রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

নতুন বছরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অস্থিরতা কাটবে কি?

২০১৭ সাল শেষ হল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্প জানুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের এক বছরের মধ্যেই তার বেশ কিছু সিদ্ধান্ত একদিকে তাকে বিতর্কিত করেছে, অন্যদিকে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তিনি একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন এবং নিজেকে বিতর্কিত করছেন। সর্বশেষ তিনি ইসরাইলের মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে বিশ্বব্যাপী মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। পূর্ব জেরুজালেম ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী। এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যে দুই রাষ্ট্রের তত্ত্ব দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেখানে পূর্ব জেরুজালেম হবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী এমন একটা ‘শর্ত’ও ছিল। এখন ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত ওই সিদ্ধান্তের বরখেলাপ। যুক্তরাষ্ট্র যে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা হারিয়ে ফেলেছে, তা জানিয়ে দিয়েছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে আবার ‘ইনতিফাদা’ বা ফিলিস্তিনি গণঅভ্যুত্থানের ডাক দিয়েছে হামাস। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এক ধরনের স্থিতিশীলতা ফিরে আসার যে সম্ভাবনা ছিল, তা রহিত হল।
ট্রাম্প তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর ধারণা নিয়েও খুব বেশি দূর যেতে পারেননি। আলাক্সায় একটি সিনেট নির্বাচনে তার প্রার্থী রয় মুর হেরে গেছেন ডেমোক্রেট প্রার্থী ডগ জোসের কাছে। এর ফলে সিনেটে এখন রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটদের আসন সংখ্যা যথাক্রমে ৫১ ও ৪৯। ওই আসনটি গত ২৫ বছর ধরে রিপাবলিকানদের দখলে ছিল। এখন সেটা তাদের হাতছাড়া হল। এর ফলে সিনেটে অনেক সিদ্ধান্তই ট্রাম্প পাস করাতে পারবেন না। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এর ধারণা যে মার্কিন সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, এটি তার একটা বড় প্রমাণ।
বিদায়ী বছর ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বিশ্ব আসরে কিছুটা হলেও উত্তেজনা ছড়িয়েছে। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি হয়েছে। বিদায়ী বছর উত্তর কোরিয়া একাধিক আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। একটি হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণও ঘটিয়েছে তারা। শুধু তাই নয়, উত্তর কোরিয়া সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক বোমা হামলা চালাতে পারে এমন হুমকি দিয়ে আসছেন উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উন। এ সম্ভাব্য হামলাকে ট্রাম্প প্রশাসন খুব সিরিয়াসলি নিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে কোনো নীতি অবলম্বন করা হবে, তা স্পষ্ট নয়। এ ব্যাপারে ট্রাম্প-টিলারসন দ্বন্দ্বের খবরও পত্রপত্রিকায় এসেছে। সরাসরি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কোনো সংলাপে যাবে কিনা, তা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলেই দক্ষিণ কোরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘থাড’ মোতায়েন করা হয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র উত্তর কোরিয়া থেকে আগত যে কোনো মিসাইল মহাশূন্যেই ধ্বংস করে দিতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ব্যয়ভার কে বহন করবে? ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, এর ব্যয়ভার বহন করবে দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু তাতে আপত্তি জানিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার। বিদায়ী বছর উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের ব্যাপারে ট্রাম্প যেমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি, ঠিক তেমনি ইরানের সঙ্গে ওবামা প্রশাসনের আমলে যে পারস্পরিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা থেকেও বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি। ট্রাম্প স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, ওই চুক্তি তিনি মানবেন না। তিনি মনে করেন, ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে ইরানের পারমাণবিক শক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বন্ধ করা যাবে না। ইসরাইলের অভিমতও অনেকটা তেমন। ইসরাইল মনে করে, ইরান ইতিমধ্যে পারমাণবিক বোমা তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, ইরান সমঝোতায় শুধু ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রই জড়িত নয়, ২০১৫ সালে যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তাতে জড়িত ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জার্মানি। এখন এককভাবে যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারে না।
একই কথা প্রযোজ্য জলবায়ু চুক্তির ক্ষেত্রেও। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৫টি দেশ এতে স্বাক্ষর করে। পরে ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল জাতিসংঘ সদর দফতরে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এটি অনুমোদিত হয় এবং আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়। যুক্তরাষ্ট্রও তখন এ চুক্তি অনুমোদন করেছিল এবং জাতিসংঘ সদর দফতরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাতে স্বাক্ষর করেছিল। এটি এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, গ্রিনহাউস গ্যাসের কারণে বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। সুতরাং গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের হার কমাতে হবে। প্যারিস চুক্তিতে সেভাবেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এখন ট্রাম্প বলছেন, তিনি ওই চুক্তি মানেন না। তিনি চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহারের কথাও বলেছেন। ফলে সত্যি সত্যিই যদি যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা আদৌ সম্ভব হবে না। ভুলে গেলে চলবে না, ‘জ্বালানি’ একটা বিশাল ব্যবসা। ট্রাম্প নিজে ব্যবসায়ী। তিনি যা করছেন, তা ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই করছেন। তিনি যখন জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন, তখন ওই ব্যবসায়িক স্বার্থটাই বড় হয়ে দেখা দেয়।
বিদায়ী বছর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে সিরিয়া-ইরাক থেকে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) যোদ্ধাদের পিছুহটা। ২০১৪-২০১৫ সালে আইএসের উত্থান ও তাদের হত্যাযজ্ঞ সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। তারা বন্দিদের আগুনে পুড়িয়ে মেরে নিজেরা তা প্রচারও করেছিল। তারা বিশ্বব্যাপী একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে তারা তথাকথিত একটি খিলাফত প্রতিষ্ঠার কথাও ঘোষণা করেছিল। সিরিয়া-ইরানের একটা অংশ দখল করে নিয়ে তারা তথাকথিত একটি জিহাদি রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠা করেছিল। শেষ পর্যন্ত সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে পুরো দৃশ্যপট পালটে যায়। সিরিয়া থেকে আইএস উৎখাত হয়। তবে এই উৎখাত মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির সুবাতাস নিশ্চিত করেনি। সৌদি আরবের ‘একটি ভূমিকা’ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। বিদায়ী বছর পুরোটা সময় সৌদি আরব ইয়েমেনে বিমান হামলা অব্যাহত রাখে। এতে হাজার হাজার শিশু মারা গেছে। সেখানে বড় ধরনের চিকিৎসা সংকট দেখা দিয়েছে। ইয়েমেন কার্যত এখন দ্বিধাবিভক্ত একটি দেশ। হুথি বিদ্রোহীরা কার্যত রাজধানী সানা নিয়ন্ত্রণ করছে। হুথিরা মূলত শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এবং অভিযোগ করা হয় তারা ইরান সমর্থনপুষ্ট। এদের হাতেই ডিসেম্বরে মারা গেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহ। আর নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পালিয়ে গেছেন সৌদি আরবে, পরে এডেনে। সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় প্রশাসন নেই। ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সৌদি আরবের সামরিক হস্তক্ষেপ, কাতারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও কাতারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ, লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ- সব মিলিয়ে সৌদি আরবের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এজন্য ক্রাউন প্রিন্স সালমানের ভূমিকাকে দায়ী করা হয়। প্রিন্স সালমানের ভূমিকা খোদ সৌদি আরবেই এখন বিতর্কিত। প্রসঙ্গত, তিনি এক ধরনের ‘অভ্যন্তরীণ ক্যু দে’তার মাধ্যমে’ সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন। পিতা বাদশাহ সালমান নামে রাজ্য চালালেও মূল ক্ষমতা প্রিন্স সালমানের হাতে। তিনি তথাকথিত দুর্নীতি উচ্ছেদের নামে রাজপরিবারের অনেক সদস্যকে গ্রেফতার করেছেন। দ্বিতীয়ত, মুসলমান প্রধান দেশগুলোকে নিয়ে তিনি একটি সামরিক জোটও গঠন করেছেন। বাংলাদেশও সেই জোটের সদস্য। অভিযোগ আছে, এ জোটকে তিনি ব্যবহার করছেন নিজের ক্ষমতা করায়ত্ত করার জন্য। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে তার সখ্য ও নেতৃত্ব আগামী দিনে নতুন করে রচিত হতে পারে। কারণ প্রিন্স সালমানের সঙ্গে ইসরাইলের একটা সম্পর্ক(?) স্থাপিত হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন। এমন খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে যে, প্রিন্স সালমান চান ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেমের বদলে অন্যত্র তাদের রাজধানী স্থাপন করার দাবি করুক! যদিও সরকারিভাবে এমন কোনো কথা বলা হয়নি।
জেরুজালেম নিয়ে সংকটের প্রেক্ষাপটে ইস্তাম্বুলে ওআইসির বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৩ ডিসেম্বর। সেখানে পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এক্ষেত্রে এটাকে একটি ‘আন্দোলনের অংশ’ হিসেবে নিয়ে বিশ্বের অমুসলিম দেশগুলোকেও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কথা কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের পক্ষ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। বিশেষ করে চীনের কথা বলছেন কেউ কেউ (অধ্যাপক চন্দ্রা মুজাফফরের প্রবন্ধ, ষেড়নধষ জবংবধৎপয)। এটাকে নতুন এক ধরনের ‘বেলফোর ঘোষণা’র সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বিশেষ এই অধিবেশনে সৌদি বাদশাহ যোগ দেননি। বলা ভালো, ১৯১৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলেফোর ব্রিটিশ জায়নিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি লর্ড রথচাইল্ডকে যে চিঠি দেন, তার ওপর ভিত্তি করেই ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। ফিলিস্তিনি এলাকায় ফিলিস্তিনি নাগরিকদের উচ্ছেদ করে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হলেও আজ পর্যন্ত স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
২০১৭ সালে আলোচিত ঘটনাবলির একটি হচ্ছে জিম্বাবুয়ের দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবেকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ। তিনি দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে জিম্বাবুয়ে শাসন করে আসছিলেন। কিন্তু তার ক্ষমতালিপ্সু স্ত্রী গ্রেস স্বামীর অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে নিজে প্রেসিডেন্ট হতে উদ্যোগী হলে ‘বিদ্রোহ’ সংঘটিত হয় দলের ভেতরে। আর সেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে অপসারিত এমারসন মনানগাগুয়ে। তাকে সমর্থন করে সেনাবাহিনী। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত মুগাবে পদত্যাগ করেন এবং নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন মনানগাগুয়ে। তবে এক্ষেত্রে মুগাবেকে সব ধরনের বিচার থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তাকে আর বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যাবে না।
বিদায়ী বছর ইউরোপেও বেশ ক’টি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। ব্রিটেন লিসবন চুক্তির ৫০ ধারা অনুসরণ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ডিসেম্বরে ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন- ব্রেক্সিটের কারণে ব্রিটেনকে কী পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে (অর্থের পরিমাণ ৪০ থেকে ৬০ বিলিয়ন ইউরো)। ২০১৯ সালে ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
জার্মানিতে বিদায়ী বছর যে নির্বাচন সম্পন্ন হয়, তাতে বর্তমান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের দল বিজয়ী হলেও সরকার গঠনে সেখানে জটিলতা রয়ে গেছে। ডিসেম্বরে এসেও সরকার গঠনের কাজটি সম্পন্ন হয়নি। মে মাসে ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এমানুয়েল ম্যাক্রো বিজয়ী হয়েছেন। সেটা ছিল একটা বড় ধরনের ঘটনা। সেপ্টেম্বরে কাতালোনিয়ায় গণভোটে স্পেন থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পক্ষে রায় পড়লেও তা স্পেন স্বীকার করে নেয়নি। বরং কেন্দ্রীয় সরকার কাতালোনিয়া সরকারকে বরখাস্ত করে। অস্ট্রিয়ার নির্বাচনে উগ্রপন্থীরা বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছে। জুন মাসে মনটেনেগরো ২৯তম সদস্য হিসেবে ন্যাটোতে যোগ দেয়। লক্ষণীয়, এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদ ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। মূলত সিরীয় ও ইরাকি অভিবাসীদের ব্যাপক হারে ইউরোপে প্রবেশের কারণেই এ দক্ষিণপন্থী প্রবণতা বেড়েছে। এটা নতুন বছরের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে।
দক্ষিণ এশিয়াতেও বেশকিছু সংবাদ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। দুর্নীতিতে অভিযুক্ত হয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের একটি সিদ্ধান্ত ছিল। তবে বলা হয়, সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণেই শরিফকে সরে যেতে হয়েছে। নতুন বছর সেখানে নির্বাচন। ওই নির্বাচনে শরিফ ব্যক্তিগতভাবে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। নেপালে সংসদীয় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে ডিসেম্বরে। এতে নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি (ইউএমএল) ও মাওবাদীদের জোট বিজয়ী হয়েছে। তবে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত তারা সেখানে সরকার গঠন করতে পারেনি। ভারতে গুরুত্বপূর্ণ গুজরাট রাজ্য সরকারের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে ডিসেম্বরে। মোদির বিজেপি সেখানে আবারও বিজয়ী হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নরেন্দ্র মোদি ভারতে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যে ‘গেরুয়া বিপ্লবের’ সূচনা করেছিলেন, তা অব্যাহত রেখেছেন। ভারতের একাধিক রাজ্যে বিজেপির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালে বিজেপি যেখানে ৭টি রাজ্যে বিজয়ী হয়েছিল (কংগ্রেস ১৩টিতে), সেখানে বর্তমানে বিজেপির হাতে রয়েছে ১৯টি রাজ্য, আর কংগ্রেসের মাত্র ৪টি রাজ্য। এর অর্থ মোদির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এ জনপ্রিয়তা নিয়েই ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদি ১৭তম লোকসভা নির্বাচনে দল তথা এনডিএ জোটের নেতৃত্ব দেবেন। এদিকে কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন রাহুল গান্ধী, যা প্রত্যাশিত ছিল। সোনিয়া গান্ধী অবসরে গেছেন। এখন রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের ইমেজ কতটুকু বাড়াতে পারবেন, সেটাই দেখার বিষয়।
রোহিঙ্গাদের ব্যাপকহারে বাংলাদেশে প্রবেশ বিদায়ী বছর বড় ধরনের আন্তর্জাতিক সংবাদের জন্ম দেয়। রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য অং সান সু চির অভিযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনার কথাও বলা হচ্ছে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে। সব মিলিয়ে বিশ্বে সু চির যে ইতিবাচক ইমেজ ছিল, তা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
একধরনের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে শেষ হল ২০১৭ সাল। এর রেশ যে নতুন বছর ২০১৮ সালেও থেকে যাবে, তা বলাই বাহুল্য।
Daily Jugantor
1.1.2018

