রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

তুরস্কের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে

ঢাকা থেকে তুরস্কের এরজুরুমের দূরত্ব কতটুকু বলতে পারব না। কিন্তু টার্কিস এয়ারলাইন্সের সহযোগী বিমান সংস্থা ওডুগোলোগোর বিমানে করে যখন সন্ধ্যাবেলায় এরজুরুমের বিমানবন্দরের টারমাকে পা রাখলাম, তখন সেখানকার তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রি। অথচ আমি ঢাকা ছেড়েছিলাম প্লাস ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা নিয়ে। এরজুরুমের আতাতুর্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে সেখানে গেছি। উদ্দেশ্য প্রথম আনাতোলিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়া। সেখানে যোগ দিয়েছিলেন প্রায় ২৬টি দেশের বিশেষজ্ঞরা। মূল বিষয় ছিল জীববৈচিত্র্য, ভ্রমণ ও পরিবর্তিত বিশ্ব নিয়ে আলোচনা করা। আমি নিজেও একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছি, যা প্রশংসিত হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে তুরস্কের সঙ্গে যাদের সাংস্কৃতিক বন্ধন ছিল, সেসব দেশকে নিয়েই এ সম্মেলন। সম্মেলনে তাজিকিস্তান, কিরঘিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাখিস্তান, আজারবাইজানের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি মালয়েশিয়া, ভারত কিংবা পাকিস্তানের প্রতিনিধিরাও অংশ নিয়েছেন। আফগানিস্তান ও মঙ্গোলিয়ার প্রতিনিধিরাও ছিলেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র হিসেবে আমার কাছে বারবার মনে হয়েছে, একুশ শতকে এসে তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে চায়। তাদের সেই যোগ্যতা রয়েছে এবং তাদের পক্ষে সেটা সম্ভবও। সম্মেলনে যোগ দেয়া কিংবা তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে আমার বারবার মনে হয়েছে আমরা তুরস্ক থেকে কত পিছিয়ে আছি। আজ তুরস্কের নেতৃত্ব দেশটিকে যেখানে নিয়ে গেছে, আমরাও তো পারতাম বাংলাদেশকে সেখানে নিয়ে যেতে। কেন পারলাম না? বরং মেধার দিক থেকে আমাদের প্রজন্ম তুরস্ক থেকে অনেক এগিয়ে থাকলেও নেতৃত্বের প্রশ্নে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। প্রায় দু’সপ্তাহ তুরস্ক সফর করে তুরস্ক সম্পর্ক সবকিছু জানা সম্ভব নয়। কিন্তু ইস্তামবুল, আনকারায় যাদের সঙ্গেই আমার কথা হয়েছে, আমি জানতে চেয়েছি মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের অবস্থান কোথায়। তুরস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা ‘জামান’ (প্রচার সংখ্যা ১০ লাখ)-এর অঙ্গসংগঠন’র বিদেশ ডেস্কের প্রধান ইয়াকুপ সালভারসি, ফাতেহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (ওরা ভাইস রেক্টর বলে) প্রফেসর বজকুর্ট কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ড. জেনসের সঙ্গে আলাপ ও মতবিনিময় করে আমার মনে হয়েছে, ‘নতুন এক তুরস্ককে’ আমরা দেখতে পাব এই শতাব্দীতে। সেই মেধা, অর্থনৈতিক ভিত্তি তাদের রয়েছে। ইস্তামবুলে * মতো মিউজিয়াম তৈরি করে তারা তাদের ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করে রেখেছে। ঞঙচকঅচও-তে হজরত আলীর (রা.) ব্যবহৃত তলোয়ারও সংরক্ষণ করা হয়েছে। রয়েছে মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর দাড়ি মোবারক ও তার সাহাবিদের ব্যবহৃত পোশাক। হজরত আলী (রা.) যে তলোয়ারটি যুদ্ধে ব্যবহার করতেন, তা এত বড় ও চওড়া যে ভাবতে অবাক লাগে এই তলোয়ার দিয়ে তিনি কীভাবে যুদ্ধ করতেন।

