রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কেমন হবে নরেন্দ্র মোদির পররাষ্ট্রনীতি


গত ৩০ মে নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। সেই সঙ্গে ভারত একজন নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীও পেয়েছে। অসুস্থতার কারণে সুষমা স্বরাজ এবার লোকসভা নির্বাচনে অংশ নেননি। ফলে তিনি আর মন্ত্রিসভায় থাকছেন না। একজন নয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এখন মন্ত্রণালয়টি সামলাতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে মোদির ‘দর্শন’ হয় একটি বড় ভূমিকা পালন করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো দায়িত্ব নিয়ে মোদি পাশর্^বর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার তালিকায় প্রথম স্থান দিয়েছিলেন। সূচনা করেছিলেন ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ পলিসি। অন্যান্য দেশ সফরের আগেই তিনি ‘সার্ক যাত্রা’ শুরু করেছিলেন, সফর করেছিলেন সার্কভুক্ত প্রতিটি দেশ। যদিও বাংলাদেশে এসেছিলেন একটু পরে, ২০১৬ সালের জুনে। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট কি বদলে গেল? নির্বাচনের আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি (২০১৯) ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার লেথপুরা গ্রামে পুঁতে রাখা বোমায় ভারতের সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশের ৪০ জন জওয়ানের মৃত্যু ও এর প্রতিক্রিয়য় ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় বিমানের বালাকোটে (পাখতুনখোয়া প্রদেশে) হামলা পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। যে কারণে মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। যদিও ইমরান খান মোদিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। কিন্তু সম্পর্ক এখন তলানিতে।
পাকিস্তানি মদদপুষ্ট জঙ্গিরা ভারতের মাটিতে হামলা চালাচ্ছে অনেক দিন থেকেই। ২০১৬ সালে উরিতে হামলা, ২০০১ সালে ভারতীয় পার্লামেন্ট ভবনে হামলা, ২০০৮ সালে মুম্বাই হোটেলে হামলাÑ এই প্রতিটি জঙ্গি হামলার ঘটনাতেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার হাত রয়েছে বলে ভারতের অভিযোগ এবং সর্বশেষ বালাকোটে ভারতীয় বিমান হামলা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটিয়েছে। পাকিস্তানে সার্ক সম্মেলন আয়োজনের বিষয়ে ভারতের আপত্তি রয়েছে। ফলে মোদির জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জÑ তিনি কীভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবেন। একই সঙ্গে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক মোদির আরেকটি এজেন্ডা। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়ছে। এটা ভারতের পছন্দ নয়। চীন তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনছে। এটা ভারতের চিন্তার কারণ। মোদির আমলেই পুরনো ‘কটনরুট’কে পুনরুজ্জীবিত করতে চায় ভারত। এটা চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এর একটা বিকল্প। ভারত-চীন সম্পর্কটা তাই আলোচনায় থাকবে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ‘কৌশলগত সম্পর্ক’ আরও জোরদার হয়েছে। ভারতের জোটনিরপেক্ষতা এখন প্রশ্নের মুখে। মার্কিনি চাপে ভারত ইরান থেকে সস্তায় জ¦ালানি তেল আনতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আগামী ৫ বছর কোন পর্যায়ে যায়, সেটাও মোদির অন্যতম একটি এজেন্ডা। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশাও অনেক। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করে এসব সমস্যার সমাধানে মোদি আন্তরিক হবেন।
কট্টর হিন্দুত্ববাদ মোদিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। তিনি যদি এখানে একটি বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ করেন, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে এবং তিনি সত্যিকার অর্থেই বিশ^ নেতায় পরিণত হবেন। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, মোদির রাজনীতি নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, মোদি নিজেকে জওয়াহেরলাল নেহরু ও ইন্দিরা গান্ধীর সমপর্যায়ে নিয়ে গেছেন। যে বিজেপি সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে ১৯৮৪ সালে (৮ম লোকসভা) মাত্র ২টি আসন পেয়েছিল, ২০১৯ সালে সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে দলটি পেয়েছে এককভাবে ৩০৩ আসন, আর জোটগতভাবে ৩৫০ আসন।
মোদির ব্যক্তি ক্যারিশমার কারণে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে নেহরু পরিবার আর বিরোধী দলের সম্মিলিত উদ্যোগ। পারিবারিক আসন আমেথিতে রাহুলের পরাজয়ের পেছনে স্মৃতি ইরানীর অবদান যতটুকু না ছিল, তার চাইতে  বেশি ছিল মোদির ইমেজ। স্বাভাবিকভাবেই তাই আশা অনেক। নির্বাচনের আগে তিনি যেসব বক্তব্য দিয়েছিলেন (পশ্চিম বাংলা ও আসামে নাগরিকপঞ্জি করে কিছু মুসলমানদের ‘অবৈধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের পুশব্যাক করার বিষয়ে) তা কি তিনি বাস্তবায়ন করবেন? নাকি একটি বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ করবেন? আগামী ৫ বছর তিনি ক্ষমতায় থাকবেন। বিবিসির ভাষ্য মতে এবারের লোকসভা নির্বাচন ভারতবাসীকে অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছিল; একদিকে হিন্দুত্ববাদী কট্টর জাতীয়তাবাদ অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা। হিন্দুত্ববাদের বিজয় হয়েছে। কিন্তু