সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। দলীয়
সিদ্ধান্ত অমান্য করে এক এক করে সুলতান মনসুর, মোকাব্বির খান ও জাহিদুর
রহমান সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। আবার মোকাব্বির খানকে গণফোরাম বহিষ্কারের
কথা ঘোষণা করলেও তাকে দেখা গেল কামাল হোসেনের পাশে বসতে গণফোরামের বিশেষ
অধিবেশনে। এদের সংসদে অধিবেশনে যোগদান রাজনীতিতে বিতর্ক বাড়িয়েছে। একটা
যুক্তি আছে। এরা নির্বাচিত। জনগণ তাদের ভোট দিয়েছে। এখন কি এরা তাদের
এলাকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না? এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন। এই
প্রশ্নটিই প্রথমে তুলেছিলেন সুলতান মনসুর। তিনি সংসদে তার এলাকার জনগণের
কথা বলতে চান। জনগণ তাকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছে। দলীয় শৃঙ্খলার কারণে সেই
প্রতিনিধিত্বে তখন বড় অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছিল। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের
এটাই বড় সমস্যা। অনেকেই ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের কথা বলেছেন। কিন্তু এই
অনুচ্ছেদ যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে তো সংসদ ‘কেনা-বেচার’ হাটে পরিণত হবে!
টাকার বিনিময়ে সংসদ সদস্যরা ‘বিক্রি’ হয়ে যেতে পারেন। দল ভাঙা ও নতুন দল
গড়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হবে। যাদের হাতে টাকা আছে, তারা
সাংসদদের ক্রয় করে সরকার গঠনে উদ্যোগী হবেন! এর মধ্য দিয়ে অস্থিতিশীল সরকার
গঠিত হতে পারে। গণতন্ত্রের জন্য এটা কোনো ভালো খবর নয়। সুতরাং ৭০ অনুচ্ছেদ
পরিবর্তন না করাই শ্রেয়। তবে ৭০ অনুচ্ছেদকে আরও যুগোপযোগী করা যায়। যেমন
৭০ অনুচ্ছেদে ‘দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে’ কথাটা অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। না
হলে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকল।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৮ বছরে পা দিয়েছে চলতি মার্চ মাসে। একটি দেশের জন্য ৪৮ বছর একেবারে কম সময় নয়। এই ৪৮ বছরে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। সামাজিক ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও আমরা ভারতের কাছ থেকেও এগিয়ে আছি। কিন্তু আমাদের একটা বড় অন্তরায় হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। রাজনীতিতে যে আস্থার সম্পর্ক প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি অনেক। এই আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্রকে আমরা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না। একটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে বটে। কিন্তু নির্বাচনটি ভালো হয়নি। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি হলেও, নির্বাচনটি ছিল ত্রুটিযুক্ত। নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আটটি আসন পাওয়া অনেককেই অবাক করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রন্ট সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন দল তথা ফ্রন্টের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেই সুলতান মনসুররা সংসদে যোগ দিলেন। আর মোকাব্বির খান, জাহিদরা তাকে অনুসরণ করলেন। এখন একটা মৌলিক প্রশ্ন এখনÑ জাহিদ, মোকাব্বির কিংবা সুলতান মনসুরের ভাগ্য এখন কীভাবে লিখিত হবে? তারা কি সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে আগামী পাঁচ বছর থাকতে পারবেন? নানা প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা এখন জনমনে। নবম জাতীয় সংসদের শেষের দিকে জাতীয় পার্টি থেকে সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসদে তার সংসদ্যপদ স্বতন্ত্র হিসেবে বজায় ছিল। অষ্টম সংসদের শেষের দিকে তৎকালীন বিএনপি থেকে রাজশাহী-৪ আসনের এমপি আবু হেনাকে বহিষ্কার করা হয়। আবু হেনার ক্ষেত্রেও তর সংসদ সদস্যপদ বহাল ছিল। সুলতান মনসুর, মোকাব্বির খান ও জাহিদরা এসব জানেন। আর জেনেশুনেই তারা সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। যতদূর জানি সুলতান মনসুর নিজে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেননি। তিনি সংস্কারবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সংস্কারবাদী অনেক নেতাকেই আওয়ামী লীগ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুলতান মনসুরকে যদি ফিরিয়ে নেয়, আমি অবাক হব না।
