একজন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন কিশোরী রাফি। তার মা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন। এটাই তার কাল হয়েছিল। সিরাজ-উদ-দৌলার সমর্থকরা তাকে মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। ৬ এপ্রিল আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথমপত্রের পরীক্ষার দিন তাকে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ১০ এপ্রিল মারা যায় রাফি। ওই ঘটনায় সারা দেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। পুলিশের পিবিআই ২৯ মে ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করে। ৩০ জুন বিচার শুরু হয়। আর চার মাসের আগেই ২৪ অক্টোবর রায় দিল আদালত।
নিঃসন্দেহে এই রায় একটি যুগান্তকারী এবং এ থেকে আমাদের ও সমাজের শেখার আছে অনেক কিছু। প্রথমত, এই রায়ে জনমানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। এভাবে একজন ছাত্রীকে পুড়িয়ে মারা হবে, এটা এই সভ্যসমাজে চিন্তাও করা যায় না। এই রায়ে এটাই প্রমাণিত হলো, ক্ষমতাধর যারাই থাকুক না কেন, হত্যাকাণ্ডের বিচার থেকে কেউ-ই মাফ পেতে পারে না। পুলিশের ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনও (পিবিআই) ধন্যবাদ পেতে পারে। তারা অতি দ্রুততার সঙ্গে মামলার তদন্তকাজ সম্পন্ন করেছে। দ্বিতীয়ত, রায়ে চারজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার ও সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। এখন দেখার পালা, পুলিশের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে মামলার কালক্ষেপণ, এজাহার নিয়ে কুটচাল, গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের নাম বাদ, নুসরাতকে থানায় জবানবন্দির নামে ওসির হেনস্তা, আইনিবহির্ভ‚ত জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদি। বলা ভালো, পুলিশ সুপারকে দাবির মুখে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল আর ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির অনেক পর তিনি গ্রেপ্তার হন। ওসি মোয়াজ্জেম অনেক ক্ষমতা রাখেন। ভাবতে অবাক লাগে, কীভাবে তিনি নুসরাতকে থানায় ডেকে নিয়ে (মৃত্যুর আগে) জবানবন্দির নামে তাকে হেনস্তা করেন এবং তার বক্তব্য ফেইসবুকে আপলোড করেন। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমরা কোনোভাবেই যেন থানাপর্যায়ে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা আছেন, তাদের ‘নিয়ন্ত্রণে’ আনতে পারছি না। একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, তারা প্রশিক্ষণের সময় ওসি তথা দারোগাদের এটা স্মরণ করিয়ে দেন, তারা জনগণের ‘সেবক’, তারা ‘শাসক’ নন। আইজি সাহেবও একাধিকবার এ ধরনের কথা বলেছেন। কিন্তু ওসিরা নিজেদের ‘রাজা’ ভাবেন। নুসরাতের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়েছিল।
এখন একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করার সময় এসেছে। না হলে পুলিশের ওপর জনগণের যে আস্থা, তা কমতে থাকবে, যা পুলিশ প্রশাসনের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। আমার অনেক ছাত্র পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আমি আস্থাটা রাখতে চাই। ওসি মোয়াজ্জেমের বিচার আইসিটি আইনে হচ্ছে। তৃতীয়ত, নুসরাতের বিচার প্রক্রিয়া যেভাবে সম্পন্ন হয়েছে, বুয়েটছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের বিচারও কি সেভাবে সম্পন্ন হবে? আবরার হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সারা দেশে যেন একটি ‘ঝড়’ বয়ে গিয়েছিল। ছাত্ররাজনীতির নাম করে ক্ষমতাসীনদের ছাত্রসংগঠন যে কত সহিংস হয়ে উঠতে পারে, আবরার হত্যাকাণ্ড ছিল এর বড় প্রমাণ। যে বুয়েট এ দেশে মেধাবী সন্তানদের জন্ম দিয়েছিল, সেই বুয়েটে এখন তথাকথিত ছাত্ররাজনীতির নামে জন্ম হয়েছিল খুনিদের। সবাই মিলে একজন সাধারণ ছাত্রকে পিটিয়ে মেরে ফেলল, তাকে চিকিৎসা দিল না, এই খুনিদেরও যেন নুসরাত হত্যাকাণ্ডের মতো বিচার হয়। তবে একটা শঙ্কা আছে– যেন ‘দ্বিতীয় আরেকটি বিশ্বজিৎ’-এর ঘটনার জন্ম না দেয়। বিশ^জিতের ঘটনায় খুনিদের চিহ্নিত ও ভিডিও ফুটেজ থাকা সত্ত্বেও খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি। এখন আবরার হত্যাকাণ্ডের বিচার যেন আরেকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। আমি খুশি হব যদি এই মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়। একাধিক মন্ত্রী আবরার হত্যাকাণ্ডের খুনিদের বিচার চেয়েছেন। আমরা দেখতে চাই এর বাস্তব প্রতিফলন। একজন মন্ত্রী আবরার হত্যাকাণ্ডে জড়িত একজন খুনিকে প্রথমদিকে গ্রেপ্তার না হওয়ায় যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তার মধ্যে ‘সাম্পªদায়িকতার’ গন্ধ খুঁজে পেয়েছিলেন! এ ধরনের বক্তব্য সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্টের বিরোধী। মন্ত্রীদের সতর্ক হয়ে বক্তব্য দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
