রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সিরিয়া সংকটের নয়া মোড়

সিরিয়া সংকট একটি নতুন দিকে মোড় নিয়েছে। ১৩ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়ায় বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। মার্কিন বিমান বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের বিমান বাহিনী। এক বক্তব্যে ট্রাম্প সিরিয়ায় আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে নিজ জনগণের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ আনেন। দামেস্কের পার্শ্ববর্তী একটি ছোট্ট শহর দৌমায় ৭ এপ্রিল এ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয় বলে তিনি অভিযোগ আনেন। এখন সিরিয়া আক্রমণের এই নির্দেশ সিরিয়া সংকটকে আরও ঘনীভূত করল। এ হামলা হল এমন এক সময়, যখন পুতিন আঙ্কারায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আর ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। এখন দেখার পালা রাশিয়া কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া দেখায়। নিরাপত্তা পরিষদে (১০ এপ্রিল) কথিত রাসায়নিক হামলা নিয়ে বৈঠকের সময় রাশিয়ার পক্ষ থেকে একটি সতর্কবার্তা আসে। বৈঠকে কথিত হামলা নিয়ে নতুন তদন্ত শুরু করার যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাব রাশিয়ার ভেটোর মুখে বাতিল হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের উত্থাপিত প্রস্তাবটিতে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাশিয়া ভেটো দেয়, আর চীন ভোটদানে বিরত থাকে। সব মিলিয়ে সিরিয়া সংকট যখন আট বছরে পা রাখল, তখন নতুন করে এ সংকট একটি ‘মাত্রা’ পেয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ক্ষেপণাস্ত্র হামলার হুমকিতে। একটি সম্ভাব্য রুশ-মার্কিন ‘যুদ্ধ’র সম্ভাবনাও দেখছেন কেউ কেউ। স্পষ্টতই সিরিয়ার যুদ্ধ শেষ হচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এর আগে সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের কথা বললেও, এখন বলা হচ্ছে ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস পরিপূর্ণভাবে উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত সেখানে কিছু মার্কিন সেনা থাকবে। সেখানে তারা ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে কাজ করছে। যদিও আইএস সেখান থেকে পরিপূর্ণভাবে উৎখাত না হলেও আগের মতো আইএসের অস্তিত্ব আর নেই। তবে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন গ্রুপ এখনও আসাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এদের যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করছে। অন্যদিকে রাশিয়া সাহায্য করছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে। একই সঙ্গে আসাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ইরানও।
অনেকের স্মরণ থাকার কথা কুর্দি শহর কোবানিকে আইএসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সালে সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য যদি আমরা সত্য বলে ধরে নেই, তাহলে এটা স্পষ্ট যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তাদের উপস্থিতি আরও অনেক দিনের জন্য রাখতে চায়। তারা সিরিয়ায় আরও দুই হাজার সামরিক উপদেষ্টা পাঠাতে চায়। আর তাই তারা ব্যবহার করতে চায় ওয়াইপিজিকে। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানে। তুরস্কের এটা পছন্দ নয়। ওয়াইপিজি যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে তা তুরস্কের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। এক সময় ওয়াইপিজির সঙ্গে রাশিয়ার ভালো সম্পর্ক ছিল। অভিযোগ আছে রাশিয়ার উপদেষ্টারা আফরিনে ওয়াইপিজির পক্ষে কাজ করত। কিন্তু ওয়াইপিজি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি দ্বিতীয় ‘ফ্রন্ট’ ওপেন করায় রাশিয়া কুর্দিদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। এবং সর্বশেষ খবর অনুযায়ী আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযানের ব্যাপারে রাশিয়ার কোনো আপত্তি ছিল না। এখানে বৃহৎ শক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর একটি ভূমিকা লক্ষ্য করার মতো। সিরিয়ার রাজনীতিকে কেন্দ্র করে স্পষ্টতই দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। এটা স্পষ্ট যে রাশিয়ার কারণেই আসাদ সরকার টিকে গেল। এখানে রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া একটি পক্ষ। আর যুক্তরাষ্ট্র আসাদবিরোধী। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া জোটের বিরুদ্ধে। তুরস্ক তার জাতীয় স্বার্থের কারণেই রাশিয়া-ইরান-সিরিয়া শিবিরে অবস্থান করছে।সিরিয়া যুদ্ধে এখন অনেক ‘ফ্রন্টের’ জন্ম হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরান- সবারই সিরিয়ায় স্বার্থ রয়েছে। এরপর যোগ হয়েছে ইসরাইল। কিছুদিন আগে তুরস্ক কর্তৃক ইসরাইলি যুদ্ধবিমান ধ্বংসের পর ইসরাইল এটাকে হালকাভাবে নেবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। তুরস্ক সিরিয়ার কুর্দি অধ্যুষিত আফরিন দখল করে নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। অথচ দেশ দুটো ন্যাটোর সদস্য। তুরস্কের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। রাশিয়া থেকে অস্ত্রও কিনছে তুরস্ক। এই অস্ত্র কেনার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখে দেখছে না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আফরিনে তুরস্কের সামরিক আগ্রাসন যুক্তরাষ্ট্রের ভালো না লাগারই কথা। তুরস্কে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড হয়েছে, তা কুর্দি সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে হয়েছে বলে তুরস্কের অভিযোগ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কুর্দি অঞ্চল মানবিজকে নিয়ে। মানবিজ সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের একটি শহর। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশের অবস্থান রয়েছে, যারা সেখানে ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে কর্মরত রয়েছে। তুরস্ক মানবিজ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল জোসেফ ভোগেল সিএনএনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি সেনা প্রত্যাহারের ব্যাপারে আদৌ কোনো চিন্তাভাবনা করছেন না। তিনি এটাও স্পষ্ট করেছেন, পেন্টাগন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সকে তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখবে। এ ফোর্স তুরস্কের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আফরিন শহর মুক্ত করার জন্য ‘যুদ্ধ’ করছে। ফলে সিরিয়া সংকট নতুন একটি মোড় নিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে আফরিন অঞ্চল থেকে কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ওয়াইপিজি উচ্ছেদ হলেও, তারা পাল্টা লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। তুরস্কের সামরিক আগ্রাসন সিরিয়ার শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও বিস্মিত করবে। জেনেভায় জাতিসংঘের উদ্যোগে যে শান্তি আলোচনা চলে আসছিল, তা কোনো ফল বয়ে আনতে পারছিল না। অন্যদিকে রাশিয়ার সোচিতে যে বিকল্প শান্তি আলোচনা চলছিল, তাতেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। ২৯ জানুয়ারি সোচিতে যে শান্তি আলোচনা আহ্বান করা হয়েছিল, সিরিয়ারবিরোধী পক্ষ তাতে যোগ না দেয়ায় কার্যত সেই উদ্যোগও এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফলে এ প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই উঠবে যে সিরিয়ার রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা কাটবে কী? সিরিয়া থেকে আইএসের মতো জঙ্গি গোষ্ঠী এক রকম উচ্ছেদ হয়েছে। বিশেষ করে বছর দু’এক আগে মার্কিন ও রাশিয়ার বিমান হামলার পর আইএস সিরিয়ায় দুর্বল হয়ে যায়। তারা ২০১৪ সালের পর থেকে যেসব এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল এবং যেসব এলাকায় তারা তথাকথিত একটি ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা করেছিল, ওই বিমান হামলায় তা ধ্বংস হয়ে