রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ভারতের গণবিক্ষোভের চূড়ান্ত পরিণতি কী





ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস হওয়ার পর এই আইনের প্রতিবাদে ভারতের সর্বত্র যে গণবিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা কি শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদি সরকারের পতন ডেকে আনবে? ‘আরব বসন্ত’-এর মতো ভারতেও কি ‘ভারত বসন্ত’-এর একটি ক্ষেত্র তৈরি হতে যাচ্ছে? নাগরিক সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে শুধু পশ্চিমবঙ্গ প্রতিবাদী হয়েছে। সেই ‘চেনা-জানা’ মমতা ব্যানার্জি, সাধারণ একটি সুতির শাড়ি আর পায়ে চপ্পল পরে কর্মীদের নিয়ে কয়েক মাইল রাস্তা হেঁটে এই আইনের প্রতিবাদ জানালেন। মিছিলে তার সেই ছবি ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে তার বক্তব্য। সেখানে তিনি বলেছেন, নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন তালিকা (এনআরসি) বাস্তবায়ন করতে হলে তার মৃতদেহের ওপর দিয়ে তা করতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, যতদিন তিনি বেঁচে আছেন, পশ্চিমবঙ্গে তিনি নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি হতে দেবেন না। তিনি যখন এই আইনের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন, তখন হাজার হাজার মানুষ তার সঙ্গে পথে নেমেছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ কেন বলি? নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঢেউয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিসহ অন্তত ১০টি রাজ্যের ১৩টি শহর। আন্দোলন দমাতে পুলিশের গুলিতে কর্নাটকের মেঙ্গালুরুতে দুজন ও লক্ষেèŠতে একজন নিহত হয়েছেন। এছাড়া কারফিউ জারি করা হয়েছে মেঙ্গালুরুতে। আরও অবাক হওয়ার কথা মেঙ্গালুরুতে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে জমায়েত থেকে আটক হয়েছেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ। দিল্লিতে আটক হয়েছেন প্রখ্যাত সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি, বৃন্দা কারাট ও উমর খালেদের মতো নেতা। তবে বিক্ষোভ শািন্তপূর্ণ ছিল কলকাতা, চেন্নাই ও মুম্বাইয়ে। হাজার হাজার লোকের মিছিলে দাবি উঠেছে ‘আমরা কি সমান’? ‘আমরা কি ধর্মনিরপেক্ষ’? মিছিল থেকেই জবাব এসেছে, ‘হ্যাঁ’। ভারতের বিহারেও হিন্দু-মুসলমানরা একত্রিত হয়ে বিশাল মিছিল করেছে। গত ১১ ডিসেম্বর এই আইনটি কার্যকর হয়েছে। এর পর থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছে পুরো ভারত।

পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেলে মমতা ব্যানার্জির মতো নেতা বলতে পারেন ‘রাষ্ট্রপুঞ্জ গণভোট করাক ভারতে’। কত বড় কথা? মানুষ কোন পর্যায়ে গেলে এ ধরনের দাবি উত্থাপন করতে পারে? সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা (সিএএ) ভারতবর্ষে কার্যকর হবে কি না, সে ব্যাপারে জাতিসংঘকে একটি গণভোটের আয়োজন করার আহ্বান জানিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। যদিও জাতিসংঘ এটা পারে না এবং সংস্থাটির এই এখতিয়ারও নেই। তবুও মমতার এই দাবি প্রমাণ করে ভারতের বর্তমান সংকটের গভীরতা কত বেশি। মমতা ব্যানার্জির পাশাপাশি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা গ্রেগরি স্টানটন। তিনি বলেছেন, ‘ভারতে নিশ্চিতভাবেই গণহত্যার পূর্ব প্রস্তুতি চলছে। আসাম ও কাশ্মীরে যে নিপীড়ন চলছে, তা গণহত্যার ঠিক পূর্ববর্তী স্তর। এর পরের স্তরই হচ্ছে সম্পূর্ণরূপে নিধন, যাকে গণহত্যা বলা হয়।’ (দ্য উইক, ১৪ ডিসেম্বর)। তিনি ১২ ডিসেম্বরে ওয়াশিংটনে একটি অনুষ্ঠানে এ ধরনের মন্তব্য করেন। ড. স্টানটন একসময় যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন। তিনি বিখ্যাত তার  ‘Ten stages of Genocide’ তত্ত্বের জন্য (Sabrang, 14 December)। হয়ত অনেকেই ড. স্টানটনের সঙ্গে একমত হবেন না। ভারতে যা হচ্ছে, তাকে ‘গণহত্যা’ বলা যাবে কি না, তা বিতর্কের বিষয়।


