সাম্প্রতিক সময়ে চীনের একটি ভূমিকা কোনো কোনো আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকের কাছে বেশ কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। চীনের এই ভূমিকাটি হচ্ছে বিরোধ মেটানো বা বিরোধ নিষ্পত্তি। অর্থাৎ দুটি দেশ কিংবা দুটি বিবদমান গোষ্ঠীর মাঝে বিবাদ ও দ্বন্দ্বের মীমাংসা করার জন্য একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এই ঈড়হভষরপঃ জবংড়ষঁঃরড়হ-এর বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। একটি রাষ্ট্র ঈড়হভষরপঃ জবংড়ষঁঃরড়হ এবং সেই সঙ্গে আরও বেশ কিছু বিষয়ে (যেমন : বিশ^ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, গণতন্ত্র বিনির্মাণ, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, বৈষম্য হ্রাস ইত্যাদি) কতটুকু সক্ষমতা অর্জন করেছে, তা বিবেচনায় নিয়েই বিশ^ নেতৃত্বে তার মানদ- বিচার করা হয়। বিশ^ নেতৃত্বের শীর্ষে সেই দেশটি থাকবে, যদি দেশটি ঈড়হভষরপঃ জবংড়ষঁঃরড়হ-এর ক্ষেত্রেও একটা ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ বিশে^ নেতৃত্ব দেওয়ার একটি ভূমিকা রাখা।
একসময় বিশ^ দুধারায় বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, আমরা যাকে বলি স্নায়ুযুদ্ধÑ একদিকে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। আদর্শগতভাবে বিভক্ত ছিল শিবির দুটো। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিম ইউরোপে পুঁজিবাদ তথা পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র বিকশিত হয়েছিল। অন্যদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্র বিকশিত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ভিত্তি ও সামরিক সক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রকে যেমনি বিশ^ শক্তিতে পরিণত করেছিল, ঠিক তেমনি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক শক্তি দেশটিকেও বিশ^ আসরে অন্যতম শক্তি হিসেবে পরিণত করেছিল। তখন ‘শক্তির’ বিচারের ক্ষেত্রে যেমন ‘প্যারাডাইম’ ব্যবহৃত হতো, তাতে পরিবর্তন এসেছে। আয়তনে একটি ছোট্ট দেশও ‘শক্তি’ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে এবং বিরোধ নিষ্পত্তিতে একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু চীনের অবস্থানটা ভিন্ন। চীন অর্থনৈতিক শক্তি তো বটেই, একই সঙ্গে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম সামরিক শক্তিও বটে। চীনের ভূমিকা বাড়ছে। আফ্রিকাতে চীনের ভূমিকা ব্যাপক। এটা বিবেচনায় নিয়েই চীন এখন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় আবির্ভূত হচ্ছে। অবশ্য যেখানে চীনের স্বার্থ বেশি, সেখানেই চীন এই কাজটি করছে।
আফগান সংকটের যখন কোনো সমাধান হচ্ছিল না এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানদের ‘সংলাপ’ ও যখন সমাধানের কোনো পথ বাতলে দিচ্ছিল না, তখন চীন এগিয়ে আসে এ সমস্যার সমাধানে। পাকিস্তানি সংবাদপত্র ‘ডন’-এ প্রকাশিত এক সংবাদ (জুন ২০, ২০১৯) থেকে জানা যায়, চীন সম্প্রতি কাতারে নিযুক্ত তালেবানদের ‘রাষ্ট্রদূত’ আবদুল গনি বারাদারকে পেইচিংয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। চীন এটা স্পষ্ট করেছে, আফগান সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ওপর। অর্থাৎ বিবদমান গ্রুপগুলো নিজেরাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। এ ক্ষেত্রে চীন প্রয়োজনে এক ধরনের মধ্যস্থতা করতে পারে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বক্তব্যে এটা ফুটে উঠেছে। এটা বিবেচনায় নিয়েই চীন আবদুল গনি বারাদারকে পেইচিংয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। চীনের এই ভূমিকা নতুন। অতীতে চীনকে এ ধরনের ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি।
Image :rushhour daily |
