রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

‘প্লুটোক্রেসি’ : বাংলাদেশ স্টাইল

গত ষাট ও সত্তরের দশকে আফ্রিকার রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ‘প্লুটোক্রেসি’ ও ‘প্লুটোনমি’ কথাটা ব্যবহার করতেন। আক্ষরিক অর্থে ‘প্লুটোক্রেসি’ হচ্ছে ধনিকতন্ত্র। ভিন্ন ধারার বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কি ইদানীং ব্যবহার করছেন ‘প্লুটোনমি’ শব্দটি। অর্থাৎ ধনিক শ্রেণী নির্ভর যে অর্থনীতি সেটাই প্লুটোনমি। ষাট ও সত্তর দশকে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনা করেছেন, তারা রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহার করে নিজেরা প্রচুর টাকার মালিক হয়েছেন। তারা নিজেরা একটা ধনিক শ্রেণীও তৈরি করেছিলেন। আফ্রিকার সম্পদ এখন আলোচনায় আসে কম। এখন আলোচনায় আসে মধ্য এশিয়া। কেননা সেখানে রয়েছে প্রচুর গ্যাস ও তেল আর সে কারণে বৃহৎ শক্তিগুলোরও আগ্রহ বেশি ওই দেশগুলো সম্পর্কে। মধ্য এশিয়ার জ্বালানি সম্পদ সেখানে একটি  ধনিক শ্রেণীর জন্ম দিয়েছে, যারা রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করে প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছেন। গত ৪ সেপ্টেম্বর বিখ্যাত ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছে একটি প্রতিবেদন- Corruptistan : The Baron, Divas & Ruling Families on central Asia। প্রতিবেদনে মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্র নায়কদের পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশে হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে সংসদ ও সংসদের বাইরে যখন বড় ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, তখন ওই ‘প্লুটোক্রেসি’ আর corruptistan এর কথা মনে হয়ে গেল। বাংলাদেশ কি তাহলে সেদিকেই যাচ্ছে? ইতোমধ্যে হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রে প্রচুর সংবাদ ছাপা হচ্ছে। একটা আশার কথা হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র নেতারা এই হলমার্ক কেলেঙ্কারিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেননি। তারা প্রকাশ্যেই সংসদে এই ঘটনার সমালোচনা করেছেন। এ থেকে সরকার কী শিক্ষা গ্রহণ করবে, আমরা জানি না। কিন্তু সরকার যদি এই ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেয়, তাহলে তা সরকারের জন্য ভালো খবর নয়। গত ৭ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ হলমার্ক ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। আমি মনে করি এটা একটা পজেটিভ দিক। কিন্তু যে প্রশ্ন আমাকে বড় বেশি ভাবিত করে, তা হচ্ছে আদৌ কি জড়িতদের গ্রেফতার করা হবে? হলমার্ক কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে যেসব প্রশ্নের জন্ম হয়েছে তার জবাব জানা আমাদের জন্য জরুরি। প্রশ্ন এক. সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখার সর্বোচ্চ ঋণ দেয়ার ক্ষমতা দু’শ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে হলমার্কের মতো অখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠান কী করে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ঋণ পেল? এত বিপুল ঋণ বরাদ্দের জন্য স্থানীয় ব্যবস্থাপকের সেই ক্ষমতা নেই। তাহলে কে তাকে প্ররোচিত করেছে এত বিপুল ঋণ বরাদ্দের জন্য? কে এই শক্তি? এটা জানা আমাদের জরুরি। প্রশ্ন দুই. হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে যেখানে পুরো জাতি আজ আতঙ্কিত, এই ঘটনার রেশ ফুরিয়ে যাবার আগেই আমরা দেখলাম সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ সদস্যদের ব্যাপারে একটি সরকারি সিদ্ধান্ত তারা পূর্ণ সময় কাটাবেন। এর কি আদৌ প্রয়োজন ছিল? কেন তাদের পূর্ণ মেয়াদে রাখা হচ্ছে? কাদের স্বার্থে রাখা হচ্ছে? তারা যদি পর্ষদে থাকেন, তাহলে কি তারা তদন্তে প্রভাব বিস্তার করবেন না? প্রশ্ন তিন. সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে যাদের রাখা হয়েছে, তারা সবাই রাজনৈতিকভাবে একটি দলের অনুগত। একজন সাংবাদিক কিংবা একজন রাজনৈতিক কর্মীও পর্ষদে রয়েছেন। যাদের ব্যাংকিং সম্পর্কে আদৌ ধারণা নেই, তাদেরকে রাখা হলো কাদের স্বার্থে? প্রশ্ন চার. অর্থমন্ত্রী প্রকাশ্যেই হলমার্ক গ্রুপের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। এতে করে কি এই কেলেঙ্কারির সাথে অর্থমন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে না? বাম মোর্চা তার পদত্যাগ দাবি করেছে। শেখ সেলিম ও তোফায়েল আহমদের মতো প্রভাবশালী নেতারা অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করেছেন। এর পরও অর্থমন্ত্রী থাকেন কী করে? প্রশ্ন পাঁচ. অর্থমন্ত্রী আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে, হলমার্ককে দেয়া ঋণের অর্ধেক পরিশোধের জন্য তাদের চিঠি দেয়া হয়েছে এবং পনের দিনের মধ্যে অর্ধেক টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। কিন্তু একটি জনপ্রিয় দৈনিক আমাদের জানাচ্ছে যে, টাকা ফেরত দিতে চাইছে না হলমার্ক (কালের কণ্ঠ, ৭ সেপ্টেম্বর)। সংবাদপত্রটি আমাদের জানাচ্ছে যে, হলমার্কের কেনা বিভিন্ন জমিতে তাদের যে সাইনবোর্ড টানানো