রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মিয়ানমারের সেনা বিদ্রোহ ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট। গত ২০ জানুয়ারি তিনি শপথ নিয়েছেন। যেখানে ট্রাম্প একটি বিভক্ত সমাজ রেখে গেছেন এবং কৃষ্ণাঙ্গরা এখনো সেখানে বঞ্চিত, সেখানে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ভাইস প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে কতটুকু বদলে দিতে পারবেন? নানা কারণে কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। তার শরীরে যেমনি ভারতীয় রক্ত রয়েছে, তেমনি রয়েছে জ্যামাইকান রক্তও। মা শ্যামালা গোপালন ভারতীয়, আর বাবা ডোনাল্ড হ্যারিস এসেছিলেন জ্যামাইকা থেকে। দুজন ইমিগ্রেন্টের সন্তান কমলা, জন্ম ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ডে। নিজেকে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে পরিচয় দিলেও, শতকরা একশ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ এটা বলা যাবে না। অনেকটাই বাদামি রং তার শরীর ধারণ করে। ট্রাম্প হ্যারিসের জন্ম ও গায়ের রং নিয়েও কটাক্ষ করেছেন। যদিও ট্রাম্প নিজেও ছিলেন ইমিগ্রেন্টের সন্তান। তবে পার্থক্যটা হলো তিনি শে^তাঙ্গ, কমলা শে^তাঙ্গ নন, তিনি বাদামি। কমলা হ্যারিসকে নিয়ে শে^তাঙ্গদের ভয়টা কি এ কারণে যে কমলা হ্যারিস ডেমোক্র্যাট দলের উঠতি স্টার! ৭৮ বছরের জো বাইডেনের রানিংমেট হয়ে কমলা কি সবাইকে জানিয়ে দিলেন তিনি আগামীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী! ২০২৪ সালের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কি কমলা হ্যারিস টার্গেট করছেন? এটা ঠিক, আমেরিকার রাজনীতিতে ভাইস প্রেসিডেন্টের তেমন কোনো ভূমিকা থাকে না। নীতিনির্ধারণে প্রেসিডেন্টের ভূমিকাই আসল। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট ওবামার অধীনে ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন (২০০৯-১৭)। তবে এটা সত্য, তিনি কোনো ‘ক্যারিশমাটিক’ লিডার নন, যেমনটি ছিলেন বারাক ওবামা। এ ক্ষেত্রে কমলা হ্যারিসের নিযুক্তি ডেমোক্র্যাটদের ইমেজ বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে কিছুটা হলেও। কমলা হ্যারিসের ভারতীয় ও জ্যামাইকান ‘কানেকশন’ ভারতীয় ও ক্যারিবীয় বংশোদ্ভূতদের মধ্যে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলতে পারে। এ ক্ষেত্রে ক্যারিবীয় কিংবা ভারতীয় আমেরিকানদের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে যে বেশি, তা বলা যাবে না। পরিসংখ্যান বলছে, ক্যারিবীয়দের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা শতকরা চার ভাগ, আর ভারতীয়দের ক্ষেত্রে ০.৯ ভাগ। নতুন প্রজন্মের ক্যারিবীয় ও ভারতীয়দের সঙ্গে তাদের আদি বাসস্থানের কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। কমলা হ্যারিসের মা এসেছিলেন চেন্নাই থেকে। তার যখন বয়স সাত বছর তখন তাদের বাবা-মার মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। চেন্নাইয়ে তার মাতৃকুলের আত্মীয়স্বজনরা আছেন। তবে তাদের সঙ্গে কমলা হ্যারিসের যোগাযোগ খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। মার কারণে হিন্দু ধর্মের প্রতি তার ভালোবাসা ও ভক্তি আছে। আবার বাবার কারণে তিনি চার্চেও যান। তবে তিনি কোনো একটি বিশেষ ধর্ম পালন করেন কি না, তা জানা যায়নি। তার বাবা-মা উভয়েই উচ্চশিক্ষিত এবং পিএইচডি ডিগ্রির অধিককারী। তার বাবা ডোনাল্ড জে. হ্যারিস স্ট্যানফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। আর তার মা