রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিদ্যুৎ নিয়ে ভাবনাটা জরুরি

পুরোপুরি গ্রীষ্ম মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই বড় ধরনের বিদ্যুৎ ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশ। দিনের বেলায় একাধিকবার এখন লোডশেডিং হয়। চাহিদা বাড়ছে; কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে কম। অথচ ব্যয়বহুল ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ওপর নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে এ খাতে সরকারের দেয়া ভর্তুকির পরিমাণ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গেল বছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে এটি কিছুটা কমে ২৬৭ কোটি টাকায় কমালেও ফেব্রুয়ারিতে ফের বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮৭ কোটি টাকায়। গত এপ্রিলে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪১৬ কোটি টাকা। যেহেতু বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে, সে কারণে ভর্তুকির পরিমাণ কমে যাওয়ার সম্ভাবনাও কম। কারণ জনগণের চাহিদা মেটাতে বাড়তি ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ওপর যে নির্ভরশীলতা, তা এক রকম থেকেই যাচ্ছে। বিদ্যুৎ আমাদের প্রয়োজন। সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় এখন বিদ্যুৎ শীর্ষে থাকা উচিত। গ্যাসের রিজার্ভ ফুরিয়ে আসছে এবং নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্রও আবিষ্কৃত হচ্ছে না। সুতরাং গ্যাসনির্ভর যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জাপানের ফুকুসিমার দুর্ঘটনার পর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়েও কথা উঠেছে। তাই ভরসা এখন কয়লা। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পাঁচটি কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন, যা ৭৩ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য (উত্তোলনযোগ্য ২০ টিসিএফ)। এতে ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি চাহিদা পূরণ সক্ষম। উত্তরাঞ্চলের বড়পুকুরিয়ায় ছয়টি কয়লা স্তর (১১৯ থেকে ৫৬০ মিটার গভীরে) পাওয়া গেছে, যার মজুদের পরিমাণ ৬০৩ মিলিয়ন টন। বর্তমানে এ কয়লা খনিটি ভূগর্ভস্থ খনন পদ্ধতির মাধ্যমে উন্নয়নের পর্যায়ে রয়েছে। বড়পুকুরিয়া ছাড়াও জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে কয়লা পাওয়া গেছে। অথচ সরকার ভারত থেকে কয়লা আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে। ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশনের সঙ্গে পিডিবির চুক্তি হয়েছে। ভারতীয় কয়লায় চট্টগ্রাম ও খুলনায় দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। ব্যয় হবে ২১ হাজার কোটি টাকা। শুধু তাই নয় বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকেও যাচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ রাশিয়ার পরমাণু জ্বালানি সহযোগিতা সংস্থা রোসাটমের সঙ্গে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের একটি চুক্তি করেছে। পাবনার রূপপুরে এটি তৈরি হবে। ২০২০ সাল নাগাদ সেখান থেকে আমরা পারমাণবিক বিদ্যুৎ পাব। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশী টাকায় ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সমান। যদি রিস্ক ফ্যাক্টরকে বিবেচনায় নেয়া হয়, তাহলে পারমাণবিক বিদ্যুৎ সস্তা নয়। এখানে নিরাপত্তা ঝুঁকিটা সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞান এখনও সেই নিরাপত্তার পূর্ণ গ্যারান্টি দিতে পারেনি। ১৯৮৬ সালে আজকের ইউক্রেনের চেরনোবিল পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর ২০১১ সালে জাপানের ফুকুসিমায় যখন পারমাণবিক চুলি্লতে বিস্ফোরণ ঘটে, তখন বুঝতে হবে বিজ্ঞান এখনও পারমাণবিক চুলি্লর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রযুক্তি খুঁজে পায়নি। বাংলাদেশের মতো একটি জনঘনত্বপূর্ণ দেশে, যেখানে নিজস্ব দক্ষ জনশক্তি নেই, সেখানে একটি পারমাণবিক কেন্দ্রের নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করব কীভাবে? জাপানের ফুকুসিমায় বিস্ফোরণের পর রেডিয়েশনের মাত্রা বেড়েছিল ৫-এ। চেরনোবিলের রেডিয়েশনের মাত্রা ছিল ৭, আর যুক্তরাষ্ট্রের থ্রিমাইল আয়ল্যান্ডে বিস্ফোরণের পর রেডিয়েশনের মাত্রা ছিল ৫। পরিসংখ্যান বলছে, চেরনোবিল বিস্ফোরণের পর ওই অঞ্চলে