যায়। আইএস সিরিয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়; কিন্তু রাশিয়ার বিমান হামলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অভিযোগ ওঠে রাশিয়ার বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে আসাদবিরোধী বেশকিছু বিদ্রোহী গ্রুপ, যারা আইএস এর সঙ্গে জড়িত ছিল না। এ যখন পরিস্থিতি, তখন আফরিনে তুরস্ক সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিল। তুরস্ক তার সামরিক আগ্রাসনের জন্য যুক্তি দেখিয়েছে। তুরস্ক বলছে তারা শহরটিকে সন্ত্রাসীদের করিডোর হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেবে না। এ সামরিক আগ্রাসনের ঘটনা ন্যাটোভুক্ত যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে। তুরস্কের সামরিক আগ্রাসনের একদিন আগে সিরিয়ার তুরস্ক সীমান্তবর্তী এলাকায় কুর্দিদের নিয়ে শক্তিশালী সীমান্তরক্ষী বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) নেতৃত্বেই এ পরিকল্পনা করে যুক্তরাষ্ট্র। পিকেকে তুরস্কে নিষিদ্ধ। ওয়াইপিজি হচ্ছে পিকেকের সামরিক শাখা। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে তুরস্কের অভ্যন্তরে যেসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে পিকেকের হাত রয়েছে বলে তুরস্ক অভিযোগ করেছিল। আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযানে সিরিয়ার জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণ আরও বেশি জটিল হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র কুর্দি ওয়াইপিজি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এ হামলা ট্রাম্প প্রশাসনকে ন্যাটোভুক্ত তুরস্কের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে সিরিয়ার রাকা শহর থেকে আইএসকে উৎখাতে ওয়াইপিজির সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু তুরস্ক ওয়াইপিজি-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতাকে ভালো চোখে নেয়নি। তুরস্কের ভয় ছিল কুর্দি বিদ্রোহীরা ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের অংশবিশেষ নিয়ে একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। সিরিয়ার কুর্দিরা বেশির ভাগই দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে। পিকেকের সশস্ত্র শাখা ওয়াইপিজি বা পিপলস ডিফেনস ইউনিট (YPG) ২০১২ সালে ইউফ্রেটিস নদীর পূর্বপারের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর থেকেই তুরস্ক এক ধরনের অস্বস্তিতে ছিল। বলা ভালো ১৯৮৪ সাল থেকেই পিকেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ চালিয়ে আসছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
তাহলে সিরিয়া সংকটের সমাধান হবে কোন পথে? সেখানে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। সেখানে আসাদকে রাখা, না রাখা নিয়ে একটি ‘ডিবেট’ আছে। সিরিয়ায় আসাদবিরোধী অনেক ‘পক্ষ’ রয়েছে, যারা একদিকে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধেও ‘যুদ্ধ’ করছে, আবার ক্ষমতা দখলের জন্য নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষেও লিপ্ত। দুটি বড় শক্তি, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়াও সিরিয়া সংকটে নিজেদের জড়িত করেছে। জাতিসংঘের উদ্যোগে জেনেভাতে একটি শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু ওই সম্মেলনে এখন অব্দি একটি শান্তি ফর্মুলা উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে রাশিয়ার উদ্যোগে সোচিতেও আসাদবিরোধীদের নিয়ে একটি শান্তি সম্মেলন আয়োজন করে আসছে ক্রেমলিন। কিন্তু সেখানেও কোনো সমাধান বের করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ সোচি বৈঠক বয়কট করেছে সিরিয়ার বিরোধী পক্ষ, যাদের কেউ কেউ জেনেভা সম্মেলনেও অংশ নিয়েছিল। জেনেভা সম্মেলনে যোগ দিতে বিরোধী দলগুলোর উদ্যোগে একটি ‘হাই নেগোসিয়েশনস কমিটি’ (এইচএনসি) গঠিত হয়েছিল। কিন্তু কমিটির মধ্যেও দ্বন্দ্ব আছে। এইচএনসি সৌদি আরব সমর্থিত। তবে কুর্দিদের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে এখানে দ্বন্দ্ব আছে। বস্তুত ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্ম হওয়া এইচএনসির কোনো ভূমিকা নেই।
