প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ বিবৃতিটি প্রকাশিত হওয়ার পর যে প্রশ্নটি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছেÑ সত্যি সত্যিই কি শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হবে? পদ্মা সেতু নিয়ে মন্ত্রী তথা ক্ষমতাসীনদের অতিকথন একটি বড় ধরনের জটিলতাই সৃষ্টি করেছে, যা বিশ্বব্যাংক বলেনি, তা বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে করে অসন্তুষ্ট হয়েছে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ। গত ২৬ সেপ্টেম্বর তারা যে বিবৃতিটি দেন, তাতে তাদের অসন্তুষ্টিই প্রকাশিত হয়েছে। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে যখন বড় ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছিল, তখন বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষের ২০ সেপ্টেম্বরের বিবৃতিটি আমাদের মনে আশার সঞ্চার করেছিল। ওই বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংক বলেছিলÑ কিছু শর্তের সন্তোষজনক বাস্তবায়ন হলেই শুধু বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে সম্পৃক্ত হবে। বিশ্বব্যাংকের ওই বিবৃতি অনেকটা ভুলভাবে উপস্থাপন করা হল। অথবা বলা যেতে পারে সাময়িক বাহবা নেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের ওই বক্তব্য ভালোভাবে না বুঝে জনসম্মুখে উপস্থাপন করা হল। সরকারের নীতিনির্ধারকদের উচিত ছিল বিশ্বব্যাংক তাদের বিবৃতির মাধ্যমে কী বলতে চেয়েছে, তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করা। সরকারের নীতিনির্ধারকরা, এমনকি আমাদের ‘বাচাল’ অর্থমন্ত্রী বলেই ফেললেনÑ বিশ্বব্যাংক ফিরে আসছে। এমনকি কোন কিছু না বুঝেই তিনি বলে ফেললেনÑ মার্চ-এপ্রিলে কাজ শুরু করা হবে। আমাদের অর্থমন্ত্রীর বয়স হয়েছে। তিনি একটু বেশি কথা বলেন, এটা তার দলের লোকেরাও বলেন। তবে তিনি তো শিক্ষিত মানুষ! ‘রাবিশ’ বলে তিনি যত গালাগালিই দিন না কেন, বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিধি, স্ট্র্যাটেজি বোঝেন না, তেমন নয়। বোঝেন এবং জানেন বিশ্বব্যাংক কী চায়। কিন্তু সরকারপ্রধান তথা সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে পেতে বলেই ফেললেনÑ মার্চ-এপ্রিলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে যাবে! তার দেখাদেখি বাকি মন্ত্রীরাও সরব হলেন। খুশিতে ডগমগ হয়ে বলাবলি করতে থাকলেনÑ সরকারের বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণেই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়নে ফিরে এসেছে! ব্যতিক্রম ছিলেন একজনÑ ওবায়দুল কাদের। তিনি সবাইকে কম কথা বলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বাস্তবে দেখা গেল ওবায়দুল কাদেরের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। মন্ত্রীদের অতিকথন, বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাংক এখন বাধ্য হল নতুন বক্তব্যটি দিতে। তবে এই বক্তব্য গত ২৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্কে দেয়া বক্তব্যের কোন প্রতিক্রিয়া কি না, সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেনÑ তিনি বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের কাছে জানতে চেয়েছেন কেন পূর্ববর্তী অর্থায়ন বাতিল করা হয়েছিল। তিনি এও বলেছিলেনÑ অর্থায়ন বন্ধের পেছনের অপরাধীদের তিনি ছাড় দেবেন না। তিনি ড. ইউনূসের নাম সরাসরি না বললেও আকারে-ইঙ্গিতে তাকেই মূল অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পরই বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ বক্তব্যটি এলো।