রাজনীতিবিজ্ঞানে ‘চিকেন গেম’ নামে একটি তত্ত্ব রয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি তথা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশ্লেষকরা এ তত্ত্ব ব্যবহার করে থাকেন।
যখন পরস্পরবিরোধী দুই পক্ষ সংঘর্ষের মতো একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, তখন এক ‘পক্ষ’ হাল ছেড়ে দেয়, আবার কখনো সংঘর্ষে উভয় পক্ষ ধ্বংস হয়ে যায়। এক পক্ষ যখন হাল ছেড়ে দেয় আর অন্য পক্ষ যখন কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়; তখন যে ‘পক্ষ’ হাল ছেড়ে দেয়, তাকে ‘চিকেন’ বলে। এখানে ‘চিকেন’ ভীরু বা কাপুরুষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। ‘চিকেন গেম’ তত্ত্বে এক ‘পক্ষ’ হুমকি দিয়ে বিজয়ী হয়। অতি সাম্প্রতিককালে পারমাণবিক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান দ্বন্দ্ব ‘চিকেন গেম’ তত্ত্ব দ্বারা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। মিয়ানমারের সংকটকেও আমরা ‘চিকেন গেম’ তত্ত্ব দ্বারা বিশ্লেষণ করতে পারি। এখানে ‘চিকেন’ কে? সেনাবাহিনী? নাকি নেতৃত্বহীন সাধারণ মানুষ?
প্রায় এক মাস হতে চলল মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। নভেম্বরের (২০২০) যে নির্বাচনে অং সান সু চির দল বিজয়ী হয়েছিল, সেনাবাহিনী তাকে আবার ক্ষমতায় যেতে দেয়নি; বরং নির্বাচন বাতিল করে দেশে সামরিক আইন জারি করেছে। প্রথম দিকে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে একটি নমনীয় ভাব লক্ষ করা গেলেও গেল সপ্তাহে সেখানে বড় ধরনের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। পুলিশের গুলিতে দু’জন বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। মজার ব্যাপার, এ বিক্ষোভ সংঘটনের ডাক দেয়নি অং সান সু চির দল এনএলডি। এ বিক্ষোভ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং বিদেশি মিডিয়াগুলো আমাদের জানাচ্ছে- কোনো ধরনের নেতৃত্ব ছাড়াই সেখানে বিক্ষোভ সংঘটিত হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, বিক্ষোভকারী ও সেনাবাহিনী পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে। এ পরিস্থিতি মিয়ানমারকে কোথায় নিয়ে যাবে? সেনাবাহিনী ক্ষমতা সিভিলিয়ানদের কাছে ফিরিয়ে দেবে, নাকি সেনাবাহিনী আরও কঠোর হবে? মিয়ানমারের ইতিহাসে বিক্ষোভের মুখে সেনাবাহিনীর নতি স্বীকারের ইতিহাস আছে। পাঠক জাফরান বিপ্লব বা Saffron Revolution-এর কথা স্মরণ করতে পারেন। মিয়ানমারের দীর্ঘ ইতিহাসে যেখানে সেনাবাহিনী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে; সেখানে স্যাফরন রেভ্যুলিউশন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল।
মিয়ানমারের রাজনৈতিক উন্নয়নে স্যাফরন রেভ্যুলিউশন-এর একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। অন্যান্য দেশের কালার রেভ্যুলিউশন সঙ্গে এ বিপ্লবকে মেলানো যায়। ২০০৭ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ পরিচালিত হয়েছিল, তা মিয়ানমারের ইতিহাসে স্যাফরন রেভ্যুলিউশন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ওই বিপ্লবের পুরোভাগে ছিলেন বৌদ্ধধর্মের ভিক্ষুরা ও সেই সঙ্গে ছাত্ররা। সামরিক জান্তা জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করলে ধর্মীয় নেতারা এর প্রতিবাদে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিলেন। ধর্মীয় নেতারা শরীরে যে চাদর ব্যবহার করেন, তা হচ্ছে স্যাফরন বা জাফরানি রঙের, যা কিনা হলুদ ও লাল রঙের মিশ্রণে নতুন এক রং। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এ চাদর সব সময় ব্যবহার করেন।
সম্ভবত এ কারণেই সামরিক জান্তাবিরোধী ওই আন্দোলন চিহ্নিত হয়েছিল জাফরান রেভ্যুলিউশন হিসাবে। ওই রেভ্যুলিউশন বেশ কিছু পরিবর্তন সাধন করেছিল মিয়ানমারে। যেমন, ওই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল বৌদ্ধ ধর্মের ভিক্ষুরা মিয়ানমারে একটি শক্তি। শান্তিপূর্ণ ও অহিংস পদ্ধতিতে তারা পরিবর্তন আনতে চায়। ওই বিপ্লব সামরিক জান্তাকে সংস্কারে যেতে বাধ্য করেছিল এবং ওই বিপ্লবের রেশ ধরে সামরিক জান্তা শেষ অবধি ২০১৫ সালে নির্বাচন দেয়; যার মাধ্যমে অং সান সু চি ক্ষমতাসীন হন।
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের গায়ের স্যাফরন রঙের চাদর বিপ্লবের প্রতীক হয়ে উঠেছিল মিয়ানমারে। অহিংস পদ্ধতিতে যে সরকারকে বাধ্য করা যায় সংস্কারে যেতে, মিয়ানমারের স্যাফরন রেভ্যুলিউশন ছিল তার বড় প্রমাণ। কিন্তু ২০২১ সালে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ ঘনীভূত হচ্ছে, তার সঙ্গে স্যাফরন রেভ্যুলিউশনের মিল খুঁজে পাওয়া হয়তো যাবে না। কেননা, এখন অবধি বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাদের বিখ্যাত জাফরানি রঙের চাদর গায়ে জড়িয়ে বিক্ষোভে অংশ নেননি। ফলে এটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণকে কতটুকু সমর্থন করছেন।
এটা ঠিক ‘স্যাফরন রেভ্যুলিউশন’ সফল হয়নি। তবে একটি আবেদন রেখে গেছে। অর্থাৎ বৌদ্ধরা যে শুধু শান্তির কথা, অহিংস নীতির কথা প্রচার করেন, তাই নয়; বরং রাজনৈতিকভাবেও তারা যে বড় একটি শক্তি, মিয়ানমারের প্রেক্ষাপটে তারা তা প্রমাণ করেছিলেন। সেনাবাহিনীর প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে এখানে যে, তারা অতীতে এ ভিক্ষুদের তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। তবে বর্তমানে সেনাবাহিনীবিরোধী যে গণআন্দোলন গড়ে উঠছে, তার সঙ্গে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নিজেদের সম্পর্কিত করেনি। সেনাবাহিনীর প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে এখানেই।
নেপিদো, মান্দালয়, রেঙ্গুন প্রভৃতি বড় বড় শহরে বিক্ষোভ হচ্ছে। কোথাও কোথাও সরকারি কর্মচারীরা সরকারের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ উপেক্ষা করে গণজমায়েতে যোগ দিয়েছেন। ডাক্তাররা কর্মবিরতিতে গেছেন। তাহলে কি মিয়ানমারে আবারও ক্ষমতার পালা বদলের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে? পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই- ১৯৮৭-৮৮ সালে গণবিক্ষোভের সময় জেনারেল উসান ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন সিভিলিয়ান মংমং। ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে জেনারেল সুমং তাকে উৎখাত করে। এরপর জেনারেল সুমং নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। ১৯৯০ সালের ২৭ মে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অং সান সু চির দল বিজয়ী হলেও তাকে ক্ষমতা দেয়া হয়নি; বরং বন্দি করা হয়েছিল। এর অনেক পরে ১৯৯৭ সালে সেনাবাহিনী গঠন করেছিল ‘স্টেট পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল’। এরাই পরে গঠন করে ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি। এ দলটি সেনাবাহিনী সমর্থিত।
এ দলটিকে সামনে রেখেই সেনাবাহিনী তাদের স্বার্থ আদায় করে। যদিও সর্বশেষ নির্বাচনে (২০২০) দলটি ভালো করেনি। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে জেনারেল মিন আউং হ্লাইং এখন এই দলটিকে সামনে রেখে নির্বাচন দিতে পারেন এবং দলটিকে ‘বিজয়ী’ করে নিজের ক্ষমতাকে আরও বাড়াতে পারেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে এখন অং সান সু চির বিচার হবে। তাতে ফৌজদারি অপরাধে তিনি দণ্ডিত হবেন (?) এবং আগামী নির্বাচনে তিনি অযোগ্য ঘোষিত হবেন- এ ধরনের একটি ‘গুজব’-এর জন্ম হয়েছে। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য একটি খারাপ খবর হচ্ছে- সেখানে এনএলডি বাদে অন্য কোনো বড় দলের জন্ম হয়নি। সর্বশেষ পার্লামেন্টে বিরোধী দল ছিল সেনাবাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)।
২০২০ সালের নির্বাচনে এনএলডি পেয়েছিল ১৩৮ (হাউজ অব ন্যাশনালিটিজ) ও ২৫৮ (হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ)। অন্যদিকে ইউএসডিপির আসন ছিল মাত্র ৭ ও ২৬। ফলে বোঝাই যায়, কেন সেনাবাহিনী আতঙ্কিত ছিল। যদি ইউএসডিপির ফলাফল এনএলডির আসন সংখ্যার পাশাপাশি থাকত, তাহলে সেনাবাহিনী হয়তো ক্ষমতা গ্রহণ করত না। কেননা তাদের ভয় ছিল- এনএলডি সংবিধানে পরিবর্তন এনে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা সংকুচিত করতে পারে। ২০২০ সালের নভেম্বরের ফলাফল আমাদের বলে দেয়- সেখানে কেন্দ্রীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলো সংগঠিত নয়; বরং তারা আঞ্চলিকভাবে সংগঠিত। যেমন আরাকান ন্যাশনাল পার্টির আসন মাত্র ৪, মন ইউনিটি পার্টি ৩, শান ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি ২ (মোট আসন ২২৪, হাউজ অব ন্যাশনালিটিজ) কিংবা হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ এ (মোট আসন ৪৪০, সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত ১১০) শান ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি ১৩, আরাকান ন্যাশনাল পার্টি ৪, মন ইউনিটি পার্টি ২ ইত্যাদি। এর অর্থ পরিষ্কার। মিয়ানমারে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় সেনাবাহিনীই উভয় কক্ষে (৫৬+১১০ আসন) এক রকম বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। যদিও শেষ অবধি সেনাবাহিনী নির্বাচনের ফলাফল মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং অং সান সু চিকে গৃহবন্দি করে।
মিয়ানমারে এ মুহূর্তে পক্ষ দুটি। একদিকে সেনাবাহিনী, অন্যদিকে অসংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি। এ দুই শক্তির মাঝে এখন সহাবস্থান কীভাবে সম্ভব? ‘চিকেন গেম’ তত্ত্ব অনুযায়ী এক পক্ষ হাল ছেড়ে দেবে, আরেক পক্ষ হুমকি দিয়ে ‘বিজয়ী’ হবে। তাহলে তত্ত্ব অনুযায়ী ‘চিকেন’ কে হবে? সেনাবাহিনী, নাকি অসংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি? দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একজন শীর্ষস্থানীয় বিশ্লেষক বার্টিল লিন্টনার এশিয়া টাইমসে লিখেছেন, সেনাবাহিনী ব্যবসায়িক নেতাদের গ্রেফতার করতে শুরু করেছে। তার মন্তব্য- অর্থনীতি যদি সঠিক পথে না চলে, কোভিড-১৯ যদি সঠিকভাবে মোকাবিলা করা না যায়, তাহলে ব্যাপক গণগ্রেফতার সেনাবাহিনীর ভবিষ্যৎকে একটি প্রশ্নের মুখে রাখবে (২৫ ফেব্রুয়ারি)। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন, অর্থনীতি যদি আগের জায়গায় ফিরে আসে, তাহলে তা সেনা নেতৃত্বকে সফলতা এনে দেবে। কিন্তু প্রশ্ন এখানেই। অর্থনীতি আগের জায়গায় আসবে কিনা? শুধু জাপানি কোনো কোনো কোম্পানি সেখানে তাদের কর্মকাণ্ড আপাতত স্থগিত করেছে। এর বাইরে চীন কিংবা ভারত তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছে- এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই। অন্যদিকে আরেকজন বিশ্লেষক ডেভিড হাট লিখেছেন, With sanctions having little impact, some think the best hope for a peaceful resolution lies with ASEAN. আসিয়ানকেই বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। ইতোমধ্যে আমাদের কাছে তথ্য আছে, ইন্দোনেশিয়া একটি উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, উদ্যোগটি কী? ২০২০ সালের নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়া? একটি নয়া নির্বাচন? সেনাবাহিনীর কঠোর অবস্থান? জুন মাসে সেনাপ্রধানের অবসরে যাওয়া স্পষ্টতই একটি ইঙ্গিত দেয় যে, সেনাবাহিনী সহসা হাল ছেড়ে দেবে না। দ্বিতীয় ‘স্যাফরন রেভ্যুলিউশন’-এর সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী নয়; বরং অসংগঠিত রাজনৈতিক শক্তিই কি শেষ পর্যন্ত ‘চিকেন’ এ পরিণত হতে যাচ্ছে? এটা দেখতে হলে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই
Jugantor
28.2.2021
Prof Dr Tareque Shamsur Rehman
In his Office at UGC Bangladesh
Prof Rahman With US Congressman Joseph Crowley
here you go!!!
Prof Dr Tareque Shamsur Rahman
During his stay in Germany
Prof Dr Tareque Shamsur Rahman
At Fatih University, Turkey during his recent visit.