বিশ্বরাজনীতির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা




যে কয়েকটি ঘটনা ২০১৭ সালে বিশ্বরাজনীতিতে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জেরুজালেম প্রশ্নে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা, জাতিসংঘ কর্তৃক ওই সিদ্ধান্ত ‘অকার্যকর ও বাতিল’ ঘোষণা, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সৌদি আরবের ভূমিকা, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়া উত্তেজনা ইত্যাদি। বছরের একটা বড় সময়জুড়ে এ বিষয়গুলো বারবার আলোচিত হয়েছে। ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি পারমাণবিক চুক্তি ট্রাম্প কর্তৃক বাতিলের ঘোষণাও বড় বিতর্কের ঝড় তোলে। রাশিয়ার সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো ছিল না চলতি বছর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (২০১৬) রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি বারবার গণমাধ্যমে এসেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের এক বছরের শাসনামলে একাধিক শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তা হয় পদত্যাগ করেছেন অথবা ট্রাম্প তাদের সরিয়ে দিয়েছেন। একটা বছর একধরনের অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে মার্কিন প্রশাসনের। দক্ষিণপন্থি উত্থান ইউরোপের রাজনীতিকে একটা বড় প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে চলতি বছর। ট্র্যাডিশনাল রাজনীতির সেখানে ব্যত্যয় ঘটেছে। অস্ট্রিয়া কিংবা জার্মানিতে উগ্র ডানপন্থিদের উত্থান ও ক্ষমতা গ্রহণ (অস্ট্রিয়া) ইউরোপের সনাতন রাজনীতিকে একটা প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে; জন্ম দিয়েছে নানা বিতর্কের। লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দেশগুলোর জন্য চলতি বছর কোনো ভালো সংবাদ ছিল না। ভেনিজুয়েলার মাদুরো সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি ঘটে। আর ওবামা প্রশাসন কিউবার রাহুল ক্যাস্ত্রো প্রশাসনের সঙ্গে যে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, ট্রাম্প প্রশাসন তা একরকম বাতিল ঘোষণা করেছে।
চলতি বছর ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বিশ্ব আসরে কিছুটা হলেও উত্তেজনা ছড়িয়েছে। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। চলতি বছর উত্তর কোরিয়া একাধিক আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। একটি হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণও ঘটিয়েছে তারা। শুধু তা-ই নয়, উত্তর কোরিয়া সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে পারমাণবিক বোমা হামলা চালাতে পারেÑ এমন হুমকি দিয়ে আসছে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। এই সম্ভাব্য ‘হামলা’কে ট্রাম্প প্রশাসন খুব সিরিয়াসলি নিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে কোন নীতি অবলম্বন করা হবে, তা স্পষ্ট নয়। এরই মধ্যে জাতিসংঘ উত্তর কোরিয়ার ওপর আবারও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এক্ষেত্রে ট্রাম্প-টিলারসন দ্বন্দ্বের খবরও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সরাসরি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কোনো সংলাপে যাবে কিনা, এটা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলেই দক্ষিণ কোরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘থাড’ মোতায়েন করা হয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র উত্তর কোরিয়া থেকে আসা যে কোনো মিসাইল মহাশূন্যেই ধ্বংস করে দিতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ব্যয়ভার কে বহন করবে? ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, এর ব্যয়ভার বহন করবে দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু তাতে আপত্তি জানিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার। চলতি বছর উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের ব্যাপারে ট্রাম্প যেমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি, ঠিক তেমনি ইরানের সঙ্গে ওবামা প্রশাসনের আমলে যে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা থেকেও বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, ওই চুক্তি তিনি মানবেন না। তিনি মনে করেন, ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে ইরানের পারমাণবিক শক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বন্ধ করা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে ইসরাইলের অভিমতও অনেকটা তেমনই। ইসরাইল মনে করে, ইরান এরই মধ্যে পারমাণবিক বোমা তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে! কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, ইরান সমঝোতায় শুধু ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রই জড়িত নয়; বরং ২০১৫ সালে যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তাতে জড়িত ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জার্মানি। এখন এককভাবে যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারে না। একই কথা প্রযোজ্য জলবায়ু চুক্তির ক্ষেত্রেও। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে জলবায়ু চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ১৯৫টি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছিল। পরে ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল জাতিসংঘের সদর দপ্তরে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এটি অনুমোদিত হয়েছিল এবং আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রও তখন চুক্তিটি অনুমোদন করেছিল ও জাতিসংঘের সদর দপ্তরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাতে স্বাক্ষর করেছিল। এটা এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, গ্রিনহাউজ গ্যাসের কারণে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের হার কমাতে হবে। প্যারিস চুক্তিতে সেভাবেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এখন ট্রাম্প বলছেন, তিনি এ চুক্তি মানেন না। তিনি চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহারের কথাও বলেছেন। এ কারণে সত্যি সত্যিই যদি যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা আদৌ সম্ভব হবে না। ভুলে গেলে চলবে না, ‘জ্বালানি’ একটা বিশাল ব্যবসা। ট্রাম্প নিজে ব্যবসায়ী। তিনি যা করছেন, তা ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই করছেন। আজ তিনি যখন জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন, তখন ওই ব্যবসায়িক স্বার্থটাই বড় হয়ে দেখা দেয়।
চলতি বছর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে সিরিয়া-ইরাকে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) যোদ্ধাদের পরাজয়। ২০১৪-১৫ সালে আইএসএর উত্থান ও তাদের হত্যাযজ্ঞ সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। তারা বন্দিদের আগুনে পুড়িয়ে মেরে নিজেরা তা প্রচারও করেছিল। তারা বিশ্বব্যাপী একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে তারা তথাকথিত একটি খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথাও ঘোষণা করেছিল। সিরিয়া-ইরাকের একটা অংশ দখল করে নিয়ে তারা তথাকথিত একটি ‘জিহাদি রাষ্ট্র’ও প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার রাজধানী ছিল সিরিয়ার রাকায়। শেষ পর্যন্ত সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে পুরো দৃশ্যপট পাল্টে যায়। সিরিয়া থেকে আইএস উৎখাত হয়। তবে এই উৎখাত মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির সুবাতাস নিশ্চিত করেনি। সৌদি আরবের ‘একটি ভূমিকা’ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি বড় অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। চলতি বছর পুরোটা সময় সৌদি আরব ইয়েমেনে বিমান হামলা অব্যাহত রাখে। অব্যাহত বোমা হামলায় হাজার হাজার শিশু সেখানে মারা গেছে; সেখানে বড় ধরনের চিকিৎসা সংকট দেখা দিয়েছে। ইয়েমেন কার্যত এখন দ্বিধাবিভক্ত একটি দেশ। হুথি বিদ্রোহীরা কার্যত রাজধানী সানা নিয়ন্ত্রণ করছে। হুথিরা মূলত শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত এবং অভিযোগ করা হয়, তারা ইরানের সমর্থনপুষ্ট। এদের হাতেই চলতি বছরের ডিসেম্বরে মারা যান সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহ। আর নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পালিয়ে যান সৌদি আরবে, পরে এডেনে। সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় প্রশাসন নেই। ইয়েমেনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সৌদি আরবের সামরিক হস্তক্ষেপ কাতারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও কাতারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ, লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপÑ সব মিলিয়ে সৌদি আরবের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
 জেরুজালেম নিয়ে সংকটের প্রেক্ষাপটে ইস্তানবুলে ওআইসির বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল গত ১৩ ডিসেম্বর। সেখানে বিশ্ববাসীর কাছে পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল। এক্ষেত্রে এটাকে একটি ‘আন্দোলনের অংশ’ হিসেবে নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য নন-মুসলিম দেশকেও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কথা কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের পক্ষ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। বিশেষ করে চীনের কথা বলছেন কেউ কেউ (অধ্যাপক চন্দ্রা মুজাফফরের প্রবন্ধ, এষড়নধষ জবংবধৎপয। এটাকে নতুন এক ধরনের ব্যালফোর ঘোষণার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বিশেষ এই অধিবেশনে সৌদি রাজা যোগ দেননি। বলা ভালো, ১৯১৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এজে ব্যালফোর ব্রিটিশ জায়নিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি লর্ড রথ চাইল্ডকে যে চিঠি দেন, তার ওপর ভিত্তি করেই ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। ফিলিস্তিনি এলাকায় ফিলিস্তিনি নাগরিকদের উচ্ছেদ করে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হলেও আজ অবধি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গণতন্ত্রের জন্য চলতি বছরটি ছিল ভালো ও মন্দের দিক মিলিয়ে। আফ্রিকার গণতন্ত্র ছিল প্রশ্নের মুখে। ২০১৭ সালে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি হচ্ছে জিম্বাবুয়ের দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট বরার্ট মুগাবের ক্ষমতা থেকে অপসারণ। তিনি দীর্ঘ ৩৭ বছর জিম্বাবুয়ে শাসন করে আসছিলেন। কিন্তু তার ক্ষমতালিপ্সু স্ত্রী গ্রেস স্বামীর অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে নিজে প্রেসিডেন্ট হতে উদ্যোগী হন। আর তখনই ‘বিদ্রোহ’ সংঘটিত হয় দলের ভেতরে। সেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে অপসারিত এমারসন মানানগাগাবা। আর তাকে সমর্থন করে সেনাবাহিনী। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত মুগাবে পদত্যাগ করেন এবং নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন মানানগাগাবা। তবে এক্ষেত্রে মুগাবেকে সব ধরনের অন্যায় ও অবিচার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাকে আর বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যাবে না। চলতি বছর ইউরোপে বেশ কটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। ব্রিটেন লিসবন চুক্তির ৫০ ধারা অনুসরণ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ডিসেম্বর মাসেই ব্রিটেন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নেতারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, ব্রেক্সিটের কারণে ব্রিটেনকে কী পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে (অর্থের পরিমাণ ৪০ থেকে ৬০ বিলিয়ন ইউরো)। ২০১৯ সালে ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। জার্মানিতে চলতি বছর যে নির্বাচন সম্পন্ন হয়, তাতে বর্তমান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মরকেলের দল বিজয়ী হলেও সরকার গঠনে সেখানে জটিলতা রয়ে গেছে। ডিসেম্বরে এসেও সরকার গঠনের কাজটি সম্পন্ন হয়নি। মে মাসে ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ম্যাক্রোঁ বিজয়ী হয়েছিলেন। সেটা ছিল একটা বড় ধরনের ঘটনা। সেপ্টেম্বর মাসে কাতালোনিয়ায় গণভোটে স্পেন থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পক্ষে রায় পড়লেও তা স্পেন স্বীকার করে নেয়নি; বরং কাতালোনিয়া সরকারকে বরখাস্ত করে। ডিসেম্বেরে নির্বাচনে এ বিচ্ছিন্নতাবাদীরাই আবার বিজয়ী হয়েছে। অস্ট্রিয়ার নির্বাচনে উগ্রপন্থিরা বিজয়ী হয়ে সেখানে সরকার গঠন করেছে। জুন মাসে মন্টিনিগরো ২৯তম সদস্য হিসেবে ন্যাটোয় যোগ দেয়। একধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদ ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত ব্যাপক হারে সিরীয় ও ইরাকি অভিবাসীদের ইউরোপে প্রবেশের কারণেই এ দক্ষিণপন্থি প্রবণতা বেড়েছে। এটা ২০১৮ সালের রাজনীতিতেও বড় প্রভাব ফেলবে।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেও ছিল অস্থিরতা। দুর্নীতির অভিযোগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ২০১৮ সালে সেখানে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তাতে নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফ মুসলিম লীগের প্রার্থী হবেন। দল বিজয়ী হলে তিনি হবেন প্রধানমন্ত্রী। নেপালে মাওবাদীরা ও কমিউনিস্ট পার্টি যে ঐক্য করেছিল, নির্বাচনে তারা বিজয়ী হয়েছে। সেখানে তারা এখন সরকার গঠন করবেন। মালদ্বীপে সমস্যা রয়ে গেছে। ভারতে গেরুয়া বিপ্লব অব্যাহত রয়েছে। ২০১৯ সালে মোদি নির্বাচনে দল তথা এনডিএ জোটকে নেতৃত্ব দেবেন। মালদ্বীপেও গণতন্ত্রের বিকাশ ছিল প্রশ্নের মুখে। তবে চলতি বছর ভারত-পাকিস্তান বিরোধ রয়ে গিয়েছিল। তাই ২০১৮ সালটি অনেকগুলো কারণে বিশ্ব রাজনীতি আলোচিত হতে থাকবে। ২০১৭ সালের প্রতিটি ঘটনা ২০১৮ সালের ঘটনাপ্রবাহকে প্রভাবিত করবে।
Daily Alokito Bangladesh
31.12.2017

জেরুজালেম সম্পর্কে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি


চলতি বছরের শেষের দিকে জেরুজালেম নিয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ছাপা হয়েছে। তথ্য মতে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়ার একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, যা কার্যত ইসরায়েল যে জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী হিসেবে দাবি করে আসছিল, তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার শামিল।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ। নামধাম লিখে রাখা এবং অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির পরও ১২৮টি দেশ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ‘জেরুজালেম নগরীর মর্যাদার বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত অকার্যকর ও বাতিলযোগ্য’ শীর্ষক যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে তার পক্ষে ভোট দিয়েছে। আর বিপক্ষে, অর্থাৎ ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পক্ষে ভোট দিয়েছে ৯টি দেশ। ভোটদানে বিরত ছিল ৩৫টি দেশ। তৃতীয়ত, জেরুজালেমকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্থায়ী রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ইরানের জাতীয় সংসদে একটি বিল পাস হয়েছে। তুরস্কও এরই মধ্যে ঘোষণা করেছে, তারা তাদের দূতাবাস পূর্ব জেরুজালেমে সরিয়ে নেবে! সব মিলিয়ে জেরুজালেমকে নিয়ে হঠাৎ করেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এই রাজনীতি আগামী দিনে মধ্যপ্রাচ্যকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা এ মুহূর্তে বলা কিছুটা কঠিন। তবে এটা স্পষ্ট করেই বলা যায়, ২০১৮ সালের রাজনীতিতে এই জেরুজালেম ইস্যু একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। এরই মধ্যে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রকে আর তারা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মানে না।
মুসলমান বিশ্বের জন্য জেরুজালেম একটি স্পর্শকাতর বিষয়। পূর্ব জেরুজালেম যে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হবে, এটি অনেক আগেই স্বীকৃত। এখানে রয়েছে পবিত্র আল-আকসা মসজিদ। তবে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। সেই থেকে পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলি দখলদারি বজায় রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৮০ সালে ইসরায়েল এক আইনবলে সমগ্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু জাতিসংঘে গৃহীত এক সিদ্ধান্তে (সিদ্ধান্ত নং-৪৭৮) এর সমালোচনা করা হয়েছিল। ২০১৭ সালে এসেও জাতিসংঘ আরেকটি সিদ্ধান্ত নিল—সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ‘জেরুজালেম নগরীর মর্যাদার বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত অকার্যকর ও বাতিলযোগ্য। ’ নন-বাইন্ডিং প্রস্তাবটি পালনে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু চীন, রাশিয়া, ভারত, বাংলাদেশ, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলো (জার্মানি, যুক্তরাজ্য) যখন এ ধরনের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় তখন এটিকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ফলে সংগত কারণেই যে প্রশ্নটি এখন উঠেছে, তা হচ্ছে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আন্দোলন এখন কোন পথে? সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের’ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। একটি ‘দুই রাষ্ট্র’ ফর্মুলার দিকে ধীরে ধীরে এই দুই পক্ষ এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত এখন এই ফর্মুলার পেছনে ছুরিকাঘাতের শামিল! দুই রাষ্ট্রের ফর্মুলায় পূর্ব জেরুজালেম ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হবে—এমন কথা স্বীকৃত ছিল। ওবামা প্রশাসন এই ‘দুই রাষ্ট্র’ ফর্মুলায় অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সেখান থেকে সরে এলো এখন। তারা ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের সংগ্রামকে উপেক্ষা করে পুরো জেরুজালেম যে ইসরায়েলের রাজধানী, সেটা স্বীকার করল! এতে উপেক্ষিত হলো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের চিন্তাধারা। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ১৯১৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ জে বেলফো ব্রিটিশ জায়নিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি লর্ড রথচাইল্ডকে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠির উদ্দেশ্য হচ্ছে ইহুদিদের জন্য একটি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা। ইতিহাসে এটিই ‘বেলফো’র ঘোষণা নামে পরিচিত। এই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করেই ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনি এলাকা বিভক্তির সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে একাধিকবার আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। মূলত ইসরায়েলের আগ্রাসী তৎপরতার কারণে সেখানে শান্তি পরিকল্পনা বেশি দূর যেতে পারেনি। ১৯৭৮ সালে মিসর ও ইসরায়েল পরস্পরকে স্বীকৃতি ও সিনাই থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার, ১৯৯৩ সালের পিএলও ও ইসরায়েল পরস্পরকে স্বীকৃতি এবং ওয়াশিংটনে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর, ১৯৯৪ সালে গাজা ও জেরিকোতে ফিলিস্তিনি শাসন প্রতিষ্ঠা, ১৯৯৫ সালে পশ্চিম তীরে স্বায়ত্তশাসনসংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর ইত্যাদি শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত হলেও মূল সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। অর্থাৎ স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে বটে; কিন্তু এর কোনো সার্বভৌমত্ব নেই। উপরন্তু পশ্চিম তীর আর গাজা নিয়ে যে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্ম, তা কার্যত অনেকটাই ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘একটি রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়েছে। ইসরায়েল এমন একটি রাষ্ট্রই দেখতে চায়, যা তাদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে। পাঠক, ২০১৪ সালের পরিস্থিতির কথা স্মরণ করতে পারেন। ওই সময় ইসরায়েলি বিমান আর ট্যাংকের গোলায় গাজা নগরী একটি ধ্বংসের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। সাত সপ্তাহ ধরে এই আগ্রাসন অব্যাহত ছিল। ইসরায়েলি বিমান হামলায় শত শত শিশু সেখানে মারা গিয়েছিল। কিন্তু বিশ্বসম্প্রদায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। একদিন, ৭০ বছর আগে, পশ্চিমা বিশ্ব একটি ইহুদি রাষ্ট্র জন্মের পথ প্রশস্ত করেছিল। কিন্তু সেখানে আজও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখন ট্রাম্প কর্তৃক জেরুজালেমকে ইহুদি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতিদানের মধ্য দিয়ে সেই স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা আরো অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে গেল। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেখানে যে অসন্তোষের জন্ম হয়েছে, তা সহজে থামার নয়। এই অসন্তোষ পুরো আরববিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর এতে বাড়তে পারে জঙ্গি তৎপরতা। ট্রাম্প সত্যিকার অর্থেই বিশ্বকে একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিলেন। এতে  ইসরায়েল তার দীর্ঘদিনের ‘পরিকল্পনা’ বাস্তবায়নের পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল। যাঁরা ইসরায়েলি রাজনীতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন তাঁরা জানেন ইনন পরিকল্পনা সম্পর্কে। ওডেড ইনন (Oded Yinon) হচ্ছেন মূলত একজন কট্টর ইহুদি স্ট্র্যাটেজিস্ট। তিনি মূলত একজন গবেষক ও শিক্ষক। বলা যেতে পারে, থিওডোর হারজেল যে স্বপ্ন একসময় দেখতেন, তা বাস্তবে রূপ দিতেই ইনন সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। আর তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও ইসরায়েল সরকার। ইনন পরিকল্পনায় রয়েছে লেবাননকে ভেঙে পাঁচটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করা, সিরিয়াকে ভেঙে একাধিক রাষ্ট্রে পরিণত করা ইত্যাদি (দেখুন, Oded Yinon, A strategy for Israel in the Nineteen Eighties, Belment, Massachusetts, 1982)। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে এই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলেও আজ পর্যন্ত এতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। তবে স্ট্র্যাটেজিতে নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হচ্ছে! আরববিশ্বের মধ্যে যদি বিভক্তি জিইয়ে রাখা যায়, তাতেই লাভ ইসরায়েলের। আজ এত বছর পর ইসরায়েল অনেক অংশে সফল। আরববিশ্বে বিভক্তি যত বেশি স্পষ্ট এখন, অতীতে তেমনটি ছিল না। কাতার-সৌদি দ্বন্দ্ব, সৌদি আরব-ইয়েমেন দ্বন্দ্ব কিংবা ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা, কুর্দিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, সিরিয়া-ইরাকে আইএসের উত্থান ও পতন সব মিলিয়ে মুসলিম বিশ্বের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে ইসরায়েল তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে। ইসরায়েলের এই ‘গ্রেট গেম’ যদি সত্যি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এই একুশ শতকেই নতুন এক মধ্যপ্রাচ্যকে আমরা দেখতে পাব। ইনন পরিকল্পনায় একাধিক মুসলিম রাষ্ট্রের জন্মের কথা যেমন বলা হয়েছে, ঠিক তেমনি একটি ‘গ্রেটার ইসরায়েল রাষ্ট্র’-এর কথাও বলা হয়েছে। বৃহত্তর এই ইসরায়েলি রাষ্ট্রটি গঠিত হবে পুরো ফিলিস্তিনি এলাকা, দক্ষিণ লেবানন থেকে সিডন (Sidon) এবং লিটানি নদী (Litani River), সিরিয়ার গোলান উপত্যকা (যা অনেক আগেই ইসরায়েল দখল করেছে), হাওরান (Hauran) ও দেরা (Deraa) উপত্যকা, হিজাজ (Hijaz), রেলপথ দেরা (Deraa) থেকে আম্মান (জর্দান) পর্যন্ত এবং সেই সঙ্গে Gulf of Aaaba-এর নিয়ন্ত্রণভার। কোনো কোনো ইসরায়েলি স্ট্র্যাটেজিস্ট আরো ইহুদি এলাকা সম্প্রসারণের পক্ষে—পশ্চিমে নীল নদ থেকে পূর্বে ইউফ্রেতিস (Euphraets) নদী পর্যন্ত, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে ফিলিস্তিনি এলাকা, লেবানন, পশ্চিম সিরিয়া ও দক্ষিণ তুরস্ক। স্টেফান লেন্ডম্যানের (Stephen Lendman) বই ‘Greater Isreal’-এ এমন ধারণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখন এই বৃহত্তর ইসরায়েল রাষ্ট্রের ধারণা কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত যে ইসরায়েলকে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উত্সাহ জোগাবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্পষ্টতই মধ্যপ্রাচ্য একটি বিপজ্জনক পথে হাঁটছে এখন।
মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কও এখন প্রশ্নের মুখে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক জেরুজালেম ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ঘোষণা করেছেন। তিনি গত শুক্রবার রাজধানী পুত্রজায়ায় জুমা নামাজের পর এক বিক্ষোভ মিছিলের নেতৃত্ব দেন। সেখানে তিনি বলেন, ট্রাম্পের ওই ঘোষণার বিরুদ্ধে মালয়েশিয়া তার সর্বশক্তি প্রয়োগে প্রস্তুত রয়েছে। এ ধরনের ঘোষণার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মালয়েশিয়ার সম্পর্কের অবনতি হওয়ার একটি ইঙ্গিত দিচ্ছে। যেসব রাষ্ট্র জাতিসংঘে ট্রাম্পের ঘোষণার বিরুদ্ধে ‘অবস্থান’ নিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের ‘দেখে নেওয়ার’ যে পরোক্ষ হুমকি দিয়েছে, তা যেকোনো বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘আগ্রাসী মনোভাবের’ পরিচায়ক। অতীতেও জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু এভাবে ‘হুমকি দিয়ে’ কথা বলার কথা কখনো জাতিসংঘে উচ্চারিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে যে সাত লাখ কোটি ডলার সাহায্য দিয়ে আসছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ট্রাম্প। বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বোকার মতো এই অর্থ ব্যয় করেছে! একজন ‘ব্যবসায়ী’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মূলত রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দ্বিপক্ষীয় সব সম্পর্ককে দেখছেন। যুক্তরাষ্ট্র বড় অর্থনীতির দেশ। বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের। এ কারণে বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই একটি বড় ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু ট্রাম্পের একের পর এক কর্মকাণ্ড তাঁর ‘ভূমিকাকে’ প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা এবং স্বাধীন একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের সংকট বাড়বে বৈ কমবে না। মধ্যপ্রাচ্যের সংকটময় পরিস্থিতিতে এটি একটি নতুন মাত্রা যোগ হলো। এর ফলে এ অঞ্চলে উত্তেজনা রয়ে যাবে। সিরিয়া-ইরাক থেকে আইএস বিতাড়নের পর একদিকে সৌদি-ইয়েমেন দ্বন্দ্বের যেমন কোনো সমাধান হয়নি, ঠিক তেমনি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিকে একটি বিপজ্জনক পথে ঠেলে দিল। চীন ও রাশিয়া ফিলিস্তিনিদের পক্ষে থাকায় এবং ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করায় স্নায়ুযুদ্ধের একটি নয়া রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করব আগামী দিনগুলোতে, যা বিশ্বরাজনীতির জন্য কোনো ভালো খবর বয়ে আনবে না।
Daily Kalerkontho
28.12.2017

