২০১৭ সাল শেষ হল আন্তর্জাতিক
অঙ্গনে অনেক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্প জানুয়ারিতে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু
দায়িত্ব গ্রহণের এক বছরের মধ্যেই তার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত একদিকে তাকে
বিতর্কিত করেছে, অন্যদিকে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
তিনি একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এবং নিজেকে বিতর্কিত করছেন।
সর্বশেষ তিনি ইসরাইলের মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত
নিয়েছেন। এতে বিশ্বব্যাপী মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। পূর্ব
জেরুজালেম ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী। এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যে দুই রাষ্ট্রের
তত্ত্ব দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেখানে
পূর্ব জেরুজালেম হবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী এমন একটা ‘শর্ত’ও ছিল।
এখন ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত ওই সিদ্ধান্তের বরখেলাপ। যুক্তরাষ্ট্র যে
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা হারিয়ে ফেলেছে, তা
জানিয়ে দিয়েছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে আবার
‘ইনতিফাদা’ বা ফিলিস্তিনি গণঅভ্যুত্থানের ডাক দিয়েছে হামাস। ফলে
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এক ধরনের স্থিতিশীলতা ফিরে আসার যে সম্ভাবনা ছিল,
তা রহিত হল।
ট্রাম্প তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর ধারণা নিয়েও খুব বেশি দূর যেতে পারেননি।
আলাক্সায় একটি সিনেট নির্বাচনে তার প্রার্থী রয় মুর হেরে গেছেন ডেমোক্রেট
প্রার্থী ডগ জোসের কাছে। এর ফলে সিনেটে এখন রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটদের আসন
সংখ্যা যথাক্রমে ৫১ ও ৪৯। ওই আসনটি গত ২৫ বছর ধরে রিপাবলিকানদের দখলে ছিল।
এখন সেটা তাদের হাতছাড়া হল। এর ফলে সিনেটে অনেক সিদ্ধান্তই ট্রাম্প পাস
করাতে পারবেন না। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর ধারণা যে মার্কিন সমাজে
গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, এটি তার একটা বড় প্রমাণ।
বিদায়ী বছর ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বিশ্ব আসরে কিছুটা হলেও উত্তেজনা ছড়িয়েছে। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি হয়েছে। বিদায়ী বছর উত্তর কোরিয়া একাধিক আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। একটি হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণও ঘটিয়েছে তারা। শুধু তাই নয়, উত্তর কোরিয়া সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক বোমা হামলা চালাতে পারে এমন হুমকি দিয়ে আসছেন উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উন। এ সম্ভাব্য হামলাকে ট্রাম্প প্রশাসন খুব সিরিয়াসলি নিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে কোনো নীতি অবলম্বন করা হবে, তা স্পষ্ট নয়। এ ব্যাপারে ট্রাম্প-টিলারসন দ্বন্দ্বের খবরও পত্রপত্রিকায় এসেছে। সরাসরি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কোনো সংলাপে যাবে কিনা, তা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলেই দক্ষিণ কোরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘থাড’ মোতায়েন করা হয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র উত্তর কোরিয়া থেকে আগত যে কোনো মিসাইল মহাশূন্যেই ধ্বংস করে দিতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ব্যয়ভার কে বহন করবে? ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, এর ব্যয়ভার বহন করবে দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু তাতে আপত্তি জানিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার। বিদায়ী বছর উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের ব্যাপারে ট্রাম্প যেমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি, ঠিক তেমনি ইরানের সঙ্গে ওবামা প্রশাসনের আমলে যে পারস্পরিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা থেকেও বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি। ট্রাম্প স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, ওই