রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বুয়েটের ছাত্ররাজনীতি ও আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি

Image result for BUET student movement Dhaka


বুয়েটের তরুণ মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাংলাদেশের তথাকথিত ছাত্ররাজনীতিকে একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আবরার হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করল তথাকথিত লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি আর যাই হোক, সাধারণ ছাত্রদের কোনো মঙ্গল ডেকে আনতে পারে না। তথাকথিত এই ছাত্ররাজনীতি এক শ্রেণির তরুণ প্রজন্মকে খুনি বানাচ্ছে, তৈরি করছে দানব। বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির যে ঐতিহ্য, তার সঙ্গে এই রাজনীতিকে মেলানো যাবে না। তাই ছাত্ররাজনীতি দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি করার পরিবর্তে, তৈরি করছে এমন এক প্রজন্মকে, যারা পরমতসহিষ্ণুতায় বিশ্বাসী নয়। তরুণ বয়সেই তাদের মাঝে গড়ে উঠছে অপর মতকে সহ্য না করার মানসিকতা। দেশের শ্রেষ্ঠ
সন্তানরা পড়াশোনা করে বুয়েটে। আমরা যাদের ‘জেনারেশন জেড’ (Genaration Z)  বলছি, এই জেনারেশনের ছাত্ররা বুয়েটে পড়াশোনা করে। একুশ শতক হচ্ছে ‘জেনারেশন জেড’-এর জেনারেশন। এই জেনারেশনই আমাদের আশা-ভরসা। আমাদের পথ দেখাবে। বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে উন্নত বিশ্বর কাতারে। এই অস্ট্রিন (যুক্তরাষ্ট্র) শহরে আমি যখন বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ারদের ঢাকা থেকে সরাসরি রিক্রুট হতে দেখি, তখন শত হতাশার মাঝেও একটা আশার আলো দেখি। কিন্তু বিশ-ত্রিশ বছর আগের বুয়েট, আজ বদলে গেল কীভাবে? কীভাবে এবং কেন বুয়েটের মেধাবী ছাত্রটি একটি নিরপরাধ সাধারণ একটি ছাত্রকে পিটিয়ে মেরে ফেলে? যারা তাকে পিটিয়ে মারল তাদের একটা রাজনৈতিক পরিচয় আছে। সেই ছাত্রসংগঠনটি এখন প্রশ্নবিদ্ধ। সেই ছাত্রসংগঠনটি এখন ‘আসামির কাঠগড়ায়’। অথচ একসময় এই ছাত্রসংগঠনের একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বের সারিতে ছিল এই ছাত্রসংগঠনটি। মাত্র ৪৮ বছরের মাঝে এই ছাত্রসংগঠনটির অধঃপতন ঘটল কেন? এসব বিষয় নিয়ে আমাদের সিরিয়াসলি ভাবা উচিত। রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে আস্থাহীনতা ও বিদ্বেষ এত বেশি যে, তা তরুণ প্রজন্মকে খুব সহজেই আকৃষ্ট করে। এই তরুণ প্রজন্ম দলের শীর্ষ নেতাদের আস্থা অর্জন করার জন্য তাই এমন অনেক কর্মকাণ্ডে নিজেদের নিয়োজিত করে, যা দলের জন্যও বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য তাই একটি সুস্থধারার রাজনীতি প্রবর্তন করা জরুরি। আর এ উদ্যোগটা নিতে হবে রাজনীতিবিদদেরই। কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী যুবলীগের নেতাকর্মীদের ব্যাপারে একটি শুদ্ধি অভিযানের নির্দেশ দিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন। এখন দরকার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা। চাঁদা দাবিতে অভিযুক্ত হয়ে ইতিমধ্যে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদত্যাগ করেছেন। এখন যা দরকার, তা হচ্ছে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতাদের আমলনামা খতিয়ে দেখা। দরকার তদন্ত করা। শুদ্ধি অভিযানটা খুবই জরুরি। এতে বরং সরকারেরই লাভ বেশি। আবরার হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করল লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। শুধু বুয়েট নয়, কোনো ক্যাম্পাসেই দলীয় ছাত্ররাজনীতি থাকবে না। ছাত্ররাজনীতি থাকতে পারে, কিন্তু তা হতে হবে শুধু ছাত্রদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কিত। ছাত্ররা জাতীয় রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাবে না। জাতীয় রাজনীতির বিষয়টি ছেড়ে দিতে হবে জাতীয় নেতাদের কাছে। কোনো দল কোনো ক্যাম্পাসে তাদের ছাত্রসংগঠনকে স্বীকৃতি দেবে না। জাতীয় দলগুলোর সমর্থক থাকতেই পারে। কিন্তু ক্যাম্পাসে তা প্রকাশ করার কোনো সুযোগ থাকবে না। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে সংসদে আইন পাস করতে হবে। বিশ^বিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে এমন একটি আইনপ্রণয়ন করা জরুরি, যেখানে দলীয় ছাত্র ও শিক্ষকরাজনীতিও নিষিদ্ধ থাকবে। বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ডের পর সারা দেশে যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে, তা যেকোনো বিবেচনায় আমাদের একটি পজিটিভ বার্তা দেয়। বুয়েট কর্তৃপক্ষ সেখানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে। নিষিদ্ধ হয়েছে শিক্ষকরাজনীতিও। প্রধানমন্ত্রী তো জানিয়ে দিয়েছেন যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেদের আইন বলে সেখানে তথাকথিত ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারে। বুয়েটে এ ধরনের আইন ছিল। কিন্তু অতীতের কোনো উপাচার্যই ওই আইনটি বাস্তবায়ন করতে পারেননি ছাত্রনেতাদের চাপে। এখন সম্ভব হলো, তাও প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের পর। এখন অন্যান্য বিশ^বিদ্যালয়ও বুয়েটকে অনুসরণ করতে পারে।