বরং চীন ব্যস্ত থেকেছে নিজ দেশে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে, পরে অর্থনৈতিক সংস্কারে। চীন তার বিশাল জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে বিশে^র দ্বিতীয় বড় অর্থনৈতিক শক্তি। সাধারণ নিয়মে জাতীয় আয়ের পরিমাণ ১১,৩৯১ দশমিক ৬২ মিলিয়ন ডলার (যুক্তরাষ্ট্রের ১৮,৫৬১ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন ডলার)। আবার ক্রয়ক্ষমতার (পিপিপি) ভিত্তিতে চীনের অবস্থান প্রথমÑ ২১,২৬৯ দশমিক ০২ মিলিয়ন ডলার (আইএমএফ)। একই সঙ্গে চীনের রিজার্ভের পরিমাণ ৩,৪০৫ মিলিয়ন ডলার। চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার যদি বজায় থাকে, তাহলে চীন আগামী কয়েক বছরের মধ্যে জাতীয় উৎপাদনের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমপর্যায়ে এসে যাবে। অস্ট্রেলিয়ার খড়ুি ওহংঃরঃঁঃব আটটি মানদ-কে সামনে রেখে বিশে^র ক্ষমতা বিন্যাসকে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছে, তাতে চীনের অবস্থান দ্বিতীয়, প্রথম যুক্তরাষ্ট্র। চীনের এই ‘শক্তি’ (সামরিক ও অর্থনৈতিক) চীনকে এখন বড় ধরনের ‘প্রভাব’ ফেলতে সাহায্য করছে। খুব সংগত কারণেই আফগানিস্তানের সমস্যার সমাধানে চীন একটি ভূমিকা রাখতে চায়।
সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা সমস্যাটি বহুল আলোচিত। চীন তার জাতীয় স্বার্থের কারণেই এত দিন পর্যন্ত মিয়ানমারকে সমর্থন করে আসছে। কিন্তু সারা বিশ^ এখন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চায়। চীনের উপলব্ধিতে এটা এখন এসেছে। একটি বিশ^শক্তি হিসেবে চীন বিশ^ জনমতের বাইরে যেতে পারে না। তাই প্রধানমন্ত্রী যখন জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে চীনে তার রাষ্ট্রীয় সফর শুরু করবেন, তখন একটা সুযোগ তৈরি হবে চীনকে তার মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা গ্রহণ করার। বিশে^র কাছে এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে, মিয়ানমার নানাভাবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো থাকলেও, চীন শুধু ব্যবসায়িক ও তার নিজস্ব স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করেছে। বাংলাদেশের পাশে সেভাবে চীন দাঁড়ায়নি।
প্রধানমন্ত্রীর এই সফর বাংলাদেশের জন্য একটা সম্ভাবনা তৈরি করবে চীনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের এটা বোঝাতে যে, চীন যদি মিয়ানমারের ওপর কিছুটা হলেও চাপ প্রয়োগ করে এ সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী না হয়, তাহলে তা চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। প্রকারান্তরে চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর যে মহাপরিকল্পনা, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও
নানা সংকট তৈরি করবে। চীন ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম শক্তি। এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে চীনের একটি বড় ভূমিকা আছে। বাংলাদেশ চায় চীন তার এই ভূমিকাটা পালন করুক। মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘকাল তাদের আশ্রয় দিতে পারে না। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মিয়ানমার তার নাগরিকদের ফেরত নিতে বাধ্য। শুধু তা-ই নয়। অতি সম্প্রতি ওআইসির ১৪তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। সেখানে রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান সমর্থন করা হয়েছে। ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আবুধাবি সম্মেলনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা করারও একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। অতীতে এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, বিশেষ করে কেনিয়ার গণহত্যা কিংবা হুতু-তুতসি গণহত্যাকারীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার হয়েছে।