চুক্তি তিনি মানবেন না। তিনি মনে করেন, ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে ইরানের পারমাণবিক শক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বন্ধ করা যাবে না। ইসরাইলের অভিমতও অনেকটা তেমন। ইসরাইল মনে করে, ইরান ইতিমধ্যে পারমাণবিক বোমা তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, ইরান সমঝোতায় শুধু ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রই জড়িত নয়, ২০১৫ সালে যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তাতে জড়িত ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জার্মানি। এখন এককভাবে যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারে না।
একই কথা প্রযোজ্য জলবায়ু চুক্তির ক্ষেত্রেও। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৫টি দেশ এতে স্বাক্ষর করে। পরে ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল জাতিসংঘ সদর দফতরে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এটি অনুমোদিত হয় এবং আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়। যুক্তরাষ্ট্রও তখন এ চুক্তি অনুমোদন করেছিল এবং জাতিসংঘ সদর দফতরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাতে স্বাক্ষর করেছিল। এটি এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, গ্রিনহাউস গ্যাসের কারণে বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। সুতরাং গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের হার কমাতে হবে। প্যারিস চুক্তিতে সেভাবেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এখন ট্রাম্প বলছেন, তিনি ওই চুক্তি মানেন না। তিনি চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহারের কথাও বলেছেন। ফলে সত্যি সত্যিই যদি যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা আদৌ সম্ভব হবে না। ভুলে গেলে চলবে না, ‘জ্বালানি’ একটা বিশাল ব্যবসা। ট্রাম্প নিজে ব্যবসায়ী। তিনি যা করছেন, তা ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই করছেন। তিনি যখন জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন, তখন ওই ব্যবসায়িক স্বার্থটাই বড় হয়ে দেখা দেয়।
বিদায়ী বছর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে সিরিয়া-ইরাক থেকে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) যোদ্ধাদের পিছুহটা। ২০১৪-২০১৫ সালে আইএসের উত্থান ও তাদের হত্যাযজ্ঞ সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। তারা বন্দিদের আগুনে পুড়িয়ে মেরে নিজেরা তা প্রচারও করেছিল। তারা বিশ্বব্যাপী একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে তারা তথাকথিত একটি খিলাফত প্রতিষ্ঠার কথাও ঘোষণা করেছিল। সিরিয়া-ইরানের একটা অংশ দখল করে নিয়ে তারা তথাকথিত একটি জিহাদি রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠা করেছিল। শেষ পর্যন্ত সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে পুরো দৃশ্যপট পালটে যায়। সিরিয়া থেকে আইএস উৎখাত হয়। তবে এই উৎখাত মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির সুবাতাস নিশ্চিত করেনি। সৌদি আরবের ‘একটি ভূমিকা’ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। বিদায়ী বছর পুরোটা সময় সৌদি আরব ইয়েমেনে বিমান হামলা অব্যাহত রাখে। এতে হাজার হাজার শিশু মারা গেছে। সেখানে বড় ধরনের চিকিৎসা সংকট দেখা দিয়েছে। ইয়েমেন কার্যত এখন দ্বিধাবিভক্ত একটি দেশ। হুথি বিদ্রোহীরা কার্যত রাজধানী সানা নিয়ন্ত্রণ করছে। হুথিরা মূলত শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এবং অভিযোগ করা হয় তারা ইরান সমর্থনপুষ্ট। এদের হাতেই ডিসেম্বরে মারা গেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহ। আর নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পালিয়ে গেছেন সৌদি আরবে, পরে এডেনে। সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় প্রশাসন নেই। ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সৌদি আরবের সামরিক হস্তক্ষেপ, কাতারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও কাতারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ, লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ- সব মিলিয়ে সৌদি আরবের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এজন্য ক্রাউন প্রিন্স সালমানের ভূমিকাকে দায়ী করা হয়। প্রিন্স সালমানের ভূমিকা খোদ সৌদি আরবেই এখন বিতর্কিত। প্রসঙ্গত, তিনি এক ধরনের ‘অভ্যন্তরীণ ক্যু দে’তার মাধ্যমে’ সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। পিতা বাদশাহ সালমান নামে রাজ্য চালালেও মূল ক্ষমতা প্রিন্স সালমানের হাতে। তিনি তথাকথিত দুর্নীতি উচ্ছেদের নামে রাজপরিবারের অনেক সদস্যকে গ্রেফতার করেছেন। দ্বিতীয়ত, মুসলমান প্রধান দেশগুলোকে নিয়ে তিনি একটি সামরিক জোটও গঠন করেছেন। বাংলাদেশও সেই জোটের সদস্য। অভিযোগ আছে, এ জোটকে তিনি ব্যবহার করছেন নিজের ক্ষমতা করায়ত্ত করার জন্য। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে তার সখ্য ও নেতৃত্ব আগামী দিনে নতুন করে রচিত হতে পারে। কারণ প্রিন্স সালমানের সঙ্গে ইসরাইলের একটা সম্পর্ক(?) স্থাপিত হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন। এমন খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে যে, প্রিন্স সালমান চান ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমের বদলে অন্যত্র তাদের রাজধানী স্থাপন করার দাবি করুক! যদিও সরকারিভাবে এমন কোনো কথা বলা হয়নি।
জেরুজালেম নিয়ে সংকটের প্রেক্ষাপটে ইস্তাম্বুলে ওআইসির বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৩ ডিসেম্বর। সেখানে পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এক্ষেত্রে এটাকে একটি ‘আন্দোলনের অংশ’ হিসেবে নিয়ে বিশ্বের অমুসলিম দেশগুলোকেও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কথা কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের পক্ষ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। বিশেষ করে চীনের কথা বলছেন কেউ কেউ (অধ্যাপক চন্দ্রা মুজাফফরের প্রবন্ধ, ষেড়নধষ জবংবধৎপয)। এটাকে নতুন এক ধরনের ‘বেলফোর ঘোষণা’র সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বিশেষ এই অধিবেশনে সৌদি বাদশাহ যোগ দেননি। বলা ভালো, ১৯১৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলেফোর ব্রিটিশ জায়নিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি লর্ড রথচাইল্ডকে যে চিঠি দেন, তার ওপর ভিত্তি করেই ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। ফিলিস্তিনি এলাকায় ফিলিস্তিনি নাগরিকদের উচ্ছেদ করে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হলেও আজ পর্যন্ত স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
২০১৭ সালে আলোচিত ঘটনাবলির একটি হচ্ছে জিম্বাবুয়ের দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবেকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ। তিনি দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে জিম্বাবুয়ে শাসন করে আসছিলেন। কিন্তু তার ক্ষমতালিপ্সু স্ত্রী গ্রেস স্বামীর অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে নিজে প্রেসিডেন্ট হতে উদ্যোগী হলে ‘বিদ্রোহ’ সংঘটিত হয় দলের ভেতরে। আর সেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে অপসারিত এমারসন মনানগাগুয়ে। তাকে সমর্থন করে সেনাবাহিনী। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত মুগাবে পদত্যাগ করেন এবং নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন মনানগাগুয়ে। তবে এক্ষেত্রে মুগাবেকে সব ধরনের বিচার থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তাকে আর বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যাবে না।
বিদায়ী বছর ইউরোপেও বেশ ক’টি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। ব্রিটেন লিসবন চুক্তির ৫০ ধারা অনুসরণ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ডিসেম্বরে ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন- ব্রেক্সিটের কারণে ব্রিটেনকে কী পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে (অর্থের পরিমাণ ৪০ থেকে ৬০ বিলিয়ন ইউরো)। ২০১৯ সালে ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
