রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

ব্রেক্সিট-পরবর্তী ইউরোপের রাজনীতি





শেষ পর্যন্ত যা হওয়ার, তাই হয়েছে। যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেল। ৩১ জানুয়ারি তারিখটি নির্ধারিত ছিল। আর সে মোতাবেক যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের। শেষ মুহূর্তে এসেও দু-দুটো অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। প্রথমটি ছিল গেল ২৪ জানুয়ারি (২০২০), যখন ইউরোপিয়ান কমিশন ও ইউরোপিয়ান কাউন্সিল প্রধানরা ব্রেক্সিট চুক্তিতে চূড়ান্ত স্বাক্ষর করেন। এর আগের দিন এক ভোটাভুটিতে ইইউ পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা এই চুক্তিতে সায় দেন। এরপর ২৯ জানুয়ারি সর্বশেষ ধাপ সম্পন্ন হয় ইইউ পার্লামেন্টের সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তিকে অনুমোদন দেন। ফলে সমাপ্তি ঘটল ৪৭ বছরের সম্পর্কের। যুক্তরাজ্য এখন এক বছর সময় পাবে ইইউর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করার।

‘ব্রিটিশ এক্সিট’ নামটিকে সংক্ষেপ করেই ডাকা হয় ব্রেক্সিট নামে। এটা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া। তবে এই কাজটি অত সহজ ছিল না। নানা প্রশ্ন ও নানা প্রক্রিয়া মধ্য দিয়ে ‘ব্রেক্সিট’ প্রক্রিয়াটি এগিয়ে গেছে। ২০১৬ সালের ২৩ জুন ব্রিটেনে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেদিন ব্রিটেনের নাগরিকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যুক্তরাজ্যের কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে থাকা উচিত, নাকি থাকা উচিত নয়? সেদিন ৫২ শতাংশ ভোট পড়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে আর থাকার পক্ষে ভোট পড়েছিল ৪৮ শতাংশ। এরপর ঘটতে থাকে নাটকীয় সব ঘটনা। ২০১০ সাল থেকে ছয় বছর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ডেভিড ক্যামেরন। তিনি চেয়েছিলেন যুক্তরাজ্য যেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে থেকে যায়। কিন্তু গণভোটে তিনি হেরে গেলে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন টেরিজা মে। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই (২০১৭) তিনি বলে আসছিলেন, তার সময়েই ‘ব্রেক্সিট’ সম্পন্ন হবে। কিন্তু কাজটি তার জন্য সহজ ছিল না। ব্রিটেনের সঙ্গে ইইউর একটি চুক্তির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার প্রস্তাবিত ব্রেক্সিট চুক্তিটি যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে প্রত্যাখ্যান হলে ২০১৭ সালের জুন মাসে আগাম সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন তিনি। কিন্তু ভোটে কনজারভেটিভরা পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। পর টেরিজা মে পদত্যাগ করলে (২০১৯) প্রধানমন্ত্রী হন বরিস জনসন। জনসনের আনা ব্রেক্সিট প্রস্তাবও কয়েক দফা প্রত্যাখ্যান হয় ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। এমতাবস্থায় গেল বছরের শেষে সেখানে আবার নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন বরিস জনসন ও তার কনজারভেটিভ পার্টি।

