হামবুর্গের এই ট্রাইব্যুনালের রায় আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা হয়, গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের এলাকায় ১৮ বিলিয়ন ব্যারেল তেল ও ২০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ রয়েছে। বাংলাদেশ যে বড় ধরনের জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে এই রিজার্ভ আমাদের জন্য একটা সমাধান বয়ে আনতে পারে।
মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধে বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিয়েছে জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইবুনাল ফর ল’ অব দ্য সি। এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের বিজয়। এ রায়ের ফলে সমুদ্রে ২০০ নটিক্যাল মাইল (১ লাখ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার) পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এলাকা ও সার্বভৌম অধিকারের অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত হল। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কোন সুযোগ নেই এবং মিয়ানমার রায়টি মানতে বাধ্য। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভারতের সঙ্গেও সমুদ্রসীমা নিয়ে আমাদের বিরোধ রয়েছে। মিয়ানমার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এর সমাধান চাইলেও ভারত দ্য হেগের পারমানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান চাইছে। দু’ভাবেই সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা যায়। মূলত মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে সমস্যা ছিল একটাই। আর তা হচ্ছে, কিভাবে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হবে। মিয়ানমারের দাবি ছিল, ‘সমদূরত্ব’ ভিত্তিতে এ সীমা নির্ধারণ করতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের যুক্তি ছিল, সীমানা নির্ধারণ করতে হবে ‘ন্যায়পরায়ণতা’র ভিত্তিতে। কারণ বাংলাদেশ মনে করে, যদি ‘সমদূরত্ব’কে ভিত্তি করে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়, তাহলে বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকা ১৩০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। এর ফলে সমুদ্রের অগাধ সম্পদ আহরণ থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে।
দীর্ঘদিন সমুদ্রসীমা নিয়ে দু’দেশের মাঝে বিরোধ চলে এলেও দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এর কোন সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সমস্যা ছিল ভারতের সঙ্গেও। এমন এক পরিস্থিতিতে ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মিয়ানমার ও ভারতের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে হার্মবুগের ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার কথা জানান। বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনালে তার অভিযোগ দায়েরের পর ২০১০ সালের ১ জুলাই তার দাবির সমর্থনে নথিপত্র উপস্থাপন করে। মিয়ানমার তাদের দাবির সমর্থনে নথি উপস্থাপন করে ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর। এখন মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের অবসান হলেও ভারতের সঙ্গে বিষয়টি এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসায় আমরা ট্রাইব্যুনালে যাইনি। আমরা গেছি আরবিট্রেশনে। চলতি বছরের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ভারত তার জবাব দেবে। আমরা সময় পাব ২০১৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। আর আরবিট্রেশনের চূড়ান্ত রায় পাওয়া যাবে ২০১৪ সালে।
সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টি বেশ জটিল। অতীতে বাংলাদেশে বিষয়টির ওপর তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বাংলাদেশে সমুদ্র আইন নিয়ে গবেষণাও ছিল সীমিত। যে কারণে তেমন কোন বিশেষজ্ঞ এ দেশে তৈরি হয়নি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘এটাচড’ করা হয় এবং তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় সমুদ্রসীমা নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বহির্বিশ্বে তুলে ধরতে। মূলত তিনভাবে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে থাকে- ১. সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল, ২. আন্তর্জাতিক আদালত ও ৩. আরবিট্রয়াল ট্রাইব্যুনাল। ভারত প্রথম দুটিতে আগেই আপত্তি দেয়ায় ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আমাদের তৃতীয় ‘অপশনে’ যেতে হয়েছে। এখন মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তিতে ‘ন্যায়পরায়ণতা’র (বা ইকুইটি) দাবি স্বীকৃত হওয়ায় ধারণা করছি, ভারতের সঙ্গেও বিরোধ নিষ্পত্তিতে এই দাবি টিকে যাবে। ভারত ও মিয়ানমার প্রথম থেকেই ‘ইকোডিসটেন্স’ বা সমদূরত্বের কথা বলে আসছিল। এ দাবি মেনে নেয়া হলে বঙ্গোপসাগরের ওপর যথাক্রমে দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দুটি সীমারেখা টানা হতো। এর ফলে বাংলাদেশ সমুদ্র অঞ্চলের ওপর তার অধিকার হারাত। বাংলাদেশ চেয়েছে ‘সমতা ও ন্যায়পরায়ণতার’ ভিত্তিতে একটি সমাধান। এ পদ্ধতিতে সোজা দক্ষিণ দিকে এই সীমারেখা টানতে হবে। ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের এই দাবিকে স্বীকৃতি দিল। বাংলাদেশ যদি মিয়ানমারের দাবি অনুযায়ী ‘সমদূরত্বে’র দাবি মেনে নিত, তাহলে বাংলাদেশের ৪৮ হাজার ২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা মিয়ানমারের হাতে চলে যেত। একই সঙ্গে ৩১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা চলে যেত ভারতের হাতে। ফলে সমুদ্রের যে বিশাল সম্পদ, সেই সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতো বাংলাদেশ। তাই ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি এখন সঠিক বলেই বিবেচিত হবে।
যারা সমুদ্র আইন নিয়ে কাজ করেন তারা জানেন, হামবুর্গে বাংলাদেশের অনুকূলে ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছে, তার সঙ্গে ১৯৬৯ সালের আন্তর্জাতিক আদালতের দেয়া একটি রায়ের অদ্ভুত এক মিল রয়েছে। আজ বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতকে নিয়ে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, ঠিক একই ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছিল জার্মানি, ডেনমার্ক ও হল্যান্ডের মধ্যে। এই তিনটি দেশই তেলসমৃদ্ধ নর্থ সিতে তাদের বিশাল এলাকা দাবি করেছিল। ওই সময় একদিকে ছিল জার্মানি, অন্যদিকে ডেনমার্ক ও হল্যান্ড। জার্মানির অবস্থান ছিল অনেকটা আজকের বাংলাদেশের মতো। জার্মানির দাবি ছিল, ডেনমার্ক ও হল্যান্ড ‘সমদূরত্বে’র নীতি অনুসরণ করায় সমুদ্রে তার অধিকার খর্ব হয়েছে এবং দেশটি ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিরোধ নিষ্পত্তিতে দেশ তিনটি ১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে যায়। আদালত ১৯৬৯ সালের ২০ ফেব্র“য়ারি এক রায়ে ঘোষণা করে যে, দেশ তিনটির সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করতে হবে ‘সমদূরত্বে’র নীতিতে নয়, বরং ‘ন্যায়পরায়ণতা’র ভিত্তিতে। আজ ৪৩ বছর পর নতুন করে আবার ‘ন্যায়পরায়ণতা’র ভিত্তিটি স্বীকৃতি পেল।
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের উপকূল বিচিত্র ধরনের। এখানে প্রতিনিয়ত পলি জমার কারণে তীরের গভীরতাও এতই কম যে জাহাজ সরাসরি বন্দরে ভিড়তে পারে না। অন্যদিকে ভারত ও মিয়ানমারের উপকূল উত্তল (কনভেক্স), অর্থাৎ তাদের উপকূল সমুদ্রের ভেতর ঢুকে গেছে। আমাদের উপকূল অবতল (কনকেইভ), অর্থাৎ সমুদ্র এখানে উপকূলের ভেতর ঢুকে গেছে। এর ফলে উপকূল আঁকাবাঁকা হয়। এখানে পলি বেশি জমা হয়। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনে একে বিশেষ পরিস্থিতি বলা হয়েছে। ভূসন্নিহিত এ ধরনের সমুদ্র সম্পদে পরিপূর্ণ হলে আন্তর্জাতিক আইনে সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার বেশি থাকে। তবে এক্ষেত্রে একটা সমস্যা ছিল ভারতকে নিয়ে। সমুদ্রসীমাটা কোত্থেকে শুরু হয়েছে, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যাখ্যা ভিন্ন ভিন্ন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক নদী হাড়িয়াভাঙ্গার মধ্য স্রোত হবে বাংলাদেশের সীমানা। অন্যদিকে ভারত চাইছে, রায়মঙ্গল, যমুনা ও হাড়িয়াভাঙ্গা নদী বঙ্গোপসাগরে গিয়ে যেখানে মিশেছে, সেখানে গভীর চ্যানেলের কোন এক জায়গায় সীমানা নির্ধারিত হোক। তবে বাংলাদেশের যুক্তি- রায়মঙ্গল ও যমুনা অভ্যন্তরীণ নদী। সমুদ্রসীমা শুরুর পয়েন্ট নিয়ে বিরোধ থাকায় ভারত দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপকে নিজের বলে দাবি করে আসছে।
এখানে পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৫৮ সালের আগ পর্যন্ত সমুদ্রসংক্রান্ত কোন আইন ছিল না। ১৯৫৮ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় প্রথমবারের মতো চারটি কনভেনশন বা সনদ গ্রহণ করা হয়। এগুলো হচ্ছে- রাষ্ট্রীয় সমুদ্র ও নিকটস্থ অঞ্চলবিষয়ক কনভেনশন, উন্মুক্ত সমুদ্রবিষয়ক কনভেনশন, মহীসোপান বিষয়ক কনভেনশন ও মৎস্য শিকার ও প্রাণিজসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণবিষয়ক কনভেনশন। এসব কনভেনশন পরে অনেক রাষ্ট্রের অনুমোদন পেয়ে আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য বর্তমানে বলবৎ আছে। এটি ১৯৮২ সালে গৃহীত এবং ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে তা কার্যকর হয়। ভারত ১৯৯৫ সালের ২৭ জুন ও মিয়ানমার ১৯৯৬ সালের ২১ মে * অনুমোদন করে। বাংলাদেশ তা অনুমোদন করে ২০০১ সালের ২৭ জুলাই। তবে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ** ১৯৭৪ পাস করেছিল। ওই আইনের বেইজলাইন ৬০ ফুট সমুদ্র গভীরতার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়েছিল। জাতিসংঘের সমুদ্র আইনের ৭৬ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সমুদ্র তটরেখা থেকে ৩৫০ নটিকেল মাইল বা ৬৪৮ দশমিক ২ কিলোমিটার পর্যন্ত নিজেদের অধিকার দাবি করতে পারে। ২০০ নটিক্যাল মাইল এমনিতেই বাংলাদেশের পাওনা। বাকি ১৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে জাতিসংঘে দাবি করতে হয়। আইন অনুযায়ী মহীসোপানের মহিঢাল থেকে যেখানে সেডিমেন্ট (পলি) ১ শতাংশ পর্যন্ত আছে অথবা ২ হাজার ৫০০ মিটার পানির গভীরতা রেখা থেকে আরও ১০০ নটিকেল মাইল পর্যন্ত পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রথম ২০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যেই ভারত ও মিয়ানমার তাদের ভূখণ্ড দাবি করে আসছিল। ২০০৯ সালের ২৯ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি সংসদকে জানিয়েছিলেন, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে ২৮ হাজার ৪৭৬ বর্গনটিক্যাল মাইল অমীমাংসিত সীমান্ত রয়েছে। এখানে ভারতের দাবি ৮ হাজার ৭১৪ বর্গ নটিক্যাল মাইল ও মিয়ানমারের দাবি ১৯ হাজার ৭০২ বর্গনটিক্যাল মাইল। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সমুদ্রে গ্যাস ব্লক (৫, ১০ ও ১১) ইজারা দিতে গেলে ভারত (৫ ও ১০) এবং মিয়ানমার (১১) একযোগে আপত্তি তোলে। শুধু তাই নয়, গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের ২৮টি ব্লকের মাঝে ভারতের দাবি রয়েছে ১০টিতে, আর মিয়ানমারের দাবি ১৭টিতে। বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র ব্লক ১৩, ১৭, ১৮, ২২, ২৩, ২৭ ও ২৮-এর ভেতর মিয়ানমারের গভীর সমুদ্র ব্লক এডি-৭, এডি-৮, এডি-৯ ও এডি-১০ ঢুকে পড়েছে। ২০০৮ সালের নভেম্বরে মিয়ানমার এডি-৭ (বাংলাদেশের ব্লক ১৩) ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে গেলে (কোরিয়ার দেওউ কোম্পানি) দু’দেশের নৌবাহিনী পরস্পর পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল।
আমাদের সমুদ্র অঞ্চল নানা ধরনের খনিজ পদার্থ ও গ্যাসসম্পদে ভরপুর। বাংলাদেশের নিজ উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ নৌসীমা রয়েছে। এই অভ্যন্তরীণ নৌসীমায় বাংলাদেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব বজায় রয়েছে। এর পরের ১২ নটিক্যাল মাইল সন্নিকটবর্তী অঞ্চল এবং এ অঞ্চলের সীমানা শেষ হলে শুরু হয় ‘একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল’, যা ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। এখন টাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী এই ২০০ নটিক্যাল মাইলের ওপর আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরেই সাগরের যে মহীসোপান, সেখানেও আমাদের অধিকার রক্ষিত হল। হামবুর্গের এই ট্রাইব্যুনালের রায় আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা হয়, গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের এলাকায় ১৮ বিলিয়ন ব্যারেল তেল ও ২০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ রয়েছে। বাংলাদেশ যে বড় ধরনের জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে এই রিজার্ভ আমাদের জন্য একটা সমাধান বয়ে আনতে পারে।
মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা এখন চিহ্নিত হল। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে না, এটাই আশা করি। কারণ বাংলাদেশের উন্নয়নে মিয়ানমারের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের ‘পূর্বমুখী’ পররাষ্ট্রনীতির আলোকে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা অত্যন্ত প্রয়োজন। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের **-কে আরও শক্তিশালী করা দরকার। বিশেষজ্ঞ টিম তৈরি করাও জরুরি। কারণ একুশ শতকে সমুদ্র হবে সম্পদের আধার। এ সম্পদের সুষ্ঠু আহরণ ও ব্যবহারের জন্য চাই দক্ষ জনশক্তি।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[সূত্রঃ যুগান্তর, ১৬/০৩/১হামবুর্গের এই ট্রাইব্যুনালের রায় আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা হয়, গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের এলাকায় ১৮ বিলিয়ন ব্যারেল তেল ও ২০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ রয়েছে। বাংলাদেশ যে বড় ধরনের জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে এই রিজার্ভ আমাদের জন্য একটা সমাধান বয়ে আনতে পারে।
মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধে বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিয়েছে জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইবুনাল ফর ল’ অব দ্য সি। এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের বিজয়। এ রায়ের ফলে সমুদ্রে ২০০ নটিক্যাল মাইল (১ লাখ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার) পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এলাকা ও সার্বভৌম অধিকারের অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত হল। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কোন সুযোগ নেই এবং মিয়ানমার রায়টি মানতে বাধ্য। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভারতের সঙ্গেও সমুদ্রসীমা নিয়ে আমাদের বিরোধ রয়েছে। মিয়ানমার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এর সমাধান চাইলেও ভারত দ্য হেগের পারমানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান চাইছে। দু’ভাবেই সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা যায়। মূলত মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে সমস্যা ছিল একটাই। আর তা হচ্ছে, কিভাবে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হবে। মিয়ানমারের দাবি ছিল, ‘সমদূরত্ব’ ভিত্তিতে এ সীমা নির্ধারণ করতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের যুক্তি ছিল, সীমানা নির্ধারণ করতে হবে ‘ন্যায়পরায়ণতা’র ভিত্তিতে। কারণ বাংলাদেশ মনে করে, যদি ‘সমদূরত্ব’কে ভিত্তি করে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়, তাহলে বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকা ১৩০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। এর ফলে সমুদ্রের অগাধ সম্পদ আহরণ থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে।
