রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কেমন হবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

আগামী ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ৪৯তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ১৭৮৯ সালে সেখানে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় এখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন দুজন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প, আর ডেমোক্রেট পার্টি প্রার্থী জো বাইডেন। কিন্তু এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্ক, যত নাটকীয়তা- অতীতে কোনো নির্বাচন নিয়ে এতটা হয়নি। ৭৪ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, আবার ফিরে এসে নির্বাচনী প্রচারণাসহ তার দৈনন্দিন কাজকর্ম করছেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার ফর ডিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের’ মতে, তার ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকার কথা। কিন্তু তিনি তা থাকেননি। অসুস্থতাজনিত কারণে তার ‘কর্মদক্ষতা’ ও জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ১৯১৯ সালে এ রকম একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ওই সময় মহামারীতে (ইনফ্লুয়েঞ্জ) সারাবিশ্ব আক্রান্ত হয়েছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হন। তিনি প্যারালাইজড ও অন্ধ হয়ে যান। কিন্তু বিষয়টি গোপন রাখা হয়। কিন্তু এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের একটি ব্যাখ্যা আছে। সংবিধানের ২৫তম সংশোধনীতে প্রেসিডেন্ট অসুস্থ, অকর্মণ্য হলে তাকে অপসারণ করার বিধান আছে। অনেক ক্ষেত্রে এটা ‘জোর’ করে অথবা তিনি যদি উত্তরাধিকারীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে না চান, সে ক্ষেত্রেও তাকে অপসারণ করা যায়। কিন্তু ট্রাম্প বলে কথা। তাকে অপসারণ করা যাবে না! এরই মাঝে তিনি নানা কথাবার্তা বলে নির্বাচনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছেন। প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কেও তিনি জাতিকে বিভ্রান্ত করেছেন। মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। অশোভন বক্তব্য দিয়ে বিতর্কের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে তিনি যত বেশি বিতর্কিত হয়েছেন, অতীতে অন্য কোনো প্রেসিডেন্ট এভাবে বিতর্কিত হননি। ক’বছর আগেও তার নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা সারাবিশ্ব জেনেছিল। জনৈকা বারবণিতার সঙ্গে তার ‘দৈহিক সম্পর্ক’ ও তা সংবাদমাধ্যমে যাতে প্রকাশ না পায়, তার জন্য মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা, একের পর এক শীর্ষ কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করা, নির্বাচনে বাইরের শক্তির দ্বারা প্রভাব খাটানোর উদ্যোগ, চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়ে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা করা ইত্যাদি ঘটনায় তিনি বারবার আলোচিত হয়েছেন। তার শাসনামলে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হয়েছে, যার কারণে জন্ম হয়েছে ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারর্স’ আন্দোলনের। একপর্যায়ে এই আন্দোলন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং যা পরিণত হয় কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে। সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত তিনি দুটো কারণে। এক. একজন ধনী ব্যক্তি হয়েও (তার সম্পদের পরিমাণ ২.৫ বিলিয়ন ডলার) তিনি কর পরিশোধ করেছেন মাত্র ৭৫০ ডলার (২০১৭)। দুই. নির্বাচনে হেরে গেলে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা ছাড়বেন কিনা? একটা আশঙ্কা ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে যে, তিনি ফন্দিফিকিরের আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার উদ্যোগ নিতে পারেন। সংবাদ সম্মেলনে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি কি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষটি নিশ্চিত করতে পারেন? এর জবাবে তিনি বলেছিলেন, মহামারীর কারণে ডাকযোগে বর্ধিত ভোট না হলে তিনি বিশ্বাস করেন ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো দরকারই হতো না। তিনি মনে করেন, ডাকযোগের ভোটে জালিয়াতি হলেই কেবল তিনি হারতে পারেন। নির্বাচনে হেরে গেলে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছিল- ট্রাম্প বলেছেন, নির্বাচনের ভোটগ্রহণের পর ফলাফল নিষ্পত্তি হবে সুপ্রিমকোর্টে। এটা বিবেচনায় নিয়েই কি তিনি প্রয়াত বিচারপতি রুথ বাদের গির্নসবাদের জায়গায় বিচারপতি অ্যামি কোনি ব্যারেটের নাম প্রস্তাব করেছিলেন? সিনেটে তার ‘কনফার্মেশনের’ শুনানি শেষ হয়েছে। সিনেটে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিচারপতি ব্যারেটের মনোনয়ন চূড়ান্ত হলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য তা হবে একটা প্লাসপয়েন্ট। তিনি যা চাইবেন, সুপ্রিমকোর্ট তাতে অনুমোদন দিতে