জার্মানিতে বিদায়ী বছর যে নির্বাচন সম্পন্ন হয়, তাতে বর্তমান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের দল বিজয়ী হলেও সরকার গঠনে সেখানে জটিলতা রয়ে গেছে। ডিসেম্বরে এসেও সরকার গঠনের কাজটি সম্পন্ন হয়নি। মে মাসে ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এমানুয়েল ম্যাক্রো বিজয়ী হয়েছেন। সেটা ছিল একটা বড় ধরনের ঘটনা। সেপ্টেম্বরে কাতালোনিয়ায় গণভোটে স্পেন থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পক্ষে রায় পড়লেও তা স্পেন স্বীকার করে নেয়নি। বরং কেন্দ্রীয় সরকার কাতালোনিয়া সরকারকে বরখাস্ত করে। অস্ট্রিয়ার নির্বাচনে উগ্রপন্থীরা বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। জুন মাসে মনটেনেগরো ২৯তম সদস্য হিসেবে ন্যাটোতে যোগ দেয়। লক্ষণীয়, এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদ ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। মূলত সিরীয় ও ইরাকি অভিবাসীদের ব্যাপক হারে ইউরোপে প্রবেশের কারণেই এ দক্ষিণপন্থী প্রবণতা বেড়েছে। এটা নতুন বছরের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে।
দক্ষিণ এশিয়াতেও বেশকিছু সংবাদ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত ছিল। তবে বলা হয়, সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণেই শরিফকে সরে যেতে হয়েছে। নতুন বছর সেখানে নির্বাচন। ওই নির্বাচনে শরিফ ব্যক্তিগতভাবে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। নেপালে সংসদীয় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে ডিসেম্বরে। এতে নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি (ইউএমএল) ও মাওবাদীদের জোট বিজয়ী হয়েছে। তবে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত তারা সেখানে সরকার গঠন করতে পারেনি। ভারতে গুরুত্বপূর্ণ গুজরাট রাজ্য সরকারের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে ডিসেম্বরে। মোদির বিজেপি সেখানে আবারও বিজয়ী হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নরেন্দ্র মোদি ভারতে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যে ‘গেরুয়া বিপ্লবের’ সূচনা করেছিলেন, তা অব্যাহত রেখেছেন। ভারতের একাধিক রাজ্যে বিজেপির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালে বিজেপি যেখানে ৭টি রাজ্যে বিজয়ী হয়েছিল (কংগ্রেস ১৩টিতে), সেখানে বর্তমানে বিজেপির হাতে রয়েছে ১৯টি রাজ্য, আর কংগ্রেসের মাত্র ৪টি রাজ্য। এর অর্থ মোদির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এ জনপ্রিয়তা নিয়েই ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদি ১৭তম লোকসভা নির্বাচনে দল তথা এনডিএ জোটের নেতৃত্ব দেবেন। এদিকে কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন রাহুল গান্ধী, যা প্রত্যাশিত ছিল। সোনিয়া গান্ধী অবসরে গেছেন। এখন রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের ইমেজ কতটুকু বাড়াতে পারবেন, সেটাই দেখার বিষয়।
রোহিঙ্গাদের ব্যাপকহারে বাংলাদেশে প্রবেশ বিদায়ী বছর বড় ধরনের আন্তর্জাতিক সংবাদের জন্ম দেয়। রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য অং সান সু চির অভিযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার কথাও বলা হচ্ছে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে। সব মিলিয়ে বিশ্বে সু চির যে ইতিবাচক ইমেজ ছিল, তা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
একধরনের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে শেষ হল ২০১৭ সাল। এর রেশ যে নতুন বছর ২০১৮ সালেও থেকে যাবে, তা বলাই বাহুল্য।
Daily Jugantor
1.1.2018
বিদায়ী বছর ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বিশ্ব আসরে কিছুটা হলেও উত্তেজনা ছড়িয়েছে। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি হয়েছে। বিদায়ী বছর উত্তর কোরিয়া একাধিক আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। একটি হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণও ঘটিয়েছে তারা। শুধু তাই নয়, উত্তর কোরিয়া সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক বোমা হামলা চালাতে পারে এমন হুমকি দিয়ে আসছেন উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উন। এ সম্ভাব্য হামলাকে ট্রাম্প প্রশাসন খুব সিরিয়াসলি নিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে কোনো নীতি অবলম্বন করা হবে, তা স্পষ্ট নয়। এ ব্যাপারে ট্রাম্প-টিলারসন দ্বন্দ্বের খবরও পত্রপত্রিকায় এসেছে। সরাসরি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কোনো সংলাপে যাবে কিনা, তা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলেই দক্ষিণ কোরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘থাড’ মোতায়েন করা হয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র উত্তর কোরিয়া থেকে আগত যে কোনো মিসাইল মহাশূন্যেই ধ্বংস করে দিতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ব্যয়ভার কে বহন করবে? ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, এর ব্যয়ভার বহন করবে দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু তাতে আপত্তি জানিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার। বিদায়ী বছর উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের ব্যাপারে ট্রাম্প যেমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি, ঠিক তেমনি ইরানের সঙ্গে ওবামা প্রশাসনের আমলে যে পারস্পরিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা থেকেও বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি। ট্রাম্প স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, ওই চুক্তি তিনি মানবেন না। তিনি মনে করেন, ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে ইরানের পারমাণবিক শক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বন্ধ করা যাবে না। ইসরাইলের অভিমতও অনেকটা তেমন। ইসরাইল মনে করে, ইরান ইতিমধ্যে পারমাণবিক বোমা তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, ইরান সমঝোতায় শুধু ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রই জড়িত নয়, ২০১৫ সালে যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তাতে জড়িত ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জার্মানি। এখন এককভাবে যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারে না।
একই কথা প্রযোজ্য জলবায়ু চুক্তির ক্ষেত্রেও। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৫টি দেশ এতে স্বাক্ষর করে। পরে ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল জাতিসংঘ সদর দফতরে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এটি অনুমোদিত হয় এবং আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়। যুক্তরাষ্ট্রও তখন এ চুক্তি অনুমোদন করেছিল এবং জাতিসংঘ সদর দফতরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাতে স্বাক্ষর করেছিল। এটি এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, গ্রিনহাউস গ্যাসের কারণে বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। সুতরাং গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের হার কমাতে হবে। প্যারিস চুক্তিতে সেভাবেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এখন ট্রাম্প বলছেন, তিনি ওই চুক্তি মানেন না। তিনি চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহারের কথাও বলেছেন। ফলে সত্যি সত্যিই যদি যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা আদৌ সম্ভব হবে না। ভুলে গেলে চলবে না, ‘জ্বালানি’ একটা বিশাল ব্যবসা। ট্রাম্প নিজে ব্যবসায়ী। তিনি যা করছেন, তা ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই করছেন। তিনি যখন জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন, তখন ওই ব্যবসায়িক স্বার্থটাই বড় হয়ে দেখা দেয়।
বিদায়ী বছর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে সিরিয়া-ইরাক থেকে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) যোদ্ধাদের পিছুহটা। ২০১৪-২০১৫ সালে আইএসের উত্থান ও তাদের হত্যাযজ্ঞ সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। তারা বন্দিদের আগুনে পুড়িয়ে মেরে নিজেরা তা প্রচারও করেছিল। তারা বিশ্বব্যাপী একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে তারা তথাকথিত একটি খিলাফত প্রতিষ্ঠার কথাও ঘোষণা করেছিল। সিরিয়া-ইরানের একটা অংশ দখল করে নিয়ে তারা তথাকথিত একটি জিহাদি রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠা করেছিল। শেষ পর্যন্ত সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে পুরো দৃশ্যপট পালটে যায়। সিরিয়া থেকে আইএস উৎখাত হয়। তবে এই উৎখাত মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির সুবাতাস নিশ্চিত করেনি। সৌদি আরবের ‘একটি ভূমিকা’ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। বিদায়ী বছর পুরোটা সময় সৌদি আরব ইয়েমেনে