দীর্ঘদিন সমুদ্রসীমা নিয়ে দু’দেশের মাঝে বিরোধ চলে এলেও দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এর কোন সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সমস্যা ছিল ভারতের সঙ্গেও। এমন এক পরিস্থিতিতে ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মিয়ানমার ও ভারতের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে হার্মবুগের ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার কথা জানান। বাংলাদেশ ট্রাইব্যুনালে তার অভিযোগ দায়েরের পর ২০১০ সালের ১ জুলাই তার দাবির সমর্থনে নথিপত্র উপস্থাপন করে। মিয়ানমার তাদের দাবির সমর্থনে নথি উপস্থাপন করে ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর। এখন মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের অবসান হলেও ভারতের সঙ্গে বিষয়টি এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসায় আমরা ট্রাইব্যুনালে যাইনি। আমরা গেছি আরবিট্রেশনে। চলতি বছরের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ভারত তার জবাব দেবে। আমরা সময় পাব ২০১৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। আর আরবিট্রেশনের চূড়ান্ত রায় পাওয়া যাবে ২০১৪ সালে।
সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টি বেশ জটিল। অতীতে বাংলাদেশে বিষয়টির ওপর তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বাংলাদেশে সমুদ্র আইন নিয়ে গবেষণাও ছিল সীমিত। যে কারণে তেমন কোন বিশেষজ্ঞ এ দেশে তৈরি হয়নি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘এটাচড’ করা হয় এবং তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় সমুদ্রসীমা নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বহির্বিশ্বে তুলে ধরতে। মূলত তিনভাবে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে থাকে- ১. সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল, ২. আন্তর্জাতিক আদালত ও ৩. আরবিট্রয়াল ট্রাইব্যুনাল। ভারত প্রথম দুটিতে আগেই আপত্তি দেয়ায় ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আমাদের তৃতীয় ‘অপশনে’ যেতে হয়েছে। এখন মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তিতে ‘ন্যায়পরায়ণতা’র (বা ইকুইটি) দাবি স্বীকৃত হওয়ায় ধারণা করছি, ভারতের সঙ্গেও বিরোধ নিষ্পত্তিতে এই দাবি টিকে যাবে। ভারত ও মিয়ানমার প্রথম থেকেই ‘ইকোডিসটেন্স’ বা সমদূরত্বের কথা বলে আসছিল। এ দাবি মেনে নেয়া হলে বঙ্গোপসাগরের ওপর যথাক্রমে দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দুটি সীমারেখা টানা হতো। এর ফলে বাংলাদেশ সমুদ্র অঞ্চলের ওপর তার অধিকার হারাত। বাংলাদেশ চেয়েছে ‘সমতা ও ন্যায়পরায়ণতার’ ভিত্তিতে একটি সমাধান। এ পদ্ধতিতে সোজা দক্ষিণ দিকে এই সীমারেখা টানতে হবে। ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশের এই দাবিকে স্বীকৃতি দিল। বাংলাদেশ যদি মিয়ানমারের দাবি অনুযায়ী ‘সমদূরত্বে’র দাবি মেনে নিত, তাহলে বাংলাদেশের ৪৮ হাজার ২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা মিয়ানমারের হাতে চলে যেত। একই সঙ্গে ৩১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা চলে যেত ভারতের হাতে। ফলে সমুদ্রের যে বিশাল সম্পদ, সেই সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতো বাংলাদেশ। তাই ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি এখন সঠিক বলেই বিবেচিত হবে।
