রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পোপের ঢাকা সফর ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা


Image result for Popes Bangladesh visit\


বিশ্বের ১৩০ কোটি খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীর ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস তিন দিনের ঢাকা সফর শেষ করেছেন গত শনিবার। ৩০ বছর পর এ প্রথম একজন পোপ বাংলাদেশে এলেন। এর আগে ১৯৮৬ সালে পোপ পল এবং ১৯৭০ সালেও পোপ এ অঞ্চল সফর করে গিয়েছিলেন। পোপ ফ্রান্সিস একজন ধর্মীয় নেতা হলেও ভ্যাটিকান সিটির প্রধান হিসেবে তিনি বিশ্বের সর্বত্র আলাদা একটি সম্মান পান এবং একজন প্রেসিডেন্টের মতো তিনি ‘প্রটোকল’ পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশেও তিনি সে সম্মান পেয়েছেন। তার এ সফর যে কোনো বিবেচনায় যথেষ্ট গুরত্বপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে মিয়ানমারের কয়েক লাখ নাগরিক, যাদের আমরা রোহিঙ্গা বলি, তারা অত্যাচার আর নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে যখন আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন, তখন পোপ ফ্রান্সিসের বাংলাদেশে আগমন ও তাদের কাছ থেকে তাদের দুরবস্থার কথা শোনা, রোহিঙ্গা সংকটের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখতে ছুটে যাননি বটে; কিন্তু রোহিঙ্গাদের একটা ক্ষুদ্র অংশ তার সঙ্গে ঢাকায় এসে দেখা করেছে। তিনি তাদের কথা শুনেছেন। এখানে বলা ভালো, তিনি ঢাকা সফরের আগে মিয়ানমার সফর করেছেন। সেখানে তিনি তার বক্তব্যে রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেননি; কিন্তু পরোক্ষভাবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কথা বলেছেন। তিনি সেখানে সব ধর্ম সম্প্রদায়ের মাঝে ঐক্য ও সম্প্রীতির পথে সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিগত নির্যাতন বন্ধেরও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশে এসেও তিনি কৌশলে রোহিঙ্গা শব্দটি সর্বত্র বলেননি; কিন্তু বলেছেন, সৃষ্টিকর্তার মাঝে একজন রোহিঙ্গাও বসবাস করেন। পরোক্ষভাবে এ নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি ইঙ্গিত করে পোপ ফ্রান্সিস ঢাকায় দেয়া তার বক্তব্যে বলেছেন, গত কয়েক মাসে রাখাইন থেকে আসা বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে এবং তাদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমাজ উদার মন এবং অসাধারণ ঐক্যের পরিচয় দিয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, এটি কোনো ছোট বিষয় নয়, বরং সারা বিশ্বের সামনেই এটি ঘটেছে। পুরো পরিস্থিতি মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট এবং শরণার্থী শিবিরগুলোয় থাকা আমাদের ভাইবোন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু তাদের ঝুঁকির গুরুত্ব বুঝতে আমরা কেউই ব্যর্থ হইনি। এ সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসাটা অপরিহার্য বলেও মন্তব্য করেছেন পোপ।
সুতরাং পোপ ফ্রান্সিস তার মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফরে রোহিঙ্গা শব্দটি সবসময় উচ্চারণ না করলেও এ সংকট সমাধানে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে ‘উদার মন’ ও ‘অসাধারণ ঐক্যের’ পরিচয় দিয়েছে, সে কথাটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বিপুলসংখ্যক বিদেশি সাংবাদিক তার সঙ্গে ঢাকায় এসেছেন। তাদের প্রতিবেদনে পোপ ফ্রান্সিসের এ বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক আসরে রোহিঙ্গা সংকটের গভীরতা আরও বাড়ল। পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বের যেখানেই যান, সেখানে তিনি শান্তি ও সম্প্রীতির কথা বলেন। তিনি মূলত বিশ্বশান্তির প্রতীক। যিশুখ্রিস্টের দৃশ্যমান প্রতিনিধি তিনি। ২০১৩ সালের মার্চে ২৬৬তম পোপ হিসেবে নিযুক্তির পর থেকে তিনি আন্তঃধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত ঐক্যের কথা বলে আসছেন। ঢাকায় গেল শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত নাগরিক সমাবেশেও তিনি প্রার্থনা করেন। তরুণ সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তিনি মতবিনিময় করেন। বাংলাদেশ একটি সহনীয় ইসলাম ধর্মের দেশ। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ যে হাজার বছর ধরে একসঙ্গে বসবাস করে আসছে এবং সম্প্রীতির এক মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছে, তা পোপ ফ্রান্সিসের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। তবে প্রতিটি সমাজেই বিভ্রান্তকারী কিছু ব্যক্তি থাকে, যারা ধর্মের নামে সমাজকে বিভক্ত করতে চায়। বাংলাদেশেও এ রকম মানুষ আছে, যারা ধর্মকে ব্যবহার করে হাজার বছরের সম্প্রীতির ঐক্যকে বিনষ্ট করতে চেয়েছিল। পোপ ফ্রান্সিস ঢাকায় গুলশানে জঙ্গি হামলার কথা উল্লেখ করে আমাদের সে কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তবে বলতে দ্বিধা নেই, পোপ ফ্রান্সিসের ঢাকা সফরের সময় আমাদের প্রত্যাশা ছিল, তিনি রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রশ্নে সোচ্চার হবেন। পোপ রোহিঙ্গা শব্দটি সর্বত্র ব্যবহার না করেও রাখাইনের জনগোষ্ঠীর কথা বলেছেন, কার্যত তা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকেই বুঝিয়েছেন তিনি। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন প্রশ্নে কিছু কিছু অগ্রগতি হয়েছে। দুই দেশের মাঝে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটা কিছুটা হলেও একটি অগ্রগতি বটে। দায়িত্ব এখন মিয়ানমারের। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিদেশে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূতদের একটি সম্মেলন। বিদেশে বাংলাদেশকে যারা প্রতিনিধিত্ব করেন, তারা এ প্রথমবারের মতো ঢাকায় একটি সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন। ওই সম্মেলনে বাংলাদেশী দূতরা বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। ফলে তারা নানা অজুহাতে চুক্তি কার্যকর করা নিয়ে টালবাহানা করতে পারে।’ বাংলাদেশী সিনিয়র কূটনীতিকরা যখন এ ধরনের মনোভাব প্রদর্শন করেন, তখন বিষয়টাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এটা ছাড়া বাংলাদেশের কোনো বিকল্পও ছিল না। গেল ২২ ও ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী মিয়ানমারের নেপিদোতে আসেম সম্মেলনে যোগ দেন। এরপর ২৩ নভেম্বর তিনি সেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট অন রিটার্ন অব ডিসপ্লেসড পারসন্স ফরম রাখাইন স্টেট’ নামে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন। এরপর ঢাকায় এসে তিনি সংবাদ সম্মেলন করেন ২৫ নভেম্বর। এর পরপরই ঢাকায় সিনিয়র কূটনীতিকদের এ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনেই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, মিয়ানমার শেষ পর্যন্ত হয়তো এ সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ফেরত নেবে না! এখানে লক্ষ করার বিষয়, সমঝোতা স্মারকে কিন্তু রোহিঙ্গা শব্দটিও ব্যবহার করা হয়নি; ব্যবহার করা হয়েছে ‘ডিসপ্লেসড পারসন’, অর্থাৎ বাস্তুচ্যুত নাগরিক। যারা সমঝোতা স্মারকটি দেখেছেন, তারা লক্ষ করেছেন, সেখানে ১৯ দফা আছে। এ দফাগুলো নিয়েও কথা আছে। অতীতে দুই-দুইটি চুক্তি হয়েছিল মিয়ানমারের সঙ্গে। একটি ১৯৭৮ সালে, অপরটি ১৯৯২ সালে। এবার সমঝোতা স্মারকে ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুসরণ করা হবে বলা হয়েছে। যতদূর জানা যায়, অতীতে ৪ লাখ ৭৬ হাজার রোহিঙ্গা সেসব চুক্তি বলে ফেরত গেছে। কিন্তু তারপরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বৈধ ও অবৈধভাবে কক্সবাজারে রয়ে গেছে। এদের একটা অংশ বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গেছে। একটা অংশ এরই মধ্যে বাংলাদেশী নাগরিকত্ব সনদ গ্রহণ করেছে। অনেকে বাংলাদেশী পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। ইউএনএইচসিআর এদের দেখভাল করছে। তাদের হিসাবে বৈধ রোহিঙ্গাদের সংখ্যা কয়েক হাজার। অবৈধ অর্থাৎ রেজিস্টারবিহীন রোহিঙ্গা নাগরিকদের সংখ্যা এর কয়েকগুণ বেশি। তারা অবৈধভাবে ক্যাম্প করে বসবাস করছে। এখন যোগ হলো আরও প্রায় ৭ লাখ। এদের মাঝ থেকে কতজনকে মিয়ানমার ফেরত নেবে, সে প্রশ্ন থাকলোই। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলরের অফিস থেকে বলা হয়েছে, ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা হবে! সমঝোতা চুক্তিতে এ ১৯৯২ সালের চুক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এটা একটা বড় ধরনের ঝুঁকি। আমরা সম্ভবত তাদের ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছি! ১৯৯২ সালের চুক্তিতে াবৎরভরপধঃরড়হ শব্দটা আছে। অর্থাৎ মিয়ানমারকে যেসব রোহিঙ্গার নাম-ঠিকানা দেয়া হবে, সেগুলো তারা যাচাই করবে। অতীতে এ ধরনের নামের একটি তালিকা দেয়া হয়েছিল; কিন্তু মিয়ানমার এর কোনো জবাব দেয়নি। এবারও সে ফাঁদে আটকে যেতে পারে বাংলাদেশ! তথাকথিত াবৎরভরপধঃরড়হ-এর নামে তারা সময়ক্ষেপণ করতে পারে। লোকদেখানো কিছু রোহিঙ্গাকে তারা ফেরত নিতে পারে; কিন্তু একটা বড় অংশকেই তথাকথিত াবৎরভরপধঃরড়হ-এর নামে আর ফেরত না-ও নিতে পারে। এটাই মিয়ানমারের স্ট্র্যাটেজি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের ওপর একটা ‘চাপ’ আছে। উপরন্তু পোপ ফ্রান্সিস রাখাইনের নির্যাতিত ভাইবোনের পক্ষে কথা বলেছেন, সেক্ষেত্রে মিয়ানমারের পক্ষে কাজটি করা খুব সহজ হবে না। তারা রাখাইন স্টেটের নির্যাতনের খবর অস্বীকার করবেন কীভাবে? পোপ ফ্রান্সিসের ঢাকা সফরের পর রোহিঙ্গা সংকটের আন্তর্জাতিক মাত্রাটা আরও বাড়ল। আমাদের কাজটি হবে, এখন আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগের কাজটি আরও দ্রুত করা। আন্তর্জাতিক কমিউনিটি আমাদের পক্ষে। এখন পোপ ফ্রান্সিসও আমাদের পক্ষে দাঁড়ালেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এর মাধ্যমেই পোপ অন্তত একটি মেসেজ দিলেন বিশ্বসম্প্রদাকে। আমাদের কাজটিই হবে এখন পোপের এ মেসেজটি ধারণ করে আন্তর্জাতিক আসরে রোহিঙ্গা প্রশ্নে জনমত গড়ে তোলা। রাষ্ট্রদূতদের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীও এ রকম আহ্বান জানিয়েছিলেন। একদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা অব্যাহত রাখা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আসরে মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ অব্যাহত রাখাÑ এভাবেই আামাদের এগিয়ে যেতে হবে।
পোপ ফ্রান্সিস বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। এ সফরের মধ্য দিয়ে ভ্যাটিকানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হলো। বাংলাদেশ যে একটি ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ, তা আবারও প্রমাণিত হলো। তার এ সফরের মধ্য দিয়ে এটা আরও প্রমাণিত হলো যে, বাংলাদেশে উগ্রবাদের কোনো স্থান নেই। হাজার বছরের যে ইতিহাস, যেখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি একটা বড় স্থান করে আছে, পোপের এ সফরের মধ্য দিয়ে তা আবারও প্রমাণিত হলো।
Daily Alokito Bangladesh
05.12.2017

0 comments:

Post a Comment