সুলতান মনসুর মোকাব্বির কিংবা জাহিদরা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সংসদে যোগ দিয়ে নৈতিকভাবে এরা ‘পরাজিত’ হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ‘রাজনৈতিক শত্রু’ বিএনপির ধানের শীষ মার্কা নিয়ে বিজয়ী হয়ে মনসুর সাহেবরা যদি এখন আবার তার নিজ দলে ফিরে যান, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য সেটা ভালো দৃষ্টান্ত হবে না। রাজনীতিকদের প্রতি মানুষের যে আস্থা হারাচ্ছে, এটা হবে তার একটা বড় দৃষ্টান্ত। মানুষ চায় রাজনীতিবিদরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। দলবদল, সীমিত সুযোগের জন্য দলত্যাগ কিংবা আবার দলে ফিরে আসা কোনো ভালো খবর নয়।
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন অতিসম্প্রতি। বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন নানা মহল থেকে নানা কথা উচ্চারিত হচ্ছে, তখন উপজেলা নির্বাচন চলাকালীন তিনি বলেছিলেন, ‘ভোটের প্রতি জনগণের যে অনীহা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে জাতি এক গভীর খাদের কিনারার দিকে অগ্রসরমান। আমরা গণতন্ত্রের শোকযাত্রায় শামিল হতে চাই না। রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিকদের এটা ভেবে দেখা দরকার।’ (যুগান্তর) নির্বাচন কমিশন থেকে একজন নির্বাচন কমিশনার যখন এ ধরনের কথাবার্তা বলেন, তখন আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘মেসেজ’ দেয়। আমরা নির্বাচন ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছি। পাঠক, কম্বোডিয়ার পরিস্থিতির দিকে লক্ষ রাখতে পারেন। নির্বাচন ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারি দলের ওপর নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্ব বাড়ানো ও বড় দলগুলোর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার। না হলে সরকার ক্ষমতায় থাকবে বটে, কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো উন্নতি হবে না। গণতন্ত্রের জন্য তা হবে দুঃখজনক ঘটনা।
আমরা বারবার রাজনীতিবিদের কাছে ফিরে যাই। রাজনীতিবিদরাই আমাদের পথ দেখাবেন। তাদের ওপর আস্থাটা রাখতে চাই। কিন্তু সুলতান মনসুর, মোকাব্বির খান আর জাহিদুর রহমানরা সেই আস্থাটা কতটুকু ধরে রাখতে পারলেন এখন? ড. কামাল হোসেন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি ‘সফল’ না হলেও, তার ব্যক্তিত্ব, দুর্নীতিমুক্ত থাকা, একজন সিনিয়র সিটিজেন, উপরন্তু সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় তার ভূমিকা তাকে সমাজে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিতে পরিণত করেছে। কিন্তু একি করলেন তিনি? যে মোকাব্বির খানকে তার বাসা ও অফিসে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, সেই মোকাব্বির খানকে পাশে বসিয়ে গণফোরামের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে বক্তব্য দেন কীভাবে? তাহলে কি ধরে নেব মোকাব্বির খানের সংসদ অধিবেশনে যোগদানের ব্যাপারে তার নীরব সম্মতি ছিল? মোকাব্বির খান তো তেমনটাই ইঙ্গিত করেছিলেন। এটা কি তাহলে তার দ্বিমুখী নীতি হয়ে গেল না? বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে ড. কামাল হোসেন কখনোই আওয়ামী লীগের বিকল্প না, কখনো ছিলেন না, এখনো তিনি নন। একটা সীমিত সময়ের জন্য তার প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজন এখন ফুরিয়ে গেছে বলে আমার ধারণা।
