রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মন্ত্রিসভায় রদবদল ও বিবিধ প্রসঙ্গ



সবচেয়ে অবাক হয়েছি ‘কালো বিড়াল’ খ্যাত সুরঞ্জিত বাবু এখনও মন্ত্রী! ‘উজিরে খামোখা’ সুরঞ্জিত বাবুকে কি মন্ত্রিসভায় রাখা হয়েছে শুধু ‘গোলটেবিল বৈঠকে কথা বলার জন্য? ইনিয়ে বিনিয়ে তিনি যা বলতে পারেন তাতে বিষয়বস্তুর গভীরতা না থাকলেও
একশ্রেণীর মানুষ তাতে খুশি। এটাও একটা ‘চাকরি’। ‘গোলটেবিল’-এ নিত্য যাওয়া। কোন মন্ত্রণালয় না পেলেও, তাতে ক্ষতি নেই। ‘পতাকা ওড়ানো’ গাড়ি তো আছে। কিন্তু ৭০ লাখ টাকার কাহিনী কি মানুষ ভুলে গেছে?
বহুল প্রত্যাশিত মন্ত্রিসভায় রদবদল হল। জাতি নতুন সাতজন মন্ত্রী পেয়েছে। এতে চমক যেমন নেই, তেমনি প্রধানমন্ত্রী ১৫ সেপ্টেম্বর মন্ত্রীদের দফতর যখন বণ্টন করেন, তাতেও নেই আশাবাদী হওয়ার মতো কোন কারণ। বিতর্কিত ও অযোগ্য মন্ত্রীরা রয়ে গেছেন বহাল তবিয়তে। সাহারা খাতুন মন্ত্রণালয় পরিচালনায় পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ ছিলেন এটা খোদ আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও স্বীকার করেন। তিনি একের পর এক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছিলেন। শ্রমিক নেতা আমিনুলের হত্যাকাণ্ড, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ড, ইলিয়াস আলীর গুম হয়ে যাওয়ার ঘটনায় বিশ্ব মিডিয়া যখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার দিকে আঙুল নির্দেশ করছিল, তখন সাহারা খাতুন দিব্যি পুলিশের প্রশংসা করে যাচ্ছিলেন। তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া ছিল ভুল। তিনি এখন গেলেন ডাকে (ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়)। বললেন তার ‘প্রমোশন’ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় আরেকটি ভুল করলেন মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে। আমলা ছিলেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ‘জনতার মঞ্চ’-এর অন্যতম রূপকার ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম সরকারে (১৯৯৬-২০০১) তিনি ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। তার মেধা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও তার সংসদ সদস্যপদে থাকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ তার সংসদ সদস্যপদ খারিজ করে দিলেও, জটিল আইনি মারপ্যাঁচে এখনও তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে বহাল আছেন। নৈতিকভাবে অনেক আগেই তার ‘পরাজয়’ হয়েছে। তার মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তিও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে সাবেক রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদের অন্তর্ভুক্তিতে তিনি নিজেও অবাক হয়েছিলেন। আলোচনায় কখনও তিনি ছিলেন না। সংসদীয় কার্যক্রমে তিনি অংশ নিয়েছেন এমন ঘটনা ঘটেছে খুব কম। যা অবাক করার বিষয় তা হচ্ছে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে জনাব ফারুকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও পাসপোর্ট জব্দের পরামর্শ ছিল বিশ্বব্যাংকের। বিতর্কিত সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘সাকো’-এর তিনি ছিলেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী যে জানেন না, তেমন নয়। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট তার কাছে থাকার কথা। এ সিদ্ধান্তটি সঠিক হয়নি। আওয়ামী লীগে তার চেয়ে আরও যোগ্য লোক রয়েছেন।
