রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

একটি সংবাদ ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন


বিশ্বের এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে অবস্থান করছে ৮০১তম স্থানে। ডেটা ও গবেষণার ওপর ভিত্তি করে প্রতি বছরের মতো এবারও বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং প্রকাশ করেছে 'কিউএস'। এটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। এশিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১২৭তম। এই খবরটি খোদ জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। খবরটি গণমাধ্যমে জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী 'কৃতিত্ব' নিতে চাইল, জানি না। তবে এটা বুঝি, ১২৭তম স্থান পাওয়া কোনো ভালো সংবাদ হতে পারে না। এর আগে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আরেকটি প্রতিষ্ঠান 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর একটি জরিপ প্রকাশ করে। ওই জরিপে ৪১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অবস্থান ছিল না। আমাদের উচ্চশিক্ষার হাল কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা এ ধরনের জরিপের ফলাফল থেকেই বোঝা যায়।

অনেকেই হয়তো এই র‌্যাংকিংয়ের ধারণায় বিশ্বাস করেন না। কিন্তু প্রকারান্তরে এটা স্বীকার করেন, শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন, বাংলাদেশে প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কমেছে। কেন কমেছে কিংবা এ জন্য কী করা উচিত, এটা নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বলছেন। তাতে একটা কথা উঠে এসেছে আর তা হচ্ছে, গবেষণায় অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ কম। এর পেছনে সত্যতা যেমনি আছে, তেমনি আবার এটাও সত্য, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকরাও পাঠদানে কিংবা গবেষণার ব্যাপারে সিরিয়াস 'কমিটেড' নন। গবেষণা বা গবেষণাধর্মী পুস্তক প্রকাশের চেয়ে তারা এখন 'দ্বিতীয় আরেকটি চাকরি' কিংবা গবেষণার পরিবর্তে টিভিতে সময় কাটাতেই বেশি সময় দেন। রাষ্ট্র যখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা ও বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানকারীকে ৯০ লাখ ৩১ হাজার টাকা দামের মিতসুবিশি পাজেরো, স্পোর্টস কিউএক্স জিপ গাড়ি বরাদ্দ দেয় এবং একজন সিনিয়র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে যখন নিত্যদিন রিকশা কিংবা বাসে করে ক্যাম্পাসে আসতে হয়, তখন তিনি আর গবেষণায় উৎসাহী হন না- এটাই স্বাভাবিক। আবার গবেষণায় বরাদ্দও থাকে কম। ফলে ভালো মানের গবেষণাও হয় না আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিংয়েও নাম আসে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা এক জায়গাতে আর তা হচ্ছে, যারা উপাচার্য হয়ে আসেন, তারা নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করার পরিবর্তে দলীয়করণের দিকেই মনোযোগী হন বেশি। দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া থেকে শুরু করে ক্ষমতাবান শিক্ষকরা নিজ স্বার্থে নতুন নতুন বিভাগ খুলছেন- এ সংবাদ তো পত্রপত্রিকাতেই ছাপা হয়েছে। এতে করে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে কীভাবে?