শ্যামালা গোপালান ব্রেস্ট ক্যানসার গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে তার স্বামী ইহুদি, তিনি ইসরায়েলের জোরালো সমর্থক। কমলা হ্যারিস একজন আইনজীবী, ক্যালিফোর্নিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সিনেটর। জাতীয় রাজনীতিতে তিনি আসবেন, এমন কথা অনেক দিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল। তিনি নিজে জো বাইডেনের সঙ্গে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিলেন। তাতে সফল হননি। শেষ পর্যন্ত জো বাইডেনই তাকে তার রানিংমেট হিসেবে বেছে নেন। বলা ভালো, কমলা হ্যারিসই প্রথম মহিলা আফ্রিকান-আমেরিকান তথা প্রথম এশিয়ান-আমেরিকান মহিলা যিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এর আগে মাত্র দুজন মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য ছিলেন গেরালডিন আন্নে ফেরারো (১৯৭৯-৮৫)। ১৯৮৪ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ওয়াল্টার মেনডেলের সঙ্গে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। সেটা ছিল একটা বড় অগ্রগতি। মার্কিন সমাজে নারীরা উচ্চপর্যায়ে খুব এগিয়েছে, তা বলা যাবে না। সে ক্ষেত্রে আন্নে ফেরারোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ছিল উল্লেখযোগ্য একটি অগ্রগতি। কেননা এর আগে প্রতিনিধি পরিষদের দুজন সদস্য শার্লি চিসহল্ম ও পেটসি মিন্ক ১৯৭২ সালে ডেমোক্র্যাট পার্টি কনভেনশনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পার্টি তাদের মনোনয়ন দেয়নি। কিন্তু ১৯৮৪ সালে মেনডেল তার রানিংমেট হিসেবে আন্নে ফেরারোকে বেছে নিয়েছিলেন। আন্নের পথ ধরেই এসেছেন কমলা হ্যারিস। তিনি প্রেসিডেন্ট পদেও প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় তিনি জো বাইডেনের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাইডেন তার রানিংমেট হিসেবে কমলা হ্যারিসকে বেছে নিয়েছিলেন। এ কথা বলতেই হবে কমলা হ্যারিস তার যোগ্যতা বলেই এতদূর আসতে পেরেছেন। অবৈধ অভিবাসীদের কাজের অনুমতি দিতে তিনি Dream Act (২০০১)-এর প্রস্তাব করে অভিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে জনপ্রিয় হলেও, তার ইসরায়েলপ্রীতি আরবদের কাছে তাকে জনপ্রিয় করেনি। এমনকি ভারতীয়-আমেরিকানদের কাছে তিনি যে খুব জনপ্রিয়, তারও প্রমাণ পাওয়া যায় না। কমলা হ্যারিসের স্বামীর নাম ডগলাস এমহফ, একজন আইনজীবী এবং একজন শে^তাঙ্গ। তিনি ইহুদি ধর্মাবলম্বী। কমলার সঙ্গে তার ছোট বোন মায়ার পার্থক্য এখানেইমায়া যেখানে একজন জ্যামাইকানকে বেছে নিয়েছেন তার জীবনসঙ্গী হিসেবে, সেখানে কমলা হ্যারিস একজন শে^তাঙ্গকে বেছে নিয়েছেন তার জীবনসঙ্গী হিসেবে। ডগলাস এমহফ এর আগে একবার বিয়ে করেছিলেন, সে ঘরে তার দু-সন্তান রয়েছে কোল ও এল্লা। কোল ও এল্লাকে নিজের আপন সন্তান হিসেবেই পছন্দ করেন কমলা। সন্তানরা তাকে আদর করে ডাকেন মোমালা (Momala)। সম্ভবত Mother থেকে Mo এবং Kamala থেকে mala- দুটো মিলে Momala। মাত্র ছ’বছর আগে কমলা ও ডগলাস বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কমলা এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, তার মা একবার তার ছোট বোন মায়াকে সঙ্গে নিয়ে মাদ্রাজে গিয়েছিলেন, যা আজকে চেন্নাই নামে পরিচিত। তিনি বলেছেন, তার নানা পিভি গোপালনের কাছ থেকে তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইতিহাস জেনেছেন, যা তাকে আজকে এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে। মা শ্যামালা গোপালান মারা গেলেও, বাবা ডোনাল্ড হ্যারিস ৮২ বছর বয়সে