গেল সপ্তাহে গাজায় অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিরা যখন ঐতিহাসিক নাকবা (Nakba) দিবস পালন করছিলেন, তখন ইসরাইলি সেনাবাহিনী তাদের ওপর বড় ধরনের হামলা চালায়। প্রকাশ্যে গুলি আর ড্রোন বিমান ব্যবহার করে বোমা নিক্ষেপ করে ইসরাইল সেখানে গণহত্যা চালায়। তাতে প্রাণ হারিয়েছেন ৬০ জন নিরীহ ফিলিস্তিনি, আর আহতদের সংখ্যা কয়েক হাজার। ইসরাইল এই হত্যাকা-ের জন্য এমন একটা সময় বেছে নিয়েছিল, যখন যুক্তরাষ্ট্র তার দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেয়। নিঃসন্দেহে ট্রাম্প প্রশাসনের ওই সিদ্ধান্ত তেলআবিব সরকারকে উৎসাহ জুগিয়ে থাকবে গাজায় গণহত্যা চালাতে। এই গণহত্যা, বিশেষ করে একজন পঙ্গু ফিলিস্তিনি ফাদি আবু সালেহ ও ৮ মাসের শিশু লাইলা আল গান্দেউরের হত্যাকা- সারা বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গাজার এই হত্যাকা-কে যুদ্ধাপরাধ বলেছে। আর জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন গাজার হত্যাকা- নিয়ে তদন্ত করতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার বাধার মুখে তা বাতিল হয়ে যায়। তবে খোদ জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান। আর ইসরাইলের হাত থেকে ফিলিস্তিনিদের রক্ষার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সুরক্ষা বাহিনী গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে আংকারায় অনুষ্ঠিত ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) জরুরি সম্মেলনে। ইসরাইলি এই গণহত্যার প্রতিবাদ উঠেছে সর্বত্র। অনেক দেশ ইসরাইল থেকে তাদের নিজ নিজ দূত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এমনকি খোদ ইসরাইলের ভেতরেও এই হত্যাকা-ের প্রতিবাদ উঠেছে।
গেল ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন, ওই সময় তা বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। ট্রাম্প যখন ডিসেম্বরে (২০১৭) তার এই সিদ্ধান্তের কথা জানান, তখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছিল। জাতিসংঘে ওই সময় আয়োজিত ভোটাভুটির সময় যুক্তরাষ্ট্র হুমকি দিয়েছিল, যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবে, তাদের নামধাম লিখে রাখা হবে এবং তাদের অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিন্তু এই হুমকির পরও ১২৮টি দেশ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ‘জেরুজালেম নগরীর মর্যাদার বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত অকার্যকর ও বাতিলযোগ্য’ শীর্ষক যে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল, তার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। আর বিপক্ষের অর্থাৎ ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পক্ষে ভোট দিয়েছিল ৯টি দেশ। ভোটদানে বিরত ছিল ৩৫টি দেশ। এখানে বলে রাখা ভালো, মুসলিমবিশ্বের জন্য জেরুজালেম একটি স্পর্শকাতর বিষয়। পূর্ব জেরুজালেম যে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হবে, এটা অনেক আগেই স্বীকৃত। এখানে রয়েছে পবিত্র আল আকসা মসজিদ। তবে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। সেই থেকে পূর্ব জেরুজালেমে ইসরাইলি দখলদারি বজায় রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৮০ সালে ইসরাইল এক আইনবলে সমগ্র জেরুজালেমকে ইসরাইলি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু জাতিসংঘ গৃহীত এক সিদ্ধান্তে (সিদ্ধান্ত নম্বর ৪৭৮) এর সমালোচনা করা হয়েছিল। গেল বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে এসেও যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল, তাতে বলা হয়েছে, ‘জেরুজালেম নগরীর মর্যাদার বিষয়ে যে-কোনো সিদ্ধান্ত অকার্যকর ও বাতিলযোগ্য।’ সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও ইসরাইলের মধ্যে একটি ‘শান্তিপূর্ণ’ সহাবস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। একটি ‘দুই রাষ্ট্র’ ফরমুলার দিকে ধীরে ধীরে দুই পক্ষে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত এখন সেই ফরমুলার পেছনে ছুরিকাঘাতের শামিল। দুই রাষ্ট্রের ফরমুলায় পূর্ব জেরুজালেম ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হবেÑ এমন কথা স্বীকৃত ছিল। ওবামা প্রশাসন সেই ‘দুই রাষ্ট্র’ ফরমুলায় অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সেখান থেকে সরে এসেছেন। তারা ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের সংগ্রামকে উপেক্ষা করে পুরো জেরুজালেম যে ইসরাইল রাষ্ট্রের রাজধানী, তা তারা পরোক্ষভাবে স্বীকার করল। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি যখন উত্তপ্ত, ইসরাইলের সঙ্গে ইরানের যখন এক ধরনের ‘ছায়াযুদ্ধ’ চলছে, এমনকি সিরিয়া সংকটের যখন কোনো সমাধান হচ্ছে না, তখন এই উত্তপ্ত রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এটি শুধু এ অঞ্চলের রাজনীতি নয়, বরং বিশ্বে উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট। জেরুজালেমে রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প মূলত তার প্রতিশ্রুতি পালন করলেন। গেল ডিসেম্বরে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি অতি সত্বর যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেবেন। এই কাজটি তিনি এখন করলেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটি পরিবর্তনের দিক নির্দেশ করলেন। এই কাজটি তিনি করলেন এমন একটা সময়, যখন তিনি ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিলেন। দ্বিতীয়ত, ইসরাইল স্পষ্টই সিরিয়া যুদ্ধের একটা অংশ হয়ে গেছে এবং ইসরাইল-ইরান এক ধরনের ‘ছায়াযুদ্ধ’ শুরু হয়ে গেছে। তৃতীয়ত, সিরিয়া সংকটের কোনো সমাধানও হচ্ছে না। ইতোমধ্যে লেবানন ও ইরাকে নির্বাচন হয়েছে এবং তাতে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। লেবাননে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ গ্রুপ নির্বাচনে ভালো করেছে এবং হিজবুল্লাহ সমর্থিত একটি সরকার সেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে। হারিরি যদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যান, তিনি হিজবুল্লাহর বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। ইরাকে মুকতাদা আল সদরের সমর্থকরা ভালো করেছে। ওয়াশিংটন সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল আবাদি সরকারের পতন ঘটেছে। মুকতাদা আল সদর ইরান সমর্থিত এবং প্রচ- আমেরিকানবিরোধী। একই সঙ্গে হিজবুল্লাহরাও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী। ফলে পারসীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরানের প্রভাব বাড়ল। এটা একদিকে যেমন সৌদি আরবের জন্য চিন্তার কারণ, ঠিক তেমনি চিন্তার কারণ ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও।
সুতরাং গাজা সংকটকে উসকে দিয়ে ইসরাইল এ অঞ্চলে আরেকটি যুদ্ধের পাঁয়তারা করছে বলে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন। অতীতে একাধিকবার আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৮-৪৯, ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩ এবং ১৯৮২। ১৯৪৮ সালে ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে প্রথম ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে মিশর, জর্ডান, ইরাক, সিরিয়া ও লেবানন। ১৯৫৬ সালে মিশরের জাতীয়তাবাদী নেতা জামাল আবদেল নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করলে ইসরাইল মিশরের সিনাই মরুভূমি দখল করে নেয়। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে ৬ দিনব্যাপী যুদ্ধে আরবরাষ্ট্রগুলো আবারও যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল ইসরাইলের সঙ্গে। ওই যুদ্ধে ইসরাইল সিনাই উপত্যকা ও গোলান উপত্যকা দখল করে নিয়েছিল। পরবর্তীতে মিশরের সঙ্গে শান্তি চুক্তির বিনিময়ে মিশর সিনাই উপত্যকা ফেরত পেলেও সিরিয়া গোলান উপত্যকা ফেরত পায়নি। গোলান উপত্যকা ফেরত দেওয়ার সম্ভাবনাও কম। কেননা এখানে সম্প্রতি তেল পাওয়া গেছে। আর ইসরাইলের পানির অন্যতম উৎস হচ্ছে এই গোলান উপত্যকা। ১৯৮২ সালে ইসরাইল লেবাননে পিএলও অবস্থানের ওপর বোমা বর্ষণ করে। একপর্যায়ে পিএলও’কে লেবানন থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। আর ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে গাজায় ব্যাপক সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনিরা ‘ইন্তিফাদা’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেই আন্দোলন কখনও আর থেমে থাকেনি।
তবে ইসরাইলের সাম্প্রতিক এই ‘গণহত্যা’ প্রমাণ করল, ইসরাইল এ অঞ্চলে আরেকটি যুদ্ধ শুরু করতে চায়। নেতানিয়াহু এবং ট্রাম্প দুজনই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বড় ধরনের সংকটে আছেন। দুর্নীতির অভিযোগে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে সেখানে তদন্ত হচ্ছে। আর ট্রাম্প নিজে নানা সংকটে জড়িত। তার যৌন কেলেঙ্কারির পাশাপাশি তিনি চীন ও ইউরোপের সঙ্গে একধরনের ‘বাণিজ্য যুদ্ধে’ জড়িয়ে গেছেন। এ থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্যই মধ্যপ্রাচ্যে এ সংকট নতুন করে সৃষ্টি করা হচ্ছে। কিন্তু এতে ফিলিস্তিনিদের দমিয়ে রাখা যাবে না। এতদিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি সংকট সমাধানে একধরনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে আসছিল। কিন্তু ট্রাম্পের ইসরাইলপন্থি নীতি সেই অবস্থান থেকে এখন সরে এলো। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস তো স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, তারা আর যুক্তরাষ্ট্রকে ‘মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে মানেন না। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক। এমনকি বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র এখন আর রাখে নাÑ এমন কথাও উচ্চারিত হয়েছে বিভিন্ন মহলে। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, জেরুজালেমে যখন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ভবন (১৪ মে) উদ্বোধন করা হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বন্ধুরাষ্ট্র ওই অনুষ্ঠানে যোগদান করেনি। আলজাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের ট্র্যাডিশনাল মিত্ররা (জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স) অনুষ্ঠানে যোগ দেয়নি। ভারতের সঙ্গে ইসরাইলের ‘ভালো’ সম্পর্ক থাকলেও ভারতও ওই অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিল। চীনও অনুপস্থিত ছিল। এর মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হলো যে, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে অনেক দেশই একমত নয়। এটা ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির জন্য খুব ভালো সংবাদ নয়।
বন্দুকের জোরে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের অধিকারবঞ্চিত করছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পেয়েছে গাজাবাসীর অবর্ণনীয় দুরবস্থার কথা। বলা হচ্ছে গাজা হচ্ছে উন্মুক্ত একটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। একটি সীমিত এলাকায় ইসরাইলি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকে গাজাবাসী। এতে কি ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম দমিয়ে রাখা যাবে? ফিলিস্তিনি তরুণ ফাদি আবু সালাহর ছবি সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। ২০০৮ সালে ফাদি প্রতিবাদ জানাতে এসে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গুলিতে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে হুইলচেয়ারে প্রতিবাদ করতে এসে তিনি শহীদ হলেন। ৮ মাসের শিশু লাইলা আল গান্দেউরের ছবিও ভাইরাল হয়েছে। ইসরাইলি সেনাদের নিক্ষেপিত টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায় লায়লা। ফাদি আর লায়লার মৃত্যু প্রমাণ করে ফিলিস্তিনি আন্দোলন দমিয়ে রাখা যাবে না। ট্রাম্পের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে উত্তেজনা বেড়েছে। কিন্তু তাতে ফিলিস্তিনি আন্দোলন বন্ধ হবে না। দীর্ঘ ৭০ বছর ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে আসছে। কিন্তু একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রও আজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তা এখনও অনেকটা কাগজে-কলমে আটকে আছে। ১৯৯৩ সালে পিএলও এবং ইসরাইল পরস্পরকে স্বীকৃতি এবং ওয়াশিংটনে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর, ১৯৯৪ সালে গাজা ও জেরিকোয় ফিলিস্তিনি শাসন প্রতিষ্ঠা, ১৯৯৫ সালে পশ্চিমতীরে স্বায়ত্তশাসনসংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর ইত্যাদি শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত হলেও মূল সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। অর্থাৎ স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে, কিন্তু এর কোনো সার্বভৌমত্ব নেই। উপরন্তু পশ্চিমতীর ও গাজা নিয়ে যে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্ম, তা কার্যত অনেকটাই ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি ‘রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়েছে। ইসরাইল এমন একটি ‘ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র’ দেখতে চায়, যা তাদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে।
পাঠক ২০১৪ সালের পরিস্থিতির কথা স্মরণ করতে পারেন। ওই সময় ইসরাইলি বিমান আর ট্যাংকের গোলায় গাজা নগরী একটি ধ্বংসের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। সাত সপ্তাহ ধরে এই আগ্রাসন অব্যাহত ছিল। ইসরাইলি বিমান হামলায় শত শত শিশু সেখানে মারা গিয়েছিল। কিন্তু জাতিসংঘ ও বিশ্বসম্প্রদায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো ববস্থা নিতে পারেনি। কিংবা গণহত্যার জন্য ইসরাইলি নেতাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নিয়ে যেতে পারেনি। আর এটাই হচ্ছে মূল সমস্যা। ইসরাইলি আগ্রাসী নীতির কারণে আজও সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জেরুজালেমে তাদের দূতাবাস স্থানান্তরের কারণে এই শান্তি প্রক্রিয়া অনির্দিষ্টকারের জন্য পিছিয়ে গেল। এর মধ্য দিয়ে যে অসন্তোষের জন্ম হয়েছে, তা সহজে থামবে বলে মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্র বড় দেশ এবং তার ভূমিকা আন্তর্জাতকিভাবে স্বীকৃত। ওবামা প্রশাসন একটি দুই রাষ্ট্র ফর্মুলা নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসন যদি এদিকে অগ্রসর হয়, তাহলে ফিলিস্তিন সমস্যার একটা সমাধান সম্ভব। আর এতে করে তা হবে স্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একধাপ অগ্রগতি।
গেল ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন, ওই সময় তা বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। ট্রাম্প যখন ডিসেম্বরে (২০১৭) তার এই সিদ্ধান্তের কথা জানান, তখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছিল। জাতিসংঘে ওই সময় আয়োজিত ভোটাভুটির সময় যুক্তরাষ্ট্র হুমকি দিয়েছিল, যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবে, তাদের নামধাম লিখে রাখা হবে এবং তাদের অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিন্তু এই হুমকির পরও ১২৮টি দেশ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ‘জেরুজালেম নগরীর মর্যাদার বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত অকার্যকর ও বাতিলযোগ্য’ শীর্ষক যে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল, তার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। আর বিপক্ষের অর্থাৎ ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পক্ষে ভোট দিয়েছিল ৯টি দেশ। ভোটদানে বিরত ছিল ৩৫টি দেশ। এখানে বলে রাখা ভালো, মুসলিমবিশ্বের জন্য জেরুজালেম একটি স্পর্শকাতর বিষয়। পূর্ব জেরুজালেম যে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হবে, এটা অনেক আগেই স্বীকৃত। এখানে রয়েছে পবিত্র আল আকসা মসজিদ। তবে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। সেই থেকে পূর্ব জেরুজালেমে ইসরাইলি দখলদারি বজায় রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৮০ সালে ইসরাইল এক আইনবলে সমগ্র জেরুজালেমকে ইসরাইলি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু জাতিসংঘ গৃহীত এক সিদ্ধান্তে (সিদ্ধান্ত নম্বর ৪৭৮) এর সমালোচনা করা হয়েছিল। গেল বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে এসেও যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল, তাতে বলা হয়েছে, ‘জেরুজালেম নগরীর মর্যাদার বিষয়ে যে-কোনো সিদ্ধান্ত অকার্যকর ও বাতিলযোগ্য।’ সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও ইসরাইলের মধ্যে একটি ‘শান্তিপূর্ণ’ সহাবস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। একটি ‘দুই রাষ্ট্র’ ফরমুলার দিকে ধীরে ধীরে দুই পক্ষে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত এখন সেই ফরমুলার পেছনে ছুরিকাঘাতের শামিল। দুই রাষ্ট্রের ফরমুলায় পূর্ব জেরুজালেম ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হবেÑ এমন কথা স্বীকৃত ছিল। ওবামা প্রশাসন সেই ‘দুই রাষ্ট্র’ ফরমুলায় অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন সেখান থেকে সরে এসেছেন। তারা ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের সংগ্রামকে উপেক্ষা করে পুরো জেরুজালেম যে ইসরাইল রাষ্ট্রের রাজধানী, তা তারা পরোক্ষভাবে স্বীকার করল। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি যখন উত্তপ্ত, ইসরাইলের সঙ্গে ইরানের যখন এক ধরনের ‘ছায়াযুদ্ধ’ চলছে, এমনকি সিরিয়া সংকটের যখন কোনো সমাধান হচ্ছে না, তখন এই উত্তপ্ত রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এটি শুধু এ অঞ্চলের রাজনীতি নয়, বরং বিশ্বে উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট। জেরুজালেমে রাজধানী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প মূলত তার প্রতিশ্রুতি পালন করলেন। গেল ডিসেম্বরে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি অতি সত্বর যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেবেন। এই কাজটি তিনি এখন করলেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটি পরিবর্তনের দিক নির্দেশ করলেন। এই কাজটি তিনি করলেন এমন একটা সময়, যখন তিনি ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিলেন। দ্বিতীয়ত, ইসরাইল