রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কভিড-১৯ ধনীদের আরও ধনী করেছে

কভিড-১৯ মহামারিতে সারাবিশ্বে মৃত্যুর সংখ্যা যখন ১০ লাখ অতিক্রম করেছে, তখন আশ্চর্যজনকভাবে বিলিওনেয়ারদের সম্পদ আরও বেড়েছে। ভারতের মতো দেশে শতকোটিপতির সংখ্যা শুধু বাড়েইনি, তাদের সম্পদও বেড়েছে। কতকগুলো পরিসংখ্যান দিলে আমাদের বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। যুক্তরাষ্ট্রে বিলিওনেয়ারদের শীর্ষে রয়েছেন জেফ বেজোস, যিনি আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী। ৫৬ বছর বয়সী জেফ বেজোসের সম্পদের পরিমাণ এখন ১৭৫.৩ বিলিয়ন ডলার, যা অনেক দেশের জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি। আমাজন এই মহামারির সময় সম্পদ বৃদ্ধি করেছে দ্বিগুণ। ২০১৯ সালে এই সময় তাদের আয় ছিল ২.৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে তাদের আয় বেড়েছে দ্বিগুণ ৫.২ বিলিয়ন ডলার (দ্য ভার্জ, ৩০ জুলাই ২০২০)। শুধু আমাজনের কথা কেন বলি? বিল গেটসের (মাইক্রোসফট) সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৮ বিলিয়ন ডলারে। তার অবস্থান দ্বিতীয়। তৃতীয় অবস্থানে আছেন ওয়ারেন বাফেট (বার্কশায়ার হাথাওয়ে), তার সম্পদের পরিমাণ ৬৭.৫ বিলিয়ন ডলার। এভাবে ওরাকলের লেরি এলিসন, ফেসবুকের মার্ক জাকারবার্গ- সবার সম্পদ বেড়েছে। আরেকটি পরিসংখ্যানে আমরা দেখতে পাই, করোনাভাইরাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বেশি মানুষ মারা গেলেও, সেখানে বিলিওনেয়ারের সংখ্যা চীনের পরে (চীনে ৭৯৯ জন, যুক্তরাষ্ট্রে ৬২৬ জন, ভারতে ১৩৭ জন। সূত্র :স্ট্যাটিস্টা)। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ধনীরা আরও ধনী হয়েছে, তেমনটি নয়। ফোর্বস যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে প্রথম ১৫ জন বিলিওনেয়ারের মাঝে ফ্রান্সের আছে দু'জন, স্পেনের একজন, মেক্সিকোর একজন। করোনাকালে ভারতেও ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। সেখানেও ধনীরা আরও ধনী হয়েছেন। ভারতে গত ছয় মাসে নতুন ১৫ জন বিলিওনেয়ারের জন্ম হয়েছে। ভারতে মোট বিলিওনেয়ারের সংখ্যা এখন ১৩৭। এই ১৩৭ জনের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি ডলার। তালিকার শীর্ষে রয়েছেন মুকেশ আম্বানি (৮৮২০ কোটি ডলার)। পরের অবস্থান যথাক্রমে শিব নাদার (৮৮২০ কোটি ডলার), গৌতম আদানি (১৮৬০ কোটি ডলার), রাধাকৃষ্ণ দামানি (১৫২০ কোটি ডলার)। নতুন শতকোটিপতিদের তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, তারা হচ্ছেন বিমল কুমার জগদচাদানি, বিনি বনসল, রাধোশ্যাম গোয়েনকা প্রমুখ (আনন্দবাজার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)। করোনাকালে ভারতে শতকোটিপতির সংখ্যা বেড়ে যাওয়াকে অর্থনীতিবিদরা সেখানে ধনী ও গরিবদের মধ্যে পার্থক্য আরও বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ হিসেবেই দেখছেন। এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে দেব? একদিকে করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না, মৃত্যুর সংখ্যা এখনও বাড়ছে। অন্যদিকে ধনীর সংখ্যা বাড়ছে, ধনীরা আরও ধনী হচ্ছেন। অথচ ভারতের অর্থনীতি ভালো নয়। ভারতে জিডিপি গত ৪০ বছরের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। কাজ হারিয়েছেন ৪১ লাখ মানুষ (আইএলও তথ্যমতে)। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকের জিডিপি সংকুচিত হয়েছে ২৩.