ছিল, তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এমন খবরও সংবাদপত্রটি আমাদের দিচ্ছে যে, হলমার্ক গ্রুপের এমডি প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে দৌড়-ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন। এখন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি এক হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা দিতে ব্যর্থ হয় হলমার্ক, তখন কী হবে? প্রশ্ন ছয়. সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী আরো ২৬টি ব্যাংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে হলমার্ক। এর অর্থ বেসরকারি ব্যাংকগুলোও হলমার্কের প্রতারণার শিকার হয়েছে। হলমার্কের এই লুটপাট পুরো অর্থব্যবস্থাকে একটি ঝুঁকির মাঝে ফেলে দিলো। মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে ব্যাংক ব্যবস্থা। এর জন্য আমরা কাদের দায়ী করবো?
প্রশ্ন সাত. একটি অনলাইন বার্তা সংস্থা আমাদের জানাচ্ছে যে, হলমার্ক ঋণ পেতে ৫০ কোটি টাকার আধুনিক গাড়ি ক্রয় করেছিল। সোনালী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপঢৌকন দেয়ার জন্য এই গাড়িগুলো ক্রয় করেছিল। ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তা ওই গাড়িগুলো ব্যবহারও করেছেন। এখন ওই গাড়িগুলোর কী হবে? প্রশ্ন আট. দুদক বলছে তারা হলমার্কের এমডি ও তার স্ত্রীকে তলব করবে। শুধু হলমার্কের এমডি কেন? যারা সুবিধাভোগী তাদের কেন দুদকে ডাকা হবে না? সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকেও ডাকা উচিত। প্রশ্ন নয়. প্রথমে শেয়ার বাজার, তারপর পদ্মা সেতু, এখন হলমার্কÑ প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে এবং একটি ক্ষেত্রেও অভিযুক্তদের বিচার হয়নি। সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ একটি প্রভাবশালী চক্র শুধু শেয়ারবাজার থেকে হাতিয়ে নিয়েছিল ২০ হাজার কোটি টাকা। ইব্রাহিম খালেদ রিপোর্টে এই ঘটনায় যারা জড়িত ছিল, তাদের চিহ্নিত করা হলেও, কারোরই বিচার হয়নি। ক্ষতি হয়েছিল ৪০ লাখ খুদে বিনিয়োগকারীর। কোনো রকম টেন্ডার ছাড়া কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের নামে লুটপাট করা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ডেসটিনি নামের একটি এমএলএম কোম্পানি অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে পাচার করেছে ১০ হাজার কোটি টাকা। সরকারের লোকজন এই ডেসটিনি গ্রুপের সাথে জড়িত। একই সাথে অপর একটি এমএলএম কোম্পানি যুবক ৩ হাজার কোটি টাকা, ইউনেটুইউ ৩ হাজার কোটি টাকা, এইমওয়ে কর্পোরেশন প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। কোনো একটি ক্ষেত্রেও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হয়নি।
হলমার্ক কেলেঙ্কারি আমাদের দেখিয়ে দিল আমাদের অর্থব্যবস্থায় মারাত্মক সব ত্রুটি রয়েছে। ব্যাংকগুলোতে নিয়মিত ইনসপেকশন হবার কথা। তা হয়নি। ফলে এ ধরনের আর্থিক অনিয়ম রয়ে গেছে। কোথাও কোথাও এসব অনিয়ম অর্থের বিনিময়ে ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে তদারকি থাকা উচিত ছিল, বাংলাদেশ ব্যাংক তা করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক ব্যবস্থাপনা নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তার দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতেও বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরের নাম উচ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু সরকারের উচ্চমহলের সাথে যোগ সাজসের কারণে বহাল তবিয়তে এখনও রয়ে গেছেন গভর্নর সাহেব।
হলমার্কের ঘটনায় শুধু একটি ব্যাংকের কথা আমরা জানলাম। রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিটি ব্যাংকেই বড় ধরনের ঋণ জালিয়াতি রয়েছে বলে আমার ধারণা। খুব দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে তদারকি করা উচিত। এতে করে অনেক গোপন তথ্য বেরিয়ে যেতে পারে। একজন তানভির মাহমুদ জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থাকে একটি ঝুঁকির মাঝে ফেলে দিয়েছেন। সাধারণ মানুষের আশ্রয়স্থল ছিল এই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। এখন সেই আস্থায় চিড় ধরলো। একজন তানভির মাহমুদ, যিনি একযুগ আগেও ছিলেন সাধারণ একজন মানুষ এবং যার পারিবারিক ব্যবসার কোনো ঐতিহ্যও নেই, তিনি হঠাৎ করে কিভাবে এত বিপুল সম্পদের মালিক হলেন, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে দুদকের জন্য তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনার। একসময় আফ্রিকার দেশগুলো যে প্লুটোক্রেসি বিকশিত হয়েছিল, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশ্লেষকরা বলতেন কেপেটোক্রেসির কথা। অর্থাৎ চৌর্ষবৃত্তি, চুরি করা। আর চুরি করে প্রচুর সম্পদের মালিক হওয়া। ষাট ও সত্তর দশকের আফ্রিকার এক একটি দেশ (যেমন নাইজেরিয়া) ছিল কেপেটোক্রেসির মডেল। আমরা চাই না একজন তানভির মাহমুদের জন্য বিদেশী মিডিয়ায় আমাদেরকে কেপেটোক্রেসির মডেল হিসেবে তুলনা করুক। আমরা তানভির মাহমুদ তথা তার সহযোগীদের বিচার চাই। সেই সাথে চাই দ্রুত টাকা উদ্ধারের ব্যবস্থা করা।

0 comments:

Post a Comment