রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মার্কিন নির্বাচন যে শঙ্কা জাগায়

আগামী ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে এখন নানা বিতর্ক। একের পর এক বিতর্ক ও নাটকীয়তার সৃষ্টি হচ্ছে এবং শেষ অব্দি বিশ্ব একটি ভালো নির্বাচন দেখতে পাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ফিরে এসে তার দৈনন্দিন কাজকর্ম করছেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতে, তার ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকার কথা। কিন্তু তিনি তা থাকেননি। এ অসুস্থতাজনিত কারণে তার 'কর্মদক্ষতা' ও জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ১৯১৯ সালে এ রকম একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ওই সময় মহামারিতে (ইনফ্লুয়েঞ্জা) সারাবিশ্ব আক্রান্ত হয়েছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হন। তিনি প্যারালাইজড ও অন্ধ হয়ে যান। বিষয়টি গোপন রাখা হয়। কিন্তু এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের একটি ব্যাখ্যা আছে। সংবিধানের ২৫তম সংশোধনীতে প্রেসিডেন্ট অসুস্থ, অকর্মণ্য হলে তাকে অপসারণ করার বিধান আছে। অনেক ক্ষেত্রে এটা 'জোর' করে অথবা তিনি যদি উত্তরাধিকারীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে না চান, সে ক্ষেত্রেও তাকে অপসারণ করা যায়। কিন্তু ট্রাম্প বলে কথা। তাকে অপসারণ করা যাবে না! এরই মাঝে তিনি নানা কথাবার্তা বলে নির্বাচনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছেন। প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কেও তিনি জাতিকে বিভ্রান্ত করেছেন। মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। অশোভন বক্তব্য দিয়ে বিতর্কের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কের আগেই কতগুলো 'ইস্যু' সামনে চলে এসেছিল, যা বিতর্কের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যেমন- প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কী পরিমাণ ট্যাক্স দেন। যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ ধনীদের একজন ট্রাম্প। প্রথম কাতারে না থাকলেও, ২০১৯ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন যুক্তরাষ্ট্রের ধনীদের যে তালিকা প্রকাশ করেছিল, তাতে দেখা যায় ট্রাম্পের সম্পদের পরিমাণ ৩.১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালের ৫ মার্চ পর্যন্ত এই হিসাব। ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত তার সম্পদ আরও বেড়েছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ধনীদের কাতারে তার অবস্থান ২৫৯তম, আর বিশ্বে ৭১৫তম। তবে ২০১৫ সালে ট্রাম্প এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে স্বীকার করেছিলেন, তার সম্পদের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলার (এনবিসি, ১৬ জুলাই ২০১৫)। যে পরিমাণ অর্থই তার থাকুক না কেন, তা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর (২০১৬) তিনি স্বীকার করেননি কখনও। তার ট্যাক্স ফাইলে তা উল্লেখও করেননি। তবে তার ট্যাক্স ফাইলের গোপন তথ্যটি ফাঁস করে দেয় নিউইয়র্ক টাইমস গত ২৭ সেপ্টেম্বর; প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কের দুই দিন আগে। তাতে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা সবাইকে অবাক করেছে। তিনি একজন বিলিয়নেয়ার, কিন্তু ট্যাক্স দিয়েছেন মাত্র ৭৫০ ডলার (২০১৭ সালের হিসাব)! অন্যদিকে আরেকটি তথ্যও আমরা পেয়েছি। তাতে দেখা যায়, অন্যতম প্রার্থী জো বাইডেন ট্যাক্স দিয়েছেন ৩৭,৪২,৯৭৪ ডলার, ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ও জো বাইডেনের রানিং মেট কমলা হ্যারিস দিয়েছেন ৫,১৬,৪৬৯ ডলার, সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ৩,৪৩,৮৮২ ডলার, সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন দিয়েছেন ২,৬৮,৪৮৪ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে সবাইকে ট্যাক্স দিতে হয়। যারা চাকরি করেন, আয় থেকেই তারা ট্যাক্স দেন। তাহলে ট্রাম্পের ব্যাপারে এত ফাঁকিজুকি কেন? সাধারণত ধনী ব্যবসায়ীরা এ কাজটি করেন। তারা ট্যাক্স ফাঁকি দেন। ট্রাম্পও দিয়েছেন। তবে অত্যন্ত কৌশলে এ কাজটি তিনি করেছেন। অতীতে একাধিকবার এই প্রশ্নটি উত্থাপিত হলেও, ট্রাম্প কখনোই তা খোলাসা করেননি। এবারও যখন নিউইয়র্ক টাইমস তথ্যটি