বিমান হামলা অব্যাহত রাখে। এতে হাজার হাজার শিশু মারা গেছে। সেখানে বড় ধরনের চিকিৎসা সংকট দেখা দিয়েছে। ইয়েমেন কার্যত এখন দ্বিধাবিভক্ত একটি দেশ। হুথি বিদ্রোহীরা কার্যত রাজধানী সানা নিয়ন্ত্রণ করছে। হুথিরা মূলত শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এবং অভিযোগ করা হয় তারা ইরান সমর্থনপুষ্ট। এদের হাতেই ডিসেম্বরে মারা গেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহ। আর নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পালিয়ে গেছেন সৌদি আরবে, পরে এডেনে। সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় প্রশাসন নেই। ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সৌদি আরবের সামরিক হস্তক্ষেপ, কাতারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও কাতারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ, লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ- সব মিলিয়ে সৌদি আরবের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এজন্য ক্রাউন প্রিন্স সালমানের ভূমিকাকে দায়ী করা হয়। প্রিন্স সালমানের ভূমিকা খোদ সৌদি আরবেই এখন বিতর্কিত। প্রসঙ্গত, তিনি এক ধরনের ‘অভ্যন্তরীণ ক্যু দে’তার মাধ্যমে’ সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। পিতা বাদশাহ সালমান নামে রাজ্য চালালেও মূল ক্ষমতা প্রিন্স সালমানের হাতে। তিনি তথাকথিত দুর্নীতি উচ্ছেদের নামে রাজপরিবারের অনেক সদস্যকে গ্রেফতার করেছেন। দ্বিতীয়ত, মুসলমান প্রধান দেশগুলোকে নিয়ে তিনি একটি সামরিক জোটও গঠন করেছেন। বাংলাদেশও সেই জোটের সদস্য। অভিযোগ আছে, এ জোটকে তিনি ব্যবহার করছেন নিজের ক্ষমতা করায়ত্ত করার জন্য। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে তার সখ্য ও নেতৃত্ব আগামী দিনে নতুন করে রচিত হতে পারে। কারণ প্রিন্স সালমানের সঙ্গে ইসরাইলের একটা সম্পর্ক(?) স্থাপিত হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন। এমন খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে যে, প্রিন্স সালমান চান ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমের বদলে অন্যত্র তাদের রাজধানী স্থাপন করার দাবি করুক! যদিও সরকারিভাবে এমন কোনো কথা বলা হয়নি।
জেরুজালেম নিয়ে সংকটের প্রেক্ষাপটে ইস্তাম্বুলে ওআইসির বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৩ ডিসেম্বর। সেখানে পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এক্ষেত্রে এটাকে একটি ‘আন্দোলনের অংশ’ হিসেবে নিয়ে বিশ্বের অমুসলিম দেশগুলোকেও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কথা কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের পক্ষ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। বিশেষ করে চীনের কথা বলছেন কেউ কেউ (অধ্যাপক চন্দ্রা মুজাফফরের প্রবন্ধ, ষেড়নধষ জবংবধৎপয)। এটাকে নতুন এক ধরনের ‘বেলফোর ঘোষণা’র সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বিশেষ এই অধিবেশনে সৌদি বাদশাহ যোগ দেননি। বলা ভালো, ১৯১৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলেফোর ব্রিটিশ জায়নিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি লর্ড রথচাইল্ডকে যে চিঠি দেন, তার ওপর ভিত্তি করেই ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। ফিলিস্তিনি এলাকায় ফিলিস্তিনি নাগরিকদের উচ্ছেদ করে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হলেও আজ পর্যন্ত স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
২০১৭ সালে আলোচিত ঘটনাবলির একটি হচ্ছে জিম্বাবুয়ের দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবেকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ। তিনি দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে জিম্বাবুয়ে শাসন করে আসছিলেন। কিন্তু তার ক্ষমতালিপ্সু স্ত্রী গ্রেস স্বামীর অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে নিজে প্রেসিডেন্ট হতে উদ্যোগী হলে ‘বিদ্রোহ’ সংঘটিত হয় দলের ভেতরে। আর সেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে অপসারিত এমারসন মনানগাগুয়ে। তাকে সমর্থন করে সেনাবাহিনী। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত মুগাবে পদত্যাগ করেন এবং নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন মনানগাগুয়ে। তবে এক্ষেত্রে মুগাবেকে সব ধরনের বিচার থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তাকে আর বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যাবে না।
