রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও আমাদের পররাষ্ট্রনীতি



প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর শেষ হয়েছে। গেল শনিবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার বৈঠক হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তিনটি প্রকল্পেরও উদ্বোধন করা হয়েছে। তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রীর এটা ছিল প্রথম সফর। এর আগে ২০১৭ সালে তিনি ভারত সফর করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেকগুলো। প্রথমত, তিস্তার পানিবণ্টনের ব্যাপারে ভারত সরকারের একটি ঘোষণা। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের একটি কার্যকর ভূমিকা। তৃতীয়ত, আসামের এনআরসি প্রশ্নে ভারত সরকারের সুস্পষ্ট ঘোষণা। এ ক্ষেত্রে কতটুকু অগ্রগতি হলো? তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে কোনো চুক্তি হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, ‘তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে ২০১১ সালে দুই দেশের সরকার যে অন্তর্বর্তী চুক্তির কাঠামোয় একমত হয়েছিল কবে তা বাস্তবায়ন হবে, বাংলাদেশের জনগণ অধীর আগ্রহে সেই অপেক্ষায় আছে’ (বিবিসি বাংলা)। যৌথ বিবৃতিতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ভারত সরকার তিস্তায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে নিরন্তর কাজ করে চলেছে, যাতে দ্রুত সম্ভব একটি তিস্তাচুক্তি করা যায় (ওই)। এর আগেও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একই ধরনের আশ্বাস দিয়েছিল। এটা অনেকেই তখন জানেন যে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণেই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হচ্ছে না। তবে এবারের সফরে ৬টি অভিন্ন নদীর (মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতি, ধরলা, দুধকুমার) পানি কীভাবে ভাগাভাগি করা যায়, তার একটি খসড়া কাঠামো প্রস্তুত করতে যৌথ নদী কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ফেনী নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি ত্রিপুরার সাবরুম শহরে সরবরাহ করতে রাজি হয়েছে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের দ্রুত ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পথ প্রশস্ত করতে যে অধিকতর প্রয়াস দরকার, দুই দেশ এ ব্যাপারে একমত হয়েছে। বলা ভালো, জাতিসংঘে সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে যে ভোটাভুটি হয়েছে তাতে ভারত বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেয়নি। এনআরসি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় উৎকণ্ঠার কারণ। সম্প্রতি নিউইয়র্কে হাসিনা-মোদি সাক্ষাতের পর বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় বলা হয়েছিল যে, এনআরসি প্রশ্নে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেইÑ এমনটাই মোদি শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু যৌথ বিবৃতিতে এনআরসি (আসামের নাগরিকপঞ্জি) সম্পর্কে কোনো কথা বলা হয়নি। ভারতীয় কর্মকর্তাদের বক্তব্য, এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। যৌথ বিবৃতিতে অভ্যন্তরীণ বিষয় স্থান পেতে পারে না। এক যুক্তিতে এটা ঠিক। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মাঝে একটা উৎকণ্ঠা কাজ করেÑ তা হচ্ছে আসামের যে ১০ লাখ মুসলমান নাগরিক তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন (যাদের অভিহিত করা হয়েছে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী হিসেবে), তাদের আসাম রাজ্য সরকার বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করতে পারে! যদিও এটা হয়তো এই মুহূর্তে হবে না তবে তাদের অনেককে তথাকথিত ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া এবং অত্যন্ত ক্ষমতাধর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বারবার হুমকি, এ ধরনের একটি সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে যে, ভবিষ্যতে এই ১০ লাখ মুসলমান এক ধরনের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, এনআরসি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে আলোচনায় তিনি সন্তুষ্ট (নিউজ এইট, বাংলা)। নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। প্রধানমন্ত্রী মোদি জানিয়েছেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আজ অন্যমাত্রা পেল।’ তিনি বলেছেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বন্ধুত্বের অন্যতম উদাহরণ বিশ্বের কাছে’।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ও চীনের সম্পর্ক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে অনেকেই কৌতূহল প্রকাশ করেছেন। ভারত সফরের আগে প্রধানমন্ত্রী চীনে গিয়েছিলেন (জুলাই ২০১৯)। এটা নিয়ে কোনো কোনো ভারতীয় বিশ্লেষক একটি নেতিবাচক দৃষ্টি দিয়ে ওই সফরকে দেখেছিলেন। বাংলাদেশ বেশি মাত্রায় চীনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে, এমন মন্তব্যও ছিল কারও কারও। বাংলাদেশ চীন থেকে দুটি সাবমেরিন কিনেছিল, এটা নিয়েও ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কাউকে কাউকে উষ্মা প্রকাশ করতে দেখেছি। তবে একজন বিশ্লেষক সি উদয় ভাস্কর ( C. Uday Bhaskar) একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে তা দেখেছেন। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে তিনি লিখেছেন,  " India should not make Bangladesh pick sides between it and China " ( 2 October 2019 )। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। ভারতের এমন কোনো কিছু করা ঠিক হবে না, যা বাংলাদেশকে চীনের দিকে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য চীনের পাশাপাশি ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন রয়েছে। তবে কিছু সমস্যা তো আছেই। বাংলাদেশ চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ মহাপরিকল্পনায় যোগ দিয়েছে। কিন্তু ভারত দেয়নি। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় তিনি চীনা প্রধানমন্ত্রী লিকে ছিয়াংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বিসিআইএমের অবকাঠামো খাত নির্মাণের আহ্বান জানালেও এতে ভারতের ‘ভূমিকা’ নিয়ে একটা প্রশ্ন আছেই। ভারত না চাইলে সিপিআইএম করিডরের ধারণা শুধু ধারণা পর্যায়েই থেকে যাবে।
