রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অর্থমন্ত্রী ও হলমার্ক কেলেঙ্কারি


আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সনাতন রাজনীতিবিদ নন। সাবেক আমলা। ছিলেন এরশাদের অর্থমন্ত্রী। আর বর্তমান মহাজোট সরকারেরও অর্থমন্ত্রী। দুর্ভাগ্য একটাই- মহাজোট সরকারের যে কজন মন্ত্রী বিতর্কিত হয়েছেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। ঝানু রাজনীতিবিদদের মতো কথা পেঁচিয়ে বলতে পারেন না। বয়স একটু বেশি এবং প্রবীণ রাজনীতিবিদ শেখ ফজলুল করিম সেলিমের মতে, 'তিনি একটু বেশিই কথা বলেন।' আর্থিক সেক্টরকে ঠিক বাগে আনতে পারছেন না তিনি। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই আবারও বিতর্কিত হলেন হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে। বললেন, 'চার হাজার কোটি টাকা খুব বেশি কিছু নয়।' যে দেশের জনগোষ্ঠীর ৩২ শতাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, সেখানে তিনি কী করে বললেন 'চার হাজার কোটি টাকা তেমন কোনো টাকা নয়'! তিনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন একজন ব্যক্তির মাসিক আয়ের ভিত্তিতে তিনি কত বছরে এই চার হাজার কোটি টাকা আয় করবেন? অঙ্কটা অনেক বড়। তাই উল্লেখ করলাম না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তাঁর আমলে আর্থিক দুর্নীতি এমন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে যে আমরা এ পরিস্থিতিকে 'ক্লেপটোক্রেসি' হিসেবে উল্লেখ করতে পারি। ক্লেপটোক্রেসির সহজ-সরল বাংলা হচ্ছে চৌর্যবৃত্তি, চুরিনির্ভর একটি সমাজব্যবস্থা। এই সমাজব্যবস্থায় একদল লোক রাষ্ট্রীয় সম্পদের চুরি আর লুটপাট করে অগাধ সম্পদের মালিক হয়। একসময় সমাজবিজ্ঞানীরা আফ্রিকার সমাজব্যবস্থার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এই ক্লেপটোক্রেসি শব্দটা ব্যবহার করতেন। যাঁরা আফ্রিকার ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন, তাঁরা জানেন আফ্রিকার অনেক দেশে (যেমন নাইজেরিয়া) রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি করা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল বিগত ষাট তথা সত্তরের দশকে। আজকে বাংলাদেশে হলমার্কের ঘটনার পর আমার আফ্রিকার সেসব দিনের কথা মনে হয়ে গেল। বাংলাদেশ কী শেষ পর্যন্ত একটি চোরদের রাজ্যে (!) পরিণত হতে যাচ্ছে। যারা শেয়ারবাজার থেকে হাজার হাজার টাকা 'চুরি' করল, তাদের বিচার হলো না। হলমার্কের বড় 'চুরির' কথা প্রথম জানা যায় ২০১০ সালে। বিচার তো হয়ইনি, টাকাও ফেরত আসেনি। আজ মাহবুব-উল-আলম হানিফ যখন হলমার্ক ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার দাবি করেন, তখন আমি পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত হতে পারছি না অভিযুক্তদের আদৌ গ্রেপ্তার করা হবে! হলমার্কের কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে যেসব প্রশ্নের জন্ম হয়েছে, তার জবাব জানা আমাদের জন্য জরুরি। প্রশ্ন এক. সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখার সর্বোচ্চ ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা ২০০ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে হলমার্কের মতো অখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠান কী করে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ঋণ পেল? এত বিপুল পরিমাণ ঋণ বরাদ্দের জন্য স্থানীয় ব্যবস্থাপকের সে ক্ষমতা নেই। তাহলে কে তাঁকে প্ররোচিত করেছে এত বিপুল পরিমাণ ঋণ বরাদ্দের জন্য? কে এই 'শক্তি'? এটা জানা আমাদের জন্য জরুরি। প্রশ্ন দুই. হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে যেখানে পুরো জাতি আজ আতঙ্কিত, এ ঘটনার রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই আমরা দেখলাম সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত- তাঁরা পূর্ণ সময় কাটাবেন। এর কি আদৌ প্রয়োজন ছিল? কেন তাঁদের পূর্ণ মেয়াদে রাখা হচ্ছে! কাদের স্বার্থে রাখা হচ্ছে? তাঁরা যদি পর্ষদে থাকেন, তাহলে কি তাঁরা তদন্তে প্রভাব বিস্তার করবেন না? প্রশ্ন তিন, সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে যাঁদের রাখা হয়েছে, তাঁরা সবাই রাজনৈতিকভাবে একটি দলের অনুগত। একজন সাংবাদিক কিংবা একজন রাজনৈতিক কর্মীও পর্ষদে রয়েছেন। যাঁদের ব্যাংকিং সম্পর্কে আদৌ কোনো ধারণা নেই। তাঁদের রাখা হলো কাদের স্বার্থে? প্রশ্ন চার. অর্থমন্ত্রী প্রকাশ্যেই হলমার্ক গ্রুপের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। এতে করে কি এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে না? বাম মোর্চা তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছে। শেখ সেলিম ও তোফায়েল আহমেদের মতো প্রভাবশালী নেতারা অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করেছেন। এর পরও অর্থমন্ত্রী থাকেন কী করে? প্রশ্ন পাঁচ. অর্থমন্ত্রী আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে হলমার্ককে দেওয়া ঋণের অর্ধেক পরিশোধের জন্য তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। এবং পনেরো দিনের মধ্যে