রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ইতিহাস তোফায়েল-মেননকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে


বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই মুহূর্তে আলোচিত বিষয় একটি আর তা হচ্ছে- আমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেননের মন্ত্রিসভায় যোগ না দেওয়া। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস এদেরকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে আগামী দিনগুলোতে? আমরা যারা রাজনীতির শিক্ষক ও রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে লেখালেখি করি, সঙ্গত কারণেই তাদের কাছে বিষয়টি আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। একজন ‘যদু-মধু’ মন্ত্রী হলেন কি হলেন না, তাতে একজন সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসে না। কিন্তু সেই ব্যক্তি যদি তোফায়েল আহমেদ কিংবা রাশেদ খান মেনন হন তাহলে তার একটা প্রভাব রাজনীতিতে থেকে যায় বৈকি! দু’জনই তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। এক্ষেত্রে আমার কাছে রাশেদ খান মেননকে যতটুকু স্পষ্ট মনে হয়েছে, তোফায়েল আহমেদকে ততটুকু স্পষ্ট মনে হয়নি। দু’জনই বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবিসংবাদিত দুই পুরুষ। বিশ্ব জুড়েই বাম রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এলেও মেনন এখনও সেই রাজনীতি ধরে রেখেছেন। একসময়ের বাম আদর্শের অনেক লোক এখন আদর্শ ত্যাগ করে সুবিধাবাদী রাজনীতিতে নিজেদের জড়িত করেছেন। বলতে দ্বিধা নেই, যারা একসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনীতির বিরোধিতা করতেন, তারা এখন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সৈনিক। মন্ত্রী হয়েছেন। ধনী লোকের তালিকায় নিজেদের নামও লিখিয়েছেন। কিন্তু তারা তাদের অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন-এই ইতিহাস নেই। রাশেদ খান মেনন এই ধারায় নিজেকে সম্পর্কিত করেননি বটে, তবে এটাও সত্য, মহাজোট সরকারে তিনি যখন যোগ দিলেন, তখন অনেকেই সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তার নিজের এলাকা বাদ দিয়ে ঢাকার একটি আসনে ‘নৌকা’ প্রতীক নিয়ে তিনি নির্বাচন করবেন-এটাও অনেকে প্রত্যাশা করেননি তার কাছ থেকে। মহাজোটে যোগ দিয়ে গত সাড়ে তিন বছরে তিনি কতটুকু অর্জন করতে পেরেছেন, এর হিসাব-নিকাশ তিনি নিশ্চয়ই করেছেন। সংবিধানের অসঙ্গতি নিয়ে তিনি বিভিন্ন সময়ে যেসব মন্তব্য করেছেন, তা ছিল স্পষ্ট ও যুক্তিযুক্ত। একজন জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ যখন সমাজের অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরেন, মানুষের আস্থাটা ফিরে আসে।
তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেনন ডাকসুর ভিপি ছিলেন, গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, এ দেশের মানুষ তা ভুলে যাননি। তোফায়েল আহমেদ আগেও মন্ত্রী ছিলেন। অনেক আগেই তার মহাজোট সরকারের মন্ত্রী হওয়ার কথা। সরকারপ্রধানের সঙ্গে তার একটি দূরত্ব তৈরি হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার ভূমিকার কারণে। তিনি তথাকথিত সংস্কারের নামে নতুন একটি ‘ধারায়’ আওয়ামী লীগকে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন, তাতে দোষের কিছু ছিল না। একুশ শতকে আওয়ামী লীগকে নতুন ধারায় আসতে হবে, এটা বোধ করি সরকারপ্রধানও উপলব্ধি করেন। তাকে উপদেষ্টা পরিষদে পাঠানো হয়েছিল, তাতেও আমি দোষ দেখি না। কিন্তু প্রয়োজন ছিল তাকে কাজে লাগানোর। সরকারপ্রধান এখানেই ব্যর্থ। তাকে কাজে লাগাননি।
তোফায়েল-মেননের মন্ত্রী না-হওয়া রাজনীতিতে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে না-এই মতের যারা অনুসারী, আমি তাদের সঙ্গে বিনীতভাবে দ্বিমত পোষণ করছি। সম্ভবত সরকারপ্রধানের উপদেষ্টারা তাকে সঠিক উপদেশটি দিতে পারেননি। তারা অবশ্যই মন্ত্রিসভায় যোগ দিতেন, যদি সরকারপ্রধান নিজে উদ্যোগ নিতেন। ‘মানসিক চাপে তিনি এই মুহূর্তে মন্ত্রিসভায় যেতে চান না’-এটা যে তোফায়েল আহমেদের মনের কথা নয়, তা বোধ করি এ দেশের অনেক মানুষই বোঝেন। অভিমান তার আছে। এবং এটা যৌক্তিক। নানা সঙ্কটে দেশ আজ আক্রান্ত। হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় আমরা দেখতে পেলাম দেশের অর্থনীতি আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রভাবশালীরা আজ জড়িত থাকার কারণেই ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে যারা জড়িত, তারা কেউই গ্রেফতার হননি। হলমার্ক কেলেঙ্কারির ৪ হাজার কোটি টাকার সঙ্গে ডেসটিনির ৩ হাজার ২৮৫ কোটি টাকার অর্থ পাচার, যুবকের ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাত্, ইউনিপেটুইউর সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাট, কিংবা আইটিসিএলের ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনার সঙ্গে সরকারের প্রভাবশালী মহল জড়িত এমন অভিযোগ অনেকের। পদ্মা সেতুতে কথিত দুর্নীতি ও অভিযুক্ত মন্ত্রীর অনেক পরে পদত্যাগ, কিংবা অর্থ উপদেষ্টার এখনও ক্ষমতায় থাকা বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির অনেক ক্ষতি করেছে। অধ্যাপক ড. ইউনূসকে নিয়ে সরকারপ্রধান ও মন্ত্রীদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বিদেশে বাংলাদেশের মান-সম্মান উজ্জ্বল করেনি। এক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়টির চেয়ে ব্যক্তি ইউনূস প্রাধান্য পেয়েছেন সবচেয়ে বেশি। সরকারের ব্যর্থতা, সরকার বিদেশিদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট করতে পারেনি। রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্র নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ, তা-ও সরকার কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এখন সরকারের শেষ সময়। এসব সঙ্কট মোকাবেলা করা, কিংবা বিরোধী দলকে আস্থায় নিয়ে একটি নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য সরকারের যে ক’জন দক্ষ, অভিজ্ঞ, গ্রহণযোগ্য মন্ত্রী থাকা দরকার, তা সরকারে নেই। সরকারপ্রধান যে সাতজনকে মন্ত্রী বানালেন, তারা রাজনীতিতে কতটুকু গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবেন, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তবে এটা দিব্যি দিয়ে বলতে পারি, তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেনন মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হলে সরকারের অবস্থান আরও শক্তিশালী হতো। বিরোধী দলের সঙ্গে দর-কষাকষিতে এরা দু’জন যে ভূমিকা রাখতে পারতেন, বর্তমান সরকারে সেরকম লোকের অভাব রয়েছে। যে সাতজন মন্ত্রী হলেন, তারা সবাই দুর্নীতির ঊর্ধ্বে, তা বলা যাবে না। তাদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে সঙ্কট উত্তরণে ‘রাজনৈতিক ম্যাচিউরিটি’র প্রমাণ দেওয়া। বর্তমান মন্ত্রিপরিষদে ও উপদেষ্টামণ্ডলীতে সেরকম লোক নেই! যারা আছেন তারা অনর্থক বেশি কথা বলেন। সরকারপ্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তারা বিভিন্ন সময়ে যে বক্তব্য দেন ও টকশো মাতিয়ে রাখেন, তাতে তারা সঙ্কটকেই আরও গভীরতর করে তোলেন মাত্র। ‘কালো বিড়াল’ খ্যাত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সরকারের সম্পদ নন-বরং এক আপদ। পদত্যাগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুনরায় পতাকাবাহী গাড়ি হাঁকানো সাধারণ মানুষ পছন্দ করেননি। এই তথ্যটুকু সরকারপ্রধান কতটুকু জানেন, কিংবা তার উপদেষ্টারা তাকে সঠিক উপদেশটি দিয়েছিলেন বলে মনে হয় না। বিদেশমন্ত্রী বিদেশে যেতে, ক্যামেরা নিয়ে প্রটোকল ভেঙে ছবি তুলতে কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের ‘অটোগ্রাফ’ নিয়ে বালখিল্যতার পরিচয় দিতে পারলেও, বৈদেশিক নীতিতে আদৌ সাফল্য পেয়েছেন বলে বলতে পারছি না। তার ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে দু’জন উপদেষ্টার ‘দৌড়ঝাঁপ’ আমরা লক্ষ করলেও ইমেজ সঙ্কটের মুখে যে বাংলাদেশ, তা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি। বিনিয়োগ বাড়েনি (বরং কমেছে। ব্যবসা সক্ষমতা রিপোর্টে বাংলাদেশের অবস্থান ১০ ধাপ নিচে নেমে গেছে। শ্রমবাজার ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু বিদেশমন্ত্রীর ‘ভ্রমণপ্রীতি’ বেড়েছে (এখনও তিনি বিদেশে)। আর তার পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশকে একটি ‘সফ্ট পাওয়ার’ (ঝড়ভঃ চড়বিত্) হিসেবে তুলে ধরার চেয়ে (হিলারি ক্লিনটনের মতে) দেশে ‘রবীন্দ্রপ্রেম’ নিয়ে বেশি ব্যস্ত। সরকারের এই যে পরিস্থিতি, এখন প্রয়োজন যোগ্য ও মেধাসম্পন্ন নেতৃত্বের। হাসানুল হক ইনু মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে ক্যাবিনেটের এই যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। কেননা তার ব্যক্তিগত সততা নিয়ে প্রশ্ন আছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসা ঘেরাও করার রাজনীতির মধ্য দিয়ে জাসদ ‘হঠকারী’ রাজনীতির জন্ম দিয়েছিল। ইনু সাহেব সেই রাজনীতিরই ‘প্রডাক্ট’। আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধিতা করে যার জন্ম, তিনি এখন সেই আওয়ামী লীগেরই মন্ত্রী। ইতিহাস কী নির্মম! যিনি বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাতে চেয়েছিলেন, তিনিও মন্ত্রী। কিন্তু যিনি ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেন, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব হয়ে যিনি তরুণ বয়সে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছিলেন, পরিণত বয়সে তিনি হয়ে গেলেন ‘অযোগ্য’। প্রধানমন্ত্রী একটা বড় পরিবর্তন আনতে পারতেন। অদক্ষ, অযোগ্য, দুর্নীতিপরায়ণ ‘কালো বিড়াল’দের বাদ দিয়ে তরুণ, যোগ্য ও মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভায় নিয়ে আসতে পারতেন। সেই সুযোগ তার ছিল। সংবিধান তাকে অগাধ ক্ষমতা দিয়েছে। তিনি পারলেন না বা করলেন না। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হল না।
দেশ একটি সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সংবিধান সংশোধনের দাবি উঠেছে। নির্বাচনের স্বচ্ছতা, গ্রহণযোগ্যতা ও শক্তিশালী একটি রাজনৈতিক সরকারের জন্য নির্দলীয় সরকারের অধীনে দশম সংসদ নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা শক্তিশালী হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে সঠিক উপদেশ দেওয়ার লোকের খুব অভাব। একটি ব্যাপক ঐকমত্যের তাগিদে মহাজোটের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সেই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একজন দিলীপ বড়ুয়া (যিনি কোনো নির্বাচনে ৫০০ ভোটও পাননি কোনো দিন), কিংবা একজন হাসানুল হক ইনুকে (যিনি মশাল মার্কা নিয়ে জামানত হারিয়েছেন বার বার) নিয়ে যে সরকার, সেই সরকার সুশাসন নিশ্চিত করতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। প্রয়োজন ছিল তোফায়েল কিংবা মেননের মতো অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের— যারা তাদের দক্ষতা ও ম্যাচিউরিটি দিয়ে সরকারপ্রধানকে সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারতেন। এখন যা হল, তাতে সরকারের কোনো লাভ হল না। মন্ত্রী বাড়ল। সরকারের খরচ বাড়ল। নানাবিধ সঙ্কটের জালে আবদ্ধ সরকার, সেই জাল কেটে বের হয়ে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। সরকারপ্রধানের হাতে একটি সুযোগ ছিল, সেই সুযোগটি তিনি কাজে লাগাতে পারলেন না।

0 comments:

Post a Comment