আবরার হত্যাকাণ্ড আমাদের ছাত্ররাজনীতির জন্য একটি ‘ক্ষত’ সৃষ্টি করেছে। ছাত্ররাজনীতি আজ এ পর্যায়ে কেন এলো, তা ভেবে দেখা দরকার। সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের বেপরোয়া মনোভাব আবারও ধরা পড়ল যখন বুয়েটের ঘটনার পর ছাত্রলীগের ছেলেরা জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদকারী ছাত্রদের ওপর হামলা  চালায়। এটা ভালো নয় এবং এতে করে ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা যাবে না। ছাত্রলীগের এই বেপরোয়া মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‌্যাগ কিংবা মিছিল-মিটিংয়ে যোগ দিতে ছাত্রলীগের ছেলেরা সাধারণ ছাত্রদের বাধ্য করে। সাধারণ ছাত্রদের কোনো উপায় থাকে না। হলে থাকার স্বার্থেই তারা বাধ্য হয় মিটিং-মিছিলে যোগ দিতে। কিন্তু এতে করে ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা বাড়ানো যাবে না। সাধারণ ছাত্রদের স্বার্থে কাজ করলেই জনপ্রিয়তা পাওয়া যাবে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এ ব্যাপারে একটি কঠোর নির্দেশনা দিতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রয়োজনে কিছু নির্দেশনা দিতে পারে। ছাত্রনেতারা টেন্ডারবাজি প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। খোঁজ নিলে জানা যাবে, সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের সিনিয়র নেতারা এই টেন্ডারবাজি করে ছাত্র অবস্থাতেই গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছে। এ ব্যাপারে শীর্ষপর্যায় থেকে কঠোর নির্দেশনা থাকা উচিত।
আবরার হত্যাকাণ্ডে আমি ব্যথিত। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি ক্ষমাপ্রার্থী আমার বুয়েটের সহকর্মীরা আবরারকে বাঁচাতে পারেননি। এতে ছাত্রদের যে ক্ষোভ ও দুঃখ, তাতে কোনো অন্যায় আমি দেখি না। তবে বুয়েটের একটা সম্মান আছে, মর্যাদা আছে। দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি অপরাজনীতির কারণে তার ভাবমূর্তি আরও নষ্ট হোক আমরা তা কেউই চাইব না। আবরার তার নিজের জীবন দিয়ে আমাদের ‘জাগিয়ে’ গেল। আমরা এত দিন ‘ঘুমিয়ে’ ছিলাম। আমরা জেগে উঠতে শুরু করছি। তরুণ প্রজন্ম আমাদের অহংকার। আমাদের আশা-ভরসার জায়গা। তরুণ প্রজন্ম ইয়াবায় আসক্ত হবে, টেন্ডারবাজি করবে, খুনি-মস্তানবাহিনী তৈরি করবে এটা কোনো সুস্থধারার লক্ষণ না। বুয়েটের ছাত্ররা শেষ পর্যন্ত তাদের পাঁচ দফা দাবি দিয়েছে এবং বুয়েট কর্তৃপক্ষ তা মেনেও নিয়েছে। ছাত্ররা ভর্তি পরীক্ষা শুরু করার ব্যাপারে তাদের সম্মতি দিয়েছে। সরকার ও বুয়েট কর্তৃপক্ষের জন্যও সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে। খুনিরা ছাত্র হতে পারে; কিন্তু এই খুনিদের কোনো ‘চরিত্র’ থাকে না। এদের আজীবনের জন্য বুয়েট থেকে বহিষ্কার করা হোক। সাময়িক বহিষ্কার আন্দোলনরত ছাত্রদের আস্থায় নেওয়া যাবে না। আরও একটা কথা খুনিদের রাজনৈতিক চরিত্র যাই থাকুক না কেন, এই ঘটনা যেন ‘দ্বিতীয় আরেকটি বিশ্বজিৎ’-এর ঘটনার জন্ম না দেয়। বিশ্বজিতের ঘটনায় খুনিদের চিহ্নিত ও ভিডিও ফুটেজ থাকা সত্ত্বেও খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি। এখন আবরার হত্যাকাণ্ডের বিচার যেন আরেকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে না পারে। আমি খুশি হব যদি এই মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়। একাধিক মন্ত্রী আবরার হত্যাকাণ্ডের খুনিদের বিচার চেয়েছেন। আমরা দেখতে চাই এর বাস্তব প্রতিফলন। জনৈক ছোট মন্ত্রী আবরার হত্যাকাণ্ডে জড়িত একজন খুনিকে প্রথমদিকে গ্রেপ্তার না হওয়ায় যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তার মাঝে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খুঁজে পেয়েছিলেন! এ ধরনের বক্তব্য সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্টের বিরোধী। মন্ত্রীদের সতর্ক হয়ে বক্তব্য দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও যখন সুস্থধারার রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে হয়, তখন এর চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। রাজনীতির নামই তো জনকল্যাণ; কিন্তু যে রাজনীতি ‘খুনি’ তৈরি করে, খুনিদের সমর্থন করে, সে রাজনীতি জনকল্যাণের রাজনীতি হতে পারে না। আবরারের হত্যাকাণ্ড আমাদের রাজনীতিবিদদের যদি কিছু ‘শেখায়’, আমাদের প্রাপ্তিটা সেখানেই।
Daily Desh Rupantor
15.10.2019

0 comments:

Post a Comment