রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ইসলামিক স্টেটের পতন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা



Image result for IS picture
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। গেল মাসে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (্আইএস) তথাকথিত রাজধানী রাকার পতন ঘটেছে। আর গেল সপ্তাহে আইএসের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত দাইর আল জয়ুর (Deir al Zour)) শহরের পতন ঘটেছে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর হাতে। প্রায় একই সময় ইরাকি সেনাবাহিনী দখল করেছে আল কাইমে(al-Qaim) অবস্থিত আইএসের শেষ ঘাঁটিটি। অনেকের মনে থাকার কথা, গেল জুলাই মাসে ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুলের পতনের মধ্য দিয়ে আইএসের পতন শুরু হয়েছিল। আর শেষ হলো দাইর আল জয়ুর ও আল কাইমে অবস্থিত আইএসের শক্ত দুইটি ঘাঁটি পতনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু আইএসের পতনের মধ্য দিয়ে কি আইএসের মতবাদের পরিসমাপ্তি ঘটল? মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের পতন যখন সংবাদপত্রে বড় করে আলোচনায় আসছে, তখন গেল ৩১ অক্টোবর নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে সন্ত্রাসী কর্মকা- আইএসের আগামী ভূমিকাকে সামনে নিয়ে এসেছে। ম্যানহাটনের এ ঘটনায় জড়িত রয়েছেন সায়ফুল্লো সাইকভ নামে এক ব্যক্তি, যিনি নিজেকে আইএস সমর্থক বলে দাবি করছেন। এরই মধ্যে আইএসের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতাও প্রমাণিত হয়েছে। তিনি একজন উজবেকিস্তানের নাগরিক এবং যুক্তরাষ্ট্রে গ্রিনকার্ড নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন। ম্যানহাটনের ওই ঘটনায় সায়ফুল্লো ট্রাকের চাপায় পিষ্ট করে আটজনকে হত্যা করে। গেল বেশ কিছুদিন আইএস এ ধরনের স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করে আসছে। বিশেষ করে ফ্রান্সের নিস কিংবা লন্ডনে আইএসের সঙ্গে জঙ্গিরা এভাবে ট্রাক দিয়ে পিষে সাধারণ মানুষদের হত্যা করে। এভাবে আইএস সর্বত্র একটা ভয়ের আবহ তৈরি করে। ফলে যে প্রশ্নটি এখন উঠেছে, তা হচ্ছে আইএসের কর্মকা- কি শেষ হয়ে গেল? অনেক বিশেষজ্ঞের মতামত আমি পেয়েছি, যারা বলার চেষ্টা করেছেন যে, আইএস মধ্যপ্রাচ্য থেকে উৎখাত হয়েছে; কিন্তু তাদের মতাদর্শের মৃত্যু ঘটেনি। ২০১৪ সালের ১০ জুন প্রথমবারের মতো বিশ্ব জেনেছিল আইএস নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের কথা। সেদিন ইরাকের মসুল শহর দখল করে আইএস তাদের অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করেছিল। সেদিন তারা নিজেদের ঘোষণা করেছিল ‘ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট (Islamic state and the Levant) নামে। Levant  হচ্ছে এ এলাকার ঐতিহাসিক নাম। পরবর্তী ক্ষেত্রে অবশ্য এরা আইএস বা ইসলামিক স্টেট হিসেবে পরিচিতি পায়। তারা একটি খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথাও ঘোষণা করে। এরা মুসলিমবিশ্বের সব মুসলমানের আনুগত্য দাবি করে। গেল দুই বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একের পর এক জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হয়, যারা আইএসের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে। বাংলাদেশেও আমরা নয়া জেএমবির উত্থান দেখেছি, যারা আইএসের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছিল। তবে আশার কথা, এদের কর্মকা- এখন নেই বললেই চলে। আইএস তাদের নেতা আবু বকর বুগদাদির নাম প্রকাশ করেছিল। বুগদাদি নিজে প্রকাশ্যে আবির্ভূত হয়ে খেলাফত প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু রাকার পতন এবং সিরিয়া ও ইরাক থেকে আইএসের উৎখাতের পর আবু বকর বুগদাদির খবর কেউ জানে না। সুতরাং সবার দৃষ্টি যে এখন আইএসের ভবিষ্যৎ কর্মকা-ের দিকে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। এরই মাঝে ঘটল নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের সন্ত্রাসী কর্মকা-।