তুরস্ক তাদের ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করেছে। প্রায় পাঁচশ’ বছরের পুরনো মসজিদও রয়েছে ইস্তামবুলে একাধিক। একটি জাতি তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করে দেশটিকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তুরস্ক তার বড় প্রমাণ। *’র মিউজিয়ামটি দেখে আমার শাহবাগের মিউজিয়ামের কথাটি মনে হয়েছিল। আমরা কী সেখানে পুরোপুরিভাবে আমাদের অতীতকে সংরক্ষণ করতে পেরেছি? পারলে কতটুকু পেরেছি? বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জনমত ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের দাবি উপেক্ষা করে ফ্রান্সের একটি জাদুঘরের জন্য পাঠানো হয়েছিল আমাদের কিছু প্রত্ননিদর্শন। সাবেক আমলা (পাক আমলের সিএসপি) আইয়ুব কাদরী সব প্রতিবাদ উপেক্ষা করে নিজ ক্ষমতাবলে (শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা) আমাদের কিছু প্রত্ননিদর্শন গিমের মিউজিয়ামে পাঠিয়েছিলেন। অভিযোগ আছে, সব প্রত্ননিদর্শন ফেরত আসেনি। ভাবতে অবাক লাগে, বিষয়টি নিয়ে তেমন আর আলোচনা হল না এবং কাদরী সাহেবের ভূমিকা পর্দার অন্তরালেই থেকে গেল। পৃথিবীর কোন দেশেই এটা সম্ভব নয়। কেউ এটা চিন্তাও করতে পারে না। লাখ লাখ ডলারে এসব প্রত্ননিদর্শন বিক্রি হয়। ওই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে একটি আন্তর্জাতিক চোরাকারবারির দল অত্যন্ত সক্রিয়। তারা এগুলো কিনে নেয় অল্প দাম দিয়ে। পরে অত্যন্ত চড়া দামে তা ইউরোপ তথা আমেরিকার বাজারে বিক্রি করে। তুরস্কেও এমনটি ঘটেছিল। কিন্তু ওরা পেরেছে। আমেরিকার মতো দেশ থেকে ওরা ওদের চুরি হয়ে যাওয়া প্রত্ননিদর্শন ফেরত নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমরা পারিনি। অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে গিমের মিউজিয়ামে পাঠানো প্রত্ননিদর্শনগুলো নিয়ে (যার একটা অংশ হারিয়ে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে) আর আলোচনা হয় না। একটা জাতি যদি তার ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে না পারে, সে জাতি নিজেকে কখনও উন্নত করতে পারে না। ঞঙচকঅচও-তে আমি অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকদের ব্যবহৃত পোশাক, অলংকারাদিও দেখেছি। আমাদের এই অঞ্চলের শাসকদের পাঠানো উপহার সামগ্রীও সেখানে প্রদর্শন করা হয়। লন্ডন কিংবা নিউইয়র্কের মিউজিয়ামের চেয়ে কোন অংশে কম নয় ইস্তামবুলের *’র মিউজিয়ামটি।