এখন ব্রেক্সিট চুক্তি কার্যকর হলেও অনেক প্রশ্ন রয়েছে, যা আগামী দিনের ব্রিটেন তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে যে ‘ডিভোর্স’ বা ‘প্রত্যাহার’ চুক্তি হয়েছে, তাতে ব্রিটেনকে ইইউকে দিতে হবে ৩৯ মিলিয়ন ডলার। ব্রিটেনে ইইউভুক্ত দেশগুলোর যেসব নাগরিক রয়েছেন, এখন তাদের কী হবে? নর্দান আয়ারল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড রিপাবলিকের মাঝামাঝি ইইউ এবং ব্রিটেনের সীমানা এখন কীভাবে নির্ধারিত হবে? যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত স্কটল্যান্ড কি যুক্তরাজ্য ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদাভাবে ইইউতে যোগ দেবে? আইরিশ সীমান্তে এখন কী হবে, এটা একটা বড় চিন্তার কারণ। ব্রিটেনের সঙ্গে ইইউর যে চুক্তি হয়েছে, তাতে ‘ব্যাকস্টপ’ নামে একটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ব্রেক্সিট সমঝোতায় যাই আসুক না কেন, আয়ারল্যান্ড দ্বীপে একটি মুক্ত সীমান্ত রাখার সর্বশেষ চেষ্টা বোঝাতে ‘ব্যাকস্টপ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এটা হলো এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে যুক্তরাজ্যের অন্যান্য অংশ ছাড়া শুধু নর্দান আয়ারল্যান্ডে খাদ্যদ্রব্যসহ বেশ কিছু বিষয়ে ইইউর নিয়ম বলবৎ থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন তুলেছেন অনেক এমপি। তাদের যুক্তি, ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলেও তার অংশ উত্তর আয়ারল্যান্ড ইইউর আইনের কাঠামোর মধ্যেই থেকে যাচ্ছে, এটা হতে পারে না। আবার অনেকে ইইউর কাছাকাছি বা ভেতরেও থাকতে চাইছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, নর্দান আয়ারল্যান্ডকে যুক্তরাজ্য-অন্যান্য অংশ থেকে ভিন্নভাবে দেখা উচিত নয়। একটা সম্ভাবনা জন্ম হয়েছে যে, স্কটল্যান্ডও এখন যুক্তরাজ্য-ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড (১৭০৭) আর উত্তর আয়ারল্যান্ড (১৮০১) নিয়ে যুক্তরাজ্য গঠিত। স্কটল্যান্ডে ব্রিটেনের গণভোটের প্রভাব পড়েছে। সেখানে স্বাধীনতার চেতনা শক্তিশালী হচ্ছে। ব্রিটেনের ২০১৬ সালের গণভোট আর ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত স্কটিশ আর আইরিশ কট্টরপন্থিদের উৎসাহিত করেনি। তারা ব্রিটেনের সঙ্গে সুর মেলায়নি। স্কটিশরা এখন ইইউতে ব্রিটেনের জায়গাটিকে নিতে চায়। একবার ব্রিটেন বেরিয়ে গেলে স্কটল্যান্ড ইইউর সদস্যপদের জন্য আবেদনও করতে পারে।

১৯৯৩ সালে বর্তমানে ইইউ বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নামে পরিচিত সংস্থাটি যাত্রা শুরু করলেও, এটি গড়ে উঠেছিল ১৯৫৭ সালে। মাত্র ছয়টি দেশ নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই দেশগুলো হচ্ছে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও লুক্সেমবার্গ। তখন এর পরিচিতি ছিল ইইসি বা ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাজ্য এই সংস্থায় যোগ দেয়। ধীরে ধীরে এর সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। একসময়ের সাবেক সমাজতান্ত্রিক পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোও ইইউতে যোগ দেয়। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে আইসল্যান্ড, নরওয়ে ও মনটেনেগরো ইইউর সদস্য হয়। গত ৬৩ বছরের ইতিহাসে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ঘটনা। তবে ইইউর অনেক সাফল্যও আছে। গত ১ জানুয়ারি (২০০২) ইইউর মধ্যে ১২টি দেশ অভিন্ন মুদ্রা ইউরো চালু করে। বর্তমানে ১৫টি দেশে ইউরো চালু রয়েছে। ডেনমার্ক, ব্রিটেন, বুলগেরিয়া, চেক রিপাবলিক, এস্তোনিয়াসহ কয়েকটি দেশ ইউরো মুদ্রা গ্রহণ না করে নিজস্ব মুদ্রা চালু রেখেছিল। আরেকটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হচ্ছে শেঙেন চুক্তি কার্যকর হওয়ার (মার্চ ১৯৯৫) পর থেকে সীমান্ত উঠে গেছে। এর অর্থ হচ্ছে, শেঙেন ভিসা নিয়ে যে কেউ ইইউভুক্ত যেকোনো দেশে যেতে পারবেন এবং এক ভিসায় ইইউভুক্ত প্রতি দেশে যেতে পারবেন (ব্রিটেন বাদে)। এমনকি ইউরোপের এক দেশের নাগরিক অন্য দেশে গিয়ে থাকতে পারবেন এবং চাকরিও করতে পারবেন। একটা সমস্যা ব্রিটেনে তৈরি হয়েছিল। অভিন্ন ইউরোপের (ম্যাগস্ট্রিট চুক্তি অনুযায়ী) ধারণার ফলে শত শত পূর্ব ইউরোপের নাগরিক লন্ডনে এসে বসবাস ও চাকরি করতে শুরু করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে ব্রিটেনের আদি সংস্কৃতিতে ধ্বংস নেমেছিল। বয়স্ক মানুষরা এটা পছন্দ করেননি। তাই তারা ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে গণভোটে রায় দিয়েছিলেন। অন্যান্য ইউরোপের দেশ থেকে তাদের সংস্কৃতি যে আলাদা, তা তারা চেয়েছিলেন। ফলে কনজারভেটিভ পার্টিকে তারা নির্বাচনে বিজয়ীও করেছিলেন। কিন্তু এরপর কী?