যারা বিশ্বব্যাপী জঙ্গি কার্যক্রম নিয়ে কাজ করেন, তারা লক্ষ করেছেন যে সিরিয়া-ইরাকের আইএসের কার্যক্রম সীমিত হয়ে আসছে। আইএস সিরিয়া-ইরাকও পরাজিত হয়েছে এরই মধ্যে। তবে এখানে যেসব জঙ্গি ‘যুদ্ধে’ অংশ নিয়েছিলেন, তারা এখন সেখান থেকে সটকে পড়েছেন। আগামীতে জঙ্গি কার্যক্রম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তৃত হবে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। এক্ষেত্রে দুইটি দেশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন অনেকে। একটি ফিলিপাইনে, অপরটি মিয়ানমার-বাংলাদেশে রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে। ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ ম্যাগাজিনে অক্টোবর (২০১৭) সংখ্যায় অধ্যাপক জাকারি আবুজার (Zachary Abuza) একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে ফিলিপাইনের জঙ্গিবাদের প্রসার নিয়ে। অধ্যাপক আবুজা যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত National war collage-এর একজন অধ্যাপক। তার প্রবন্ধের নাম গধুযবস  Mayhem in Marawi। ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলের একটি শহর মারাবি(Marawi)। সেখানে গত মে (২০১৭) থেকে ফিলিপাইনের সেনাবাহিনী আইএস-সংশ্লিষ্ট আবু সায়াফ গ্রুপের সঙ্গে যে ‘যুদ্ধে’ লিপ্ত, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। ৪ মাসে সেখানে জঙ্গিদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন সেনাবাহিনীর ১৪৭ সদস্য এবং ৪৭ সিভিলিয়ান। জঙ্গিদের সঙ্গে যুদ্ধে ওই শহরটি পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। এ যুদ্ধের সঙ্গে সিরিয়া-ইরাকে আইএসের বিরুদ্ধে সিরিয়া ও ইরাকি বাহিনী যে যুদ্ধ পরিচালনা করছে, তার কথা মনে করিয়ে দেয়। সেনাবাহিনী এখন মারাবি শহরের নিয়ন্ত্রণভার নিতে পেরেছে। শহরটি এখন পরিপূর্ণভাবে পরিত্যক্ত। শহরের শতকরা একশ ভাগ বসতবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ এখন সম্প্রসারিত হয়েছে ফিলিপাইনে। সিএনএন ২৯ মে (২০১৭) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে Phillippines : The Next ISIS Stronghold? অর্থাৎ ফিলিপাইন কি হতে যাচ্ছে আইএসের পরবর্তী শক্তিশালী ঘাঁটি? ওই প্রতিবেদনে একটি মসজিদে আইএস কর্তৃক তাদের পতাকা উত্তোলন করার দৃশ্য আমরা দেখেছিলাম। এ অঞ্চলের তিনটি দেশেÑ ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়ায় গেল ২ বছরে যেসব জঙ্গি কর্মকা- হয়েছে এবং যার সঙ্গে আইএস জড়িত, তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে সিএনএনের প্রতিবেদনে। পাঠকদের সেখান থেকে কিছু তুলে দিচ্ছিÑ জুন ২৮, ২০১৬। কুয়ালালামপুরের একটি নাইট ক্লাবে জঙ্গি হামলায় আটজনের মৃত্যু। জানুয়ারি ১৪, ২০১৬Ñ জার্কাতায় সন্ত্রাসী হামলায় চারজনের মৃত্যু। মে ২৪, ২০১৭Ñ জাকার্তায় সন্ত্রাসী হামলায় তিনজনের মৃত্যু। ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ফিলিপাইনের দাভাও শহর সন্ত্রাসী বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু ১৪ জন। আর মারাবির ঘটনা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। প্রতিটি ঘটনায় আইএস তার দায় স্বীকার করেছে। সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন তৎপর, যাদের সঙ্গে আইএসের যোগাযোগ রয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে, মরো লিবারেশন ফ্রন্ট (এমআইএলএফ)। এরা তৎপর সুলু দীপপুঞ্জ এলাকায়। সুলু দ্বীপপুঞ্জ এলাকায় Bangoamoro Islamic Freedom Fighters (BIFF)--ও তৎপর। জাকার্তায় তৎপর জামেইয়া ইসলামিয়া। আবু সায়াফ গ্রুপ ও মাউটে গ্রুপ তৎপর দক্ষিণাঞ্চলে। আবার ব্রুনাইডে আবু সায়াফ গ্রুপ তাদের তৎপরতা সম্প্রসারিত করেছে। সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক Centre for Political Violence and Terrorism Research (ICPVTR)  তাদের এক গবেষণায় উল্লেখ করেছে, আইএস সম্প্রতি সিরিয়া ফেরত জঙ্গিদের নিয়ে এ অঞ্চলে নতুন একটি ব্রিগেড তৈরি করেছে, যার নাম Katibah Al Muhajirৎ. পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এ ব্রিগেডের তৎপরতা রয়েছে। এ ব্রিগেডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন হাপিলন নামে এক জঙ্গি। হাপিলন এসেছেন সুলু অঞ্চল থেকে। ২০১৬ সালে আইএস তাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আমির হিসেবে ঘোষণা করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মার্কিনি গোয়েন্দাদের মতে, হাপিলন ইংরেজি বা আরবি ভাষা কিছুই বোঝেন না এবং ইসলাম ধর্ম সম্পর্ক তার জ্ঞানও সীমিত। যুক্তরাষ্ট্র তাকে ধরার জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেছে। কয়েক হাজার জঙ্গি বর্তমানে এ অঞ্চলে জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত। ফলে আগামী দিনগুলোয় এ অঞ্চলে যে অস্থিরতা বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হলো রোহিঙ্গাদের নাম।
সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণটি হচ্ছে, রাকা থেকে আইএস জঙ্গিরা উৎখাত হওয়ার পর এরা হারিয়ে যাবে না। এখন ফিলিপাইনের মারাবি শহর থেকে আইএসকে উৎখাত করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তে। তাহলে আইএস জঙ্গিরা কোথায় এখন আশ্রয় নেবেন? ওয়াশিংটনের ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসিতে কর্মরত গবেষক আরন ওয়াই জেলিন মনে করেন, আইএস শেষ হয়ে যায়নি। তারা কিছুদিন চুপ করে থেকে ফের শক্তি সঞ্চয় করবে এবং তাদের অনুসারীদের উৎসাহ জোগাবে। তারা গেরিলা কায়দায় তাদের কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখবে(with loss of its Caliphate, ISIS May Return to Guerilla Roots, NP Times, Oct 18, 2017))। আর ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা MIS-এর পরিচালক এন্ডু পারকার মনে করেন, That threat is multidimensional, wolving rapidly and operating at a scale and pace we’ve not seen before|। এসব মন্তব্যের পেছনে কিছুটা হলেও সত্যতা আছে। নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের ঘটনা এর সর্বশেষ প্রমাণ। সায়ফুল্লো উজবেক নাগরিক। শত শত উজবেক নাগরিক আইএসে যোগ দিয়ে রাকায় যুদ্ধ করেছিলেন। অনেকে মারাও গেছেন। অনেকে আবার সেখানে থেকে অন্য দেশে চলে গেছেন। ভয়টা হচ্ছে, এসব উগ্রপন্থী উজবেক নাগরিক ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারেন এবং সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাতে পারেন। আইএসের কর্মকা- এ মুহূর্তে হয়তো সিরিয়া-ইরাকে দেখা যাবে না; কিন্তু অন্য কোনো জায়গায় দেখা দিতে পারে। মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পরবর্তী টার্গেট। আফ্রিকায়, বিশেষ করে সোমালিয়া কিংবা কেনিয়ার দিকেও আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। সিরিয়া-ইরাকের পর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এখন স্থান করে নেবে এসব অঞ্চল। রোহিঙ্গাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো তৎপর হতে পারে, যা কিনা আমাদের নিরাপত্তাকে বিস্মিত করতে পারে। তাই রাকা থেকে আইএস উৎখাতের পর আমরা যেন উৎসাহিত না হই, আমাদের সতর্ক হতে হবে এবং যে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা-কে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। আইএস জঙ্গিরা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এরা যে কোনো দেশে, বিশেষ করে মুসলমানপ্রধান দেশে জঙ্গি হামলা চালাতে পারে। তাই যা বলা যায়, তা হচ্ছে রাকা থেকে উৎখাত, কিংবা ম্যানহাটনে সন্ত্রাসী হামলাই শেষ হয়। গেল ৫ নভেম্বর টেক্সাসে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এটা এখন নিশ্চিত, এ হামলার সঙ্গে আইএস জড়িত ছিল না। তবু এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যে মুসলমানবিরোধী একটা ‘ক্যাম্পেইন’ শক্তিশালী হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, তা অব্যাহত থাকবে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ ‘ক্যাম্পেইন’কে আরও শক্তিশালী করবেন। এবার এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মুসলমান।
Alokito bangladesh
12.11.2017

0 comments:

Post a Comment