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ বক্তব্যে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়েছে তা হচ্ছেÑ ১. গণমাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের অবস্থান সম্পর্কে বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হচ্ছে ২. নতুন করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে সম্পৃক্ত হতে হলে নতুন বাস্তবায়ন ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে ৩. প্রকল্পের ক্রয় কর্মকাণ্ড নিবিড় পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন হবে ৪. শুধু এসব পদক্ষেপের সন্তোষজনক বাস্তবায়ন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত এক্সটারনাল প্যানেল থেকে ইতিবাচক প্রতিবেদন পাওয়ার ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের ব্যাপারে অগ্রসর হবে। প্রধানমন্ত্রী নিজে স্বয়ং এবং অর্থমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীরা বারবার বলে আসছেনÑ পদ্মা সেতুতে কোন দুর্নীতি হয়নি। অথচ বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ বক্তব্যে বিশ্বব্যাংক বলছেÑ পদ্মা সেতুর অর্থায়নের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন সরকারি ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতিতে জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ সরকারকে একাধিকবার তারা দিয়েছেন। সরকারের কাছ থেকে সাড়া না পাওয়ার পরই তারা ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে দেন।
বিশ্বব্যাংকের তথাকথিত ‘ফিরে আসা’র ব্যাপারে সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বক্তব্যের পার্থক্য রয়েছে। অর্থমন্ত্রী, দফতরবিহীন মন্ত্রী, ইআরডি সচিব আমাদের জানাচ্ছেনÑ বিশ্বব্যাংক নতুন করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাপারে নতুন কোন ‘শর্ত’ দেয়নি। অথচ বিশ্বব্যাংকের বক্তব্যে দেখা যাচ্ছে তারা চাচ্ছেন অভিযোগ তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি বিশেষ তদন্ত ও আইনি দল গঠন করা এবং সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি এক্সটারনাল প্যানেলের কাছে তদন্তসংশ্লিষ্ট সব তথ্যের পূর্ণ ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ করে দেয়া। তার পরই বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের বিষয়টি বিবেচনায় নেবে। এটাই তো ‘শর্ত’। বিশ্বব্যাংকের অবস্থান মূলত এ জায়গাতেই কেন্দ্রীভূত। বিশ্বব্যাংক এর আগে যে চারটি ‘শর্ত’-এর কথা বলেছিল তা পালন করা হয়েছে। আবুল হোসেন মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। সচিব ছুটিতে গেছেন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টার ‘ছুটি’-তে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে এখনও একটি বিভ্রান্তি রয়েছে। তিনি ‘ছুটি’-তে গেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিউইয়র্কে গেছেন, এবং যুক্তরাষ্ট্রে বেশকিছু দিন থাকবেনÑ এগুলো সবই বাস্তব। কিন্তু তিনি নিজে সরাসরিভাবে ‘ছুটি’র বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। বলেছেনÑ তিনি খুব শিগগিরই কাজে ফিরে যাবেন! তার ছুটিতে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে একটি ধোঁয়াশা রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ বক্তব্যে যে দুটি বিষয় রয়েছে, আমি সে ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে চাই। বিষয় দুটো হচ্ছেÑ ১. দুদকে একটি বিশেষ তদন্ত ও আইনি দল গঠন করা ২. একটি বিদেশী তদন্ত কমিটির কাছে সব তথ্য দেয়া ও তাদের সব নথিপত্র ঘাঁটতে সুযোগ দেয়া। সরকার যদি আন্তরিক হয়, তাহলে এ সুযোগ দুটো দেবে। যদি সময়ক্ষেপণ করে তাহলে বিশেষজ্ঞ দলের কাছে সরকারের অসততা প্রমাণিত হবে। মূলত এ দুটো বিষয়ের ওপর আটকে আছে সব কিছু। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক শতভাগ রাজি হয়েছে তা বলা যাবে না। আমরা তাকে শর্ত বলি আর না বলি, বিশ্বব্যাংক কতগুলো বিষয় নিশ্চিত করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ‘বল’টি এখন ঠেলে দিয়েছে বাংলাদেশের দিকে। কীভাবে ‘বল’টি খেলবেন, তার দায়িত্ব বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের।