ব্রিটেন তো ইইউ থেকে বেরিয়ে গেল। এতে করে কি ইইউ ভেঙে যাবে? ইউরোপের রাজনীতিতে তা কতটুকু প্রভাব ফেলবে? বলার অপেক্ষা রাখে না ইইউ একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকট প্রমাণ করেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের মডেল গ্রিসের রাজনীতি তথা অর্থনীতির জন্য সহায়ক নয়। এরপর সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে ইউরোপে ব্যাপক অভিবাসনের ঘটনা ঘটে। হাজার হাজার মানুষ সিরিয়া ও ইরাক ছেড়ে ইউরোপে পাড়ি জমায়। ইউরোপের পথে-ঘাটে, রেলস্টেশনে হাজার হাজার বিদেশি মানুষের উপস্থিতি ইউরোপের দৃশ্যপটকে বদলে দেয়। ইইউ এসব অভিবাসীকে ইইউভুক্ত বিভিন্ন দেশে পাঠানোর উদ্যোগ নিলে, তা বড় বিতর্কের জন্ম দেয়। অভিবাসনবিরোধী একটা জনমত শক্তিশালী হয়। এই অভিবাসনবিরোধী জনমতকে পুঁজি করেই কট্টর দক্ষিণপন্থিরা ইউরোপে শক্তিশালী হয়। স্থানীয় তথা জাতীয় রাজনীতিতে তারা ভালো ফলাফল করে। জার্মানিতে তারা এখন তৃতীয় বড় দল এবং ভবিষ্যতে তারা শরিক দল হয়ে সরকারও গঠন করতে পারে! এই কট্টর দক্ষিণপন্থিরা এখন ফ্রান্স, পোল্যান্ডে অত্যন্ত শক্তিশালী। হাঙ্গেরিতে তারা সরকারও গঠন করেছে। অনেক রাষ্ট্র এখন (পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, ডেনমার্ক ও সুইডেন) নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও অর্থনীতির সুরক্ষার জন্য আলাদা আইন করার উদ্যোগ নিচ্ছে।

ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা অর্থনৈতিকভাবে ইইউকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেবে। ব্রিটেনের অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়বে। সেখানে বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। অন্যত্র চলে যাবে ব্যবসা। ক্ষতি হবে স্থানীয় অর্থনীতির। ইতিমধ্যে অনেক বড় ব্যাংক ও বীমার সদর দপ্তর লন্ডন থেকে সরিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্টে (জার্মানি) নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্রেক্সিটের ঘটনা আদৌ ব্রিটেনকে বিশ্ব আসরে একটি ‘শক্তি’তে পরিণত করতে পারবে না। এটা সত্য, ব্রিটেনের ভোটাররা প্রথমে গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে ও পরে সাধারণ নির্বাচনে কনজারভেটিভদের বিজয়ী করে নিজেদের আলাদা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু এতে করে তারা খুব লাভবান হবেন কি না সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। বরং ইইউতে থেকেই ব্রিটেন বিশ্ব আসরে বড় ভূমিকা পালন করে আসছিল। এখন তাতে ছন্দপতন ঘটল। কেমন হবে এখন ব্রিটেন, সে প্রশ্নও আছে। ইইউর সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে থাকবে, সেটাও একটা প্রশ্ন। এখন ব্রিটেনকে ইইউভুক্ত প্রতিটি দেশের সঙ্গে আলাদাভাবে বাণিজ্যিক ও নিরাপত্তা-সংক্রান্ত চুক্তি করতে হবে। এ আলোচনা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। যেসব ইইউ নাগরিক বর্তমানে ব্রিটেনে কাজ করেন, তাদের ব্যাপারেও একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। এমনকি যেসব ব্রিটিশ নাগরিক ইইউভুক্ত দেশে কাজ করেন, তাদের ব্যাপারেও একটি চুক্তি করতে হবে।

যুক্তরাজ্য বিশ্বের বড় অর্থনীতিগুলোর একটি। জি-৭-এর সদস্য এবং নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যও যুক্তরাজ্য। দুর্বল যুক্তরাজ্যের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না বিশ্ব আসরে। যুক্তরাজ্যের জিডিপির পরিমাণ ৩.০২৮ ট্রিলিয়ন ডলার (তিন দশমিক শূন্য দুই আট ট্রিলিয়ন ডলার)। এটা ক্রয়ক্ষমতা, অর্থাৎ পিপিপির ভিত্তিতে হিসাব, সাধারণ হিসাবে এর পরিমাণ ২.৯৩৬ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের পঞ্চম। মাথাপিছু আয় সাধারণ হিসাবে ৪৪১৭৭ ডলার (বিশ্বের ১৯তম) পিপিপিতে এর পরিমাণ ৪৫৫৬৫ ডলার (২৫তম)। এই অবস্থান যুক্তরাজ্য ধরে রাখতে পারবে না।