যারা সমুদ্র আইন নিয়ে কাজ করেন তারা জানেন, হামবুর্গে বাংলাদেশের অনুকূলে ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছে, তার সঙ্গে ১৯৬৯ সালের আন্তর্জাতিক আদালতের দেয়া একটি রায়ের অদ্ভুত এক মিল রয়েছে। আজ বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতকে নিয়ে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, ঠিক একই ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছিল জার্মানি, ডেনমার্ক ও হল্যান্ডের মধ্যে। এই তিনটি দেশই তেলসমৃদ্ধ নর্থ সিতে তাদের বিশাল এলাকা দাবি করেছিল। ওই সময় একদিকে ছিল জার্মানি, অন্যদিকে ডেনমার্ক ও হল্যান্ড। জার্মানির অবস্থান ছিল অনেকটা আজকের বাংলাদেশের মতো। জার্মানির দাবি ছিল, ডেনমার্ক ও হল্যান্ড ‘সমদূরত্বে’র নীতি অনুসরণ করায় সমুদ্রে তার অধিকার খর্ব হয়েছে এবং দেশটি ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিরোধ নিষ্পত্তিতে দেশ তিনটি ১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে যায়। আদালত ১৯৬৯ সালের ২০ ফেব্র“য়ারি এক রায়ে ঘোষণা করে যে, দেশ তিনটির সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করতে হবে ‘সমদূরত্বে’র নীতিতে নয়, বরং ‘ন্যায়পরায়ণতা’র ভিত্তিতে। আজ ৪৩ বছর পর নতুন করে আবার ‘ন্যায়পরায়ণতা’র ভিত্তিটি স্বীকৃতি পেল।
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের উপকূল বিচিত্র ধরনের। এখানে প্রতিনিয়ত পলি জমার কারণে তীরের গভীরতাও এতই কম যে জাহাজ সরাসরি বন্দরে ভিড়তে পারে না। অন্যদিকে ভারত ও মিয়ানমারের উপকূল উত্তল (কনভেক্স), অর্থাৎ তাদের উপকূল সমুদ্রের ভেতর ঢুকে গেছে। আমাদের উপকূল অবতল (কনকেইভ), অর্থাৎ সমুদ্র এখানে উপকূলের ভেতর ঢুকে গেছে। এর ফলে উপকূল আঁকাবাঁকা হয়। এখানে পলি বেশি জমা হয়। আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনে একে বিশেষ পরিস্থিতি বলা হয়েছে। ভূসন্নিহিত এ ধরনের সমুদ্র সম্পদে পরিপূর্ণ হলে আন্তর্জাতিক আইনে সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার বেশি থাকে। তবে এক্ষেত্রে একটা সমস্যা ছিল ভারতকে নিয়ে। সমুদ্রসীমাটা কোত্থেকে শুরু হয়েছে, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যাখ্যা ভিন্ন ভিন্ন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক নদী হাড়িয়াভাঙ্গার মধ্য স্রোত হবে বাংলাদেশের সীমানা। অন্যদিকে ভারত চাইছে, রায়মঙ্গল, যমুনা ও হাড়িয়াভাঙ্গা নদী বঙ্গোপসাগরে গিয়ে যেখানে মিশেছে, সেখানে গভীর চ্যানেলের কোন এক জায়গায় সীমানা নির্ধারিত হোক। তবে বাংলাদেশের যুক্তি- রায়মঙ্গল ও যমুনা অভ্যন্তরীণ নদী। সমুদ্রসীমা শুরুর পয়েন্ট নিয়ে বিরোধ থাকায় ভারত দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপকে নিজের বলে দাবি করে আসছে।
এখানে পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৫৮ সালের আগ পর্যন্ত সমুদ্রসংক্রান্ত কোন আইন ছিল না। ১৯৫৮ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় প্রথমবারের মতো চারটি কনভেনশন বা সনদ গ্রহণ করা হয়। এগুলো হচ্ছে- রাষ্ট্রীয় সমুদ্র ও নিকটস্থ অঞ্চলবিষয়ক কনভেনশন, উন্মুক্ত সমুদ্রবিষয়ক কনভেনশন, মহীসোপান বিষয়ক কনভেনশন ও মৎস্য শিকার ও প্রাণিজসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণবিষয়ক কনভেনশন। এসব কনভেনশন পরে অনেক রাষ্ট্রের অনুমোদন পেয়ে আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য বর্তমানে বলবৎ আছে। এটি ১৯৮২ সালে গৃহীত এবং ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে তা কার্যকর হয়। ভারত ১৯৯৫ সালের ২৭ জুন ও মিয়ানমার ১৯৯৬ সালের ২১ মে * অনুমোদন করে। বাংলাদেশ তা অনুমোদন করে ২০০১ সালের ২৭ জুলাই। তবে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ** ১৯৭৪ পাস করেছিল। ওই আইনের বেইজলাইন ৬০ ফুট সমুদ্র গভীরতার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়েছিল। জাতিসংঘের সমুদ্র