অর্থমন্ত্রী এখনও বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলেন। একবার বললেন মার্চ-এপ্রিলে কাজ শুরু হবে। আবার সিলেট গিয়ে বললেন ফেব্র“য়ারির কথা। তিনি ‘অতিকথা’ বলেন। তিনিও ‘ছুটি’-তে গেলে সরকারের কাজ অনেক সহজ হতো। তিনি নিজে বলেছিলেন ‘তাকে কম কথা বলতে বলা হয়েছে’। কিন্তু তার পরও তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। ‘হুট’ করে একটা কথা বলে ফেলেন, যা বিতর্কের সৃষ্টি করে। প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে যে বক্তব্যটি দিয়েছেন তা না বললেও পারতেন। যেখানে আমরা এখনও চাচ্ছি বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করুক, সেখানে এমন কোন বক্তব্য দেয়া ঠিক নয়, যা বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তারা কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।
বিশ্বব্যাংকের রাজনীতি সম্পর্কে আমরা মোটামুটিভাবে অবগত। বিশ্বব্যাংক ‘স্বার্থ’ ছাড়া কোথাও বিনিয়োগ করে না। আর তাদের ঋণ শর্তহীন নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তুলনামূলক বিচারে বিশ্বব্যাংকের ঋণ ‘ভালো’। দীর্ঘমেয়াদি। সুদের হার তুলনামূলকভাবে কম। আমাদের স্বার্থেই বিশ্বব্যাংকের ঋণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের এমন কোন বক্তব্য দেয়া সমীচীন নয়, যা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। কিছু বিষয়ের নিষ্পত্তি হলেই বিশ্বব্যাংক ফিরে আসবে, নচেৎ নয়। আর ‘বিষয় নিষ্পত্তি’র ভার একান্তভাবেই বাংলাদেশের ওপর। আগামী দিনগুলোতে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় আমরা যদি আমাদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে না পারি, যদি সত্যি সত্যিই আন্তরিক না হই, তাহলে বিশ্বব্যাংকের দিকে তাকানো আমাদের ভুলে যেতে হবে। সামনে অনেক কাজ বাকি। নদীশাসন, সেতু নির্মাণ, সংযোগ সড়কÑ প্রতিটি কাজ হবে ভিন্ন ভিন্ন চুক্তির ভিত্তিতে। আন্তর্জাতিক প্রকিউরমেন্ট বিষয়ে টার্মস অব রেফারেন্স এখনও নির্ধারিত হয়নি। এখানে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন, কেননা বিশ্বব্যাংক এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতির ‘গন্ধ’ খুঁজে পেতে পারে। এ সংক্রান্ত যে কমিটি হবে, তাতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি কারা থাকবেন সে ব্যাপারেও বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন, যাতে করে বিশ্বব্যাংক কোন প্রশ্ন তুলতে না পারে। টেন্ডার চূড়ান্ত করার আগে প্রি-কোয়ালিফাই করা হবে। এখানে স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন। লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে বিতর্কিত ব্যক্তিরা প্রভাব খাটাতে না পারেন।
অনেক কাজ এখনও বাকি। একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে মাত্র। এখন যদি আমরা আমাদের স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতা দেখাতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদের জন্য শেষ সুযোগটিও নষ্ট হয়ে যাবে। দুর্নীতির অপবাদ ওঠায় আমাদের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের দুর্নাম অনেকাংশে লাঘব করতে পারি। তাই এখন থেকে বিশ্বব্যাংকের প্রতিটি পদক্ষেপ আমাদের সতর্কতার সঙ্গে অনুসরণ করা প্রয়োজন। সরকারের কোন পর্যায়েই এমন কোন বক্তব্য দেয়া ঠিক নয়, যা বিতর্কের মাত্রা বাড়ায়। পদ্মা সেতু আমাদের ‘স্বপ্নের সেতু’। এটা আমাদের প্রয়োজন। আমাদের স্বার্থেই এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংকের ‘অবজারভেশন’-এর ব্যাপারে আমাদের আন্তরিকতা থাকতে হবে। তাহলেই বিশ্বব্যাংক ফিরে আসবে।
Daily JUGANTOR
01.10.12
