রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

তুরস্ক কেন আমাদের জন্য একটি মডেল


তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন

তুরস্কের (এরজুরুম) আতাতুর্ক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান কিংবা তুরস্কের সুশীল সমাজের কারও কারও সঙ্গে মতবিনিময়ের পর আমার যে ধারণাটি বদ্ধমূল হয়েছে, তা হচ্ছে তুরস্ক বাংলাদেশের জন্য একটা মডেল হতে পারে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত তুরস্ক সম্পর্কে আমার একটা ভুল ধারণা ছিল। বিশেষ করে আশির দশকে জার্মানিতে থাকার সুবাদে সেখানে বসবাসকারী তুর্কি নাগরিকদের আমি কাছ থেকে দেখেছি। অর্ধশিক্ষিত তুর্কি নাগরিকরা জার্মানিতে শ্রমিক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। জার্মানিতে থেকেও জার্মান সংস্কৃতি ধারণ না করায় তুর্কি নাগরিকদের সম্পর্কে সেখানে একটা খারাপ ধারণা ছিল। কিন্তু গত ২০ বছরে তুরস্ক যে কীভাবে বদলে গেছে, তা না দেখে বিশ্বাস করা যাবে না। সেখানকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেখানে শুধু স্থিতিশীলতাই উপহার দেননি, বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে দেশটিকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি উঠতি শক্তি। তাই আমার বারবার মনে হয়েছে বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ‘তুরস্ক মডেল’কে অনুসরণ করতে পারে। প্রসঙ্গত, দুটো দেশই মুসলিমপ্রধান ও দেশ দুটোতে রাজনীতিতে সেনবাহিনীর হস্তক্ষেপের ইতিহাস আছে। তুরস্কের ‘জাতির পিতা’ মুস্তাফা কামাল পাশা। তিনি নিজে ছিলেন সেনাবাহিনীর লোক। তার নেতৃত্বেই তুরস্ক অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিলোপ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর তুরস্ক প্রজাতন্ত্র হিসেবে জন্মলাভ করে। এর ঠিক ৩৭ বছর পর ১৯৬০ সালে সেনাবাহিনী জেনারেল সিমেল গুরসেলের নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করে। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনী তিনবার ক্ষমতা দখল করেছিল। সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল এভরেন ১৯৮০ সালে। জেনারেল এভরেনের স্বাভাবিক অবসরের পর (১৯৮৯) সেনাবাহিনী আর ক্ষমতা গ্রহণ করেনি। এটা সম্ভব হয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ও দলটির পূর্ব নাম ইসলামিক ওয়েলফেয়ার পার্টির কারণে। দলটির নেতৃত্ব অত্যন্ত সত্ ও মেধাবী। ওয়েলফেয়ার পার্টির নেতা এরবাকানের স্বাভাবিক মৃত্যু ও দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নামে দলটি আত্মপ্রকাশ করে। দলটির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এরদোগান। ২০০২ সালের নির্বাচনে দলটি পেয়েছিল ৩৪ ভাগ ভোট, আর ২০১১ সালে সর্বশেষ নির্বাচনে তারা পায় ৪৯ ভাগ ভোট। এ থেকেই বোঝা যায় দলটির জনপ্রিয়তা কত বেশি। মাঝখানে ২০০৭ সালের নির্বাচনে তারা পেয়েছিল ৪৭ ভাগ ভোট। দলটির জনপ্রিয়তার মূল কারণ হচ্ছে এর নেতৃত্বের সারিতে যারা আছেন, তারা কেউ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন। সাবেক শাসকরা দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। ফলে দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সরকারের ভূমিকাকে তারা সমর্থন করে। দ্বিতীয়ত, ইসলাম ও গণতন্ত্র যে একে অপরের পরিপূরক এবং ইসলাম গণতন্ত্রের শত্রু নয়, কিংবা গণতন্ত্র ইসলামের বিরোধী নয়, ক্ষমতাসীন দল এটা প্রমাণ করেছে। মানুষ এটা মেনে নিয়েছে। এটাই তুরস্কের ঐতিহ্য। কামাল আতাতুর্ক দেশটিকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি তুরস্ককে একটি আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন। তাতে তিনি সফল হয়েছেন, সন্দেহ নেই। তিনি একটি বিষয় বিবেচনায় নেননি, আর তা হচ্ছে মুসলিম ঐতিহ্য। মুসলমানদেরকে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তিনি নিজেকে একজন ইউরোপিয়ান ভাবতেন। তুরস্কে মাদ্রাসা শিক্ষা ছিল। তা আতাতুর্ক নিষিদ্ধ করেছিলেন। বর্তমান