একজন রাজনীতিবিদ সৎ থাকবেন। কমিটেড থাকবেন। লোভ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের কাছে দৃষ্টান্ত যে নেই, তেমনটি নয়। দৃষ্টান্ত আছে। তাদের নাম আজ না হয় নাই বা উল্লেখ করলাম। কিন্তু আজ যখন দেখি শুধু রাজনীতি করে অনেকে অঢেল সম্পদের ‘মালিক’ হয়েছেন, তখন কষ্ট লাগে। আস্থায় ঘাটতি সৃষ্টি হয়। শুধু বাড়ি-গাড়ি নয়, অনেকে আবার ‘ব্যবসায়ী’ হয়ে গেছেন। অনেকে আবার কর দেন না অথবা করখেলাপি। সাধারণ একজন মানুষ থেকে হঠাৎ করে ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়ে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে গেছেন! দুদক যখন এদের কাউকে কাউকে ‘নোটিস’ করে, তখন আমাদের আস্থার জায়গাটা আর থাকে না।
একটা দল ভুল করতেই পারে। বিএনপিও ভুল করেছে। এখন জাহিদুর রহমানরা সংসদে গিয়ে কি আরেকটি ভুল করতে যাচ্ছেন? এটা ‘ওয়ান মিলিয়ন’ ডলারের প্রশ্ন। যদিও বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, সরকারের ‘চাপ’ ছিল। অথচ প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন কোনো ‘চাপ ছিল না’। অনেকে বলার চেষ্টা করেন, সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সংসদ সদস্যের পদটি একটি ‘লোভনীয় পদে’ পরিণত হয়েছে! সংসদ সদস্যরা ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি পান (অনেকে আবার সেই গাড়ি অনেক টাকায় বিক্রি করে দেন)। ফ্ল্যাট কিংবা প্লট পান। মাসিক বেতন ও মাসোহারা পান। এককালীন থোক বরাদ্দ পান। নামে-বেনামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারেন। এটা যে শুধু যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাদের জন্যই প্রজোয্য নয়। বরং যারা বিরোধী দলে থাকেন, তারাও এই ‘সুযোগ’টি গ্রহণ করেন। একসময় যারা বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারাও এক-একজন ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন এমন অভিযোগ তো আছে। নিজের স্ত্রী, ভাই কিংবা বোনকে সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে নিয়ে এসেছেন এমন দৃষ্টান্ত তো এ সংসদেই আছে। একজন মওলানা ভাসানী চিরদিন ‘কুঁড়ের ঘরে’ জীবন কাটিয়ে গেছেন। তিনি কখনো প্লট বা ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন করেননি। ঢাকা শহরে তার বাড়িও নেই। এসব তার প্রয়োজন ছিল না। তার অনুসারীরা তাকে কলা-মুড়ি, চিঁড়া এনে দিয়ে যেতÑ এসব তিনি নিজে যেমন খেতেন, তেমনি আমাদের মতো অতিথি গেলে, তাদেরও খেতে দিতেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, ‘দ্বিতীয়’ আরেকজন মওলানা ভাসানী আমরা পেলাম না!
এখন সুলতান মনসুর, মোকাব্বির খান কিংবা জাহিদুর রহমানরা কতটুকু ‘নিজের স্বার্থের’ জন্য সংসদে গেলেন, কিংবা কতটুকু ‘রাজনীতি’র জন্য সংসদে গেলেন, তার মূল্যায়ন হয়তো আগামী দিনে হবে। কিন্তু এ ‘ঘটনা’ একটা বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল। এ ‘ঘটনা’ আগামী দিনের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। এর ফলে ‘রাজনীতি’ আর থাকল না। সুবিধাবাদিতা এখন এসে ভিড় করবে রাজনীতির ময়দানে।
Daily Desh Rupantor
30.04.2019
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৮ বছরে পা দিয়েছে চলতি মার্চ মাসে। একটি দেশের জন্য ৪৮ বছর একেবারে কম সময় নয়। এই ৪৮ বছরে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। সামাজিক ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও আমরা ভারতের কাছ থেকেও এগিয়ে আছি। কিন্তু আমাদের একটা বড় অন্তরায় হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। রাজনীতিতে যে আস্থার সম্পর্ক প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি অনেক। এই আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্রকে আমরা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব না। একটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে বটে। কিন্তু নির্বাচনটি ভালো হয়নি। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি হলেও, নির্বাচনটি ছিল ত্রুটিযুক্ত। নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আটটি আসন পাওয়া অনেককেই অবাক করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রন্ট সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এখন দল তথা ফ্রন্টের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেই সুলতান মনসুররা সংসদে যোগ দিলেন। আর মোকাব্বির খান, জাহিদরা তাকে অনুসরণ করলেন। এখন একটা মৌলিক প্রশ্ন এখনÑ জাহিদ, মোকাব্বির কিংবা সুলতান মনসুরের ভাগ্য এখন কীভাবে লিখিত হবে? তারা কি সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে আগামী পাঁচ বছর থাকতে পারবেন? নানা প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা এখন জনমনে। নবম জাতীয় সংসদের শেষের দিকে জাতীয় পার্টি থেকে সাতক্ষীরা-৪ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংসদে তার সংসদ্যপদ স্বতন্ত্র হিসেবে বজায় ছিল। অষ্টম সংসদের শেষের দিকে তৎকালীন বিএনপি থেকে রাজশাহী-৪ আসনের এমপি আবু হেনাকে বহিষ্কার করা হয়। আবু হেনার ক্ষেত্রেও তর সংসদ সদস্যপদ বহাল ছিল। সুলতান মনসুর, মোকাব্বির খান ও জাহিদরা এসব জানেন। আর জেনেশুনেই তারা সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। যতদূর জানি সুলতান মনসুর নিজে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেননি। তিনি সংস্কারবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সংস্কারবাদী অনেক নেতাকেই আওয়ামী লীগ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুলতান মনসুরকে যদি ফিরিয়ে নেয়, আমি অবাক হব না।
সুলতান মনসুর মোকাব্বির কিংবা জাহিদরা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সংসদে যোগ দিয়ে নৈতিকভাবে এরা ‘পরাজিত’ হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ‘রাজনৈতিক শত্রু’ বিএনপির ধানের শীষ মার্কা নিয়ে বিজয়ী হয়ে মনসুর সাহেবরা যদি এখন আবার তার নিজ দলে ফিরে যান, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য সেটা ভালো দৃষ্টান্ত হবে না। রাজনীতিকদের প্রতি মানুষের যে আস্থা হারাচ্ছে, এটা হবে তার একটা বড় দৃষ্টান্ত। মানুষ চায় রাজনীতিবিদরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। দলবদল, সীমিত সুযোগের জন্য দলত্যাগ কিংবা আবার দলে ফিরে আসা কোনো ভালো খবর নয়।
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন অতিসম্প্রতি। বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন নানা মহল থেকে নানা কথা উচ্চারিত হচ্ছে, তখন উপজেলা নির্বাচন চলাকালীন তিনি বলেছিলেন, ‘ভোটের প্রতি জনগণের যে অনীহা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে জাতি এক গভীর খাদের কিনারার দিকে অগ্রসরমান। আমরা গণতন্ত্রের শোকযাত্রায় শামিল হতে চাই না। রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিকদের এটা ভেবে দেখা দরকার।’ (যুগান্তর) নির্বাচন কমিশন থেকে একজন নির্বাচন কমিশনার যখন এ ধরনের কথাবার্তা বলেন, তখন আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘মেসেজ’ দেয়। আমরা নির্বাচন ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছি। পাঠক, কম্বোডিয়ার পরিস্থিতির দিকে লক্ষ রাখতে পারেন। নির্বাচন ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারি দলের ওপর নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্ব বাড়ানো ও বড় দলগুলোর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার। না হলে সরকার ক্ষমতায় থাকবে বটে, কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো উন্নতি হবে না। গণতন্ত্রের জন্য তা হবে দুঃখজনক ঘটনা।