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ বক্তব্যে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়েছে তা হচ্ছেÑ ১. গণমাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের অবস্থান সম্পর্কে বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হচ্ছে ২. নতুন করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে সম্পৃক্ত হতে হলে নতুন বাস্তবায়ন ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে ৩. প্রকল্পের ক্রয় কর্মকাণ্ড নিবিড় পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন হবে ৪. শুধু এসব পদক্ষেপের সন্তোষজনক বাস্তবায়ন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত এক্সটারনাল প্যানেল থেকে ইতিবাচক প্রতিবেদন পাওয়ার ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের ব্যাপারে অগ্রসর হবে। প্রধানমন্ত্রী নিজে স্বয়ং এবং অর্থমন্ত্রীসহ অন্য মন্ত্রীরা বারবার বলে আসছেনÑ পদ্মা সেতুতে কোন দুর্নীতি হয়নি। অথচ বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ বক্তব্যে বিশ্বব্যাংক বলছেÑ পদ্মা সেতুর অর্থায়নের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন সরকারি ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতিতে জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ সরকারকে একাধিকবার তারা দিয়েছেন। সরকারের কাছ থেকে সাড়া না পাওয়ার পরই তারা ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে দেন।
বিশ্বব্যাংকের তথাকথিত ‘ফিরে আসা’র ব্যাপারে সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বক্তব্যের পার্থক্য রয়েছে। অর্থমন্ত্রী, দফতরবিহীন মন্ত্রী, ইআরডি সচিব আমাদের জানাচ্ছেনÑ বিশ্বব্যাংক নতুন করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাপারে নতুন কোন ‘শর্ত’ দেয়নি। অথচ বিশ্বব্যাংকের বক্তব্যে দেখা যাচ্ছে তারা চাচ্ছেন অভিযোগ তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি বিশেষ তদন্ত ও আইনি দল গঠন করা এবং সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি এক্সটারনাল প্যানেলের কাছে তদন্তসংশ্লিষ্ট সব তথ্যের পূর্ণ ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ করে দেয়া। তার পরই বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের বিষয়টি বিবেচনায় নেবে। এটাই তো ‘শর্ত’। বিশ্বব্যাংকের অবস্থান মূলত এ জায়গাতেই কেন্দ্রীভূত। বিশ্বব্যাংক এর আগে যে চারটি ‘শর্ত’-এর কথা বলেছিল তা পালন করা হয়েছে। আবুল হোসেন মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। সচিব ছুটিতে গেছেন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টার ‘ছুটি’-তে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে এখনও একটি বিভ্রান্তি রয়েছে। তিনি ‘ছুটি’-তে গেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিউইয়র্কে গেছেন, এবং যুক্তরাষ্ট্রে বেশকিছু দিন থাকবেনÑ এগুলো সবই বাস্তব। কিন্তু তিনি নিজে সরাসরিভাবে ‘ছুটি’র বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। বলেছেনÑ তিনি খুব শিগগিরই কাজে ফিরে যাবেন! তার ছুটিতে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে একটি ধোঁয়াশা রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ বক্তব্যে যে দুটি বিষয় রয়েছে, আমি সে ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে চাই। বিষয় দুটো হচ্ছেÑ ১. দুদকে একটি বিশেষ তদন্ত ও আইনি দল গঠন করা ২. একটি বিদেশী তদন্ত কমিটির কাছে সব তথ্য দেয়া ও তাদের সব নথিপত্র ঘাঁটতে সুযোগ দেয়া। সরকার যদি আন্তরিক হয়, তাহলে এ সুযোগ দুটো দেবে। যদি সময়ক্ষেপণ করে তাহলে বিশেষজ্ঞ দলের কাছে সরকারের অসততা প্রমাণিত হবে। মূলত এ দুটো বিষয়ের ওপর আটকে আছে সব কিছু। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক শতভাগ রাজি হয়েছে তা বলা যাবে না। আমরা তাকে শর্ত বলি আর না বলি, বিশ্বব্যাংক কতগুলো বিষয় নিশ্চিত করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ‘বল’টি এখন ঠেলে দিয়েছে বাংলাদেশের দিকে। কীভাবে ‘বল’টি খেলবেন, তার দায়িত্ব বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের।