বাংলাদেশ এই প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা গণহত্যাকারীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের কথা বলেছে। প্রধানমন্ত্রীর এই চীন সফরে বাংলাদেশের জন্য একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে চীনের নেতাদের বোঝানো যে, রোহিঙ্গা সমস্যা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে মিয়ানমারের নেতাদের বিচারের দাবি আরও শক্তিশালী হবে। বাংলাদেশের তখন করার কিছু থাকবে না। একমাত্র চীনই পারে মিয়ানমারকে বোঝাতে। দ্বিতীয়ত, চীনের একটি মহাপরিকল্পনা হচ্ছে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি। এই মহাপরিকল্পনার একটি অংশ হচ্ছে বিসিআইএম করিডর। অর্থাৎ বাংলাদেশ-চীনের ইউনান প্রদেশ-ভারতের পূর্বাঞ্চল ও মিয়ানমারকে নিয়ে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল। ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এ যে ছয়টি অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে, তার মধ্যে বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডরের গুরুত্ব অনেক। ভারতের জন্যও এই রুটের গুরুত্ব রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যখন ২০১৪ সালে চীন গিয়েছিলেন, তখন খুনমিংয়ে তিনি এই বিসিআইএম করিডরের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।
Image: Abhinav Bhargava |
এই রুটের গুরুত্ব এ কারণে যে, আসিয়ান-এ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তখন খুনমিং-কক্সবাজার সড়কপথ যদি চালু হয়, তাহলে সড়কপথে আমরা আমাদের পণ্য নিয়ে আসিয়ান বাজারে প্রবেশ করতে পারব। এই জোটের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা, এই ৪টি দেশের রয়েছে বিপুল তেল ও গ্যাসসম্পদ (মিয়ানমার), রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি (চীন ও ভারত), রয়েছে শিল্প (চীন), শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টরও রয়েছে। রয়েছে বিশাল অব্যবহৃত জমি (মিয়ানমার) এবং রয়েছে সমুদ্রবন্দর (মিয়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত)। এই চারটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কিনা বিশ^ জিডিপির ১০ ভাগ। ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা আর ৪৪০ মিলিয়ন মানুষের বাস এই বিসিআইএম জোটভুক্ত দেশগুলোতে। পূর্বে রয়েছে কুনমিং আর পশ্চিমে কলকাতা। মাঝখানে মান্দালয় ও ঢাকা।
Image: The Hindu |
চীনের স্বার্থ রয়েছে এই জোটের ব্যাপারে। কারণ যদি খুনমিং-কক্সবাজার মহাসড়কটি হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সোনাদিয়ায় যদি একটি সমুদ্রবন্দর হয়, তাহলে চীন সড়কপথ ব্যবহার করে ইউনান প্রদেশে উৎপাদিত পণ্য এই বন্দর দিয়ে বিদেশে রফতানি করতে পারবে। যদিও সোনাদিয়ায় যে গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হওয়ার কথা ছিল, তা ভারতের আপত্তির কারণে বাতিল হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও চীন যদি ভারতকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, প্রস্তাবিত এই সমুদ্রবন্দরটি দিয়ে ভারতও তার পণ্য রপ্তানি-আমদানি করতে পারবে, তাহলে আগামীতে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণ সম্ভব। এ ক্ষেত্রে চীনকেই এগিয়ে আসতে হবে। ভারতকে আশ^স্ত করতে হবে যে, এই সমুদ্রবন্দর ভারতের জন্য কোনো নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করবে না। এমনকি বাংলাদেশ, চীন ও ভারতের ত্রিদেশীয় উদ্যোগে এই বন্দরের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়াও সম্ভব। যতদূর জানি, চীনের এ ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। চীন ভারতের কোম্পানির সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এখন বাংলাদেশ এক ধরনের দূতিয়ালি করতে পারে।
বাংলাদেশের যেমন প্রয়োজন রয়েছে চীনকে, ঠিক তেমনি চীনেরও প্রয়োজন রয়েছে বাংলাদেশকে। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে অনেকগুলো সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে আমাদের জন্য।
দেশরূপান্তর
১ জুলাই, ২০১৯
লেখক
তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক