রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

তিনটি সংবাদ এবং অনেক প্রশ্ন

সংবাদ তিনটি, কিন্তু প্রশ্ন অনেক। তিনটি সংবাদই এখন মিডিয়ায় আলোচিত। আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে এই সংবাদগুলোকে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছে নানা ‘বিতর্কের’। প্রথম সংবাদ আলোচিত সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেননের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। দ্বিতীয় সংবাদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমানের একটি বক্তব্য। তৃতীয় সংবাদ সংরক্ষিত আসনের একজন মহিলা সংসদ সদস্য তামান্না নুসরাত বুবলীর একটি কর্মকাণ্ড। তিনটি সংবাদই ঘুরেফিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বড় ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
রাশেদ খান মেনন সম্প্রতি বরিশালে পার্টির এক সভায় বলেছেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, গেল নির্বাচনে (২০১৮) জনগণ ভোট দিতে পারেনি। এমনকি পরবর্তী সময়ে উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও ভোট দিতে পারেনি দেশের মানুষ।’ একটি সহজ-সরল স্বীকারোক্তি। তাঁর এই বক্তব্য অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দেশব্যাপী ক্যাসিনোবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে এবং জনাব মেননের নাম যখন এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, তখনই কি তিনি এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন? নির্বাচন তো হয়েছে প্রায় ১০ মাস আগে, তাহলে এত দিন পর কেন তিনি এ কথা বললেন? কেন তিনি জানুয়ারি মাসে, নির্বাচনের পরপরই এ কথা বললেন না? ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও একটি ‘বিতর্ক’ আছে, যেখানে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। জনাব মেনন ওই নির্বাচনেও ‘বিজয়ী’ হয়েছিলেন এবং মন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু ওই নির্বাচন নিয়ে তিনি কোনো কথা বা মন্তব্য করেছেন বলে শোনা যায় না। তাহলে কি এবার মন্ত্রী হতে না পারার ‘বেদনা’ থেকেই তিনি এ ধরনের কথা বলেছেন? জনাব মেনন প্রতি মাসে ‘ক্যাসিনো কিং’ সম্রাটের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা ‘সম্মানী’ নিতেন। এটি স্বয়ং সম্রাটের স্বীকারোক্তি। এর পেছনে আদৌ কি সত্যতা আছে, নাকি সম্রাট নিজেকে বাঁচানোর জন্যই এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন? নির্বাচনে জনগণ তাঁকে ভোট দেয়নি—এ ধরনের বক্তব্যের পর তাঁর সংসদ সদস্য হিসেবে থাকা কতটুকু নৈতিকতার মধ্যে পড়ে? তাঁর জন্য এই মুহূর্তে পদত্যাগ করাই কি শ্রেয় নয়?
জনাব মেননের আরো একটি বক্তব্য এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়।
তিনি বলেছেন, এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৯ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। এই বক্তব্য অত্যন্ত সেনসেটিভ। এনবিআরের উচিত, এ ব্যাপারে তাঁর কাছ থেকে তথ্য চাওয়া। জনাব মেনন সিনিয়র রাজনীতিবিদ। আমরা ধরে নেব তিনি যা বলেন, নিশ্চয়ই তার পেছনে সত্যতা আছে। নিশ্চয়ই তিনি কোনো ‘ফালতু’ কথা বলবেন না। কিন্তু সরকারি ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম অংশীদার হিসেবে তিনি যখন এ ধরনের কথাবার্তা বলেন তখন সরকারকে যে একটি বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেবে, তা বলাই বাহুল্য।
এমনই পরিস্থিতিতে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান। বলেছেন, তাঁকে যুবলীগের সভাপতি করা হলে তিনি উপাচার্য পদটি ছেড়ে দেবেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি নিয়ে ঝড় বইছে। সমালোচনার পাল্লাটি যেন একটু বেশিই। তাঁর এই মন্তব্যের অনেক দিক আছে। এক. তিনি একটি রাজনৈতিক পদ চান এবং যুবলীগের মধ্যে সংকট চলছে, তা থেকে তিনি সংগঠনটিকে বের করে আনতে চান। আমি এতে অবাক হইনি। কেননা উপাচার্য হওয়ার পরও তিনি যুবলীগের প্রেসিডিয়ামের ১ নম্বর সদস্য। তিনি সেখান থেকে পদত্যাগ করেননি।
সর্বশেষ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি কুমিল্লা উত্তর থেকে কাউন্সিলর হয়েছিলেন। কাউন্সিলরের ট্যাগ লাগানো ছবি তিনি নিজের ফেসবুকে ‘আপলোড’ করেছিলেন। সুতরাং একজন ‘রাজনৈতিক ব্যক্তি’ একটি সংগঠনের দায়িত্ব নেবেন—তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে প্রশ্নটি নৈতিকতার। তিনি উপাচার্য হয়ে সরাসরি দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারেন কি না? এটি ঠিক, রাজনৈতিক বিবেচনায় ও দলীয় আনুগত্যের প্রতি যাঁরা ‘কমিটেড’ তাঁরাই উপাচার্য হন। এবং হয়ে আসছেন। তখন আর সিনিয়রিটি মানা হয় না। অনেকে উপাচার্য হয়েছেন, যাঁরা অধ্যাপক হিসেবে ‘সিলেকশন গ্রেড’ও পাননি। এবং কোনো কোনো উপাচার্য আবার একই সঙ্গে ‘এনজিও ব্যবসা’ও করেন। বিদেশ থেকে টাকা এনে এনজিও চালান আবার সপ্তাহে দুই দিনের জন্য উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। এ ক্ষেত্রে অধ্যাপক মীজানের দোষ কোথায়! তবে তিনি যদি প্রেসিডিয়ামের পদ থেকে পদত্যাগ করতেন, তাহলে ভালো করতেন।
দুই. রাজনীতিতে ‘মেরিওটোক্রেসি (Meriotocracy) দরকার। তিনি যুবলীগের চেয়ারম্যান হলে বরং ভালোই হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে চিনি। তিনি যোগ্য ব্যক্তি নিঃসন্দেহ। তবে যেহেতু এই মুহূর্তে বিতর্ক উঠেছে, সেহেতু তিনি উপাচার্য হিসেবে পদত্যাগ করে পূর্ণকালীন রাজনীতিতে নিজেকে জড়িত করুন। এতে উপাচার্য পদের সম্মান বাড়বে। সম্প্রতি ১৪ জন উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে ইউজিসি, যদিও তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়টি এই তালিকায় নেই। তবে অতীতেও তিনি সমালোচিত হয়েছেন তাঁর বক্তব্যের জন্য। অভিযোগ আছে, ২০১৬ সালে তিনি আইন-কানুন ভেঙে ছাত্রলীগের ১২ জন নেতাকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তখন প্রশ্ন উঠলে তিনি জানিয়েছিলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্র বা চাকরিপ্রার্থী বলতে কিছু নেই। এখানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই চাকরি পাবেন। এটা তাঁদের বিশেষ যোগ্যতা (উদ্ধৃতি : প্রথম আলো, ১৯ অক্টোবর ২০১৯)। তিন বছর আগের কথা। তখন সংবাদটি পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। তিনি এর একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। বহুদিন আমি তাঁর সঙ্গে টক শো করেছি। আমাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন। কোনো দিন অশ্রদ্ধা নিয়ে আমার বক্তব্যের সমালোচনা তিনি করেননি। তবে তাঁর মধ্যে এক ধরনের সরলতা কাজ করে, তিনি স্ট্রেইট কথা বলতে পছন্দ করেন। রাজনীতিবিদরা যেভাবে ‘ম্যাকিয়াভেলিয়ান’ সুরে কথা বলেন, তিনি সেভাবে বলেন না। তিনি সোজাসাপ্টা কথা বলতে পছন্দ করেন। তাঁর মধ্যে রাজনীতি করার একটা ‘ইচ্ছা’ আছে। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে যোগ দেওয়া—এর বড় প্রমাণ। আমি প্রত্যাশা করব, তিনি ২০২৩ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নিজেকে তৈরি করবেন। জবির উপাচার্য হিসেবে তাঁর দ্বিতীয় টার্ম শেষ হবে ২০২১ সালে। এরপর তিনি যদি নিজেকে রাজনীতিতে জড়ান, তিনি ভালো করবেন। রাজনীতিতে শিক্ষিত লোকের বড় অভাব। একুশ শতক হচ্ছে ‘মেরিওটোক্রেসির’ অথবা মেধাবীদের যুগ। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে মেধাসম্পন্ন রাজনীতিবিদদের খুব দরকার, যাঁরা বাংলাদেশকে একুশ শতকে নেতৃত্ব দেবেন। মেধাবী রাজনীতিবিদ না হলে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারবে না। আমার বিবেচনায় যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার চেয়ে তাঁর জন্য মঙ্গল কুমিল্লা উত্তর থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়া।
মেধাসম্পন্ন রাজনীতিবিদদের কথা যখন বলছি তখন সংসদ সদস্য তামান্না নুসরাত বুবলীর কথাও বলতে হয়। তিনি এখন ব্যাপকভাবে সমালোচিত। এর কারণও আছে। তিনি শুধু এইচএসসি পাস। শখ হয়েছে বিএ পাস করার। এটি কোনো অন্যায় নয়। পড়াশোনার জন্য বয়স কোনো ফ্যাক্টর নয়। তিনি হতে পারেন একজন সংসদ সদস্য। কিন্তু উচ্চশিক্ষা নিতে তো কোনো বাধা নেই। কিন্তু এটি নিতে গিয়ে তিনি অসৎ পন্থা অবলম্বন করলেন। আটজন ছাত্রী তাঁর হয়ে প্রায় সব পরীক্ষা দিল। একজন সংসদ সদস্যের হয়ে যারা পরীক্ষা দিল, তাদের চ্যালেঞ্জ করার সাহস কার? যাঁরা পরীক্ষাকেন্দ্রে পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁরা দায়িত্বে অবহেলা করেছেন। এখন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবে?
আমার দুঃখ লাগে এখানে যে আমরা কাদের সংসদে পাঠাচ্ছি? যিনি আইন প্রণেতা, তিনি যদি এ ধরনের কাজ করেন, তাহলে আমাদের আস্থার জায়গাটি আর থাকে কোথায়? তিনি অপরাধ করেছেন। শুধু তা-ই নয়, জাতীয় সংসদকেও তিনি এক অর্থে অপমান করেছেন। যদিও তিনি তখন বলার চেষ্টা করেছেন, ‘কোথাও যেন একটা ষড়যন্ত্র’ হয়েছে! এটি ষড়যন্ত্র? নিজে পরীক্ষার্থী, পরীক্ষা দিলেন আরেকজন—তিনি এটি জানেন না, এটি কি হয়? আমি জানি না, জাতীয় সংসদ তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে কি না? একটি ‘ব্যবস্থা’ নেওয়া প্রয়োজন এ কারণে যে এ ধরনের অন্যায়, জালিয়াতি দ্বিতীয়বার যেন আর না হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যায় আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছেন। তিনি কাউকে ছাড় দিচ্ছেন না। নিজের দলীয় কর্মী ও নেতাদের বিরুদ্ধে তিনি শক্ত অবস্থানে গেছেন। কাউকে তিনি দলীয় পরিচয়ের কারণে এতটুকুও ছাড় দিচ্ছেন না। এখন একজন বুবলী যিনি দলকে অসম্মানিত করলেন, তাঁর কী হবে? উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে। কিন্তু একজন শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি, এই বহিষ্কারই যথেষ্ট নয়। এরই মধ্যে আরেকজন সাবেক সংসদ সদস্যকে দেখলাম, তিনি টিভিতে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, হাতে তাঁর সিগারেট। প্রকাশ্যে ধূমপান যে দণ্ডনীয় অপরাধ, এটি কি ওই সাবেক সংসদ সদস্য জানেন না? তিনি তো আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। একসময় ছোট মন্ত্রী ছিলেন। তিনি হাতে সিগারেট নিয়ে ও ধূমপান করা অবস্থায় সাক্ষাৎকার দেবেন, এটি কি প্রত্যাশিত? আওয়ামী লীগ তো তরুণ নেতৃত্ব তৈরি করছে। তরুণ প্রজন্ম এই নেতাদের দেখে কী শিখবে? এটি কি নিছক একটি ভুল, নাকি আইনকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করার শামিল?
জনাব মেনন, অধ্যাপক মীজান কিংবা সংসদ সদস্য বুবলী আমাদের আশার জায়গা। কিন্তু তাঁদের কর্মকাণ্ড আমাদের কী মেসেজ দিচ্ছে? আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো মেসেজ যে আমরা পাচ্ছি না, তা বলাই বাহুল্য।
Daily Kalerkontho

29.10.2019



0 comments:

Post a Comment