রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সরকারের পড়ন্ত বেলা ও কিছু প্রশ্ন

শেষ পর্যন্ত বহুল প্রত্যাশিত মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত হলো। কিন্তু তাতে চমক নেই। ৫ জন পূর্ণ মন্ত্রী, ২ জন প্রতিমন্ত্রী। ৭ জনের মধ্যে একজন শুধু শরিক দলের। ইতিমধ্যে তাদের দফতর বণ্টনের পাশাপাশি পুরনো কিছু জায়গায়ও হাত দেয়া হয়েছে। হাসানুল হক ইনু মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়ার চেষ্টা অনেক দিন ধরেই করে আসছিলেন। সরকারের পড়ন্ত বেলায় এসে সফল হলেন। চমক নেই এ কারণে যে, মন্ত্রিসভার তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও যোগ দেননি তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেনন। মেনন সাহেবের দলের একটা প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। আর মানসিকভাবে প্রস্তুত নন জানিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ। এদের মন্ত্রিসভায় যোগ না দেয়ার নানা সমস্যা থাকতে পারে। তোফায়েল আহমেদের মন্ত্রিসভায় যোগ না দেয়ায় প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি ‘ম্যাসেজ’। বলা হয় নতুন বার্তাও বটে। কিছুটা অভিমান তার আছে। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের সময় তাকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত না করা, দলে তাকে ‘ক্ষমতাহীন’ করে দলের উপদেষ্টা পরিষদে ‘পাঠিয়ে’ দেয়া ইত্যাদি কারণে খোদ প্রধানমন্ত্রীর ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন তিনি। তবে তিনি দলের বিরুদ্ধে যাননি। দলের ও সরকারের সংকটে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানকে বারে বারে সমর্থন করে গেছেন। শেষের দিকে মাঝে মধ্যে সরকারের ‘মৃদু’ সমালোচনা করেছেন বটে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা তিনি কখনো করেননি। শেষ বেলায় এসে মন্ত্রী না হয়ে তিনি তার সংসদীয় আসনটি নিশ্চিত করতে চান। তিনি ভালো করে জানেন সরকারের দিনকাল খুব ভালো যাচ্ছে না। নানা সংকটের মাঝে আছে সরকর। জনপ্রিয়তা যে ভাটির দিকে, একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি তা ভালো বোঝেন। তাই ‘বেলা শেষে’র মন্ত্রী তিনি হলেন না। বরং একজন সিনিয়র রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি ইতিহাসে নিজের নাম লেখাতে চান। অতীতে সংস্কারবাদীদের তালিকায় তার নাম যুক্ত হয়েছিল। তার সেই অবস্থান থেকে তিনি সরে গেলেও মূল ধারা থেকে বিচ্যুত হননি। মন্ত্রী তো তিনি অনেক আগেই হয়েছিলেন। ‘শেষ বেলা’র মন্ত্রী তাকে নতুন কোনো মর্যাদায় নিয়ে যাবে না।  মেনন মন্ত্রী হননিÑএটা দলীয় সিদ্ধান্ত। সম্ভবত মেনন সাহেবের কাছে যা বিবেচ্য হয়েছে বেশি, তা হচ্ছে সরকারের সকল অপকর্মের দায়ভার গ্রহণ না করা। দ্বিতীয় আরেকটি চিন্তা তার ভেতরে কাজ করে থাকতে পারে। আর তা হচ্ছে আগামীতে মহাজোট থেকে বেবিয়ে গিয়ে বামপন্থিদের সমন্বয়ে তৃতীয় একটি ‘ধারার’ সূচনা করা। তবে তাতে তিনি সফল হবেন এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছি না। হাসানুল হক ইনুর মন্ত্রিসভায় যোগদানে অবাক হইনি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তারাই প্রথম বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছিলেন। জাসদের গণভিত্তি কতটুকু তার পরিসংখ্যান শুধু নির্বাচন কমিশন নয়, আমাদের কাছেও আছে। ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন না করলে (নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন), তিনি তার জামানত ফিরে পেতেন কিনা, আমি নিশ্চিত নই। নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে ‘সাবেক মন্ত্রী’ এ পরিচয়টা তিনি দিতে পারবেন বটে, কিন্তু আগামী ১৩ মাসের যে রাজনীতি, তাতে আদৌ গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবেন কি? তার মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে এখন মহাজোট সরকারে আ’লীগের বাইরে তিনটি দলের প্রতিনিধিত্ব ঘটল। জাতীয় পার্টি, সাম্যবাদী দল ও জাসদ। জিএম কাদের ও হাসানুল হক ইনু নির্বাচিত সংসদ সদস্য হলেও, দিলীপ বড়–য়া সংসদ সদস্য নন। তার নিজের সংসদীয় নির্বাচনের রেকর্ড খুবই খারাপ। অতীতে কখনো ৫০০ ভোটের ওপরে তিনি পাননি। মহাজোটে জাতীয় পার্টির অন্তর্ভুক্তিতে স্ট্র্যাটেজিক্যালি শেখ হাসিনা ও তার সরকার নিঃসন্দেহে উপকৃত হয়েছেন। জাতীয় পার্টির বেশ ক’জন সংসদ সদস্য রয়েছেন যারা লাঙ্গল মার্কা নিয়েই বিজয়ী হয়েছেন, ‘নৌকা’ প্রতীক নিতে হয়নি। তবে এই জাতীয় পার্টিকে কী শেখ হাসিনা মহাজোটে পাবেন আগামী দিনে? এরশাদ সাহেব তো এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও নিন্দুকেরা তার এই ঘোষণায় ‘অন্য কিছু’র গন্ধ খুঁজে পান।
