রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

শেষ রক্ষা হলো না অং সান সু চির

শেষ রক্ষা হলো না অং সান সু চির। গত ৮ নভেম্বর মিয়ানমারের নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। ১ ফেব্রুয়ারি সংসদ অধিবেশন বসার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই সেনাবাহিনী সেখানে ক্ষমতা গ্রহণ করল। অং সান সু চি ছিলেন মিয়ানমারের শীর্ষ নেত্রী, স্টেট কাউন্সিলর। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন তার দল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির নেতা উইন মিনত। সেনাবাহিনীর হাতে অং সান সু চি, উইন মিনতসহ দলের শীর্ষ নেতারা সবাই বন্দি। কার্যত সেনাপ্রধান মিন আউং হল্লাইয়ং এখন প্রেসিডেন্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। গত চার বছর অং সান সু চি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা ‘সখ্য’ তৈরি করে, সেনাবাহিনীর সব অপকর্মকে সমর্থন করে নিজে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিলেন। সেনাবাহিনী যখন ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে রাখাইন থেকে উচ্ছেদ করল, রাখাইনে গণহত্যায় জড়িত হলো, তখন অং সান সু চি অত্যন্ত নগ্নভাবে সেনাবাহিনীকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এমনকি হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সেনাবাহিনীর পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন। রোহিঙ্গা গণহত্যা ও নির্যাতনের দায়ভার সু চি এড়াতে পারেন না। এ কারণে সু চি আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত হয়েছেন। তার অনেক খেতাব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সারাবিশ্বই তার প্রতি ধিক্কার জানিয়েছিল। শুধু ক্ষমতার লোভে অং সান সু চি এতদিন ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিলেন। কিন্তু যে সেনাবাহিনীর সব অপকর্ম তিনি এতদিন সমর্থন করে এসেছিলেন, সেই সেনাবাহিনীই তাকে উৎখাত করল। মিয়ানমারের এই সেনা অভ্যুত্থান এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যে সেনাবাহিনী এতদিন অং সান সু চির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে পর্দার অন্তরালে থেকে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিল, হঠাৎ এমন কী ঘটল যে, সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা নিতে হবে? ক্ষমতার এই পরিবর্তনের ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা? সেনাবাহিনীর এই ক্ষমতা গ্রহণ চীন ও ভারত কোন দৃষ্টিতে দেখবে? বলা ভালো মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে আবারও জয় পেয়েছিল অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি বা এনএলডি। মিয়ানমারে পার্লামেন্ট দুকক্ষবিশিষ্ট। উচ্চকক্ষ (অসুধঃযধ ঐষঁঃঃধ)ি ২২৪ সদস্যবিশিষ্ট আর নিম্নকক্ষ (চুরঃযঁ ঐষঁঃঃধ)ি ৪৪০ সদস্যবিশিষ্ট। উভয় কক্ষেই সেনাবাহিনীর জন্য আসন সংরক্ষিত। উচ্চকক্ষে ৫৬ আসন ও নিম্নকক্ষে ১১০টি আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। ফলে নিম্নকক্ষের সব আসনে নির্বাচন হয় না। মোট ৩৩০টি আসনে নির্বাচন হয় ও বাকি আসনগুলো সেনাবাহিনী প্রধান কর্তৃক মনোনীত। উচ্চকক্ষে সব আসনে নির্বাচন হয় না। ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনে এনএলডি নিম্নকক্ষে ২৫৫ আসন পেয়ে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। এবার সর্বশেষ প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী উভয় কক্ষের ৫৬৪ আসনের মধ্যে এনএলডি ৩৪৬ (ঘোষিত ৪১৮ আসনের মধ্যে) আসন পেয়েছে। ফলে নিশ্চিত করেই অং সান সু চির দলেরই মিয়ানমারে সরকার গঠন করার কথা ছিল। তবে ওই নির্বাচন মিয়ানমারের জাতিগত দ্বন্দ্বের যেমন কোনো সমাধান দেয়নি, ঠিক তেমনি সেনা অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার জন্যও কোনো সুসংবাদ বয়ে আনবে না। অস্ট্রেলিয়ার খড়ুি ওহংঃরঃঁঃব-এর বুলেটিন ঃযব ওহঃবৎঢ়ৎবঃবৎ-এর এক প্রতিবেদনে (১২ অক্টোবর ২০২০) বলা হয়েছিল, মিয়ানমারের এই নির্বাচন ভৎবব, ভধরৎ ধহফ ংধভব হবে না। অর্থাৎ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আগে