নেপালের নির্বাচন ও অনেকগুলো প্রশ্ন

 
 

সম্প্রতি দুই দফায় নেপালের জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। প্রথম পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল গেল ২৬ নভেম্বর, আর দ্বিতীয় পর্যায়ে ভোটাভুটি হয়ে গেল ৭ ডিসেম্বর। নেপালের রাজনীতির জন্য এটা একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। কেননা গেল ১০ বছরে সেখানে একের পর এক সরকার গঠিত হয়েছিল; কিন্তু কোনো সরকারই স্থিতিশীলতা পাচ্ছিল না। তবে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছিল ২০১৫ সালে, যখন একটি সংবিধান রচনা করা সম্ভব হয়েছিল। ওই সংবিধানের আলোকেই এবার নির্বাচনটি সম্পন্ন হলো। কিন্তু ওই নির্বাচন সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে, তা বলা যাবে না। এরই মধ্যে অনেক শঙ্কার জন্ম দিয়েছে এবং নেপালের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। প্রথমত যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হচ্ছেÑ এ নির্বাচন নেপালে একটি স্থিতিশীল সরকার উপহার দিতে পারবে কিনা, অর্থাৎ নির্বাচিত সরকার ৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারবে কিনা? দ্বিতীয়ত, এ নির্বাচনকে ভারত কোন দৃষ্টিতে দেখছে? নেপাল সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন এখন। তৃতীয়ত, নেপালের রাজনীতিতে বামপন্থীদের উত্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য আদৌ কোনো মেসেজ কিনা? এখানে বলা ভালো, নির্বাচনের পর এখন পর্যন্ত নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। এ নির্বাচনে বামপন্থী জোট বিজয়ী হয়েছে। এ বাম জোটে আছে নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি ও মাওবাদীরা। এদের সঙ্গে আরও দুই-একটি দল আছে। ১৬৫ আসনে সরাসরি নির্বাচন হয়েছে। এর মাঝে বাম জোট ৮১টি আসন পেয়েছে। নেপালি পার্লামেন্ট দ্বিকক্ষবিশিষ্টÑ প্রতিনিধিসভা ও রাষ্ট্রীয় সভা। প্রতিনিধিসভার সদস্যসংখ্যা ২৭৫। এর মাঝে ১৬৫ জন সরাসরি নির্বাচিত হবেন, আর বাকি ১১০ জন নির্বাচিত হবেন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের হারে। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সভার সদস্য হচ্ছেন ৫৯ জন। প্রতিনিধিসভায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের হারটি নতুন। পৃথিবীর অনেক দেশের সংসদে এ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারা রয়েছে। যদিও ভারত, বাংলাদেশ কিংবা শ্রীলঙ্কার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে এ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নেই। ভারত পৃথিবীর বড় গণতান্ত্রিক দেশ। তারা গণতন্ত্র বিনির্মাণ করেছে সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে। কিন্তু নেপাল এটা প্রচলন করল। এখন ১৬৫ আসনে সরাসরি নির্বাচন সম্পন্ন হলো। বাকি ১১০ আসনের মধ্য থেকে জোটপ্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়ন দেবে তারা। এর অর্থ হচ্ছে, সংসদে ২৭৫ আসনে বাম জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতাই থাকবে। প্রতিটি দল নির্বাচনে শতকরা যত ভোট পাবে, তাদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব সেভাবে নির্ধারিত হবে। আর এভাবেই ১১০ জন ‘নির্বাচিত’ হবেন। আর এভাবেই হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদে মোট ২৭৫ সংসদ সদস্য প্রতিনিধিত্ব করবেন। এরা ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। অন্যদিকে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বা রাষ্ট্রীয় সভা ৫৯ সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। এর মাঝে ৫৬ জন নির্বাচিত হবেন প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলি, গ্রাম্য কাউন্সিল, মেয়র কিংবা ডেপুটি মেয়রদের পক্ষ থেকে। বাকি তিনজনকে সরকারের পরামর্শক্রমে প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দেবেন। নেপালে প্রদেশ রয়েছে সাতটি।
নেপালে একসময় রাজতন্ত্র ছিল। দীর্ঘদিন দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলে। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নেপালে রাজতন্ত্র পতনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ওই গণঅভ্যুত্থানে নেপালে রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০১ সালের ১ জুন তৎকালীন রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহদেব ও তার পরিবারের সদস্যরা যুবরাজ দীপেন্দ্র কর্তৃক ব্রাশফায়ারে নিহত হন। এরপর রাজা হিসেবে নিযুক্ত হন রাজার ভাই জ্ঞানেন্দ্র। কিন্তু রাজা জ্ঞানেন্দ্র কখনোই জনপ্রিয় ছিলেন না। তিনি ধীরে ধীরে সব ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সরকার মাওবাদীদের দমনে ব্যর্থ এ অভিযোগ তুলে ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজা জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহদেব নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তার এ ক্ষমতা করায়ত্ত করার প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেনি। ফলে প্রচ- বিক্ষোভের মুখে তিনি তৎকালীন সাত দলীয় জোটের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। শেষ পর্যন্ত নেপালে রাজতন্ত্র বাতিল ঘোষিত হয়েছিল। বলা ভালো, ১৭৬৯ সালে হিমালয়ের পাদদেশের এ দেশটিতে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
নেপালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত ঘোষিত হলেও সেখানে একটা বড় সমস্যা ছিল সরকারের স্থিতিশীলতা নিয়ে। গেল ১০ বছরে সেখানে একাধিক সরকার গঠিত হয়েছিল। কিন্তু কোনো সরকারই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি। এমনকি দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বও ছিল প্রবল। একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করা নিয়েও সমস্যা ছিল। সংখ্যালঘুদের অধিকার কীভাবে নিশ্চিত হবে, তা নিয়েও সমস্যা ছিল। তবে নেপালের রাজনীতির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ছিল চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচিত মাওবাদীদের সশস্ত্র বিপ্লবের ধারণা পরিত্যাগ করা ও স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসা। মাওবাদীরা সেখানে দীর্ঘদিন ধরে একটি গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে আসছিল। ২০০৬ সালের ২১ নভেম্বর ওই সময়ের ক্ষমতাসীন সাত দলীয় জোটের প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রসাদ কৈরালার সঙ্গে মাওবাদী নেতা প্রচ- একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। ওই চুক্তি হলে মাওবাদীরা মূল ধারায় ফিরে এসেছিল। পরে প্রচ- দেশটির প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি। একটি সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৮ সালে। কিন্তু দীর্ঘ সময় লেগেছিল একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব নেপালি রাজনীতির অন্যতম সমস্যা। ১৯৯১ সালের ৭ মে সাধারণ ভোটে দীর্ঘ ৩২ বছর পর নেপালে যে পার্লামেন্ট গঠিত হয়েছিল, জুলাই ১৯৯৪ সালে সে পার্লামেন্ট ভেঙে গিয়েছিল মূলত নেপালি কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে। নেপালি কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল মূলত দুই ব্যক্তিকে নিয়ে। একদিকে ছিলেন গিরিজা প্রসাদ কৈরালা, অন্যদিকে ছিলেন কৃষ্ণ প্রসাদ ভট্টরাই। এ দ্বন্দ্বের কারণে দেউবাও এর আগে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পার্টি ফোরামে সিদ্ধান্ত হয়েছিল কৈরালা এবং ভট্টরই কেউই প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী হতে পারবেন না। তখন তৃতীয় প্রার্থী হিসেবে শের বাহাদুর দেউবা উঠে এসেছিলেন। দ্বন্দ্ব ছিল মাওবাদীদের মধ্যেও। প্রচ- (পুষ্প কমল দাহাল) ও বাবুরাম ভট্টরাইয়ের মধ্যকার দ্বন্দ্বে সেখানে মাওবাদীরাও শক্ত অবস্থানে যেতে পারেনি। প্রচ- ও বাবুরাম দুইজনই সীমিত সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। মাওবাদীদের বাইরে ইউনাইটেড মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট পার্টিও (ইউএমএল) নেপালে অন্যতম একটি রাজনৈতিক শক্তি। এর পাশাপাশি মাদেশি ফ্রন্টও স্থানীয়ভাবে শক্তিশালী। জাতীয় পর্যায়ে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি না থাকলেও স্থানীয়ভাবে এরা শক্তিশালী।
মূলত চার ব্যক্তিকে ঘিরে এখন নেপালের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে  শের বাহাদুর দেউবা, খাদগা প্রসাদ অলি, পুষ্প কমল দাহাল ও কামাল থাপা। দেউবা নেপালি কংগ্রেসের নেতা, খাদগা প্রসাদ অলি ইউএমএল নেতা, পুষ্প কমল দাহাল (প্রচ-) মাওবাদীদের নেতা, আর কামাল থাপা রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টির নেতা। এদের একজন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। কোনো একটি দলের পক্ষে এককভাবে সরকার গঠন সম্ভব নয়। তাই দলগুলো জোটবদ্ধ হয়েছিল। বামপন্থী জোটে আছে কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউএমএল), কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী), নয়া শক্তি পার্টি। নয়া শক্তি পার্টির নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক মাওবাদী নেতা বাবুরাম ভট্টরাই। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি আর বাম জোটে থাকেননি গোরকা নির্বাচনী এলাকায় জোটের প্রার্থী হতে না পারায়। পরবর্তীতে তিনি জোটবদ্ধ হয়েছেন, আবার দুইটি বাম সংগঠন রাষ্ট্রীয় জনমোর্চা ও কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের (এমএল) সঙ্গে। অপরদিকে নেপালি কংগ্রেস জোটবদ্ধ হয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি, রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি (গণতান্ত্রিক) এবং মাদেশি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে। মোট ৮৮টি রাজনৈতিক দল এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
নির্বাচনের পরও নেপালে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে কিনা, সেটা একটা মৌলিক প্রশ্ন এখন। বাম জোটে মাওবাদীরা ইউএমএলের সঙ্গে ঐক্য করলেও এ ঐক্য নির্বাচনের পর আদৌ থাকবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে অনেকের মধ্যে। অতীতে খাদগা প্রসাদ অলি যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, সে সরকার পদত্যাগ করেছিল মাওবাদীরা সমর্থন প্রত্যাখ্যান করে নেয়ার কারণে। এমনটি এবারও হতে পারে। বামজোট নির্বাচনে ভালো করলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা নিয়ে অলি-প্রচ- আবারও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে পারেন। এ নির্বাচনের ব্যাপারে চীন ও ভারতের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। এ দেশ দুইটি নেপালি রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। দুইটি দেশের সঙ্গেই নেপালের সীমান্ত রয়েছে। চীন অলির নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন করেছিল। ভারতের একচ্ছত্র বাণিজ্যিক প্রভাব কমাতে চীন নেপালের সঙ্গে একাধিক বাণিজ্যিক চুক্তি করেছিল। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে ভারত চেয়েছিল অলি সরকারের পতন (ডিপ্লোম্যাটি, ২৬ জুলাই ২০১৬)। অনেকেই মনে করেন, নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন একটি সরকার সেখানে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে বেশি। সুতরাং এ নির্বাচনে দেশ দুইটি কোনো না কোনোভাবে প্রভাব খাটাতে চাইবে। নির্বাচনে বাম জোটই ভালো ফল করেছে। এখন সবার দৃষ্টি থাকবে প্রধানমন্ত্রী পদটির দিকে। অলি ও প্রচ- এখন ক্ষমতা ভাগাভাগি করবেন। হয়তো কে পি অলি আগামীতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন। দেউবা হবেন বিরোধী নেতা। তিনি এখন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী। তিনি ১৯৯৫-৯৭, ২০০১, ২০০২, ২০০৪-০৫ সময়সীমায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। একই সঙ্গে অলি ও প্রচ-ও নেপালের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। একজন নারী নেত্রী বিদ্যাদেবী ভা-ারি নেপালের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেও নেপালের রাজনীতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ তেমন একটা নেই। পার্লামেন্টে মহিলাদের জন্য কোনো ‘কোটা’ ব্যবস্থাও নেই। মিসেস ভা-ারি মাওবাদী নেতা ও সাবেক দেশরক্ষামন্ত্রী। তার প্রয়াত স্বামী মদন কুমার ভা-ারিও ছিলেন মাওবাদীদের নেতা। সংসদে তিনি মাওবাদী গ্রুপের ডেপুটি লিডার ছিলেন। ২০১৫ সালের অক্টোবরে তিনি পার্লামেন্ট কর্তৃক ৫ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
কমিউনিস্ট নেতা কে পি অলির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণে চীন খুশি হলেও ভারতের খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। এতে নেপাল বেশি মাত্রায় চীনের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে, নেপালে চীনের প্রভাব বাড়তে পারেÑ এমন আশঙ্কা ভারতের থাকবে। এ অঞ্চলজুড়ে চীন-ভারত দ্বন্দ্বের খবর আমরা জানি। শ্রীলঙ্কায় সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের সময় শ্রীলঙ্কা বেশি মাত্রায় চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল। একসময় ভারত সেখানে সরকার পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয় ও সফল হয়। এখন মালদ্বীপেও চীনের প্রভাব বাড়ছে। তাই দেখতে হবে, নেপালে একটি চীনাবাহু সরকারকে ভারত কোন দৃষ্টিতে দেখে। তাই ভাবি প্রধানমন্ত্রী কে পি অলির ওপর এখন অনেক কিছু নির্ভর করছে তিনি কীভাবে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করেন।
থাকবে। এ অঞ্চলজুড়ে চীন-ভারত দ্বন্দ্বের খবর আমরা জানি। শ্রীলঙ্কায় সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের সময় শ্রীলঙ্কা বেশি মাত্রায় চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল। একসময় ভারত সেখানে সরকার পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয় ও সফল হয়। এখন মালদ্বীপেও চীনের প্রভাব বাড়ছে। তাই দেখতে হবে, নেপালে একটি চীনাবাহু সরকারকে ভারত কোন দৃষ্টিতে দেখে
