প্রণব মুখার্জি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি। তিনি ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। এখন তিনি অবসরে। ভারতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দেশটি যখন বড় ধরনের বিক্ষোভের মুখে পড়েছে, তখন, গত ১৬ ডিসেম্বর নয়াদিল্লির ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের দফতরে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা মানে যা খুশি করা নয়।
ভারতে নানা ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় রয়েছে। গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদের এই পরিবেশ যেন লঙ্ঘিত না হয়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’ স্পষ্টতই তার ইঙ্গিত কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের প্রতি। তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা হল, ভারতে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যা হচ্ছে তা গণতন্ত্রের মূল স্পিরিটের পরিপন্থী। গণতন্ত্র পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার কথা শেখায়। গণতন্ত্র হচ্ছে অপরকে আস্থায় নেয়া। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠরা শাসন করে বটে; কিন্তু এ শাসন নিশ্চিত হয় বিরোধী পক্ষকে আস্থায় নিয়েই।
সারা বিশ্বের মানুষ ভারতের এ গণতান্ত্রিক চরিত্রই দেখে এসেছে গত প্রায় ৭২ বছর। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় জমানায় (২০১৯) এক ভিন্ন ভারতকে দেখছে বিশ্ব। সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামে উগ্র দলীয় চিন্তা-চেতনা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এ কথাটাই বলতে চেয়েছেন।
ভারতের রাজনীতিতে প্রণব মুখার্জির স্থান অনেক উঁচুতে। ভারতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিতে তিনি জড়িত থাকলেও সর্বভারতীয় মহলে তার একটি গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। অনেক শীর্ষস্থানীয় বিজেপি নেতাও তাকে সম্মানের চোখে দেখেন। সুতরাং ভারতের বর্তমান সংকটের সময় তিনি যখন এ ধরনের একটি কথা বলেন, তখন সে কথার গুরুত্ব রয়েছে বৈকি। সঙ্গত কারণেই তার এ বক্তব্যের পেছনে একটি ‘ইতিহাস’ রয়েছে- আর তা হচ্ছে, বর্তমান ভারতের কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার খোদ ভারতের মৌলিক আদর্শকে বদলে দিতে চাচ্ছে! এর শুরুটা হয়েছিল প্রথমে আসাম থেকে, যখন আসামের নাগরিকপুঞ্জির উদ্যোগ নেয়া হল।
অর্থাৎ আসামে দীর্ঘদিন ধরে যারা বসবাস করে আসছেন এবং যারা বাংলায় কথা বলেন, তারা আদৌ ভারতীয় নাগরিক কিনা, তা যাচাই-বাছাই করে দেখে একটা তালিকা তৈরি করা হয়। এ তালিকায় যাদের নাম থাকবে না বা নেই, তাদের ‘অবৈধ বসবাসকারী’ হিসেবে ঘোষণা করে বাংলাদেশে ‘পুশহীন’ করাই উদ্দেশ্য! এখানে টার্গেট করা হয়েছে বাঙালি মুসলমানদের এবং বলা হচ্ছে, এরা বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসে ‘অবৈধভাবে’ ভারতে বাস করছেন! এই নাগরিকপুঞ্জি বা এনআরসি বাংলাদেশে বড় ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একাধিকবার আশ্বাস দিয়েছেন এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আমরা নরেন্দ্র মোদির কথায় আস্থা রাখতে পেরেছি বলে মনে হচ্ছে না। আসামে এনআরসি নিয়ে বিতর্কের যখন অবসান হল না, তখন দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি নিল মোদি সরকার কাশ্মীরের সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করে দিয়ে সেখানে কেন্দ্রের শাসন ও জম্মু-কাশ্মীর থেকে লাদাখকে বের করে আলাদা কেন্দ্রের শাসনে পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে। ভারতের সংবিধানে ৩৭০নং ধারা নামে একটা ধারা ছিল।
ওই ধারা বলে কাশ্মীরের অধিবাসীরা ভারতীয় কাঠামোয় বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন। ভারতের সংবিধান প্রণেতারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, বিভিন্ন জাতি, উপজাতি, ধর্ম ও বর্ণে বিভক্ত ভারতকে এক রাখতে হলে কোনো কোনো অঞ্চলকে ও জনগোষ্ঠীকে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। কাশ্মীরসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো এ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। এখন কাশ্মীর থেকে সেই সুযোগ-সুবিধা সংসদে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাতিল করা হয়েছে।
এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুসলমানরা। তারা সেখানে শুধু চাকরি হারানোর ঝুঁকিতেই নেই, বরং নিজ এলাকায় ‘দ্বিতীয় শ্রেণির’ নাগরিকে পরিণত হওয়ার একটা আশঙ্কার মাঝে আছেন। একই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতেও।
ভারতের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত বিষয়টি সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট ১৯৫৫-এর সঙ্গে জড়িত। পরে ১৯৮৬, ১৯৯২, ২০০৩, ২০০৫ ও ২০১৫ সালে এতে কিছু কিছু পরিবর্তন আনা হয়। তবে এবার যে পরিবর্তন আনা হল, তা মূল কাঠামোকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে।
এখন ইসলাম ধর্মাবলম্বী কারও পক্ষে ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করতে পারাটা কঠিন হয়ে পড়বে। অথচ হিন্দু ধর্মসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন এবং তাদের নাগরিকত্বের আবেদন বিবেচনা করা হবে। সংবিধানের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত অনুচ্ছেদে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে ভারত সরকার মূলত ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের একটা ব্যবধান তৈরি করল। প্রশ্ন হচ্ছে- এ সংশোধনী ভারতের সংবিধানের পরিপন্থী কিনা?