৯ শতাংশ। আর্থিক সংকটের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মুকেশ আম্বানির 'রিলায়েন্স' গ্রুপ গুগল ও ফেসবুকের মতো অনলাইন সংস্থায় বিনিয়োগ করেছে ও তার মূলধন বেড়েছে। করোনাভাইরাস ভারতে ধনীদের আরও ধনী করেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা কী? বাংলাদেশেও করোনাকালে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। গত মার্চ থেকে জুন (২০২০) এই চার মাসে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ৮৬ হাজার ৩৭ জন। মার্চে এ সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫ জন। করোনার সময় ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে বলে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে (বিডিটুডে, ১৬ সেপ্টেম্বর)। আবার যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতির দিকে ফিরে যাই। যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এই নভেম্বরের আগেই দ্বিতীয় আরেকটি 'ওয়েভ' বা ঢেউ যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানতে পারে। স্বাস্থ্যসেবায় অব্যবস্থাপনা সেখানে চরমে। মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার জন্য নোয়াম চমস্কি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দায়ী করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার কলেজের প্রফেসর থমাস মাগাস্টাডট ২৮ সেপ্টেম্বর নিউজ পোর্টাল 'নেশন অব চেঞ্জ'-এ যুক্তরাষ্ট্রকে একটি 'ফেইলড স্টেট' বা ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর কারণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন, করোনাকালেও যুক্তরাষ্ট্রে ধনীরা আরও ধনী হয়েছেন, গরিব আরও গরিব হয়েছেন। 'ফ্যামিলিজ অব ইউএসএ'-এর তথ্যমতে, মহামারির সময় ৫৪ লাখ মানুষ তাদের যে স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ছিল, তা হারিয়েছে। চাকরি না থাকায় অনেকেই এখন আর ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম দিতে পারছেন না। কভিড-১৯ এর কারণে যুক্তরাষ্ট্রে নিম্ন আয়ের মানুষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হার্ভার্ডের অর্থনীতির অধ্যাপক রাজ চেট্টি কভিড-১৯-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাতে তিনি দেখিয়েছেন, নিম্ন আয়ের মানুষ যাদের বছরে আয় ২৭ হাজার ডলারের নিচে, তাদের মাঝে ১১ মিলিয়ন, অর্থাৎ এক কোটি ১০ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। কিন্তু যাদের আয় বছরে ৬০ হাজার ডলারের ওপরে, তাদের মাঝে চাকরি হারানোর সংখ্যা ৩ ভাগের ১ ভাগ। অধ্যাপক থমাস মাগাস্টাডট তার প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, যেখানে নিম্ন আয়ের মানুষদের চাকরি চলে গেছে, অথবা বেতন কমেছে, সেখানে প্রধান নির্বাহীদের বেতন বেড়েছে ৯৪০ ভাগ। চিন্তা করা যায়? এই করোনাভাইরাসকেও ব্যবসায়ীরা পুঁজি করেছে, তাদের ব্যবসা সম্প্রসারিত করেছে, তারা আরও ধনী হয়েছে। লকডাউনের কারণে অনলাইন ব্যবসা বেড়েছে। তেমনি বেড়েছে স্বাস্থ্যরক্ষা সংক্রান্ত ব্যবসা। বিশেষ করে মাস্ক কিংবা স্বাস্থ্য সুরক্ষা পোশাকের (পিপিই) চাহিদা ছিল সর্বোচ্চ। এটা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা বেড়েছে। মহামারিটি যখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং যখন সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্য সামগ্রীর চাহিদা বেড়ে যায়, তখন প্রশ্ন উঠেছিল কে অগ্রাধিকার পাবে? মানুষ না অর্থ? বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল মানুষ প্রাধান্য পায়নি। প্রাধান্য পেয়েছে অর্থ, অর্থাৎ ব্যবসা। ধনী মানুষের সংখ্যা তাই বেড়েছে। এই করোনাভাইরাস এক অর্থে আবার মানুষের মাঝে বৈষম্যও সৃষ্টি করেছে। কভিড-১৯ এর টিকার কথা আমরা সবাই জানি। এটা এখন প্রমাণিত যে, টিকা ছাড়া কভিড-১৯ এর সংক্রমণ রোধ করা যাবে না। এই টিকা আবার একধরনের 'ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের' জন্ম দিয়েছে। জন্ম দিয়েছে 'মাই নেশন ফার্স্ট' ধারণার। এর অর্থ কী? আগামী বছরের প্রথম দিকে যখন টিকা বাজারে আসবে, তখন প্রথম পাবে ধনী দেশগুলো। শত শত কোটি ডোজ টিকা দরকার। ধনী দেশগুলো আগেই টিকার অর্ডার দিয়ে বসে আছে। সুতরাং নিম্ন বা মধ্যম আয়ের দেশগুলো কবে নাগাদ টিকা পাবে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আফ্রিকার গরিব দেশগুলো রয়েছে বড় ঝুঁকিতে। কভিড-১৯ মানুষের সঙ্গে মানুষের বৈষম্য বাড়িয়েছে। ধনীরা আরও ধনী হয়েছে। গরিবরা হয়েছে আরও গরিব। কভিড-১৯-পরবর্তী 'নিউ নরমাল' যুগে এই বৈষম্য আরও স্পষ্ট হবে। Samokal 5.10.2020

0 comments:

Post a Comment