Prof Dr Tareque Shamsur Rehman
In front of an Ethnic Mud House in Mexico
মাহবুব তালুকদার ও তার পাঁচ ‘নি’-তত্ত্ব
22:16
No comments
দেশ জুড়ে চতুর্থ ধাপের পৌর নির্বাচন যখন সম্পন্ন হয়েছে, ঠিক তখনই একজন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার আবারও আলোচনায় এসেছেন। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, কেন্দ্র দখল, ককটেল বিস্ফোরণ ও নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ ধাপের পৌর নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষ হয়। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে, গড় ভোট পড়ার হার ৬৫.৩৩ শতাংশ। এতে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোটের হার ৫৭.৬২ ভাগ ও বিএনপির ১৬.৪৪ ভাগ। মেয়র পদে ৫৪টি পৌরসভার নির্বাচন সম্পন্ন হয় (যুগান্তর, ১৬ ফেব্রুয়ারি)। এই যখন পরিস্থিতি তখন আবারও আলোচনায় এসেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। কিছুদিন ধরেই কমিশনের নানা সিদ্ধান্তে তিনি দ্বিমত (নোট অব ডিসেন্ট) পোষণ করে আসছেন। কে এম নুরুল হুদার (সিইসি) নেতৃত্বাধীন কমিশনের বিরুদ্ধে ৪২ জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, ‘দেশের ভালোর জন্য’ তার পদত্যাগের কোনো সমস্যা নেই (দেশ রূপান্তর, ১৬ ফেব্রুয়ারি)। নির্বাচন কমিশনারদের বিরুদ্ধে ‘আর্থিক অনিয়ম’ ও ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’-এর কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ওই ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক ইসি সদস্যদের পদত্যাগ দাবি করেছিলেন।
মাহবুব তালুকদার সাংবাদিকদের কাছে নিজেদের আত্মবিশ্লেষণের কথাও বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রায় সব নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে আমরা তৃপ্তিবোধ করি। কিন্তু নির্বাচন বিষয়ে আমাদের সব জনগণের উপলব্ধির সঙ্গে সেটা সংগতিপূর্ণ নয়।’ তার মতে, বর্তমান নির্বাচন এককেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। এককেন্দ্রিক নির্বাচন বহুদলীয় গণতন্ত্রের উপাদান হতে পারে না (ওই)। তার বক্তব্য স্পষ্ট। পাঁচজন সদস্য নিয়ে নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে কে এম নুরুল হুদা প্রধান নির্বাচন কমিশনার। বাকি সদস্যরা হচ্ছেন মাহবুব তালুদার, মো. রফিকুল ইসলাম, বেগম কবিতা খানম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহদাত হোসেন (অব.)। এর মধ্যে মাহবুব তালকদার তার বক্তব্যের জন্য যত বেশি আলোচিত হয়েছেন, অন্য কোনো কমিশনাররা তত আলোচিত হননি। কিছুদিন আগে তিনি পাঁচ ‘নি’ তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি (২০২০) নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এক কর্মশালায় তিনি তার ওই তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। প্রথম ‘নি’ হচ্ছে ‘নিশ্চয়তা’। অর্থাৎ নির্বাচনটি সুষ্ঠু হওয়ার নিশ্চয়তা। এই নিশ্চয়তার অর্থ ভোটার ও রাজনৈতিক দলের আস্থা সৃষ্টি। দ্বিতীয় ‘নি’ হচ্ছে ‘নিরপেক্ষতা’। এর অর্থ হচ্ছে নির্বিঘেœ ভোট প্রদান ও ভোট কার্যক্রম চালানোর প্রতিশ্রুতি। তৃতীয় ‘নি’ হচ্ছে ‘নিরাপত্তা’। এই নিরাপত্তা ভোটার, রাজনৈতিক দল ও অন্য অংশীজনের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যকরভাবে নির্বাচনকালে কমিশনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসা। চতুর্থ ‘নি’ হচ্ছে ‘নিয়মনীতি’। নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোরভাবে বিধিবিধান পরিচালনের আওতায় আনা। পঞ্চম ‘নি’ হচ্ছে ‘নিয়ন্ত্রণ’। নির্বাচন ব্যবস্থাপনা নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকা। তিনি এই কথাগুলো বলেছিলেন এমন একসময়, যখন ১ ফেব্রুয়ারি (২০২০) ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু এই নির্বাচনটি ভালো হয়নি। মাত্র ১৭ থেকে ২০ ভাগ ভোট পেয়ে দুজন ‘নগরপিতা’ হয়েছিলেন।
সিটি করপোরেশনের নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল এমন একসময় যখন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিকাশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে নানা সংবাদ প্রকাশিত হয়ে আসছিল। যদিও সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের চর্চার মূল্যায়ন করা হয়তো ঠিক হবে না। কিন্তু একটা সাধারণ ধারণা তো পাওয়া যায়ই। জনপ্রিয় সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্ট-এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২০২০ সালে গণতন্ত্র সূচকে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের বিকাশের ধারায় বাংলাদেশের অবস্থান (১৬৭ দেশের মধ্যে) দেখিয়েছিল ৮০ নম্বরে। বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছিল ‘হাইব্রিড ডেমোক্রেসি’ ক্যাটাগরিতে (ইকোনমিস্ট, ২২ জানুয়ারি ২০২০)। ‘হাইব্রিড’ (Hybrid) অর্থ অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ। অর্থাৎ ইকোনমিস্ট বলতে চেয়েছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ পরিপূর্ণ নয়। মোট ৪টি ক্যাটাগরিতে বিশ্বের গণতন্ত্রের বিকাশকে ক্যাটাগরিভুক্ত করা হয়। যেমন : Full democracies বা পূর্ণ গণতন্ত্র (৯.৮৭ পয়েন্ট নিয়ে নরওয়ে শীর্ষে), Flawed democracies বা ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র (৮ পয়েন্ট নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া রয়েছে শীর্ষে), Hybrid regimes বা অসম্পূর্ণ গণতন্ত্র বা সরকারব্যবস্থা (উত্তর মেসিডোনিয়া ৫.৯৭ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে), আর Authoritarian regimes বা কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারব্যবস্থা (৩.৯৩ পয়েন্ট নিয়ে জর্ডান রয়েছে শীর্ষে)। বাংলাদেশের পয়েন্ট ৫.৮৮। বাংলাদেশকে ‘হাইব্রিড’ শাসনব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর একটি ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ফ্রিডম হাউজ ২০১৯ সালের Freedom in the World 2019-এর যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশকে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘Partly Free’ হিসেবে। এখানে তিন ক্যাটাগরিতে দেশগুলো ভাগ করা হয়েছে (Free, Partly Free, Not free)। সামগ্রিক বিচারে দেশগুলো কতটুকু স্বাধীন, তা মূল্যায়ন করা হয়েছে। যেমন নির্বাচনীব্যবস্থা, নির্বাচনে অংশগ্রহণ, সরকারিব্যবস্থা, মিডিয়া কতটুকু স্বাধীন, আইনের শাসন কতটুকু আছে এসব বিবেচনা করেই দেশগুলোর ‘স্বাধীনতা’ ক্যাটাগরিভুক্ত করা হয়েছে। আবার ২০২০ সালে Reporters Without Borders প্রকাশ করেছে ২০১৯ সালের Press Freedom Index। এতে শীর্ষে রয়েছে নরওয়ে, এক নম্বরে। বাংলাদেশের অবস্থান এখানে ১৫০ নম্বরে (মোট ১৮০টি দেশ জরিপে স্থান পেয়েছে)। প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে যেখানে নরওয়ের স্কোর ৭.৮২, সেখানে বাংলাদেশের স্কোর ৫০.৭৪ (সর্বনিম্নে অবস্থানকারী তুর্কমিনিস্তানের স্কোর ৮৫.৪৪)। বাংলাদেশের নিচে অবস্থান সিঙ্গাপুরের, অর্থাৎ সেখানে মিডিয়ার স্বাধীনতা সীমিত। আবার বাংলাদেশের ওপর স্থান পাওয়া কম্বোডিয়া (১৪৩), পাকিস্তান (১৪২), মিয়ানমার (১৩৮), উগান্ডা (১২৫) সংবাদমাধ্যম আমাদের চেয়ে স্বাধীন এটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে!
গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়ে আছে এটা সত্য, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়। যেমন আমরা Gobal Gender Gap Index 2018-এর কথা উল্লেখ করতে পারি, যেখানে নারী-পুরুষের ক্ষমতায়নের প্রশ্নে বিভিন্ন দেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের অবস্থান আমরা দেখি ৪৮ নম্বরে (সর্বনিম্নে আছে ইয়েমেন ১৪৯ নম্বরে ও ০.৪৯৯ স্কোর নিয়ে)। সবচেয়ে ভালো অবস্থানে, অর্থাৎ ১ নম্বরে আছে আইসল্যান্ড, স্কোর ০.৮৫৮১। এখানে ৪ ক্যাটাগরিতে এই র্যাংকিং করা হয়েছে (অর্থনৈতিকভাবে অংশগ্রহণ, শিক্ষা অর্জন, স্বাস্থ্য ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন)। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশে নারী-পুরুষের ব্যবধান অনেক কম, ৫ নম্বরে। আইসল্যান্ড যেখানে ১ নম্বরে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ৫ নম্বরে থাকা, উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। আমরা আরও অনেক তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বোঝাতে পারব। প্রতিটি বিষয় বাংলাদেশের গণতন্ত্রচর্চার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া পৌরসভার নির্বাচন গণতন্ত্রচর্চার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হলেও, এর ফলাফল নিয়ে সবকিছু বিচার করা যাবে না। এটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি এটাও সত্য, ভোটগ্রহণে আমরা ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের টানতে পারছি না। একই সঙ্গে নির্বাচনি সহিংসতাকেও আমরা কমাতে পারছি না। নির্বাচন কমিশন সবার আস্থার জায়গায় পরিণত হয়েছে, তাও বলা যাবে না। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে যে আর্থিক অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল, তা নির্বাচন কমিশন প্রত্যাখ্যান করলেও, ৪২ জন বুদ্ধিজীবী যখন মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে একটি চিঠি লেখেন, তখন বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়ার আর সুযোগ থাকে না। বর্তমান কমিশন গঠিত হয়েছিল ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। এই হিসেবে এই কমিশনের মেয়াদকাল ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে যত বেশি ‘বিতর্ক’ হয়েছে, বিশেষ করে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আপত্তি উত্থাপন, অতীতে এমনটি কখনো দেখা যায়নি। অতীতে এম এ আজিজ কমিশন (২০০৫-২০০৭), এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন (২০০৭-২০১২), রাকিবউদ্দিন কমিশনও (২০১২-২০১৭) কম বিতর্কিত হয়নি। কিন্তু কে এম নুরুল হুদা কমিশন বোধকরি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে।
সাম্প্রতিককালে এই নির্বাচন কমিশন অনেকগুলো নির্বাচন আয়োজন করেছে। ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন, জাতীয় সংসদের কয়েকটি উপনির্বাচন এর মধ্যে অন্যতম। ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পর (১ ফেব্রুয়ারি ২০২০) ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ কি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছিল? আমার তা মনে হয় না। পাঠক, স্মরণ করতে পারেন, ঢাকার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পর ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘ভোটের প্রতি মানুষের অনীহা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়’ (বাংলা ট্রিবিউন, ৪ ফেব্রুয়ারি)। ভোটকেন্দ্রে মানুষের অনুপস্থিতির কথা বোঝাতে গিয়েই তিনি তখন এই কথাগুলো বলেছিলেন। আর তখন মাহবুব তালুকদারও পাঁচ ‘নি’ তত্ত্বের কথা বলেন। তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার শুধু অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত নিরপেক্ষতা, নির্বিঘে্ন ভোট প্রদান ও ভোট কার্যক্রম চালানোর প্রতিশ্রুতি, নিরাপত্তা এবং নির্বাচন কমিশনের ‘ভূমিকা’।
নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় এসবের অনুপস্থিতির কারণেই মানুষ এখন আর ভোটকেন্দ্রে যায় না। কিন্তু ভোট হয় এবং এক একটি নির্বাচনের পেছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয় (ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪৩ কোটি ২২ লাখ টাকা)। এই টাকা জনগণের ট্যাক্সের টাকা। এত বিপুল অর্থ ব্যয় করেও কেন ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনা যায় না তা খুঁজে বের করা দরকার। নির্বাচন কমিশন তার দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারে না। মাহবুব তালুকদার এই নির্বাচনে কমিশনেরই অংশ। নির্বাচন কমিশন ‘বিতর্কিত’ হলে তিনিও এই বিতর্কের ভাগীদার! নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নীতিগতভাবে ‘পদত্যাগ’ করার কথা বলেছেন। কিন্তু তার ‘পদত্যাগ’(?) আদৌ কোনো পরিবর্তন বয়ে আনবে না। তত্ত্বগতভাবে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। এ ক্ষেত্রে পুরো কমিশন যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে না পারে, তাহলে নির্বাচন কমিশন নিয়ে ‘সংকট’ থাকবেই
Desh Ripantor
24.2.2021
করোনা টিকা, ভ্যাকসিন ক‚টনীতি ও বিশ্বায়ন
09:21
No comments
করোনাভাইরাসের টিকা এ মুহূর্তে আলোচিত একটি বিষয়। বাংলাদেশে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে করোনা ভ্যাকসিনের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধানসহ অনেক মন্ত্রী ইতোমধ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত AstraZeneca’র টিকা গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ টিকা সংগ্রহ করতে পারলেও পৃথিবীর অনেক দেশই এখনো টিকা সংগ্রহ করতে পারেনি। এ করোনা টিকা ইতোমধ্যে ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত ১৭ ফেব্র“য়ারি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বলেছেন-এখন পর্যন্ত মোট ভ্যাকসিনের ৭৫ শতাংশ মাত্র ধনী ১০টি দেশের দখলে। এটাকে তিনি ‘চরম অসম ও অন্যায্য’ হিসাবে উলেখ করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের এ বক্তব্যই প্রমাণ করে, টিকা গ্রহণের প্রশ্নে বিশ্ব কীভাবে বিভক্ত হয়ে আছে।
এদিকে ‘ভ্যাকসিন ক‚টনীতি’ নিয়ে সক্রিয় হয়েছে দুটি বড় দেশ চীন ও রাশিয়া। যখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন ২০২২ সালের আগে বিশ্বের চারভাগের এক ভাগ মানুষের করোনা টিকা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই (STAT, December 45, 2020); তখন চীন ও রাশিয়া তাদের ‘ভ্যাকসিন ক‚টনীতি’ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চীন ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে, তারা গরিব দেশগুলোকে স্বল্প সুদে ঋণ দেবে; যাতে করে গরিব দেশগুলো করোনা টিকা কিনতে পারে। পশ্চিমা বিশ্ব যেখানে ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের’ জন্ম দিয়ে নিজ দেশের জনগণকে আগে টিকা দেওয়া শুরু করেছে, সেখানে চীন কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিনামূল্যে; কোথাও স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে গরিব দেশগুলোকে ভ্যাকসিন কেনার সুযোগ করে দিয়েছে। ভ্যাকসিন ক‚টনীতিতে রাশিয়াও পিছিয়ে নেই। লন্ডনের গার্ডিয়ান-এর প্রতিবেদনে (১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১) কোন কোন দেশে রাশিয়া ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছে, তার একটি তালিকাও দেয়া হয়েছে।
সারা বিশ্ব যখন কোভিড-১৯ নিয়ে উৎকণ্ঠিত এবং করোনাভাইরাসের নতুন একটি ধরন যখন নতুন করে বিশ্বকে আঘাত করেছে; তখন টিকার বিশ্বায়ন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ভ্যাকসিনের বিশ্বায়ন প্রশ্নে গরিব দেশগুলোর জন্য কোনো সুখবর নেই। বস্তুত বিশ্বায়ন গরিব দেশগুলোর ভ্যাকসিনপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারেনি। ‘মাই ন্যাশনস ফাস্ট’-এর ধারণা ভ্যাকসিনপ্রাপ্তিতে গরিব দেশগুলোকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে।
মহামারি কোভিড-১৯ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় একটি প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে-আর তা হচ্ছে বিশ্বায়ন ব্যর্থ হতে চলেছে। বিশ্বায়ন ‘নতুন এক বিশ্ব’ উপহার দিয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, বিশ্বায়ন কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কোনো বড় ভ‚মিকা পালন করতে পারেনি। Harvard Business Review স্টেভেন এ. আলটম্যান (Steven A. Altman) একটি প্রবন্ধ লিখেছেন Will covid-19 have a lasting Impact on Globalization? (May 20, 2020)| তার মতে, Current forecasts, while inevitably rough at this stage, call for a 13-32y, decline in merchandise trade, a 30-40y, reduction in foreign direct investment and a 44-80y, drop in international airtime passengers in 2020; these numbers imply a major rollback of globalizations recent gains. বক্তব্য পরিষ্কার। বিশ্বায়নে যে সফলতা পেয়েছিল বিশ্ব, তা এখন হ্রাস পেয়েছে। বলা যেতে পারে বিশ্বায়নের পতন ঘটেছে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) মতে, বৈশ্বিক বাণিজ্যও হ্রাস পেয়েছে। (WTO) -এর মতে, বৈশ্বিক বাণিজ্য ১৩ ভাগ থেকে ৩২ ভাগ হ্রাস পেয়েছে ২০২০ সালে। কারণ কোভিড-১৯ এর কারণে অনেক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০২১ সালে অর্থনীতি কিছুটা আশার আলো দেখবে, যদি কোভিড-১৯ দীর্ঘস্থায়ী না হয়। (WTO) -এর তথ্যমতে, কীভাবে পণ্যের ব্যবসায় ধস নেমেছে; তা বিভিন্ন ছক থেকে বোঝা যাবে। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীন বিশ্বে বড় রপ্তানিকারক দেশ ছিল (২৪৯৯ মিলিয়ন ডলার, বিশ্ব রপ্তানির ১৩.২ ভাগ)। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ছিল (২০১৯) বড় আমদানিকারক দেশ (২৫৬৮ বিলিয়ন ডলার, বিশ্ব আমদানির ১৩.৪ ভাগ)। কোভিড-১৯ এ আমদানি-রপ্তানিতে বড় পরিবর্তন এনেছে। এটাই বিশ্বায়নের এক ধরনের ব্যর্থতা। বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে FDI বা বৈদেশিক বিনিয়োগ একটি বড় অনুসর্গ। বিশ্ব উন্ম ুক্ত হওয়ায় FDI বেড়ে যায়। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে FDI শতকরা ৩৮ ভাগ কমে গেছে (আলটম্যান)। বৈদেশিক ভ্রমণে বড় ধস নামে করোনার সময়। বিশ্বে ৪৫ ভাগ দেশ তার নিজ সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। শতকরা ৯০ ভাগ কম যাত্রী নিয়ে বিমানগুলো কিছু রুটে চলাচল করত। ফলে ধস নামে বিমান ব্যবসায়। আলটম্যানের মন্তব্য-Thus 2020 is likely to be a low point for many globalization metrics-অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্বায়নের ছন্দপতন ঘটেছে।
কিন্তু এ ‘ছন্দপতন’-এর অর্থ কি বিশ্বায়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া? আমি আমার গ্রন্থে বিশ্বায়নের ব্যর্থতাগুলো চিহ্নিত করেছি ও নতুন এক বিশ্বায়নের কথা বলেছি (বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর : দ্বিতীয় খণ্ড)। বিশ্বায়ন মানুষের মাঝে দারিদ্র্য (আফ্রিকাতে) ও অসমতা দূর করতে পারেনি। বিশ্বায়ন একটি ‘করপোরেট’ জগতের জন্ম দিয়েছে, যেখানে ধনীরা আরও ধনী হয়েছে। করোনাকালেও বিলিয়নিয়াররা কীভাবে আরও ধনী হয়েছেন, তার পরিসংখ্যানও আমরা অন্যত্র দিয়েছি। বাংলাদেশের মতো দেশেও করোনাকালে কোটিপতিদের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে বিশ্বায়ন নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তবে বিশ্বায়নকে পরিপূর্ণভাবে অবজ্ঞা করা কিংবা বাদ দেওয়া, এটা বোধ করি সম্ভব নয়।
৫টি বিষয়ের ওপর এখন বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এগুলো হচ্ছে, Global growth patterns, supply chain policies, superpower frictions and fragility, Technological shifts এবং Public opinion । তাই আলটম্যানের মন্তব্য Covid-19 looks like a ‘bend but won’t briak crises’ for globalization । তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা হচ্ছে, কোভিড-১৯ বিশ্বায়নের যুগে একটি বড় ‘ধাক্কা’ দিয়েছে, যা বিশ্বায়নের ‘চাকা’ সচল করার জন্য যথেষ্ট নয়। আর এ জন্য বড় করপোরেট হাউজগুলোর ভ‚মিকা আজ বড়। স্টেডেন আলটম্যানের সমাপনী মন্তব্য ছিল অনেকটা এ রকম- ‘Now is the time for global corporations to show their value by harnessing the best of the worlds capabilities to end the pandemic and bolster the recovery.’ আলটম্যান নিউইর্য়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের Stern school or basemen-এর গবেষক ও Sterns canter for the globalization or Education Management-এর নির্বাহী পরিচালক।
কোভিড-১৯ একটি বড় ‘ধাক্কা’ যে দিয়েছে, তা অস্বীকার করেনি world Economic Forum-ও। তাদের এক প্রতিবেদন (Lessons form China : This is how covid-19 could affect globalization) বলা হয়েছে- ‘Globalization relies or complex links-global value chains (Gve’s)-that connect producers across multiple countries, These producers often use highly specialized intermediate goods, or ‘inputs’,- produced by only one distant, overseas supplier. Covid-19 has severely disrupted these lint’s| অধ্যাপক Jun Du (অ্যাস্টন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া), এঞ্জেলস ডেলিস (প্রভাষক, অ্যাস্টন বিশ্ববিদ্যালয়), মুস্তাফা ডউচ (গবেষক, অ্যাস্টন বিশ্ববিদ্যালয়) ও ওলেকছাণ্ডার সেপেটাইলো (প্রভাষক, অ্যাস্টন বিশ্ববিদ্যালয়) The conversation (Corona virus wan’t kill globalization but a shakeup is inevitable, may 23, 2020) এটি প্রকাশ করেছে। তাহলে কোভিড-১৯ জনিত সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব? World Economic forum বলেছে, ‘Nobody can predict the next crisis. But the most reliable and efficient insurance by for is to build a strong international co-operation network. As yet, global political cons emus on this remains elusive. But that doesn’t mean we should ever lose the ambition.’