ইস্তামবুলের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বসফরাস চ্যানেল। ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই এ চ্যানেলের কথা জানেন। এটাকে ওরা ওদের ভাষায় বলে ইড়মধুরপর। ইউরোপ আর এশিয়ার সংস্কৃতির এক যোগসূত্র হচ্ছে বসফরাস চ্যানেলের ওপর নির্মিত সেতুটি। এ চ্যানেল কৃষ্ণ সাগরের সঙ্গে মার্মার সাগরকে সংযুক্ত করেছে। পরে মার্মার সাগর আজিয়ান সাগরের সঙ্গে মিশে ভূমধ্যসাগরে গিয়ে মিশেছে। যারাই ইস্তামবুলে যান, তারা ছোট্ট জাহাজে করে বসফরাস চ্যানেল দিয়ে দেড় ঘণ্টার এক সাগর ভ্রমণ করেন। বসফরাস চ্যানেলের একদিকে ইউরোপ, অন্যদিকে এশিয়া। দুই ঐতিহ্যই ধারণ করেছে ইস্তামবুল। বসফরাস চ্যানেল দিয়ে যখন সাগরে যাচ্ছি, তখন আমার মনে পড়ে গেল বুড়িগঙ্গার কথা। বসফরাস চ্যানেলের পানি এত স্বচ্ছ, এত পরিষ্কার। আর আমরা বুড়িগঙ্গাকে ইতিমধ্যে হত্যা করেছি। বুড়িগঙ্গার পানি এত দুর্গন্ধময় ও কালো যে শরীরে লাগলে তাতে চর্মরোগ হতে বাধ্য। বুড়িগঙ্গা পর্যটকদের জন্য আমরা আকর্ষণীয় করে তুলতে পারতাম। কিন্তু আমাদের দেশের পরিবেশমন্ত্রীরা আসেন আর যান, কেউ বুড়িগঙ্গা নিয়ে ভাবেন না। আমাদের মন্ত্রীরা তো ইস্তামবুলে রাষ্ট্রীয় সফরে যান। তাদের কারোর কি বসফরাস চ্যানেল দেখার সময় বুড়িগঙ্গার কথা মনে হয়েছে? আমাদের বর্তমান পরিবেশমন্ত্রী অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। ‘পরিবেশ রক্ষায়’ বিশ্বব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি সুদূর এন্টার্কটিকায় গিয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রী বাহাদুরের সময় কি কখনও হয়েছে বুড়িগঙ্গার কালো পানি দেখার? সচিবালয় থেকে বুড়িগঙ্গার দূরত্ব কত? পাঁচ কিলোমিটার। মন্ত্রী সাহেব সুদূর এন্টার্কটিকায় যান। কিন্তু যান না বুড়িগঙ্গায়। আমরা পরিবেশ নিয়ে কথা বলি। পরিবেশ তথা জীববৈচিত্র্য নিয়ে কথা বলতে আমরা গিয়েছিলাম তুরস্কে। বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে সম্মেলনে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন ফ্রান্সের সাভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. কারমেন ডি জং। তিনি উদ্বিগ্ন জলবায়ু উদ্বাস্তু নিয়ে। পানি সমস্যা নিয়েও উদ্বিগ্ন তিনি। সারা বিশ্ব তিনি চষে বেড়ান। পরিবেশ নিয়ে কথা বলেন। তাকে বুড়িগঙ্গার কথা বললাম। তিতাসে বাঁধ দেয়ার প্রশ্ন উঠল। পরিবেশবিদ প্রফেসর কারমেন জানতে চাইলেন পরিবেশমন্ত্রীর ভূমিকার কথা। আমার কোন জবাব ছিল না। আমরা সেই মন্ত্রী কবে পাব, যিনি বিদেশ সফর না করে নিজ দেশের পরিবেশ রক্ষায় নিরলস কাজ করে যাবেন। ড. কারমেন জানালেন, নদী রক্ষায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাহায্য দেয়। বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে আমাদের পরিবেশমন্ত্রী কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলবেন?

সম্মেলনে অংশ নিয়ে আমার মনে হয়েছে, তুরস্কের কাছ থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। তুরস্কের ইতিহাস ও সভ্যতা কয়েক হাজার বছরের পুরনো হলেও আধুনিক তুরস্কের যাত্রা ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর, যখন তুরস্ক মুস্তাফা কামাল পাশার নেতৃত্বে একটি রিপাবলিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর আগে দেশটি ৬২৩ বছর অটোমান শাসকদের দ্বারা পরিচালিত হতো। অটোমান শাসকরা সুলতান হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বাংলাদেশের চেয়ে সাড়ে পাঁচগুণ বড় তুরস্ক। কিন্তু লোকসংখ্যা মাত্র সাড়ে ৭ কোটি, বাংলাদেশের অর্ধেক। বাংলাদেশ যদি জনসংখ্যার হার আরও কমিয়ে আনতে না পারে, তাহলে তা উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে আটকে দেবে। তুরস্ক এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য একটি মডেল। তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আমাদের জন্য একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে যৌথ উদ্যোগে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার। তুরস্ক এখন একটি মধ্য আয়ের দেশ। ক্রয় ক্ষমতা অনুযায়ী (পিপিপি) তুরস্কের জিডিপি এখন ১ দশমিক ১১৬ ট্রিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় (পিপিপি) বছরে ১৫ হাজার ৩৪০ ডলার। বিশ্ব অর্থনীতিতে তুরস্কের অবস্থান ১৫তম। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ও’নেইল ২০১১ সালে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছেন। তাতে তিনি তুরস্ককে অন্তর্ভুক্ত করেছেন * গ্রুপে, অর্থাৎ মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্ক বিশ্বে নতুন একটি অর্থনৈতিক ব্লক সৃষ্টি করেছে। জিম ও’নেইল এ চারটি দেশকে শুধু দ্রুতবর্ধনশীল উন্নয়নশীল বিশ্ব বলতে নারাজ। ২০০১ সালে তিনিই **-এর ধারণা দিয়েছিলেন (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন)। বাংলাদেশ গওকঞ মডেল অনুসরণ করতে পারে এবং এ ব্লকের দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে পারে।

