রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ও বিবিধ প্রসঙ্গ

শেষ পর্যন্ত যা আশঙ্কা করা হয়েছিল, তাই হয়েছে। করোনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ ইউরোপে আঘাত হানতে শুরু করেছে। এর ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বেশ কয়েকটি দেশ। বিবিসি আমাদের খবর দিচ্ছে যে, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড, হল্যান্ড ও দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে করোনার প্রকোপ বাড়ছে। মাদ্রিদে ১৫ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। ফ্রান্সের চারটি শহরে বার-রেস্তোরাঁ বন্ধের প্রস্তুতি চলছে। পোল্যান্ডে সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় সেখানে কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ করা হয়েছে। জার্মানিতে নতুন করে ৪ হাজার ৫১৬ জনের ভাইরাস শনাক্তের খবর পাওয়া গেছে। যুক্তরাজ্যে বার-রেস্তোরাঁ বন্ধের পাশাপাশি তিন স্তরের লকডাউন বিধি আরোপের পরিকল্পনা করছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতের আগমনীতে ভাইরাস জেগে উঠেছে। হাসপাতালে বেড়ে যাচ্ছে রোগীর সংখ্যা। বৃদ্ধ নিবাসগুলোতে সংক্রমণ আরও বেড়ে যাওয়ার খবর আসছে। এমনকি কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ থাকা এলাকাগুলোতেও অবিরাম দ্রুতগতিতে ভাইরাস সংক্রমণ ঘটে চলছে। ব্লুমবার্গ ওপিনিয়ন-এর মতে ইউরোপে কভিড-১৯-এর যে কার্ভ, তা যুক্তরাষ্ট্রের মতোই অথবা যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতির চেয়েও খারাপ হচ্ছে! ১৬ অক্টোবর নিউ ইয়র্ক টাইমস আমাদের জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ১৭টি স্টেটে নতুন করে করোনাভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। মিনেসোটা, মনটানা কিংবা উইসকনসিনের মতো স্টেটে নতুন করে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক তাদের ১৬ অক্টোবরের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, কোনো কোনো স্টেটে নতুন করে করোনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ আঘাত হেনেছে। এর অর্থ হচ্ছে কভিড-১৯ পরিপূর্ণভাবে নির্মূল হয়নি। এর ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ আঘাত হানতে শুরু করেছে। একমাত্র টিকা ছাড়া কভিড-১৯ নির্মূল করা সম্ভব নয়। আর এই টিকা নিয়েও আছে নানা ‘সমস্যা’ ও ‘রাজনীতি’। যাদের ওপর টিকা প্রয়োগ করা হয়েছিল, তারা অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় ওই টিকার গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে। ফাইজারের করোনাভাইরাস টিকার ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে। এই করোনাভাইরাস গত দশ মাসে একদিকে যেমনি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে তেমনি বড় ধরনের বৈষম্যও সৃষ্টি করেছে। ধনীরা আরও ধনী হয়েছে, গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছে। ধনী ও গরিব মানুষের মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে আয়ের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ কভিড-১৯-এর কারণে ব্যবসার প্রসারও বেড়েছে, যাতে ধনীরা আরও ধনী হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীতে সারা বিশ্বে মৃত্যুর সংখ্যা যখন এগারো লাখ অতিক্রম করেছে, তখন আশ্চর্যজনকভাবে বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ আরও বেড়েছে। ভারতের মতো দেশে শত কোটিপতির সংখ্যা শুধু বাড়েইনি, তাদের সম্পদও বেড়েছে। কতগুলো পরিসংখ্যান দিলে আমাদের বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। যুক্তরাষ্ট্রে বিলিয়নিয়ারদের শীর্ষে রয়েছে জেফ বেজোস, যিনি আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী। ৫৬ বছর বয়সী জেফ বেজোসের সম্পদের পরিমাণ এখন ১৭৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, যা অনেক দেশের জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি। আমাজন এই প্যানডেমিকের সময় সম্পদ বৃদ্ধি করেছে দ্বিগুণ। ২০১৯ সালে এ সময় তাদের আয় ছিল ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে তাদের আয় বেড়েছে দ্বিগুণ, ৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার (দ্য ভার্জ, জুলাই ৩০, ২০২০)। শুধু