এটাই হচ্ছে আসল কথা-আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো। কোভিড-১৯ প্রমাণ করেছে, বহুপাক্ষিকতা ছাড়া করোনাভাইরাস পরিপূর্ণভাবে উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। আশার কথা, সম্প্রতি জি-৭ এর যে ভার্চুয়াল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় এবং যাতে প্রথমবারের মতো জো বাইডেন অংশ নেন, সেখানে ধনী দেশগুলো এবং ওষুধ কোম্পানিগুলো বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোকে করোনাভাইরাসের টিকা প্রদানের ব্যাপারে প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। এ প্রতিশ্র“তিটি এলো এমন এক সময়, যখন করোনাভাইরাস রিসোর্স সেন্টার (জন্স হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়) আমাদের জানাচ্ছে-বিশ্বব্যাপী এগারো কোটিরও বেশি মানুষ কোভিড ১৯-এ সংক্রমিত হয়েছে।
সংক্রমণের সংখ্যায় এখনো যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে রয়েছে। এখানে দুই কোটি সত্তর লাখ লোক সংক্রমিত হয়েছে। বিশ্বের ধনী দেশগুলো তাদের অলীক সক্ষমতার কারণে করোনা টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারবে সত্য, কিন্তু গরিব দেশগুলো একটি বড় ঝুঁকিতে থাকবেই। Covax (Vaccine global Access) গরিব দেশগুলোর মতো ২০ ভাগ মানুষকে বিনামূল্যে এ টিকা সরবরাহের প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। কিন্তু তাতে করে বিশ্ব থেকে পরিপূর্ণভাবে কোভিড-১৯ নির্মূল করা সম্ভব হবে না। কেননা বিশ্লেষকরা বলছেন-বিশ্ব থেকে পরিপূর্ণভাবে কোভিড-১৯ নির্মূল করা না গেলে এটা আবারও ছড়িয়ে যাবে! Covex গরিব দেশগুলোকে এ টিকা দেওয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের মতো দেশও অর্থের বিনিময়ে Covex থেকে টিকা কিনতে চাচ্ছে। ইতোমধ্যে Covex ২.২৭ বিলিয়ন ডোজ কোভিড-১৯ টিকা ক্রয় নিয়ে ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা এখন অবধি তারা পায়নি (WSJ, February 20, 2021)। কেননা ধনী দেশগুলো আগেই প্রি-অর্ডার দিয়ে বসে আছে।
সুতরাং তাদের আগে টিকা দিতে হবে। বলা ভালো, বিশ্বে করোনাভাইরাসের টিকার বিপুল চাহিদা থাকা সত্তে¡ও মাত্র কয়েকটি ভ্যাকসিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে উৎপাদন ও ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে। এগুলো হচ্ছে মর্ডানা (যুক্তরাষ্ট্র), অক্সফোর্ড-অ্যাসট্রাজেনেকা (সুইডিশ-ব্রিটিশ কোম্পানি ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায়), বায়োএনটেক-ফাইজার জার্মানি), স্পুটনিক-ভি (রাশিয়া), সিনোফার্ম (চীন) ও সিনোভেক (চীন) এবং ভারতের কোভ্যাকসিন (DW)। ৭৩টি টিকা নিয়ে গবেষণা এখন শেষ পর্যায়ে। চলতি বছর আরও কিছু ভ্যাকসিন অনুমোদন পাবে। টিকার জন্য সারা বিশ্বে মানুষের হাহাকার যখন বাড়ছে, তখন ভ্যাকসিনের বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ওই কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি। খুব দ্রুত এ মহামারিটি বিশ্ব থেকে নির্মূল করা সম্ভব হবে না। সুতরাং ভ্যাকসিন প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, এর সহজলভ্যতা ও ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনাই হবে এ মুহূর্তে অগ্রাধিকার। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্লাস পয়েন্টটি হচ্ছে, আমরা জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে পেরেছি। কিন্তু যেতে হবে অনেকদূর।
Daily Jugnator
22.2.2021
একটি ছবি ও ভাষা আন্দোলনের কিছু স্মৃতি
09:18
No comments
একটি ছবি। ছবিটি ৬৯ বছর আগের তোলা। কয়েকজন নারী, একজনের হাতে একটি কালো পতাকা। পা খালি। মাঝখানের জনের বাদে বাকিদের সবার পোশাক সাদা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষার দাবিতে মিছিল। স্পট কোথায় জানি না। নিঃসন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা আজকের যেখানে শহিদ মিনার, তার আশপাশে কোথাও হবে। মাতৃভাষার দাবিতে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও যে অংশ নিয়েছিলেন, এ ছবি তার বড় প্রমাণ। একজন বাদে, ছবির কাউকেই আমি চিনি না। ওই সময় আমার জন্মও হয়নি। আর ছবির আশপাশে যারা, তাদের সন্তানদের সঙ্গেও আমার কোনো পরিচয় নেই। চিনিও না। মিছিলের সামনে সাদা শাড়িতে যিনি মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, শুধু তাকে আমি চিনি। তিনিও গত হয়েছেন অনেক বছর আগে, মাত্র ৪৯ বছর বয়সে।
যারা ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করেছেন, কিংবা আগামীতেও করবেন, তাদের কারো কাছে এ ছবিটি সংগ্রহে আছে কী না, কিংবা এই ছবির ‘গল্প’ তাদের জানা আছে কী না জানি না। কিন্তু এটা একটা ঐতিহাসিক ছবি। ছোটখাটো এই মানুষটি, যিনি মিছিলের অগ্রভাগে থেকে মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন, তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে পুলিশের হাতে তিনি গ্রেফতার বরণও করেছিলেন। এ তথ্য কোনো গবেষকরা সংরক্ষণ করেছেন কী না জানি না। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের সময়কালে যে ক’জন ছাত্রী প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের মাঝে তিনিও ছিলেন। অনেকটা অবাক করার বিষয়, ওই সময় তিনি ছাত্রী হয়েও এসএম হলের সঙ্গে ‘এটাচ্ড’ ছিলেন। থাকতেন টিকাটুলি এলাকার কোথাও। সম্ভবত কোনো আত্মীয়ের বাসায় থেকে পড়াশোনা করতেন। যদিও ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী নিবাস রোকেয়া হল চালু হয়নি। চামেলি হাউজ নামে ছোট্ট একটি ছাত্রী নিবাস চালু হয়েছিল ১৯৫৬ সালে (১৯৬৪ সালে রোকেয়া হল প্রতিষ্ঠিত হয়)। সম্ভবত এ কারণেই তিনি এসএম হলের সঙ্গে ‘এটাচ্ড’ ছিলেন। যখন রোকেয়া হল প্রতিষ্ঠিত হয়, ততদিন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাট চুকিয়েছেন।
ওই সময় মেয়েদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা সহজ ছিল না। মফস্বলের একটি ছোট্ট মহকুমা (এখন জেলা) পিরোজপুর থেকে ঢাকায় এসে তৎকালীন বক্সিবাজারে অবস্থিত ইডেন মহিলা কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। এ জন্যই টিকাটুলি এলাকায় থাকতেন, আর সেখান থেকে যেতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার খুব কাছের বন্ধুদের মাঝে ছিলেন অধ্যাপক সুফিয়া খাতুন (প্রথম মহিলা জাতীয় অধ্যাপক, প্রয়াত সৈয়দ ব্যারিস্টার ইসতিয়াক আহমদের স্ত্রী ও বিচারপতি রিফাত আহমদের মা), অধ্যাপক শরীফা খাতুন (একুশে পদকপ্রাপ্ত), অধ্যাপক হালিমা খাতুন, প্রয়াত অ্যাডভোকেট গাজীউল হক (ভাষা সৈনিক) প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় থেকেই তিনি প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি কোনো পদ-পদবির জন্য লবিং করেননি। আইন পেশায় নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা অ্যাডভোকেট। পরবর্তীতে তিনি নোটারি পাবলিকের দায়িত্বও পালন করেছেন। কাজ করেছেন ব্যারিস্টার ইসতিয়াক আহমদ, ও ব্যারিস্টার রফিকুল হকের জুনিয়র হিসাবে।
প্রগতিশীল রাজনীতি করলেও, তিনি রাষ্ট্রের কাছ থেকে কখনও কোনো রাজনৈতিক সুবিধা নেননি। ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা নিয়েও সেভাবে আলোচনা হয়নি। তিনি নিজেও চাননি। বরাবরই পর্দার অন্তরালের মানুষ ছিলেন তিনি। ছোটখোট এ মানুষটি যে কত সাহসী ছিলেন, তার বড় প্রমাণ তিনি জেলগেটে বিয়ে করেছিলেন তৎকালীন প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের আরেক নেতা আনোয়ার জাহিদকে।
প্রগতিশীল রাজনীতি করার কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে সবার সঙ্গেই তার পরিচয় ছিল। তার পুরনো পল্টনের বাসায় আমি নিজে অনেকদিন প্রয়াত তাজউদ্দীন আহমদকে দেখেছি গাজীউল হককে দেখেছি। তাজউদ্দীনের মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পরও তিনি আসতেন। বঙ্গবন্ধুও তাকে চিনতেন। যতদূর মনে পড়ে শুনেছি বঙ্গবন্ধু তাকে তাজউদ্দীন আহমদের মাধ্যমে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া ও মহিলাদের সংরক্ষিত আসন থেকে তাকে সংসদ সদস্য হিসাবে মনোনয়ন দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রাজনীতিতে জড়িত হতে চাননি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর প্রয়াত মসিউর রহমান (যাদু মিয়া) তাকে রাজনীতিতে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। তখনও তিনি রাজি হননি। পল্টনের বাসায় ‘যাদু চাচা’ই (আমি তাকে এ নামেই ডাকতাম) লন্ডনে তার ছেলে স্বপন ভাইকে আমার জন্য একটি চিঠি দিয়েছিলেন, যাতে করে লন্ডনে আমার জন্য একটি থাকার ব্যবস্থা তিনি করে দেন। চীনের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরপরই যে বেসরকারি একটি প্রতিনিধি দল চীনে গিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তার অন্যতম সদস্য। চীনের ‘বন্ধু’ ছিলেন তিনি। যে কারণে তার মৃত্যুর পর চীনা রাষ্ট্রদূত তার কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে সুদূর ডুমরিতলা (পিরোজপুর) ছুটে গিয়েছিলেন।
লোভ, পদ-পদবি তাকে কখনো আকৃষ্ট করেনি। তিনি চাইলে অনেক কিছু করতে পারতেন। মন্ত্রী, এমপি, অনেক কিছু তিনি হতে পারতেন। অনেকটা নিভৃতে থেকেছেন। আজ যখন দেখি রাজনীতিবিদদের ঢাকা শহরে বাড়ি, ফ্লাট, গাড়ি, তখন ভাবতে অবাক লাগে রাজনীতির শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও, তিনি এর কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি।
এই ভাষার মাসে এ মানুষটির ভাষা আন্দোলনে তার অবদানের কথা স্মরণ করছি। ছবিটি ঐতিহাসিক, এর অনেক মূল্য। যারা ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করেন, তারা তার সম্পর্কে আরও জানুন, জনগণকে জানান, এটা আমার প্রত্যাশা। রাষ্ট্র তার অবদানকে স্বীকৃতি দিক, এটাও আমার কামনা। তিনি অ্যাডভোকেট কামরুন নাহার লাইলী।
Daily Jugantor
21.2.2020
মিয়ানমারের জাফরান বিপ্লব ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা
19:23
No comments
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর গেল সপ্তাহে যে গণবিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে প্রায় ১৪ বছর আগের ‘স্যাফরন রেভ্যুলেশন’ বা ‘জাফরান বিপ্লব’-এর কথা। ২০০৭ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ পরিচালিত হয়েছিল, তা মিয়ানমারের ইতিহাসে ‘স্যাফরন রেভ্যুলেশন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ওই বিপ্লবের পুরোভাগে ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের ভিক্ষুরা, অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মের (থেরাভেদা) ধর্মীয় ব্যক্তিরা ও সেই সঙ্গে ছাত্ররা। সামরিক জান্তা জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করলে (পেট্রল/ডিজেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ, আর সিএনজিচালিত বাসে শতকরা ৫০০ ভাগ বৃদ্ধি), ধর্মীয় নেতারা এর প্রতিবাদে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিলেন।
ধর্মীয় নেতারা শরীরে যে চাদর ব্যবহার করতেন, তা ছিল স্যাফরন বা জাফরানি রঙের, যা কি না হলুদ ও লাল রঙের মিশ্রণে নতুন এক রং। বৌদ্ধ ভিক্ষু বা ধর্মীয় ব্যক্তিরা এই চাদর সব সময় ব্যবহার করেন। সম্ভবত এ কারণেই সামরিক জান্তাবিরোধী ওই আন্দোলন চিহ্নিত হয়েছিল ‘স্যাফরান রেভ্যুলেশন’ হিসেবে। ওই ‘রেভ্যুলেশন’ বেশ কিছু পরিবর্তন সাধন করেছিল মিয়ানমারে। যেমন ১. ওই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল বৌদ্ধ ধর্মের ভিক্ষুরা, অর্থাৎ ধর্মীয় ব্যক্তিরা মিয়ানমারে একটি শক্তি। শান্তিপূর্ণ ও অহিংস পদ্ধতিতে তারা পরিবর্তন আনতে চায়, ২. ওই বিপ্লব সামরিক জান্তাকে সংস্কারে যেতে বাধ্য করেছিল, ৩. ওই বিপ্লবের রেশ ধরে সামরিক জান্তা শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালে নির্বাচন দেয় ও যার মাধ্যমে অং সান সু চি ক্ষমতাসীন হন।