সম্প্রতি দুই দফায় নেপালের জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। প্রথম পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল গেল ২৬ নভেম্বর, আর দ্বিতীয় পর্যায়ে ভোটাভুটি হয়ে গেল ৭ ডিসেম্বর। নেপালের রাজনীতির জন্য এটা একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। কেননা গেল ১০ বছরে সেখানে একের পর এক সরকার গঠিত হয়েছিল; কিন্তু কোনো সরকারই স্থিতিশীলতা পাচ্ছিল না। তবে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছিল ২০১৫ সালে, যখন একটি সংবিধান রচনা করা সম্ভব হয়েছিল। ওই সংবিধানের আলোকেই এবার নির্বাচনটি সম্পন্ন হলো। কিন্তু ওই নির্বাচন সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে, তা বলা যাবে না। এরই মধ্যে অনেক শঙ্কার জন্ম দিয়েছে এবং নেপালের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। প্রথমত যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হচ্ছেÑ এ নির্বাচন নেপালে একটি স্থিতিশীল সরকার উপহার দিতে পারবে কিনা, অর্থাৎ নির্বাচিত সরকার ৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারবে কিনা? দ্বিতীয়ত, এ নির্বাচনকে ভারত কোন দৃষ্টিতে দেখছে? নেপাল সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হবে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন এখন। তৃতীয়ত, নেপালের রাজনীতিতে বামপন্থীদের উত্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য আদৌ কোনো মেসেজ কিনা? এখানে বলা ভালো, নির্বাচনের পর এখন পর্যন্ত নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। এ নির্বাচনে বামপন্থী জোট বিজয়ী হয়েছে। এ বাম জোটে আছে নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি ও মাওবাদীরা। এদের সঙ্গে আরও দুই-একটি দল আছে। ১৬৫ আসনে সরাসরি নির্বাচন হয়েছে। এর মাঝে বাম জোট ৮১টি আসন পেয়েছে। নেপালি পার্লামেন্ট দ্বিকক্ষবিশিষ্টÑ প্রতিনিধিসভা ও রাষ্ট্রীয় সভা। প্রতিনিধিসভার সদস্যসংখ্যা ২৭৫। এর মাঝে ১৬৫ জন সরাসরি নির্বাচিত হবেন, আর বাকি ১১০ জন নির্বাচিত হবেন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের হারে। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় সভার সদস্য হচ্ছেন ৫৯ জন। প্রতিনিধিসভায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের হারটি নতুন। পৃথিবীর অনেক দেশের সংসদে এ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারা রয়েছে। যদিও ভারত, বাংলাদেশ কিংবা শ্রীলঙ্কার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে এ আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নেই। ভারত পৃথিবীর বড় গণতান্ত্রিক দেশ। তারা গণতন্ত্র বিনির্মাণ করেছে সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে। কিন্তু নেপাল এটা প্রচলন করল। এখন ১৬৫ আসনে সরাসরি নির্বাচন সম্পন্ন হলো। বাকি ১১০ আসনের মধ্য থেকে জোটপ্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়ন দেবে তারা। এর অর্থ হচ্ছে, সংসদে ২৭৫ আসনে বাম জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতাই থাকবে। প্রতিটি দল নির্বাচনে শতকরা যত ভোট পাবে, তাদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব সেভাবে নির্ধারিত হবে। আর এভাবেই ১১০ জন ‘নির্বাচিত’ হবেন। আর এভাবেই হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদে মোট ২৭৫ সংসদ সদস্য প্রতিনিধিত্ব করবেন। এরা ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। অন্যদিকে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বা রাষ্ট্রীয় সভা ৫৯ সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। এর মাঝে ৫৬ জন নির্বাচিত হবেন প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলি, গ্রাম্য কাউন্সিল, মেয়র কিংবা ডেপুটি মেয়রদের পক্ষ থেকে। বাকি তিনজনকে সরকারের পরামর্শক্রমে প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দেবেন। নেপালে প্রদেশ রয়েছে সাতটি।
নেপালে একসময় রাজতন্ত্র ছিল। দীর্ঘদিন দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলে। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নেপালে রাজতন্ত্র পতনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ওই গণঅভ্যুত্থানে নেপালে রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০১ সালের ১ জুন তৎকালীন রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহদেব ও তার পরিবারের সদস্যরা যুবরাজ দীপেন্দ্র কর্তৃক ব্রাশফায়ারে নিহত হন। এরপর রাজা হিসেবে নিযুক্ত হন রাজার ভাই জ্ঞানেন্দ্র। কিন্তু রাজা জ্ঞানেন্দ্র কখনোই জনপ্রিয় ছিলেন না। তিনি ধীরে ধীরে সব ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সরকার মাওবাদীদের দমনে ব্যর্থ এ অভিযোগ তুলে ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজা জ্ঞানেন্দ্র বীর বিক্রম শাহদেব নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তার এ ক্ষমতা করায়ত্ত করার প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেনি। ফলে প্রচ- বিক্ষোভের মুখে তিনি তৎকালীন সাত দলীয় জোটের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। শেষ পর্যন্ত নেপালে রাজতন্ত্র বাতিল ঘোষিত হয়েছিল। বলা ভালো, ১৭৬৯ সালে হিমালয়ের পাদদেশের এ দেশটিতে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
নেপালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত ঘোষিত হলেও সেখানে একটা বড় সমস্যা ছিল সরকারের স্থিতিশীলতা নিয়ে। গেল ১০ বছরে সেখানে একাধিক সরকার গঠিত হয়েছিল। কিন্তু কোনো সরকারই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি। এমনকি দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বও ছিল প্রবল। একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করা নিয়েও সমস্যা ছিল। সংখ্যালঘুদের অধিকার কীভাবে নিশ্চিত হবে, তা নিয়েও সমস্যা ছিল। তবে নেপালের রাজনীতির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ছিল চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচিত মাওবাদীদের সশস্ত্র বিপ্লবের ধারণা পরিত্যাগ করা ও স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসা। মাওবাদীরা সেখানে দীর্ঘদিন ধরে একটি গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে আসছিল। ২০০৬ সালের ২১ নভেম্বর ওই সময়ের ক্ষমতাসীন সাত দলীয় জোটের প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রসাদ কৈরালার সঙ্গে মাওবাদী নেতা প্রচ- একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। ওই চুক্তি হলে মাওবাদীরা মূল ধারায় ফিরে এসেছিল। পরে প্রচ- দেশটির প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি। একটি সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৮ সালে। কিন্তু দীর্ঘ সময় লেগেছিল একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব নেপালি রাজনীতির অন্যতম সমস্যা। ১৯৯১ সালের ৭ মে সাধারণ ভোটে দীর্ঘ ৩২ বছর পর নেপালে যে পার্লামেন্ট গঠিত হয়েছিল, জুলাই ১৯৯৪ সালে সে পার্লামেন্ট ভেঙে গিয়েছিল মূলত নেপালি কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে। নেপালি কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল মূলত দুই ব্যক্তিকে নিয়ে। একদিকে ছিলেন গিরিজা প্রসাদ কৈরালা, অন্যদিকে ছিলেন কৃষ্ণ প্রসাদ ভট্টরাই। এ দ্বন্দ্বের কারণে দেউবাও এর আগে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পার্টি ফোরামে সিদ্ধান্ত হয়েছিল কৈরালা এবং ভট্টরই কেউই প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী হতে পারবেন না। তখন তৃতীয় প্রার্থী হিসেবে শের বাহাদুর দেউবা উঠে এসেছিলেন। দ্বন্দ্ব ছিল মাওবাদীদের মধ্যেও। প্রচ- (পুষ্প কমল দাহাল) ও বাবুরাম ভট্টরাইয়ের মধ্যকার দ্বন্দ্বে সেখানে মাওবাদীরাও শক্ত অবস্থানে যেতে পারেনি। প্রচ- ও বাবুরাম দুইজনই সীমিত সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। মাওবাদীদের বাইরে ইউনাইটেড মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট পার্টিও (ইউএমএল) নেপালে অন্যতম একটি রাজনৈতিক শক্তি। এর পাশাপাশি মাদেশি ফ্রন্টও স্থানীয়ভাবে শক্তিশালী। জাতীয় পর্যায়ে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি না থাকলেও স্থানীয়ভাবে এরা শক্তিশালী।
মূলত চার ব্যক্তিকে ঘিরে এখন নেপালের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে  শের বাহাদুর দেউবা, খাদগা প্রসাদ অলি, পুষ্প কমল দাহাল ও কামাল থাপা। দেউবা নেপালি কংগ্রেসের নেতা, খাদগা প্রসাদ অলি ইউএমএল নেতা, পুষ্প কমল দাহাল (প্রচ-) মাওবাদীদের নেতা, আর কামাল থাপা রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টির নেতা। এদের একজন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। কোনো একটি দলের পক্ষে এককভাবে সরকার গঠন সম্ভব নয়। তাই দলগুলো জোটবদ্ধ হয়েছিল। বামপন্থী জোটে আছে কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউএমএল), কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী), নয়া শক্তি পার্টি। নয়া শক্তি পার্টির নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক মাওবাদী নেতা বাবুরাম ভট্টরাই। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি আর বাম জোটে থাকেননি গোরকা নির্বাচনী এলাকায় জোটের প্রার্থী হতে না পারায়। পরবর্তীতে তিনি জোটবদ্ধ হয়েছেন, আবার দুইটি বাম সংগঠন রাষ্ট্রীয় জনমোর্চা ও কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের (এমএল) সঙ্গে। অপরদিকে নেপালি কংগ্রেস জোটবদ্ধ হয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি, রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি (গণতান্ত্রিক) এবং মাদেশি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে। মোট ৮৮টি রাজনৈতিক দল এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
নির্বাচনের পরও নেপালে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে কিনা, সেটা একটা মৌলিক প্রশ্ন এখন। বাম জোটে মাওবাদীরা ইউএমএলের সঙ্গে ঐক্য করলেও এ ঐক্য নির্বাচনের পর আদৌ থাকবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে অনেকের মধ্যে। অতীতে খাদগা প্রসাদ অলি যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, সে সরকার পদত্যাগ করেছিল মাওবাদীরা সমর্থন প্রত্যাখ্যান করে নেয়ার কারণে। এমনটি এবারও হতে পারে। বামজোট নির্বাচনে ভালো করলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা নিয়ে অলি-প্রচ- আবারও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে পারেন। এ নির্বাচনের ব্যাপারে চীন ও ভারতের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। এ দেশ দুইটি নেপালি রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। দুইটি দেশের সঙ্গেই নেপালের সীমান্ত রয়েছে। চীন অলির নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন করেছিল। ভারতের একচ্ছত্র বাণিজ্যিক প্রভাব কমাতে চীন নেপালের সঙ্গে একাধিক বাণিজ্যিক চুক্তি করেছিল। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে ভারত চেয়েছিল অলি সরকারের পতন (ডিপ্লোম্যাটি, ২৬ জুলাই ২০১৬)। অনেকেই মনে করেন, নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন একটি সরকার সেখানে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে বেশি। সুতরাং এ নির্বাচনে দেশ দুইটি কোনো না কোনোভাবে প্রভাব খাটাতে চাইবে। নির্বাচনে বাম জোটই ভালো ফল করেছে। এখন সবার দৃষ্টি থাকবে প্রধানমন্ত্রী পদটির দিকে। অলি ও প্রচ- এখন ক্ষমতা ভাগাভাগি করবেন। হয়তো কে পি অলি আগামীতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন। দেউবা হবেন বিরোধী নেতা। তিনি এখন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী। তিনি ১৯৯৫-৯৭, ২০০১, ২০০২, ২০০৪-০৫ সময়সীমায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। একই সঙ্গে অলি ও প্রচ-ও নেপালের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। একজন নারী নেত্রী বিদ্যাদেবী ভা-ারি নেপালের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেও নেপালের রাজনীতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ তেমন একটা নেই। পার্লামেন্টে মহিলাদের জন্য কোনো ‘কোটা’ ব্যবস্থাও নেই। মিসেস ভা-ারি মাওবাদী নেতা ও সাবেক দেশরক্ষামন্ত্রী। তার প্রয়াত স্বামী মদন কুমার ভা-ারিও ছিলেন মাওবাদীদের নেতা। সংসদে তিনি মাওবাদী গ্রুপের ডেপুটি লিডার ছিলেন। ২০১৫ সালের অক্টোবরে তিনি পার্লামেন্ট কর্তৃক ৫ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
কমিউনিস্ট নেতা কে পি অলির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণে চীন খুশি হলেও ভারতের খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। এতে নেপাল বেশি মাত্রায় চীনের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে, নেপালে চীনের প্রভাব বাড়তে পারেÑ এমন আশঙ্কা ভারতের থাকবে। এ অঞ্চলজুড়ে চীন-ভারত দ্বন্দ্বের খবর আমরা জানি। শ্রীলঙ্কায় সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের সময় শ্রীলঙ্কা বেশি মাত্রায় চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল। একসময় ভারত সেখানে সরকার পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয় ও সফল হয়। এখন মালদ্বীপেও চীনের প্রভাব বাড়ছে। তাই দেখতে হবে, নেপালে একটি চীনাবাহু সরকারকে ভারত কোন দৃষ্টিতে দেখে। তাই ভাবি প্রধানমন্ত্রী কে পি অলির ওপর এখন অনেক কিছু নির্ভর করছে তিনি কীভাবে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করেন।
Daily Alokito Bangladesh
24.12.2017

