রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

‘কপ’ শীর্ষ সম্মেলন ও বাংলাদেশে পরিবেশগত সমস্যা

 মাদ্রিদে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কপ-২৫ শীর্ষ সম্মেলন যখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, ঠিক তখনই এশিয়া নিউজ নেটওয়ার্কে প্রকাশিত হয়েছে গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স ২০২০। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে সাত নম্বরে স্থান দেয়া হয়েছে।
এ তালিকার শীর্ষে রয়েছে পুয়ের্টোরিকো, মিয়ানমার ও হাইতির মতো দেশ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কপ-২৫ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। এ সম্মেলন চলবে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। বিশ্ব যে বড় ধরনের পরিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, এবং বাংলাদেশ যে কত বড় ঝুঁকির মুখে রয়েছে, কিছুদিন আগে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ তার একটি উদাহরণ। বাংলাদেশের এ জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদের কথা বলতেই প্রধানমন্ত্রী মাদ্রিদে গিয়েছিলেন।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত কপ-২১ সম্মেলনে পৃথিবীর উষ্ণতা কমানোর জন্য বিশ্বের ১৯৫টি দেশ নীতিগতভাবে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্যারিস চুক্তিতে যে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল, তা শেষ হবে ২০২০ সালে। এ সময়ের মধ্যেই চুক্তির বাস্তবায়ন চূড়ান্ত করতে হবে। কিন্তু এখন অবধি তাতে কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না।
পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। উষ্ণতা বাড়ার কারণে সাগর-মহাসাগরের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তাতে করে বিশ্বের যেসব সমুদ্র পাড়ের দেশের ক্ষতি হবে, তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা কতটুকু সচেতনতা গড়ে তুলতে পেরেছি? সম্প্রতি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জানিয়েছেন, দেশটি ২০০ কোটি গাছ লাগাবে। নরওয়ে গাছ কাটা নিষিদ্ধ করেছে।
একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (Crowther Lab) জানিয়েছে, বিশ্বের ২২০ কোটি একর জমিতে যদি গাছ লাগানো যায়, তাহলে বিশ্বে যে কার্বন নির্গমন হয়, তার তিন ভাগের দুই ভাগ ধরে রাখা সম্ভব হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ করার জন্য ২০১৫ সালের কপ-২১ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এ ব্যাপারে উদ্যোগটা কম। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো আদৌ দায়ী নয়। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়নশীল বিশ্ব।
শিল্পোন্নত ১০টি দেশ বিশ্বের কার্বন নিঃসরণের ৬৭.৬ ভাগ নিজেরা নিঃসরণ করে। এ তালিকার শীর্ষে রয়েছে চীন। দুঃখজনক হচ্ছে, কপ-২১-এ যুক্তরাষ্ট্র স্বাক্ষর করলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হয়ে কপ-২১ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। সারা বিশ্ব যেখানে এটা স্বীকার করে নিয়েছে এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দায়ী, সেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ বৈজ্ঞানিক ও প্রমাণিত সত্যকে বিশ্বাস করতে চাইছেন না। বলা হচ্ছে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। মরু অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে। এতে করে বাড়ছে সাগর-মহাসাগরের জলরাশি। World
Meteorological Organization (WMO)-এর সর্বশেষ রিপোর্টে ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে- কার্বন নিঃসরণের মাত্রা অতীতের চেয়ে ২০১৫-২০১৯ সময়সীমায় ২০ ভাগ হারে বেড়েছে। ১৯৯৩ সাল থেকে যেখানে সাগরের জলসীমার উচ্চতা বেড়েছে গড়ে ৩.২ মিলিমিটার, সেখানে ২০১৫-২০১৯ সময়সীমায় বেড়েছে ৫ মিলিমিটারের উপর (এবিসি নিউজ, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বারবার ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। দ্বীপাঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো আতঙ্কের মাঝে আছে। এ ক্ষেত্রে বড় রাষ্ট্রগুলোর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের যে দায়িত্ব পালন করার কথা, যুক্তরাষ্ট্র তা পালন করছে না। জাতিসংঘের ব্যর্থতা এখানেই যে, বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে জাতিসংঘ সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। সুতরাং ভয়টা এখানেই।
এ বিষয়ে কিশোরী গ্রেটা থানবার্গ যে সত্য উচ্চারণ করেছিলেন, তা কতটুকু আবেদন রাখতে পারবে? সম্প্রতি দি ইকোনমিস্টের একটি কভার স্টোরি ছিল ‘The climate issue’ (২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। এ প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে কীভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাময়িকীটি একটি তথ্য দিয়েছে। তাতে দেখা যায় কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দ্বিতীয়। ব্যক্তি পর্যায়ে এর পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রে ৫.৩ গিগাটন, মধ্যপ্রাচ্যে ২.৭ গিগাটন, ইউরোপে ৪.৯ গিগাটন, চীনে ৯.৮ গিগাটন, এশিয়া-প্যাসিফিকে ৫.১ গিগাটন, ভারতে ২.৫ গিগাটন ইত্যাদি (বিশ্বে গড় ৪.৬ গিগাটন, ২০১৭ সালের হিসাব)।