শিক্ষায়, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে। কিন্তু বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে গুণগত মান নিশ্চিত করা যাবে না। সরকার এ ক্ষেত্রে কতগুলো পদক্ষেপ নিতে পারে। তথাকথিত স্বায়ত্তশাসনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠানে সময় দিচ্ছেন বেশি। নিজ প্রতিষ্ঠানে তিনি যে বেতন পান, অন্য প্রতিষ্ঠানে 'সময় দিয়ে' তিনি তার চেয়ে বেশি আয় করেন। সুতরাং আইন করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্য প্রতিষ্ঠানে 'চাকরি' করা কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা (যে কোনোভাবে, পার্টটাইম বা কনসালট্যান্ট) নিষিদ্ধ করতে হবে। দুই প্রতিষ্ঠানে কেউ শিক্ষকতা-চাকরি করতে পারবেন না। আইনটা সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। উপাচার্যের ইচ্ছায় বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে হবে- এই প্রবণতা বন্ধ করে ইউজিসির অধীনে পিএসসির মডেলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আর শুধু লিখিত পরীক্ষা নয়, বরং মৌখিক ও 'ডেমো'র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং তিনি এক বছর শিক্ষানবিশ থাকবেন। এরপর আরেকটি মৌলিক গবেষণাকর্ম সম্পাদন করে স্থায়ী পদে যোগ দেবেন। সরাসরি কাউকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। টিআইবির গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক স্বার্থ জড়িত রয়েছে। অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ। এর সত্যতা আছে। এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। এ জন্য নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংসদে তৈরি করতে হবে, যা ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইনের স্থলাভিষিক্ত হবে। এরই সঙ্গে উপাচার্য নিয়োগে সিনিয়র শিক্ষকদের দিয়ে একটি প্যানেল তৈরি করতে হবে। তরুণ শিক্ষকদের বিদেশে পিএইচডি করার জন্য পাঠাতে হবে। এর জন্য ফান্ড তৈরি করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নামে এই ফান্ড হতে পারে, যেখানে শীর্ষ ব্যবসায়ীরা অনুদান দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের পদোন্নতির নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। চাকরির বয়স পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হতে পারবে না। পদোন্নতির জন্য মৌলিক গ্রন্থ এবং পিএইচডি ডিগ্রি থাকতে হবে। এটা বর্তমানে নেই। পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া সহযোগী অধ্যাপক পদেও পদোন্নতি পাওয়া যাবে না। ভিজিটিং স্কলার হিসেবে সিনিয়র প্রফেসরদের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের জন্য সুযোগ করে দিতে হবে। এতে করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উপকৃত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। গত দশ বছরে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। নিজের মেয়েকে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পাইয়ে দেওয়া (যে বোর্ডে তিনি নিজে সভাপতিত্ব করেছেন), বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেওয়া সন্তানের যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া- এ ধরনের 'অভিযোগ' রয়েছে। ইউজিসি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা বিতরণ করবে- শুধু এই কাজটি করাই তাদের মুখ্য কাজ হতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান দেখা, পর্যালোচনা করা, সুপারিশ করা ইত্যাদি তাদের 'কাজের' অন্তর্ভুক্ত থাকলেও, এসব ক্ষেত্রে তাদের কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান নয়। ফলে ইউজিসিকে নিয়ে ভাবতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদগুলোতে (সচিব, অ্যাডিশনাল সচিব) সিনিয়র শিক্ষকদের পেষণে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

একুশ শতকে এসে কতগুলো বিশেষ মন্ত্রণালয় (শিক্ষা, অর্থ, বাণিজ্য, পররাষ্ট্র) পরিচালনার ভার বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। ভারতে মোদি সরকার এই কাজটি শুরু করেছে। পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশে এ ব্যবস্থা আছে। একটি কমিশন গঠন করে সরকার তাদের কাছে মতামত চাইতে পারে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের রয়েছে একটি শক্তিশালী তরুণ প্রজন্ম। দেশের জনগোষ্ঠীর ১৯.৩৬ ভাগ হচ্ছে ১৫ থেকে ২৪ বছরের যুবক-যুবতী। আর জনগোষ্ঠীর ৩৯.৭৩ ভাগের বয়স ২৫ থেকে ৫৪ বছরের মধ্যে। এটা আমাদের জন্য একটি শক্তি। ইউরোপের প্রতিটি দেশে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি 'মাইনাস' অর্থাৎ জনসংখ্যা বাড়ছে না। জাপানেও বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। শিশুর জন্ম হ্রাস পাচ্ছে। তাই জাপান দক্ষ জনগোষ্ঠী 'আমদানি' করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যে দেশগুলো থেকে তারা দক্ষ জনশক্তি আনবে, ওই তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশে একটি বিশাল তরুণ প্রজন্ম থাকলেও তারা দক্ষ নয়। আমাদের নীতিনির্ধারকদের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে কতগুলো সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া দরকার। মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিদেশ থেকে শিক্ষক আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি করা জরুরি। প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যেখান থেকে শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট বের হবে। সাধারণ শিক্ষার প্রসার না ঘটিয়ে প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। নার্সিং, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, কৃষি তথা কৃষিপ্রযুক্তির মতো বিষয় চালু করা উচিত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙে প্রতি বিভাগে একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ওই বিভাগের সব কলেজকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত করতে হবে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার জন্য আলাদা একটি কমিশন গঠন করে এর মর্যাদা ইউজিসির মতো উন্নীত করা। একুশ শতকে এসে আমরা যদি একটি দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করতে না পারি, তাহলে এই জনগোষ্ঠী আমাদের জন্য 'বোঝা' হবে। এ ক্ষেত্রে চীনের দৃষ্টান্ত আমরা অনুসরণ করতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিসর বাড়াতে হবে। না হলে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে আমরা পিছিয়ে পড়ব বারবার। শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের দরকার যোগ্য নেতৃত্ব। কিন্তু সেটা নেই। দলীয়করণের কারণে যোগ্য শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ইউজিসির মতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারছেন না। এ ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা দ্রুত প্রয়োজন।
Daily Samakal
27.06.2019

0 comments:

Post a Comment