তবে বলাবাহুল্য, ভারতে নরেন্দ্র মোদি একের পর এক যেমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তা তাকে শুধু বিতর্কিতই করেনি, বরং ভারতের ভাবমূর্তিও তাতে নষ্ট হচ্ছে। ভারতের সেন্টার ফর কনটেম্পোরারি সাউথ এশিয়ার পরিচালক আশুতোষ ভারশো ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে আন্তর্জাতিক ড়্গেত্রে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষণ্ন হবে।’ মিথ্যা বলেননি তিনি, ইতিমধ্যে মার্কিন সিনেটরদের কেউ কেউ যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা ভারতের গণতান্ত্রিক চর্চার সঙ্গে মানানসই নয়। গণতন্ত্রের নামে একদলীয় চিন্তাচেতনা সাধরণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। প্রসঙ্গক্রমে আমরা প্রণব মুখার্জির একটি মন্তব্য উল্লেখ করতে পারি। তিনি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি। তিনি ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। এখন তিনি অবসরে। ভারতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দেশটি যখন বড় ধরনের বিক্ষোভের মুখে পড়েছে, তখন গত ১৬ ডিসেম্বর নয়াদিল্লির ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের দপ্তরে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা মানে যা খুশি করা নয়। ভারতে নানা ধর্ম-বর্ণ সম্পªদায় রয়েছে। গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদের এই পরিবেশ যেন লিঙ্ঘত না হয়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’ স্পষ্টতই তার ইঙ্গিত কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের দিকে। তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা হচ্ছে– ভারতে সাম্পªতিক সময়গুলোতে যা হচ্ছে তা গণতন্ত্রের মূল স্পিরিটের পরিপন্থী। গণতন্ত্রে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার কথা শেখায়। গণতন্ত্র হচ্ছে অপরকে আস্থায় নেওয়া। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠরা শাসন করে বটে, কিন্তু এই শাসন নিশ্চিত হয় বিরোধী পক্ষকে আস্থায় নিয়েই। সারা বিশ্বের মানুষ ভারতের এই গণতান্ত্রিক চরিত্রকেই দেখে এসেছে গত প্রায় ৭২ বছর। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় জমানায় (২০১৯) এক ভিন্ন ভারতকে দেখছে বিশ্ব। সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামে উগ্র দলীয় চিন্তাচেতনা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার পরিপন্থী। সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এ কথাটাই বলতে চেয়েছেন।

ভারতের রাজনীতিতে প্রণব মুখার্জির স্থান অনেক উঁচুতে। ভারতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিতে তিনি জড়িত থাকলেও, সর্ব ভারতীয় মহলে তার একটি গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। অনেক শীর্ষ স্থানীয় বিজেপি নেতা তাকে সম্মানের চোখে দেখেন। সুতরাং ভারতের বর্তমান সংকটের সময় তিনি যখন এ ধরনের একটি কথা  বলেন, তা গুরুত্ব পায় বৈকি। সঙ্গত কারণেই তার এই বক্তব্যের পেছনে একটি ‘ইতিহাস’ রয়েছে– আর তা হচ্ছে বর্তমান ভারতের কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার খোদ ভারতের মৌলিক আদর্শকে বদলে দিতে চাচ্ছে! এর শুরুটা হয়েছিল প্রথমে আসাম থেকে। যখন আসামের নাগরিকপঞ্জির উদ্যোগ নেওয়া হলো, অর্থাৎ আসামে দীর্ঘদিন ধরে যারা শাসন করে আসছেন এবং যারা বাংলায় কথা বলেন, তারা আদৌ ভারতীয় নাগরিক কি না–তা যাচাইবাছাই করে দেখে একটা তালিকা তৈরি করা হয়; যারা ভারতের নাগরিক। এই তালিকায় যাদের নাম থাকবে না বা নেই, তাদেরকে ‘অবৈধ বসবাসকারী’ হিসেবে ঘোষণা করা। এখানে টার্গেট করা হয়েছে বাঙালি মুসলমানদের এবং বলা হচ্ছে এরা বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসে ‘অবৈধভাবে’ ভারতে বাস করছেন। ওই নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি বাংলাদেশে বড় ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একাধিকবার আশ্বাস দিয়েছেন এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আমরা নরেন্দ্র মোদির কথায় আস্থা রাখতে পারছি বলে মনে হচ্ছে না। আসামে এনআরসি নিয়ে বিতর্কের যখন অবসান হলো না, তখন দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি নিলেন মোদি সরকার কাশ্মীরের সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করে দিয়ে। সেখানে কেন্দ্রের শাসন এবং জম্মু ও কাশ্মীর থেকে লাদাখকে বের করে আলাদা কেন্দ্রের শাসনে পরিচালনা করা। ভারতের সংবিধানে ৩৭০ ধারা নামে একটা ধারা ছিল। এই ধারা বলে কাশ্মীরের অধিবাসীরা ভারতীয় কাঠামোয় বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন। ভারতের সংবিধান প্রণেতারা এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, বিভিন্ন জাতি-উপজাতি, ধর্ম ও বর্ণে বিভক্ত ভারতকে এক রাখতে হলে কোনো কোনো অঞ্চলকে ও জনগোষ্ঠীকে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। কাশ্মীরসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো এই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। এখন কাশ্মীর থেকে সেই সুযোগ-সুবিধা সংসদে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাতিল করা হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুসলমানরা। তারা সেখানে শুধু চাকরি হারানোর ঝুঁকিতেই নেই, রবং মুসলমানরা নিজ এলাকায় ‘দ্বিতীয় শ্রেণির’ নাগরিকে পরিণত হওয়ার একটা আশঙ্কার মাঝে আছেন। একই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতেও।


নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটি পাস হওয়ার পর যেভাবে সারা ভারত উত্তাল হয়ে উঠেছে এবং বিক্ষোভ এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ছে, তাকে কি আমরা ‘ভারত বসন্ত’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি? অর্থাৎ এই বিক্ষোভ কি শেষ পর্যন্ত এক দফা, অর্থাৎ মোদি সরকারের পতনের ডাকে সীমাবদ্ধ হবে? এটা ঠিক ‘আরব বসন্ত’-এর সঙ্গে বর্তমানে ভারতে যে গণবিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তা মেলানো যাবে না। ভারতে সরকার পরিবর্তিত হয় গণতান্ত্রিক পন্থায়। অর্থাৎ জনগণের ভোটে সরকারের পরিবর্তন হয়। কিন্তু ২০১১ সালে সারা আরব বিশ্বে যে গণঅভু¨ত্থানের সৃষ্টি হয়েছিল, যাকে ‘আরব বসন্ত’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, সেখানে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে স্বৈরাচারী সরকার উৎখাত ছিল মূল লক্ষ¨। একজন বেকার কম্পিউটার গ্র্যাজুয়েট বউকুজিজি নিজের শরীর আগুন লাগিয়ে যে প্রতিবাদ করেছিলেন, তা পরিণামে তিউনেসিয়ায় বেন আলী, মিসরে হোসনি মোবারক, ইয়েমেনে আবদুল্লাহ সালেহর পতন ডেকে এনেছিল।

আরব দেশগুলোর রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসেরও মিল পাওয়া যাবে না। তবে, একটা মিল আছে– আর তা হচ্ছে জনঅস‡ন্তাষ। এই জনঅসন্তোষ আরব দেশগুলোতে ছিল, এখন ভারতেও এই অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। অর্থনীতিতে বড় ধরনের মন্দার  মুখে পড়তে যাচ্ছে ভারত। দেশটির প্রাক্তন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামানিয়ান সম্পªতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত একটি সেমিনারে বলেছেন, যে মন্দার মুখ দেখছে ভারত, তা কোনো সাধারণ মন্দা নয়। এটা হলো ভারতের অন্যতম বৃহৎ আকারের অর্থনৈতিক মন্দা। ভারতের অর্থনীতি এখন আইসিইউর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে (ie bangla, ১৮ ডিসেম্বর)। একজন বড় অর্থনীতিবিদ যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন এটাকে হালকাভাবে নেওয়া যায় না। ভারতের এই গণবিক্ষোভ শেষ পর্যন্ত মোদি সরকারের ওপর কতটুকু চাপ প্রয়োগ করতে পারবে, বলা মুশকিল। তবে তার সরকার যে খুব একটা স্বস্তিতে নেই, তা বলাই বাহুল্য।
Daily Desh Rupantor
21.12.2019

0 comments:

Post a Comment