বিকল্প জ্বালানির অভাবে অথবা না থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বেশি মাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। দুঃখজনক হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটা উপলব্ধি করেন না। তাই তিনি যখন কপ-২১ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন, তখন বোঝা যায় তিনি বিষয়টিকে বিবেচনায় নেননি। অথচ বিকল্প জ্বালানি উৎপাদন, গবেষণা ইত্যাদির দিকে তিনি নজর দিতে পারতেন। এখন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা শিল্পোন্নত দেশগুলোর উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে যে ক্ষতি হবে, তা হয়তো তারা কাটিয়ে উঠতে পারবে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, সোলার বা বায়ু এনার্জির প্রসার ঘটিয়ে তারা এনার্জি চাহিদা পূরণ করতে পারবে।
কিন্তু বাংলাদেশসহ সাগর পারের দেশগুলো? অনেক দেশ এখন ঝুঁকির মধ্যে আছে। প্যারিস কপ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, উন্নত দেশগুলো পরিবেশ রক্ষায় উন্নয়নশীল, বিশ্ব বিশেষ করে সাগর পারের দেশগুলোকে সাহায্য করবে। কিন্তু তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি গত চার বছরেও। বলা ভালো, উন্নত বিশ্বের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিশ্ব জিডিপির ৭৫ শতাংশ, আর তারা কার্বন নিঃসরণ করে ৬৭.৬ শতাংশ।
এসব উন্নত দেশের কার্বন নিঃসরণের কারণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এটা মেনে নেয়া যায় না। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় দ্বীপাঞ্চলের মানুষ ঢাকায় আসতে বাধ্য হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে প্রতি সাতজনে একজন মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। বাংলাদেশ কোপেনহেগেন কপ সম্মেলনে (২০০৯) এসব উদ্বাস্তু মানুষকে Universal Natural Person হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছিল।
কিন্তু এ দাবি গ্রহণ করা হয়নি। বাংলাদেশ জাতিসংঘে এ দাবি আবারও উত্থাপন করেছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলায় যে বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে (২০১৯) যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে এ উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টিও। প্রধানমন্ত্রী এবার মাদ্রিদেও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ে তার উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ অর্থায়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দিলেও অভ্যন্তরীণভাবে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে কম। প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেককে তিনটি করে গাছ লাগানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগটা কম। বন অধিদফতরের কোনো উদ্যোগও আমার চোখে পড়ছে না। পরিবেশ মন্ত্রণালয় একটি সমন্বিত পরিকল্পনার আওতায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের একটি কাজে জড়িত হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারত। কিন্তু পরিবেশ কিংবা বন মন্ত্রণালয়, কারও কোনো উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গাছের কোনো বিকল্প নেই।
গাছ লাগানোর ব্যাপারে যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে, তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। নিউজিল্যান্ড সরকার ১০০ কোটি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করছে পরিবেশ রক্ষার জন্য (Educate Inspire Change, ১৯ আগস্ট ২০১৯)। দেশটি ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে চায়। এ জন্যই গাছ লাগানোর এ পরিকল্পনা। ফিলিপাইন নতুন একটি আইন প্রণয়ন করেছে, যেখানে একজন শিক্ষার্থী ১০টি গাছ না লাগালে তাকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি দেয়া যাবে না। ইতিমধ্যে আইনটি ফিলিপাইনের আইনসভায় পাসও হয়েছে (Insider, ২৯ মে ২০১৯)।
ভারতের দৃষ্টান্ত দেই। উষ্ণতা রোধকল্পে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে স্কুল শিক্ষার্থীসহ সবাই একদিনে ২২ কোটি গাছ লাগিয়েছে। অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশের মোট বাসিন্দা ২২ কোটি, সবাই একটি করে গাছ লাগিয়েছেন ১৪ লাখ ৩০ হাজার ৩৮১টি জায়গায়, যার মধ্যে আছে ৬০ হাজার গ্রাম, আর ৮৩ হাজার জঙ্গল চিহ্নিত এলাকা। এ তথ্যটি দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ (USA Today, ৯ আগস্ট ২০১৯)।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বৈঠকে উল্লেখ করেছিলেন, ‘Climate change is a security threat. We must act now’- অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তন একটি নিরাপত্তা ঝুঁকি। এখনই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শেখ হাসিনা সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘The time to act on climate changes in now. If anyone still doubts climate change,
even slightly, I invite you to visit Bangladesh. I am ready to walk with you to shwo hwo climate change silently impacts the lives of million’ (WEFORUM.ORG, 26 March 2019)।
প্রধানমন্ত্রীর এ কথার পেছনে সত্যতা আছে। সারা বিশ্ব আজ স্বীকার করে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। এখন মাদ্রিদ সম্মেলনে সামগ্রিকভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে সত্য; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অনাগ্রহের কারণে এক্ষেত্রে আদৌ কোনো সমাধানে আসা যাবে না। ‘কপ’ সম্মেলনের ব্যর্থতা এখানেই।
Daily Jugantor
07.12.2019

0 comments:

Post a Comment