রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মধ্যপ্রাচ্য সংকটের নতুন মাত্রা




প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত ৯ জানুয়ারি হোয়াইট হাউসে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চান না, তিনি শান্তি চান। প্রেস ব্রিফিংটি তিনি করলেন এমন এক সময় যখন ইরান ইরাকে অবস্থিত দুটি মার্কিন ঘাঁটির ওপর ১২টি মিসাইল রকেট নিক্ষেপ করে। গত ৭ জানুয়ারি ইরাকে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের শীর্ষ কমান্ডার কাসেম সোলাইমানিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে হত্যার পর এর প্রতিশোধ হিসেবে ইরান এই মিসাইল হামলা চালায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে মার্কিন ড্রোন বিমান হামলায় শীর্ষ ইরানি সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানির মৃত্যুর পর খোদ ইরানসহ সমগ্র বিশ্বে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, তা মধ্যপ্রাচ্য সংকটে নতুন একটি মাত্রা এনে দিয়েছে। সংবাদপত্রগুলোতে সম্ভাব্য একটি ‘যুদ্ধ’, এমনকি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের (?) সম্ভাবনার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত ইরান-যুক্তরাষ্ট্র আদৌ কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে কি না, তা এই মুহূর্তে স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে নিঃসন্দেহে এই হত্যাকাণ্ড মধ্যপ্রাচ্যের চলমান রাজনীতিতে উত্তেজনা ছড়িয়েছে এবং এ অঞ্চলের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে কাসেম সোলাইমানি ছিলেন ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের এলিট ফোর্স কুদস ফোর্সের শীর্ষ কমান্ডার। এই রেভল্যুশনারি গার্ড সরাসরি ইরানের ‘সুপ্রিম লিডার’ আলী খামেনির কাছে দায়বদ্ধ। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন তিনি নন। বলা হয় ১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লবের পর ‘রেভল্যুশনারি গার্ড’ গঠন করা হয়েছিল শুধু ইসলামিক শাসন ব্যবস্থা তথা ধর্মীয় নেতাদের ‘প্রটেকশনের’ জন্য! এ জন্যই বলা হয় রেভল্যুশনারি গার্ড হচ্ছে ইরানি বিপ্লবের অন্যতম স্তম্ভ। তবে তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ নেই, তা নয়। অভিযোগ আছে। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক সময়ে স্ট্রেইট অব হরমুজ প্রণালিতে যেসব বিদেশি জাহাজ আক্রান্ত হয়েছিল, এর পেছনে ছিল এই রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনী। অনেক দিন থেকেই নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলার চেষ্টা করছেন, কোনো সংকটে এই রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনী স্ট্রেইট অব হরমুজ প্রণালি বাদ করে দিতে পারে। তারা এই সমুদ্র সীমানায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের পর এই আশঙ্কা আরো বাড়ল। সোলাইমানির বিরুদ্ধে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ আমরা শুনেছি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মুখ থেকে। ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে যত সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড তার রচয়িতা ছিলেন এই সোলাইমানি। বিশেষ করে লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকে তিনি শিয়া ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে মার্কিনবিরোধী একটি ‘অ্যালায়েন্স’ গড়ে তুলেছিলেন। পেন্টাগনের সাবেক শীর্ষ সেনা কমান্ডার জেনারেল ডেভিড পেত্রাউসের মুখেও আমরা শুনেছি সে কথা। পেত্রাউস বলেছেন, ইরানি শীর্ষ সেনা কমান্ডার সোলাইমানিকে হত্যা মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবিরোধী সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। তিনি বলেছেন, নির্দিষ্ট উদ্যোগের কারণেই এটি গুরুত্বপূর্ণ। ওসামা বিন লাদেন ও আইএস নেতা বাগদাদিকে হত্যার চেয়েও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হলো জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা। এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে আমরা জানি না। এখন পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি কোন কোন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জেনারেল সোলাইমানি জড়িত ছিলেন। তবে এটি ঠিক সাম্প্রতিক সময়গুলোতে লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনীর সদস্যরা সক্রিয় ছিলেন। সিরিয়ার অভ্যন্তরে এই গার্ড বাহিনীর নেতৃত্বে একটি সেনা ক্যাম্প পরিচালিত হতো, যেখানে ইসরায়েলি বিমান হামলার খবর কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল, ইরান তা অস্বীকারও করেনি। একই সঙ্গে লেবাননে হিজবুল্লাহ গ্রুপ কিংবা ইরাকের আধাসামরিক বাহিনী হাশেদ আল শাবির অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের অন্যতম উৎস ছিল এই রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনী। মার্কিন ড্রোন হামলায় ‘হাশেদ আল শাবি’র সহকারী প্রধান আবু মাহদি আল মুহানদিসও নিহত হয়েছিলেন। মুহানদিস ইরাকে ‘কায়তাব হিজবুল্লাহ’ নামে একটি সংগঠনের প্রধান ছিলেন। ড্রোন হামলার আগে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলা ও একজন কন্ট্রাক্টরকে হত্যার জন্য হাশেদ আল শাবিকে অভিযুক্ত করা হয়। সুতরাং এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে সোলাইমানি ছিলেন ইসরায়েলি ও মার্কিন গোয়েন্দাদের টার্গেট। তাঁকে যেকোনো সময় হত্যা করা হতে পারে, এটি তিনি জানতেন। তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন বলে মনে হয় না। কেননা তিনি কোন সময় এবং কখন বাগদাদে থাকবেন, এটি তাঁর ঘনিষ্ঠ লোকজন তথা ইরাকি শীর্ষ সেনা কমান্ডার ছাড়া অন্য কারো জানার কথা নয়। ইসরায়েল ও মার্কিন গোয়েন্দাদের সাফল্য এখানেই যে তারা এ তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছিল। সোলাইমানির বিরুদ্ধে যত অভিযোগই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে একটি স্বাধীন দেশের ভেতরে কোনো নাগরিককে হত্যা করা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। জাতিসংঘের সনদেও এমনটি নেই। এটি এক ধরনের ‘যুদ্ধের’ শামিল! এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে স্বীকার করেছেন তিনি সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর ব্যক্তি। কিন্তু তিনি কি কাউকে সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিতে পারেন? খোদ যুক্তরাষ্ট্রে এই বিতর্ক উঠেছে এখন।
Kalerkontho
14.1.2020

0 comments:

Post a Comment