ক্যান্সারের প্রকোপ বেড়েছিল ৪০ ভাগ। শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী বেলারুশের কৃষি পণ্য উৎপাদন ও রফতানিতে মারাত্মক ধস নেমেছিল। চেরনোবিলের বিস্ফোরণের পর পুরো নিউক্লিয়ার প্লান্ট তো বটেই, ওই গ্রামের একটা বড় অংশই মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু জার্মান সাংবাদিক আন্দ্রেই ক্রেমেনশক ২০১১ সালের মার্চে চেরনোবিলের আশপাশের এলাকা সফর করে তার প্রতিবেদনে লেখেন, মাটিচাপা দেয়ার পরও সেখান থেকে তেজস্ক্রিয়তা বেরুচ্ছে। ২০১১ সালের ১৭ মার্চ ঋড়ৎবরমহ চড়ষরপু ম্যাগাজিনে চার্লস হোম্যানস যে প্রবন্ধটি লিখেছিলেন (অঃড়সরপ উড়মং) তাতে তিনি বুলগেরিয়া, তুরস্ক, আর্মেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ঝুঁকির মাত্রা ও অব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তার প্রবন্ধে উল্লেখ করা আছে, তুরস্কের একাধিক পারমাণবিক প্লান্ট প্রতিবাদ ও দুর্ঘটনার পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রাশিয়ার জাপানি (যারা বাংলাদেশেও প্লান্ট তৈরি করার দায়িত্ব পেয়েছে) রোসাটোম ওইসব প্লান্ট (আক্কুজু-তে) তৈরি করেছিল। বুলগেরিয়ায় কোজলোডুইতে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তা ১৯৯৫ সালেই যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। আর্মেনিয়ার মেটসামোরে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের আপত্তির মুখে ও ঝুঁকি এড়াতে ১৯৮৯ সালে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। জাপানের 'সিকা'য় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও ১৯৯৯ সালে দুর্ঘটনার পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তবে এটাও সত্য, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঝুঁকির মুখে থাকলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে চীনে ২৭টি, রাশিয়ায় ১১টি ও ভারতে ৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। একই সঙ্গে পরিকল্পনা আছে চীনে আরও ৩০টি, ভারতে ১৮টি, জাপানে ১২টি, রাশিয়ায় ১৪টি ও যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার। তবে জাপান সেই পরিকল্পনা ফুকুসিমার পর স্থগিত করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কিন্তু খুব বড় অবদান রাখছে না। আন্তর্জাতিক এনার্জি এজেন্সির মতে, পারমাণবিক বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে শতকরা ৬ ভাগ হারে। বর্তমানে বিশ্বে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় তার ১৩.৫ ভাগই পরমাণু শক্তি থেকে। এগুলো সবই উন্নত দেশে অবস্থিত। বিশ্বে ২৮টি পরমাণুভিত্তিক ৪২০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এর মাঝে ফ্রান্সে ৫৯টি। ফ্রান্সে মোট বিদ্যুতের ৭৯ শতাংশ উৎপাদিত হয় পরমাণু শক্তি থেকে। বেলজিয়ামে বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে ৫৮টি। দেশটির মোট বিদ্যুতের ৫৮ ভাগই পারমাণবিক। সুইডেনে ৪৪ ভাগ, কোরিয়ায় ৪০ ভাগ, জাপানে ৫৫ ভাগ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২০ ভাগ বিদ্যুৎ পরমাণু শক্তিনির্ভর। তবে ফুকুসিমার পর জাপান নতুন করে চিন্তাভাবনা করছে এবং বিকল্প শক্তির কথা চিন্তা করছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে চীনে ৯ হাজার, ভারত ৪ হাজার ১২০ ও পাকিস্তানে ৪২৫ মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। ২০২০ সালের মধ্যে চীন ৪০ হাজার, ভারত ২০ হাজার ও পাকিস্তান ৭ হাজার মেগাওয়াটের পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করবে। অনেকেই জানেন পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমতি নিতে হয়। বাংলাদেশ এ অনুমতি পেয়েছিল ২০০৭ সালের জুন মাসে। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভয়টা হচ্ছে এর রক্ষণাবেক্ষণ। দক্ষ জনশক্তি আমাদের নেই। এর অর্থ দীর্ঘদিন রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা আমাদের থেকে যাবে। দ্বিতীয় আরেকটি সমস্যা হচ্ছে জনবসতির ঘনত্ব। রূপপুরে যেখানে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, সেখানে আশপাশে জনবসতি রয়েছে। এ জনবসতি অপসারণ করা হবে একটি বড় সমস্যা। এছাড়া বাংলাদেশে এমন কোনো বিরান এলাকা নেই, যেখানে কেন্দ্রটি স্থাপন করা যায়। আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। আগামী ২০২০ সালে বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১৬ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াটে। তখন এ চাহিদা আমরা মেটাব কীভাবে? সম্ভবত পারমাণবিক বিদ্যুৎ ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের কয়লার একটা সম্ভাবনা থাকলেও সেখানে একটা 'রাজনীতি' ঢুকে গেছে। কয়লা উত্তোলনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে স্থানীয় জনগণের স্বার্থ। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুললে কয়লা খনির সর্বোচ্চ ব্যবহার আমরা নিশ্চিত করতে পারব বটে; কিন্তু বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে স্থানান্তরিত করতে হবে। উপরন্তু ভূগর্ভস্থ বিপুল পানি অপসারণ করতে হবে। তাতে করে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে। কোনো জনপ্রিয় সরকারই এ অপ্রিয় কাজটি করতে চাইবে না। দলটি স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়তা হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে। বাংলাদেশের মতো অধিক ঘনবসতিপূর্ণ ও কৃষিনির্ভর দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের একটা ঝুঁকি থাকবেই। ঝুঁকির বিষয়টি থাকা সত্ত্বেও সরকার এ সিদ্ধান্তটি নিয়েছে। কেননা আমাদের কাছে এ মুহূর্তে বিকল্প জ্বালানির কোনো উৎস নেই। গ্যাস সম্পদ সীমিত হয়ে আসার কারণে আমাদের কাছে বিকল্প তেমন কিছু নেই কয়লা ছাড়া। কয়লা পরিবেশ নষ্ট করে এটা সত্য। কিন্তু সম্ভাবনা প্রচুর। কিন্তু দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, কয়লার সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। কয়লা উত্তোলন নিয়ে যে জটিলতা, সে জটিলতা এখনও দূর হয়নি। তবে একটি আশার কথা শুনিয়েছিল জাতীয় সংসদের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। কমিটির বৈঠকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পক্ষে মত দেয়া হয়েছিল। তারা কয়লানীতি দ্রুত চূড়ান্ত করারও সুপারিশ করেছিলেন। তারপর তেমন কিছু আর শোনা যায়নি। এখন দশম সংসদে আরেকটি কমিটি গঠিত হয়েছে। এই যখন পরিস্থিতি এবং যেখানে দেশে প্রচুর কয়লা সম্পদ রয়েছে, সেখানে বিদেশ থেকেই (ভারত) কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত_ এ প্রশ্ন করাই যায়। এতে করে ভারতের ওপর এক ধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি হতে পারে। আগামীতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে যদি অবনতি ঘটে তাহলে এ কয়লা আমদানির ওপর তা কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা, আমরা তা জানি না। বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুটি নির্মাণে যে ব্যয় হবে, তা দেশ দুটো সমানভাবে ভাগ করে নেবে। এক্ষেত্রে ভারত যা ব্যয় করবে তা তুলে নেবে কীভাবে? এ চুক্তিটি বহাল থাকবে কত বছরের জন্য? এসব বিষয় বিস্তারিত জানা দরকার। এটা ভালো হয় যদি তা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়। এতে করে বিরোধী দলের অংশগ্রহণের একটি সুযোগ তৈরি হবে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের বিরোধী দলের এবং জাতীয় কমিটির নেতারা এটা জানার সুযোগ পাবেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুটোর জন্য যে কয়লার প্রয়োজন তা আমরা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করতে পারতাম কিনা? দ্বিতীয়ত, চুক্তিতে যেসব শর্ত রাখা হয়েছে, তা বাংলাদেশের স্বার্থের প্রতিকূলে কিনা? তৃতীয়ত, ভারতীয় ঋণ শোধ করার প্রক্রিয়াটি কী? চতুর্থত, যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তাতে কোনো 'তৃতীয় পক্ষ'-এর উপস্থিতি রয়েছে কিনা? এরই মধ্যে রামপালে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নিয়ে পরিবেশবাদীরা বড় আন্দোলন শুরু করেছেন। ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ সঙ্কটে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ আমাদের জন্য একটি 'আশার আলো'। কিন্তু যেহেতু দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে, সেহেতু এ চুক্তি যেন আমাদের 'গলার কাঁটা' হয়ে না দাঁড়ায়! একই সঙ্গে অতীতে সংসদীয় কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার যে সুপারিশ করেছিল, আমি তাকে স্বাগত জানাই। তবে ফুলবাড়ীর মানুষের কথা মনে রাখতে হবে। কয়লা সম্পদের ভাগিদার তারাও। তাদের পুনর্বাসনই শুধু নয়, চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। ফুলবাড়ীর কয়লা সম্পদের 'হক' তাদের আছে। এ 'হক' থেকে তাদের আমরা বঞ্চিত করতে