থেকেই ছিল। এটি শান্তিপূর্ণ, স্বাধীন ও অবাধ হয়নি। ইতোমধ্যে সেখানে ২৭৯০০ লোক কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছে, যা থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার চেয়ে বেশি। এখন নির্বাচনের পর এই সংখ্যা আরও বাড়ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ৫ অক্টোবর এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে একটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। সেনাবাহিনীর আপত্তিটা এখানেই। এই নির্বাচনে রাখাইনের অধিবাসী রোহিঙ্গাদের ভোট প্রদানকে অস্বীকার করা হয়েছিল। মিয়ানমারের নির্বাচনী আইনের ১০নং ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও প্রার্থিতার ক্ষেত্রে প্রার্থীকে মিয়ানমারের নাগরিক হতে হবে। ২০১০ সালের চড়ষরঃরপধষ ঢ়ধৎঃরবং ৎবমরংঃৎধঃরড়হ খড়ি পরে ২০১৪ সালে পরিবর্তন করা হয়, যাতে বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থীকে কোনো দলে যোগ দিতে হলে অথবা নির্বাচনে অংশ নিতে হলে তাকে ‘পূর্ণ’ নাগরিক হতে হবে। এই ‘পূর্ণ’ নাগরিকের বিষয়টি মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য প্রযোজ্য। তারা পূর্ণ নাগরিক নন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন সামরিক সরকার যে ডযরঃব পধৎফ ইস্যু করে, তাতে করে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ফলে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণে কোনো নির্বাচন এবার অনুষ্ঠিত হয়নি। মুসলমান রোহিঙ্গারা এবার নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। মিয়ানমার সরকার রাখাইন ও চীন স্টেটে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। ফলে ভোটারদের সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। ২০১৯ সালের ২১ জুন সরকার রাখাইন স্টেটের ৮টি টাউনশিপে ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করে। এই বিধিনিষেধ এখনো বহাল রয়েছে। ফলে মানুষ নির্বাচনসংক্রান্ত তথ্য জানতে পারেনি। কোভিড-১৯ এর কারণে কোনো নির্বাচনী প্রচারণাও হয়নি। ফলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা একটি বড় প্রশ্নের মুখে পড়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও সশস্ত্র আন্দোলন আন্তর্জাতিক সংবাদ হয়ে আসছে। সাম্প্রতিককালে রাখাইন ও চীন স্টেটে আরাকান আর্মির সশস্ত্র তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এই দুই স্টেটে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। একই কথা প্রযোজ্য কাচিন, কারেন ও শান স্টেটের ক্ষেত্রেও। সশস্ত্র সংঘর্ষের কারণে এখানে নির্বাচনে ভোট দেওয়ার পরিবেশ ছিল ন। স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ডধ ংঃধঃব-এর অবস্থাও ছিল তেমনি। ফলে নামমাত্র একটি নির্বাচন হয়েছে বটে। কিন্তু তাতে অংশগ্রহণ ব্যাপক ছিল না। সরকার তথা সেনাবাহিনীবিরোধী বক্তব্যের জন্য অনেক বিরোধীদলীয় প্রার্থী তথা সমর্থককে পেনাল কোডের ৫০৫ (বি) ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ফলে যারাই অং সান সু চি সরকারের বিরোধিতা করেছেন, তাদের স্থান এখন জেলে। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম টিভি ও বেতারে তাদের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু তাদের বক্তব্য আগে নির্বাচন কমিশন থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়েছিল। ফলে দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল যা ছিল মুক্তচিন্তার পরিপন্থী। ক্ষমতাসীন এনএলডি সরকার রাষ্ট্রীয় মিডিয়াকে ব্যবহার করেছিল, অন্যরা সেই সুযোগ পায়নি। উবসড়পৎধঃরপ চধৎঃু ভড়ৎ ধ হবি ঝড়পরঃু, ঘধঃরড়হধষ উবসড়পৎধঃরপ ঋড়ৎপব চধৎঃু, চবড়ঢ়ষবং চধৎঃু’র পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল যে, তারা সমসুযোগ পাচ্ছে না। খোদ মিয়ানমারের সংবিধানই একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে প্রধান অন্তরায়। এটি অগণতান্ত্রিকও বটে। শুধু ৭৫ ভাগ আসন পূর্ণ হয় গণতান্ত্রিকভাবে, বাকি আসন শুধু মনোনয়ন। এতে করে সেনাবাহিনীর অলিখিত কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক চরিত্রের সঙ্গে বেমানান। ২০০৮ সালে এই সংবিধান গ্রহণ করা হয়। এই সংবিধানের আলোকেই ২০১৫ সালে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল। সংবিধানে এমন সব শর্ত যুক্ত করা হয়েছে, যাতে অং সান সু চি কোনোদিনই প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। শর্তে বলা হয়েছে, ‘মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের স্বামী বা স্ত্রী বিদেশি নাগরিক হতে পারবেন না। তার সন্তানরা যদি বিদেশি নাগরিক হন, তা হলে তিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন।’ এই শর্তের কারণে সু চি কোনোদিনই প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। কেননা তার প্রয়াত স্বামী ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। তার দুই সন্তানও বিদেশি নাগরিক। সু চি এই শর্ত মেনেই নির্বাচনে গিয়েছিলেন এবং সংবিধান সংশোধনের দাবি বিভিন্ন মহল থেকে উঠলেও সেনাবাহিনীর সমর্থন এতে পাওয়া যায়নি। এবার নির্বাচনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভোট দেওয়ার সুযোগ না থাকা ও ব্যাপকসংখ্যক জনগোষ্ঠীর দেশত্যাগ এই নির্বাচনকে অর্থহীন করেছিল। সীমিত কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা সেখানে থাকলেও তাদের ভোট দেওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। রাখাইনে শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ভোট দিতে পেরেছেন। ফলে ওই নির্বাচন মিয়ানমারের জন্য আদৌ কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনেনি। গত বেশ কয়েক বছর সেনাবাহিনীর সঙ্গে অং সান সু চির একটি অলিখিত আঁতাত গড়ে উঠেছিল। এই আঁতাতের কারণেই তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। শুধু তাই নয়, হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অত্যন্ত নগ্নভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যায় সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। ফলে অং সান সু চির দলের পুনরায় ক্ষমতায় আসটা অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন। সবাই এটা জানত সেনাবাহিনী সমর্থিত একটি দল আছে বটে। কিন্তু তাদের পক্ষে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ছিল না। আগামীতেও নেই। সেনাবাহিনী তাদের স্বার্থে সু চিকে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু তাতে করে মিয়ানমারের মূল সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। মূল সমস্যা মূলত দুটি। এক. মিয়ানমারের জাতিগত দ্বন্দ্বের একটা সমাধান। জাতিগতভাবে বিভক্ত মিয়ানমারের সশস্ত্র তথা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। গেল পাঁচ বছর অং সান সু চি এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেননি এবং এর কোনো সমাধানও করেননি। এখন সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। তারাও এ সমস্যার সমাধান করবে না। আর জাতিগত দ্বন্দ্বের কোনো সমাধান দিতে পারবে না সেনাবাহিনী। দুই. প্রায় ১১ লাখ মিয়ানমারের নাগরিক (রোহিঙ্গা) এখন বাংলাদেশে বাস করে। এদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সেনাবাহিনীর কোনো লক্ষণীয় উদ্যোগও থাকবে না। জনগোষ্ঠীর একটা অংশকে বাইরে রেখে যে নির্বাচন হয়েছিল সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরে আসবে না। যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য অং সান সু চি বিশ্বব্যাপী এক সময় প্রশংসিত হয়েছিলেন এবং নোবেল শাািন্ত পুরস্কারও পেয়েছিলেন, তিনি গণতান্ত্রিক বিশ্বে একজন ঘৃণিত ব্যক্তি। ব্যক্তিগত স্বার্থে তিনি গণহত্যার মতো বিষয়টি বারবার এড়িয়ে গেছেন। ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না। মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ নতুন কিছু নয়। মিয়ানমারে সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেছে। আবারও পুরনো বৃত্তে ফিরে গেল মিয়ানমার। একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে চলে গেল দেশটি এখন। Amader Somoy 02. 02.2021

0 comments:

Post a Comment