স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে গুলজারিলাল নন্দ দু’বার (২৭ মে-৯ জুন ১৯৬৪ এবং ১১ জানুয়ারি-২৪ জানুয়ারি ১৯৬৬) অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আর ভিপি সিংয়ের শাসনামল ছিল ৩৪৩ দিনের। তিনিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে হেরে গিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। অন্যদিকে বিজেপির অটল বিহারি বাজপেয়ীর প্রথম টার্ম ছিল মাত্র ১৬ দিনের। কিন্তু দ্বিতীয়বার তিনি দীর্ঘ ৬ বছর ৬৪ দিন ক্ষমতায় ছিলেন (১৯ মার্চ ১৯৯৮-২২ মে ২০০৪)। ভারতের দীর্ঘ ৭২ বছরের রাজনীতিতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৭, ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ এবং ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস দেশটি শাসন করেছে। ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীর পতনের মধ্য দিয়ে জনতা দল ক্ষমতাসীন হয়েছিল। কিন্তু জনতা দল একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায় এবং এর মধ্য দিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) অন্যতম শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। মোরারজি দেশাই ছিলেন প্রথম জনতা দলের প্রধানমন্ত্রী। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ২ বছর ১১৬ দিন (২৪ মার্চ ১৯৭৭-২৮ জুলাই ১৯৭৯)। তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। দেশাই পদত্যাগ করলে চরণ সিং প্রধানমন্ত্রী হন (১৭০ দিন)। তিন ছিলেন জনতা পার্টির নেতা (পরবর্তী সময়ে লোকদল গঠন করেন)। জনতা দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব পুনরায় কংগ্রেস তথা ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে। আততায়ীর হাতে রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর (১৯৮৯) পুনরায় জনতা দল ক্ষমতাসীন হয়। দলটি একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ক্ষমতাসীন হয়। ভিপি সিং (জনতা দল), চন্দ্রশেখর (সমাজবাদী জনতা দল), দেবগৌড়া (জনতা দল-সেকুলার), আইকে গুজরাল (জনতা দল)- সবাই যথাক্রমে ৩৪৩ দিন, ২২৩ দিন, ৩২৪ দিন ও ৩৩২ দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। প্রকৃত অর্থেই বিজেপির উত্থান ঘটে অটল বিহারি বাজপেয়ীর আমলে (১৯ মার্চ ১৯৯৮-২২ মার্চ ২০০৪)। সেই রাজনীতির ধারাবাহিকতায় মোদি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০১৪ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন। অটল বিহারি বাজপেয়ীর পর অবশ্য ড. মনমোহন সিং দীর্ঘ ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন।
এখন কতদূর যেতে পারবেন নরেন্দ্র মোদি? নির্বাচনের আগে তিনি ‘সাম্প্রদায়িক কার্ড’ ব্যবহার করেছেন। প্রচণ্ড মুসলমান বিদ্বেষকে পুঁজি করে তিনি যেতে চেয়েছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের কাছে। তাতে তিনি সফল হয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই রাজনীতি নিয়েই কি তিনি এগিয়ে যাবেন? নাকি একটি ‘লো-প্রোফাইল’ অবস্থান গ্রহণ করবেন? গত ২৫ মে তার এক বক্তব্য একটি আশার খোরাক জুগিয়েছে। সংসদের সেন্ট্রাল হলে পা রাখার ঠিক আগে ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখা সংবিধানের ওপর মাথা রেখে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস।’ ‘সবকা বিশ্বাস’ এটা নতুন মন্ত্র। এই বিশ্বাসটা মুসলমানদের। তিনি বলেছেন, ‘সংবিধানকে সাক্ষী রেখে আমরা প্রতিজ্ঞা করছি যে, সব বর্গের মানুষকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে হবে। ধর্ম-জাতির ভিত্তিতে কোনো ভেদাভেদ হবে না।’ (আনন্দবাজার, ২৬ মে)। তার এ বক্তব্যে মানুষ খুশি হবে। বিশেষ করে মুসলমানদের মাঝে যে ভয় জেগে গেছে, এ বক্তব্য তাদের হয়তো আশার বাণী শোনাবে। আবার এটাও সত্য, নির্বাচনের আগে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিয়ে একটা মুসলমান বিদ্বেষের ঢেউ তিন সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এটা এখন তিনি কীভাবে কমাবেন? বিষয়টি অত সহজ নয়। তবে ভারত বড় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হলেও সমাজে নানা সংকট রয়েছে। সমাজে জাত-পাতের বিভেদ অনেক বেশি। নিজে কৈশোরে চা বিক্রি করে এবং মা পরের বাড়িতে ঝি’র কাজ করে (টাইম ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, ৭ মে ২০১৫) যাদের সংসার চলত, সেই মোদি এখন কর্পোরেট জগতের বাসিন্দা। যখন বিদেশে যান, তখন সঙ্গে নিয়ে যান কর্পোরেট জগতের প্রতিনিধিদের। কিন্তু ভারতের জনগোষ্ঠীর ৩৭ শতাংশ মানুষ এখনও গরিব। ৫৩ শতাংশের কোনো টয়লেট নেই, যারা প্রকাশ্যেই এ ‘কাজটি’ নিত্য সমাধান করেন। পরিসংখ্যান বলে, বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ গরিব মানুষের বাস ভারতে, যাদের দৈনিক আয় বিশ্বব্যাংক নির্ধারিত ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে। প্রায় ৯ বছর আগে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে (৮ সেপ্টেম্বর ২০১০) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, প্রতিদিন ভারতে ৫ হাজার শিশু মারা যায় ক্ষুধা ও অপুষ্টির কারণে। ২০১৯ সালে এসে এতে খুব যে একটা পরিবর্তন এসেছে তা বলা যাবে না। শুধু দরিদ্রতা কেন বলি, প্রায় ৮০ কোটি লোকের দৈনিক আয় ২ দশমিক ৫০ ডলার। ৭০ শতাংশ লোক গ্রামে বসবাস করে। নারী-পুরুষের পার্থক্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেখানে অবস্থান (জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র ১৮৬টি হিসাব করে) ১৪৬, সেখানে ভারতের ১৩৬। নারী নির্যাতন আর নারী ধর্ষণের ঘটনা বন্ধ হয়নি (পাঠক, উত্তর প্রদেশের বুন্দেলখণ্ডের গ্রামের সত্য কাহিনী নিয়ে তৈরি সিনেমা ‘গুলাব গ্যাং’-এর কথা স্মরণ করতে পারেন)।
সড়ক, মহাসড়ক নির্মাণ করে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব একটি অর্থনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চাচ্ছেন মোদি। কিন্তু তাতে একদিকে যেমন দরিদ্রতা দূর হয়নি, অন্যদিকে তেমনি ব্যবসাবান্ধব একটি পরিবেশও তিনি তৈরি করতে পারেননি গত ৫ বছরে। IMD World Competitiveness Ranking 2019-এর তালিকায় ভারতের অবস্থান এখন ৪৩ (প্রথম সিঙ্গাপুর, দ্বিতীয় হংকং, তৃতীয় যুক্তরাষ্ট্র)। ভারতের এ অবস্থান মালয়েশিয়া (২২তম) ও ব্রিটেনেরও (২৩তম) পরে। তিনি কাজপাগল মানুষ (মাত্র ৩ ঘণ্টা ঘুমান- একথা স্বীকার করেছেন টাইম প্রতিবেদকের কাছে)। কিন্তু ভারতের বড় যে সমস্যা দরিদ্রতা, অসমতা, তা তিনি দূর করতে পারেননি। গত ৫ বছরে মোদি ৫৯টি দেশ সফর করলেও নিজ দেশের সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছেন খুব কম। পরিসংখ্যান বলছে, ২ দশমিক ৮৪৮ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ভারতের। কিন্তু বেকার সমস্যা সেখানে প্রবল। কর্মজীবী মানুষের (যাদের বয়স ১৫-এর ওপরে) মাঝে ৫০ শতাংশের কোনো চাকরি নেই। ৬৫ শতাংশ মানুষের বয়স ৩৫-এর নিচে। এদের চাকরি দরকার। বেকারত্বের হার ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ, এখন তা দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিমাসে ১২ লাখ তরুণের জন্য কাজ দরকার। বিষয়টি নরেন্দ্র মোদির জন্য যে খুব সহজ, তা বলা যাবে না।
