রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ইতিহাস কিভাবে স্মরণ করবে মোহামেদ মুরসিকে

মোহামেদ মুরসির মৃত্যুর পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে ইতিহাস এখন কিভাবে স্মরণ করবে তাঁকে? মিসরের সমসাময়িককালের ইতিহাসে তিনি ছিলেন প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। আরব বসন্ত পরবর্তী সময়ে মিসরে ২০১২ সালে তিনি জনগণের ভোটে প্রথমবারের মতো সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মধ্যে ২০১৩ সালের ৩ জুলাই তিনি সামরিক অভ্যুত্থানে উত্খাত হন। তাঁর বিচার চলছিল এবং বিচার চলাকালে তিনি আদালতেই কাঠগড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি অধ্যায়ের অবসান হলো। কিন্তু ইতিহাস তাঁকে কিভাবে স্মরণ করবে? একজন ইসলামপন্থী নেতা, যিনি মিসরকে ইসলামিক ধারায় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন? নাকি একজন ‘গণতন্ত্রী’, যিনি মিসরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক একজন সিনিয়র সাংবাদিক রবার্ট ফিসক (Robert Fisk) ইংল্যান্ডের দৈনিক ‘ইনডিপেনডেন্ট’-এ লিখেছেন, মুরসির সঙ্গে সঙ্গে মিসরের গণতন্ত্রেরও মৃত্যু হয়েছে বন্দিদের খাঁচায়। গণতন্ত্রের মৃত্যু। মিথ্যা বলেননি রবার্ট ফিসক। তিনি আরো লিখেছেন, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
ড. মুরসি অসুস্থ ছিলেন। দীর্ঘ পাঁচ বছরের অধিক সময়ে তিনি নির্জন প্রকোষ্ঠে দিন কাটিয়েছেন। একজন প্রেসিডেন্টের জন্য যে সম্মান পাওয়ার কথা, তা তিনি পাননি। উপরন্তু ‘খাঁচার মধ্যে’ রেখে তাঁর কথাকথিত বিচার চলছিল। দুঃখজনক হচ্ছে, হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে খাঁচার মেঝেতে তিনি ২০ মিনিট পড়ে থাকলেন। কোনো ডাক্তার এলেন না। তাঁকে কেউ হাসপাতালে নিয়ে গেল না! কোনো ধরনের চিকিৎসাসেবা ছাড়াই তিনি চলে গেলেন পরপারে! এটা তো এক ধরনের হত্যাই। এ ধরনের মৃত্যুর নিন্দা জানিয়েছেন অনেকেই—জাতিসংঘ মুরসিকে হত্যার অভিযোগে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছে। শোক জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা। তুরস্ক বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। মুরসির মৃত্যুতে বিভিন্ন মুসলিম দেশ শোক ও প্রতিবাদ জানালেও ব্যতিক্রম আরববিশ্ব। কাতার বাদে আরববিশ্বের কোনো নেতার শোকবাণী পাওয়া যায়নি।
মিসরে হোসনি মুবারকের স্বৈরতান্ত্রিকতা যখন জনগণের ওপর চেপে বসেছিল, তখনই উদ্ভব ঘটেছিল মোহামেদ মুরসির। প্রকৃত ধর্মীয় নেতা বলতে যা বোঝায় কিংবা পশ্চিমের দৃষ্টিতে যেটাকে ইসলামী মৌলবাদী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করার একটি প্রয়াস লক্ষ করা যায়, মুরসি ঠিক তেমনটি ছিলেন না। মুরসি প্রথমবারের মতো নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে মিসরের পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০০০ সালে। তিনি ইসলামিক ব্রাদারহুডে যোগদান করেন ২০০৫ সালে। তবে দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর আত্মপ্রকাশ করে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে মিসরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির প্রথম পছন্দ ছিল খায়রত আল শাতের। কিন্তু অতীতে তাঁর অপরাধমূলক কাজে যুক্ত থাকার প্রমাণ থাকায় তিনি মুরসি থেকে পিছিয়ে পড়েন। বলতে গেলে অনেকটা ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় পদটি পেয়ে যান মুরসি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রায় ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ২০১২ সালের ৩০ জুন মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন মুরসি। কিন্তু তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০১২ সালের ২২ নভেম্বর একটি ডিক্রি জারি করেছিলেন। তাতে তিনি প্রেসিডেন্টের হাতে সব ক্ষমতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। এমনকি বিচার বিভাগের কাছেও জবাবদিহি করতে প্রেসিডেন্ট বাধ্য থাকবেন না—এ ধরনের কথাও ছিল ওই ডিক্রিতে। আদালতের ক্ষমতা খর্ব করার পাশাপাশি ক্ষমতায় আসার পর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে নানা দিক থেকে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন মুরসি। এর পেছনে কারণ হিসেবে দেখা হয়েছিল যে তিনি মিসরের রাজনীতিতে প্রবেশে মুসলিম ব্রাদারহুডের আশ্রয় নিয়েছিলেন।