প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত করলেন। কারো কারোর দফতরও বদল করেছেন। এটা তার অধিকার। তিনি যখন ইচ্ছা মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত করতে পারেন। কিন্তু এই মুহূর্তে এটা করে কতটুকু লাভবান হবেন তিনি? মন্ত্রীর সংখ্যা বেড়েছে। এতে করে বাড়ল রাষ্ট্রের খরচ। সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে এখনো যখন স্থিরতা আসছে না, ইউরোপের অনেক দেশে যখন এখনো কৃচ্ছ সাধন চলছে তখন আমাদের মতো দেশে এত বড় একটি মন্ত্রিসভা রাখার আদৌ প্রয়োজন নেই। অনেক মন্ত্রীর অদক্ষতা ও দুর্নীতি দেশে ও দেশের বাইরে নানা প্রশ্নের জš§ দিয়েছে। সেখানে এই মুহূর্তে মন্ত্রিসভার কলেবর বৃদ্ধি করার আদৌ প্রয়োজন ছিল কি? সরকার নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। সর্বশেষ হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে পুরো অর্থনীতি এখন ঝুঁকির মুখে। হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে শুধু সোনালী ব্যাংকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, এতে আরো ২৯টি ব্যাংকও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হলমার্কের প্রায় চার হাজার কোটি টাকার বাইরেও ডেসটিনির ৩ হাজার ২৮৫ কোটি টাকার অর্থ পাচার, যুবক এর ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা আÍসাৎ, ইউনিপেটুইউ’র সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাট, কিংবা আইটিসিএলের ১০০ কোটি টাকা আÍসাতের ঘটনার সঙ্গে সরকারের প্রভাবশালী মহল জড়িত। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়া ও ইব্রাহিম খালেদ কমিশন তদন্ত রিপোর্টে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হলেও তাদের বিচার হয়নি। কাকতালীয়ভাবে কি না জানি না, রেলওয়ের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস গভীর রাতে ৭০ লাখ টাকাসহ বিজিবির হাতে ধরা পড়ার পর মন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সুরঞ্জিত সেন ফিরে এসেছিলেন দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে। হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে সারা জাতি যখন ওই একটি বিষয়ের দিকে তাদের দৃষ্টি নিবন্ধ রাখছেন এবং সমমনা দলগুলো যখন আওয়ামী বলয়ের বাইরে একটি ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছে, ঠিক তখনই মন্ত্রিসভায় ৭ জন মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত হলেন। কিন্তু তাতে করে কি মানুষ হলমার্ক কেলেঙ্কারি ভুলে যাবে? নানা ফ্রন্টে সরকারের পারফরমেন্স খুব আশাপ্রদ নয়। পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে জটিলতা এখনো কাটেনি। অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের ফিরে না আসার সম্ভাবনাই বেশি। ড. ইউনূস ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। রেন্টাল আর কুইক রেন্টাল এখন সরকারের গলার কাঁটা। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে এখন ভর্তুকি কমানোর চেষ্টা চলছে।
সাধারণ মানুষকে অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে এই ‘বিদ্যুৎ সেবা’ নিতে হচ্ছে। ২০০৬ সালের আগে যেখানে বিদ্যুৎ খাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়নি, সেখানে গত অর্থবছরে দিতে হয়েছিল ৬ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। আর গত তিন মাসে এ খাতে তেলের ভর্তুকির পরিমাণ ৩ হাজার কোটি টাকা (আমার দেশ, ১২ সেপ্টেম্বর)। কিন্তু তার পরও লোডশেডিং এখন খোদ ঢাকা শহরে ২ ঘণ্টার ওপরে প্রতিদিন। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের শ্রমবাজার হাতছাড়া হয়ে গেছে। সেখান থেকে প্রায়ই কর্মীরা দেশে ফিরে আসছেন। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত এক বছরে ব্যবসা সক্ষমতা সূচকে ১০ ধাপ অবনমনের ফলে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে ঠেকেছে। ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৮তম, অথচ এক বছর আগেও ছিল ১০৮তম। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি শূন্য দশমিক ৮০ ভাগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ১ ভাগ। এ বিষয়গুলো সরকার প্রধানের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া উচিত ছিল। কেননা সরকারকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে। জনগণের কাছে ভোট চাইতে হবে। তাদের দক্ষতা দেখাতে হবে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর দিকে নজর না দিয়ে শুধু মন্ত্রীর সংখ্যা বাড়িয়ে আর যাই হোক জনগণের আস্থা অর্জন করা যাবে না।
Daily Manobkontho
18.09.12

0 comments:

Post a Comment