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বিপজ্জনক খেলা


জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক বিপজ্জনক খেলা শুরু করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি এই কাজটি করবেন।
শেষ পর্যন্ত করলেনও। এতে করে ইসরায়েল খুশি হলেও, কোনো দেশই খুশি হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের যারা ট্র্যাডিশনাল মিত্র, বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলো, তারাও খুশি হতে পারেনি। ফলে মধ্যপ্রাচ্য নতুন এক অস্থিরতার যুগে প্রবেশ করল। একদিকে সিরিয়া ও ইরাকে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিদের পরাজয়, অন্যদিকে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ সম্প্রসারিত হওয়া মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিকে যখন আরো অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে, ঠিক তখনই এলো জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টি। যদিও ট্রাম্প এর পেছনে যে যুক্তিটি দেখিয়েছেন, তা হচ্ছে নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি ওয়াদাবদ্ধ ছিলেন। এখন সেই ওয়াদা তিনি কার্যকর করলেন। কিন্তু তাঁর এই সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে একটি বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। খোদ ফিলিস্তিনেই যে এর প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে তেমনটি নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের ট্র্যাডিশনাল বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছে। স্পষ্টতই এতে করে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়া এখন বিলম্বিত হবে। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে মুসলিম বিশ্ব এবং সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাবে, সেটা ছিল স্বাভাবিক। নতুন করে আবার গণ-আন্দোলন শুরু হলো। আর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আরো আগ্রাসী হয়ে উঠেছে এ ঘটনার পর। কী হতে পারে এখন মধ্যপ্রাচ্যে? কিংবা বিশ্ব রাজনীতিতে এর কি কোনো প্রভাব পড়বে? এরই মধ্যে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোতে যেসব বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে একটি ‘অশনিসংকেত’ই দেওয়া হয়েছে। এতে করে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি অবস্থান শক্তিশালী হলো। ইসরায়েলে ১৯৮০ সালে আইন করে পূর্ব জেরুজালেমকে (পূর্ব ও পশ্চিম জেরুজালেম) ইসরায়েল রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এই ঘোষণা বিশ্ব সম্প্রদায় মানেনি। এমনকি জাতিসংঘও ইসরায়েলি এই সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছিল। এমনকি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত এক সিদ্ধান্তের (সিদ্ধান্ত নম্বর ৪৭৮, ১৯৮০) পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলকে ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েল কখনোই জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মানেনি। বরং ধীরে ধীরে একটি বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জেরুজালেমকে গ্রাস করতে চেয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে ট্রাম্পের সময়ে এসে।
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন। ১৯৯৫ সালে মার্কিন কংগ্রেসে একটি আইন পাস হয়। তাতে ইসরায়েলে মার্কিন দূতাবাসকে তেলআবিবের পরিবর্তে জেরুজালেমে স্থানান্তরের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টই এই সিদ্ধান্তটি কার্যকর করেননি। তাঁরা বারবার সময় নিয়েছেন। কংগ্রেসে গৃহীত সিদ্ধান্তে প্রেসিডেন্টকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট বুশ, ক্লিনটন, ওবামা—কেউই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেননি। এখন হঠাৎ করেই ট্রাম্প এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্প কেন এটি করলেন? এখানে অনেক কারণ আছে। প্রথমত, একটি শক্তিশালী প্রো-ইসরায়েলি লবিস্ট গ্রুপ এটা চেয়ে আসছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই মনে করে, রাতারাতি এই কাজটি হয়নি। একটি শক্তিশালী গ্রুপ এর পেছনে সক্রিয় ছিল। একজন ধনী ব্যবসায়ী ও ক্যাসিনো মোগল হিসেবে পরিচিত শেলডন এভেলসন ও তাঁর স্ত্রী মারিয়াম অকশ্রম ২০১৬ সালে রিপাবলিকান পার্টিকে ৮৩ মিলিয়ন ডলার দিয়েছিলেন, যাতে করে নয়া প্রেসিডেন্ট (রিপাবলিকান) প্রো-ইসরায়েলি নীতি গ্রহণ করতে পারেন। এসব নীতিমালার একটি ছিল ইসরায়েলের রাজধানীকে জেরুজালেমে স্থানান্তর। এর বাইরে বিভিন্ন প্রো-ইসরায়েলি থিংক ট্যাংক গেল বছর ২০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছিল ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণা টিমকে। এর মধ্যে ছিল বিতর্কিত আমেরিকান-ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি (এআইপিএসি)। এআইপিএসি বরাবরই চেয়ে এসেছে ইসরায়েলের রাজধানী জেরুজালেমে হোক। ইভানগেলিস ক্রিশ্চিয়ানরা (Christian Evangelics) ব্যাপক হারে ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। তাদেরও একটা প্রেসার ছিল (তথ্যসূত্র টিআরটি ওয়ার্ল্ড)। দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের জামাতা কুশনার, যিনি একজন ইহুদি, বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে অনেক নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সরকারিভাবে তিনি এই ভূমিকাটি পালন করেন। ফলে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কুশনারের একটি বড় ভূমিকা ছিল।
এখন ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের ফলে কী হতে পারে? মার্কিন শক্তিশালী গণমাধ্যম পাঁচটি সম্ভাব্য পরিণতির কথা বলছে। এক. যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বিশ্বের প্রথম দেশ, যারা জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকার করে নিল (ফিলিপাইন ও চেক রিপাবলিক বলছে, তারাও তাদের দূতাবাস স্থানান্তরিত করবে)। এর মধ্য দিয়ে জেরুজালেমের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে এক ধরনের ‘স্ট্যাটাসকো’ ছিল, তা লঙ্ঘিত হলো। দুই. এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এটি মানেনি। তারা পূর্ব জেরুজালেমকে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। তিন. জেরুজালেম বাহ্যত তিনটি পবিত্র ধর্মেরই (ইসলাম, খ্রিস্টান ও ইহুদি) পবিত্র ধর্মীয় স্থান। মুসলমানদের পবিত্র মসজিদ বায়তুল মোকাদ্দাস রয়েছে এখানে। এখন শুধু একটি ধর্মের (ইহুদি) অনুসারীদের রাজধানী করায় তাতে অন্য ধর্মের অনুসারীদের ধর্মকর্ম পালনে বাধাবিপত্তি আসতে পারে। চার. জেরুজালেমের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী হচ্ছে ফিলিস্তিনি। এই সিদ্ধান্ত এখানে উত্তেজনা বাড়াবে। উপরন্তু আন্তর্জাতিক আইন ও নিষেধাজ্ঞা (জাতিসংঘের) উপেক্ষা করে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেমে ইহুদি বসতি গড়ে তুলছে। এ নিয়ে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে তাদের নিত্য বিবাদের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে। পাঁচ. বিশ্ব সম্প্রদায়, মুসলিম বিশ্ব, ইউরোপীয় ইউনিয়ন—কেউই ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেনি। তারা বারবার বলে আসছে, এতে করে এই অঞ্চলের অস্থিতিশীলতা আরো বাড়ল। উল্লেখ্য, জেরুজালেম শহরের ইতিহাস সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো। তিনটি ধর্মের জন্যই পবিত্র শহর জেরুজালেম বিখ্যাত। এখানে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের জন্য যে ধর্মীয় এলাকা রয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে Holy Sepulchre, Calvary,, যেখানে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, আর The Empty Tomb, যেখানে যিশুকে কবর দেওয়া হয়েছিল। ইহুদিদের জন্য পবিত্র স্থান Western Wall-এ রয়েছে Temple Mount,, যা কি না হাজার হাজার ইহুদির ধর্মীয় স্থান। আর মুসলমানদের জন্য রয়েছে   Al-Aqsa মসজিদ, যা কি না মুসলমানদের তৃতীয় ধর্মীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত।
এখন অনেকেই যেটা বলার চেষ্টা করছে, তা হচ্ছে এ ঘটনার মধ্য দিয়ে নতুন করে ফিলিস্তিনি গণ-অভ্যুত্থান, যা ইন্তিফাদা নামে পরিচিত, তা আবার শুরু হলো। ইন্তিফাদা প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৮৭ সালে, আর এ পর্যায়ে এ আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ১৯৯১ সালে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হয়েছিল ২০০০ সালে, আর শেষ হয়েছিল ২০০৫ সালে। আর এখন শুরু হলো তৃতীয় ইন্তিফাদা। এর শেষ কবে হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। খুব সংগত কারণেই এটা বলা সম্ভব, অতিদ্রুত এটা শেষ হচ্ছে না। তৃতীয় ইন্তিফাদা শুরু হলো মাত্র।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের’ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। একটি ‘দুই রাষ্ট্র’ ফর্মুলার দিকে ধীরে ধীরে এই দুই পক্ষ এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত এখন এ ফর্মুলার পেছনে ছুরিকাঘাতের শামিল। দুই রাষ্ট্রের ফর্মুলায় পূর্ব জেরুজালেম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হবে—এমন কথা স্বীকৃত ছিল। ওবামা প্রশাসন এই ‘দুই রাষ্ট্র’ ফর্মুলায় অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সেখান থেকে ‘ইউটার্ন’ নিল। তারা ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের সংগ্রামকে উপেক্ষা করে সমগ্র জেরুজালেম যে ইসরায়েলের  রাজধানী, সেটা স্বীকার করল। এতে করে উপেক্ষিত হলো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের চিন্তাধারা। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ১৯১৭ সালে তৎকালীন  ব্রিটিশ  পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ জে বেলফো ব্রিটিশ জায়নিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি লর্ড রথচাইল্ডকে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠির উদ্দেশ্য হচ্ছে ইহুদিদের জন্য একটি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা। ইতিহাসে এটিই বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত। এই সিদ্ধান্ত  অনুসরণ করেই ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনি  এলাকা বিভক্তির সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রটি  প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে একাধিককার আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। মূলত ইসরায়েলের আগ্রাসী তৎপরতার কারণে সেখানে শান্তি পরিকল্পনা বেশি দূর যেতে পারেনি।
১৯৭৮ সালে মিসর ও ইসরায়েল পরস্পরকে স্বীকৃতি ও সিনাই থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার, ১৯৯৩ সালে পিএলও এবং ইসরায়েল পরস্পকৃকে স্বীকৃতি ও ওয়াশিংটনে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর, ১৯৯৪ সালে গাজা ও জেরিকোতে  ফিলিস্তিনি শাসন প্রতিষ্ঠা, ১৯৯৫ সালে পশ্চিম তীরে স্বায়ত্তশাসন-সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর ইত্যাদি শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত হলেও মূল সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। অর্থাৎ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু এর কোনো সার্বভৌমত্ব  নেই। উপরন্তু পশ্চিম তীর আর গাজা নিয়ে যে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্ম, তা কার্যত অনেকটাই ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েল এমন একটি রাষ্ট্রই দেখতে চায়, যা তাদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে। পাঠক, ২০১৪ সালের পরিস্থিতির কথা স্মরণ করতে পারেন। ওই সময় ইসরায়েলি বিমান আর ট্যাংকের গোলায় গাজা নগরী একটি ধ্বংসের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। সাত সপ্তাহব্যাপী এই আগ্রাসন অব্যাহত ছিল। ইসরায়েলি বিমান হামলায় শত শত শিশু সেখানে মারা গিয়েছিল। কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। একদিন, ৭০ বছর আগে পশ্চিমা বিশ্ব একটি ইহুদি রাষ্ট্র জন্মের পথ প্রশস্ত করেছিল। কিন্তু সেখানে আজও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখন ট্রাম্প কর্তৃক জেরুজালেমকে ইহুদি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতিদানের মধ্য দিয়ে সেই স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা আরো অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে গেল। এই শেষ ঘোষণার মধ্য দিয়ে যে অসন্তোষের জন্ম হয়েছে, তা সহজে থামার নয়। এই অসন্তোষ সমগ্র আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর এতে করে বাড়তে পারে জঙ্গি তৎপরতা। ট্রাম্প সত্যিকার অর্থেই তাই বিশ্বকে একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিলেন
Daily Kalerkontho
20.12.2017

ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত ও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ



একজন আকায়েদ উল্লাহ নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে অবস্থিত পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালের পাতালপথে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে গিয়ে বড় ধরনের সংবাদের জন্ম দিয়েছেন। এই আকায়েদ উল্লাহ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত, তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা। ফ্যামিলি ভিসায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন এবং সেখানেই থাকতেন। এ ঘটনায় বাংলাদেশে যেমনি তোলপাড় শুরু হয়েছে, ঠিক তেমনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মাঝেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা এখন ‘হেইট ক্রাইম’-এর শিকার হতে পারেন। একই সঙ্গে ব্যাপক স্কুট্রিনিরও শিকার হতে পারেন তারা। তবে এই ঘটনা প্রমাণ করল যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে মুসলমান সমাজে সর্বত্র অসন্তোষ আছে। বিশেষ করে ট্রাম্পের সর্বশেষ সিদ্ধান্তে, যেখানে তিনি জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় বইছে। পূর্ব জেরুজালেম হচ্ছে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী। এখানে রয়েছে মুসলমানদের পবিত্র মসজিদ আল আকসা। একজন মুসলমান হিসেবে আকায়েদ উল্লাহর কাছেও ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত মনঃপূত হয়নি। আকায়েদ উল্লাহ তার ফেসবুকে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আগেই হুশিয়ারি দিয়েছিলেন। আকায়েদ জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছে, জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস-এর জন্যই সে এ কাজটি করেছে। সে সিরিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে মার্কিন বিমান হামলার জবাবে এই হামলা বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। তিনি মার্কিন পুলিশকে কী বলেছেন, কতটুকু বলেছেন, তার বিস্তারিত আমরা জানি না। মার্কিন পুলিশ যা বলছে এবং যা পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, সেটাই আমরা উল্লেখ করতে পারি মাত্র। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, গেল নভেম্বর (২০১৭) মাসে ম্যানহাটনে একজন উজবেক নাগরিক সাইফুল সাইপভ পথচারীদের ওপর ট্রাক চালিয়ে দিয়ে ৯২ জনকে হত্যা করেছিল। সেও ছিল আকায়েদ উল্লাহর মতো অভিবাসী এবং আইএস সমর্থক। এর অর্থ পরিষ্কার, আকায়েদ উল্লাহ কিংবা সাইফুল সাইপভরা নিজ দেশে জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে জড়িত না থাকলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত হয়েছে। এর পেছনে কাজ করেছে মার্কিনি নীতি। সিরিয়া কিংবা জেরুজালেম নিয়ে মার্কিনি সিদ্ধান্তে তারা অসন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে কী ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান বের করা যাবে? এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তো ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানকে আরও জটিল করে তুলবে।


সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও ইসরাইলের মধ্যে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। একটি ‘দুই রাষ্ট্র’ ফর্মুলার দিকে ধীরে ধীরে এই দুই পক্ষ এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত এখন এই ফর্মুলার পেছনে ছুরিকাঘাতের শামিল। দুই রাষ্ট্রের ফর্মুলায় পূর্ব জেরুজালেম ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হবে- এমন কথা স্বীকৃত ছিল। ওবামা প্রশাসন এই দুই রাষ্ট্র ফর্মুলায় অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সেখান থেকে সরে আসল এখন। তারা ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের সংগ্রামকে উপেক্ষা করে সমগ্র জেরুজালেম যে ইসরাইলের রাজধানী, সেটা স্বীকার করলেন। এতে করে উপেক্ষিত হল স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের চিন্তাধারা। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ১৯১৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এজে বেলফোর ব্রিটিশ জায়নিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি লর্ড রথচাইল্ড একটি চিঠি দেন। ওই চিঠির উদ্দেশ্য হচ্ছে ইহুদিদের জন্য একটি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা। ইতিহাসে এটাই বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত। এই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করেই ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনি এলাকা বিভক্তির সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে একাধিকবার আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। মূলত ইসরাইলের আগ্রাসী তৎপরতার কারণে সেখানে শান্তি পরিকল্পনা বেশিদূর যেতে পারেনি। ১৯৭৮ সালে মিসর ও ইসরাইল পরস্পরকে স্বীকৃতি ও সিনাই থেকে ইসরাইলি সৈন্য প্রত্যাহার, ১৯৯৩ সালে পিএলও এবং ইসরাইল পরস্পরকে স্বীকৃতি ও ওয়াশিংটনে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর, ১৯৯৪ সালে গাজা ও জেরিকোতে ফিলিস্তিনি শাসন প্রতিষ্ঠা, ১৯৯৫ সালে পশ্চিম তীরে স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর ইত্যাদি শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত হলেও, মূল সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। অর্থাৎ স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু এর কোনো সার্বভৌমত্ব নেই। উপরন্তু পশ্চিম তীর আর গাজা নিয়ে যে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্ম, তা কার্যত অনেকটাই ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ইসরাইল এমন একটি রাষ্ট্রই দেখতে চায়, যা তাদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে। পাঠক, ২০১৪ সালের পরিস্থিতির কথা স্মরণ করতে পারেন। ওই সময় ইসরাইলি বিমান আর ট্যাংকের গোলায় গাজা নগরী একটি ধ্বংসের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। ৭ সপ্তাহব্যাপী এই আগ্রাসন অব্যাহত ছিল। ইসরাইলি বিমান হামলায় শত শত শিশু সেখানে মারা গিয়েছিল। কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। একদিন ৭০ বছর আগে, পশ্চিমা বিশ্ব একটি ইহুদি রাষ্ট্র জন্মের পথ প্রশস্ত করেছিল। কিন্তু সেখানে আজও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখন ট্রাম্প কর্তৃক জেরুজালেমকে ইহুদি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতিদানের মধ্য দিয়ে সেই স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা আরও অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে গেল। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেখানে যে অসন্তোষের জন্ম হয়েছে, তা সহজে থামবার নয়। এই অসন্তোষ সমগ্র আরব বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর এতে করে বাড়তে পারে জঙ্গি তৎপরতা। ট্রাম্প সত্যিকার অর্থেই তাই বিশ্বকে একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিলেন। এতে করে ইসরাইল তার দীর্ঘদিনের ‘পরিকল্পনা’ বাস্তবায়নের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। যারা ইসরাইলি রাজনীতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন, তারা জানেন ইনন পরিকল্পনা সম্পর্কে। ওডেড ইনন (Oded Yinon) হচ্ছেন মূলত একজন কট্টর ইহুদি স্ট্র্যাটেজিস্ট। তিনি মূলত একজন গবেষক ও শিক্ষক। বলা যেতে পারে থিওডোর হারজেল যে স্বপ্ন এক সময় দেখতেন, তার বাস্তবে রূপ দিতেই ইনন সদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। আর তা বাস্তবে রূপ দেয়ার পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী ও দেশটির সরকার। ইনন পরিকল্পনায় রয়েছে লেবাননকে ভেঙে ৫টি রাষ্ট্রে বিভক্ত করা, সিরিয়াকে ভেঙে একাধিক রাষ্ট্রে পরিণত করা ইত্যাদি (দেখুন, oded Yinon, A Strategy for Israel in the Nineteen Eighties, Belmart, Massachusetts, 1982) আজ থেকে ৩৫ বছর আগে এই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলেও, আজ অব্দি এতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। তবে স্ট্র্যাটেজিতে নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হচ্ছে। আরব বিশ্বের মাঝে যদি বিভক্তি জিইয়ে রাখা যায়, তাতেই লাভ ইসরাইলের। আজ এত বছর পর ইসরাইল অনেক অংশে সফল। আর বিশ্বে বিভক্তি যত বেশি স্পষ্ট এখন, অতীতে তেমনটি ছিল না। কাতার-সৌদি দ্বন্দ্ব, সৌদি আরব-ইয়েমেন দ্বন্দ্ব কিংবা ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা, কুর্দিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, সিরিয়া-ইরাকে আইএসের উত্থান ও পতন- সব মিলিয়ে মুসলিম বিশ্বের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করে ইসরাইল তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে। ইরাইলের এই ‘গ্রেট গেম’ যদি সত্যি সত্যি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এই একুশ শতকেই নতুন এক মধ্যপ্রাচ্যকে আমরা দেখতে পাব। ইনন পরিকল্পনায় একাধিক মুসলিম রাষ্ট্রের জন্মের কথা যেমনি বলা হয়েছে, ঠিক মেনি একটি ‘গ্রেটার ইসরাইল রাষ্ট্র’-এর কথাও বলা হয়েছে। বৃহত্তর এই ইসরাইলি রাষ্ট্রটি গঠিত হবে পুরো ফিলিস্তিনি এলাকা, দক্ষিণ লেবানন থেকে সিডন (Sidon) এবং লিটানী নদী (Litani River), সিরিয়ার গোলান উপত্যকা (যা অনেক আগেই ইসরাইল দখল করেছে), হাওরান (Hauran) এবং দেরা (Deraa) উপত্যকা, হিজাজ (Hijay) রেলপথ দেরা (Deraa) থেকে আম্মান (জর্ডান) পর্যন্ত এবং সেই সঙ্গে Gulf of aqaba-এর নিয়ন্ত্রণভার। কোনো কোনো ইসরাইলি স্ট্র্যাটেজিস্ট আরও ইহুদি এলাকা সম্প্রসারণের পক্ষে- পশ্চিমে নীলনদ থেকে পূর্বে ইউফ্রেটিস (Euphrates) নদী পর্যন্ত, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে ফিলিস্তিনি এলাকা, লেবানন, পশ্চিম সিরিয়া ও দক্ষিণ তুরস্ক।

