রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

\'সিল্ক রোড\' ধরে যেতে যেতে




ইতিহাসের ছাত্র মাত্রেই \'সিল্ক রোড\' সম্পর্কে একটা ধারণা রাখেন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের এরজুরুম শহর থেকে চলে যাওয়া \'সিল্ক রোড\' ধরে যখন একটি গ্রামে যাচ্ছি, তখন ইতিহাস ধরা দিল আমার কাছে। এরজুরুম শহরে এসেছি আতাতুর্ক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে। ঊঝজটঈ সম্মেলন। এর অর্থ ঊঁৎড়অংরধহ ঝরষশ জড়ড়ফ টহরাবৎংরঃু পড়হাবহঃরড়হ. বলা যেতে পারে, সিল্ক রোডভুক্ত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তথা শিক্ষার্থীদের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন। আমাদের \'সিল্ক রোড\' দিয়ে যাওয়ার কোনো প্রোগ্রাম ছিল না। কিন্তু এটা সম্ভব হয়েছিল প্রফেসর জেকারিয়া আতাতুর্কের সৌজন্যে। মাইলের পর মাইল আমরা মাইনাস ২৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ভ্রমণ করেছি। তুরস্ক এই \'সিল্ক রোড\' নতুন করে তৈরি করেছে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, মধ্য এশিয়ার মুসলমান প্রধান দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো। ঐতিহাসিকভাবেই তুরস্কের সঙ্গে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর একটা সম্পর্ক রয়েছে। ইতিহাস বলে, আজকের তুরস্কের জনগোষ্ঠী একসময় মধ্যযুগে মধ্য এশিয়া থেকে এসেছিল। তাদের বলা হতো ঙমযুঁ ঞঁৎশং, অর্থাৎ টার্কিস ট্রাইজ। এগারো শতকে তারা ইসলাম গ্রহণ করেন এবং এক সময় উরাল হ্রদ থেকে অঞ্চল ছেড়ে আজকের পারস্যে বসবাস করেন। তারাই জন্ম দিয়েছিলেন এৎবধঃ ঝবষরলঁশ সাম্রাজ্যের। ওই শতকের শেষ দিকে ওই সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটে পূর্ব আনাতোলিয়ায়, আজকে যা তুরস্কের অন্তর্ভুক্ত। ইতিহাসে আরও আছে, মোঙ্গলরা ১২৪৩ সালে ঝবষরলঁশ সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে। এর মধ্য দিয়ে জন্ম হয় অটোমান সাম্রাজ্যের। আর এর ঠিক ২১০ বছর পর ১৪৫৩ সালে বাইজেনটাইনদের পরাজিত করে এ অঞ্চলজুড়ে গড়ে ওঠে বিশাল অটোমান সাম্রাজ্য, যে সাম্রাজ্য টিকেছিল ৬২৩ বছর। এসব ইতিহাসের কথা। আজ এত বছর পর সিল্ক রোড ধরে যেতে যেতে আমার বারবার মনে হয়েছিল, তুরস্ক কি সত্যিকার অর্থে একুশ শতকে নিজেকে নতুন এক অটোমান সাম্রাজ্য দেখতে চায়? তুরস্কে, বিশেষ করে ইস্তাম্বুলের ফাতেহ বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা এরজুরুমের আতাতুর্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আলাপচারিতায় কেউই তুরস্ককে একটি আগ্রাসী শক্তি হিসেবে দেখতে চাননি। তবে তুরস্ক এ অঞ্চলের উন্নয়নে একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে, এটা তাদের অভিমত।
যারা সিল্ক রোড সম্পর্কে ধারণা রাখেন,তারা জানেন, সিল্ক রোডে দুটি রুট ছিল। একটি সড়কপথ, যা অনেক দেশের ওপর দিয়ে গেছে। অপরটি সাগররুট। তবে সড়কপথের সঙ্গে সাগররুটের একটা সংযোগ ছিল। প্রায় ৪ হাজার মাইল বিস্তৃত সিল্ক রোডটি এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের যোগসূত্র ঘটিয়েছে। ইতিহাসে আছে, চীনের হান রাজবংশের আমলে (খ্রিস্টপূর্ব ২০৬ থেকে ২২০), চীনের ব্যবসায়ীরা এই সড়ক ও সাগরপথ ধরে ব্যবসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তেন। তারা চীন থেকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন চীনের