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের গায়ের ‘স্যাফরন’ রঙের চাদর একটি বিপ্লবের প্রতীক হয়ে উঠেছিল মিয়ানমারে। অহিংস পদ্ধতিতে যে সরকারকে বাধ্য করানো যায় সংস্কারে যেতে, মিয়ানমারের ‘স্যাফরন রেভ্যুলেশন’ ছিল তার বড় প্রমাণ। কিন্তু ২০২১ সালে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ ঘনীভূত হচ্ছে, তার সঙ্গে ‘স্যাফরন রেভ্যুলেশন’-এর মিল খুঁজে পাওয়া হয়তো যাবে না।
কেননা এখন পর্যন্ত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাদের বিখ্যাত জাফরানি রঙের চাদর গায়ে জড়িয়ে বিক্ষোভে অংশ নেননি। ফলে এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণকে কতটুকু সমর্থন করছেন।
এটা ঠিক ‘স্যাফরন রেভ্যুলেশন’ সফল হয়নি। কিন্তু এর একটা আবেদন রেখে গেছে। অর্থাৎ বৌদ্ধরা যে শুধু শান্তির কথা, অহিংস নীতির কথা প্রচার করেন, শুধু তা-ই নয়। বরং রাজনৈতিকভাবেও তারা যে বড় একটি শক্তি, মিয়ানমারের প্রেক্ষাপটে, তারা তা প্রমাণ করেছিলেন। সেনাবাহিনীর প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে এখানে যে তারা অতীতে এই ভিক্ষুদের তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান তিনটি শাখার কথা জানা যায়থেরাভেদা, মহাযান এবং বজ্রযান। মিয়ানমারের বৌদ্ধরা থেরাভেদা মতবাদের অনুসারী। এরা আদি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশ্বস্ত এবং কট্টর।
মিয়ানমারের প্রেক্ষাপটে এরা প্রচন্ড রকম মুসলমান তথা রোহিঙ্গাবিদ্বেষী। এরা কার্যত মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধরাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। পাঠক আমিন ভিথারুর কথা স্মরণ করতে পারেন, যাকে নিয়ে টাইম ম্যাগাজিন (১ জুলাই ২০১৩) কভার স্টোরি করেছিল, যাকে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘বার্মিজ বিন লাদেন’ হিসেবে। সাবেক প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উৎখাত করার যে পরিকল্পনা করেছিলেন, ভিথারু তার সমর্থনে উগ্রপন্থি বৌদ্ধদের নিয়ে একটা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তার সমর্থকরা যারা মিয়ানমারে এক ধরনের সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তিনি যে ঘৃণার রাজনীতি শুরু করেছিলেন, তা ছিল বৌদ্ধ ধর্মের পরিপন্থী। তার সমর্থকরা যখন মুসলমানদের হত্যা ও আক্রমণ করছিল, তখন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট তাকে এক ‘মহান ব্যক্তি’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। ভিথারু যে মুসলমানবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তা ছড়িয়ে গিয়েছিল সর্বত্র। এই আন্দোলনের (969 Movement) পেছনে সমর্থন ছিল সেনা শাসকদের। ভিথারুকে ব্যবহার করেই সেনা শাসকরা রাখাইনে রোহিঙ্গা উৎখাতে মেতেছিল। রোহিঙ্গা উৎখাতে সেনাবাহিনীর অন্য একটি স্বার্থও ছিল আর তা হচ্ছে ব্যবসা। রাখাইনে রয়েছে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ। রাখাইনের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বও রয়েছে। এ কারণেই দেখা যায় যুগ যুগ ধরে রাখাইনে রোহিঙ্গারা যেসব অঞ্চলে ছিল, সেখান থেকে উৎখাত করে তাদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ওইসব অঞ্চল এখন বিনিয়োগের জন্য দেওয়া হয়েছে জাপানি ও চীনা বিনিয়োগকারীদের। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যা তাতমাদো নামে পরিচিত, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মিয়ানমারের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে। মূল্যবান পাথর তথা ‘জেম’-এর জন্য মিয়ানমারের বিশ্বজোড়া খ্যাতি রয়েছে। এই মূল্যবান ‘জেম’ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন শীর্ষ জেনারেলদের পত্নীরা। রাখাইনে রয়েছে এর অস্তিত্ব। ফলে রোহিঙ্গাদের উৎখাত করে সেখানে মাটির নিচ থেকে গভীর কূপ খনন করে সেই মূল্যবান ‘জেম’ আহরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আর জাপানিরা সেখানে বিনিয়োগ করছে।
চীনের আগ্রহও সবার জানা। বঙ্গোপসাগরের পাশঘেঁষে রাখাইন স্টেটের Kyautphyu-তে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে চীন। চীনের স্বার্থ এখানে দুটি। এক. গভীর সমুদ্রে যে গ্যাস ও তেল পাওয়া গেছে, তা এখান থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশে নিয়ে যাওয়া ও সেখানকার জ্বালানি চাহিদা মেটানো। যেহেতু ইউনান প্রদেশের সঙ্গে কোনো সমুদ্রবন্দর নেই, ফলে ইউনানের উৎপাদিত পণ্য ১১৩২ কিলোমিটার দূরবর্তী Kyautphyu বন্দর থেকে রপ্তানি করা। এতে করে চীনের আমদানি খরচ অনেক কমে যাবে। দুই. এই সমুদ্রবন্দর থেকে বঙ্গোপসাগরের বিদেশি নৌবাহিনীর (ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র) জাহাজের গতিবিধির ওপর নজর রাখা। ভারত মহাসাগরে চীন ও ভারতের নৌবাহিনী এক ধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এ কারণে Kyautphyu গভীর সমুদ্রবন্দরের গুরুত্ব অনেক বেশি। ভারতেরও স্বার্থ রয়েছে রাখাইন স্টেটে। সম্প্রতি হাসিনা-মোদি ভার্চুয়াল বৈঠকে বাংলাদেশ প্রস্তাবিত ত্রিদেশীয় মহাসড়কে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
প্রস্তাবিত ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড মহাসড়কে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার বিষয়টি নতুন। ভারত যে তার ‘লুক ইস্ট’ নীতি গ্রহণ করেছে, সে আলোকেই এই মহাসড়কটি এখন নির্মিত হচ্ছে। তবে এই মহাসড়ক নিয়ে ভারতেই কিছুটা বিতর্ক আছে। এই মহাসড়কটি শুরু হবে ভারত-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী Moreh-Tamu হয়ে মিয়ানমারের মান্দালয় ও নাইপেডো এবং বাগো শহর হয়ে শেষ হবে থাইল্যান্ডের Myawaddy-Mae Sot শহরে। এই মহাসড়কের কিছু অংশ ভালো থাকলেও, একটি অংশ অত্যন্ত খারাপ, যা ভারত এখন পুনর্নির্মাণ করছে। এই মহাসড়কের ব্যাপারে ভারতের স্বার্থ অনেক বেশি। কেননা, ভারত যে EastWest Economic Corridor চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তার জন্য এই মহাসড়কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে ভারতীয় পণ্য সড়কপথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেতে পারবে এবং মুক্তবাণিজ্যের সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, ভারত এই মহাসড়কটি কম্বোডিয়া, লাওস ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত নিয়ে যেতে চায়। ভারতের EastWest Economic Corridor-এর এটা অংশ। এই মহাসড়কটি যদি সম্প্রসারিত হয়, তাহলে ভারত মনে করছে ভারত-আসিয়ান বাণিজ্যে আরও ৭০ মিলিয়ন ডলার যোগ হবে (বর্তমানে এর পরিমাণ ১৪২ বিলিয়ন ডলার। যা ২০২৫ সালে ৩০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায় ভারত। এই মহাসড়কটির ব্যাপারে ভারতের মণিপুর রাজ্যে একটি মামলা চলমান। তবে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ (প্রধান বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবডের নেতৃত্বে) একটি রায়ে বলেছেন, মহাসড়কের নির্মাণকাজ চলমান থাকতে পারে (এনডিটিভি, ১১ আগস্ট ২০২০)। ২০১৬ সালে ভারত এই ত্রিদেশীয় মহাসড়কের ব্যাপারে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ওই চুক্তি বলে ভারত ১২০.৭৪ কিলোমিটার দীর্ঘ Kalewa-yagyi সড়ক নির্মাণ করছে। একই সঙ্গে ১৪৯ কিলোমিটার দীর্ঘ Tamu-Kyigone-Kalewa মহাসড়কে ৬৯টি ছোট ছোট সেতু তৈরি করছে। মিয়ানমারে ভারতের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। ভারতের ‘লুক ইস্ট’ পলিসির সফলতা নির্ভর করছে মিয়ানমারের ওপর।
পাঠক, নিশ্চয়ই কালাদান প্রজেক্টের কথা স্মরণ করতে পারেন। কালাদান প্রজেক্টের আওতায় পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা বন্দরের সঙ্গে সমুদ্রপথে ভারতের সাতবোন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত মিজোরাম রাজ্যের রাজধানী আইজল সংযুক্ত হয়েছে। কলকাতা থেকে পণ্য ৫৩৯ কিলোমিটার দূরে মিয়ানমারের সমুদ্রবন্দর সিটওয়েতে (রাখাইন) নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে কালাদান নদীর ১৫৮ কিলোমিটার অতিক্রম করে নিয়ে যাওয়া হবে নদীবন্দর পালেটাওয়াতে (মিয়ানমারের চিন স্টেট)। এরপর ১৬২ কিলোমিটার মহাসড়ক হয়ে পণ্য যাবে আইজলে। ভারত এজন্য সিটওয়ে সমুদ্রবন্দর উন্নত করছে, একই সঙ্গে মহাসড়ক উন্নয়নেও বিনিয়োগ করছে। ফলে বোঝাই যায় মিয়ানমারের ব্যাপারে ভারতের স্বার্থ কেন এত বেশি। এখন বাংলাদেশ ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড মহাসড়কে সংযুক্ত হওয়ার প্রস্তাব করছে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় এই প্রস্তাবে ভারত রাজি থাকলেও, মিয়ানমার নাও রাজি হতে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হলে এই রুট বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারত। বাংলাদেশ তার পণ্য নিয়ে সড়কপথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় যেতে পারত। ওই অঞ্চলে বাংলাদেশের পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হতে পারত। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশই লাভবান হতো। প্রস্তাবিত বিসিআইএম করিডরও সাফল্যের মুখ দেখত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় (জুন, ২০১৪) কুনমিংয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি কুনমিং-কক্সবাজার মহাসড়কের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। চীনও এ ব্যাপারে তাদের সম্মতি দিয়েছিল। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সড়কপথে চীনা পণ্য বাংলাদেশে আসত। তাতে করে চীনা পণ্যের দাম কমে যেত। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এই প্রকল্পটি ঝুলে আছে। ফলে মিয়ানমার প্রস্তাবিত বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড মহাসড়কে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিকে সমর্থন করবে কি না এটা একটা প্রশ্ন।
ফলে মিয়ানমারের সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে ওই প্রশ্নগুলো সরকারিভাবে জড়িত। অর্থাৎ পাশর্^বর্তী দুটো বড় দেশ চীন ও ভারতের স্বার্থ যখন বেশি, তখন দেশ দুটি মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করবে না। পার্শ^বর্তী আরেকটি দেশ থাইল্যান্ডেরও স্বার্থ রয়েছে (রাখাইনের গভীর সমুদ্রে প্রাপ্ত গ্যাস যাচ্ছে থাইল্যান্ডে)। যে কারণে সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যাপারে থাইল্যান্ড কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। সব মিলিয়ে মিয়ানমারে আরেকটি ‘স্যাফরন রেভ্যুলেশন’ হবে, এটা আমার মনে হয় না। তবে অতীতে সেনাবাহিনী অং সান সু চির সঙ্গে একটি ‘রাজনৈতিক সহাবস্থানে’ গিয়েছিল। আবারও সু চি সে ধরনের সহাবস্থানে যাবেন কি না সেটাই দেখার বিষয়।
Desh Rupantor
15.2.2021
অনিশ্চিত গন্তব্যে মিয়ানমার
22:40
No comments
মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের প্রায় দুই সপ্তাহ পার হওয়ার পরও দেশটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। একদিকে সামরিক সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে, অন্যদিকে সেনাবাহিনী তাদের অবস্থানও শক্তিশালী করেছে। কতগুলো বিষয় এখানে লক্ষণীয়। এক. সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং বলেছেন তিনি নির্বাচন দেবেন। আপাতত এক বছর দেশে জরুরি অবস্থা থাকবে। দুই. নির্বাচন দিলেও অং সান সু চির ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা কতটুকু? তিন. সেনা বিদ্রোহের বিরুদ্ধে যে জনঅসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে, তা কি ২০০৭-২০০৮ সালের ‘স্যাফরন রেভ্যুলেশনে’র মতো একটি বিপ্লব তথা গণজোয়ার সৃষ্টি করতে পারবে? চার. মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের এক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা মিয়ানমার সরকারের একশ’ কোটি ডলার সেনাবাহিনী যাতে ব্যবহার করতে না পারে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। পাঁচ. সেনা অভ্যুত্থান রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বড় অনিশ্চয়তায় ফেলে দিল কিনা?
আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা শেষ পর্যন্ত একটি নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে। ধারণা করছি, এ নির্বাচনটি চলতি বছরের শেষের দিকে অথবা আগামী বছরের প্রথমদিকে অনুষ্ঠিত হবে। তবে এতে করে ক্ষমতার পালাবদলের সম্ভাবনা কম। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেই ১৯৮৭-৮৮ সালের গণবিক্ষোভের সময় জেনারেল উ সান ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন সিভিলিয়ান মং মং। ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে জেনারেল সু মং তাকে উৎখাত করেন। এরপর জেনারেলরা নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। ১৯৯০ সালের ২৭ মে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অং সান সু চির দল বিজয়ী হলেও তাকে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি, বরং বন্দি করা হয়েছিল। এর অনেক পরে ১৯৯৭ সালে সেনাবাহিনী গঠন করেছিল ‘স্টেট পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল’। এরাই পরে গঠন করে ‘ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’। এ দলটি সেনাবাহিনী সমর্থিত। এ দলটিকে সামনে রেখেই সেনাবাহিনী তাদের স্বার্থ আদায় করে। যদিও সর্বশেষ নির্বাচনে (২০২০) দলটি ভালো করেনি। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে জেনারেল মিন অং হ্লাইং এখন এই দলটিকে সামনে রেখে নির্বাচন দিতে পারেন এবং দলটিকে ‘বিজয়ী’ করে নিজের ক্ষমতা আরও বাড়াতে পারেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে এখন অং সান সু চির বিচার হবে। তাতে ফৌজদারি অপরাধে তিনি দণ্ডিত হবেন (?) এবং আগামী নির্বাচনে তিনি অযোগ্য ঘোষিত হবেন-এ ধরনের একটি ‘গুজবে’র জন্ম হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, সেনাবাহিনী এ ধরনের দল গঠন করে। ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তো জমানায় ‘গোলকারে’র জন্ম দিয়ে সংসদে সেনা সদস্যদের প্রতিনিধিত্ব তিনি নিশ্চিত করেছিলেন। মিয়ানমারের মডেল অনেকটা তেমনি। এর মধ্য দিয়ে অং সান সু চির ‘রাজনৈতিক জীবনে’রও ‘মৃত্যু’ হতে যাচ্ছে! ১৯৪৫-এ জন্ম নেওয়া সু চির বয়স এখন ৭৫। তার পক্ষে আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা সম্ভব হবে না। ২০২২ সালে যে নির্বাচন হবে, আর তাতে যদি তিনি অংশ নিতে না পারেন, তাহলে তার কোনো রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আর থাকবে না। শুধু তাই নয়, তার দল এনএলডিকেও ভেঙে ফেলতে পারেন জেনারেল হ্লাইং। অতীতেও এরকমটি হয়েছিল। ২০১০ সালের নির্বাচনে এনএলডি অংশ নেয়নি। পরে উপনির্বাচনে (এপ্রিল, ২০১২) বিজয়ী হয়ে সু চি পার্লামেন্টে এসেছিলেন (তার দল উপনির্বাচনের ৪৫টি আসনের মাঝে ৪৩টিতে বিজয়ী হয়েছিল)।
২০২১ সালে পরিস্থিতি ভিন্ন। রোহিঙ্গা গণহত্যায় প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীকে সমর্থন করায় এবং সেখানে কোনো গণহত্যা হয়নি বলে দাবি করায় আন্তর্জাতিক পরিসরে সু চির গ্রহণযোগ্যতা এখন আর নেই। কৌশলে সেনাবাহিনী তাকে ব্যবহার করে এখন ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। সেনাবাহিনীর এখন আর সু চিকে প্রয়োজন নেই। তবে ইতোমধ্যে আমরা একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির খবর পেয়েছি। ১০ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের দৈনিক The Irrawaddy খবর দিয়েছে, নির্বাচিত সংসদের (২০২০) এনএলডির সদস্যরা সেনাবাহিনীর আদেশ উপেক্ষা করে সংসদের অধিবেশন আহ্বান করে অং সান সু চিকে আবার স্টেট কাউন্সেলর হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন। ‘NLD's Self-Declared Parliament Reappoints Daw Aung San Suu Kyi as Myanmar's Leader’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে শুধু বলা হয়েছে, নির্বাচনে বিজয়ী এনএলডির সদস্যরা স্বঘোষিত পার্লামেন্টের অধিবেশনে উপস্থিত হয়েছিলেন। এই ঘোষণা নিঃসন্দেহে সেনাপ্রধান জেনারেল হ্লাইংয়ের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। এ ঘটনা কার্যত এই মুহূর্তে মিয়ানমারে দুটি সরকারের অস্তিত্বের কথা বলে। এটা এখনো স্পষ্ট নয় এনএলডির এ স্বঘোষিত সরকার(!) কিভাবে এবং কোত্থেকে কাজ করবে। এ ঘোষণার ফলে অং সান সু চি এখন রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগেও অভিযুক্ত হতে পারেন। সেনাবাহিনী যে এনএলডিকে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ মনে করছে, তার বড় প্রমাণ গত ৯ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী এনএলডির সদর দপ্তরে হামলা চালায় এবং সেখানে ভাঙচুর করে (বিবিসি, ইউরো-উইকলি, ১০ ফেব্রুয়ারি)। এর অর্থ হচ্ছে, সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। এখন দেখার পালা সেনাবাহিনীকে এনএলডি কতটুকু চ্যালেঞ্জ করতে পারবে। তবে এখানে সেনাবাহিনীর একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, অত্যন্ত ক্ষমতাবান ও প্রভাব বিস্তারকারী বৌদ্ধ ভিক্ষু তথা ধর্মীয় ব্যক্তিরা রাজপথে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সরব হননি। ২০০৭ সালে স্যাফরন রেভ্যুলেশন সংগঠিত করেছিলেন বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা। এখন অবধি এই ধর্মীয় নেতারা সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যাপারে নীরব রয়েছেন। এ ক্ষেত্রে এনএলডির সমর্থকরা যদি বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতাদের সংগঠিত করতে পারেন, তাহলে তা সেনাপ্রধান জেনারেল হ্লাইংকে যে চাপে রাখবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা’ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এর আওতায় রয়েছে শীর্ষ জেনারেলদের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ নিষিদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রে মিয়ানমারের যে সম্পদ রয়েছে তা ফ্রিজ করা, মিয়ানমারের আমদানি-রপ্তানিতে কড়াকড়ি আরোপ ইত্যাদি। বাইডেন দ্রুত ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য সেনাপ্রধানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মিয়ানমারের প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ এখন ‘ফ্রিজ’ থাকবে (Nikkei Asia, ১১ ফেব্রুয়ারি)। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং জাতিসংঘ সু চির গ্রেফতার ও সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু তা কি জেনারেল হ্লাইংকে বাধ্য করবে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে? আমার তা মনে হয় না। মিয়ানমারের অতীত আমরা জানি। দেশটি অতীতে জাতিসংঘ ছেড়ে গিয়েছিল। সনাতন ডিপ্লোমেসিতে তারা বিশ্বাস করে না। তাদের প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। তারা জানে, প্রাকৃতিক সম্পদের কারণেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের দেশে আসবেন। তাই কোনো ধরনের স্যাঙ্কশন বা ব্যবস্থা মিয়ানমারের জান্তাকে বাধ্য করবে না ক্ষমতা সিভিলিয়ানদের কাছে ফিরিয়ে দিতে। International Crisis Group-এর Richard Horsey'র মতে, ‘Sanctions are important symbolically. They may have some impact on the margins, but we shouldn't pretend they are going to change the behavior of the Military' (FP, ১১ ফেব্রুয়ারি)। এটাই হচ্ছে আসল কথা। চীন, রাশিয়াসহ বৃহৎ শক্তিগুলোর অর্থনৈতিক ও স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারে। এই স্বার্থ তারা অস্বীকার করতে পারবে না। তাদের কাছে ‘রাষ্ট্র টু রাষ্ট্র’ সম্পর্কই বড়। মিয়ানমারে কোন ধরনের সরকার থাকবে, এটা তাদের বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য হচ্ছে ‘ব্যবসা’। তারা ব্যবসা বোঝে। চীনের পর সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ থাইল্যান্ডের। তারপর জাপানের স্থান। এ কারণেই থাইল্যান্ড কোনো নেতিবাচক মনোভাব দেখায়নি। তারা সরকারের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখতে চায়।
ব্যবসায়িক স্বার্থ যেখানে বেশি, সেখানে রাজনৈতিক স্বার্থ গৌণ হয়ে যায়। আর তাই রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপক আলোচিত হলেও জাপান, থাইল্যান্ড, চীন, এমনকি ভারতও মিয়ানমারে বিনিয়োগ করতে পিছপা হয়নি। চীনের বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে আলোচিত। আর ভারতের বিনিয়োগ এবং মিয়ানমারের ব্যাপারে ভারতের আগ্রহ সম্প্রতি আলোচিত হয়েছে। আমরা কিছু তথ্য দিতে পারি, যাতে বুঝতে সহজ হবে মিয়ানমারের ব্যাপারে তাদের স্বার্থ কোথায়। ১. ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মিয়ানমারে বিদেশি বিনিয়োগ ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এই অর্থ প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। অক্টোবর (২০১৯) থেকে সেপ্টেম্বর (২০২০) পর্যন্ত ২৩৪টি ‘ফরেন ইনভেস্টমেন্ট’ রেকর্ড হয়েছে সেখানে (মিয়ানমার টাইমস, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০), ২. রেঙ্গুনে নতুন একটি শিল্পপার্ক গড়ে তুলছে জার্মান ফার্ম রোলান্ড বার্জার। এখানে অর্থের পরিমাণ ধরা হয়েছে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থের বিনিময়ে জার্মান ফার্ম তৈরি করবে ব্রিজ, সড়ক ও ১০ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে একটি শিল্পপার্ক (The Irrawaddy, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০), ৩. গত ১০ মাসে মিয়ানমারে পাওয়ার সেক্টরে বিনিয়োগ এসেছে ১ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার (মিজ্জিমা, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০), ৪. ফিলিপাইনের জিকল্যাব ডিজিটাল কোম্পানি মিয়ানমারে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে, ৫. শ্রীলংকা মিয়ানমারের ট্যুরিজম সেক্টরে বিনিয়োগে উৎসাহ দেখিয়েছে।
আমি আমার একাধিক লেখায় বলার চেষ্টা করেছি, মিয়ানমারে চীনা স্বার্থ সবচেয়ে বেশি। ১৯৮৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চীন মিয়ানমারে বিনিয়োগ করেছে ২০.২৪ বিলিয়ন ডলার। ওই সময় মিয়ানমারে যত বিনিয়োগ এসেছে, তার মধ্যে চীনের বিনিয়োগ ছিল সবচেয়ে বেশি। চীন মিয়ানমারের পাওয়ার সেক্টরে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে। মোট বিনিয়োগের শতকরা ৫৭ ভাগ এই সেক্টরে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর পরের অবস্থান তেল ও গ্যাস সেক্টরে, বিনিয়োগের পরিমাণ শতকরা হিসাবে ১৮ ভাগ।
মিয়ানমার চীনের সীমান্তবর্তী দেশ। এক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক বন্ধনটা ঐতিহাসিক। একজন গবেষক ও লেখক Maung Aung গুড়ব চীন-মিয়ানমার সম্পর্ককে উল্লেখ করেছেন ‘Pauk-Phaw' হিসাবে। ‘Pauk-Phaw' বার্মিজ শব্দ। এর মধ্য দিয়ে জাতিগতভাবে দুদেশের মাঝে যে মিল আছে, তা উল্লেখ করা হয়েছে। দুদেশের সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে বার্মিজ নেতারা অতীতেও এ শব্দ ব্যবহার করেছেন। ভারত মহাসাগরে চীনের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। চীনের ‘জ্বালানি ক্ষুধা’ মেটানোর স্বার্থে দেশটি ভারত মহাসাগরে নির্বিঘ্নে তার জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায়। এ কারণেই বঙ্গোপসাগর থেকে কিয়াউকপিউতে (রাখাইন) সমুদ্রবন্দরটি চীন নির্মাণ করেছে। এর মধ্য দিয়ে চীনের স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে মিয়ানমার একটি অংশ। খুব সংগত কারণেই রোহিঙ্গা ইস্যুটি চীনের কাছে তাই প্রাধান্য পায়নি কখনো। এক সময় চীন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে চেয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমারের অসহযোগিতার কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রশ্নে কোনো জট খোলেনি।
এই যখন পরিস্থিতি তখন চীন কখনো মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যাবে বলে মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের মতো চীন, এমনকি জাপানও কোনো ধরনের ‘ব্যবস্থা’ নেওয়ার বিরুদ্ধে থাকবে। আর সামরিক জান্তার প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে এখানেই। সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেছে ক্ষমতা সিভিলিয়ানদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের বিরুদ্ধে জনমত যেমন বাড়ছে, তেমনি সেনাবাহিনীও শক্ত অবস্থানে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করা হচ্ছে। স্পষ্টতই মিয়ানমারের পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
Jugantor
14.2.2021
মিয়ানমারের সেনা বিদ্রোহ ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
21:30
No comments
মিয়ানমারের সেনা বিদ্রোহ ও শীর্ষ নেত্রী অং সান সু চি ও সে দেশের প্রেসিডেন্ট উইন মিনতকে গ্রেপ্তারের পর মিয়ানমারের রাজনীতি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান ঘটল এমন একটা সময় যখন ২০২০ সালের ৮ নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের পর ওইদিনই, অর্থাৎ ১ ফেব্রুয়ারি (২০২১) পার্লামেন্ট অধিবেশন বসার কথা। নির্বাচনে অং সান সু চি’র দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে সংসদের উভয় কক্ষে বিজয়ী হয়েছিল। তার দল ‘লিগ ফর ন্যাশনাল ডেমোক্রেসি’র নেতৃত্বে যখন আবারও সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই এই সেনা অভ্যুত্থান ঘটল।
সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সর্বশেষ ত্রিদেশীয় ভার্চুয়াল মিটিংয়ে (বাংলাদেশ-মিয়ানমার-চীন) একটি সময়সীমাও যখন নির্ধারিত হয়েছিল, ঠিক তখনই এই সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা এ প্রশ্নকে সামনে আনল যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ এখন কী?
সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে যে যুক্তিটি দাঁড় করানো হয়েছে, তা হচ্ছে নভেম্বরের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে অভ্যুত্থানের এক সপ্তাহ আগে এ ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ওই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। এর পরপরই সেনা অভ্যুত্থান ঘটল। যদিও অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করছেন সেনা অভ্যুত্থানের পেছনে এই কারণটি মূল নয়। সেনাপ্রধান জেনারেল মিন আউং হল্লাইয়ংয়ের উচ্চাভিলাষ, জুলাই মাসে তার অবসরের পর দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তির আশ্বাস না পাওয়া এবং সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত (সাংবিধানিকভাবে) তিনটি কেবিনেট পদে তার মনোনীতদের ব্যাপারে সু চি’র আপত্তিই মূল কারণ। গেল ৫ বছরে সেনাপ্রধানের সঙ্গে সু চি’র সম্পর্ক ‘ভালো’ থাকলেও, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হয়েছিল। গেল নভেম্বরে একটি নির্বাচন হয়েছিল বটে, কিন্তু তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল।
এই নির্বাচন মিয়ানমারের জন্য আদৌ কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনেনি।
গত বেশ কয়েক বছর যাবত সেনাবাহিনীর সঙ্গে অং সান সু চি’র একটি অলিখিত আঁতাত গড়ে উঠেছিল। এই আঁতাতের কারণেই তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। শুধু তাই নয়, হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অত্যন্ত নগ্নভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যায় সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। ফলে অং সান সু চি’র দলের পুনরায় ক্ষমতায় আসবেন অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন। সবাই এটা জানতেন। সেনাবাহিনী সমর্থিত একটি দল আছে বটে। কিন্তু তাদের পক্ষে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ছিল না। সেনাবাহিনী তাদের স্বার্থে সু চিকে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু তাতে করে মিয়ানমারের মূল সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। মূল সমস্যা মূলত দুটি। এক. মিয়ানমারের জাতিগত দ্বন্দ্বের একটা সমাধান। জাতিগতভাবে বিভক্ত মিয়ানমারের সশস্ত্র তথা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। গেল পাঁচ বছর অং সান সু চি এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেননি এবং এর কোনো সমাধানও করেননি। এখন সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। তারাও এ সমস্যার সমাধান করবে না। আর জাতিগত দ্বন্দ্বেরও কোনো সমাধান দিতে পারবে না সেনাবাহিনী। দুই. প্রায় ১১ লাখ মিয়ানমারের নাগরিক (রোহিঙ্গা) এখন বাংলাদেশে বাস করে। এদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সেনাবাহিনীর কোনো লক্ষণীয় উদ্যোগও থাকবে না। জনগোষ্ঠীর একটা অংশ বাইরে রেখে যে নির্বাচন হয়েছিল সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরে আসত না। যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য অং সান সু চি বিশ^ব্যাপী একসময় প্রশংসিত হয়েছিলেন এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন, তিনি এখন গণতান্ত্রিক বিশে^ একজন ঘৃণিত ব্যক্তি। তার শাসনামলেই তিনি জাতিগত দ্বন্দ্বকে উসকে দিয়েছিলেন। শুধু সেনাবাহিনীর স্বার্থেই যে তিনি কাজ করেছেন তেমনটি নয়, বরং সংখ্যাগুরু ‘বামার’দের তথা উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের স্বার্থে জাতিগত নিপীড়ন চালিয়ে যান। মিয়ানমারে মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে এই বিষয়টিকে তিনি কখনই গুরুত্ব দেননি। তাই নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক হাম্মাহ বেক যখন লেখেন, ‘Her strongest critics accuse her, as a member of the Bamar ethnic majority, of racism and an unwillingness to fight for the human right of all people in Myanmar’, তখন তিনি মিথ্যা বলেন না। নিজ ক্ষমতার স্বার্থে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও মিয়ানমারে মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি তার কাছে মুখ্য নয়। মুখ্য হচ্ছে ক্ষমতায় থাকা। এ জন্যই আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে অভিযুক্ত করা হলেও তিনি নিজে সেনাবাহিনীকে সমর্থন করে যাচ্ছেন বারবার। উগ্র বৌদ্ধরা (পাঠক বার্মিজ বিন লাদেন হিসেবে পরিচিত ভিথারুর কথা স্মরণ করতে পারেন) তাকে শুধু সমর্থনই করছে না, বরং রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে উচ্ছেদ করার উদ্যোগকেও সমর্থন করছে। হাম্মাহ বেক তার প্রতিবেদনে কাচিন প্রদেশের একজন রাজনীতিবিদ সেং নু পান (Seng Nu Pan)-এর উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে, ‘Now that she has tasted Power, don’t think she wants to share it with anyone’ (তার প্রতিবেদন How a Human Right Angel Lost her Halo, Nov 14, 2020)। এটাই হচ্ছে আসল কথা। সু চি কাউকে ক্ষমতার ভাগ দিতে চান না। যেখানে জাতিগত ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা বেশি, সেখানে জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসানে কোনো উদ্যোগ তিনি নেননি। তার এই ভূমিকা গণতান্ত্রিক বিশে^ নিন্দিত হয়েছিল। তার অনেক খেতাব প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল। এমনকি নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রত্যাহারের দাবিও করা হয়েছিল। এত কিছুর পরও শেষ রক্ষা হলো না। যে সেনাবাহিনীর সমর্থনে তিনি ‘দি হেগে’ পর্যন্ত গিয়েছিলেন, সেই সেনাবাহিনীই তাকে উৎখাত করল।
তাহলে পরিস্থিতি এখন কোন দিকে যাচ্ছে? এক বছরের জন্য সেখানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মিন্ট সওকে (Myint Swe) ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মিন্ট সও একজন সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল। তিনি সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি হয়ে প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এখন তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হলেন। এর অর্থ হচ্ছে সেনাবাহিনী সর্বত্র কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়। আর সেনাপ্রধান জেনারেল মিন আউং হল্লাইয়ংকে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে একটা ভবিষ্যৎ পথ নির্দেশনা পাওয়া যায়। জেনারেল মিন আউং হল্লাইয়ং হতে যাচ্ছেন দেশটির পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। তিনি একটি দল গঠন করতে পারেন, অথবা সেনা সমর্থিত দল ‘ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’র নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারেন। নভেম্বরের (২০২০) নির্বাচনে এই দলটি খুব ভালো করেনি। ‘হাউজ অব ন্যাশনালিটিস’-এ ২২৪ আসনের মধ্যে দলটি পেয়েছিল ৭ আসন। এনএলডি পেয়েছিল ১৩৮। সেনাবাহিনীর জন্য মনোনীত ছিল ৫৬টি আসন। আর ‘হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ’ এ দলটির আসন ছিল ৪৪০ আসনের মধ্যে ২৬ (এনএলডির ২৫৮, সেনাবাহিনী মনোনীত ১১০)। ফলে নির্বাচনী ফলাফলের ব্যাপারে দলটির অভিযোগ ছিল। এখন জেনারেল মিন আউং হল্লাইয়ং তার ক্ষমতায় থাকার জন্য এই দলটিকে ব্যবহার করতে পারেন। জুলাই মাসে (২০২১) তিনি অবসরে যাবেন। এরপর পূর্ণ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ২০২২ সালে তিনি নির্বাচন দিতে পারেন। ইতিমধ্যে সেনা সমর্থন নিয়ে যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে তাতে অং সান সু চি’র প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ রুদ্ধ। এখন এনএলডি বা ‘ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি’ দলটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার উদ্যোগ নিতে পারেন জেনারেল হল্লাইয়ং। কেননা একমাত্র অং সান সু চি-ই তাকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা রাখেন। সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের আগে তিনি কর্মীদের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সেনাবাহিনীবিরোধী কোনো গণ-অসন্তোষ সেখানে গড়ে উঠবে বলে মনে হয় না।
এখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে বলে মনে হয় না। এ বছরের মাঝামাঝি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে বলে মিয়ানমার রাজি হলেও, এই প্রক্রিয়া এখন ঝুলে যেতে পারে। সেনাবাহিনীর পেছনে সমর্থন রয়েছে উগ্র বৌদ্ধ সংগঠনগুলোর। সেনাবাহিনীও তাদের ব্যবহার করে। আর এই বৌদ্ধ সংগঠনগুলো মুসলমান তথা রোহিঙ্গাবিরোধী। ফলে সেনাবাহিনী এদের বিরুদ্ধে গিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে রাজি হবে না। তারা সময় ক্ষেপণ করবে।
মোট কথা মিয়ানমার আবারও পুরনো বৃত্তে ফিরে গেল। ১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘ সময় সেনাবাহিনী দেশটি শাসন করেছে। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন প্রথম রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। ১৯৮১ সালে তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন জেনারেল উ সান ইউ। নে উইন ক্ষমতা গ্রহণ করে গঠন করেছিলেন বার্মিজ সোশ্যালিস্ট পার্টি। উ সান ইউ দায়িত্ব নিলেও পর্দার অন্তরালে ক্ষমতা পরিচালনা করতেন নে উইন। ১৯৮৮ সালে বড় ধরনের ছাত্র বিক্ষোভে জেনারেল উ সান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। নতুন প্রেসিডেন্ট হন জেনারেল সেন লেন। কিন্তু ছাত্র বিক্ষোভের মুখে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এরপর একজন সিভিলিয়ান মং সং ক্ষমতা নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে সমঝোতার উদ্যোগ নিলেও তাতে কাজ হয়নি। আরেক জেনারেল সু মং (সেপ্টেম্বর ১৯৮৮) ক্ষমতা নেন। একই পথে ১৯৯২ সালের মে মাসে আরেক জেনারেল থান শিউ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসেন। মাঝখানে ১৯৯১ সালে একটি নির্বাচন হয়েছিল ও তাতে এনএলডি বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু সামরিক জান্তা নির্বাচনের ফলাফল বাতিল ঘোষণা করেছিল। ১৯৮৯ সালে অং সান সু চিকে অন্তরীণ করা হয়েছিল। ১৯৯৫ সালে তিনি অন্তরীণ অবস্থা থেকে ‘মুক্তি’ পেলেও নজরদারিতে ছিলেন। জেনারেল থান সিউ ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য গঠন করেছিলেন ‘স্টেট পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল’ (এসপিডিসি)। তিনি ছিলেন এর চেয়ারম্যান। তার খুব বিশ^স্ত ছিলেন জেনারেল খিন নাইয়ান্ট, যিনি মূল ক্ষমতা পরিচালনা করতেন। ২০০৪ সালে তাকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল সো উইন। ২০০৮ সালে সেনাবাহিনী একটি সংবিধান প্রণয়ন করে, যেখানে সেনাবাহিনীর জন্য সংসদে শতকরা ২৫ ভাগ সিট রিজার্ভ রাখা হয়। ২০১০ সালে সেখানে নির্বাচন হয় এবং সেনা সমর্থিত ‘ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’কে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় (এনএলডি নির্বাচনে অংশ নেয়নি)। ইতিমধ্যে সেখানে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল থাইন সেইন। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালে সেখানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবং তাতে এনএলডি বিজয়ী হয়েছিল।
ফলে এটা স্পষ্ট জেনারেল আউং হল্লাইয়ং দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতায় আসছেন। ফলে খুব সহসাই মিয়ানমার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে যাবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
Desh Ripantor
6.2.2021
শেষ রক্ষা হলো না অং সান সু চির
21:26
No comments
শেষ রক্ষা হলো না অং সান সু চির। গত ৮ নভেম্বর মিয়ানমারের নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। ১ ফেব্রুয়ারি সংসদ অধিবেশন বসার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই সেনাবাহিনী সেখানে ক্ষমতা গ্রহণ করল। অং সান সু চি ছিলেন মিয়ানমারের শীর্ষ নেত্রী, স্টেট কাউন্সিলর। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন তার দল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির নেতা উইন মিনত। সেনাবাহিনীর হাতে অং সান সু চি, উইন মিনতসহ দলের শীর্ষ নেতারা সবাই বন্দি। কার্যত সেনাপ্রধান মিন আউং হল্লাইয়ং এখন প্রেসিডেন্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। গত চার বছর অং সান সু চি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা ‘সখ্য’ তৈরি করে, সেনাবাহিনীর সব অপকর্মকে সমর্থন করে নিজে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিলেন। সেনাবাহিনী যখন ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে রাখাইন থেকে উচ্ছেদ করল, রাখাইনে গণহত্যায় জড়িত হলো, তখন অং সান সু চি অত্যন্ত নগ্নভাবে সেনাবাহিনীকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এমনকি হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সেনাবাহিনীর পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন। রোহিঙ্গা গণহত্যা ও নির্যাতনের দায়ভার সু চি এড়াতে পারেন না। এ কারণে সু চি আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত হয়েছেন। তার অনেক খেতাব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সারাবিশ্বই তার প্রতি ধিক্কার জানিয়েছিল। শুধু ক্ষমতার লোভে অং সান সু চি এতদিন ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিলেন। কিন্তু যে সেনাবাহিনীর সব অপকর্ম তিনি এতদিন সমর্থন করে এসেছিলেন, সেই সেনাবাহিনীই তাকে উৎখাত করল।
মিয়ানমারের এই সেনা অভ্যুত্থান এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যে সেনাবাহিনী এতদিন অং সান সু চির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে পর্দার অন্তরালে থেকে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিল, হঠাৎ এমন কী ঘটল যে, সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা নিতে হবে? ক্ষমতার এই পরিবর্তনের ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা? সেনাবাহিনীর এই ক্ষমতা গ্রহণ চীন ও ভারত কোন দৃষ্টিতে দেখবে?
