রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্য প্রসঙ্গে



ড. তারেক শামসুর রেহমান
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন অতি সম্প্রতি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, সীমান্তে ধারাবাহিকভাবে হত্যাকা- চলতে থাকলে তিনি জাতিসংঘে নালিশ জানাবেন। তার এ বক্তব্য এভাবেই পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য। কেননা ড. মিজান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হলেও, তিনি রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। তিনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। বাংলাদেশে কোথায় কোথায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, তার দেখভালের দায়িত্ব তার সংস্থার ওপর অর্পিত হয়েছে। তিনি কতটুকু করতে পেরেছেন, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন; কিন্তু তিনি যখন সীমান্তে ভারতীয় রক্ষী বাহিনীর গুলিতে প্রায় প্রতিনিয়ত বাংলাদেশিরা মারা যাচ্ছেন, তখন তার ওই বক্তব্য গুরুত্বের দাবি রাখে বৈকি! তার ওই বক্তব্য এলো এমন এক সময় যখন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) প্রধান ইউ কে বনশালের একটি বক্তব্যও ছাপা হয়েছে, যেখানে বনশাল স্পষ্ট করেই বলেছেন সীমান্তে গুলি চালনা বন্ধ করা সম্ভব নয়। কী ঔদ্ধত্বপূর্ণ কথা! একের পর এক সীমান্ত হত্যা চলছে; কিন্তু কোনোভাবেই সীমান্তহত্যা বন্ধ করা যাচ্ছে না। এখন বনশালের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়ে গেল, সীমান্তে হত্যা বিএসএফ আদৌ বন্ধ করবে না। এর আগে বাংলাদেশি হাবিবুর রহমানকে উলঙ্গ করে অত্যাচার করার দৃশ্য খোদ ভারতেই বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। ওই ঘটনায় প্রভাবশালী ভারতীয় দৈনিক দি হিন্দু বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। এক পর্যায়ে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম ক্ষমা না চাইলেও দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নিয়ে নানা সমস্যা রয়েছে। এটা নিয়ে অতীতে দুদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে; কিন্তু সীমান্ত নির্যাতনের হার কমছে না_ উদ্বেগের কারণ এটাই। যখন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কিংবা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো সীমান্ত নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আজ ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে প্রকারন্তরে 'দোষ' স্বীকার করে নিলেন। তার এই সৎসাহসের জন্য তিনি নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তিনি বাংলাদেশের জনগণের সমর্থন ও ভালোবাসা পাবেন, যদি তিনি এই নির্যাতন বন্ধে কার্যকর কোনো কর্মসূচি হাতে নেন। দুঃখ প্রকাশ করে হাবিবুর রহমানের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। আস্থা অর্জন করতে হলে নিতে হবে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা।
বিএসএফের নির্যাতন আজ চরম পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে। হাবিবুর রহমানের নির্মম অত্যাচারের রেশ কাটতে না কাটতে গত ২৬ জানুয়ারি ছাপা হয়েছে আরেকটি সংবাদ_ কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গমারী সীমান্তে বাংলাদেশি আবদুল লতিফ লেবুর লাশ ফেরত দিয়েছে ভারতীয় পুলিশ। সরকারের এটা বড় ব্যর্থতা, সরকার শক্ত হাতে এ ধরনের হত্যাকা-ের প্রতিবাদ করতে পারছে না। বাংলাদেশের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণে বিএসএফ এ সুযোগটি নিচ্ছে। দুঃখজনক হচ্ছে এটাই, বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর ভারতকে একের পর এক সুযোগ দেয়ার পরও বিনিময়ে আমরা পাচ্ছি বাংলাদেশিদের লাশ। এটা কোন ধরনের বন্ধুত্বের নিদর্শন, এটা সহজেই অনুমান করা যায়। সত্যিকার ক্ষেত্রেই ভারত বাংলাদেশকে একটি বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করে কি না সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। বাংলাদেশকে তাদের প্রয়োজন নানা কারণে। প্রায় ১৬ কোটি দেশের এই জনগোষ্ঠী ভারতের জন্য বিশাল একটা 'বাজার'। ভারত দেখছে তাদের স্বার্থ। তাই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসে সীমান্তে হত্যা বন্ধ হবে বলে আভাস দিলেও তা আদৌ কার্যকর হয়নি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আদৌ সীমান্তহত্যা বন্ধে কোনো নির্দেশ দেননি। দিলে হাবিব বা লেবু হত্যার মতো ঘটনা ঘটত না। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, গত একযুগে বিএসএফের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ১০০৬ জন বাংলাদেশি। খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের সীমান্ত রয়েছে মিয়ানমার, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল ও চীনের সঙ্গে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত না থাকলেও, শ্রীলঙ্কার সীমান্ত খুব বেশি দূরে নয়; কিন্তু কোনো একটি সীমান্তে কী এ ধরনের হত্যাকা- কখনো হয়েছে? চোরাকারবারির অভিযোগ তোলা হয়; কিন্তু ভারত-নেপাল সীমান্ত কিংবা ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে চোরাকারবারি বা মাদক ব্যবসায়ীদের তৎপরতা কম নয়। তাহলে এসব সীমান্তে ভারত হত্যাকা- চালায় না কেন? এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি। আসলে ভারত বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে না। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ সমমর্যাদা নিশ্চিত করতে পারেননি। কাঁটাতারের বেড়ায় যখন কিশোরী ফেলানীর লাশ ঝুলে ছিল, সেদিন এর প্রতিবাদ করতে সাহস পর্যন্ত পায়নি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা। এই 'ব্যর্থতা' বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট করেছে। আমরা অবশ্যই ভারতের বন্ধুত্ব চাই। বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত বড় ভূমিকা রাখতে পারে_ এটাও আমরা মনে করি; কিন্তু এই 'বন্ধুত্ব' এখন যেন একতরফা হয়ে যাচ্ছে। গত ২৬ জানুয়ারি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে একটি সংবাদ_ তাতে বলা হয়েছে, ভারতকে দ্রুত চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়ার জন্য একজন উপদেষ্টার নেতৃত্বে (ড. মসিউর রহমান) একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। এরা কাজ করছে অর্থাৎ এখানেও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটি তাগিদ। একই দিন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছে আরেকটি সংবাদ_ গেল সেপ্টেম্বর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা আদৌ ভারতীয় মন্ত্রিসভায় উত্থাপিত হয়নি এবং অনুমোদিতও হয়নি। কেননা এতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ও বিজেপির আপত্তি রয়েছে। এর অর্থ কী? চুক্তি হল; কিন্তু তা কার্যকর করল না ভারত। কিন্তু আমরা নদীকে 'হত্যা' করে বাঁধ দিয়ে ভারতের ৪২ চাকার যান চলাচলের সুযোগ করে দিয়েছি। এভাবে পৃথিবীর কোথাও নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়, এটা চিন্তাও করা যায় না। কোনো আইনই এই 'নদীহত্যা'কে সমর্থন করে না। অথচ আমরা করলাম। আমাদের স্বার্থ এত কী? দুঃখ লাগে এ কারণে যে, কোনো 'মন্ত্রী' সাহস করে 'নদীহত্যা' বন্ধের কথা বললেন না। কোথায় আমাদের পরিবেশমন্ত্রী?
আজ সীমান্তহত্যা নিয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান যখন কথা বলেন, তখন আমরা উৎসাহিত হই। তিনি সেই অর্থে সরকারি কর্মকর্তা নন। তিনি বলতে পারেন। তার চাকরি হারানোর ভয়ও নেই। তার জাতিসংঘে নালিশ জানানোর সিদ্ধান্তটি সঠিক। এটাই জনগণের দাবি। কমিশনের পক্ষ থেকে তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে সীমান্তহত্যার বিষয়টি তুলতে পারেন। এখানে সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় তার নেই। তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব বলেই তিনি কাজটি করতে পারেন। তবে তিনি যদি না করেন, তাহলে বুঝতে হবে তিনিও রাজনীতিবিদদের মতো কথা বলেন। মানুষকে বিভ্রান্ত করেন। সাময়িক বাহবা নেয়ার জন্যই তিনিও এ ধরনের কথা বলেছেন। তিনি অধ্যাপক মানুষ। তিনি এ কাজটি করবেন, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে উজ্জ্বল করবেন_ আমাদের প্রত্যাশা এটাই।

http://www.dainikdestiny.com/index.php?view=details&type=main&cat_id=1&menu_id=54&pub_no=81&news_type_id=1&index=2&archiev=yes&arch_date=22-02-2012

0 comments:

Post a Comment