স্পষ্টই সিরিয়া যুদ্ধের একটা অংশ হয়ে গেছে এবং ইসরাইল-ইরান এক ধরনের ‘ছায়াযুদ্ধ’ শুরু হয়ে গেছে। তৃতীয়ত, সিরিয়া সংকটের কোনো সমাধানও হচ্ছে না। ইতোমধ্যে লেবানন ও ইরাকে নির্বাচন হয়েছে এবং তাতে বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। লেবাননে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ গ্রুপ নির্বাচনে ভালো করেছে এবং হিজবুল্লাহ সমর্থিত একটি সরকার সেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে। হারিরি যদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে যান, তিনি হিজবুল্লাহর বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। ইরাকে মুকতাদা আল সদরের সমর্থকরা ভালো করেছে। ওয়াশিংটন সমর্থিত প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল আবাদি সরকারের পতন ঘটেছে। মুকতাদা আল সদর ইরান সমর্থিত এবং প্রচ- আমেরিকানবিরোধী। একই সঙ্গে হিজবুল্লাহরাও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী। ফলে পারসীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে ইরানের প্রভাব বাড়ল। এটা একদিকে যেমন সৌদি আরবের জন্য চিন্তার কারণ, ঠিক তেমনি চিন্তার কারণ ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও।
সুতরাং গাজা সংকটকে উসকে দিয়ে ইসরাইল এ অঞ্চলে আরেকটি যুদ্ধের পাঁয়তারা করছে বলে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন। অতীতে একাধিকবার আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৮-৪৯, ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩ এবং ১৯৮২। ১৯৪৮ সালে ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে প্রথম ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে মিশর, জর্ডান, ইরাক, সিরিয়া ও লেবানন। ১৯৫৬ সালে মিশরের জাতীয়তাবাদী নেতা জামাল আবদেল নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করলে ইসরাইল মিশরের সিনাই মরুভূমি দখল করে নেয়। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে ৬ দিনব্যাপী যুদ্ধে আরবরাষ্ট্রগুলো আবারও যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল ইসরাইলের সঙ্গে। ওই যুদ্ধে ইসরাইল সিনাই উপত্যকা ও গোলান উপত্যকা দখল করে নিয়েছিল। পরবর্তীতে মিশরের সঙ্গে শান্তি চুক্তির বিনিময়ে মিশর সিনাই উপত্যকা ফেরত পেলেও সিরিয়া গোলান উপত্যকা ফেরত পায়নি। গোলান উপত্যকা ফেরত দেওয়ার সম্ভাবনাও কম। কেননা এখানে সম্প্রতি তেল পাওয়া গেছে। আর ইসরাইলের পানির অন্যতম উৎস হচ্ছে এই গোলান উপত্যকা। ১৯৮২ সালে ইসরাইল লেবাননে পিএলও অবস্থানের ওপর বোমা বর্ষণ করে। একপর্যায়ে পিএলও’কে লেবানন থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। আর ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে গাজায় ব্যাপক সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনিরা ‘ইন্তিফাদা’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেই আন্দোলন কখনও আর থেমে থাকেনি।
তবে ইসরাইলের সাম্প্রতিক এই ‘গণহত্যা’ প্রমাণ করল, ইসরাইল এ অঞ্চলে আরেকটি যুদ্ধ শুরু করতে চায়। নেতানিয়াহু এবং ট্রাম্প দুজনই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বড় ধরনের সংকটে আছেন। দুর্নীতির অভিযোগে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে সেখানে তদন্ত হচ্ছে। আর ট্রাম্প নিজে নানা সংকটে জড়িত। তার যৌন কেলেঙ্কারির পাশাপাশি তিনি চীন ও ইউরোপের সঙ্গে একধরনের ‘বাণিজ্য যুদ্ধে’ জড়িয়ে গেছেন। এ থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্যই মধ্যপ্রাচ্যে এ সংকট নতুন করে সৃষ্টি করা হচ্ছে। কিন্তু এতে ফিলিস্তিনিদের দমিয়ে রাখা যাবে না। এতদিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি সংকট সমাধানে একধরনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে আসছিল। কিন্তু ট্রাম্পের ইসরাইলপন্থি নীতি সেই অবস্থান থেকে এখন সরে এলো। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস তো স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, তারা আর যুক্তরাষ্ট্রকে ‘মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে মানেন না। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লজ্জাজনক। এমনকি বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র এখন আর রাখে নাÑ এমন কথাও উচ্চারিত হয়েছে বিভিন্ন মহলে। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, জেরুজালেমে যখন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ভবন (১৪ মে) উদ্বোধন করা হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বন্ধুরাষ্ট্র ওই অনুষ্ঠানে যোগদান করেনি। আলজাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের ট্র্যাডিশনাল মিত্ররা (জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স) অনুষ্ঠানে যোগ দেয়নি। ভারতের সঙ্গে ইসরাইলের ‘ভালো’ সম্পর্ক থাকলেও ভারতও ওই অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিল। চীনও অনুপস্থিত ছিল। এর মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হলো যে, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে অনেক দেশই একমত নয়। এটা ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতির জন্য খুব ভালো সংবাদ নয়।
বন্দুকের জোরে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের অধিকারবঞ্চিত করছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পেয়েছে গাজাবাসীর অবর্ণনীয় দুরবস্থার কথা। বলা হচ্ছে গাজা হচ্ছে উন্মুক্ত একটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। একটি সীমিত এলাকায় ইসরাইলি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকে গাজাবাসী। এতে কি ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম দমিয়ে রাখা যাবে? ফিলিস্তিনি তরুণ ফাদি আবু সালাহর ছবি সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। ২০০৮ সালে ফাদি প্রতিবাদ জানাতে এসে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গুলিতে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে হুইলচেয়ারে প্রতিবাদ করতে এসে তিনি শহীদ হলেন। ৮ মাসের শিশু লাইলা আল গান্দেউরের ছবিও ভাইরাল হয়েছে। ইসরাইলি সেনাদের নিক্ষেপিত টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায় লায়লা। ফাদি আর লায়লার মৃত্যু প্রমাণ করে ফিলিস্তিনি আন্দোলন দমিয়ে রাখা যাবে না। ট্রাম্পের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে উত্তেজনা বেড়েছে। কিন্তু তাতে ফিলিস্তিনি আন্দোলন বন্ধ হবে না। দীর্ঘ ৭০ বছর ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে আসছে। কিন্তু একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রও আজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তা এখনও অনেকটা কাগজে-কলমে আটকে আছে। ১৯৯৩ সালে পিএলও এবং ইসরাইল পরস্পরকে স্বীকৃতি এবং ওয়াশিংটনে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর, ১৯৯৪ সালে গাজা ও জেরিকোয় ফিলিস্তিনি শাসন প্রতিষ্ঠা, ১৯৯৫ সালে পশ্চিমতীরে স্বায়ত্তশাসনসংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর ইত্যাদি শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে চিহ্নিত হলেও মূল সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। অর্থাৎ স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে, কিন্তু এর কোনো সার্বভৌমত্ব নেই। উপরন্তু পশ্চিমতীর ও গাজা নিয়ে যে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্ম, তা কার্যত অনেকটাই ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি ‘রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়েছে। ইসরাইল এমন একটি ‘ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র’ দেখতে চায়, যা তাদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে।
পাঠক ২০১৪ সালের পরিস্থিতির কথা স্মরণ করতে পারেন। ওই সময় ইসরাইলি বিমান আর ট্যাংকের গোলায় গাজা নগরী একটি ধ্বংসের নগরীতে পরিণত হয়েছিল। সাত সপ্তাহ ধরে এই আগ্রাসন অব্যাহত ছিল। ইসরাইলি বিমান হামলায় শত শত শিশু সেখানে মারা গিয়েছিল। কিন্তু জাতিসংঘ ও বিশ্বসম্প্রদায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো ববস্থা নিতে পারেনি। কিংবা গণহত্যার জন্য ইসরাইলি নেতাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নিয়ে যেতে পারেনি। আর এটাই হচ্ছে মূল সমস্যা। ইসরাইলি আগ্রাসী নীতির কারণে আজও সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জেরুজালেমে তাদের দূতাবাস স্থানান্তরের কারণে এই শান্তি প্রক্রিয়া অনির্দিষ্টকারের জন্য পিছিয়ে গেল। এর মধ্য দিয়ে যে অসন্তোষের জন্ম হয়েছে, তা সহজে থামবে বলে মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্র বড় দেশ এবং তার ভূমিকা আন্তর্জাতকিভাবে স্বীকৃত। ওবামা প্রশাসন একটি দুই রাষ্ট্র ফর্মুলা নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসন যদি এদিকে অগ্রসর হয়, তাহলে ফিলিস্তিন সমস্যার একটা সমাধান সম্ভব। আর এতে করে তা হবে স্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একধাপ অগ্রগতি।
Daily Alokito Bangladesh
27.05.2018