তাহলে সমাধানটা হবে কীভাবে? সিরিয়ার পরিস্থিতি সত্যিকার অর্থেই জটিল হয়ে পড়েছে। এখানে কার্যত দুটি বড় শক্তির অবস্থান পরস্পর বিরোধী। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টতই কুর্দিদের নিয়ে সিরিয়ায় আসাদবিরোধী একটি ফ্রন্ট গড়ে তুলতে চায়। অর্থাৎ আসাদবিরোধী একটি পক্ষকে সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় তার অবস্থান ধরে রাখতে চায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখানে তুরস্কের সমর্থন না পাওয়া। কুর্দিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহাবস্থান ও সমর্থন তুরস্ক ভালো চোখে দেখছে না। যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে সিরিয়ায় ইরানি প্রভাব কমান। এক্ষেত্রে সুন্নি ধর্মাবলম্বী তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাচারাল মিত্র হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। বরং তুরস্ক ও ইরান এক ধরনের অ্যালায়েন্সে গেছে। রাশিয়া আইএসবিরোধী অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে ছিল। কিন্তু রাশিয়া চায় না আসাদ অপসারিত হোক। আসাদকে রেখেই রাশিয়া এক ধরনের সমাধান চায়। এখানে তুরস্কের আপত্তি থাকলেও, বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তুরস্ক আজ রাশিয়ার মিত্র। রাশিয়া নিজ উদ্যোগে সিরিয়ায় একটি রাজনৈতিক সমাধান বের করতে চায়। সে জন্যই সোচিতে সিরিয়ার সকল দল ও মতের প্রতিনিধিদের একটি সম্মেলন আহ্বান করেছিল রাশিয়া, যাকে তারা বলছে ‘সিরিয়ান কংগ্রেস অব ন্যাশনাল ডায়ালগ’। কিন্তু সেখানেও বিরোধ আছে। নানা মত ও পক্ষের প্রায় ১৫০০ প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও, একটা বড় অংশ এতে অংশ নেয়নি। সিরিয়ার বিরোধী পক্ষ ‘সিরিয়ান নেগোসিয়েশন কমিশন’ এ সম্মেলনে অংশ নেয়নি। সিরিয়া সংকটের মূলে রয়েছে সব মত ও পথকে একটি কাঠামোয় আনা। সেখানে সুন্নি, শিয়া, দুর্জ, আলাউত মতাবলম্বীসহ বিভিন্ন সামরিক গ্রুপও রয়েছে। আসাদ সমর্থকরাও একটি পক্ষ। কিছু ইসলামিক গ্রুপও রয়েছে, যারা আইএসের বিরোধিতা করেছিল। সবাইকে নিয়ে একটি সমাধান বের করা সহজ কাজ নয়। যদিও সোচিতে সবাই সিরিয়ার অখণ্ডতা রক্ষায় একমত হয়েছেন। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক ধারা ও নির্বাচনের প্রশ্নে সবাই একমত হয়েছেন। তারপরও কথা থেকে যায়- বড় বিরোধী দলের অবর্তমানে এ সমঝোতা আদৌ কাজ করবে কিনা?
আপাতত সিরিয়া সংকটের কোনো সমাধান হচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী নয়া স্নায়ুযুদ্ধের যে সূচনা হয়েছে, তার প্রভাব এখানেও পড়েছে। রাশিয়ার যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে সিরিয়ায়। সিরিয়ার পোর্ট আর বিমান ঘাঁটি ব্যবহার করছে রাশিয়া। সীমিত আকারে রাশিয়ার সেনা সদস্যরাও সেখানে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সদস্যরাও ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে সিরিয়ার একটি অঞ্চলে কর্মরত। তুরস্কের সেনাবাহিনী সিরিয়ার ভেতরেই অবস্থান করছে। এদিকে ইসরাইলি বিমান বাহিনী সিরিয়ার একটি বিমান ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে। এ হামলার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের যে সমর্থন রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। এর অর্থ হচ্ছে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবেই হোক ইসরাইল সিরীয় সংকটের একটা অংশ হয়ে গেল। তাই আপাতদৃষ্টিতে সিরিয়া সংকটের সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। প্রেসিডেন্ট আসাদ ক্ষমতায় থেকে গেলেন বটে, কিন্তু তিনি যে দেশটিকে পেয়েছেন, তা পুনর্গঠনে তার আর্থিক ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। আইএস উৎখাত হয়েছে, কিন্তু যুদ্ধ থামছে না। প্রশ্ন হচ্ছে এই যুদ্ধ আর কতদিন প্রলম্বিত হবে? এর জবাব বোধ হয় এ মুহূর্তে কারোরই জানা নেই।

0 comments:

Post a Comment