আমরা বারবার রাজনীতিবিদের কাছে ফিরে যাই। রাজনীতিবিদরাই আমাদের পথ দেখাবেন। তাদের ওপর আস্থাটা রাখতে চাই। কিন্তু সুলতান মনসুর, মোকাব্বির খান আর জাহিদুর রহমানরা সেই আস্থাটা কতটুকু ধরে রাখতে পারলেন এখন? ড. কামাল হোসেন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি ‘সফল’ না হলেও, তার ব্যক্তিত্ব, দুর্নীতিমুক্ত থাকা, একজন সিনিয়র সিটিজেন, উপরন্তু সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় তার ভূমিকা তাকে সমাজে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিতে পরিণত করেছে। কিন্তু একি করলেন তিনি? যে মোকাব্বির খানকে তার বাসা ও অফিসে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, সেই মোকাব্বির খানকে পাশে বসিয়ে গণফোরামের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে বক্তব্য দেন কীভাবে? তাহলে কি ধরে নেব মোকাব্বির খানের সংসদ অধিবেশনে যোগদানের ব্যাপারে তার নীরব সম্মতি ছিল? মোকাব্বির খান তো তেমনটাই ইঙ্গিত করেছিলেন। এটা কি তাহলে তার দ্বিমুখী নীতি হয়ে গেল না? বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে ড. কামাল হোসেন কখনোই আওয়ামী লীগের বিকল্প না, কখনো ছিলেন না, এখনো তিনি নন। একটা সীমিত সময়ের জন্য তার প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজন এখন ফুরিয়ে গেছে বলে আমার ধারণা।
একজন রাজনীতিবিদ সৎ থাকবেন। কমিটেড থাকবেন। লোভ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের কাছে দৃষ্টান্ত যে নেই, তেমনটি নয়। দৃষ্টান্ত আছে। তাদের নাম আজ না হয় নাই বা উল্লেখ করলাম। কিন্তু আজ যখন দেখি শুধু রাজনীতি করে অনেকে অঢেল সম্পদের ‘মালিক’ হয়েছেন, তখন কষ্ট লাগে। আস্থায় ঘাটতি সৃষ্টি হয়। শুধু বাড়ি-গাড়ি নয়, অনেকে আবার ‘ব্যবসায়ী’ হয়ে গেছেন। অনেকে আবার কর দেন না অথবা করখেলাপি। সাধারণ একজন মানুষ থেকে হঠাৎ করে ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়ে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে গেছেন! দুদক যখন এদের কাউকে কাউকে ‘নোটিস’ করে, তখন আমাদের আস্থার জায়গাটা আর থাকে না।
একটা দল ভুল করতেই পারে। বিএনপিও ভুল করেছে। এখন জাহিদুর রহমানরা সংসদে গিয়ে কি আরেকটি ভুল করতে যাচ্ছেন? এটা ‘ওয়ান মিলিয়ন’ ডলারের প্রশ্ন। যদিও বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, সরকারের ‘চাপ’ ছিল। অথচ প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন কোনো ‘চাপ ছিল না’। অনেকে বলার চেষ্টা করেন, সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সংসদ সদস্যের পদটি একটি ‘লোভনীয় পদে’ পরিণত হয়েছে! সংসদ সদস্যরা ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি পান (অনেকে আবার সেই গাড়ি অনেক টাকায় বিক্রি করে দেন)। ফ্ল্যাট কিংবা প্লট পান। মাসিক বেতন ও মাসোহারা পান। এককালীন থোক বরাদ্দ পান। নামে-বেনামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারেন। এটা যে শুধু যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাদের জন্যই প্রজোয্য নয়। বরং যারা বিরোধী দলে থাকেন, তারাও এই ‘সুযোগ’টি গ্রহণ করেন। একসময় যারা বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তারাও এক-একজন ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন এমন অভিযোগ তো আছে। নিজের স্ত্রী, ভাই কিংবা বোনকে সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে নিয়ে এসেছেন এমন দৃষ্টান্ত তো এ সংসদেই আছে। একজন মওলানা ভাসানী চিরদিন ‘কুঁড়ের ঘরে’ জীবন কাটিয়ে গেছেন। তিনি কখনো প্লট বা ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন করেননি। ঢাকা শহরে তার বাড়িও নেই। এসব তার প্রয়োজন ছিল না। তার অনুসারীরা তাকে কলা-মুড়ি, চিঁড়া এনে দিয়ে যেতÑ এসব তিনি নিজে যেমন খেতেন, তেমনি আমাদের মতো অতিথি গেলে, তাদেরও খেতে দিতেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, ‘দ্বিতীয়’ আরেকজন মওলানা ভাসানী আমরা পেলাম না!
এখন সুলতান মনসুর, মোকাব্বির খান কিংবা জাহিদুর রহমানরা কতটুকু ‘নিজের স্বার্থের’ জন্য সংসদে গেলেন, কিংবা কতটুকু ‘রাজনীতি’র জন্য সংসদে গেলেন, তার মূল্যায়ন হয়তো আগামী দিনে হবে। কিন্তু এ ‘ঘটনা’ একটা বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল। এ ‘ঘটনা’ আগামী দিনের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। এর ফলে ‘রাজনীতি’ আর থাকল না। সুবিধাবাদিতা এখন এসে ভিড় করবে রাজনীতির ময়দানে।
Daily Desh Rupantor
30.04.2019