স্টেফান লেডম্যান (Stephen Lendman-এর বই Greater Israel-এ এমন ধারণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে) এখন এই বৃহত্তর ইসরাইল রাষ্ট্রের ধারণা কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত যে ইসরাইলকে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে উৎসাহ জোগাবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্পষ্টতই মধ্যপ্রাচ্য একটি বিপজ্জনক পথে হাঁটছে এখন।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আকায়েদ উল্লাহরা কেন এর প্রতিবাদে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িত করবে? আকায়েদ উল্লাহ কিংবা সাইফুলরা ‘রেডিকালাইজড’ হয়েছে তাদের নিজ দেশে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রে। আকায়েদ দীর্ঘদিন যাবৎ যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। জেহাদি মতাদর্শে তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে থেকে। এমনকি ‘বোমা বানানোর’ যে কারিগরি জ্ঞান, তা তিনি পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। আমার ভাবতে অবাক লাগে এফবিআইর গোয়েন্দা নজরদাবিতে কেন তিনি আগে এলেন না? কেন মার্কিন গোয়েন্দারা তার সম্পর্কে আগে জানতে পারল না। আকায়েদ উল্লাহ এখন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত। সেখানকার আইনে তার বিচার হবে। কিন্তু তিনি শুধু তার নিজ পরিবারই নয়, বরং বাংলাদেশ সম্পর্কেও বহির্বিশ্বে খারাপ ধারণা দিলেন। তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ভার বাংলাদেশ নেবে না। কিন্তু তিনি অনেক ক্ষতি করে গেলেন বাংলাদেশের, সেই সঙ্গে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতদের যারা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে আসছেন তাদেরও। সহনীয় ইসলামের দেশ বাংলাদেশ। এখানে সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান নেই। হাজার বছরের ইসলামের যে ঐতিহ্য বাংলাদেশে রয়েছে, সেখানে জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্বের উম্মাহে বিশ্বাসী। বাংলাদেশের জনগণ ইসরাইলি আগ্রাসনের মুখে ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রামের পাশে থেকে বরাবর তাদের সাহায্য ও নৈতিক সমর্থন জুগিয়ে এসেছে। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশি একজন বংশোদ্ভূত মানুষ এটাকে ইস্যু করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করবে, তা সমর্থনযোগ্য নয়। একজন আকায়েদ উল্লাহকে দিয়ে পুরো বাংলাদেশকে বিচার করা যাবে না। আমরা পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হবে, এটা যেমনি বিশ্বাস করি, ঠিক তেমনি এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেরও নিন্দা জানাই।
Daily Jugantor
18.12.2017

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি কোন পথে

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এখন কোন পথে? একদিকে সিরিয়া-ইরাক থেকে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের উৎখাত, ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধকে কেন্দ্র করে সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহর মৃত্যু এবং সর্বশেষ ঘটনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক জেরুজালেমে মার্কিনি দূতাবাস স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে সারা বিশ্বে একটা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস, যারা গাজা নিয়ন্ত্রণ করে তারা গণঅভ্যুত্থান বা ইন্তিফাদার (তৃতীয়) ডাক দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেডিশনাল মিত্র, ইউরোপের দেশগুলোও ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে। এই ইস্যুতে উত্তপ্ত হচ্ছে বিশ্ব রাজনীতি। এখানে বলা ভালো, পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনিরা তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে মনে করে। ১৯৮০ সালে ইসরায়েল এক আইনবলে পুরো জেরুজালেমকে ইসরায়েল রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রই ইসরায়েলের এই ঘোষণাকে মেনে নেয়নি। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘে গৃহীত এক সিদ্ধান্তের (৪৭৮নং সিদ্ধান্ত, ১৯৮০) সমালোচনা করা হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নিয়েছিল। সেই থেকে ইসরায়েল এই অঞ্চলটি তাদের দখলে রেখেছে। এখানে রয়েছে পবিত্র আল আকসা মসজিদ। স্পষ্টতই ট্রাম্পের দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত এ অঞ্চলের রাজনীতিকে আরও উত্তপ্ত করবে। বেশ কিছুদিন ধরেই এ অঞ্চলে বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। কাতারের সঙ্গে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের যে বিরোধ, তারও কোনো সমাধান হয়নি। এই বিরোধ কোনো বড় ধরনের সংকটের জন্ম না দিলেও এই বিরোধের জের ধরে এ অঞ্চলে উত্তেজনা আছে। সিরিয়া-ইরাক থেকে আইএস বিতাড়িত হলেও পুরো মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব কমে গেছে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আইএস জঙ্গিরা ছড়িয়ে পড়েছে এবং তারা আগামীতে বড় ধরনের সংবাদের জন্ম দিতে পারে। সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাম্প্রতিক ভূমিকা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে। বিশেষ করে সৌদি আরবের ইয়েমেনবিরোধী ভূমিকা এবং দীর্ঘযুদ্ধে তার ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ‘আরব বসন্তের’ রেশ ধরে সেখানে আলী আবদুল্লাহ সালেহ সরকারের পতন ঘটেছিল ২০১১ সালে। সালেহ ১৯৭৮ সালের পর থেকে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিলেন। কিন্তু তার পতনে সেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ হয়নি, যা প্রত্যাশিত ছিল। বরং সেখানে হুথি বিদ্রোহী গ্রুপের জন্ম হয়েছিল, যারা বাধ্য করেছিল সালেহ-পরবর্তী প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদিকে রাজধানী সানা ছেড়ে যেতে। ইয়েমেনে কার্যত কোনো সরকার নেই। হুথি বিদ্রোহীরা, যাদের ইরান সমর্থন করে তারাই এখন রাজধানী নিয়ন্ত্রণ করছে। এখানে ইয়েমেনের ইতিহাস নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। আজকের যে ইয়েমেন তা এক সময় দুভাগে বিভক্ত ছিল। উত্তর ইয়েমেন ও দক্ষিণ ইয়েমেন। উত্তর ইয়েমেন ট্রেডিশনালি স্বাধীন। ধরা হয়, উত্তর ইয়েমেন স্বাধীন হয়েছে ১৯১৮ সালের ১ নভেম্বর (আর দক্ষিণ ইয়েমেন স্বাধীন হয় ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর)। দুই ইয়েমেনের মধ্যেই বৈরিতা ও যুদ্ধের ইতিহাসও আছে। আজকের ইয়েমেনের যে পরিস্থিতি, তার সঙ্গে অতীত ইতিহাসের একটা যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৬২ সালে উত্তর ইয়েমেনের শাসক ইমাম আহমেদ বিন ইয়াহিয়া মারা গেলে তার ছেলে ক্ষমতাসীন হন। কিন্তু সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করতে চাইলে সেখানে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। ওই গৃহযুদ্ধে সৌদি আরব, ব্রিটেন ও জর্ডান ক্ষমতাসীনদের পক্ষে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে মিসরের সেনাবাহিনী অবস্থান নেয় সেনাবাহিনীর পক্ষে। মিসর সেখানে সেনাবাহিনীও পাঠায় ১৯৬২ সালে। দীর্ঘ ৬ বছরের গৃহযুদ্ধের পর বিদ্রোহী সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে এবং ইয়েমেন আরব রিপাবলিক (উত্তর ইয়েমেন) হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করে। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন আবদুল্লাহ আল সাল্লাল। এর পর ক্ষমতাসীন হন আলী আবদুল্লাহ সালেহ। অন্যদিকে দক্ষিণ ইয়েমেনে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনীতির সমর্থকদের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর তথাকথিত মার্কসবাদীরা সেখানে ক্ষমতাসীন হন এবং নিজেদের পিপলস ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করেন। সমাজতান্ত্রিক মডেলে গড়া সমাজব্যবস্থায় পার্টিপ্রধানই ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। প্রথমে আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল ও পরে আলী নাসির মোহাম্মদ ক্ষমতা পরিচালনা করেন। শেষের দিকে ক্ষমতা পান আলী সালিম আল বাইদেহ। দুই ইয়েমেনের মধ্যে সম্পর্ক কখনো উষ্ণ ছিল না। ১৯৭২ সালে দুই ইয়েমেন যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। উত্তর ইয়েমেনের অভিযোগ ছিল, দক্ষিণ ইয়েমেন বিদেশি শক্তির প্ররোচনায় তাদের দেশটি দখল করতে চায়। তাদের স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল সৌদি আরবের দিকে। তার পরও দুই ইয়েমেন ১৯৯০ সালের ২২ মে একত্রিত হয়। একত্রীকরণের পর আলী আবদুল্লাহ সালেহ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হন আর দক্ষিণ ইয়েমেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলী সালিম বাইদেহ যুক্ত ইয়েমেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। সেই থেকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের আগ পর্যন্ত সালেহ এককভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিলেন। ২০১১ সালের আরব বসন্তের ঢেউ এসে লাগে ইয়েমেনেও। আন্দোলনের মুখে ২০১১ সালের নভেম্বরে সালেহ সৌদি আরব পালিয়ে যান। এর আগে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্্দ রাব্বু মনসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। হাদি পরবর্তী সময়ে নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিজয়ী হলেও সেখানে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তা সমাধানে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি সৌদি আরবে পালিয়ে পর্যন্ত গিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে সৌদি আরব হুথি বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা শুরু করে, যা আজও অব্যাহত রয়েছে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ কার্যত দেশটিকে একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভক্ত করে রেখেছে। রাজধানী সানা মূলত নিয়ন্ত্রণ করে হুথি বিদ্রেহী গ্রুপ কর্তৃক পরিচালিত সুপ্রিম পলিটিক্যাল কাউন্সিল। একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করে হাদি সরকার ও তার সমর্থকরা। আল কায়েদা সমর্থিত আনসার আল সারিয়ার নিয়ন্ত্রণেও রয়েছে একটা বড় অংশ। আবার আইএসের নিয়ন্ত্রণাধীনও রয়েছে একটি এলাকা। ২০১৫ সালের পর থেকেই কার্যত ইয়েমেনে কোনো সরকার নেই। হুথি ও হাদি সরকার পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। ২০১৫ সালের পর থেকে এখন অবধি সৌদি বিমান বাহিনী হুথি অবস্থানের ওপর বিমান হামলা অব্যাহত রেখে আসছে। ইয়েমেনের সংকটকে কেন্দ্র করে হুথিদের নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। হুথিরা মূলত শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। বলা হয়, ইয়েমেনের জাইদি গোত্রভুক্ত হচ্ছে এই হুথিরা। তবে তাদের সঙ্গে সুন্নিরাও যোগ দিয়েছেন বলে বলা হচ্ছে। ২০১১ সালের নভেম্বরের আন্দোলনের মুখে আলী আবদুল্লাহ সালেহ পদত্যাগ করেছিলেন। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্্দ রাব্বু মনসুর হাদি। পরে ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ঐকমত্যের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। ইয়েমেনে বিভিন্ন দল ও গোত্রের মধ্যে ‘ন্যাশনাল ডায়ালগ কনফারেন্স’-এর ব্যানারে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়ে এলেও একটি সংবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। হাদি ঐকমত্যের প্রার্থী হলেও তিনিও ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। হাদি সৌদি আরবে পালিয়ে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে হুথি বিদ্রোহীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে রাজধানী সানা দখল করে নিয়েছিলেন সালেহ ও তার বাহিনী। দুঃখজনক হলেও সত্য, হুথি বিদ্রোহীদের হাতে শেষ পর্যন্ত সালেহর মৃত্যু হলো। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, তিনি হঠাৎ করেই বর্তমান মিত্র হুথিদের ত্যাগ করে প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদি ও সৌদি জোটের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার ওই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছিল সৌদি জোট ও প্রেসিডেন্ট আব্্দ রাব্বু মনসুর হাদি স্বয়ং। কিন্তু হুথি বিদ্রোহীরা এটা পছন্দ করেনি। তারা এটাকে আখ্যায়িত করেছিল এক ধরনের ‘অভ্যুত্থান’ হিসেবে। ইয়েমেনের এই সংকটের সঙ্গে ট্রেডিশনালি সৌদি-ইরান দ্বন্দ্বের একটা যোগসূত্র আছে। সৌদি আরবে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের উত্থান ও সৌদি আরবের নেতৃত্বে একটি সামরিক জোট গঠনের পরপরই সৌদি-ইরান দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। এ অঞ্চলের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করেই এই দ্বন্দ্বের জন্ম। সৌদি আরবের অভিযোগে ইরান ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছে, যা সৌদি আরবের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। এ কারণেই দু’বছর ধরে সৌদি বিমান ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহী ঘাঁটির ওপর অনবরত বিমান হামলা চালিয়ে আসছে। পাঠক লক্ষ করে থাকবেন, সিরিয়া ও ইরাকে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস যখন তার সব ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পতনের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখন লেবানন আর ইয়েমেনকে ঘিরে সৌদি রাজতন্ত্র ও ইরানি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র এক অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। প্রতিযোগিতা হচ্ছে এই এলাকা কাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে তা নিয়ে। সৌদি আরব লেবানন সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল যে, লেবানন সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। লেবাননের ইরান সমর্থিত শিয়া হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা সৌদি আরবে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে। একজন সৌদি মন্ত্রী থামের আল সাবহান আল আরাবিয়া টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেছিলেন, হিজবুল্লাহ এ অঞ্চলের প্রত্যেকটি সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত, যা সৌদি আরবকে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ক’দিন আগে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি নিরাপত্তার অজুহাতে সৌদি আরব পালিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীকালে হারিরি আবার লেবানন ফিরে গিয়েছিলেন। স্পষ্টতই হারিরির অভিযোগটি ছিল হিজবুল্লাহর দিকে, যাদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে ইরান। তিনি পদত্যাগ করে পরে পদত্যাগ প্রত্যাহারও করে নিয়েছিলেন। পর্যবেক্ষকরা লক্ষ করে আসছেন, এ অঞ্চলের রাজনীতির উত্থান-পতনে সৌদি আরব ও ইরান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। সৌদি আরব ইয়েমেনে হাদি সরকার, লেবাননে প্রধানমন্ত্রী হারিরি, সিরিয়ার দামেস্কে বিভিন্ন উপদল এবং ইরাকে সরকারের সঙ্গে যারা জোটে আছে, তাদের সমর্থন জুগিয়ে আসছে। অন্যদিকে ইরান ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের, লেবাননে হিজবুল্লাহকে, সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট আসাদকে, বাগদাদে শিয়া গোষ্ঠীকে সমর্থন জুগিয়ে আসছে। সৌদি আরব ও ইরানের অবস্থান পরস্পরবিরেধী। সৌদি আরব ও ইরানের দ্বন্দ্বের কারণে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম এখন ৬৪ দশমিক ৩২ ডলার। এই দাম আরও বাড়তে পারে। এই যখন পরিস্থিতি, ঠিক তখনই এলো সাবেক ইয়েমেনি প্রেসিডন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহর মৃত্যুর খবর। এর মধ্য দিয়ে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ আরও ছড়িয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে ইয়েমেনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে সংঘর্ষ। সালেহ হত্যার বদলা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তার নির্বাসিত ছেলে আহমেদ আলী সালেহ। তিনি বর্তমানে আরব আমিরাতে বসবাস করছেন। মৃত্যুর একদিন আগে সালেহ সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে ইয়েমেনে একটি শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এখন সেখানে অনিশ্চয়তা এলো। সৌদি আরবের ভূমিকা অগামীতে আরও আলোচনায় থাকবে। বলা হচ্ছে, ট্রাম্প জেরুজালেমে মার্কিনি দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার পেছনে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স সালমানের সমর্থন আছে। প্রিন্স সালমান পূর্ব জেরুজালেমের পরিবর্তে অন্য একটি স্থানে ফিলিস্তিনের রাজধানী নির্মাণের প্রস্তাব করেছেনÑ এমন একটি সংবাদও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। যদিও সৌদি সরকারি ভাষ্যে এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। তাই ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের ভূমিকা যখন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, ঠিক তখনই সৌদি আরব-ইসরায়েল সখ্য (?) নতুন একটি মেরুকরণের জন্ম দিতে পারে। সঙ্গত কারণেই মধ্যপ্রাচ্যর রাজনীতি, এর মেরুকরণ, ইসরায়েলের ভূমিকা ইত্যাদি বিষয় আগামীতে বারবার আলোচিত হতে থাকবে।
Daily Amader Somoy
18.12.2017

ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে আরও উত্তপ্ত করছে

ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে আরও উত্তপ্ত করছে



গেল ৬ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তিনি একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছেন, যেখানে ইসরাইলের তেলআবিবে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে নেয়া হবে। এটি একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। সে থেকে পূর্ব জেরুজালেম ইসরাইলের দখলে। অথচ স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেমÑ এ সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নেয়া হয়েছিল। এখন ট্রাম্পের ওই সিদ্ধান্তে ইসরাইল খুশি হলেও সারা বিশ্বে এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কোনো একটি রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত তাদের দূতাবাস জেরুজালেমে সরানোর কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ট্র্যাডিশনাল মিত্ররাও ট্রাম্পের এ বক্তব্যকে সমর্থন করেনি। এদিকে ১৩ ডিসেম্বর ইসলামী ঐক্য সংস্থার (ওআইসি) বিশেষ অধিবেশনে জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ওআইসি। এ বিশেষ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ যোগ দেন। এর আগে সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ বলেছেন, জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে পাওয়ার একমাত্র অধিকার ফিলিস্তিনের। যদিও বাদশাহ এ সম্মেলনে যোগ দেননি, কিন্তু ৫৭ সদস্যবিশিষ্ট মুসলিম দেশগুলোর এ জোট একটি বিশেষ অধিবেশনে মিলিত হয়ে যে সিদ্ধান্তটি নিল, তা এখন আবারও মুসলিমবিশ্বকে ইসরাইলের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল একটি পক্ষ; অন্যদিকে পুরো মুসলিমবিশ্ব আরেকটি পক্ষ। আর দুই পক্ষের পরস্পরবিরোধী অবস্থান নতুন করে এ অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এরই মধ্যে আরব তথা পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে যেসব বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে, তাতে একটি ‘অশনিসংকেত’ই দেয়া হয়েছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলি অবস্থান শক্তিশালী হলো। ইসরাইলে ১৯৮০ সালে আইন করে পূর্ণ জেরুজালেমকে (পূর্ব ও পশ্চিম জেরুজালেম) ইসরাইল রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল; কিন্তু এ ঘোষণা বিশ্বসম্প্রদায় মানেনি। এমনকি জাতিসংঘও ইসরাইলি এ সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছিল। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত এক সিদ্ধান্তের (সিদ্ধান্ত নং ৪৭৮, ১৯৮০) পরিপ্রেক্ষিতে ইসরাইলকে ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ইসরাইল কখনোই জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত মানেনি; বরং ধীরে ধীরে একটি বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জেরুজালেমকে গ্রাস করতে চেয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে ট্রাম্পের সময়ে এসে। এর মাধ্যমে জেরুজালেম নিয়ে যে ‘স্ট্যাটাস কো’ ছিল, তা স্পষ্টই লঙ্ঘিত হলো। এতে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়; কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এটা মানেনি। তারা পূর্ব জেরুজালেমকে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। জেরুজালেম বাহ্যত তিনটি পবিত্র ধর্মেরই (ইসলাম, খ্রিস্ট ও ইহুদি) পবিত্র ধর্মীয় স্থান। মুসলমানদের পবিত্র মসজিদ আল আকসা রয়েছে এখানে। এখন শুধু একটি ধর্মের (ইহুদি) অনুসারীদের রাজধানী করায় তা অন্য ধর্মানুসারীদের ধর্ম-কর্ম পালনে বাধা-বিপত্তি আসতে পারে। উল্লেখ্য, জেরুজালেমের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী হচ্ছে ফিলিস্তিনি। এ সিদ্ধান্ত এখানে উত্তেজনা বাড়াবে। উপরন্তু আন্তর্জাতিক আইন ও নিষেধাজ্ঞা (জাতিসংঘ) উপক্ষা করে ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেমে ইহুদি বসতি গড়ে তুলছে। এ নিয়ে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে তাদের নিত্যবিবাদের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে। বিশ্বসম্প্রদায়, মুসলিমবিশ্ব, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কেউই ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেনি। তারা বারবার বলে আসছে, এতে ওই অঞ্চলের অস্থিতিশীলতা আরও বাড়ল। উল্লেখ্য, জেরুজালেম শহরের ইতিহাস সাড়ে ৪ হাজার বছরের পুরনো। তিনটি ধর্মের জন্যই পবিত্র শহর জেরুজালেম বিখ্যাত। খ্রিস্টানদের জন্য Holy Sepulchre, ইহুদিদের জন্য Western wall ও মুসলমানদের জন্য Al Aqsa Mosque এখানে অবস্থিত। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের জন্য যে ধর্মীয় এলাকা রয়েছে, তার মাঝে রয়েছে ((Holy Sepulchre) ealvary, যেখানে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল; আর The Empty tomb,, যেখানে যিশুকে কবর দেয়া হয়েছিল। ইহুদিদের জন্য পবিত্র স্থান Westren  Wallএ রয়েছে Temple Mount, যা হাজার হাজার ইহুদির ধর্মীয় স্থান। মুসলমানদের জন্য রয়েছে Al Aqsa মসজিদ, যা মুসলমানদের তৃতীয় ধর্মীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত।
এখন অনেকেই যেটা বলার চেষ্টা করছেন, তা হচ্ছে এ ঘটনার মধ্য দিয়ে নতুন করে ফিলিস্তিনি গণঅভ্যুত্থান, যা ইন্তিফাদা নামে পরিচিত, তা আবার শুরু হলো। ইন্তিফাদা প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৮৭ সালে, আর এ পর্যায়ে এ আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ১৯৯১ সালে। দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হয়েছিল ২০০০ সালে, আর শেষ হয়েছিল ২০০৫ সালে। আর এখন শুরু হলো তৃতীয় ইন্তিফাদা। এর শেষ কবে হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। খুব সংগত কারণেই এটা বলা সম্ভব, অতিদ্রুত এটা শেষ হচ্ছে না। তৃতীয় ইন্তিফাদা শুরু হলো মাত্র।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও ইসরাইলের মধ্যে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। একটি ‘দুই রাষ্ট্র’ ফরমুলার দিকে ধীরে ধীরে এ দুই পক্ষ এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত এখন এ ফরমুলার পেছনে ছুরিকাঘাতের শামিল। দুই রাষ্ট্রের ফরমুলায় পূর্ব জেরুজালেম ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হবেÑ এমন কথা স্বীকৃত ছিল। ওবামা প্রশাসন এ ‘দুই রাষ্ট্র’ ফরমুলায় অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সেখানে থেকে সরে এলো এখন। তারা ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের সংগ্রামকে উপেক্ষা করে সমগ্র জেরুজালেম যে ইসরাইলের রাজধানী, সেটা স্বীকার করল। এতে উপেক্ষিত হলো স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের চিন্তাধারা। পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ১৯১৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ জে বেলেফো ব্রিটিশ জায়নিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি লর্ড রথচাইল্ডকে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠির উদ্দেশ্য হচ্ছে ইহুদিদের জন্য একটি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা। ইতিহাসে এটাই বেলেফোর ঘোষণা নামে পরিচিত। এ সিদ্ধান্ত অনুসরণ করেই ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনি এলাকা বিভক্তির সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সে থেকে একাধিকবার আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। মূলত ইসরাইলের আগ্রাসী তৎপরতার কারণে সেখানে শান্তি পরিকল্পনা বেশিদূর যেতে পারেনি। ১৯৭৮ সালে মিসর ও ইসরাইল পরস্পরকে স্বীকৃতি ও সিনাই থেকে ইসরাইলি সৈন্য প্রত্যাহার; ১৯৯৩ সালে পিএলও এবং ইসরাইল পরস্পরকে স্বীকৃতি ও ওয়াশিংটনে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর; ১৯৯৪ সালে গাজা ও জেরিকোয় ফিলিস্তিনি শাসন প্রতিষ্ঠা; ১৯৯৫ সালে পশ্চিমতীরে স্বায়ত্তশাসনসংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর ইত্যাদি শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত হলেও মূল সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। অর্থাৎ স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে বটে, কিন্তু এর কোনো সার্বভৌমত্ব নেই। উপরন্তু পশ্চিমতীর আর গাজা নিয়ে যে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্ম, তা কার্যত অনেকটাই ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘একটি রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়েছে। ইসরাইল এমন একটি রাষ্ট্রই দেখতে চায়, যা তাদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে। পাঠক ২০১৪ সালের পরিস্থিতির কথা স্মরণ করতে পারেন। ওই সময় ইসরাইলি বিমান আর ট্যাংকের গোলায় গাজা নগরী একটি ধ্বংসের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। সাত সপ্তাহব্যাপী এ আগ্রাসন অব্যাহত ছিল। ইসরাইলি বিমান হামলায় শত শত শিশু সেখানে মারা গিয়েছিল। কিন্তু বিশ্বসম্প্রদায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। একদিন, ৭০ বছর আগে, পশ্চিমাবিশ্ব একটি ইহুদি রাষ্ট্র জন্মের পথ প্রশস্ত করেছিল। কিন্তু সেখানে আজও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখন ট্রাম্প কর্তৃক জেরুজালেমকে ইহুদি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতিদানের মধ্য দিয়ে সে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা আরও অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে গেল। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেখানে যে অসন্তোষের জন্ম হয়েছে, তা সহজে থামার নয়। এ অসন্তোষ গোটা আরববিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর এতে বাড়তে পারে জঙ্গি তৎপরতা। ট্রাম্প সত্যিকার অর্থেই বিশ্বকে একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিলেন। এতে ইসরাইল তার দীর্ঘদিনের ‘পরিকল্পনা’ বাস্তবায়নের পথে আরও একধাপ এগিয়ে গেল। যারা ইসরাইলি রাজনীতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন, তারা জানেন ইনন পরিকল্পনা সম্পর্কে। ওডেড ইনন (Odid Yinon) হচ্ছেন মূলত একজন কট্টর ইহুদি স্ট্র্যাটেজিস্ট। তিনি মূলত একজন গবেষক ও শিক্ষক। বলা যেতে পারে, থিওডোর হারজেল যে স্বপ্ন একসময় দেখতেন, তার বাস্তবে রূপ দিতেই ইনন সদূরপ্রসারি একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। আর তা বাস্তবে রূপ দেয়ার পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী ও ইসরাইল সরকার। ইনন পরিকল্পনায় রয়েছে লেবানকে ভেঙে পাঁচটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করা, সিরিয়াকে ভেঙে একাধিক রাষ্ট্রে পরিণত করা ইত্যাদি (দেখুন Oded Yinon, A Strategy for Israel in the Nineteen Eighteen. Belmont, Massachusetts, 1982))। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে ওই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলেও আজ অবধি এতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। তবে স্ট্র্যাটেজিতে নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হচ্ছে। আরববিশ্বের মাঝে যদি বিভক্তি জিইয়ে রাখা যায়, তাতেই লাভ ইসরাইলের। আজ এত বছর পর ইসরাইল অনেক অংশে সফল। আরববিশ্বে বিভক্তি যত বেশি স্পষ্ট এখন, অতীতে তেমনটি ছিল না। কাতার-সৌদি যুদ্ধ, সৌদি আরব-ইয়েমেন যুদ্ধ কিংবা ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা, কুর্দিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, সিরিয়া-ইরাকে আইএসের উত্থান-পতনÑ সব মিলিয়ে মুসলিমবিশ্বের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করে ইসরাইল তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে। ইসরাইলের ওই ‘গ্রেট গেম’ যদি সত্যি সত্যিই বাস্তবায়িত হয়, তাহলে এ একুশ শতকেই নতুন এক মধ্যপ্রাচ্যকে আমরা দেখতে পাব! কিন্তু যেটা খুব বেশি দরকার ছিল, তা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা। বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। নিজ বাসভূমেই তারা আজ পরবাসী। এমনকি তাদের ধর্ম-কর্মও পালন করতে হয় ইসরাইলের মর্জিমাফিক। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের মুখে জিম্মি পুরো একটি জাতি! ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায়সংগত অধিকার আরও একবার লঙ্ঘিত হলো। জেরুজালেমকে শুধু একটি দেশের (ইসরাইল) রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আবারও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করল। এ ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্যকে আরও উত্তপ্ত করবে। আরও উত্তেজনা বাড়াবে। এতে লাভ হবে যুদ্ধবাজদের, যারা চায় মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধের সূচনা হোক।
Daily Alokito Bangladesh
17.12.2017

ইয়েমেনের পরিস্থিতি এখন কোন দিকে


ইয়েমেনের বিদ্রোহী হুথি গ্রুপের হাতে ইয়েমেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ নিহত হওয়ার পর যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হচ্ছেÑ ইয়েমেনের পরিস্থিতি এখন কোন দিকে গড়াবে? সেখানে কি আদৌ স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে? গৃহযুদ্ধ কি সেখানে বন্ধ হবে? সিরিয়া থেকে আইএস উৎখাতের পর ইয়েমেনে কি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ সম্প্রসারিত হতে যাচ্ছে? ইয়েমেন সংকটকে কেন্দ্র করে সৌদি আরব আর ইরানের মধ্যে এক ধরনের ‘প্রক্সি-যুদ্ধ’ চলে আসছিল। এখন কি তা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিতে যাচ্ছে? আলী আবদুল্লাহ সালেহ নিহত হওয়ার পর এসব প্রশ্ন এখন উঠেছে এবং কোনো একটি প্রশ্নেই সুস্পষ্ট করে কোনো জবাব পাওয়া যাচ্ছে না।
কয়েক বছর ধরে ইয়েমেন আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। বিশেষ করে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা সেখানে সরকার উৎখাতের আন্দোলন করে আসছে। এক পর্যায়ে হুথি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানায় প্রেসিডেন্ট ভবন পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল। এক পর্যায়ে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি আরব প্রকাশ্যে ‘যুদ্ধ’ পর্যন্ত শুরু করে। গেল এক বছরের উপরে সৌদি বিমানবাহিনী নিয়মিত হুথি বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা চালিয়ে আসছে। কিন্তু তারপরও হুথি বিদ্রোহীদের দমন করা যায়নি; বরং হুথিরা দিন দিন আরও শক্তিশালী হয়েছে। এখানে বলা ভালো, ২০১১ সালে তিউনেশিয়ায় উচ্চশিক্ষিত এক ফলবিক্রেতা (যিনি আইটিতে ডিগ্রি নিয়েও চাকরি পাননি। ফল বিক্রি করে জীবনযাপন করতেন) বোউয়াজিজি পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে আত্মহত্যা করেছিলেন। তার আত্মহত্যায় ফুলকির মতো আন্দোলন আরববিশ্বে ছড়িয়ে যায় এবং একে একে পতন ঘটে স্বৈরশাসকদের, যারা দীর্ঘদিন ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। তিউনেশিয়ায় পদত্যাগ করেছিলেন জইন আল আবেদিন, যিনি দীর্ঘ ২৩ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। সেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কোনো চিহ্ন ছিল না। সেখানে জইন আল আবেদিনের উৎখাতের মধ্য দিয়ে জেসমিন বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল। এর রেশ ধরে মিসরে হোসনি মোবারক (১৯৮১ সাল থেকে), মুয়াম্মার গাদ্দাফি (১৯৬৯ সাল থেকে) ও ইয়েমেনে আলী আবদুল্লাহ সালেহ (১৯৭৮ সাল থেকে ক্ষমতায়) সরকারের পতন ঘটেছিল। স্বৈরাচারী শাসকদের উৎখাতের মধ্য দিয়ে সেখানে ‘আরব বসন্ত’র সূচনা হয়েছিল। যদিও আরব বসন্ত তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট (ড. মুরসি) সামরিক অভ্যুত্থানে উৎখাত হয়েছিলেন। গাদ্দাফির মৃত্যু লিবিয়াকে একটি সন্ত্রাসীদের রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। তিউনেশিয়ায় কিছুটা স্থিতিশীলতা থাকলেও ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ চলছে।
এখানে ইয়েমেনের ইতিহাস নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। আজকের যে ইয়েমেন, তা একসময় দুই ভাগে বিভক্ত ছিলÑ উত্তর ইয়েমেন ও দক্ষিণ ইয়েমেন। উত্তর ইয়েমেন ট্র্যাডিশনালি স্বাধীন। ধরা হয়, উত্তর ইয়েমেন স্বাধীন হয়েছে ১৯১৮ সালের ১ নভেম্বর (আর দক্ষিণ ইয়েমেন স্বাধীন হয় ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর)। দুই ইয়েমেনের মধ্যে বৈরিতা ও যুদ্ধের ইতিহাসও আছে। আজকের ইয়েমেনের যে পরিস্থিতি, তার সঙ্গে অতীত ইতিহাসের একটা যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৬২ সালে উত্তর ইয়েমেনের শাসক ইমাম আহমেদ বিন ইয়াহিয়া মারা গেলে তার ছেলে ক্ষমতাসীন হন। কিন্তু সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করতে চাইলে সেখানে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। ওই গৃহযুদ্ধে সৌদি আরব, ব্রিটেন এবং জর্ডান ক্ষমতাসীনদের পক্ষে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে মিসরের সেনাবাহিনী অবস্থান নেয় সেনাবাহিনীর পক্ষে। মিসর সেখানে সেনাবাহিনীও পাঠায় ১৯৬২ সালে। দীর্ঘ ৬ বছরের গৃহযুদ্ধের পর বিদ্রোহী সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে এবং ইয়েমেন আরব রিপাবলিক (উত্তর ইয়েমেন) হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করে। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন আবদুল্লাহ আল সাল্লাল। এরপর ক্ষমতাসীন হন আলী আবদুল্লাহ সালেহ। অন্যদিকে দক্ষিণ ইয়েমেনে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনীতির সমর্থকদের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯৬৭ সালে ৩০ নভেম্বর তথাকথিত মার্কসবাদীরা সেখানে ক্ষমতাসীন হন এবং নিজেদের পিপলস ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করেন। সমাজতান্ত্রিক মডেলে গড়া সমাজ ব্যবস্থায় পার্টিপ্রধানই ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। প্রথমে আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল ও পরে আলী নাসির মোহাম্মদ ক্ষমতা পরিচালনা করেন। শেষের দিকে ক্ষমতা পান আলী সালিম আল বেইদেহ। দুই ইয়েমেনের মধ্যে সম্পর্ক কখনও উষ্ণ ছিল না। ১৯৭২ সালে দুই ইয়েমেন যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। উত্তর ইয়েমেনের অভিযোগ ছিল যে, দক্ষিণ ইয়েমেন বিদেশি শক্তির প্ররোচনায় তাদের দেশটি দখল করতে চায়। তাদের স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল সৌদি আরবের দিকে। তারপরও দুই ইয়েমেন ১৯৯০ সালের ২২ মে একত্রিত হয়। একত্রীকরণের পর আলী আবদুল্লাহ সালেহ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হন। আর দক্ষিণ ইয়েমেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলী সালিম বেইদেহ যুক্ত ইয়েমেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। তারপর থেকে উৎখাতের আগ পর্যন্ত সালেহ এককভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিলেন। ২০১১ সালের আরব বসন্তর ঢেউ এসে লাগে ইয়েমেনেও। আন্দোলনের মুখে ২০১১ সালের নভেম্বরে সালেহ সৌদি আরব পালিয়ে যান। এর আগে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদ রাব্বু মনসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। হাদি পরবর্তী সময় নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিজয়ী হলেও সেখানে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তা সমাধানে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। একপর্যায়ে তিনি সৌদি আরবে পালিয়ে পর্যন্ত গিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে সৌদি আরব হুথি বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা শুরু করে, যা আজো অব্যাহত রয়েছে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ কার্যত দেশটিকে একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠীর মাঝে বিভক্ত করে রেখেছে। রাজধানী সানা মূলত নিয়ন্ত্রণ করে হুথি বিদ্রোহী গ্রুপ কর্তৃক পরিচালিত সুপ্রিম পলিটিক্যাল কাউন্সিল। একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করে হাদি সরকার ও তার সমর্থকরা। আল কায়দা সমর্থিত আনসার আল সারিয়ার নিয়ন্ত্রণেও রয়েছে একটা বড় অংশ। আবার আইএসের নিয়ন্ত্রণাধীনেও রয়েছে একটি এলাকা। ২০১৫ সালের পর থেকেই কার্যত ইয়েমেনে কোনো সরকার নেই। হুথি ও হাদি সরকার পারস্পরিক যুদ্ধে লিপ্ত। ২০১৫ সালের পর থেকে এখন অবধি সৌদি বিমানবাহিনী হুথি অবস্থানের ওপর বিমান হামলা অব্যাহত রেখে আসছে।
ইয়েমেনের সংকটকে কেন্দ্র করে হুথিদের বাস সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। হুথিরা মূলত শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। বলা হয়, ইয়েমেনের জাইদি গোত্রভুক্ত হচ্ছে এ হুথিরা। তবে তাদের সঙ্গে সুন্নিরাও যোগ দিয়েছে, বলা হচ্ছে। ২০১১ সালের নভেম্বরে আন্দোলনের মুখে আলী আবদুল্লাহ সালেহ পদত্যাগ করেছিলেন। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদ রাব্বু মনসুর হাদি। পরবর্তী সময় ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ঐকমত্যের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। ইয়েমেনে বিভিন্ন দল ও গোত্রের সঙ্গে ‘ন্যাশনাল ডায়ালগ কনফারেন্স’ এর ব্যানারে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়ে এলেও একটি সংবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। হাদি ঐকমত্যের প্রার্থী হলেও তিনিও ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। তিনি সৌদি আরবে পালিয়ে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে হুথি বিদ্রোহীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে রাজধানী সানা দখল করে নিয়েছিলেন সালেহ ও তার বাহিনী। দুঃখজনক হলেও সত্য, হুথি বিদ্রোহীদের হাতেই শেষ পর্যন্ত সালেহর মৃত্যু হলো। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, তিনি হঠাৎ করেই বর্তমান মিত্র হুথিদের ত্যাগ করে প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদি ও সৌদি জোটের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার ওই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছিল সৌদি জোট ও প্রেসিডেন্ট আবদ রাব্বু মনসুর হাদি গং। কিন্তু হুথি বিদ্রোহীরা এটা পছন্দ করেনি। তারা এটাকে আখ্যায়িত করেছিল এক ধরনের ‘অভ্যুত্থান’ হিসেবে।
ইয়েমেনের এ সংকটের সঙ্গে ট্র্যাডিশনালি সৌদি-ইরান দ্বন্দ্বের একটা যোগসূত্র আছে। সৌদি আরবে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের উত্থান ও সৌদি আরবের নেতৃত্বে একটি সামরিক জোট গঠনের পরপরই সৌদি-ইরান দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। এ অঞ্চলের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করেই এ দ্বন্দ্বের জন্ম। সৌদি আরবের অভিযোগে ইরান ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছে, যা সৌদি আরবের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। এ কারণেই ২ বছর ধরে সৌদি বিমান ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহী ঘাঁটির ওপর অনবরত বিমান হামলা চালিয়ে আসছে। পাঠক লক্ষ করে থাকবেন, সিরিয়া ও ইরাকে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস যখন তার সব ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পতনের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখন লেবানন আর ইয়েমেনকে ঘিরে সৌদি রাজতন্ত্র ও ইরানি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র এক তাগুত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। প্রতিযোগিতা হচ্ছে এ এলাকা কাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তা নিয়ে। সৌদি আরব লেবানন সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল যে, লেবানন সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে! লেবাননের ইরান সমর্থিত শিয়া হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগে ছিল, তারা সৌদি আরবে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে। একজন সৌদি মন্ত্রী থামের আল সাবহান আল আরাবিয়া টিভিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেছিলেনÑ হিজবুল্লাহ এ অঞ্চলের প্রত্যেকটি সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত, যা সৌদি আরবকে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে! ক’দিন আগে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি ‘নিরাপত্তার অজুহাতে’ সৌদি আরব পালিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও পরবর্তী সময় হারিরি আবার লেবানন ফিরে গিয়েছিলেন। স্পষ্টই হারিরির অভিযোগটি ছিল হিজবুল্লাহর দিকে, যাদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে ইরান। তিনি পদত্যাগ করে পরে পদত্যাগ প্রত্যাহারও করে নিয়েছিলেন। পর্যবেক্ষকরা লক্ষ করে আসছেন, এ অঞ্চলের রাজনীতির উত্থান-পতনে সৌদি আরব ও ইরান প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত। সৌদি আরব ইয়েমেনে হাদি সরকার, লেবাননে প্রধানমন্ত্রী হারিরি, সিরিয়ার দামেস্কে বিভিন্ন উপদল এবং ইরাকে সরকারের সঙ্গে যারা জোটে আছে, তাদের সমর্থন জুগিয়ে আসছে। অন্যদিকে ইরান ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের, লেবাননে হিজবুল্লাহকে, সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট আসাদকে, বাগদাদে শিয়া গোষ্ঠীকে সমর্থন জুগিয়ে আসছে। সৌদি আরব ও ইরানের অবস্থান পরস্পরবিরোধী। সৌদি আরব ও ইরানের দ্বন্দ্বের কারণে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম এখন ৬৪ দশমিক ৩২ ডলার। এ দাম আরও বাড়তে পারে। এই যখন পরিস্থিতি, ঠিক তখনই এলো সাবেক ইয়েমেনি প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহর মৃত্যুর খবর। এর মধ্য দিয়ে ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ আরও ছড়িয়ে পড়বে। এরই মধ্যে ইয়েমেনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে সংঘর্ষ। সালেহ হত্যার বদলা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তার নির্বাসিত ছেলে আহমেদ আলী সালেহ। তিনি বর্তমানে আরব আমিরাতে বসবাস করছেন। মৃত্যুর একদিন আগে সালেহ সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে ইয়েমেনে একটি শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এখন সেখানে অনিশ্চয়তা এলো। সৌদি আরব সেখানে বিমান হামলার পরিধি বাড়িয়েছে। এর অর্থ খুব সহসাই সেখানে গৃহযুদ্ধ থামছে না। এরই মধ্যে সেখানে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। হাজার হাজার শিশু চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে। হাসপাতালগুলোয় কার্যত এখন আর কোনো সেবা পাওয়া যায় না। অস্ত্র এখন ইয়েমেনের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে ইয়েমেনের পরিস্থিতি কোন দিকে, বলা সত্যিই কঠিন। তবে সেখানে গৃহযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
Daily Alokito Baangladesh
10.12.2017