আগামী এক দশকের মধ্যে আরও বেশ কয়েকটি দেশ ইইউ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার ও স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির প্রধান নিকোলা স্টুরিজিওন ও তার দল স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চান। আয়ারল্যান্ডের সিনফেইন পার্টিও স্বাধীনতার ডাক দিয়েছে। অস্ট্রিয়ার ফ্রিডম পার্টির সাবেক সভাপতি রবার্ট হোফারও চান অস্ট্রিয়াকে ইইউ থেকে বের করে আনতে। বেলজিয়ামের ফ্লেমিন ন্যাশনালিস্ট পার্টির প্রধান টম ভ্যান গ্রাইকেন, ডেনমার্কের ড্যানিশ পিপলস পার্টির ক্রিশ্চিয়ান থালেসেন, ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্টের ম্যারিয়েন লি পেন ও অলটারনেটিভ ফর জার্মানির ফ্রক পেট্টি, হাঙ্গেরির ফ্রিডেসজ পার্টির ভিক্টর আরকান, ইতালির ফাইভ স্টার মুভমেন্টের বেপ্পো গিল্মো, হল্যান্ডের ডাচ পার্টির নিয়াট উইন্ডাস তারা সবাই নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখার স্বার্থে ইইউ থেকে বের হয়ে আসতে চান। গ্রিনল্যান্ড অনেক আগে ইইউ থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। এখন যুক্তরাজ্য বেরিয়ে গেল। এ ঘটনা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্যের জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
Desh Rupantor
1.2.2020