এখনো বেঁচে আছেন। তবে মজার ব্যাপার, নিজ মেয়ে কমলা হ্যারিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তিতে তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি, এমনকি তিনি মন্তব্য করতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এখন কিছু বিষয় কমলা হ্যারিসকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এক. জো বাইডেনের বয়স ২০২৪ সালের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় গিয়ে দাঁড়াবে ৮২। একজন প্রেসিডেন্টের জন্য বয়সটা বেশি। এ ক্ষেত্রে কমলা হ্যারিসকে ডেমোক্রেটিক পার্টি মনোনয়ন দেবে কি না? এর জবাব এ মুহূর্তে জো বাইডেনই পুনরায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। দুই. মার্কিন সমাজ কি এখনো একজন নারী, একজন কৃষ্ণাঙ্গকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেবে? এর জবাব হচ্ছে ‘না’। মার্কিন সমাজ এখনো মানসিকভাবে একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। রেসিয়াল প্রশ্নেও ও কথাটা প্রযোজ্য। একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী প্রেসিডেন্ট হবেনএই মানসিকতা এখনো তৈরি হয়নি। উপরন্তু ট্রাম্প যে বিভক্তি তৈরি করে দিয়ে গেলেন এবং উত্তর-দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মধ্যে ‘বিভক্তি’ যেভাবে বাড়ছে, তাতে আরও কয়েক দশক লাগবে একটি স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে। তিন. কমলা হ্যারিসের ভারতীয় কিংবা জ্যামাইকান ‘কানেকশন’ কি বাইডেনের পররাষ্ট্র নীতিতে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে? এর জবাবও ‘না’। কেননা পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ভাইস প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিত। কমলা হ্যারিসের একটা ‘অতীত’ থাকতে পারে। কিন্তু এই ‘অতীত’ নীতিনির্ধারণে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তবে একটা বিষয়ের দিকে লক্ষ রাখতে হবে আর তা হচ্ছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সম্পর্ক। এর একটি সামরিক দিক আছে, আবার একটি স্ট্র্যাটেজিক দিকও আছে। ট্রাম্প ভারতকে ব্যবহার করেছিলেন চীনের বিরুদ্ধে। বাইডেন এটা করবেন বলে মনে হয় না। ফলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে ‘স্ট্যাটাস কো’ বহাল থাকবে। চার. কমলা হ্যারিসের বিজয় যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কি প্রভাব ফেলবে? জবাব হচ্ছে একটা ‘পজিটিভ’ দিক আছে এর। নারীবাদীরা উৎসাহিত হবেন এবং ডেমোক্র্যাট পার্টির গ্রহণযোগ্যতা এতে করে বাড়বে। স্ট্যানফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ার পরিচালক অধ্যাপক জিসা মেনন মন্তব্য করেছেন এভাবে ‘The historic appointment of Kamala Harris to the second-highest office in the nation is momentous and will inspire generations of young girls, and especially Black and Brown girls, to aspire to positions of leadership in the nation’s highest echelons of power.। এটাই হচ্ছে আসল কথা কমলা হ্যারিসের ঐতিহাসিক এই নিয়োগ হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ ও বাদামি রঙের তরুণীর মধ্যে একটা স্বপ্ন জাগাবে ইচ্ছে করলে তারাও সর্বোচ্চ পদে এক দিন যেতে পারবেন! কৃষ্ণাঙ্গ ও বাদামি রঙের কাছে কমলা হ্যারিস একটা আদর্শ হয়ে থাকবেন। তবে কমলা হ্যারিস একটা ‘বড়’ কিছু করতে পারবেন, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। Desh Rupantor 28 Januart 2021

0 comments:

Post a Comment