আমাজনের কথা কেন বলি? বিল গেটস (মাইক্রোসফট) তার সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে ৯৮ বিলিয়ন ডলারে। ধনীদের তালিকায় তার অবস্থান দ্বিতীয়। তৃতীয় অবস্থানে আছেন ওয়ারেন বাফেট (বার্কশায়ার হাথাওয়ে), তার সম্পদের পরিমাণ ৬৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এভাবে ওরাকলের লেরি এলিসন, ফেইসবুকের মার্ক জাকারবার্গ, সবার সম্পদ বেড়েছে। আরেকটি পরিসংখ্যানে আমরা দেখতে পাই, করোনাভাইরাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বেশি মানুষ মারা গেলেও, সেখানে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা চীনের পরে (চীনে ৭৯৯ জন, যুক্তরাষ্ট্রে ৬২৬ জন। ভারতে ১৩৭ জন। সূত্র : স্ট্যাটিস্টা। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ধনীরা আরও ধনী হয়েছে, তেমনটি নয়। ফোর্বস যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে প্রথম ১৫ জন বিলিয়নিয়ারের মধ্যে ফ্রান্সের আছে দুজন, স্পেনের একজন, মেক্সিকোর একজন। করোনাকালে ভারতেও ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। সেখানেও ধনীরা আরও ধনী হয়েছেন। ভারতে গত ছয় মাসে নতুন ১৫ জন বিলিয়নিয়ারের জন্ম হয়েছে। ভারতে মোট বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা এখন ১৩৭। এই ১৩৭ জনের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি ডলার। তালিকার শীর্ষে রয়েছে মুকেশ আম্বানি (৮৮২০ কোটি ডলার)। পরের অবস্থানগুলো যথাক্রমে শিব নাদার (৮৮২০ কোটি ডলার), গৌতম আদানি (১৮৬০ কোটি ডলার), রাঁধাকৃষ্ণ দামানি (১৫২০ কোটি ডলার)। নতুন শত কোটিপতির তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তারা হচ্ছেন বিমল কুমার জ্ঞানচন্দানি, বিনি বনসল, রাধেশ্যাম গোয়েনকা প্রমুখ (আনন্দবাজার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)। করোনাকালে ভারতে শত কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে যাওয়াকে অর্থনীতিবিদরা সেখানে ধনী ও গরিবদের মধ্যে বৈষম্য আরও বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ হিসেবেই দেখছেন। ‘ওয়ার্ল্ডোমিটার’ আমাদের যে তথ্য দিচ্ছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রে কভিড-১৯-এ মৃত্যুর সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আর ভারত মৃত্যুর হারের দিক দিয়ে বিশ্বে দ্বিতীয়, সেখানে মারা গেছেন ৯৬ হাজার ৩৭৮ জন। এই তথ্য ২৯ সেপ্টেম্বরের। এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে দেব? একদিকে করোনাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা যাচ্ছে না, মৃত্যুর সংখ্যা এখনো বাড়ছে। অন্যদিকে ধনীদের সংখ্যাও বাড়ছে, ধনীরা আরও ধনী হচ্ছেন। অথচ ভারতের অর্থনীতি এখন ভালো নয়। ভারতে জিডিপি গত ৪০ বছরের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। কাজ হারিয়েছেন ৪১ লাখ মানুষ (আইএলওর তথ্য মতে)। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকের জিডিপি সংকুচিত হয়েছে ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ। আর্থিক সংকটের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মুকেশ আম্বানির ‘রিল্যায়েন্স’ গ্রুপে গুগল, ফেইসবুকের মতো অনলাইন সংস্থায় বিনিয়োগ করেছে ও তার মূলধন বেড়েছে। করোনাভাইরাস ভারতে ধনীদের আরও ধনী করেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা কী? বাংলাদেশেও করোনাকালে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। গত মার্চ থেকে জুন (২০২০) এই চার মাসে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ৮৬ হাজার ৩৭ জন। মার্চে এ সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫ জন। করোনার সময় ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে বলে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে (বিডিটুডে, ১৬ সেপ্টেম্বর)। আবার যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতির দিকে ফিরে যাই। যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এই নভেম্বরের আগেই দ্বিতীয় আরেকটি ‘ওয়েভ’ বা ঢেউ যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানছে। স্বাস্থ্যসেবায় অব্যবস্থাপনা সেখানে চরমে। মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার জন্য নোয়াম চমস্কি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দায়ী করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার কলেজের প্রফেসর থমাস ম্যাগাস্টড্ট ২৮ সেপ্টেম্বর নিউজ পোর্টাল ‘ন্যাশন অফ চেঞ্জ’-এ যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর কারণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন, করোনাকালেও যুক্তরাষ্ট্রে ধনীরা আরও ধনী হয়েছেন, গরিব আরও গরিব হয়েছেন, ‘ফ্যামিলিস অফ ইউএসএ’-এর এর তথ্য মতে, মহামারীর সময় ৫৪ লাখ মানুষ তাদের যে স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ছিল, তা হারিয়েছে। চাকরি না থাকায় অনেকেই এখন আর ইনসিওরেন্সের প্রিমিয়াম দিতে পারছেন না। কভিড-১৯-এর কারণে যুক্তরাষ্ট্রে নিম্ন আয়ের মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হার্ভার্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক রাজ চেট্টি কভিড-১৯ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাতে তিনি দেখিয়েছেন যে, নিম্ন আয়ের মানুষ, যাদের বছরে আয় ২৭ হাজার ডলারের নিচে, তাদের মধ্যে ১১ মিলিয়ন, অর্থাৎ ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। কিন্তু যাদের আয় বছরে ৬০ হাজার ডলারের ওপরে, তাদের মধ্যে চাকরি হারানোর সংখ্যা তিন ভাগের এক ভাগ। অধ্যাপক থমাস ম্যাগাস্টড্ট তার প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, যেখানে নিম্ন আয়ের মানুষদের চাকরি চলে গেছে অথবা বেতন কমেছে, সেখানে প্রধান নির্বাহীদের বেতন বেড়েছে ৯৪০ ভাগ। চিন্তা করা যায়? এই করোনাভাইরাসকেও ব্যবসায়ীরা পুঁজি করছে। তাদের ব্যবসা সম্প্রসারিত করছে। তারা আরও ধনী হয়েছেন। যেখানে বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতির পরিমাণ ২৮ ট্রিলিয়ন ডলার, সেখানে বিশ্বে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা বেড়েছে। তাদের সম্পদও বেড়েছে। আইএমএফের আশঙ্কা, বিশ্ব অর্থনীতি এবার সংকুচিত হবে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু করোনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ ইতিমধ্যেই ইউরোপে আঘাত হেনেছে। স্পেন, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড কিংবা জার্মানিতে পুনরায় সীমিত ‘লকডাউন’ চালু হয়েছে। বার-রেস্তোরাঁ খোলার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির সংকোচনের হার ৫ দশমিক ২ শতাংশকেও ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশও এতে করে আক্রান্ত হবে। করোনায় বাংলাদেশের জিডিপি কমবে ০ দশমিক ০১ শতাংশ। এডিবি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যে ক্ষতি হবে, তার পরিমাণ ৮৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার। কিন্তু প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তৈরি পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে ইতিমধ্যে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে করোনায় মানুষের মাসিক আয় কমেছে ২০ দশমিক ২৪ শতাংশ। করোনার সময় প্রায় ৫২ দশমিক ৫৮ শতাংশ পরিবার বা খানা কোনো না কোনোভাবে খাদ্যদ্রব্য ভোগের পরিমাণ ২০২০ সালের মার্চের তুলনায় কমিয়েছে। বিবিএসের জরিপে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যানই আমাদের বলে দেয় বিশ্ব এখনো করোনামুক্ত হয়নি এবং করোনাভাইরাসের উপস্থিতি দীর্ঘায়িত হওয়ায় বিশ^ অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে থাকলই। একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল নভেম্বরেই করোনার টিকা পাওয়া যাবে। কিন্তু টিকা নিয়ে একটা মিশ্রপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কেননা, যাদের চারবার টিকা প্রয়োগ করা হয়েছিল, তারা অসুস্থ হয়ে পড়ায়, টিকার ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নের মুখে। উপরন্তু বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চলে এই টিকা কত দিনে পৌঁছানো সম্ভব হবে, সেটাও একটি প্রশ্ন। এখানেও ধনী দেশ ও গরিব দেশের মধ্যে একটা পার্থক্য তৈরি হয়েছে। ফলে করোনার ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ আমাদের একটি বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিল। Desh Ripantor 20.10.2020

0 comments:

Post a Comment