২০০২ সাল থেকেই জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির নেতৃত্বে একটি সরকার সেখানে স্থিতিশীলতা উপহার দিয়ে আসছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল (২০০৭ সাল থেকে) ও প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইপ এরদোগান অত্যন্ত জনপ্রিয়। এদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোন অভিযোগ নেই। পর পর তিনবার এরদোগান প্রধানমন্ত্রী ও তার দল বিজয়ী হয়েছে (২০০২ সালে ৩৪ ভাগ, ২০০৭ সালে ৪৭ ভাগ আর ২০১১ সালে ৪৯ ভাগ ভোট)। প্রেসিডেন্ট গুল ও প্রধানমন্ত্রী এরদোগান ব্যক্তিজীবনে ইসলামিক জীবনধারা (তাদের স্ত্রীরা মাথায় হেজাব ব্যবহার করেন) অনুসরণ করলেও তারা কট্টর নন। তারা বাধ্য করছেন না সবাইকে ইসলামিক অনুশাসন মেনে চলতে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রীদের জন্য ‘হেজাব না পরার’ যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তা তুলে নেয়া হয়েছে। আমি বেশ ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি, মেয়েরা আদৌ হেজাব পরে না। জিন্স প্যান্ট পরা আধুনিক মেয়েদের ক্যাম্পাসে চলাফেরা আমাকে ইউরোপের দেশগুলোর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্বে অভিযোগ রয়েছে যে, দলটি ইসলামপন্থী ও কট্টর। কিন্তু তুরস্কে আমি এ অভিযোগ শুনিনি। সেখানে আদৌ কোন জঙ্গিবাদী তৎপরতা নেই। একাধিক ফোরামে আমি আল-কায়েদার তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন করেছি। জবাব পেয়েছি একটাই, সেখানে আল-কায়েদার কোন তৎপরতা নেই। একটি মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশ যে ব্যক্তিজীবনে ইসলামকে ধারণ করেও আধুনিকমনস্ক হতে পারে, তুরস্ক তার বড় প্রমাণ। কামাল পাশা (যিনি জাতির পিতাও বটে) তুরস্কে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। তা আজও আছে। কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে বটে, তবে তাতে মূলনীতিতে তেমন পরিবর্তন আসেনি। আমি তুরস্কে কোথাও শুনিনি যে, বিরোধী পক্ষ সরকারের ইসলামপন্থী কিছু কর্মকাণ্ডকে ‘জঙ্গিবাদী’ তৎপরতা বলে দাবি করছে (অথচ আমরা জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গটি বারবার টেনে আনছি)। অত্যন্ত ‘ক্লিন’ চরিত্রের অধিকারী এরদোগান ছিলেন ইস্তামবুলের মেয়র। বাংলাদেশ তুরস্কের এই ‘রাজনীতি’ থেকে কিছুটা শিখতে পারে। তুরস্ক মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে তার পুরনো সম্পর্ক নতুন করে স্থাপন করার উদ্যোগ নিচ্ছে। পুরনো ‘সিল্করোড’কে নতুন করে আবার ‘আবিষ্কার’ করছে তুরস্ক। চেষ্টা করছে ওই দেশগুলোকে একটি প্লাটফর্মে দাঁড় করাতে। তুরস্ক হতে যাচ্ছে ‘সিল্করোড’ভুক্ত দেশগুলোর নেতা। বাকু-তিবিলিসি-সাইহান পাইপ লাইন (গ্যাস ও তেল) এ লক্ষ্যেই রচিত। চার বছর পর পর সেখানে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর সংসদ নির্বাচনে যারা ন্যূনতম ১০ ভাগ ভোট পেয়েছে, সংসদে তারাই দলীয়ভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। যদিও ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের’ আলোকে সেখানে নির্বাচন হয়।

তুরস্ক আধুনিক মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি আদর্শ। একটি ইসলামপন্থী দলও যে জনসমর্থন পেতে পারে এবং আধুনিকমনস্ক একটি নীতি গ্রহণ করে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে একটি মডেল হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে পারে, তুরস্ক হচ্ছে তার বড় প্রমাণ। তুরস্ক থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।

ড. তারেক শামসুর রেহমান 
প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
 জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[সূত্রঃ যুগান্তর, ১২/০৩/১২]

0 comments:

Post a Comment