পারি না। রাষ্ট্র এ অঞ্চলের সম্পদ জাতীয় উন্নয়নে ব্যয় করবে, এটা যেমন সত্য, তেমনি রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা। দেশে এরই মধ্যে একটি 'জাতীয় কমিটি' গঠিত হয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরেই দেশের জ্বালানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়ে তাদের বক্তব্য দিয়ে আসছেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলাটাও জরুরি। তবে এটা ঠিক, বাংলাদেশের কয়লা ব্যবহার না করে কেন ভারতীয় কয়লা আমদানি করব_ এর একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন। কেননা আমরা জানি ভারতীয় কয়লায় পরিবেশ দূষণ হয় সবচেয়ে বেশি। সে তুলনায় আমাদের কয়লার মান অনেক ভালো। মনে রাখতে হবে, যেখানে সারা বিশ্বে, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৭৯ শতাংশ, চীনে ৭৮ শতাংশ, জার্মানিতে ৪৯ শতাংশ কিংবা ভারতে ৬৯ শতাংশ, সেখানে আমাদের কয়লা সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আমরা তা ব্যবহার করতে পারছি না। বাংলাদেশে ২০১৪ সালের শেষের দিকে বিদ্যুতের চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১৫ হাজার মেগাওয়াট আর ২০২০ সালে ১৬ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াট, তখন কয়লা ছাড়া আমাদের কোনো 'বিকল্প' নেই। গ্যাস সম্পদ ফুরিয়ে আসছে। গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলন নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানা জটিলতা। সে ক্ষেত্রে কয়লা সম্পদ আমাদের জন্য একটি ভরসা। কিন্তু এ কয়লা সম্পদকে ব্যবহার না করে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কয়লা আমদানি করলে বিতর্ক তো বাড়বেই। আমরা চাই এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হোক। আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে চাই। কিন্তু পরনির্ভরশীল হতে চাই না। বিদ্যুৎকে আমি অনেকটা মানবাধিকারের সঙ্গে তুলনা করতে চাই। অর্থাৎ এটা অনেকটা অধিকারের মতো। রাষ্ট্র আমাদের বিদ্যুৎ দেবে। শুধু উৎপাদন কাজেই বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয় তা নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ছাড়া আমরা অচল। জ্বালানি আজ বিশ্বের অন্যতম একটি সমস্যা। সস্তায় তেল পাওয়ার দিন ফুরিয়ে গেছে। আমরা বর্তমানে এক ধরনের 'অয়েল শক'-এ আক্রান্ত। তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের সর্বোচ্চ পয়েন্টটিতে আমরা পেঁৗছে গেছি। এখন সাপ্লাই কমে গেছে বিশ্ববাজারে, যাতে করে দাম বেড়ে যাচ্ছে। গত ৪০ বছর ধরে নতুন নতুন তেল খনি আবিষ্কারের হার পড়তির দিকে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য জ্বালানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত জনসংখ্যা, উন্নয়নের চাপ, কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা ইত্যাদি নানা কারণে বাংলাদেশের জ্বালানি পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে। তেলের দুষ্প্রাপ্যতা ও দামের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাসকূপগুলো নিঃশেষ হয়ে যাওয়া এবং বিকল্প জ্বালানি উদ্ভাবনে ব্যর্থতা বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে একটি বড় ধরনের সঙ্কটে ফেলবে। বাংলাদেশ এ 'অয়েল শক' কাটিয়ে উঠতে পারবে না। তাই এখন থেকেই বিকল্প জ্বালানির কথা ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে পরমাণু জ্বালানি কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্তটি ভালো। তবে এর নেতিবাচক দিকগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। শুধু কেন্দ্র নির্মাণ করলেই চলবে না, রসদ সরবরাহ নিশ্চিত করা, ওই দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশের মনোভাবও বিবেচনায় নিতে হবে। রূপপুরে একাধিক 'রিস্ক ফ্যাক্টর' রয়ে গেছে। নদীর একেবারে পার্শ্ববর্তী এ রূপপুর। চেরনোবিল ও ফুকুসিমা আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। চেরনোবিলের দুর্ঘটনাকবলিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই এলাকা আজও নিরাপদ নয়। আর ফুকুসিমার দুর্ঘটনার পর ওই এলাকার আশপাশের এলাকা পূর্ণ 'সিল' করে দেয়া হয়েছে। জার্মানি কয়েকটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। বিষয়গুলো আমাদের নীতিনির্ধারকরা বিবেচনায় নিলে ভালো করবেন। Daily Alokito Bangladesh 14.05.14

0 comments:

Post a Comment