বিদায়ী বছর ইউরোপেও বেশ ক’টি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। ব্রিটেন লিসবন চুক্তির ৫০ ধারা অনুসরণ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ডিসেম্বরে ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন- ব্রেক্সিটের কারণে ব্রিটেনকে কী পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে (অর্থের পরিমাণ ৪০ থেকে ৬০ বিলিয়ন ইউরো)। ২০১৯ সালে ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
জার্মানিতে বিদায়ী বছর যে নির্বাচন সম্পন্ন হয়, তাতে বর্তমান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের দল বিজয়ী হলেও সরকার গঠনে সেখানে জটিলতা রয়ে গেছে। ডিসেম্বরে এসেও সরকার গঠনের কাজটি সম্পন্ন হয়নি। মে মাসে ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এমানুয়েল ম্যাক্রো বিজয়ী হয়েছেন। সেটা ছিল একটা বড় ধরনের ঘটনা। সেপ্টেম্বরে কাতালোনিয়ায় গণভোটে স্পেন থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পক্ষে রায় পড়লেও তা স্পেন স্বীকার করে নেয়নি। বরং কেন্দ্রীয় সরকার কাতালোনিয়া সরকারকে বরখাস্ত করে। অস্ট্রিয়ার নির্বাচনে উগ্রপন্থীরা বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। জুন মাসে মনটেনেগরো ২৯তম সদস্য হিসেবে ন্যাটোতে যোগ দেয়। লক্ষণীয়, এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদ ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। মূলত সিরীয় ও ইরাকি অভিবাসীদের ব্যাপক হারে ইউরোপে প্রবেশের কারণেই এ দক্ষিণপন্থী প্রবণতা বেড়েছে। এটা নতুন বছরের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে।
দক্ষিণ এশিয়াতেও বেশকিছু সংবাদ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত ছিল। তবে বলা হয়, সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণেই শরিফকে সরে যেতে হয়েছে। নতুন বছর সেখানে নির্বাচন। ওই নির্বাচনে শরিফ ব্যক্তিগতভাবে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। নেপালে সংসদীয় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে ডিসেম্বরে। এতে নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি (ইউএমএল) ও মাওবাদীদের জোট বিজয়ী হয়েছে। তবে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত তারা সেখানে সরকার গঠন করতে পারেনি। ভারতে গুরুত্বপূর্ণ গুজরাট রাজ্য সরকারের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে ডিসেম্বরে। মোদির বিজেপি সেখানে আবারও বিজয়ী হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নরেন্দ্র মোদি ভারতে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যে ‘গেরুয়া বিপ্লবের’ সূচনা করেছিলেন, তা অব্যাহত রেখেছেন। ভারতের একাধিক রাজ্যে বিজেপির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালে বিজেপি যেখানে ৭টি রাজ্যে বিজয়ী হয়েছিল (কংগ্রেস ১৩টিতে), সেখানে বর্তমানে বিজেপির হাতে রয়েছে ১৯টি রাজ্য, আর কংগ্রেসের মাত্র ৪টি রাজ্য। এর অর্থ মোদির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এ জনপ্রিয়তা নিয়েই ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদি ১৭তম লোকসভা নির্বাচনে দল তথা এনডিএ জোটের নেতৃত্ব দেবেন। এদিকে কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন রাহুল গান্ধী, যা প্রত্যাশিত ছিল। সোনিয়া গান্ধী অবসরে গেছেন। এখন রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের ইমেজ কতটুকু বাড়াতে পারবেন, সেটাই দেখার বিষয়।
রোহিঙ্গাদের ব্যাপকহারে বাংলাদেশে প্রবেশ বিদায়ী বছর বড় ধরনের আন্তর্জাতিক সংবাদের জন্ম দেয়। রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য অং সান সু চির অভিযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার কথাও বলা হচ্ছে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে। সব মিলিয়ে বিশ্বে সু চির যে ইতিবাচক ইমেজ ছিল, তা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
একধরনের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে শেষ হল ২০১৭ সাল। এর রেশ যে নতুন বছর ২০১৮ সালেও থেকে যাবে, তা বলাই বাহুল্য।
Daily Jugantor
1.1.2018