নুসরাত হত্যাকাণ্ডের রায়ের পর একজন মন্ত্রীকে দেখলাম বক্তব্য দিতে– এই রায়ের মধ্য দিয়ে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই রায় নিয়ে অতি উচ্ছ্বাস কাম্য নয়। এই রায় নিয়ে সরকারের কৃতিত্ব নেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীরা তাদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। আইন অনুযায়ী এই হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। আসামিদের কেউ কেউ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী ছিলেন। এ ড়্গেত্রে সরকারি কেঁসুলি এদের ব্যাপারে দয়াপরবশ হননি। হত্যাকাণ্ডকে হত্যাকাণ্ড হিসেবেই দেখেছেন। এখন উচ্চ আদালত রায়টি খতিয়ে দেখবে। আমরাও চাই আবরারের হত্যাকাণ্ডের বিচারও যেন একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়, যেন ছাত্রলীগের সদস্য থাকার কারণে তাদের প্রতি যেন কোনো সমবেদনা দেখানো না হয়। হত্যাকারী যেই হোক, তাদের সবার জন্য যেন বিচার এক হয়। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে যেন ‘রাজনীতি’ না হয়। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে। তাতে তিনি বলেছেন, ‘সরকার পুলিশের ওপর নির্ভরশীল বলেই নুসরাত হত্যার বিচার পুলিশের সম্পৃক্ততা সঠিকভাবে উঠে আসেনি।’ তিনি আবরার হত্যাকাণ্ডের জন্যও সরকারকে দায়ী করেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি রাজনৈতিক বক্তব্য। আদালতের রায়ে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং সরকার আদালতের এই পর্যবেক্ষণকে কীভাবে নেবে, সেটা আমাদের দেখার বিষয়। এ ব্যাপারে আগাম মন্তব্য না করাই ভালো। তবে এটা ঠিক, নুসরাতের মতো ঘটনা সমাজে নিত্য ঘটে থাকে। তনু হত্যার বিচার হয়নি। সাংবাদিক সাগর-রুনিরও বিচার হয়নি। সব বিচার হয় না। সব অপরাধী শাস্তি পায়, এটাও আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারব না। তবে একটা প্রত্যাশা তো থাকবেই। এ ধরনের প্রতিটি হত্যাকাণ্ডেরই যেন দ্রুত বিচার হয়। তাহলে অপরাধীদের কাছে একটা মেসেজ পৌঁছে যাবে– আর এতে করে ন্যায়বিচার যেমনি প্রতিষ্ঠিত হবে, ঠিক তেমনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে আমরা একধাপ এগিয়ে যাব।
আরও একটা কথা। হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা, যাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল রাফি হত্যাকাণ্ডে তার জড়িত থাকার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে। তিনি চেষ্টা করেছিলেন ‘এটা আলেম সমাজের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ’, এটা ইস্টাবলিশ করতে। তার সমর্থকরা ফেনীতে মানববন্ধন পর্যন্ত করেছিল। এখন এ দেশের আলেম সমাজ যেন এটাকে আবার ইস্যু না করে। খুনি আলেম হতে পারেন। কিন্তু তিনি খুনি, অন্য খুনিদের সঙ্গে তাকে এক কাতারেই দেখতে হবে। উপরন্তু এটা এখন আর কোনো অভিযোগ নয়, বরং আদালত কতৃক প্রমাণিত। আদালত দেশের আইন, সাক্ষী সাবুদ আর প্রত্যক্ষদর্শীর জবানি, খুনিদের স্বীকারোক্তি ইত্যাদি বিচার বিশেস্নষণ করেই রায় দিয়েছে। সুতরাং এখানে ‘আলেম সমাজ’ বলে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে সোনাগাজীর ফাজিল মাদ্রাসায় সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ড দিয়ে দেশের শত শত মাদ্রাসাকে আমরা অবমূল্যায়ন করব না। শিক্ষার উন্নয়নে মাদ্রাসাগুলোর অবদান আছে, এটা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। একজন খুনি সিরাজ-উদ-দৌলাকে দিয়ে অন্য অধ্যক্ষদেরও বিচার করাও যাবে না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই রায়ের ব্যাপারে সবাই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াই দেখিয়েছে। তবে খুনের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত একজন আসামি কামরুন নাহার মনির কন্যাসন্তানের ব্যাপারে একটি ‘সিমপ্যাথি’ লক্ষ করেছি। মাত্র এক মাসের শিশুসন্তানকে নিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মনি তার মৃত্যুদণ্ডের রায় শুনেছেন। এক মাসের শিশু মায়ের সঙ্গেই সে থাকবে। মা-ই তার আশ্রয়স্থল, সে মা যদি জেলে থাকেন, তাও। কিন্তু একটি ছোট শিশু, মায়ের অপরাধের জন্য সে কি শাস্তি ভোগ করবে? পৃথিবীতে তার আগমন ঘটল খুনি মায়ের সন্তান হিসেবে। আমি জানি না রাষ্ট্র তাকে বাবার কাছে, কিংবা নানির কাছে দেখভাল করার জন্য দিতে পারে কি-না? একটা ছোট্ট শিশুর জন্য নিশ্চয়ই জেলখানা কোনো ভালো জায়গা নয়। এমনকি তার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্যও ভালো নয়। এখন সে ছোট। অবুঝ। কিন্তু ধারণা করছি, এই রায়ের চ‚ড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগবে। ওই সময় পর্যন্ত যদি বাচ্চাটা জেলে থাকে, তাহলে তা তার মানস গঠনে একটি বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মনির সম্পৃক্ততা প্রমাণিত। তিনি নিজে পালিত কন্যা। তার পালক বাবা উচ্চ আদালতে যাবেন কি না জানি না, তবে ওই ছোট্ট বাচ্চাটার ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তারা যদি কোনো উদ্যোগ নেন, আমার ধারণা তাতে অনেকে খুশি হবেন।
Daily Desh Rupantor
30.10.2019