বিখ্যাত সিল্ক কাপড়, শার্টিন, চা ও পোরসেলিনের দ্রব্যাদি। সাগররুটে তারা ভারতে আসতেন। এখান থেকে নিয়ে যেতেন মসলা, হাতির দাঁত এবং অলঙ্কারাদি। যেহেতু চীনারা সিল্ক কাপড়ের ব্যবসা করতেন, সে কারণেই তাদের ব্যবহৃত পথটি \'সিল্ক রোড\' হিসেবে পরিচিত। সড়কপথটি চীনের বিভিন্ন অঞ্চল হয়ে মঙ্গোলিয়া, মধ্য এশিয়া, পারস্য ও আজকের তুরস্কে এসে শেষ হয়েছিল। এরপর ভূমধ্যসাগর হয়ে সাগররুটে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল ইউরোপের সঙ্গে। অন্যদিকে \'সি রুট\' বা সাগররুট ইন্দোনেশিয়ার জাভা ও ভারত মহাসাগর হয়ে একদিকে সৌদি আরব ও মিসর, অন্যদিকে সোমালিয়ায় গিয়ে শেষ হয়েছিল। এই সিল্ক রোড নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে চীনের, আগ্রহ রয়েছে তুরস্কেরও। চীন মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সমন্বয়ে গড়ে তুলেছে \'সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন\', যার সদস্য রাশিয়াও বটে। তুরস্কও গড়ে তুলেছে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা। ঊঝজটঈ সম্মেলনে যোগ দিতে এসে আমার মনে হয়েছে, চলতি শতাব্দীতেই তুরস্ক সিল্ক রোডভুক্ত দেশগুলোকে একটি প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে চায়। তবে একটা বড় প্রশ্ন থেকেই গেল, চীনের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হবে? এর জবাব শুধু ভবিষ্যৎই দিতে পারে। অস্বীকার করা যাবে না এ অঞ্চলে তুরস্ক অন্যতম একটি শক্তি। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য এবং মুসলিম দেশ হিসেবে ইসরায়েলের সঙ্গে এর কূটনৈতিক সম্পর্কও রয়েছে। যদিও এই সম্পর্কে এখন ভাটা পড়ছে। তুরস্কের অর্থনীতি, জনসাধারণের জীবনধারণের মান ইউরোপের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়নে তুরস্কের অন্তর্ভুক্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তুরস্ক আমাদের জন্য একটি মডেলও। তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শুধু মধ্য এশিয়ার দেশগুলো কেন, আমাদের জন্যও একটা আশার সঞ্চার করেছে। মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের বিনিয়োগও বাড়ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১২ সালে মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের বিনিয়োগের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ২২২ বিলিয়ন ডলারে। মিসর (১৭৬ মিলিয়ন) ও ইরানের (১৭৬ মিলিয়ন) মতো দেশেও গত বছর বড় বিনিয়োগ ছিল তুরস্কের। ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী (পিপিপি) তুরস্কের জিডিপি এখন ১ দশমিক ১১৬ ট্রিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় (পিপিপি) বছরে ১৫ হাজার ৩৪০ ডলার। বিশ্ব অর্থনীতিতে তুরস্কের অবস্থান ১৫তম। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান ম্যাকসের অর্থনীতিবিদ জিম ও নেইল ২০১১ সালে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছেন। তাতে তিনি তুরস্ককে অন্তর্ভুক্ত করেছেন গওকঞ গ্রুপে, অর্থাৎ মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্ককে নিয়ে এসেছেন এক কাতারে। এই ৪টি দেশকে শুধু দ্রুত বর্ধনশীল, উন্নয়নশীল বিশ্ব বলতে তিনি নারাজ। এর চেয়ে আরও কিছু বেশি। তাই সঙ্গত কারণেই তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি মডেল। সারা আরব বিশ্ব যখন একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের মুখোমুখি, তখন তুরস্কের স্থিতিশীলতা সারাবিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছে। এ জন্যই টাইম ম্যাগাজিন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগানকে নিয়ে প্রচ্ছদ করেছিল গত বছর ২৮ নভেম্বরের সংখ্যায় (ঊৎফড়মধহরং ধিু)। তুরস্কে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন একটি সরকার (২০০২ সাল থেকে ক্ষমতায়) সেখানে যে রাজনীতির জন্ম দিয়েছে, তার মূল কথা হচ্ছে \'ইসলাম ও গণতন্ত্র\', যা কি-না এখন \'আরব বসন্ত\'-পরবর্তী আরব বিশ্বের রাজনীতির মূল কথা। তিউনিসিয়া, মরক্কো কিংবা মিসরের রাজনীতি এখন \'ইসলাম এবং গণতন্ত্র\'কে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটা একটা মডেল। অভিযোগ উঠেছে, জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি কিছুটা ইসলামিক এবং মেয়েদের অধিকার রক্ষায় সচেতন নয়। অথচ আমরা পরিসংখ্যান পেয়েছি, তুরস্কের পার্লামেন্টে মহিলা এমপির সংখ্যা ৯ ভাগ থেকে ১৪ দশমিক ১ ভাগ বেড়েছে। কর্মজীবী মহিলাদের সংখ্যাও সেখানে কম নয়, ২৪ ভাগ (পুরুষ ৬৯.৬ ভাগ)। সেনাবাহিনী অতীতে বরাবরই তুরস্কে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে। মোস্তফা কামাল পাশা নিজে ছিলেন সেনাবাহিনীর লোক। তুরস্কের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা স্বীকৃত। এটা নিয়ে বর্তমান সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিরোধ নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। ৩৬৫ জন জেনারেল ও ৭ লাখ ২০ হাজার সেনাসদস্যকে নিয়ে গঠিত সেনাবাহিনীকে (ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম) গণতন্ত্রের মূলধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের উদ্যোগ গণতান্ত্রিক বিশ্বে প্রশংসিতও হয়েছে। ২০১০ সালে তুরস্কের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.৯ ভাগ, আর ২০১১ সালে তা উন্নীত হয়েছে ১১ ভাগে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশের তুলনায় তুরস্কের বেকার সংখ্যা কম, ৯.২ ভাগ (স্পেনে ২২.৬, গ্রিসে ১৭.৬, লিথুনিয়ায় ১৫.৫, যুক্তরাষ্ট্রে ৯.১ ফ্রান্সে ৯.৯১)। ইসলামমনস্ক একটি দল তুরস্কে ক্ষমতায় থাকলেও আল কায়দার কোনো তৎপরতা সেখানে নেই। দুর্নীতির তেমন কোনো অভিযোগও আমরা শুনিনি। তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি তুরস্ককে একটি অবস্থান তৈরি করে দিয়েছে মুসলিম বিশ্বে। দারিদ্র্যপীড়িত সোমালিয়া থেকে শত শত শিশুকে তুরস্ক বৃত্তি দিয়ে ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারার বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনার সুযোগ করে দিয়েছে। দেশটির সাহায্যের পরিমাণও বাড়ছে মুসলিম বিশ্বে। সিল্ক রোড ধরে চলতে চলতে আমার মনে পড়ে গেল সেমিনারের মূল সম্মেলন কক্ষে অভ্যর্থনায় নিয়োজিত তরুণীদের একটি কথা। আলাপচারিতায় গুল আমাকে বলছিল,\'ঞূৎশরুব নরৎ ফূহুধ মূপূ ড়ষধপধশ\'_ আমি ওর কথা নোট করে নিয়েছিলাম। এর অর্থ তুরস্ক আগামী দিনে বিশ্বশক্তিতে পরিণত হবে। জানি না এ কথার পেছনে কোনো
সত্যতা আছে কি-না। কিন্তু তুরস্ককে নিয়ে ভাবনার সুযোগ আছে যথেষ্ট।

প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান : শিক্ষক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Samakal,11.03.2012

0 comments:

Post a Comment