্রবন্ধটি লিখেছিলেন (অঃড়সরপ উড়মং) তাতে তিনি বুলগেরিয়া, তুরস্ক, আর্মেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ঝুঁকির মাত্রা ও অব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তার প্রবন্ধে উল্লেখ করা আছে, তুরস্কের একাধিক পারমাণবিক প্লান্ট প্রতিবাদ ও দুর্ঘটনার পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রাশিয়ার জাপানি (যারা বাংলাদেশেও প্লান্ট তৈরি করার দায়িত্ব পেয়েছে) রোসাটোম ওইসব প্লান্ট (আক্কুজু-তে) তৈরি করেছিল। বুলগেরিয়ায় কোজলোডুইতে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তা ১৯৯৫ সালেই যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। আর্মেনিয়ার মেটসামোরে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের আপত্তির মুখে ও ঝুঁকি এড়াতে ১৯৮৯ সালে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। জাপানের 'সিকা'য় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও ১৯৯৯ সালে দুর্ঘটনার পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তবে এটাও সত্য, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঝুঁকির মুখে থাকলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে চীনে ২৭টি, রাশিয়ায় ১১টি ও ভারতে ৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। একই সঙ্গে পরিকল্পনা আছে চীনে আরও ৩০টি, ভারতে ১৮টি, জাপানে ১২টি, রাশিয়ায় ১৪টি ও যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার। তবে জাপান সেই পরিকল্পনা ফুকুসিমার পর স্থগিত করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কিন্তু খুব বড় অবদান রাখছে না। আন্তর্জাতিক এনার্জি এজেন্সির মতে, পারমাণবিক বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে শতকরা ৬ ভাগ হারে। বর্তমানে বিশ্বে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তার ১৩.৫ ভাগই পরমাণু শক্তি থেকে। এগুলো সবই উন্নত দেশে অবস্থিত। বিশ্বে ২৮টি পরমাণুভিত্তিক ৪২০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এর মাঝে ফ্রান্সে ৫৯টি। ফ্রান্সে মোট বিদ্যুতের ৭৯ শতাংশ উৎপাদিত হয় পরমাণু শক্তি থেকে। বেলজিয়ামে বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে ৫৮টি। দেশটির মোট বিদ্যুতের ৫৮ ভাগই পারমাণবিক। সুইডেনে ৪৪ ভাগ, কোরিয়ায় ৪০ ভাগ, জাপানে ৫৫ ভাগ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২০ ভাগ বিদ্যুৎ পরমাণু শক্তিনির্ভর। তবে ফুকুসিমার পর জাপান নতুন করে চিন্তাভাবনা করছে এবং বিকল্প শক্তির কথা চিন্তা করছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে চীনে ৯ হাজার, ভারত ৪ হাজার ১২০ ও পাকিস্তানে ৪২৫ মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। ২০২০ সালের মধ্যে চীন ৪০ হাজার, ভারত ২০ হাজার ও পাকিস্তান ৭ হাজার মেগাওয়াটের পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে। অনেকেই জানেন পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমতি নিতে হয়। বাংলাদেশ এ অনুমতি পেয়েছিল ২০০৭ সালের জুন মাসে। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভয়টা হচ্ছে এর রক্ষণাবেক্ষণ। দক্ষ জনশক্তি আমাদের নেই। এর অর্থ দীর্ঘদিন রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা আমাদের থেকে যাবে। দ্বিতীয় আরেকটি সমস্যা হচ্ছে জনবসতির ঘনত্ব। রূপপুরে যেখানে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, সেখানে আশপাশে জনবসতি রয়েছে। এ জনবসতি অপসারণ করা হবে একটি বড় সমস্যা। এছাড়া বাংলাদেশে এমন কোনো বিরান এলাকা নেই, যেখানে কেন্দ্রটি স্থাপন করা যায়। আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। আগামী ২০২০ সালে বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১৬ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াটে। তখন এ চাহিদা আমরা মেটাব কীভাবে? সম্ভবত পারমাণবিক বিদ্যুৎ ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের কয়লার একটা সম্ভাবনা থাকলেও সেখানে একটা 'রাজনীতি' ঢুকে গেছে। কয়লা উত্তোলনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে স্থানীয় জনগণের স্বার্থ। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুললে কয়লা খনির সর্বোচ্চ ব্যবহার আমরা নিশ্চিত করতে পারব বটে; কিন্তু বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে স্থানান্তরিত করতে হবে। উপরন্তু ভূগর্ভস্থ বিপুল পানি অপসারণ করতে হবে। তাতে করে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে। কোনো জনপ্রিয় সরকারই এ অপ্রিয় কাজটি করতে চাইবে না। দলটি স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়তা হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে। বাংলাদেশের মতো অধিক ঘনবসতিপূর্ণ ও কৃষিনির্ভর দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের একটা ঝুঁকি থাকবেই। ঝুঁকির বিষয়টি থাকা সত্ত্বেও সরকার এ সিদ্ধান্তটি নিয়েছে। কেননা আমাদের কাছে এ মুহূর্তে বিকল্প জ্বালানির কোনো উৎস নেই। গ্যাস সম্পদ সীমিত হয়ে আসার কারণে আমাদের কাছে বিকল্প তেমন কিছু নেই কয়লা ছাড়া। কয়লা পরিবেশ নষ্ট করে এটা সত্য। কিন্তু সম্ভাবনা প্রচুর। কিন্তু দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, কয়লার সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। কয়লা উত্তোলন নিয়ে যে জটিলতা, সে জটিলতা এখনও দূর হয়নি। তবে একটি আশার কথা শুনিয়েছিল জাতীয় সংসদের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কমিটির বৈঠকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে মত দেয়া হয়েছিল। তারা কয়লানীতি দ্রুত চূড়ান্ত করারও সুপারিশ করেছিলেন। তারপর তেমন কিছু আর শোনা যায়নি। এখন দশম সংসদে আরেকটি কমিটি গঠিত হয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি এবং যেখানে দেশে প্রচুর কয়লা সম্পদ রয়েছে, সেখানে বিদেশ থেকেই (ভারত) কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত_ এ প্রশ্ন করাই যায়। এতে করে ভারতের ওপর এক ধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি হতে পারে। আগামীতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে যদি অবনতি ঘটে তাহলে এ কয়লা আমদানির ওপর তা কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা, আমরা তা জানি না। বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুটি নির্মাণে যে ব্যয় হবে, তা দেশ দুটো সমানভাবে ভাগ করে নেবে। এক্ষেত্রে ভারত যা ব্যয় করবে তা তুলে নেবে কীভাবে? এ চুক্তিটি বহাল থাকবে কত বছরের জন্য? এসব বিষয় বিস্তারিত জানা দরকার। এটা ভালো হয় যদি তা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়। এতে করে বিরোধী দলের অংশগ্রহণের একটি সুযোগ তৈরি হবে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের বিরোধী দলের এবং জাতীয় কমিটির নেতারা এটা জানার সুযোগ পাবেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুটোর জন্য যে কয়লার প্রয়োজন তা আমরা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করতে পারতাম কিনা? দ্বিতীয়ত, চুক্তিতে যেসব শর্ত রাখা হয়েছে, তা বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতিকূলে কিনা? তৃতীয়ত, ভারতীয় ঋণ শোধ করার প্রক্রিয়াটি কী? চতুর্থত, যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে কোনো 'তৃতীয় পক্ষ'-এর উপস্থিতি রয়েছে কিনা? এরই মধ্যে রামপালে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নিয়ে পরিবেশবাদীরা বড় আন্দোলন শুরু করেছেন। ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ সঙ্কটে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ আমাদের জন্য একটি 'আশার আলো'। কিন্তু যেহেতু দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে, সেহেতু এ চুক্তি যেন আমাদের 'গলার কাঁটা' হয়ে না দাঁড়ায়! একই সঙ্গে অতীতে সংসদীয় কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার যে সুপারিশ করেছিল, আমি তাকে স্বাগত জানাই। তবে ফুলবাড়ীর মানুষের কথা মনে রাখতে হবে। কয়লা সম্পদের ভাগিদার তারাও। তাদের পুনর্বাসনই শুধু নয়, চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। ফুলবাড়ীর কয়লা সম্পদের 'হক' তাদের আছে। এ 'হক' থেকে তাদের আমরা বঞ্চিত করতে পারি না। রাষ্ট্র এ অঞ্চলের সম্পদ জাতীয় উন্নয়নে ব্যয় করবে, এটা যেমন সত্য, তেমনি রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা। দেশে