সংবিধানের অনেকগুলো ধারা ও প্রস্তাবনা (preamble) সংবিধানের এ সংশোধনীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংবিধান পরিপন্থীও বটে। ভারতের সংবিধানের ১৪নং আর্টিকেলটি এ সংশোধনীর পরিপন্থী। এ আর্টিকেলে সমতার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বিভক্তি আনা যাবে না, সবাই সমান। এখানে বলা আছে, 'The state shall not deny to any person equality before law or the laws within the territory of India'. রাষ্ট্র কাউকে তার সমঅধিকর থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।
কিন্তু সংশোধনী এনে নাগরিকত্বের প্রশ্নে সমঅধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। আমরা সংবিধানের প্রস্তাবনার কথাও উল্লেখ করতে পারি। প্রস্তাবনায় ভারত সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘a welfare state committed to secure justice, liberty and equality for the people and for promoting fraternity, dignity of the individual, and unity and integrity of the nation'. এখানে unity ও integrity'র কথা, অর্থাৎ ঐক্য ও সংহতির কথা বলা হয়েছে।
এ ঐক্য ও সংহতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ওই সংশোধনী। আমরা সংবিধানের আরও কয়েকটি ধারা উল্লেখ করব। যেমন সংবিধানের ৫নং ধারায় বলা হয়েছে, ভারত হবে একটি Secular state- ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু সংবিধানের নাগরিকত্ব সংশোধনী ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের পরিপন্থী। এ ধারায় প্রতিটি ধর্মের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের সম স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে, যা সংবিধানের পরিপন্থী। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে ৬টি মৌলিক মানবাধিকারের (Fundamental Rights) কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র এ মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেবে। এখানে ৩নং উপধারায় আছে Right against exploitation, ৪নং উপধারায় আছে Right to freedom of religion-এর কথা।
কিন্তু এখন কোনো মুসলমান ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করলে সেটা গ্রাহ্য হবে না। অথচ সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদ তাকে সেই অধিকার দিয়েছে। সুতরাং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে সুপ্রিমকোর্টে যে রিট হয়েছে, তা যুক্তিযুক্ত বলে আমি মনে করি। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই ভিজয়ান বলেছেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সংবিধান পরিপন্থী। সুতরাং কেরালায় এটি কার্যকর হবে না বলেও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন।
আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এনআরসি রুখতে গণআন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। আসামে এনআরসি হলেও পশ্চিমবঙ্গে কোনো এনআরসি হবে না এটি জানাতেও তিনি ভোলেননি। পাঞ্জাব সরকারও এ আইন প্রত্যাখ্যান করেছে।
ফলে স্পষ্টতই এই এনআরসি কিংবা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ভারতকে বিভক্ত করে ফেলেছে। মজার ব্যাপার, আসাম ও ত্রিপুরায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার রয়েছে। মনিপুরেও রয়েছে বিজেপি সরকার। তাহলে এ অঞ্চলগুলো অশান্ত কেন? এর কারণ হচ্ছে, এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ মনে করেন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস হওয়ার ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিপুলসংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর পুনর্বাসন হবে।
বাংলা ভাষাভাষীদের সংখ্যা এতে করে বৃদ্ধি পাবে। ওই অঞ্চলে উপজাতীয়দের যে জমিজমা ছিল, তা হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা কিনে নেবে। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। এর মধ্য দিয়ে উপজাতীয়রা এ অঞ্চলে যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পেতেন, তা বাতিল হয়ে যাবে। আসামের ক্ষেত্রে ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এবং ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত ‘আসাম মুভমেন্টের’ মধ্যে যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেই সমঝোতা মুখ থুবড়ে পড়বে। বাংলাভাষীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে এ অঞ্চলের ভারসাম্য নষ্ট হবে। তাদের আপত্তিটা এ কারণেই।
পরিস্থিতি এখন কোন দিকে যাবে বলা মুশকিল। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতে গেছে। যারা আদালতে গেছেন, তারা যুক্তি দেখিয়েছেন, ধর্মের ভিত্তিতে কখনই নাগরিকত্ব প্রদান করা যায় না। তাদের যুক্তি, এই আইন সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী।
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বেঞ্চ এ রিটটি শোনেন। উচ্চ আদালতের এ বেঞ্চটি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটি বাতিল করার আবেদন খারিজ করে দিলেও কেন্দ্রীয় সরকারকে তারা নোটিশ দিয়েছেন। আগামী ২২ জানুয়ারি মামলার পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এ শুনানিতে কী হবে বলা মুশকিল, তবে আইনটি বাতিলের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন অমিত শাহ। গত ১৭ ডিসেম্বর এক সমাবেশে তিনি বলেছেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের রক্ষায় মোদি সরকার সবকিছু করবে। এসব শরণার্থীর জন্য ভারতের নাগরিকত্ব ও সম্মান নিশ্চিত করা হবে।
উচ্চ আদালত থেকে কোনো কিছু প্রত্যাশা করাও ঠিক হবে না বলে অনেকে মনে করেন। বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিতর্কে উচ্চ আদালত রামমন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দেয়ায় অনেকেরই উচ্চ আদালত নিয়ে এক ধরনের মোহভঙ্গ হয়েছে।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনেও এমনটি হতে পারে। তবে নিঃসন্দেহে যা বলা যায় তা হচ্ছে, এ আইনটি পুরো ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে ফেলছে। কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোকে সুযোগ করে দিয়েছে একত্রিত হওয়ার। এখন বিরোধী দলগুলো নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর কতটুকু চাপ প্রয়োগ করতে পারবে, সেটাই দেখার বিষয়।
Jugantor
21.12.2019