ফাঁস করে দিল, হোয়াইট হাউস কিংবা ট্রাম্পের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে তা খণ্ডন করা হয়নি। পাঠকদের জানার জন্য আরও কিছু তথ্য দিই। গড়পড়তা একজন শিক্ষক (স্কুল) সেখানে ট্যাক্স দেন ৭,২৩৯ ডলার (বছরে), একজন দমকলকর্মী দেন ৫,২৮৩ ডলার, একজন নার্স দেন ১০,২১৬ ডলার, একজন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার দেন ১৬,৪৪৭ ডলার (প্রোগ্রেস রিপোর্ট, ৩০ সেপ্টেম্বর)। আর ট্রাম্প দেন মাত্র ৭৫০ ডলার! তবে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে বার্ষিক যে বেতন পান (৪ লাখ ডলার), তা তিনি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে দান করে দেন। একজন প্রেসিডেন্ট যখন অবসরে যান, আজীবন তিনি পেনশন পান, তার পরিমাণ ২,১৯,২০০ ডলারের মতো বছরে। একজন ধনী ব্যক্তি হয়েও ট্রাম্প ট্যাক্স দেন না- এটা বহুল আলোচিত ও প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কেও তাকে এ প্রশ্ন করা হয়েছিল। তখন তিনি জবাবে বলেছিলেন, তিনি 'মিলিয়ন ডলার ট্যাক্স' দেন! তাহলে তিনি মিথ্যা বললেন? তার স্টাফরা অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে পারেননি। তার অর্থ হচ্ছে, তিনি যা বলেছেন তা মিথ্যা। তার বক্তব্যের সঙ্গে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত তথ্যের কোনো মিল নেই। প্রশ্ন হচ্ছে এখানেই। একজন প্রেসিডেন্ট কি তাহলে মিথ্যা বলেন? সংবাদ সম্মেলনে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি কি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেন? এর জবাবে তিনি বলেছিলেন, মহামারির কারণে ডাকযোগে বর্ধিত ভোট না হলে তিনি বিশ্বাস করেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো দরকারই হতো না। তিনি মনে করেন, ডাকযোগের ভোটে জালিয়াতি হলেই কেবল তিনি হারতে পারেন! নির্বাচনে হেলে গেলে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছিল- ট্রাম্প বলেছেন, নির্বাচনে ভোট গ্রহণের পর ফলাফল নিষ্পত্তি হবে সুপ্রিম কোর্টে। এটি বিবেচনায় নিয়েই কি তিনি প্রয়াত বিচারপতি রুথ বাদের গিন্সবার্গের জায়গায় বিচারপতি অ্যামি কোবি ক্যারেটের নাম প্রস্তাব করেছিলেন? তার কনফার্মেশনের শুনানি এখন চলছে। সিনেটে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিচারপতি ক্যারেটের মনোনয়ন চূড়ান্ত হলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য তা হবে একটি প্লাস পয়েন্ট। তিনি যা চাইবেন, সুপ্রিম কোর্ট তাতে অনুমোদন দিতে পারেন। এ জন্যই ডেমোক্র্যাটরা চেয়েছিল, নয়া প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি মনোনয়ন দেবেন। কিন্তু ট্রাম্প তা মানেননি। ট্রাম্প তার বক্তব্য ও আচরণের জন্য বারবার বিতর্কিত হলেও তিনি হাল ছাড়ছেন না। গত ১১ অক্টোবর সর্বশেষ নির্বাচনী জনমতের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এবিসি নিউজ ও ওয়াশিংটন পোস্ট এই জনমত সমীক্ষা পরিচালনা করে। তাতে দেখা যায়, ট্রাম্প পিছিয়ে আছেন ১২ পয়েন্টে। জো বাইডেনের পক্ষে ৫৫ ভাগ জনমত, আর ট্রাম্পের পক্ষে ৪৩ ভাগ। পরপর তিনটি জনমত সমীক্ষায় ১০ পয়েন্টের ওপরে জো বাইডেন এগিয়ে আছেন, এবং এই হার ৫০ ভাগের ওপরে। বাকি দুটো জনমত সমীক্ষা পরিচালনা করে সিএনএন/ এসএসআরএস এবং ফক্স নিউজ। ফক্স নিউজকে ট্রাম্পের সমর্থক বলে ধরে নেওয়া হয়। ১৯৩৬ সালের পর যে ২১টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে অন্তত পাঁচটি ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে চ্যালেঞ্জ করে বিরোধী প্রার্থী এত পয়েন্টের ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন না। কেউই শতকরা ৪৮ ভাগের ওপরে নির্বাচনে ভোট পাননি। জো বাইডেনের পক্ষে জনমত গড়ে ৫০ ভাগের ওপরে। বলা ভালো, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাধারণ ভোটাররা ভোট দেন বটে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে। নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। জিততে হলে পেতে হবে ২৭০টি ভোট। সিনেট ও হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের মোট সদস্য সংখ্যার ভিত্তিতে এই নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হয়। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই 'বিতর্ক' বাড়ছে। আর তাতে একটা বড় শঙ্কার জায়গা তৈরি হয়েছে। Somokal 23.10.2020

0 comments:

Post a Comment