সরকার সীমিত পরিসরে মাদ্রাসা চালু করেছে। মেয়েদের মাথায় ওড়না বা হিজাব ফিরে এসেছে। একসময় এই ওড়না ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ ছিল। মেয়েরা ওড়না পরতে পারত না। এখন সেই বাধা নেই। নিজের খুশি। কেউ পরে। কেউ পরে না। তবে ক্যাম্পাসে আমি শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ মেয়েকেই দেখেছি স্কার্ফ ব্যবহার করে না। ইসলাম ও গণতন্ত্রকে এক করে এরদোগান যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছেন তুরস্কে, এটা একটা মডেল। অনেক আরব দেশ, বিশেষ করে ‘আরব বসন্ত’-এর পর তারা এই রাজনীতি গ্রহণ করেছে। এর ফলে দলটিকে পুরোপুরি ইসলামিক শাসনে বিশ্বাসী, তা বলা যাবে না। তারা যথেষ্ট আধুনিকমনস্ক। তারা অনেকটা ফাতেহউল্লাহ গুলেনের ভাবধারার অনুসারী (ঞযব ারংরড়হ ধহফ রসঢ়ধপঃ ড়ভ ঋবঃযঁষষধয েঁষবহ)। ২০০৮ সালে ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন ফাতেহউল্লাহ গুলেনকে বিশ্বের শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের একজন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই বুদ্ধিজীবী তুরস্কের নাগরিক হয়েও তুরস্কে থাকেন না। থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। ইসলাম যে আধুনিকমনস্ক একটি সমাজব্যবস্থা, তা গুলেনের লেখায় পাওয়া যায়। তাই তুরস্কের বাইরে ক্ষমতাসীন পার্টিকে (জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) আল কায়দার মিত্র বলে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস চালানো হলেও তা ধোপে টেকেনি। বরং তুরস্কের নেতৃত্ব সেই প্রথম থেকেই আল কায়দার কর্মকাণ্ডকে সমালোচনা করে আসছেন। এবং এখনও করছেন। মানুষ এটা গ্রহণ করেছে। যে কারণে তুরস্কে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নেই। মানুষ সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয়ও দেয় না। বর্তমান সরকারের এটা একটা বড় সাফল্য। তৃতীয়ত, বর্তমান সরকারের গতিশীল নেতৃত্বের কারণে তুরস্ক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বে অন্যতম একটি শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। সারা ইউরোপ যেখানে বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়েছে, সেখানে বিশ্বমন্দা তুরস্কের অর্থনীতিকে এতটুকুও আঘাত করেনি। বরং ২০১০ সালে যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.৯ ভাগ, তা ২০১১ সালে ১১ ভাগে উন্নীত হয়েছে। অনেক ইউরোপীয় দেশের তুলনায় তুরস্কে বেকার সংখ্যা কম (৯.২ ভাগ)। অথচ স্পেনে ২২.৬, গ্রিসে ১৭.৬, লিথুনিয়ায় ১৫.৫, যুক্তরাষ্ট্রে ৯.১ ও ফ্রান্সে ৯.৯ ভাগ। এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দলটিকে ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করছে। চতুর্থত, দলটির বড় সাফল্য সেনাবাহিনীকে গণতন্ত্রমুখী করা। ৩৬৫ জন জেনারেল, আর ৭ লাখ ২০ হাজার সেনা সদস্যকে নিয়ে যে বিশাল সেনাবাহিনী তুরস্কের, ন্যাটোতে তার অবস্থান দ্বিতীয়। এই সেনাবাহিনী বরাবরই একটি রাজনৈতিক সরকারের জন্য ‘থ্রেট’ বা হুমকি। এরদোগান নিজে একটি কবিতা লিখে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে বিরোধিতার সম্মুখীন হয়ে জেলে গিয়েছিলেন। সেদিন তিনি (২০০২) প্রধানমন্ত্রী প্রথমে হতে পারেননি। পরে উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পার্লামেন্টে আসেন। সেই সেনাবাহিনীকে তিনি গণতন্ত্রমুখী করেছেন। সেনাবাহিনী এখন গণতন্ত্রের প্রতি ‘কমিটেড’। সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৈরিতায় না গিয়ে, তাকে গণতন্ত্রের মূল ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে এরদোগান যে সফলতা পেয়েছেন, তা সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি ‘মডেল’। বিশেষ করে মিসর, তিউনিসিয়া কিংবা ইয়েমেন এই মডেল অনুসরণ করতে পারে। পঞ্চমত, তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেশটিকে মধ্যএশিয়াসহ মুসলিম বিশ্বে বিনিয়োগ বাড়াতে সাহায্য করছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি ২০১২ সালে মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের বিনিয়োগ গিয়ে দাঁড়াবে ২২২ বিলিয়ন ডলার। মিসর (১৭৬ মিলিয়ন) ও ইরানের (১৭৬ মিয়িলন) মতো দেশেও গেল বছর বড় বিনিয়োগ ছিল তুরস্কের। ক্রয় সক্ষমতা অনুযায়ী (পিপিপি) তুরস্কের জিডিপি এখন ১ দশমিক ১১৬ ট্রিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ১৫ হাজার ৩৪০ ডলার, যা যে কোনো ইউরোপীয় দেশের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক তার বৈদেশিক নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও নানা কারণে এই সম্পর্ক এখন ‘শীতল’। ন্যাটোর সদস্য হলেও সকল ইস্যুতে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত, তা বলা যাবে না। তবে সিরিয়া সঙ্কটে পশ্চিমা বিশ্বের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তুরস্ক। তুরস্কের সঙ্গে রয়েছে সিরিয়ার সীমান্ত। সিরিয়ার নাগরিকদের জন্য ‘মানবিক কারণে’ সীমান্ত খুলে দিয়েছে তুরস্ক। সিরিয়া সঙ্কটে ‘পশ্চিমা হস্তক্ষেপ’ তুরস্ক সমর্থন না করলেও বাশার আসাদ স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিলে সঙ্কটের সমাধান হতে পারে, এটাও মনে করে তুরস্ক। সেই সঙ্গে সোমালিয়ার মতো মুসলমানপ্রধান দেশের সঙ্কট নিরসনে তুরস্কের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে। এরদোগান নিজে সোমালিয়া সফর করে একটি মুসলমানপ্রধান দেশের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করেছেন। যুদ্ধপীড়িত সোমালিয়ার শত শত শিশুকে তুরস্কের বিভিন্ন স্কুলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছে তুরস্ক সরকার। এর ফলে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত আল সাহাব গ্রুপের প্রভাব সোমালিয়ায় কিছুটা হ্রাস পাবে। ইতোমধ্যে মোগাদিসুতে প্রথম বিদেশি সংস্থা হিসেবে তার্কিশ বিমান লাইন সপ্তাহে দু’বার তার ফ্লাইট শুরু করেছে। সোমালিয়ায় তুরস্কের ভূমিকা সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে সাহায্য করবে। অন্যদিকে তুরস্কের সীমান্তঘেঁষা মুসলিমপ্রধান মধ্যএশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার উদ্যোগ নিচ্ছে তুরস্ক। একসময় ওই অঞ্চলগুলোর ওপর দিয়েই প্রাচীন ‘সিল্ক রোড’ চলে গিয়েছিল। তুরস্ক এখন সেই ‘সিল্ক রোড’ পুনরুজ্জীবিত করছে। মধ্যএশিয়ার জ্বালানি সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার করতে চাইছে তুরস্ক। আর এ লক্ষ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাকু-তিবিলিসি-সাইনহান গ্যাস পাইপলাইন।
রাজনৈতিক সংস্কৃতি, দক্ষ ব্যবস্থাপনা, যোগ্য নেতৃত্ব, অর্থনৈতিক অগ্রগতি তুরস্ককে আজ মুসলিম বিশ্বে শীর্ষ অবস্থান দিয়েছে। একসময় মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদকে নিয়ে মুসলিম বিশ্ব স্বপ্ন দেখত। মাহাথির-পরবর্তী মালয়েশিয়ার নেতৃত্ব সেই প্রত্যাশা শতকরা একশ’ ভাগ পূরণ করতে পারেননি। এ কারণে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব নিয়ে এখন এরদোগানের কথা ভাবা হচ্ছে। এরদোগান সকল গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে শুধু আজ তুরস্ককেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন না, বরং মুসলিম বিশ্বের জন্যও একটা ‘ইমেজ’ সৃষ্টি করেছেন। তবে তিনি যে সঙ্কটমুক্ত, তা বলা যাবে না। কুর্দিদের নিয়ে সমস্যা আছে। সেনাবাহিনীও শতকরা একশ’ ভাগ বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। যোগ্য নেতৃত্ব ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে তিনি সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছেন। এরদোগানের সাফল্য এখানেই। বাংলাদেশ তুরস্কের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কিংবা নেতৃত্বের গুণাবলি থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে।
লেখক : প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tareque.rahman(a)aol.com

0 comments:

Post a Comment