রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

করোনা টিকা, ভ্যাকসিন ক‚টনীতি ও বিশ্বায়ন

করোনাভাইরাসের টিকা এ মুহূর্তে আলোচিত একটি বিষয়। বাংলাদেশে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে করোনা ভ্যাকসিনের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধানসহ অনেক মন্ত্রী ইতোমধ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত AstraZeneca’র টিকা গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ টিকা সংগ্রহ করতে পারলেও পৃথিবীর অনেক দেশই এখনো টিকা সংগ্রহ করতে পারেনি। এ করোনা টিকা ইতোমধ্যে ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত ১৭ ফেব্র“য়ারি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বলেছেন-এখন পর্যন্ত মোট ভ্যাকসিনের ৭৫ শতাংশ মাত্র ধনী ১০টি দেশের দখলে। এটাকে তিনি ‘চরম অসম ও অন্যায্য’ হিসাবে উলে­খ করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের এ বক্তব্যই প্রমাণ করে, টিকা গ্রহণের প্রশ্নে বিশ্ব কীভাবে বিভক্ত হয়ে আছে। এদিকে ‘ভ্যাকসিন ক‚টনীতি’ নিয়ে সক্রিয় হয়েছে দুটি বড় দেশ চীন ও রাশিয়া। যখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন ২০২২ সালের আগে বিশ্বের চারভাগের এক ভাগ মানুষের করোনা টিকা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই (STAT, December 45, 2020); তখন চীন ও রাশিয়া তাদের ‘ভ্যাকসিন ক‚টনীতি’ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চীন ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে, তারা গরিব দেশগুলোকে স্বল্প সুদে ঋণ দেবে; যাতে করে গরিব দেশগুলো করোনা টিকা কিনতে পারে। পশ্চিমা বিশ্ব যেখানে ‘ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের’ জন্ম দিয়ে নিজ দেশের জনগণকে আগে টিকা দেওয়া শুরু করেছে, সেখানে চীন কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিনামূল্যে; কোথাও স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে গরিব দেশগুলোকে ভ্যাকসিন কেনার সুযোগ করে দিয়েছে। ভ্যাকসিন ক‚টনীতিতে রাশিয়াও পিছিয়ে নেই। লন্ডনের গার্ডিয়ান-এর প্রতিবেদনে (১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১) কোন কোন দেশে রাশিয়া ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছে, তার একটি তালিকাও দেয়া হয়েছে। সারা বিশ্ব যখন কোভিড-১৯ নিয়ে উৎকণ্ঠিত এবং করোনাভাইরাসের নতুন একটি ধরন যখন নতুন করে বিশ্বকে আঘাত করেছে; তখন টিকার বিশ্বায়ন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ভ্যাকসিনের বিশ্বায়ন প্রশ্নে গরিব দেশগুলোর জন্য কোনো সুখবর নেই। বস্তুত বিশ্বায়ন গরিব দেশগুলোর ভ্যাকসিনপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারেনি। ‘মাই ন্যাশনস ফাস্ট’-এর ধারণা ভ্যাকসিনপ্রাপ্তিতে গরিব দেশগুলোকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। মহামারি কোভিড-১৯ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় একটি প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে-আর তা হচ্ছে বিশ্বায়ন ব্যর্থ হতে চলেছে। বিশ্বায়ন ‘নতুন এক বিশ্ব’ উপহার দিয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, বিশ্বায়ন কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কোনো বড় ভ‚মিকা পালন করতে পারেনি। Harvard Business Review স্টেভেন এ. আলটম্যান (Steven A. Altman) একটি প্রবন্ধ লিখেছেন Will covid-19 have a lasting Impact on Globalization? (May 20, 2020)| তার মতে, Current forecasts, while inevitably rough at this stage, call for a 13-32y, decline in merchandise trade, a 30-40y, reduction in foreign direct investment and a 44-80y, drop in international airtime passengers in 2020; these numbers imply a major rollback of globalizations recent gains. বক্তব্য পরিষ্কার। বিশ্বায়নে যে সফলতা পেয়েছিল বিশ্ব, তা এখন হ্রাস পেয়েছে। বলা যেতে পারে বিশ্বায়নের পতন ঘটেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) মতে, বৈশ্বিক বাণিজ্যও হ্রাস পেয়েছে। (WTO) -এর মতে, বৈশ্বিক বাণিজ্য ১৩ ভাগ থেকে ৩২ ভাগ হ্রাস পেয়েছে ২০২০ সালে। কারণ কোভিড-১৯ এর কারণে অনেক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০২১ সালে অর্থনীতি কিছুটা আশার আলো দেখবে, যদি কোভিড-১৯ দীর্ঘস্থায়ী না হয়। (WTO) -এর তথ্যমতে, কীভাবে পণ্যের ব্যবসায় ধস নেমেছে; তা বিভিন্ন ছক থেকে বোঝা যাবে। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীন বিশ্বে বড় রপ্তানিকারক দেশ ছিল (২৪৯৯ মিলিয়ন ডলার, বিশ্ব রপ্তানির ১৩.২ ভাগ)। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ছিল (২০১৯) বড় আমদানিকারক দেশ (২৫৬৮ বিলিয়ন ডলার, বিশ্ব আমদানির ১৩.৪ ভাগ)। কোভিড-১৯ এ আমদানি-রপ্তানিতে বড় পরিবর্তন এনেছে। এটাই বিশ্বায়নের এক ধরনের ব্যর্থতা। বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে FDI বা বৈদেশিক বিনিয়োগ একটি বড় অনুসর্গ। বিশ্ব উন্ম ুক্ত হওয়ায় FDI বেড়ে যায়। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে FDI শতকরা ৩৮ ভাগ কমে গেছে (আলটম্যান)। বৈদেশিক ভ্রমণে বড় ধস নামে করোনার সময়। বিশ্বে ৪৫ ভাগ দেশ তার নিজ সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। শতকরা ৯০ ভাগ কম যাত্রী নিয়ে বিমানগুলো কিছু রুটে চলাচল করত। ফলে ধস নামে বিমান ব্যবসায়। আলটম্যানের মন্তব্য-Thus 2020 is likely to be a low point for many globalization metrics-অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্বায়নের ছন্দপতন ঘটেছে। কিন্তু এ ‘ছন্দপতন’-এর অর্থ কি বিশ্বায়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া? আমি আমার গ্রন্থে বিশ্বায়নের ব্যর্থতাগুলো চিহ্নিত করেছি ও নতুন এক বিশ্বায়নের কথা বলেছি (বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর : দ্বিতীয় খণ্ড)। বিশ্বায়ন মানুষের মাঝে দারিদ্র্য (আফ্রিকাতে) ও অসমতা দূর করতে পারেনি। বিশ্বায়ন একটি ‘করপোরেট’ জগতের জন্ম দিয়েছে, যেখানে ধনীরা আরও ধনী হয়েছে। করোনাকালেও বিলিয়নিয়াররা কীভাবে আরও ধনী হয়েছেন, তার পরিসংখ্যানও আমরা অন্যত্র দিয়েছি। বাংলাদেশের মতো দেশেও করোনাকালে কোটিপতিদের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে বিশ্বায়ন নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। তবে বিশ্বায়নকে পরিপূর্ণভাবে অবজ্ঞা করা কিংবা বাদ দেওয়া, এটা বোধ করি সম্ভব নয়। ৫টি বিষয়ের ওপর এখন বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এগুলো হচ্ছে, Global growth patterns, supply chain policies, superpower frictions and fragility, Technological shifts এবং Public opinion । তাই আলটম্যানের মন্তব্য Covid-19 looks like a ‘bend but won’t briak crises’ for globalization । তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা হচ্ছে, কোভিড-১৯ বিশ্বায়নের যুগে একটি বড় ‘ধাক্কা’ দিয়েছে, যা বিশ্বায়নের ‘চাকা’ সচল করার জন্য যথেষ্ট নয়। আর এ জন্য বড় করপোরেট হাউজগুলোর ভ‚মিকা আজ বড়। স্টেডেন আলটম্যানের সমাপনী মন্তব্য ছিল অনেকটা এ রকম- ‘Now is the time for global corporations to show their value by harnessing the best of the worlds capabilities to end the pandemic and bolster the recovery.’ আলটম্যান নিউইর্য়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের Stern school or basemen-এর গবেষক ও Sterns canter for the globalization or Education Management-এর নির্বাহী পরিচালক। কোভিড-১৯ একটি বড় ‘ধাক্কা’ যে দিয়েছে, তা অস্বীকার করেনি world Economic Forum-ও। তাদের এক প্রতিবেদন (Lessons form China : This is how covid-19 could affect globalization) বলা হয়েছে- ‘Globalization relies or complex links-global value chains (Gve’s)-that connect producers across multiple countries, These producers often use highly specialized intermediate goods, or ‘inputs’,- produced by only one distant, overseas supplier. Covid-19 has severely disrupted these lint’s| অধ্যাপক Jun Du (অ্যাস্টন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া), এঞ্জেলস ডেলিস (প্রভাষক, অ্যাস্টন বিশ্ববিদ্যালয়), মুস্তাফা ডউচ (গবেষক, অ্যাস্টন বিশ্ববিদ্যালয়) ও ওলেকছাণ্ডার সেপেটাইলো (প্রভাষক, অ্যাস্টন বিশ্ববিদ্যালয়) The conversation (Corona virus wan’t kill globalization but a shakeup is inevitable, may 23, 2020) এটি প্রকাশ করেছে। তাহলে কোভিড-১৯ জনিত সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব? World Economic forum বলেছে, ‘Nobody can predict the next crisis. But the most reliable and efficient insurance by for is to build a strong international co-operation network. As yet, global political cons emus on this remains elusive. But that doesn’t mean we should ever lose the ambition.’ এটাই হচ্ছে আসল কথা-আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো। কোভিড-১৯ প্রমাণ করেছে, বহুপাক্ষিকতা ছাড়া করোনাভাইরাস পরিপূর্ণভাবে উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। আশার কথা, সম্প্রতি জি-৭ এর যে ভার্চুয়াল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় এবং যাতে প্রথমবারের মতো জো বাইডেন অংশ নেন, সেখানে ধনী দেশগুলো এবং ওষুধ কোম্পানিগুলো বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোকে করোনাভাইরাসের টিকা প্রদানের ব্যাপারে প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। এ প্রতিশ্র“তিটি এলো এমন এক সময়, যখন করোনাভাইরাস রিসোর্স সেন্টার (জন্স হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়) আমাদের জানাচ্ছে-বিশ্বব্যাপী এগারো কোটিরও বেশি মানুষ কোভিড ১৯-এ সংক্রমিত হয়েছে। সংক্রমণের সংখ্যায় এখনো যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে রয়েছে। এখানে দুই কোটি সত্তর লাখ লোক সংক্রমিত হয়েছে। বিশ্বের ধনী দেশগুলো তাদের অলীক সক্ষমতার কারণে করোনা টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারবে সত্য, কিন্তু গরিব দেশগুলো একটি বড় ঝুঁকিতে থাকবেই। Covax (Vaccine global Access) গরিব দেশগুলোর মতো ২০ ভাগ মানুষকে বিনামূল্যে এ টিকা সরবরাহের প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। কিন্তু তাতে করে বিশ্ব থেকে পরিপূর্ণভাবে কোভিড-১৯ নির্মূল করা সম্ভব হবে না। কেননা বিশ্লেষকরা বলছেন-বিশ্ব থেকে পরিপূর্ণভাবে কোভিড-১৯ নির্মূল করা না গেলে এটা আবারও ছড়িয়ে যাবে! Covex গরিব দেশগুলোকে এ টিকা দেওয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের মতো দেশও অর্থের বিনিময়ে Covex থেকে টিকা কিনতে চাচ্ছে। ইতোমধ্যে Covex ২.২৭ বিলিয়ন ডোজ কোভিড-১৯ টিকা ক্রয় নিয়ে ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা এখন অবধি তারা পায়নি (WSJ, February 20, 2021)। কেননা ধনী দেশগুলো আগেই প্রি-অর্ডার দিয়ে বসে আছে। সুতরাং তাদের আগে টিকা দিতে হবে। বলা ভালো, বিশ্বে করোনাভাইরাসের টিকার বিপুল চাহিদা থাকা সত্তে¡ও মাত্র কয়েকটি ভ্যাকসিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে উৎপাদন ও ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে। এগুলো হচ্ছে মর্ডানা (যুক্তরাষ্ট্র), অক্সফোর্ড-অ্যাসট্রাজেনেকা (সুইডিশ-ব্রিটিশ কোম্পানি ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায়), বায়োএনটেক-ফাইজার জার্মানি), স্পুটনিক-ভি (রাশিয়া), সিনোফার্ম (চীন) ও সিনোভেক (চীন) এবং ভারতের কোভ্যাকসিন (DW)। ৭৩টি টিকা নিয়ে গবেষণা এখন শেষ পর্যায়ে। চলতি বছর আরও কিছু ভ্যাকসিন অনুমোদন পাবে। টিকার জন্য সারা বিশ্বে মানুষের হাহাকার যখন বাড়ছে, তখন ভ্যাকসিনের বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ওই কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি। খুব দ্রুত এ মহামারিটি বিশ্ব থেকে নির্মূল করা সম্ভব হবে না। সুতরাং ভ্যাকসিন প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, এর সহজলভ্যতা ও ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনাই হবে এ মুহূর্তে অগ্রাধিকার। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্লাস পয়েন্টটি হচ্ছে, আমরা জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে পেরেছি। কিন্তু যেতে হবে অনেকদূর। Daily Jugnator 22.2.2021

0 comments:

Post a Comment