তার দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে কৃষককে আস্থায় নেয়া। সাম্প্রতিকালে ভারতে সবচেয়ে বড় কৃষক আন্দোলন হয়েছে। কৃষককে সংগঠিত করে বাম সংগঠগুলো নয়াদিল্লিতে পর্যন্ত দীর্ঘ লংমার্চ করেছে। ঋণের ভারে কৃষক পর্যুদস্ত। তারা ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন। এ রকম ঘটনা একটি নয়, একাধিক। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী (৩ মে ২০১৭) বছরে ১২ হাজার কৃষক আত্মহত্যা করে। সুপ্রিমকোর্টে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে কৃষকের আত্মহত্যার বিষয়টি যে কোনো সরকারের জন্যই একটি বিব্রতকর অবস্থা। মোদি সরকার তাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল প্রতিটি কৃষক পরিবারকে ৬ হাজার রুপি করে দেয়ার। আর কংগ্রেসের প্রস্তাব ছিল অতি গরিব মানুষকে (২০ শতাংশ) বছরে ৭২ হাজার টাকা করে দেয়া। নয়া সরকারের জন্য এটি হবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
ব্যাপক শিল্পায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারতে বড় ধরনের পানি সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর ২ লাখ মানুষ সুপেয় পানির অভাবে মারা যায়। ২০২০ সালের মধ্যে ২১টি বড় শহরে পানি সংকট দেখা দেবে। ৭৫ শতাংশ মানুষ নিজ বাড়িতে সুপেয় পানি পায় না। আর ৭০ শতাংশ পানি দূষিত। সুচিকিৎসা ভারতের জন্য একটি বড় সমস্যা। National Health Profile 2018-এ দেখা যায়, ভারতের নাগরিকদের জন্য স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হয় জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে ধনী রাষ্ট্রগুলো ব্যয় করে ৫ দশমিক ১ শতাংশ। এমনকি নিুআয়ের দেশগুলোও ব্যয় করে প্রায় ২ শতাংশ। মোদি সরকারের আরেকটি চ্যালেঞ্জ- কী করে নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়। এজন্য বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার Ayushman Bharat প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যাতে করে একটি স্কিমের আওতায় নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হবে। কিন্তু এতে কতটুকু সফলতা পাওয়া যাবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। শিক্ষা নয়া সরকারের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ। বিপুলসংখ্যক তরুণ প্রতিবছর ‘জব মার্কেটে’ প্রবেশ করছে। কিন্তু তারা সুশিক্ষিত নয়। অথবা বলা যেতে পারে তাদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়নি।
সুতরাং মোদির জন্য রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জ। দারিদ্র্যদূরীকরণ, মুসলমানদের আস্থায় নেয়া, একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, নারী-পুরুষ বৈষম্য কমানো- এ কাজগুলো সহজ নয়। তথাকথিত নগরপুঞ্জির নাম করে মুলমানদের ‘অবৈধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করা দু’দেশের সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে না। বাংলাদেশে উগ্র ধর্মান্ধগোষ্ঠী এটা থেকে ‘ফায়দা’ ওঠাতে চাইবে। রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে মোদি নির্বাচনে সুবিধা নিয়েছেন। এখন তাকে হতে হবে বাস্তববাদী। তিনি বলেছেন বটে ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’; তবে এ বক্তব্য যদি তিনি ধারণা করেন এখন, তবেই তিনি সফল হবেন। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে, সবার উন্নতি এবং সবার বিশ্বাস নিশ্চিত করাই তার মূল মন্ত্র। আগামী ৫ বছর তিনি যদি এটি নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে ইতিহাসের খাতায় এক অবিসংবাদিত নেতা হয়ে থাকবেন। এখন দেখার পালা তার কথা ও কাজে কতটুকু মিল থাকে।
Daily Jugantor
31.05.2019