পারেন। এজন্যই ডেমোক্রেটরা চেয়েছিল নয়া প্রেসিডেন্ট সুপ্রিমকোর্টে বিচারপতি মনোনয়ন দেবেন। কিন্তু ট্রাম্প তা মানেননি। ব্যারেট মনোনয়ন নিশ্চিত করতে পারবেন বলে অনেকের ধারণা। ট্রাম্প তার বক্তব্য ও আচরণের জন্য বারবার বিতর্কিত হলেও তিনি হাল ছাড়ছেন না। গত ১১ অক্টোবর সর্বশেষ নির্বাচনী জনমতের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এবিসি নিউজ ও ওয়াশিংটন পোস্ট এই জনমত সমীক্ষা পরিচালনা করে। তাতে দেখা যায়, ট্রাম্প পিছিয়ে আছেন ১২ পয়েন্টে। জো বাইডেনের পক্ষে ৫৫ ভাগ জনমত, আর ট্রাম্পের পক্ষে ৪৩ ভাগ। পরপর তিনটি জনমত সমীক্ষায় ১০ পয়েন্টের ওপরে জো বাইডেন এগিয়ে আছেন এবং এই হার ৫০ ভাগের ওপরে। বাকি দুটো জনমত সমীক্ষা পরিচালনা করে সিএনএন/এসএসআরএস এবং ফক্স নিউজ। ফক্স নিউজকে ট্রাম্পের সমর্থক বলে ধরে নেওয়া হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রার্থীদের ‘কমিটমেন্ট’। প্রার্থীরা নির্বাচনে বিজয়ী হলে জাতিকে কী উপহার দেবেন, এটা সবাই জানতে চায়। প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণায় এসব বিষয়ে বক্তব্য রাখেন, প্রতিশ্রুতি দেন, ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। এমনকি তিন তিনটি প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ক হয়। সাধারণত টিভি চ্যানেলগুলো এসব বিতর্কের আয়োজন করে এবং লাখ লাখ মানুষ তা টিভিতে প্রত্যক্ষ করে। ভোটারদের প্রভাবিত করার এটা একটা মোক্ষম অস্ত্র। কিন্তু করোনা ভাইরাস এবার বিপত্তিটা বাধিয়েছে। ট্রাম্প করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ক বাতিল হয়ে যায়। আর তৃতীয় বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে না বলেই মনে হয়। ফলে ভোটারদের কাছে আর কোনো সুযোগ থাকল না প্রার্থীদের ‘কমিটমেন্ট’ প্রত্যক্ষ করার। তবে এটা ঠিক বিভিন্ন ইস্যুতে ট্রাম্প ও বাইডেনের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। যেমন করোনা ভাইরাস। সারাবিশ্বে এই ভাইরাসে ১১ লাখের ওপর মানুষ মারা গেলেও (যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর সংখ্যা ২২৪২৮২ জন) ট্রাম্প এই মহামারীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন। ‘চীনা ভাইরাস’ বলেও চিহ্নিত করেছেন। তিনি মাস্ক ব্যবহার করেন না। আর বাইডেন বলেছেন, তিনি নির্বাচিত হলে তার প্রথম কাজ হবে মহামারী মোকাবিলা করা। কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে ট্রাম্পের নীতির কোনো ফল পাওয়া যায়নি। কর্মসংস্থান বাড়েনি। বেকার মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। জো বাইডেনের বক্তব্য হচ্ছে, করোনা ভাইরাসের তাৎক্ষণিক ধাক্কা সামাল দিতে যত অর্থের প্রয়োজন হয়, তত অর্থ তিনি দেবেন। এর মাঝে রয়েছে ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া ও পরিবারগুলোকে নগদ অর্থ সাহায্য প্রদান। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে প্রতি মাসে ২০০ ডলার ও শিক্ষার্থীদের ১০ হাজার ডলার ঋণ মওকুফেরও প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। পরিবেশবান্ধব জ্বালানির জন্য দুই ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ ও আমেরিকান পণ্য ক্রয়ের জন্য ৪০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও তিনি দিয়েছেন। চীনের ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে নিজেদের পণ্য টিকিয়ে রাখা হচ্ছে ট্রাম্পের নীতি। এ কারণেই তিনি চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে ইতোমধ্যে চীনের সঙ্গে এক ধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ শুরু করেছেন। এ ব্যাপারে বাইডেনের নীতি খুব স্পষ্ট নয়। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ট্রাম্পের অবস্থান ‘আমেরিকা ফাস্ট’। তার নীতি দক্ষিণ চীন সাগরে তথা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনবিরোধী একটা অ্যালায়েন্স তৈরি করছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন ই বিগানের সম্প্রতি নয়াদিল্লি ও ঢাকা সফর এর বড় প্রমাণ। অন্যদিকে জো বাইডেন বিশ্বে আমেরিকার নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চান। ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি আন্তর্জাতিক জোট করতে চান তিনি। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন কমিয়ে আনতে চান। আর জো বাইডেনের নীতি অনেকটা প্রো-অভিবাসন। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত এসব ইস্যুতে ট্রাম্প ও বাইডেনের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও ভোটাররা ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আচরণ, ব্যক্তিগতভাবে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা, ক্ষমতার অপব্যবহার করা, ট্যাক্স না দেওয়া ইত্যাদিতে বেশি প্রভাবিত হয়েছেন। যে কারণে জনমত এখনই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চলে গেছে। তবে শেষ কথা বলা যাবে না এখনই। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে Amader Somoy 22.10.2020

0 comments:

Post a Comment