রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রোহিঙ্গা সমস্যার আদৌ কি সমাধান হবে



আজ রোববার তিনটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এবং সেই সঙ্গে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উখিয়ায় অবস্থিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির দেখতে যাচ্ছেন। সঙ্গে থাকবেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জার্মানি, জাপান ও সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে যাচ্ছেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও। ফিরে এসে তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন। তারপর তারা যাবেন মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে, যেখানে তারা আসেম বা এশিয়া-ইউরোপ মিটিংয়ে যোগ দেবেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে রোহিঙ্গা সমস্যা যে কত গুরুত্ব সহকারে স্থান পেয়েছে, তার বড় প্রমাণ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং মার্কিন সিনেটর জেক মার্কেলের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দলেরও একই সময় ঢাকা আগমন। এর অর্থ হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে একটি বড় ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা। এসব তৎপরতা অনুষ্ঠিত হয়েছে এমন একসময়, যখন গেল ১৬ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মানবাধিকারবিষয়ক কমিটিতে ভোটাভুটিতে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহনীর অভিযান বন্ধের আহ্বান জানিয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে ১৩৫টি রাষ্ট্র। বিপক্ষে পড়েছে ১০টি ভোট। কিছু দেশ ভোটদানে অনুপস্থিত ও বিরত ছিল। চীন ও রাশিয়া ভোটদানের সময় প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। ভারত ও জাপানসহ ২৬টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর সহিংসতা বন্ধ ও মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন পুনর্বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের ‘পূর্ণ নাগরিকত্ব’ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত ও রোহিঙ্গাদের ওপর যারা অত্যাচার-নিপীড়ন করছে, তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্যও দেশটির সরকারকে বলা হয়েছে। ওআইসি এ খসড়া প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিল। এর কো-স্পন্সর ছিল ৯৭টি দেশ। যে কোনো বিবেচনায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিটিতে এ ধরনের একটি প্রস্তাব পাস করানো আমাদের জন্য এক ধরনের ‘বিজয়’। চীন ও রাশিয়ার ‘অবস্থান’ আমাদের আগেই জানা ছিল। ভারত প্রথম দিকে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান করলেও এখন ভোটাভুটিতে ভারত বিরত থাকায় ভারতের অবস্থান কিছুটা হলেও পরিবর্তিত হয়েছে বলে আমার ধারণা। এখন এতগুলো দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ঢাকায় আসছেন। তারা নিজেরা রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখবেন। ফলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর এক ধরনের ‘চাপ’ আসতে পারে বলে আমার ধারণা। বলা হচ্ছে, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে দুই দেশের মাঝে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হবে, যারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করবে। কাজটি খুব সহজ নয়। এর সঙ্গে অনেক ‘প্রশ্ন’ জড়িত। তবে এ মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের অন্যত্র নিয়ে গিয়ে তাদের একসঙ্গে রাখা।
রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন নিয়ে সাম্প্রতিককালে দুইটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল সংবাদপত্রে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গেল ফেব্রুয়ারিতে জার্মানির মিউনিখে একটি নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মরকেলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে জার্মানির সহযোগিতা চেয়েছিলেন। অপর সংবাদটিও রোহিঙ্গা পুনর্বাসনসংক্রান্ত। বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশ প্রধান শিনজি কুবো জানিয়েছিলেন, ১ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ভিন্ন কোনো দেশে পুনর্বাসনের জন্য তারা বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি চেয়েছেন। তবে সম্প্রতি যে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন, তদের মধ্য থেকে এ ১ হাজার রোহিঙ্গাকে বেছে নেয়া হবে বলে মনে হয় না। কুবো জানিয়েছেন, বাংলাদেশের দুইটি শরণার্থী ক্যাম্পে প্রায় ৩৪ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। সেখান থেকেই এ ১ হাজার রোহিঙ্গাকে বাছাই করা হবে। এ দুইটি সংবাদই রোহিঙ্গা শরণার্থী পুনর্বাসন প্রশ্নে একটি বড় সংবাদ। কিন্তু এতে করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে না। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজারে অবৈধভাবে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের হাতিয়া উপজেলার একটি বিরান চর ঠেঙ্গারচরে (ভাসানচর) সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে স্পষ্ট করে বলা হয়নি, কবে নাগাদ সেখানে পুনর্বাসনের কাজ শুরু হবে। এরই মধ্যে সেনাবাহিনীকে একটি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেখানে অবকাঠামো গড়ে তুলতে। ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের প্রশ্নে কিছু কিছু দ্বিমত থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন। কেননা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার কক্সবাজারে উপস্থিতি শুধু পরিবেশগত সমস্যাই বাড়িয়ে দিচ্ছে না, বরং নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাকে ঝুঁকির মাঝে ফেলে দিয়েছে। স্থানীয়রা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে এবং তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংঘর্ষ হচ্ছে।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে এ ধরনের সংবাদ প্রমাণ করে, রোহিঙ্গা সমস্যাটি ধীরে ধীরে একটি আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে এরই মধ্যে। সংগত কারণেই তাই প্রশ্নটি উঠছেÑ রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কোন পথে? বাংলাদেশও এক্ষেত্রে কী করতে পারে? সম্প্রতি একাধিক টিভি চ্যানেলে রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনায় আমি অংশ নিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ ও হুমায়ুন কবির। দুইজনই সিনিয়র কূটনীতিক। সেখানেও এ প্রশ্নটি উঠেছিলÑ বাংলাদেশ এখন কী করবে? বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সমস্যাটি বিবেচনা করে সাময়িকভাবে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছেÑ এতে কি সমস্যাটির সমাধান হবে? আমার বিবেচনায় এতে সমস্যার সমাধান হবে না; বরং সমস্যার গভীরতা আরও বাড়বে। বাংলাদেশ শুধু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে ‘বসে’ থাকতে পারে না। বাংলাদেশের অনেক কিছু করার আছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যাটির আরও আন্তর্জাতিক করার উদ্যোগ নিতে পারে। এক্ষেত্রে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করতে পারে বাংলাদেশ এবং দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় (বাংলাদেশ-মিয়ানমার) পাশাপাশি বাংলাদেশ চীন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারে এবং তাদের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারে ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করতে পারে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের ভেতরেই একটি ‘সেফ হ্যাভেন’ প্রতিষ্ঠা করে আন্তর্জাতিক তদারকিতে সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার কথা বলতে পারে বাংলাদেশ। যেহেতু জাতিসংঘ রোহিঙ্গা নির্যাতনকে গণহত্যা বলছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এ গণহত্যার বিষয়টি তুলতে পারে। এটা সত্য, মিয়ানমারে আমাদের স্বার্থ রয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে এ সম্পর্কের গুরুত্ব অনেক। ন্যূনতম দুইটি আঞ্চলিক সংস্থায় (বিসিআইএন ও বিমসটেক) বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একসঙ্গে কাজ করছে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যাটাকে এ সম্পর্কের বাইরে রাখা যাবে না। এজন্য দরকার ‘স্মার্ট ডিপ্লোম্যাসি’। সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমারের সিভিল সোসাইটির সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বলা ভালো, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে অং সান সু চির কাছ থেকে প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। দুঃখজনক হলেও সত্য, ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা পেলে এবং শত শত রোহিঙ্গার নৌকাযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারেও ওই সময় সু চির কোনো বক্তব্য ছিল না। মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার মনে করে, রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক! অথচ ইতিহাস বলে, শত বছর ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছে। সু চি এ প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাইরে নন। তিনি জানেন, ক্ষমতায় থাকার জন্য তার উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থনের প্রয়োজন আছে। তাই উগ্রপন্থীরা যখন মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করতে তখন তিনি নিশ্চুপ। মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারেও তার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি যে স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছেন, তা সুবিধাবাদিতায় ভরা। সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন নেত্রী তিনিÑ এ কথাটা বলা যাবে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচনের আগে একদিকে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের ‘সহাবস্থান’ গিয়েছিলেন, অন্যদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থেকে তিনি উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অবস্থানকেই