আইনের ৭৬ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সমুদ্র তটরেখা থেকে ৩৫০ নটিকেল মাইল বা ৬৪৮ দশমিক ২ কিলোমিটার পর্যন্ত নিজেদের অধিকার দাবি করতে পারে। ২০০ নটিক্যাল মাইল এমনিতেই বাংলাদেশের পাওনা। বাকি ১৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে জাতিসংঘে দাবি করতে হয়। আইন অনুযায়ী মহীসোপানের মহিঢাল থেকে যেখানে সেডিমেন্ট (পলি) ১ শতাংশ পর্যন্ত আছে অথবা ২ হাজার ৫০০ মিটার পানির গভীরতা রেখা থেকে আরও ১০০ নটিকেল মাইল পর্যন্ত পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রথম ২০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যেই ভারত ও মিয়ানমার তাদের ভূখণ্ড দাবি করে আসছিল। ২০০৯ সালের ২৯ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি সংসদকে জানিয়েছিলেন, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে ২৮ হাজার ৪৭৬ বর্গনটিক্যাল মাইল অমীমাংসিত সীমান্ত রয়েছে। এখানে ভারতের দাবি ৮ হাজার ৭১৪ বর্গ নটিক্যাল মাইল ও মিয়ানমারের দাবি ১৯ হাজার ৭০২ বর্গনটিক্যাল মাইল। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সমুদ্রে গ্যাস ব্লক (৫, ১০ ও ১১) ইজারা দিতে গেলে ভারত (৫ ও ১০) এবং মিয়ানমার (১১) একযোগে আপত্তি তোলে। শুধু তাই নয়, গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের ২৮টি ব্লকের মাঝে ভারতের দাবি রয়েছে ১০টিতে, আর মিয়ানমারের দাবি ১৭টিতে। বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র ব্লক ১৩, ১৭, ১৮, ২২, ২৩, ২৭ ও ২৮-এর ভেতর মিয়ানমারের গভীর সমুদ্র ব্লক এডি-৭, এডি-৮, এডি-৯ ও এডি-১০ ঢুকে পড়েছে। ২০০৮ সালের নভেম্বরে মিয়ানমার এডি-৭ (বাংলাদেশের ব্লক ১৩) ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে গেলে (কোরিয়ার দেওউ কোম্পানি) দু’দেশের নৌবাহিনী পরস্পর পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল।
আমাদের সমুদ্র অঞ্চল নানা ধরনের খনিজ পদার্থ ও গ্যাসসম্পদে ভরপুর। বাংলাদেশের নিজ উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ নৌসীমা রয়েছে। এই অভ্যন্তরীণ নৌসীমায় বাংলাদেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব বজায় রয়েছে। এর পরের ১২ নটিক্যাল মাইল সন্নিকটবর্তী অঞ্চল এবং এ অঞ্চলের সীমানা শেষ হলে শুরু হয় ‘একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল’, যা ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। এখন টাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী এই ২০০ নটিক্যাল মাইলের ওপর আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরেই সাগরের যে মহীসোপান, সেখানেও আমাদের অধিকার রক্ষিত হল। হামবুর্গের এই ট্রাইব্যুনালের রায় আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা হয়, গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের এলাকায় ১৮ বিলিয়ন ব্যারেল তেল ও ২০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ রয়েছে। বাংলাদেশ যে বড় ধরনের জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে এই রিজার্ভ আমাদের জন্য একটা সমাধান বয়ে আনতে পারে।
মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা এখন চিহ্নিত হল। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে না, এটাই আশা করি। কারণ বাংলাদেশের উন্নয়নে মিয়ানমারের প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের ‘পূর্বমুখী’ পররাষ্ট্রনীতির আলোকে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা অত্যন্ত প্রয়োজন। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের **-কে আরও শক্তিশালী করা দরকার। বিশেষজ্ঞ টিম তৈরি করাও জরুরি। কারণ একুশ শতকে সমুদ্র হবে সম্পদের আধার। এ সম্পদের সুষ্ঠু আহরণ ও ব্যবহারের জন্য চাই দক্ষ জনশক্তি।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[সূত্রঃ যুগান্তর, ১৬/০৩/১২