প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাই পেয়েছেন মৎস্য মন্ত্রণালয়। পাসপোর্ট কেলেংকারির ঘটনায় তিনি অভিযুক্ত ও বিতর্কিত। কোন যুক্তিতে তাকে প্রতিমন্ত্রী করা হল, তার হিসাব আমি মেলাতে পারি না। আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো অথর্ব লোকটি এখনও আমাদের অর্থমন্ত্রী। অর্থব্যবস্থায় একের পর এক বিতর্কের জš§ দিয়ে চলেছেন এই লোকটি। বোধ করি মুহিত সাহেবের মতো অথর্ব ও অযোগ্য অর্থমন্ত্রী এ জাতি কখনও পায়নি। হলমার্কের মতো একটি অখ্যাত প্রতিষ্ঠান যখন সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আÍসাৎ করল, তিনি বললেন এটা তেমন বড় কোন অংকের টাকা নয়। সংসদে এটা নিয়ে বিতর্ক উঠল। স্বয়ং সরকারি দলের দু’জন সিনিয়র নেতা অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সমালোচনা করলেন। বললেন, ‘তার বয়সের কারণে এমনটি হচ্ছে’। প্রধানমন্ত্রীও স্বীকার করলেন তার বয়সের কথা। বয়স তার হয়েছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু যে লোক অর্থনীতির ‘বারোটা’ বাজিয়ে ছেড়েছেন, তার কি আদৌ প্রয়োজন রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে? এ প্রশ্নের জবাব শুধু প্রধানমন্ত্রীই দিতে পারবেন। কিন্তু সাধারণ একজন করদাতা হিসেবে আমি যা বুঝি, তা হচ্ছে শেয়ার কেলেংকারির সঙ্গে জড়িতদের যিনি বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারেননি, ডেসটিনির ৩ হাজার ২৮৫ কোটি টাকার অর্থ পাচার যিনি রোধ করতে পারেননি, কিংবা ইউনিপেটুইউর সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ও আইটিসিএলের আÍসাৎকৃত ১০০ কোটি টাকা যিনি উদ্ধার করতে পারেননি, তার অর্থ মন্ত্রণালয়ে থাকার কোন যোগ্যতাই নেই। তিনি যত দ্রুত বিদায় হবেন, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমাদের ‘ফটোগ্রাফার’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এখনও বহাল তবিয়তে আছেন। ভাগ্যবান আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কোন ‘গুণে’ মুগ্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রী তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করলেন, বলতে পারব না। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য ‘সম্মান’ বয়ে আনতে না পারলেও, একটা জায়গাতে তিনি ‘গিনেস বুক’-এ নাম লিখিয়ে ফেলতে পারেন আর তা হচ্ছে তার বিদেশ ভ্রমণ। নানাবিধ কারণে বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি যখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, সেখানে তার বিদেশ ভ্রমণ থেমে থাকেনি। এই লেখাটি যখন ছাপা হবে, বোধ করি তখনও তিনি বিদেশে। তাকে সাহায্য করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দু’জন উপদেষ্টা (মন্ত্রীর সমমর্যাদায়) থাকলেও, বহির্বিশ্বে আমাদের অর্জন কীÑ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র হিসেবে আমি তা বুঝে উঠতে পারি না। তিনিও বহাল তবিয়তে থেকে গেলেন।
আমাদের দিলীপ বড়-য়া। এখনও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন কিনা জানি না, কিন্তু মন্ত্রী হয়েই নিজ আÍীয়-স্বজন ও প্রিয়তমা পতœীর জন্য, মেয়ের জন্য গোটাআটেক প্লট বাগিয়ে নিয়েছেন। যমুনা সার কারখানা থেকে ‘ঘুষ’ হিসেবে একটি গাড়ি ও এসি পাওয়ার কাহিনী এখনও মানুষ স্মরণ করে। আজীবন ‘দুঃখী’ মানুষের জন্য তিনি কাজ করে গেছেন! কিন্তু প্লট, গাড়ি ও এসির লোভ তিনি সামলাতে পারলেন না। তিনিও আছেন। রাজিউদ্দীন আহমেদ রাজুর মন্ত্রণালয় পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। কিন্তু নরসিংদীর জনপ্রিয় নির্বাচিত মেয়র লোকমান হোসেনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ তিনি কি অস্বীকার করতে পারবেন? মৎস্যবিষয়ক মন্ত্রী লতিফ বিশ্বাসÑ জাতীয় রাজনীনিতে আমরা কেউ তাকে কখনও চিনিনি, দেখিওনি। কিন্তু মন্ত্রী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় তার সাত তলা বাড়ি, নিজের এক স্ত্রীকে ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হতে ‘সাহায্য’ করার সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তিনিও আছেন। মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। ছিলেন তথ্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। তথ্যটি এখন গেল। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এখন আবার পূর্ণ মন্ত্রী। একজন অবশ্য ছোট মন্ত্রী ছিলেন তিনি গেলেন সমাজকল্যাণে। কেননা সমাজকল্যাণের পূর্ণ মন্ত্রী অসুস্থ। তার চাকরিও থাকল। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় কি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে একজন পূর্ণ মন্ত্রী থাকতে হবে? যেখানে পররাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতো বড় মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী মাত্র একজন, সেখানে সংস্কৃতিতে পূর্ণ মন্ত্রী! কালাম সাহেব অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি। কিন্তু সংবাদকর্মীদের সঙ্গে তার সম্পর্কটা খুব ভালো যাচ্ছিল না। বিটিভি এখন যখন ম. হামিদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, সেখানে তিনি নিশ্চুপ। তার আমলে ১৮টি টিভি চ্যানেল লাইসেন্স পেল, একটি চ্যানেলে তার ভাই পরিচালক হলেন, নিন্দুকেরা নানা কথা বললেও তিনি ‘চাকরি’ হারালেন না। সবচেয়ে অবাক হয়েছি ‘কালো বিড়াল’খ্যাত সুরঞ্জিত বাবু এখনও মন্ত্রী! ‘উজিরে খামোখা’ সুরঞ্জিত বাবুকে কি মন্ত্রিসভায় রাখা হয়েছে শুধু ‘গোলটেবিল বৈঠকে কথা বলার জন্য? ইনিয়ে বিনিয়ে তিনি যা বলতে পারেন তাতে বিষয়বস্তুর গভীরতা না থাকলেও একশ্রেণীর মানুষ তাতে খুশি। এটাও একটা ‘চাকরি’। ‘গোলটেবিল’-এ নিত্য যাওয়া। কোন মন্ত্রণালয় না পেলেও, তাতে ক্ষতি নেই। ‘পতাকা ওড়ানো’ গাড়ি তো আছে। কিন্তু ৭০ লাখ টাকার কাহিনী কি মানুষ ভুলে গেছে? দিরাইয়ে কোটি কোটি টাকায় তৈরি মার্কেটের কাহিনী কি মানুষ ভুলে গেছে। সংস্কারবাদী ‘র‌্যাটস’-এর একজন সদস্য হিসেবে মন্ত্রিত্ব ফিরে পেয়েছেন বটে, কিন্তু সরকারপ্রধানের আস্থা কি পেয়েছেন? নিন্দুকেরা অচিরেই বলতে শুরু করবেন তিনি ‘গোলটেবিল’ মন্ত্রী। অবশ্য তাতে তার কিছু যায় আসে না।
তুলনামূলকভাবে যোগ্য ও কম কথা বলা ওবায়দুল কাদেরের এক মন্ত্রণালয় (রেলওয়ে) গেল। এলেন মুজিবুল হক। রেলওয়ের মতো একটি মন্ত্রণালয়ে কি ‘শক্ত কিসিম’-এর একজন লোকের দরকার ছিল না? ইনু সাহেবকে নিয়ে বলার কিছু নেই। গণবাহিনীর সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নিজে প্রকৌশলী হয়েও একদিনের জন্যও যিনি অর্থ আয়ের জন্য ‘চাকরি’ করেননি, কিংবা চাঁদাবাজি করে সংগঠন চালানোর অভিযোগ যার বিরুদ্ধে রয়েছে, তিনি এখন ফুল মন্ত্রী। আগামী দিনই প্রমাণ করবে তিনি কতটুকু বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারবেন। কিন্তু আমরা যারা গবেষণা করি, আমাদের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জাসদ কর্তৃক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের কাহিনী মনে আছে। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেই জাসদের জš§। আজ সেই আওয়ামী লীগ সরকারেই জাসদের সভাপতি মন্ত্রী। এরই নাম কি রাজনীতি?
প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভায় রদবদল করলেন। এটা তিনি করতেই পারেন। সংবিধান তাকে এ অধিকার দিয়েছে। এটা রুটিনওয়ার্ক। তবে তিনি ভালো করতেন যদি : ১. অযোগ্য মন্ত্রীদের বাদ দিতেন, ২. বিশ্বমন্দার এ যুগে ছোট মন্ত্রিসভা করতেন, ৩. তোফায়েলের মতো ঝানু রাজনীতিবিদের এই মুহূর্তে তার প্রয়োজন ছিল। তার ‘অভিমান’ ভাঙানোর জন্য সরকারপ্রধানের একটি ফোনই যথেষ্ট ছিল, ৪. মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের চেয়ে মানুষ এ মুহূর্তে চায় আর্থিক দুর্নীতিতে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। চায় সুশাসন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য সীমিত রাখা। আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কিংবা বিরোধী দলের সঙ্গে একটি সমঝোতায় যাওয়া ও দরকার একটি নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলা। ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, মন্ত্রীদের অতি কথা বলা বন্ধ করা। মন্ত্রীর সংখ্যা বাড়ালেন। রাষ্ট্রের ব্যয় বাড়ল। যেখানে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো (স্পেন, গ্রিস, ইতালি) কৃচ্ছ্রসাধন করছে, সেখানে আমরা রাষ্ট্রের খরচ বাড়ালাম। সাধারণ মানুষ এটা থেকে কী পেল? কিছুই না।
Daily Jugantor
24.09.12

0 comments:

Post a Comment