বলা ভালো মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে আবারও জয় পেয়েছিল অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি বা এনএলডি। মিয়ানমারে পার্লামেন্ট দুকক্ষবিশিষ্ট। উচ্চকক্ষ (অসুধঃযধ ঐষঁঃঃধ)ি ২২৪ সদস্যবিশিষ্ট আর নিম্নকক্ষ (চুরঃযঁ ঐষঁঃঃধ)ি ৪৪০ সদস্যবিশিষ্ট। উভয় কক্ষেই সেনাবাহিনীর জন্য আসন সংরক্ষিত। উচ্চকক্ষে ৫৬ আসন ও নিম্নকক্ষে ১১০টি আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। ফলে নিম্নকক্ষের সব আসনে নির্বাচন হয় না। মোট ৩৩০টি আসনে নির্বাচন হয় ও বাকি আসনগুলো সেনাবাহিনী প্রধান কর্তৃক মনোনীত। উচ্চকক্ষে সব আসনে নির্বাচন হয় না। ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনে এনএলডি নিম্নকক্ষে ২৫৫ আসন পেয়ে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। এবার সর্বশেষ প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী উভয় কক্ষের ৫৬৪ আসনের মধ্যে এনএলডি ৩৪৬ (ঘোষিত ৪১৮ আসনের মধ্যে) আসন পেয়েছে। ফলে নিশ্চিত করেই অং সান সু চির দলেরই মিয়ানমারে সরকার গঠন করার কথা ছিল। তবে ওই নির্বাচন মিয়ানমারের জাতিগত দ্বন্দ্বের যেমন কোনো সমাধান দেয়নি, ঠিক তেমনি সেনা অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার জন্যও কোনো সুসংবাদ বয়ে আনবে না। অস্ট্রেলিয়ার খড়ুি ওহংঃরঃঁঃব-এর বুলেটিন ঃযব ওহঃবৎঢ়ৎবঃবৎ-এর এক প্রতিবেদনে (১২ অক্টোবর ২০২০) বলা হয়েছিল, মিয়ানমারের এই নির্বাচন ভৎবব, ভধরৎ ধহফ ংধভব হবে না। অর্থাৎ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আগে থেকেই ছিল। এটি শান্তিপূর্ণ, স্বাধীন ও অবাধ হয়নি। ইতোমধ্যে সেখানে ২৭৯০০ লোক কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছে, যা থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার চেয়ে বেশি। এখন নির্বাচনের পর এই সংখ্যা আরও বাড়ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ৫ অক্টোবর এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে একটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। সেনাবাহিনীর আপত্তিটা এখানেই। এই নির্বাচনে রাখাইনের অধিবাসী রোহিঙ্গাদের ভোট প্রদানকে অস্বীকার করা হয়েছিল। মিয়ানমারের নির্বাচনী আইনের ১০নং ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও প্রার্থিতার ক্ষেত্রে প্রার্থীকে মিয়ানমারের নাগরিক হতে হবে। ২০১০ সালের চড়ষরঃরপধষ ঢ়ধৎঃরবং ৎবমরংঃৎধঃরড়হ খড়ি পরে ২০১৪ সালে পরিবর্তন করা হয়, যাতে বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থীকে কোনো দলে যোগ দিতে হলে অথবা নির্বাচনে অংশ নিতে হলে তাকে ‘পূর্ণ’ নাগরিক হতে হবে। এই ‘পূর্ণ’ নাগরিকের বিষয়টি মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য প্রযোজ্য। তারা পূর্ণ নাগরিক নন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন সামরিক সরকার যে ডযরঃব পধৎফ ইস্যু করে, তাতে করে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ফলে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণে কোনো নির্বাচন এবার অনুষ্ঠিত হয়নি। মুসলমান রোহিঙ্গারা এবার নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। মিয়ানমার সরকার রাখাইন ও চীন স্টেটে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। ফলে ভোটারদের সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। ২০১৯ সালের ২১ জুন সরকার রাখাইন স্টেটের ৮টি টাউনশিপে ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করে। এই বিধিনিষেধ এখনো বহাল রয়েছে। ফলে মানুষ নির্বাচনসংক্রান্ত তথ্য জানতে পারেনি। কোভিড-১৯ এর কারণে কোনো নির্বাচনী প্রচারণাও হয়নি। ফলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা একটি বড় প্রশ্নের মুখে পড়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও সশস্ত্র আন্দোলন আন্তর্জাতিক সংবাদ হয়ে আসছে। সাম্প্রতিককালে রাখাইন ও চীন স্টেটে আরাকান আর্মির সশস্ত্র তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এই দুই স্টেটে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। একই কথা প্রযোজ্য কাচিন, কারেন ও শান স্টেটের ক্ষেত্রেও। সশস্ত্র সংঘর্ষের কারণে এখানে নির্বাচনে ভোট দেওয়ার পরিবেশ ছিল ন। স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ডধ ংঃধঃব-এর অবস্থাও ছিল তেমনি। ফলে নামমাত্র একটি নির্বাচন হয়েছে বটে। কিন্তু তাতে অংশগ্রহণ ব্যাপক ছিল না। সরকার তথা সেনাবাহিনীবিরোধী বক্তব্যের জন্য অনেক বিরোধীদলীয় প্রার্থী তথা সমর্থককে পেনাল কোডের ৫০৫ (বি) ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ফলে যারাই অং সান সু চি সরকারের বিরোধিতা করেছেন, তাদের স্থান এখন জেলে। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম টিভি ও বেতারে তাদের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু তাদের বক্তব্য আগে নির্বাচন কমিশন থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়েছিল। ফলে দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল যা ছিল মুক্তচিন্তার পরিপন্থী। ক্ষমতাসীন এনএলডি সরকার রাষ্ট্রীয় মিডিয়াকে ব্যবহার করেছিল, অন্যরা সেই সুযোগ পায়নি। উবসড়পৎধঃরপ চধৎঃু ভড়ৎ ধ হবি ঝড়পরঃু, ঘধঃরড়হধষ উবসড়পৎধঃরপ ঋড়ৎপব চধৎঃু, চবড়ঢ়ষবং চধৎঃু’র পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল যে, তারা সমসুযোগ পাচ্ছে না। খোদ মিয়ানমারের সংবিধানই একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে প্রধান অন্তরায়। এটি অগণতান্ত্রিকও বটে। শুধু ৭৫ ভাগ আসন পূর্ণ হয় গণতান্ত্রিকভাবে, বাকি আসন শুধু মনোনয়ন। এতে করে সেনাবাহিনীর অলিখিত কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক চরিত্রের সঙ্গে বেমানান। ২০০৮ সালে এই সংবিধান গ্রহণ করা হয়। এই সংবিধানের আলোকেই ২০১৫ সালে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল। সংবিধানে এমন সব শর্ত যুক্ত করা হয়েছে, যাতে অং সান সু চি কোনোদিনই প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। শর্তে বলা হয়েছে, ‘মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের স্বামী বা স্ত্রী বিদেশি নাগরিক হতে পারবেন না। তার সন্তানরা যদি বিদেশি নাগরিক হন, তা হলে তিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন।’ এই শর্তের কারণে সু চি কোনোদিনই প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। কেননা তার প্রয়াত স্বামী ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। তার দুই সন্তানও বিদেশি নাগরিক। সু চি এই শর্ত মেনেই নির্বাচনে গিয়েছিলেন এবং সংবিধান সংশোধনের দাবি বিভিন্ন মহল থেকে উঠলেও সেনাবাহিনীর সমর্থন এতে পাওয়া যায়নি। এবার নির্বাচনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভোট দেওয়ার সুযোগ না থাকা ও ব্যাপকসংখ্যক জনগোষ্ঠীর দেশত্যাগ এই নির্বাচনকে অর্থহীন করেছিল। সীমিত কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা সেখানে থাকলেও তাদের ভোট দেওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। রাখাইনে শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ভোট দিতে পেরেছেন।
ফলে ওই নির্বাচন মিয়ানমারের জন্য আদৌ কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনেনি। গত বেশ কয়েক বছর সেনাবাহিনীর সঙ্গে অং সান সু চির একটি অলিখিত আঁতাত গড়ে উঠেছিল। এই আঁতাতের কারণেই তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। শুধু তাই নয়, হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অত্যন্ত নগ্নভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যায় সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। ফলে অং সান সু চির দলের পুনরায় ক্ষমতায় আসটা অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন। সবাই এটা জানত সেনাবাহিনী সমর্থিত একটি দল আছে বটে। কিন্তু তাদের পক্ষে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ছিল না। আগামীতেও নেই। সেনাবাহিনী তাদের স্বার্থে সু চিকে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু তাতে করে মিয়ানমারের মূল সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। মূল সমস্যা মূলত দুটি। এক. মিয়ানমারের জাতিগত দ্বন্দ্বের একটা সমাধান। জাতিগতভাবে বিভক্ত মিয়ানমারের সশস্ত্র তথা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। গেল পাঁচ বছর অং সান সু চি এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেননি এবং এর কোনো সমাধানও করেননি। এখন সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। তারাও এ সমস্যার সমাধান করবে না। আর জাতিগত দ্বন্দ্বের কোনো সমাধান দিতে পারবে না সেনাবাহিনী। দুই. প্রায় ১১ লাখ মিয়ানমারের নাগরিক (রোহিঙ্গা) এখন বাংলাদেশে বাস করে। এদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সেনাবাহিনীর কোনো লক্ষণীয় উদ্যোগও থাকবে না। জনগোষ্ঠীর একটা অংশকে বাইরে রেখে যে নির্বাচন হয়েছিল সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরে আসবে না। যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য অং সান সু চি বিশ্বব্যাপী এক সময় প্রশংসিত হয়েছিলেন এবং নোবেল শাািন্ত পুরস্কারও পেয়েছিলেন, তিনি গণতান্ত্রিক বিশ্বে একজন ঘৃণিত ব্যক্তি। ব্যক্তিগত স্বার্থে তিনি গণহত্যার মতো বিষয়টি বারবার এড়িয়ে গেছেন। ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ নতুন কিছু নয়। মিয়ানমারে সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেছে। আবারও পুরনো বৃত্তে ফিরে গেল মিয়ানমার। একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে চলে গেল দেশটি এখন।
Amader Somoy
02. 02.2021
টিকা ছাড়া মুক্তি নেই
21:15
No comments
গেল সপ্তাহে আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল করোনা টিকা। ২৭ জানুয়ারি বহুল আলোচিত করোনা টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি এই টিকাদান কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন। এর আগে ২১ জানুয়ারি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে প্রস্তুত ২০ লাখ ডোজ ভারতের উপহার হিসাবে ঢাকায় পৌঁছায়। এটাকে বলা হচ্ছে মৈত্রীর করোনা ভ্যাকসিন। ভারত-বাংলাদেশের পাশাপাশি ভুটানে দেড় লাখ, নেপালে ১০ লাখ, মালদ্বীপে এক লাখ ডোজ ভ্যাকসিন বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ পাঠিয়েছে।
পরে সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যে চুক্তি হয়, সে চুক্তি মোতাবেক সেরাম বাংলাদেশকে প্রথম চালান হিসাবে ৫০ লাখ ডোজ পাঠিয়েছে। সরকার এক ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে গণটিকাদান কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। বলা হচ্ছে, প্রতিদিন ২ লাখ মানুষ টিকা পাবেন। এ হিসাবে প্রথম দুই মাসের প্রতি মাসে ৬০ লাখ মানুষ টিকাদানের আওতায় আসবে। তবে কিছুটা সমস্যা যে নেই, তা বলা যাবে না। করোনাভাইরাস টিকা পেতে নিবন্ধন করতে হবে সুরক্ষা নামের একটি অ্যাপে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এ অ্যাপটি তৈরি করে ২৫ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করেছে। ২৬ জানুয়ারি থেকে অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধনও শুরু হয়েছে।
তবে দুঃখজনক হচ্ছে, এ টিকা নিয়েও রাজনীতি হচ্ছে। প্রতিটি ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যখন পরস্পরবিরোধী অবস্থান, ঠিক তখনই টিকা নিয়েও বড় দুই দলের মাঝেও বিরোধ আমরা লক্ষ করি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভি যখন বলেন, ‘ভ্যাকসিন নিয়ে সরকার বিএনপিকে নিধন করতে চায়’, তখন ওবায়দুল কাদের বললেন, ‘টিকা নিয়ে মিথ্যাচার করছে বিএনপি’ (সময়ের আলো, ২৫ জানুয়ারি)। আবার মির্জা ফখরুল ইসলাম যখন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আপনি প্রথম টিকাটি নিন’, তখন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বললেন, ‘ভ্যাকসিন নিতে সন্দেহের কারণ রয়েছে’ (সময়ের আলো, ২৫ জানুয়ারি)। যদিও এই ‘সন্দেহ’ কেন, তা তিনি ব্যাখ্যা করেননি। বৈজ্ঞানিকভাবে এটা প্রমাণিত যে, টিকা ছাড়া কোভিড-১৯ থেকে মুক্তি নেই। অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষকে টিকা নিতে হবে।
ছোটবেলায় আমাদের সবার টিকা নেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। শিশুদের এখন পর্যায়ক্রমে ৬টি টিকা দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে লাখ লাখ শিশুর জীবন রক্ষা পেয়েছে। কোভিড-১৯ যেমন একটি বাস্তবতা; ঠিক তেমনি টিকাও একটি বাস্তবতা। আমরা ভারত থেকে বিনামূল্যে কিছু টিকা পেয়েছি; কিছু আমরা কিনেছি, যার প্রথম চালান এসেছে। ৩ কোটিরও বেশি ডোজ টিকা আমরা কিনব। এগুলো আসবে ভারত থেকে। রাশান টিকাও আসছে। এখন শোনা যাচ্ছে, চীনও তার টিকা নিয়ে বাংলাদেশে ট্রায়াল করবে। যৌথভাবে চীন বাংলাদেশেও টিকা উৎপাদন করতে চায়। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে করোনা টিকাটা জরুরি। কেননা ২৭ জানুয়ারির খবর- ‘দেশে ২৪ ঘণ্টায় সুস্থের চেয়ে আক্রান্ত বেশি।’ জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বিশ্বে শনাক্ত রোগীর দিক থেকে ৩১তম স্থানে আছে বাংলাদেশ। আর মৃত্যুর সংখ্যায় রয়েছে ৩৮তম অবস্থান (বিডিনিউজ২৪.কম, ২৭ জানুয়ারি)।
করোনাভাইরাসের নতুন একটি ধরনের কথাও আমরা শুনেছি। ব্রিটেনসহ আরও কয়েকটি দেশে আবার ‘লকডাউনের’ খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। বিশ্বে ইতোমধ্যে করোনা শনাক্ত ছাড়াল ১০ কোটি আর মৃত্যু প্রায় ২২ লাখের কাছাকাছি। মৃত্যুতে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় পর্যায়ক্রমে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র (মৃত্যু ৪৩৩১৭৫), ব্রাজিল (২১৭৮০৬), ভারত (১৫৩৭২০), মেক্সিকো (১৫০২৭৩)। বাংলাদেশ অত্যন্ত জনবহুল দেশ হওয়া সত্ত্বেও এখানে মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম। এ ক্ষেত্রে টিকা নিয়ে কোনো বিতর্কই কাম্য নয়। এটা ঠিক, টিকায় কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে; তবে তা মারাত্মক নয়। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে যে টিকাটি দেওয়া হচ্ছে, তা ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি করোনা ভাইরাসের টিকা কোভিশিল্ড। সেরাম ইনস্টিটিউট পৃথিবীর বড় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক; যারা প্রতিমাসে ৫ কোটি টিকা তৈরি করে। কোম্পানিটি ইতোমধ্যে তাদের উৎপাদিত টিকা মালদ্বীপ, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার ও সেশেলসে পাঠিয়েছে।
শ্রীলংকা, আফগানিস্তান, মরিশাস ও ব্রাজিলেও বাণিজ্যিক চুক্তির আওতায় এ টিকা পাঠানো হবে। তবে যাদের অ্যালার্জিজনিত সমস্যা রয়েছে, তাদের টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কেননা ‘ইন্ডিয়া টুডে’র টিভি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- এ টিকায় L-Histamine Hydrochloride ও Disodium edentate dehydrate নামে দুটি উপাদান রয়েছে, যা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। তরপরও ভারতে লাখ লাখ মানুষ এ টিকা গ্রহণ করছে। কোভিশিল্ড দেওয়া হলে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অ্যান্টিবডি তৈরি করতে শুরু করে এবং যে কোনো রকম করোনাভাইরাস দেহে ঢুকে পড়লে, তাকে আক্রমণ করতে শিখে যায়। আন্তর্জাতিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাটি প্রথমে আধা ডোজ এবং পরে পুরো ডোজ দেওয়া হলে, তার কার্যকরিতা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত হয় (বিসিসি বাংলা, ২৭ জানুয়ারি)।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু এ ভ্যাকসিন একটি বৈষম্য বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। ধনী দেশগুলো তাদের আর্থিক সক্ষমতার জোরে আগেভাগেই ভ্যাকসিন প্রি-অর্ডারের মাধ্যমে লাখ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন সংগ্রহ করেছে। যে কারণে গরিব দেশগুলো ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে পারছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে, ভ্যাকসিন নিয়ে ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে আবার অন্যরকম বিভাজন তৈরি হয়েছে। টিকা বিতরণ নিয়ে সেখানে একটা সংকট তৈরি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সতর্ক করে বলেছে, তারা করোনা টিকা রপ্তানির বিধি কঠোর করতে পারে। পরিকল্পনা অনুযায়ী যে পরিমাণ টিকা ইইউ’র ২৭টি দেশে সরবরাহের কথা, অ্যাস্ট্রাজেনেকা তা সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে ইইউ কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে যাচ্ছে।
একদিকে টিকাপ্রাপ্তি, অন্যদিকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়- উঠতি অর্থনৈতিক শক্তির দেশগুলো আছে মহাসংকটে। বাংলাদেশ কেন, ভারতের মতো দেশও মহা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। ভারত করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি রুপি বরাদ্দ করেছে। এ অর্থ গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষদের কাজে ব্যবহার হবে। বিশ্ব অর্থনীতির পরিমাণ (২০১৯) ৮৮ হাজার বিলিয়ন ডলার। করোনাভাইরাসের কারণে এ অর্থনীতিতে এখন শ্লথ গতি আসবে। অর্থের পরিমাণ বছর শেষে কমে যাবে। ২০১৯ সালে বিশ্বে জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৯ ভাগ। ২০২০ সালে এ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৩ দশমিক ৩ ভাগ। কিন্তু এখন নিশ্চিত করেই বলা যায়, এ প্রবৃদ্ধি আরও এক ভাগ কমে গেছে।
সবচেয়ে বড় ক্ষতি হতে যাচ্ছে উন্নয়নশীল বিশ্বের। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনাভাইরাসের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা এ দেশগুলোর পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ব্যর্থতা, বেকার সমস্যা বেড়ে যাওয়া, রপ্তানি খাতে ধস ইত্যাদি উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বড় সংকটের মধ্যে ফেলে দেবে। বলা ভালো, বৈশ্বিক রপ্তানিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। বৈশ্বিক রপ্তানিতে ২০০০ সালে যেখানে এ দেশগুলোর অবস্থান ছিল শতকরা ২৯ দশমিক ৭ ভাগ; ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১ ভাগে। আর ২০১৯ সালের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ অবস্থান ছিল শতকরা ৪৪ ভাগ। এতে এখন ধস নামবে। উন্নয়নশীল দেশগুলো এখন তাদের বাজার হারাবে।
বাংলাদেশের কথা যদি বলি, তাহলে বলতেই হবে- বাংলাদেশের অর্থনীতি রয়েছে ঝুঁকির মুখে। এ কথা স্বয়ং অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের প্রধানত উৎস দুটি। এক. রেমিটেন্স দুই. তৈরি পোশাক শিল্প। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে রেমিটেন্স এসেছে ১২৭৬৯ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন ডলার। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১০৭৬১.৫৯ মিলিয়ন ডলার। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এ রেমিটেন্স খাতে একটি ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। যেহেতু বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটা মন্দাভাব আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেহেতু মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে। নির্মাণ শিল্পে শ্লথ গতি আসবে, ফলে বেকার হয়ে পড়বে শত শত কর্মী, যার একটা অংশ সরবরাহ করা হয় বাংলাদেশ থেকে। যেহেতু বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের রোগী পাওয়ার কথা বিশ্ব মিডিয়ায় ছাপা হয়েছে, ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে না।
বাংলাদেশের অপর একটি বৈদেশিক আয়ের উৎস তৈরি পোশাক শিল্প। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ হচ্ছে আমাদের বড় বাজার। এ খাতে ২০১৯ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) বাংলাদেশের আয় ছিল ৩০ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালে ছিল ৩২ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। এখন এই সেক্টরে বড় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। আড়াইশ’ কোটি ডলারের ক্রয় আদেশ বাতিল হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলো এখন ক্রেতাশূন্য। একই কথা ইউরোপের প্রতিটি দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোর বড় বড় শহর ছিল ‘লক ডাউন’-এ। যেখানে মানুষ জীবন-মৃত্যুর মাঝে বসবাস করছে, সেখানে তৈরি পোশাক কিনবে কে?