চীনের আংশিক সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রকল্প এখন বাংলাদেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে বা হবে। এ ক্ষেত্রে চীনা ঋণের শর্ত কী, সুদের হার কী, আমরা তা জানি না। সাম্প্রতিককালে ‘চীনা ঋণ’ নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ঋণগ্রহীতা দেশগুলো এক ধরনের ‘চীনা ঋণফাঁদ’-এ পড়েছে এ ধরনের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে (শ্রীলংকা, কেনিয়া, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া)। তবে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি নিজে একজন অর্থনীতিবিদও বটে, তিনি আমাদের জানিয়েছেন, দেশের স্বার্থ রক্ষা করেই চীনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হবে। তিনি আরও জানিয়েছিলেন, ‘আমরা যাতে চীনের ঋণের ফাঁদে না পড়ি, সে বিষয়ে সতর্ক রয়েছি (জাগোনিউজ, ২৮ জুন)। বলা হচ্ছে বাংলাদেশ যে চীনা ঋণ পাচ্ছে (৩১ বিলিয়ন ডলার), তা পাকিস্তানের সিপিইসির ( CPEC ) পর (৬০ বিলিয়ন ডলার) দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ (টাইমস অব ইন্ডিয়া, ৫ জুলাই)। সুতরাং চীনা ঋণ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই। তবে প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, চীনের প্রতি তিনি ঋণচুক্তির শর্তাবলি সহজ করার এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে সঠিক সময়ে তহবিল ছাড়ের আহ্বান জানিয়েছেন। চীন এই আহ্বানে কতটুকু ছাড় দিয়েছে, সে বিষয়ে অবশ্য আমরা তেমন কিছু জানি না। উন্নয়নকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়েছি। এজন্য আমাদের বৈদেশিক ঋণ প্রয়োজন। বাংলাদেশ ওবিওআরে যোগ দিয়েছে। এর ফলে চীনের ঋণ পাওয়া আমাদের জন্য সহজ। কিন্তু আমরা যেন শ্রীলংকার হামবানতোতা সমুদ্রবন্দরের অভিজ্ঞতার কথা ভুলে না যাই। মালয়েশিয়ার কথাও যেন আমাদের মনে থাকে। তবে চীনা ঋণ আমাদের প্রয়োজন আছে। চীন অবকাঠামো খাতে ঋণ দিয়ে থাকে। ওই ঋণ আমাদের প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আমরা ভারতীয় ঋণও গ্রহণ করছি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমবার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ সফর করেছিলেন ২০১৫ সালের ২৭ মে। এর পর প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যান ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। ভারতের ঋণে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। চীনের মতো ভারতের জন্যও বিশেষ ইপিজেড তৈরি করা হয়েছে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সেখানে বিনিয়োগ করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে দুদেশের সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে তা স্বীকারও করেছেন। ৪০ বছরের ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। এটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসরত ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ‘তাদের ইচ্ছায়’ ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী ভারতে প্রবেশ করে নাশকতামূলক কর্মকা- পরিচালনা করত। এখন তার অবসান হয়েছে। আমরা ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছি। আরও বিদ্যুৎ পাওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে। বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যে এখন ভারতের পণ্য যাচ্ছে। তবে দুদেশের মধ্যে সমস্যা যে নেই, তা নয়। যেমন তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি এখনো হয়নি শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে। টিপাইমুখ বাঁধ ও আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়েও কথা আছে। বাংলাদেশ ভারতে তার বাণিজ্য রপ্তানি বাড়াতে পারছে না শুধু ট্যারিফ আর প্যারা ট্যারিফের কারণে। সীমান্ত হত্যা আজও বন্ধ হয়নি। গঙ্গা পানিচুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। তখন জনসংখ্যা ও পানির চাহিদা বাড়বে ৩ গুণ। সুতরাং পানিবণ্টনের বিষয়টি নিয়ে যৌথ নদী কমিশনের আলোচনা শুরু করাটা জরুরি। ভারতে পানি সংকট রয়েছে। এখন আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প যদি বাস্তবায়িত হয়, তা হলে বাংলাদেশে পানি সংকট দেখা দেবে।
দক্ষিণ এশিয়া বড় ধরনের পানি সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে কীভাবে পানি সমস্যার সমাধান করা যায়। বিশেষ করে হিমালয় অঞ্চলে ‘রিজার্ভিয়ার’ নির্মাণ করে পানি ধরে রাখা ও শুষ্ক মৌসুমে তা ছেড়ে দেওয়াÑ এ ব্যাপারে ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া দরকার। নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় আমরা নতুন একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা শুনেছিলাম (বিপিআইএন)। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার একটি ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে জ্বালানি ও পানি সমস্যার সমাধানে এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। ভুটান ও নেপালে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পানি সংরক্ষণের একটি বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এ অঞ্চলের উন্নয়নে এই সম্ভাবনাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। তবে এ ক্ষেত্রে ভারতকে উদার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা বাংলাদেশ যদি নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করে তা হলে তা ভারতের সীমানার ওপর দিয়ে আসতে হবে। এতে করে ভারতের সম্মতির প্রয়োজন।
আমরা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপর আস্থা রাখতে চাই। তিনি যখন বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আজ অন্যমাত্রা পেল’, তখন এই আস্থার জায়গাটা আরও বেড়ে যায়। এখন দেখার পালা এই আস্থার জায়গাটা কতটুকু পূরণ হয়।
Daily Amader Somoy
08.10.2019

0 comments:

Post a Comment