অর্থমন্ত্রী এখনও বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলেন। একবার বললেন মার্চ-এপ্রিলে কাজ শুরু হবে। আবার সিলেট গিয়ে বললেন ফেব্র“য়ারির কথা। তিনি ‘অতিকথা’ বলেন। তিনিও ‘ছুটি’-তে গেলে সরকারের কাজ অনেক সহজ হতো। তিনি নিজে বলেছিলেন ‘তাকে কম কথা বলতে বলা হয়েছে’। কিন্তু তার পরও তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। ‘হুট’ করে একটা কথা বলে ফেলেন, যা বিতর্কের সৃষ্টি করে। প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে যে বক্তব্যটি দিয়েছেন তা না বললেও পারতেন। যেখানে আমরা এখনও চাচ্ছি বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করুক, সেখানে এমন কোন বক্তব্য দেয়া ঠিক নয়, যা বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তারা কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।
বিশ্বব্যাংকের রাজনীতি সম্পর্কে আমরা মোটামুটিভাবে অবগত। বিশ্বব্যাংক ‘স্বার্থ’ ছাড়া কোথাও বিনিয়োগ করে না। আর তাদের ঋণ শর্তহীন নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তুলনামূলক বিচারে বিশ্বব্যাংকের ঋণ ‘ভালো’। দীর্ঘমেয়াদি। সুদের হার তুলনামূলকভাবে কম। আমাদের স্বার্থেই বিশ্বব্যাংকের ঋণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের এমন কোন বক্তব্য দেয়া সমীচীন নয়, যা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। কিছু বিষয়ের নিষ্পত্তি হলেই বিশ্বব্যাংক ফিরে আসবে, নচেৎ নয়। আর ‘বিষয় নিষ্পত্তি’র ভার একান্তভাবেই বাংলাদেশের ওপর। আগামী দিনগুলোতে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় আমরা যদি আমাদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে না পারি, যদি সত্যি সত্যিই আন্তরিক না হই, তাহলে বিশ্বব্যাংকের দিকে তাকানো আমাদের ভুলে যেতে হবে। সামনে অনেক কাজ বাকি। নদীশাসন, সেতু নির্মাণ, সংযোগ সড়কÑ প্রতিটি কাজ হবে ভিন্ন ভিন্ন চুক্তির ভিত্তিতে। আন্তর্জাতিক প্রকিউরমেন্ট বিষয়ে টার্মস অব রেফারেন্স এখনও নির্ধারিত হয়নি। এখানে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন, কেননা বিশ্বব্যাংক এসব ক্ষেত্রে দুর্নীতির ‘গন্ধ’ খুঁজে পেতে পারে। এ সংক্রান্ত যে কমিটি হবে, তাতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি কারা থাকবেন সে ব্যাপারেও বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন, যাতে করে বিশ্বব্যাংক কোন প্রশ্ন তুলতে না পারে। টেন্ডার চূড়ান্ত করার আগে প্রি-কোয়ালিফাই করা হবে। এখানে স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন। লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে বিতর্কিত ব্যক্তিরা প্রভাব খাটাতে না পারেন।
অনেক কাজ এখনও বাকি। একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে মাত্র। এখন যদি আমরা আমাদের স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতা দেখাতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদের জন্য শেষ সুযোগটিও নষ্ট হয়ে যাবে। দুর্নীতির অপবাদ ওঠায় আমাদের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের দুর্নাম অনেকাংশে লাঘব করতে পারি। তাই এখন থেকে বিশ্বব্যাংকের প্রতিটি পদক্ষেপ আমাদের সতর্কতার সঙ্গে অনুসরণ করা প্রয়োজন। সরকারের কোন পর্যায়েই এমন কোন বক্তব্য দেয়া ঠিক নয়, যা বিতর্কের মাত্রা বাড়ায়। পদ্মা সেতু আমাদের ‘স্বপ্নের সেতু’। এটা আমাদের প্রয়োজন। আমাদের স্বার্থেই এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন প্রয়োজন। বিশ্বব্যাংকের ‘অবজারভেশন’-এর ব্যাপারে আমাদের আন্তরিকতা থাকতে হবে। তাহলেই বিশ্বব্যাংক ফিরে আসবে।
Daily JUGANTOR
01.10.12