অর্ধেক টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। কিন্তু একটি জনপ্রিয় দৈনিক আমাদের জানাচ্ছে যে 'টাকা ফেরত দিতে চাইছে না হলমার্ক' (কালের কণ্ঠ, ৭ সেপ্টেম্বর)। সংবাদপত্রটি আমাদের জানাচ্ছে যে হলমার্কের কেনা বিভিন্ন জমিতে তাদের যে সাইনবোর্ড টাঙানো ছিল, তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এমন খবরও সংবাদপত্রটি আমাদের দিচ্ছে যে হলমার্ক গ্রুপের এমডি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন। এখন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি এক হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা দিতে ব্যর্থ হয় হলমার্ক, তখন কী হবে? প্রশ্ন ছয়. সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী আরো ২৬টি ব্যাংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে হলমার্ক। এর অর্থ বেসরকারি ব্যাংকগুলোও হলমার্কের প্রতারণার শিকার হয়েছে। হলমার্কের এই লুটপাট পুরো অর্থব্যবস্থাকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিল। মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এর জন্য আমরা কাদের দায়ী করব? প্রশ্ন সাত. একটি অনলাইন বার্তা সংস্থা আমাদের জানাচ্ছে যে হলমার্ক ঋণ পেতে ৫০ কোটি টাকার আধুনিক গাড়ি ক্রয় করেছিল। সোনালী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপঢৌকন দেওয়ার জন্য এই গাড়িগুলো ক্রয় করেছিল। ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তা ওই গাড়িগুলো ব্যবহারও করেছেন। এখন ওই গাড়িগুলোর কী হবে? প্রশ্ন আট. দুদক বলছে, তারা হলমার্কের এমডি ও তাঁর স্ত্রীকে তলব করবে। শুধু হলমার্কের এমডি কেন? যাঁরা সুবিধাভোগী তাঁদের কেন দুদকে ডাকা হবে না? সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকেও ডাকা উচিত। প্রশ্ন নয়, প্রথমে শেয়ারবাজার, তারপর পদ্মা সেতু, এখন হলমার্ক- প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এবং একটি ক্ষেত্রেও অভিযুক্তদের বিচার হয়নি। সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি প্রভাবশালী চক্র শুধু শেয়ারবাজার থেকে হাতিয়ে নিয়েছিল ২০ হাজার কোটি টাকা। ইব্রাহিম খালেদ রিপোর্টে এই ঘটনায় যারা জড়িত ছিল, তাদের চিহ্নিত করা হলেও কারোরই বিচার হয়নি। ক্ষতি হয়েছিল ৪০ লাখ খুদে বিনিয়োগকারীর। কোনো রকম টেন্ডার ছাড়া কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে লুটপাট করা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ডেসটিনি নামের একটি এমএলএম কম্পানি অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে পাচার করেছে ১০ হাজার কোটি টাকা। সরকারের লোকজন এই ডেসটিনি গ্রুপের সঙ্গে জড়িত। একই সঙ্গে অপর একটি এমএলএম কম্পানি যুবক তিন হাজার কোটি টাকা, ইউনিপেটুইউ তিন হাজার কোটি টাকা, এইমওয়ে করপোরেশন প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। কোনো একটি ক্ষেত্রেও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হয়নি। হলমার্ক কেলেঙ্কারি দেখিয়ে দিল আমাদের অর্থব্যবস্থায় মারাত্মক সব ত্রুটি রয়েছে। ব্যাংকগুলোতে নিয়মিত ইন্সপেকশন হওয়ার কথা, তা হয়নি। ফলে এ ধরনের আর্থিক অনিয়ম রয়ে গেছে। কোথাও কোথাও এসব 'অনিয়ম' অর্থের বিনিময়ে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে তদারকি থাকা উচিত ছিল, ব্যাংক তা করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তাঁর দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতেও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নাম উচ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু সরকারের উচ্চ মহলের সঙ্গে যোগসাজশের কারণে বহালতবিয়তে এখনো রয়ে গেছেন গভর্নর সাহেব।
হলমার্কের ঘটনায় শুধু একটি ব্যাংকের কথা আমরা জানলাম। রাষ্ট্রায়ত্ত বাকি প্রতিটি ব্যাংকেই এ ধরনের বড় ঋণ-জালিয়াতি রয়েছে বলে আমার ধারণা। খুব দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে তদারকি করা উচিত। এতে অনেক 'গোপন তথ্য' বেরিয়ে যেতে পারে। একজন তানভীর মাহমুদ জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থাকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। সাধারণ মানুষের আশ্রয়স্থল ছিল এই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। এখন সেই আস্থায় চিড় ধরল। ডেসটিনির কথা আমরা জেনেছি। এখন জানলাম হলমার্কের কথা। এ রকম শত শত 'তানভীর মাহমুদ' ব্যাংকের টাকা লুটপাট করে প্রভাবশালীদের কারণে পার পেয়ে যাচ্ছেন। এদের যদি আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না যায়, তাহলে 'ক্লেপটোক্রেসির' বদনাম অচিরেই আমাদের ঘাড়ে বর্তাবে। উন্নতির যত দৃষ্টান্তই আমরা দিই না কেন, বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি তাতে উজ্জ্বল হবে না। অর্থমন্ত্রী সজ্জন ব্যক্তি। দুর্নীতির অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে নেই। কিন্তু অর্থব্যবস্থায় দুর্নীতি রোধ করার দায়িত্বটি তো তাঁর। সেই দায়িত্ব তিনি উপেক্ষা করেন কিভাবে?Daily KALERKONTHO17.9.12

0 comments:

Post a Comment