এতো গেল বাংলাদেশের কথা। আফ্রিকায় রয়েছে খনিজসম্পদ, বিশেষ করে কপার ও জিঙ্ক। এর বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। এ বাজার এখন নেই। কোনো অর্ডার মিলছে না। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের দাম পড়ে গেছে। জানুয়ারিতে যে তেলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৬৫ ডলার, তা এখন ৫০ ডলারে নেমে এসেছে। শতকরা আরও ২০ ভাগ দাম পড়ে যেতে পারে। ২০ ডলারে দাম চলে আসতে পারে এমন আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ। ফলে এর একটি প্রতিক্রিয়া থাকবেই। করোনাভাইরাসের কারণে অনেক দেশ Failed State বা ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হবে। কেননা এসব রাষ্ট্র, বিশেষ করে আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলো স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারবে না। প্রয়োজনীয় ওষুধ পাওয়া যাবে না। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় যে ধরনের প্রশিক্ষিত ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী থাকা দরকার, তা তাদের নেই। ফলে রাষ্ট্র ও প্রশাসনের ব্যর্থতা অনেক রাষ্ট্রকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এমন এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই করোনা টিকা নেওয়া শুরু হয়েছে। এটা একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। দুই ডোজ করে নিতে হবে। এ জন্য দরকার কোটি কোটি ডোজ ভ্যাকসিন। বিশ্বে এখন প্রায় ২০০টির মতো প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন তৈরির দৌড়ে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রি-ট্রায়ালে রয়েছে ১৫৪টি ভ্যাকসিন। চীনের সিনোফার্ম ও উহান ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টস চূড়ান্ত ট্রায়ালে রয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়ার গামেলিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একটি ভ্যাকসিনও ট্রায়ালে রয়েছে। তারপরও অতি দ্রুত বিশ্বের সব জনগোষ্ঠীকে একসঙ্গে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা সম্ভব নয়। এটা দীর্ঘস্থায়ী একটা ব্যাপার; হয়তো ২০২২ সালের শেষ পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। এখন অবধি ইসরায়েলের ৪১.৮ ভাগ জনগোষ্ঠী, আরব আমিরাতের ২৫.১ ভাগ জনগোষ্ঠী, যুক্তরাজ্যের ১০.১ ভাগ, বাহরাইনেয় ৮.৫ ভাগ, যুক্তরাষ্ট্রের ৬.২ ভাগ, ডেনমার্কের ৩.৫ ভাগ, স্লোভেনিয়ার ২.৭ ভাগ, স্পেনের ২.৫ ভাগ, আয়ারল্যান্ড ও লিথুনিয়ার ২.৫ ভাগ জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা হয়েছে। (SIGNAL, ২৪ জানুয়ারি, ২১)।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে; ২০২১ সালের পুরোটা সময় কোভিড-১৯ টিকা আলোচনায় থাকবে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যদি একত্রিত হয়ে এগিয়ে না আসে, তাহলে বিশ্বের জন্য আরও খারাপ খবর অপেক্ষা করছে (ফরেন পলিসি, ২৮ জানুয়ারি)। চীনের সহযোগিতাও দরকার। গেল সপ্তাহে এ সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট। নতুন করে যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনার নতুন আরেকটি ধরন আবিষ্কৃত হয়েছে, তখন এ সহযোগিতা এই মুহূর্তে খুবই জরুরি।
Jugantor
31.1.2021
মিয়ানমারের সেনা বিদ্রোহ ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
21:08
No comments
কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট। গত ২০ জানুয়ারি তিনি শপথ নিয়েছেন। যেখানে ট্রাম্প একটি বিভক্ত সমাজ রেখে গেছেন এবং কৃষ্ণাঙ্গরা এখনো সেখানে বঞ্চিত, সেখানে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ভাইস প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে কতটুকু বদলে দিতে পারবেন? নানা কারণে কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। তার শরীরে যেমনি ভারতীয় রক্ত রয়েছে, তেমনি রয়েছে জ্যামাইকান রক্তও।
মা শ্যামালা গোপালন ভারতীয়, আর বাবা ডোনাল্ড হ্যারিস এসেছিলেন জ্যামাইকা থেকে। দুজন ইমিগ্রেন্টের সন্তান কমলা, জন্ম ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে। নিজেকে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে পরিচয় দিলেও, শতকরা একশ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ এটা বলা যাবে না। অনেকটাই বাদামি রং তার শরীর ধারণ করে। ট্রাম্প হ্যারিসের জন্ম ও গায়ের রং নিয়েও কটাক্ষ করেছেন। যদিও ট্রাম্প নিজেও ছিলেন ইমিগ্রেন্টের সন্তান। তবে পার্থক্যটা হলো তিনি শে^তাঙ্গ, কমলা শে^তাঙ্গ নন, তিনি বাদামি। কমলা হ্যারিসকে নিয়ে শে^তাঙ্গদের ভয়টা কি এ কারণে যে কমলা হ্যারিস ডেমোক্র্যাট দলের উঠতি স্টার! ৭৮ বছরের জো বাইডেনের রানিংমেট হয়ে কমলা কি সবাইকে জানিয়ে দিলেন তিনি আগামীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী! ২০২৪ সালের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কি কমলা হ্যারিস টার্গেট করছেন?
এটা ঠিক, আমেরিকার রাজনীতিতে ভাইস প্রেসিডেন্টের তেমন কোনো ভূমিকা থাকে না। নীতিনির্ধারণে প্রেসিডেন্টের ভূমিকাই আসল।
জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট ওবামার অধীনে ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন (২০০৯-১৭)। তবে এটা সত্য, তিনি কোনো ‘ক্যারিশমাটিক’ লিডার নন, যেমনটি ছিলেন বারাক ওবামা। এ ক্ষেত্রে কমলা হ্যারিসের নিযুক্তি ডেমোক্র্যাটদের ইমেজ বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে কিছুটা হলেও।
কমলা হ্যারিসের ভারতীয় ও জ্যামাইকান ‘কানেকশন’ ভারতীয় ও ক্যারিবীয় বংশোদ্ভূতদের মধ্যে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলতে পারে। এ ক্ষেত্রে ক্যারিবীয় কিংবা ভারতীয় আমেরিকানদের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে যে বেশি, তা বলা যাবে না। পরিসংখ্যান বলছে, ক্যারিবীয়দের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা শতকরা চার ভাগ, আর ভারতীয়দের ক্ষেত্রে ০.৯ ভাগ। নতুন প্রজন্মের ক্যারিবীয় ও ভারতীয়দের সঙ্গে তাদের আদি বাসস্থানের কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। কমলা হ্যারিসের মা এসেছিলেন চেন্নাই থেকে। তার যখন বয়স সাত বছর তখন তাদের বাবা-মার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। চেন্নাইয়ে তার মাতৃকুলের আত্মীয়স্বজনরা আছেন। তবে তাদের সঙ্গে কমলা হ্যারিসের যোগাযোগ খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। মার কারণে হিন্দু ধর্মের প্রতি তার ভালোবাসা ও ভক্তি আছে। আবার বাবার কারণে তিনি চার্চেও যান। তবে তিনি কোনো একটি বিশেষ ধর্ম পালন করেন কি না, তা জানা যায়নি। তার বাবা-মা উভয়েই উচ্চশিক্ষিত এবং পিএইচডি ডিগ্রির অধিককারী। তার বাবা ডোনাল্ড জে. হ্যারিস স্ট্যানফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। আর তার মা শ্যামালা গোপালান ব্রেস্ট ক্যানসার গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে তার স্বামী ইহুদি, তিনি ইসরায়েলের জোরালো সমর্থক।
কমলা হ্যারিস একজন আইনজীবী, ক্যালিফোর্নিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সিনেটর। জাতীয় রাজনীতিতে তিনি আসবেন, এমন কথা অনেক দিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল। তিনি নিজে জো বাইডেনের সঙ্গে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিলেন। তাতে সফল হননি। শেষ পর্যন্ত জো বাইডেনই তাকে তার রানিংমেট হিসেবে বেছে নেন। বলা ভালো, কমলা হ্যারিসই প্রথম মহিলা আফ্রিকান-আমেরিকান তথা প্রথম এশিয়ান-আমেরিকান মহিলা যিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এর আগে মাত্র দুজন মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য ছিলেন গেরালডিন আন্নে ফেরারো (১৯৭৯-৮৫)। ১৯৮৪ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ওয়াল্টার মেনডেলের সঙ্গে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। সেটা ছিল একটা বড় অগ্রগতি। মার্কিন সমাজে নারীরা উচ্চপর্যায়ে খুব এগিয়েছে, তা বলা যাবে না। সে ক্ষেত্রে আন্নে ফেরারোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ছিল উল্লেখযোগ্য একটি অগ্রগতি। কেননা এর আগে প্রতিনিধি পরিষদের দুজন সদস্য শার্লি চিসহল্ম ও পেটসি মিন্ক ১৯৭২ সালে ডেমোক্র্যাট পার্টি কনভেনশনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পার্টি তাদের মনোনয়ন দেয়নি। কিন্তু ১৯৮৪ সালে মেনডেল তার রানিংমেট হিসেবে আন্নে ফেরারোকে বেছে নিয়েছিলেন। আন্নের পথ ধরেই এসেছেন কমলা হ্যারিস। তিনি প্রেসিডেন্ট পদেও প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় তিনি জো বাইডেনের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাইডেন তার রানিংমেট হিসেবে কমলা হ্যারিসকে বেছে নিয়েছিলেন।
এ কথা বলতেই হবে কমলা হ্যারিস তার যোগ্যতা বলেই এতদূর আসতে পেরেছেন। অবৈধ অভিবাসীদের কাজের অনুমতি দিতে তিনি Dream Act (২০০১)-এর প্রস্তাব করে অভিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে জনপ্রিয় হলেও, তার ইসরায়েলপ্রীতি আরবদের কাছে তাকে জনপ্রিয় করেনি। এমনকি ভারতীয়-আমেরিকানদের কাছে তিনি যে খুব জনপ্রিয়, তারও প্রমাণ পাওয়া যায় না। কমলা হ্যারিসের স্বামীর নাম ডগলাস এমহফ, একজন আইনজীবী এবং একজন শে^তাঙ্গ। তিনি ইহুদি ধর্মাবলম্বী। কমলার সঙ্গে তার ছোট বোন মায়ার পার্থক্য এখানেইমায়া যেখানে একজন জ্যামাইকানকে বেছে নিয়েছেন তার জীবনসঙ্গী হিসেবে, সেখানে কমলা হ্যারিস একজন শে^তাঙ্গকে বেছে নিয়েছেন তার জীবনসঙ্গী হিসেবে। ডগলাস এমহফ এর আগে একবার বিয়ে করেছিলেন, সে ঘরে তার দু-সন্তান রয়েছে কোল ও এল্লা। কোল ও এল্লাকে নিজের আপন সন্তান হিসেবেই পছন্দ করেন কমলা। সন্তানরা তাকে আদর করে ডাকেন মোমালা (Momala)। সম্ভবত Mother থেকে Mo এবং Kamala থেকে mala- দুটো মিলে Momala। মাত্র ছ’বছর আগে কমলা ও ডগলাস বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কমলা এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, তার মা একবার তার ছোট বোন মায়াকে সঙ্গে নিয়ে মাদ্রাজে গিয়েছিলেন, যা আজকে চেন্নাই নামে পরিচিত। তিনি বলেছেন, তার নানা পিভি গোপালনের কাছ থেকে তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইতিহাস জেনেছেন, যা তাকে আজকে এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে। মা শ্যামালা গোপালান মারা গেলেও, বাবা ডোনাল্ড হ্যারিস ৮২ বছর বয়সে এখনো বেঁচে আছেন। তবে মজার ব্যাপার, নিজ মেয়ে কমলা হ্যারিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তিতে তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি, এমনকি তিনি মন্তব্য করতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
এখন কিছু বিষয় কমলা হ্যারিসকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এক. জো বাইডেনের বয়স ২০২৪ সালের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় গিয়ে দাঁড়াবে ৮২। একজন প্রেসিডেন্টের জন্য বয়সটা বেশি। এ ক্ষেত্রে কমলা হ্যারিসকে ডেমোক্রেটিক পার্টি মনোনয়ন দেবে কি না? এর জবাব এ মুহূর্তে জো বাইডেনই পুনরায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। দুই. মার্কিন সমাজ কি এখনো একজন নারী, একজন কৃষ্ণাঙ্গকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেবে? এর জবাব হচ্ছে ‘না’। মার্কিন সমাজ এখনো মানসিকভাবে একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। রেসিয়াল প্রশ্নেও ও কথাটা প্রযোজ্য। একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী প্রেসিডেন্ট হবেনএই মানসিকতা এখনো তৈরি হয়নি। উপরন্তু ট্রাম্প যে বিভক্তি তৈরি করে দিয়ে গেলেন এবং উত্তর-দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মধ্যে ‘বিভক্তি’ যেভাবে বাড়ছে, তাতে আরও কয়েক দশক লাগবে একটি স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে। তিন. কমলা হ্যারিসের ভারতীয় কিংবা জ্যামাইকান ‘কানেকশন’ কি বাইডেনের পররাষ্ট্র নীতিতে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে? এর জবাবও ‘না’। কেননা পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ভাইস প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিত। কমলা হ্যারিসের একটা ‘অতীত’ থাকতে পারে। কিন্তু এই ‘অতীত’ নীতিনির্ধারণে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তবে একটা বিষয়ের দিকে লক্ষ রাখতে হবে আর তা হচ্ছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সম্পর্ক। এর একটি সামরিক দিক আছে, আবার একটি স্ট্র্যাটেজিক দিকও আছে। ট্রাম্প ভারতকে ব্যবহার করেছিলেন চীনের বিরুদ্ধে। বাইডেন এটা করবেন বলে মনে হয় না। ফলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে ‘স্ট্যাটাস কো’ বহাল থাকবে। চার. কমলা হ্যারিসের বিজয় যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কি প্রভাব ফেলবে? জবাব হচ্ছে একটা ‘পজিটিভ’ দিক আছে এর। নারীবাদীরা উৎসাহিত হবেন এবং ডেমোক্র্যাট পার্টির গ্রহণযোগ্যতা এতে করে বাড়বে।
স্ট্যানফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ার পরিচালক অধ্যাপক জিসা মেনন মন্তব্য করেছেন এভাবে ‘The historic appointment of Kamala Harris to the second-highest office in the nation is momentous and will inspire generations of young girls, and especially Black and Brown girls, to aspire to positions of leadership in the nation’s highest echelons of power.।
এটাই হচ্ছে আসল কথা কমলা হ্যারিসের ঐতিহাসিক এই নিয়োগ হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ ও বাদামি রঙের তরুণীর মধ্যে একটা স্বপ্ন জাগাবে ইচ্ছে করলে তারাও সর্বোচ্চ পদে এক দিন যেতে পারবেন! কৃষ্ণাঙ্গ ও বাদামি রঙের কাছে কমলা হ্যারিস একটা আদর্শ হয়ে থাকবেন। তবে কমলা হ্যারিস একটা ‘বড়’ কিছু করতে পারবেন, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
Desh Rupantor
28 Januart 2021
Subscribe to:
Posts (Atom)