নির্বাচন নেপালে স্থিতিশীলতা আনবে কি?



Image result for Nepal election
নেপালে সংসদ নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপ অনুষ্ঠিত হল গতকাল ৭ ডিসেম্বর। ২৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে নির্বাচনের প্রথম ধাপ। ২০১৭ সালটা ছিল নেপালে নির্বাচনের বছর। প্রথমে নেপাল সংবিধান সভার নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। এরপর সংবিধানের শর্ত অনুযায়ী গত মে মাসে সব স্থানীয় সরকারের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। আর এখন সম্পন্ন হল সংসদ নির্বাচন। প্রশ্ন হচ্ছে, এ নির্বাচন নেপালে স্থিতিশীলতা কতটুকু নিশ্চিত করবে? সাম্প্রতিককালে নেপালে বারবার সরকার পরিবর্তনের ফলে সেখানে বিকাশমান গণতন্ত্র একদিকে ঝুঁকির মুখে ছিল, অন্যদিকে সৃষ্টি হয়েছিল অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা। তাই সঙ্গত কারণেই এ নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি ছিল অনেকের।


নেপালের এ নির্বাচন কোন দলকে ক্ষমতায় বসাবে, তা বলা সত্যিকার অর্থেই কঠিন। গত ১০ বছরে সেখানে বারবার ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। কখনও মাওবাদীদের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে, কখনোবা কংগ্রেস ক্ষমতাসীন হয়েছে। মূলত তিনটি দলই মূল ক্ষমতা পরিচালনা করছে। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আঞ্চলিক দলগুলো। সম্প্রতি বাম জোট গঠিত হয়েছে। এ জোটে আছে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (ইউএমএল) ও মাওবাদীরা। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইউএমএল প্রথম ও মাওবাদীরা তৃতীয় স্থানে ছিল। আর দ্বিতীয় স্থানে ছিল নেপালি কংগ্রেস, যার নেতৃত্বে রয়েছেন শের বাহাদুর দেউশ, যিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীও বটে। এবার নেপালি কংগ্রেস কয়েকটি ছোট দলের সঙ্গে ঐক্য করেছে। তারা যে জোটটি করেছে, তার নাম গণতান্ত্রিক জোট। এখানে বলা ভালো, ২০১৫ সালে নেপালে নতুন যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল, সেই সংবিধানের আওতাতেই এবার নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। নেপালি পার্লামেন্ট দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট : হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ (প্রতিনিধিসভা) ও ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি (রাষ্ট্রীয়সভা)। প্রতিনিধিসভার সদস্য সংখ্যা ২৭৫, যাদের একটা অংশ জনগণের ভোটে সরাসরি নির্বাচিত হয়। আর রাষ্ট্রীয়সভার সদস্য হচ্ছে ৫৯। হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের ২৭৫ জন সদস্যের মধ্যে ১৬৫ জন সরাসরি নির্বাচিত হন। জনসংখ্যা হিসাবে ১৬৫টি এলাকা (সংসদীয়) নির্ধারণ করা হয়েছে। আর ১১০ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন আনুপাতিক হারে। প্রতিটি দল নির্বাচনে শতকরা যতভাগ ভোট পাবে, তাদের আনুপাতিক প্রতিনিধিরা সেভাবে নির্ধারিত হবে। এভাবেই ১১০ জন ‘নির্বাচিত’ হবেন। আর হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে মোট ২৭৫ জন প্রতিনিধিত্ব করবেন। তারা ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন।

নেপালে একসময় রাজতন্ত্র ছিল। দীর্ঘদিন দেশটিতে গৃহযুদ্ধ চলেছে। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নেপালে রাজতন্ত্রের পতনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এ গণঅভ্যুত্থানে রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস করা হয়। পরবর্তী সময়ে, ২০০১ সালের ১ জুন, তৎকালীন রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব ও তার পরিবারের সদস্যরা যুবরাজ দীপেন্দ্র কর্তৃক ব্রাশফায়ারে নিহত হন। এরপর রাজা হিসেবে নিযুক্ত হন রাজার ভাই জ্ঞানেন্দ্র। কিন্তু তিনি কখনই জনপ্রিয় ছিলেন না। তিনি ধীরে ধীরে সব ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেয়ার চেষ্টা করেন। সরকার মাওবাদীদের দমনে ব্যর্থ এ অভিযোগ তুলে ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজা জ্ঞানেন্দ্র নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তার এ ক্ষমতা করায়ত্ত করার প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেনি। ফলে প্রচণ্ড বিক্ষোভের মুখে তিনি তৎকালীন সাতদলীয় জোটের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। শেষ পর্যন্ত নেপালে রাজতন্ত্র বাতিল ঘোষিত হয়। বলা ভালো, ১৭৬৯ সালে হিমালয়ের পাদদেশের এ দেশটিতে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

নেপালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত ঘোষিত হলেও সেখানে একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয় সরকারের স্থিতিশীলতা। গত ১০ বছরে সেখানে কয়েকটি সরকার গঠিত হয়েছে। কিন্তু কোনো সরকারই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনি। এমনকি দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বও প্রবল। একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করা নিয়েও সমস্যা ছিল। সংখ্যালঘুদের অধিকার কীভাবে নিশ্চিত হবে, তা নিয়েও সমস্যা ছিল। তবে নেপালের রাজনীতির জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হল চীনাপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে পরিচিত মাওবাদীদের সশস্ত্র বিপ্লবের ধারণা পরিত্যাগ করা এবং স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসা। মাওবাদীরা সেখানে দীর্ঘদিন ধরে একটি গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে আসছিল। ২০০৬ সালের ২১ নভেম্বর ওই সময়ের ক্ষমতাসীন সাতদলীয় জোটের প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রসাদ কৈরালার সঙ্গে মাওবাদী নেতা পুষ্পকমল দাহাল প্রচন্ড একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। এ চুক্তি বলে মাওবাদীরা মূলধারায় ফিরে এসেছিল। পরবর্তী সময়ে প্রচন্ড দেশটির প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি। একটি সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৮ সালে। কিন্তু দীর্ঘ সময় লেগেছিল সংবিধান প্রণয়ন করতে।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব নেপালি রাজনীতির অন্যতম সমস্যা। ১৯৯১ সালের ৭ মে সাধারণ ভোটে দীর্ঘ ৩২ বছর পর নেপালে যে পার্লামেন্ট গঠিত হয়েছিল, ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে সেই পার্লামেন্ট ভেঙে যায় মূলত নেপালি কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে। নেপালি কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল মূলত দুই ব্যক্তিকে নিয়ে। একদিকে ছিলেন গিরিজা প্রসাদ কৈরালা, অন্যদিকে কৃষ্ণ প্রসাদ ভট্টরাই। এ দ্বন্দ্বের কারণে শের বাহাদুর দেউবা এর আগে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পার্টি ফোরামে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, কৈরালা ও ভট্টরাই কেউই প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী হতে পারবেন না। তখন তৃতীয় প্রার্থী হিসেবে দেউবা উঠে আসেন। দ্বন্দ্ব ছিল মাওবাদীদের মধ্যেও। প্রচন্ড ও বাবুরাম ভট্টরাইয়ের মধ্যকার দ্বন্দ্বে সেখানে মাওবাদীরাও শক্ত অবস্থানে যেতে পারেনি। প্রচন্ড ও বাবুরাম ভট্টরাই দু’জনেই সীমিত সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী

হয়েছিলেন। মাওবাদীদের বাইরে ইউনাইটেড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট পার্টিও (ইউএমএল) নেপালের অন্যতম একটি রাজনৈতিক শক্তি। এর পাশাপাশি মাদেসি ফ্রন্টও স্থানীয়ভাবে শক্তিশালী।

এখন মূলত চার ব্যক্তিকে ঘিরে নেপালের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে : শের বাহাদুর দেউবা, খাদগা প্রসাদ অলি, পুষ্পকমল দাহাল ও কামাল থাপা। দেউবা নেপালি কংগ্রেসের নেতা। খাদগা প্রসাদ অলি ইউএমএল নেতা। পুষ্পকমল দাহাল মাওবাদীদের নেতা, আর কামাল থাপা রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টির নেতা। এ চারজনের যে কোনো একজন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। কোনো দলের পক্ষে এককভাবে সরকার গঠন করা সম্ভব নয়। তাই দলগুলো জোটবদ্ধ হয়েছে। বামপন্থী জোটে আছে কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউএমএল), কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী), নয়া শক্তি পার্টি। নয়া শক্তি পার্টির নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক মাওবাদী নেতা বাবুরাম ভট্টরাই। শেষ পর্যন্ত তিনি আর বাম জোটে থাকেননি গোরকা নির্বাচনী এলাকায় জোটের প্রার্থী হতে না পারায়। পরবর্তী সময়ে তিনি জোটবদ্ধ হয়েছেন অপর দুটি বাম সংগঠন- রাষ্ট্রীয় জনমোর্চা ও কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপালের (এমএল) সঙ্গে। অপরদিকে নেপালি কংগ্রেস জোটবদ্ধ হয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি, রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি (গণতান্ত্রিক) এবং মাদেসি রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে। মোট ৮৮টি রাজনৈতিক দল এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।

নির্বাচনের পরও নেপালে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে কিনা সেটা একটা মৌলিক প্রশ্ন এখন। বাম জোটে মাওবাদীরা ইউএমএলের সঙ্গে ঐক্য করলেও এ ঐক্য নির্বাচনের পর আদৌ থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অতীতে খাদগা প্রসাদ অলি যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই সরকার পদত্যাগ করেছিল মাওবাদীরা সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়ায়। এমনটি এবারও ঘটতে পারে। বাম জোট নির্বাচনে ভালো করলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা নিয়ে অলি-প্রচন্ড আবারও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে পারেন! এ নির্বাচনের ব্যাপারে চীন ও ভারতের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। এ দেশ দুটি নেপালি রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব রাখে। দুটি দেশের সঙ্গেই নেপালের সীমান্ত রয়েছে। চীন অলির নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন করেছিল। ভারতের একচ্ছত্র বাণিজ্যিক প্রভাব কমাতে চীন নেপালের সঙ্গে একাধিক বাণিজ্যিক চুক্তি করেছিল। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে ভারত চেয়েছিল অলি সরকারের পতন (দ্য ডিপ্লোমেন্ট, ২৬ জুলাই ২০১৬)। অনেকেই মনে করেন, নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন একটি সরকার সেখানে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে বেশি। সুতরাং এ নির্বাচনে দেশ দুটি কোনো না কোনোভাবে প্রভাব খাটাতে চাইবে।

নির্বাচনে যে জোটই ভালো ফলাফল করুক না কেন, দৃষ্টি থাকবে প্রধানমন্ত্রী পদটির দিকে। তবে অলি, প্রচন্ড, দেউবা- যে কোনো একজনই আগামীতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন এটা প্রায় নিশ্চিত। দেউবা এখন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী। তিনি ১৯৯৫-১৯৯৭, ২০০১-২০০২, ২০০৪-২০০৫ সময়সীমায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। একইসঙ্গে অলি ও প্রচন্ড নেপালের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। একজন নারীনেত্রী বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারি নেপালের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেও দেশটির রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ তেমন একটা নেই। পার্লামেন্টে নারীদের জন্য কোনো ‘কোটা’ ব্যবস্থা নেই। মিসেস ভাণ্ডারি মাওবাদী নেতা ও সাবেক দেশরক্ষামন্ত্রী। তার প্রয়াত স্বামী মদন কুমার ভাণ্ডারিও ছিলেন মাওবাদীদের নেতা। সংসদে তিনি মাওবাদী গ্রুপের ডেপুটি লিডার ছিলেন। ২০১৫ সালের অক্টোবরে তিনি পার্লামেন্ট কর্তৃক ৫ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

এখন দেখার পালা দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের পর যে ফলাফল পাওয়া যাবে, তাতে সরকার গঠনে জটিলতা এড়ানো যায় কিনা। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৩৮টি আসন বাম জোট নাকি গণতান্ত্রিক জোট পাবে, তার ওপর নির্ভর করছে নেপালের আগামী দিনের রাজনীতি। আগেই বলেছি, ভারতের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে নেপালে। চীনের স্বার্থ থাকলেও দেশটি সরাসরি নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে না।

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নেপালের স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারেনি শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দলাদলির কারণে। গত ১০ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে। এখন প্রত্যাশা একটাই- সেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসুক।
Daily Jugantor
08.12.2017