সমর্থন করেছিলেন। এতে তিনি ‘বিজয়ী’ হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি সমাজ ব্যবস্থা সেখানে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হবেÑ সে প্রশ্ন আছে। একটি জনগোষ্ঠী যখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়, তখন সেই সমাজকে গণতান্ত্রিক বলা যাবে না। পশ্চিমাদের বিরাট একটা প্রত্যাশা ছিল সু চিকে ঘিরে। তাদের ধারণা ছিল, সু চি মিয়ানমারে সত্যিকার অর্থেই একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু করবেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল, তিনি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গোষ্ঠীস্বার্থেই কাজ করছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুকে সামনে রেখেই সু চি যে ব্যর্থ হয়েছেন, এটা আগামীতে সেনাবাহিনী ব্যবহার করবে। সেনাবাহিনীর পক্ষে এটা বলা সহজ হবে যে, সু চি মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছেন। ২০১৫ সালের নভেম্বরে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর সংসদ বসেছিল ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে অং সান সু চি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি; প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন হাতিন কিয়াও(Htin Kyaw)। তার টার্ম শেষ হবে ২০২১ সালে। এর আগে ২০২০ সালের দিকে সেখানে নির্বাচন হবে। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে বহির্বিশ্বে সু চির ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। ফের তার ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। এক্ষেত্রে বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল অং হ্লাইং হতে যাচ্ছেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। সেনাবাহিনীর সমর্থনকারী একাধিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী এসব রাজনৈতিক দলকে ব্যবহার করবে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের কী হবে? মিয়ানমার কি তাদের ফিরিয়ে নেবে? মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কয়েকটি শর্তের কথা বলছে। প্রথমত রয়েছে তারা যে মিয়ানমারের নাগরিক, তা প্রমাণ করতে হবে। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। মিয়ানমারের এসব নাগরিককে তারা বলছে ‘বাঙালি’। বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিকত্ব তারা প্রমাণ করতে পারবেন না। কেননা তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। জীনব বাঁচাতে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলেন। ফলে তাদের কাছে নাগরিকত্ব প্রমাণ করা সংক্রান্ত কোনো কাগজপত্র থাকার কথা হয়। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গা সন্তানদেরও প্রমাণ করতে হবে তাদের বাবা-মায়েরা রাখাইনে অনেক আগে থেকেই বসবাস করে আসছিলেন। এটিও সম্ভব হবে না। তৃতীয়ত, রাখাইনের বিভিন্ন স্থানে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে বাড়ি ঘরের কোনো অস্তিত্ব নেই। ফলে রোহিঙ্গাদের পক্ষে তাদের বাড়িঘরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। নতুন করে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে ‘আস্থার সংকটে’র যে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা রয়ে গেছে। ফলে রোহিঙ্গারা কোনো ধরনের নিশ্চয়তা না পেয়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইবে না।
একটু সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, রোহিঙ্গা প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এতে মিয়ানমারের রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটেছে বলে বলা হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের অবস্থান আশাব্যঞ্জক নয়। অং সান সু চিসহ মিয়ানমারের নেতারা মিথ্যাচারের আশ্রয় নিচ্ছেন বারবার। ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত আসিয়ানের ৩১তম সম্মেলনে সু চি বলেছিলেন, সমঝোতা চুক্তি হলে তিন সপ্তাহের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে মিয়ানমার। এটা সময়ক্ষেপণ করার একটা কৌশল। এর আগে অক্টোবরে সু চি বলেছিলেন, রোহিঙ্গারা ফিরতে চায় না। তিনি একবার এমন কথাও বলেছেন, মুসলমানরা কেন চলে যাচ্ছেন, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। গেল সেপ্টেম্বরে ঢাকায় এসেছিলেন মিয়ামনমারের বিশেষ দূত কিউ টিন। কিন্তু ফল শূন্য। ফলে একাধিক দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বাংলাদেশ সফর, এমনকি আসেম শীর্ষ সম্মেলনও আমাদের জন্য একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। আমরা এ সম্মেলনকে আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারি। এ নভেম্বরেই আসছেন পোপ ফ্রান্সিস। তিনি বাংলাদেশে এসে মিয়ানমারেও যাবেন। আমরাও এ সুযোগটি আমাদের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারি। মোদ্দাকথা, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের পাশে আছে। এখন দরকার কূটনৈতিক যোগাযোগ আরও শক্তিশালী করা।
Daily Alokito Bangladesh
19.11.2017

0 comments:

Post a Comment