গণতান্ত্রিকভাবে মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও কিছু কিছু ‘ভুল’ তিনি করেছিলেন। তিনি অতি দ্রুত ইসলামীকরণের দিকে গিয়েছিলেন। মিসরে নারীরা তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনে বড় ভূমিকা পালন করলেও বাকিদের ব্যাপারে মুরসি অতটা ‘উদার’ ছিলেন না। মিসরের নারীরা যথেষ্ট স্বাধীন এবং পশ্চিমের দৃষ্টিতে তারা আধুনিকমনস্ক। পূর্ণ পর্দাপ্রথা তারা অনুসরণ না করলেও, শালীনতা তারা বজায় রেখে চলে। মুরসি এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি মিসরে হিজাবকে বাধ্যতামূলক করেছিলেন। এতে নারীদের মধ্যে ভিন্ন একটা মেসেজ পৌঁছে গিয়েছিল। সেনাবাহিনীর ক্ষমতাকে তিনি ‘আন্ডারএস্টিমেট’ করেছিলেন। অর্থাৎ সেনাবাহিনী যে একটি ‘শক্তি’, তা তিনি বিবেচনায় নেননি। মিসরের ২১০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির ১০ থেকে ১৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী। তেল, দুধ, বেকারি, সুপেয় পানি, সিমেন্ট, গ্যাসোলিন, রিসোর্ট ও যানবাহন উৎপাদন শিল্পের সঙ্গে সেনাবাহিনী জড়িত। কোনো সরকারের পক্ষেই সেনাবাহিনীর এই ‘ক্ষমতাকে’ অস্বীকার করা সম্ভব না। মুরসি এটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
মিসরে সেনাবাহিনী বরাবরই একটি ‘রাজনৈতিক ভূমিকা’ পালন করে গেছে। ১৯৫২ সালে প্রথমবারের মতো সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মুবারকের পতন পর্যন্ত সেনাবাহিনী রাজনৈতিক দল গঠন করে (লিবারেশন র‌্যালি, ন্যাশনাল ইউনিয়ন, আরব সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি) ক্ষমতা ধরে রেখেছে। এ কারণে দেখা যায় মিসরে কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়নি। ফলে সেনাবাহিনীই মূল শক্তি হিসেবে থেকে গেছে। হোসনি মুবারক ক্ষমতা থেকে উত্খাতের পর সীমিত সময়ের জন্য সেনাবাহিনী ‘ব্যাকসাইডে’ চলে গিয়েছিল। সেনাবাহিনী কিছুটা সময় নিয়েছিল নিজেদের সংগঠিত করতে। শেষ পর্যন্ত জেনারেল আবদেল ফাতাহ আল সিসির নেতৃত্বেই তারা সংগঠিত হয়ে আবার ক্ষমতায় এসেছে। ইতিহাস বলে মিসরের ফারাওরা (অর্থাৎ শাসক, বাদশাহ, রাজা) যেভাবে সব ক্ষমতা নিজেদের হাতে করায়ত্ত করে রেখেছিলেন, আজকের যুগে মিসরের সেনাবাহিনী সেই ভূমিকাই পালন করে যাচ্ছে। মাঝখানে পাঁচ হাজার বছর চলে গেলেও মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। মুরসির আরেকটি সমস্যা ছিল, তিনি ইসলামপন্থীদের এক কাতারে নিয়ে আসতে পারেননি। আল নুর নামে একটি ইসলামিক সংগঠন রয়েছে মিসরে, যারা যথেষ্ট শক্তিশালী। পশ্চিমা বিশ্বে তাদের সালাফিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অর্থাৎ এরা আদি ইসলামী সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাসী। এদের সঙ্গে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিকভাবে পার্থক্য রয়েছে। ব্রাদারহুড যেভাবে মিসরে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়, আল নুর সেভাবে চায় না। আল নুর বেশ কনজারভেটিভ। সে তুলনায় ব্রাদারহুড অনেকটা লিবারেল। আরব বসন্ত পরবর্তী সময়ে মিসরে মাত্র দুই বছর আগে সংগঠনটির জন্ম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সামরিক বাহিনী যখন মিসরে ক্ষমতা দখল করল, তখন আল নুর পার্টি মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন না করে সমর্থন করেছিল জেনারেল সিসিকে। এতে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আল নুর রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চেয়েছিল।
আরব বসন্ত সময়কালে মিসরের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। মিসরে হোসনি মুবারকের দীর্ঘ শাসনামলে (১৯৮১-২০১১) অন্যায় ও অবিচারকে কেন্দ্র করে কায়রোর তাহরির স্কয়ারে যে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছিল (২৫ জানুয়ারি-১১ ফেব্রুয়ারি ২০১১), যা কিনা কোনো কোনো বিশ্লেষক Facebook Revolution হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন একটা সমর্থন ছিল। ফেসবুকের মাধ্যমে সেখানে ‘বিপ্লব’ সংঘটিত হয়েছিল বিধায় তাহরির স্কয়ারের ওই বিপ্লবকে Facebook Revolution হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। যাঁরা এই বিপ্লবকে সংগঠিত করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ ওয়াশিংটনে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। বিশেষ করে Kabaya Movement কিংবা April 6 Movement-কে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা থেকে সাহায্য ও সহযোগিতা দেওয়া হয়েছিল। ওয়াশিংটনভিত্তিক Carnegie Endowment, RAND কিংবা National Endowment for Democracy-এর মতো গবেষণা সংস্থাগুলো মিসরের এই ধরনের সংস্থাকে আর্থিক সহযোগিতাও করেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস ২০১১ সালের ১৪ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।
 (US Groups Helped Nurture and Uprising by Ron Nixon)। তাতে এই সাহায্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল।
এটা সত্য, আরব বসন্তকে তারা উসকে দেয়নি। কিন্তু তরুণ প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তাদের গণতন্ত্রের স্পিরিট শেখানো হয়েছিল। কিভাবে যোগাযোগ করতে হয়, সেই ‘নেটওয়ার্কিং’ শেখানো হয়েছিল। আর মিসরের তরুণ প্রজন্ম এটা ‘আরব বসন্ত’ সংগঠিত করতে ব্যবহার করেছিল। ওয়াশিংটন মিসরে একটা স্ট্র্যাটেজি নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। এখানে ইসরায়েলি স্বার্থও একসঙ্গে কাজ করেছে। মিসরে একটি শক্তিশালী শক্তির উত্থান (লেবাননে হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনে হামাস) তাদের স্বার্থে আঘাত হানবে। তাই ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টিকে ভেঙে Al-Wasat পার্টি গঠন কিংবা Kabaya Movement-এর জন্ম দেওয়া ছিল সুদূরপ্রসারী ওয়াশিংটনের স্ট্র্যাটেজির ফল। Kabaya Movement-এর জন্ম ২০০৪ সালে। উদ্যোক্তা ছিলেন আবু লা আলা মাদি—একসময় ইসলামিক ব্রাদারহুডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় এর সমর্থকরা Ikhwan Muslim Brotherhood Movement-এর জন্ম দিয়েছিলেন। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাঈদ এল কাতাতিনি। হোসনি মুবারককে সরানো প্রয়োজন ছিল। কেননা তাঁর কোনো জনপ্রিয়তা ছিল না। ভয় ছিল, সেখানে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতা দখল করতে পারে। তাই Facebook Revolution-এর মধ্য দিয়ে মুবারকের বিদায়। একসময় যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা নেওয়া ড. মুরসিকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়ার মধ্য দিয়ে মিসরের বিপ্লবকে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে না দেওয়া—এসবই ছিল ওয়াশিংটনের দীর্ঘ স্ট্র্যাটেজির ফল। একসময় মুরসির ‘প্রয়োজন’ ফুরিয়ে গেলে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতেও দ্বিধা বোধ করেনি ওয়াশিংটন। জেনারেল সিসিকে ক্ষমতায় বসিয়েই ওয়াশিংটন ও ইসরায়েলি লবি তাদের স্বার্থ আদায় করেছে।
পরিণত বয়সেই মুরসি মারা গেছেন। তবে ‘খাঁচার ভেতরে’ তাঁর মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত। বাস্তবতা হচ্ছে, এই ‘মৃত্যু’ মিসরের চলমান রাজনীতিতে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না
Daily Kalekontho
25.06.2019

0 comments:

Post a Comment