সংবাদপত্র ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি


  
unsplash.com

আমাদের সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর গণতান্ত্রিক চরিত্র। সংবিধানের প্রস্তাবনায় সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ শুধু তাই নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসহ বিভিন্ন অনুচ্ছেদে এই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন সংবিধানের প্রথম ভাগেই ১নং অনুচ্ছেদ (সংবিধানের প্রাধান্য), দ্বিতীয় ভাগের ৮নং অনুচ্ছেদ (মূলনীতি), ১০নং অনুচ্ছেদ (সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্তি), ১১নং অনুচ্ছেদ (গণতন্ত্র ও মানবাধিকার), ১৩নং অনুচ্ছেদ (মালিকানার নীতি), ১৫নং অনুচ্ছেদ (মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা), ১৯ অনুচ্ছেদ (সুযোগের সমতা), ২০ অনুচ্ছেদ (অধিকার), ২২ অনুচ্ছেদ (নির্বাহী বিভাগ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ), প্রতিটি ক্ষেত্রে এই গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। এমনকি তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত ২৩টি অনুচ্ছেদ হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কথা বলে। এর মধ্যে রয়েছে চলাফেরাসহ সমাবেশের স্বাধীনতার কথা।
স্বাধীন সংবাদপত্র গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য সহায়ক। যে দেশে স্বাধীন সংবাদপত্র নেই, মিডিয়া স্বাধীন নয়, সেই দেশকে কোনোমতেই গণতান্ত্রিক বলা যাবে না। চীনের প্রয়াত নেতা মাও জে দং একবার বলেছিলেন, ‘শত ফুল ফুটতে দাও।’ সম্ভবত মাও জে দং বিপ্লব-পরবর্তী চীনা সমাজে ‘বিভিন্ন মতের যে সহাবস্থান থাকবে’, সে ধরনের একটি মতামতই দিতে চেয়েছিলেন। যদিও চীনের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে তার ওই মতের ব্যাপারে তেমন খুব একটা ব্যাখ্যা আমি পাইনি। একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এভাবে যে, ‘শত মতের’ মধ্য দিয়ে আসল মতটিই এক সময় বেরিয়ে আসবে। তাই একটি সমাজে যদি অনেক সংবাদপত্র থাকে, তাহলে তা সমাজের জন্য মঙ্গলজনক। সংবাদপত্রে বিভিন্ন মত প্রতিফলিত হতে পারে। সংবাদপত্র সরকারের ভুল-ত্রুটিগুলো তুলে ধরতে পারে। এতে করে সরকারেরই লাভ। একই সঙ্গে ‘বিভিন্ন মত ও পথের’ মধ্য দিয়ে সঠিক মতটি গ্রহণ করে নিতে পারে সমাজ। কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যদি খর্ব হয়, তাহলে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। তাই যারা গণতন্ত্র চর্চা করেন, গণতন্ত্র নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন গণতন্ত্র ও সংবাদপত্র পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। স্বাধীন সংবাদপত্র ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন। আর গণতান্ত্রিক সমাজেই স্বাধীন সংবাদপত্র বিকশিত হয়। যেখানে গণতন্ত্র নেই, সেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও নেই। বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খুবই জরুরি।
বাংলাদেশে আমরা ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধান নিয়ে গর্ব করি। গেল ৪৮ বছরে এই সংবিধানে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মোট ১৭টি সংশোধনী সংবিধানে যুক্ত হয়েছে। উচ্চ আদালতের একটি রায়ের ফলে সংবিধান এখন ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে গেছে। এক সময় সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ২৮ মার্চ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস হয়েছিল- এর উদ্দেশ্য ছিল একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী সময়ে ৭ম, ৮ম ও ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ওইসব নির্বাচন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেলেও এক সময় এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অভিযোগ ওঠে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘অনির্বাচিত ও অগণতান্ত্রিক’। সুতরাং এ ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। এক সময় বিষয়টি উচ্চ আদালতে গেল। উচ্চ আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হলে আবারও সংবিধান সংশোধন করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এখন অতীত।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদটি ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা’ সংক্রান্ত। ৩৯নং অনুচ্ছেদের ১নং ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ এই অনুচ্ছেদের ৩৯(২) ‘ক’ ও ‘খ’ ধারা দুটো আরও স্পষ্ট। ‘ক’তে বলা হয়েছে ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের’ কথা এবং ‘খ’তে রয়েছে, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ অর্থাৎ সংবিধানের ৩৯নং ধারাটি একজন সংবাদকর্মীকে যেমন অধিকার দিয়েছে তার মতপ্রকাশ করার, ঠিক তেমনি একই সঙ্গে রাষ্ট্র সংবাদপত্রকেও অনুমতি দিয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে প্রকাশিত হওয়ার। সংবাদকর্মী তথা সংবাদপত্রের জন্য এ ধারাটি একটি রক্ষাকবচ। তবে এ রক্ষাকবচটি বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে- এমন অভিযোগ আমরা এ দেশের বিজ্ঞ আইনজীবীদের মুখে শুনেছি। তারা উচ্চ আদালতে একাধিকবার বলেছেন, ৩৯ ধারাবলে একজন সংবাদকর্মী তার মতপ্রকাশের অধিকার রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির যখন জন্ম হয়, তখন ওই সময়ের জাতীয় নেতারা উপলব্ধি করেছিলেন, বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে এখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা না গেলে এই দেশটিতে গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। তাই ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তারা সংবিধানে ৩৯নং ধারাটি জুড়ে দিয়েছিলেন। যদিও ৩৯নং ধারার সঙ্গে ৩৬ ও ৩৭নং অনুচ্ছেদ দুটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এবং তা ৩৯নং অনুচ্ছেদের পরিপূরক। ৩৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে চলাফেরার স্বাধীনতার কথা। অর্থাৎ এই ধারা বলে বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিক এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া বা চলাচল করার অধিকার রাখেন। আর ৩৭নং ধারায় বলা হয়েছে সমাবেশের স্বাধীনতার কথা। অর্থাৎ এই অনুচ্ছেদ একজন নাগরিককে জনসভা তথা শোভাযাত্রা করার অনুমতি দিয়েছে। সংবিধানের এই ৩৬, ৩৭ ও ৩৯নং অনুচ্ছেদ যদি একসঙ্গে পড়ি তাহলে দেখব, এখানেই নিহিত রয়েছে গণতন্ত্রের স্পিরিট। অর্থাৎ গণতন্ত্রের বিকাশ ও স্থায়িত্বের বিষয়টি লুকিয়ে আছে এই অনুচ্ছেদগুলোর অন্তরালে। এর একটি যদি লঙ্ঘিত হয়, তাহলে গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা থাকেন, তাদের অনেক কর্মকাণ্ড গণতন্ত্রের এই বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। যদিও অনেকের অভিমত- ১৯৭৫ সালে চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকি সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় ৩৯নং অনুচ্ছেদটি কিছুটা হলেও লঙ্ঘিত হয়েছিল। তবে পরবর্তী সময়ে এ দেশে প্রচুর সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে সোশ্যাল মিডিয়া যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একুশ শতকে এই সোশ্যাল মিডিয়া নতুন এক মাত্রা নিয়ে হাজির হয়েছে। এই সোশ্যাল মিডিয়া ভবিষ্যতে সংবাদপত্রের বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়ে যায় কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশে বর্তমানে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট জাতীয় সংসদে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী এনে আমরা আবার সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে এসেছি। তবে গণতন্ত্রের এই যে ‘দ্বিতীয় যাত্রাপথ’, এই যাত্রাপথে গণতন্ত্রের বিকাশ বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে নির্বাচন হচ্ছে। সেই নির্বাচন নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু গণতন্ত্রের যে মূল স্পিরিট, অর্থাৎ পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস, তাতে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। সংসদ যেখানে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্রবিন্দু, সেখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হতে আমরা দেখি না। নিয়মমাফিক এখানে নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ থাকুক আর না থাকুক, সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে নির্বাচন হয়। নিঃসন্দেহে নির্বাচন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ। সেই সঙ্গে মানবাধিকার আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ। একটি সমাজে যদি মানবাধিকারের প্রশ্নটি নিশ্চিত করা না যায়, যদি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে, তাহলে ওই সমাজকে আমরা গণতান্ত্রিক সমাজ বলতে পারব না। যদি সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম ‘সত্য’ কথা বলতে না পারে, তাহলে সেই সমাজকে গণতান্ত্রিক বলা যাবে না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণে সচেষ্ট রয়েছি বটে; কিন্তু এ যাত্রাপথ খুব সুখের নয়। সংবাদপত্রের কর্মীরা ‘খুন’ হচ্ছেন, গুম হয়ে যাচ্ছেন, দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় আক্রান্ত হচ্ছেন, যা আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। ২৭ জানুয়ারি (২০২০) একাধিক সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে একটি ছবি- একজন টিভি ক্যামেরাম্যান আক্রান্ত হয়েছেন, রক্তাক্ত তার দেহ। ঢাকা দক্ষিণে মেয়র নির্বাচনী প্রচারণায় দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় তিনি আহত হন। এই ছবি প্রমাণ করে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা আজ কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। এ অসহিষ্ণুতা, আস্থাহীনতায় আক্রান্ত হচ্ছেন সংবাদকর্মীরা। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য যা সত্যিই বেমানান। এই অসহিষ্ণু পরিবেশের মধ্য দিয়ে একটি ভয়ের আবহ তৈরি করে আর যাই হোক, সত্যিকারের গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যাবে না।
আমরা চাই সংবাদপত্র লিখুক। সংবাদকর্মীরা যা দেখেছেন, তা সম্প্রচার করুন। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশিত হোক। সরকারের দোষ-ত্রুটি ধরিয়ে দেয়া হোক। সমাজের সব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হোক সংবাদপত্র। তাহলেই গণতন্ত্র রক্ষা পাবে এবং গণতন্ত্রকে আমরা আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব। যুগান্তর একুশ বছরে পা দিল। প্রথম দিন থেকে এ একুশ বছর আমি যুগান্তরের সঙ্গে ছিলাম। এটি আমার জন্য একটা বড় পাওয়া। যুগান্তরের সম্পাদকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, তিনি আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন আমার মতামত দেয়ার। যুগান্তরের বিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাই প্রার্থনা- সমাজের সব অনিয়মের বিরুদ্ধে যুগান্তর যেভাবে নিরলস কাজ করে এসেছে, আগামীতেও সেভাবে কাজ করুক। আর এর মধ্য দিয়েই গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করতে যুগান্তর কাজ করে যাবে।
Jugantor
1.2.2020




উপসাগরীয় অঞ্চলে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি



৩০ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ | পড়া যাবে ৭ মিনিটে 


উপসাগরীয় অঞ্চলে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি
ইরান সংকটের পেছনে শিয়া-সুন্নির বিষয়টি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। ইসলামের শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি বাস করে ইরানে। এর বাইরে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর জনসংখ্যার একটা বড় অংশ সুন্নি ধর্মাবলম্বী। তবে এখানে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনও বসবাস করে। ইরাকে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সংখ্যালঘু সুন্নি মুসলমানরা দীর্ঘদিন এই দেশটি শাসন করে আসছিল। সাদ্দাম হোসেন নিজে ছিলেন সুন্নি সম্প্রদায়ের লোক। সাদ্দাম-পরবর্তী জমানায় শিয়ারা নেতৃত্বে রয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে ইরানি নেতৃত্বের যোগাযোগ রয়েছে। তবে ইরানে শিয়া নেতৃত্বে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইরাকে এমনটি হয়নি। উপসাগরীয় অঞ্চলে যে সুন্নি নেতৃত্ব রয়েছে বিভিন্ন দেশে, তাদের ভয় ইরান শিয়াদের নেতৃত্বে গঠিত মিলিশিয়াদের একত্র করে সুন্নি নেতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ দিতে পারে। উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে যে গণবিক্ষোভ হয়েছে, তার পেছনে রয়েছে এই শিয়ারা। একদিন এই শিয়ারা পুরো উপসাগরীয় অঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একটি ‘গ্রেটার ইরান’ বা একটি ‘গ্রেটার পারস্য রাষ্ট্র’ গঠন করতে পারে। এমন ধরনের একটি ধারণা কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের।
এখানে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন। এর একটি ধর্মীয় দিক আছে, সেই সঙ্গে আছে রাজনৈতিক দিকও। ইসলাম ধর্মে শিয়া-সুন্নি বলে কোনো কথা উল্লেখ করা হয়নি। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর এই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। সময়টা ৬৩২ সাল। দ্বন্দ্বটা তৈরি হয়েছিল নেতৃত্বের প্রশ্নে। অর্থাৎ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর কার হাতে নেতৃত্ব থাকবে, দ্বন্দ্বটা তৈরি হয়েছিল সেখান থেকেই। সুন্নিরা মূলত ‘আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত’ নামে পরিচিত। সুন্নি শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘সুন্নাহ’ থেকে। সুন্নাহ শব্দের অর্থ প্রথা, বিধান বা আচরণ। সাহাবিরা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বাণী ও তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেন বিধায় তাঁদের অনুসারীরা সুন্নি নামে পরিচিত। অন্যদিকে শিয়া শব্দটির অর্থ দল বা অনুসারী। হজরত আলী (রা.)-এর অনুসারীরাই শিয়াত-ই-আলী বা আলীর দল নামে পরিচিত। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর খলিফা নির্বাচনকালে (অর্থাৎ যাঁরা তাঁর মৃত্যুর পর ওই সময়কার রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন) একদল লোক হজরত আলী (রা.)-কে সমর্থন করেন। তিনি ছিলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চাচাত ভাই ও মেয়ে ফাতেমার স্বামী। তিনি ছিলেন চতুর্থ খলিফা। প্রথম খলিফা ছিলেন হজরত আবু বকর (রা.), দ্বিতীয়জন হজরত ওমর (রা.), তৃতীয়জন হজরত ওসমান (রা.) এবং চতুর্থজন ছিলেন আলী (রা.)। ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে হজরত আলী (রা.) আততায়ীর হাতে শহীদ হলে শিয়া আন্দোলন জোরদার হয়। এর কিছু পরে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে হজরত  হোসাইন (রা.) কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনী কর্তৃক নৃশংসভাবে শহীদ হলে শিয়া আন্দোলনের উদ্ভব হয় এবং সেই থেকে শিয়া মতবাদ বিকশিত হতে থাকে। রাজনৈতিকভাবেও শিয়া সম্প্রদায় আত্মপ্রকাশ করে। পৃথিবীর ১৬০ কোটি মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে শতকরা ৮৫ ভাগই সুন্নি সাম্প্রদায়ভুক্ত। এখানে আরো কিছু তথ্য দেওয়া প্রয়োজন। হজরত আলী (রা.) ও হজরত হোসাইন (রা.)-এর মৃত্যুর প্রায় এক হাজার বছর পর প্রাচীন সাফাভিদ ((Safavid Empire, 1504-1736) সাম্রাজ্য (আজকে যা ইরান) ইরাকের পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। ইরাক বাহ্যত আরবীয় সংস্কৃতি ধারণ করে, আর ইরান পারস্য সংস্কৃতি। এর মধ্য দিয়ে এক ধরনের বৈরিতা তৈরি হয়েছিল, যা সাদ্দাম হোসেনের সময় পর্যন্ত ছিল। পাঠক, ইরান-ইরাক আট বছর যুদ্ধের কথা (১৯৮০-৮৮) স্মরণ করতে পারেন। ইরাকি সুন্নিদের ভয় ছিল ইরাকের শিয়ারা ইরানি শিয়ার নেতৃত্ব দ্বারা ব্যবহৃত হতে পারে। সাফাভিদ সাম্রাজ্যই ইরানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে শিয়া ধর্মকে প্রবর্তন করেছিল। ১৫০১ সালে সাফাভিদ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগে ইরানে সুন্নি ধর্মের প্রচলন ছিল। এই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব এ অঞ্চলের রাজনীতির জন্য যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল ২০১৪ সালে আইএসের উত্থানের মধ্য দিয়ে। ইরাকের ও সিরিয়ার একটি অংশ দখল করে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের উত্থান ঘটেছিল। আইএস ছিল সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত। ফলে ওই সময় ইরাকের শিয়া নেতৃত্ব আইএস দমনে ইরানের সহযোগিতা চেয়েছিল। ইরান সেই সহযোগিতা দিয়েছিল।
ইরান পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। এটা করতে গিয়ে রেভল্যুশনারি আর্মির ভেতরে কুদস নামে একটি প্যারামিলিটারি ফোর্স গঠন করেছিল, যাদের কাজ ছিল বিভিন্ন দেশে বসবাসরত শিয়া ধর্মাবলম্বীদের ভেতরে কাজ করা, তাদের ঐক্যবদ্ধ করা। প্রয়াত মেজর জেনারেল সোলাইমানি ছিলেন এর মূল নেতা। তিনি স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন করতেন এবং তা বাস্তবায়ন করতেন। বলা হয়, সোলাইমানি অগাধ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং সরাসরি শীর্ষ নেতা খামেনির তত্ত্বাবধানে তাঁর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। সোলাইমানি শুধু তাঁর কাছেই রিপোর্ট করতেন, অন্য কারো কাছে নয়। অভিযোগ আছে, উপসাগরীয় অঞ্চলে যেমন শিয়া-মিলিশিয়া আছে তা ছিল তাঁর নিয়ন্ত্রণে।
উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে শিয়া জনগোষ্ঠীর একটা পরিসংখ্যান আমরা এখানে দিতে পারি। বাহরাইনে শিয়া জনগোষ্ঠী শতকরা ৭০ ভাগ, ইরানে ৯০ ভাগ, ইরাকে ৬৩ ভাগ, কুয়েতে ২৫ ভাগ, লেবাননে ৩৬ ভাগ, কাতারে ১৪ ভাগ, সৌদি আরবে ৫ ভাগ, আরব আমিরাতে ১৬ ভাগ, আর ইয়েমেনে ৩৬ ভাগ। একমাত্র ইরান বাদে প্রতিটি দেশেই ক্ষমতায় রয়েছে সুন্নিরা। সাদ্দাম হোসেন পরবর্তী সময়ে ইরাকের শাসনক্ষমতায় অবশ্য শিয়ারা রয়েছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এর বাইরে যেসব দেশ রয়েছে, সেখানে যে অসন্তোষ রয়েছে, সেসব অসন্তোষের পেছনে ‘শিয়া ফ্যাক্টর’ একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। এই শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে এ অঞ্চলে সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) পুনরুত্থান ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন অনেক বিশ্লেষক। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তো প্রকাশ্যেই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন আর আইএসের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান পরিচালনা করবে না। এটা একটি ক্লিয়ার মেসেজ আইএস পুনরুত্থানের ব্যাপারে। মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্টরা এখন আইএসকে শিয়া গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে।
অনেক বিশ্লেষকই লক্ষ করে আসছেন যে এই অঞ্চলে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে (একদিকে সৌদি আরব, অন্যদিকে ইরান) যে ‘প্রক্সিওয়ার’ চলছে, তাতে বৃহৎ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া জড়িয়ে গেছে।
পারস্য উপসাগরে গ্যাস ও তেলের রিজার্ভ ও একই সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিতে আগ্রহ রয়েছে উভয় বৃহৎ শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার। ইরান সংকটও এর সঙ্গে জড়িত। আমরা কয়েকটি পাইপলাইন প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা করতে পারি। এই গ্যাস পাইপলাইন স্ট্র্যাটেজিকে কোনো কোনো বিশ্লেষক Pipelineistain' ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন (দেখুন Paul Cochrane-এর প্রবন্ধ Middle East Eye, 16 April, 2018)। প্রথম পাইপলাইন, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে, যা কাতার-সৌদি আরব-জর্দান-সিরিয়া হয়ে তুরস্ক যাবে (কাতার-তুরস্ক পাইপলাইন)। পরে তা ইউরোপের বুলগেরিয়ায় যাবে। দ্বিতীয় পাইপলাইনটি, যা রাশিয়া সমর্থিত, ইরান (ভায়া ইরাক) হয়ে সিরিয়া যাবে। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে উভয় পাইপলাইনে সিরিয়া সংযুক্ত রয়েছে। সিরিয়া সংকটের পেছনে এটিও একটা কারণ—এই দুই পাইপলাইনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। যদিও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ ২০০৯ সালে কাতারি পাইপলাইন প্রজেক্ট বাতিল করে দিয়েছেন। বাতিল করার পেছনে রাশিয়ার একটা অনুরোধ ছিল। কেননা এই পাইপলাইন বাস্তবায়িত হলে ইউরোপে রাশিয়ার যে বিশাল ‘গ্যাসের বাজার’, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন যে কাতার এই গ্যাস পাইপলাইনের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্রদের সহযোগিতায় সিরিয়ায় আসাদবিরোধী একটি সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছিল। শুধু রাশিয়ার কারণে তাদের সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। অনেক বিশ্লেষক বলার চেষ্টা করেছেন যে সিরিয়ায় আসাদবিরোধী একটা সরকার বসাতে পারলে, তারা এই কাতার-সৌদি আরব-সিরিয়া পাইপলাইনকে সমর্থন দেবে। এতে ইউরোপের দেশগুলোকে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বের করে আনা সম্ভব হবে। এতে রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর ‘চাপ’ বাড়বে। রাশিয়াকে বাগে আনা সম্ভব হবে। সুতরাং ইরান সংকটের ‘আপাতত’ একটা সমাধান হয়েছে বটে; কিন্তু যত দিন পর্যন্ত না শিয়া-সুন্নি বিরোধের অবসান হয়, তত দিন পর্যন্ত উপসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনা বিরাজ করবে।

Kalerkontho
30.01.20207
tsrahmanbd@yahoo.com

মন্তব্য



সাতদিনের সেরা