এরই মধ্যে একটি 'জাতীয় কমিটি' গঠিত হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরেই দেশের জ্বালানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়ে তাদের বক্তব্য দিয়ে আসছেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলাটাও জরুরি। তবে এটা ঠিক, বাংলাদেশের কয়লা ব্যবহার না করে কেন ভারতীয় কয়লা আমদানি করব_ এর একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। কেননা আমরা জানি ভারতীয় কয়লায় পরিবেশ দূষণ হয় সবচেয়ে বেশি। সে তুলনায় আমাদের কয়লার মান অনেক ভালো। মনে রাখতে হবে, যেখানে সারা বিশ্বে, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৭৯ শতাংশ, চীনে ৭৮ শতাংশ, জার্মানিতে ৪৯ শতাংশ কিংবা ভারতে ৬৯ শতাংশ, সেখানে আমাদের কয়লা সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমরা তা ব্যবহার করতে পারছি না। বাংলাদেশে ২০১৪ সালের শেষের দিকে বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১৫ হাজার মেগাওয়াট আর ২০২০ সালে ১৬ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াট, তখন কয়লা ছাড়া আমাদের কোনো 'বিকল্প' নেই। গ্যাস সম্পদ ফুরিয়ে আসছে। গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলন নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা। সে ক্ষেত্রে কয়লা সম্পদ আমাদের জন্য একটি ভরসা। কিন্তু এ কয়লা সম্পদকে ব্যবহার না করে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কয়লা আমদানি করলে বিতর্ক তো বাড়বেই। আমরা চাই এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হোক। আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে চাই। কিন্তু পরনির্ভরশীল হতে চাই না। বিদ্যুৎকে আমি অনেকটা মানবাধিকারের সঙ্গে তুলনা করতে চাই। অর্থাৎ এটা অনেকটা অধিকারের মতো। রাষ্ট্র আমাদের বিদ্যুৎ দেবে। শুধু উৎপাদন কাজেই বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয় তা নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ছাড়া আমরা অচল। জ্বালানি আজ বিশ্বের অন্যতম একটি সমস্যা। সস্তায় তেল পাওয়ার দিন ফুরিয়ে গেছে। আমরা বর্তমানে এক ধরনের 'অয়েল শক'-এ আক্রান্ত। তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের সর্বোচ্চ পয়েন্টটিতে আমরা পেঁৗছে গেছি। এখন সাপ্লাই কমে গেছে বিশ্ববাজারে, যাতে করে দাম বেড়ে যাচ্ছে। গত ৪০ বছর ধরে নতুন নতুন তেল খনি আবিষ্কারের হার পড়তির দিকে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য জ্বালানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত জনসংখ্যা, উন্নয়নের চাপ, কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা ইত্যাদি নানা কারণে বাংলাদেশের জ্বালানি পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। তেলের দুষ্প্রাপ্যতা ও দামের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাসকূপগুলো নিঃশেষ হয়ে যাওয়া এবং বিকল্প জ্বালানি উদ্ভাবনে ব্যর্থতা বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে একটি বড় ধরনের সঙ্কটে ফেলবে। বাংলাদেশ এ 'অয়েল শক' কাটিয়ে উঠতে পারবে না। তাই এখন থেকেই বিকল্প জ্বালানির কথা ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে পরমাণু জ্বালানি কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্তটি ভালো। তবে এর নেতিবাচক দিকগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। শুধু কেন্দ্র নির্মাণ করলেই চলবে না, রসদ সরবরাহ নিশ্চিত করা, ওই দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশের মনোভাবও বিবেচনায় নিতে হবে। রূপপুরে একাধিক 'রিস্ক ফ্যাক্টর' রয়ে গেছে। নদীর একেবারে পার্শ্ববর্তী এ রূপপুর। চেরনোবিল ও ফুকুসিমা আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। চেরনোবিলের দুর্ঘটনাকবলিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই এলাকা আজও নিরাপদ নয়। আর ফুকুসিমার দুর্ঘটনার পর ওই এলাকার আশপাশের এলাকা পূর্ণ 'সিল' করে দেয়া হয়েছে। জার্মানি কয়েকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। বিষয়গুলো আমাদের নীতিনির্ধারকরা বিবেচনায় নিলে ভালো করবেন। Daily Alokito Bangladesh 14.05.14