এই হিন্দুত্ববাদ নিয়ে নরেন্দ্র মোদি বেশিদূর এগিয়ে যাবেন বলে মনে হয় না। এর বড় প্রমাণ গত ২৫ মে। সংসদের সেন্ট্রাল হলে পা রাখার ঠিক আগে ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখা সংবিধানের ওপর মাথা ছোঁয়ালেন নরেন্দ্র মোদি। বললেন, ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ^াস’। ‘সবকা বিশ^াস’ এটা নতুন মন্ত্র। এই বিশ্বাসটা কাদের। সংখ্যালঘু মুসলমানদের। তিনি বললেন, ‘সংবিধানকে সাক্ষী রেখে আমরা প্রতিজ্ঞা করছি যে সব বর্গের মানুষকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে হবে। ধর্ম-জাতির ভিত্তিতে কোনো ভেদাভেদ হবে না’ (আনন্দবাজার ২৬ মে)। এটাই সঠিক রাজনীতি। সবার আস্থা অর্জন করাটা জরুরি। এই নীতিটি অভ্যন্তরীণ, রাজনীতির জন্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপনেও। বিশেষ করে পাশর্^বর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ভারতের পররাষ্ট্রনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিম বাংলায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে থেকে লোকসভা ভোট পর্যন্ত রাজ্যে যে সমস্ত বিজেপি কর্মী খুন হয়েছিলেন, মোদি তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এর প্রতিবাদে মমতা মোদির শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি হলেও, মোদির সঙ্গে মমতার সম্পর্কের অবনতি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার যে সম্ভাবানা তৈরি হয়েছিল, তাতে এখন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হতে পারে।
মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বিমসটেকভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে আমন্ত্রণ জানানোর মধ্য দিয়ে মোদি মূলত একটি বার্তা দিলেন। তিনি সার্কের বদলে বিমসটেককে গুরুত্ব দিতে চান। সার্ক কার্যত এখন মৃত! শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করা যাচ্ছে না। এর পেছনে ভারতের যে অভিযোগ তার সত্যতা যাই থাকুক না কেন, পাকিস্তানকে পাশে রেখেই ভারত আঞ্চলিক সহযোগিতা ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলছে। দেশ দুটি ক্রমশই জটিল রাজনৈতিক সমীকরণে জড়িয়ে যাচ্ছে। যেদিন মোদির বিজয়ের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, সেদিন পাকিস্তান একটি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল। এর অর্থ পরিষ্কারÑ ভারতকে একটা ‘বার্তা’ দেওয়া। এর আগে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন খোয়া প্রদেশে তথাকথিত ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার ঘাঁটিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযান ও তা ধ্বংস করে দেওয়া, বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভারতের মদদ দেওয়ার অভিযোগ, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি, চীনের জিনজিয়াং থেকে বেলুচিস্তানের গাওদার সমুদ্রবন্দরের সংযুক্তি) সন্ত্রাসবাদী কর্মকা- ইত্যাদি নানা কারণে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটা আস্থাহীনতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় মোদির শপথ অনুষ্ঠানে ইমরান খানকে আমন্ত্রণ জানানো হলো না। এতে করে দুই দেশের সম্পর্ক আরও উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
মোদির শপথ অনুষ্ঠানে কিরঘিজস্তানের প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কিরঘিজস্তান মধ্য এশিয়ার একটি দেশ এবং বর্তমানে কিরঘিজস্তান ‘এসসিও’ বা ‘সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন’-এর সদস্য। মধ্য এশিয়া এবং আফগানিস্তানে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। বলা ভালো মধ্য এশিয়ার তাজিকিস্তানের ফারখর বিমান ঘাঁটিতে ভারতীয় জঙ্গিবিমান মোতায়েন করা হয়েছে। ভারতীয় বিমানবাহিনী ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এখানে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে এবং এক স্কোয়াড্রন ‘মিগ-২৯’ বিমান মোতায়েন করে। ‘এসআই-১৭’ হেলিকপ্টারও সেখানে রয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে আফগানিস্তানে ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম চালানোর জন্য এখানে বিমান মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগ আছে ক্রমবর্ধমান চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক বিশেষ করে চীনের যে কোনো সামরিক তৎপরতায় নজরদারি করার জন্যই ভারতের এই বিমানবাহিনী মোতায়েন। উল্লেখ করা প্রয়োজন পাকিস্তানের গাওদার-এ (বেলুচিস্তান প্রদেশ) চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ওমান উপসাগরের তীরে ইরানের বেলুচিস্তান প্রদেশের ‘চাবাহার’-এ ভারত একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে। শুধু তাই নয়, চাবাহার থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত সড়কও নির্মাণ করছে ভারত। এই চাবাহার বন্দর ভারতের ‘ইউরো এশিয়া স্ট্র্যাটেজি’-তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ক্রমবর্ধমান চীন-ভারত দ্বন্দ্বে (ভারত মহাসাগরে) চাবাহার বন্দরটি আগামীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
অনেকেই স্মরণ করতে পারেন ট্রাম্পের জমানায় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। মোদির বিজয়ে ট্রাম্প উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি তাতে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম পার্টনার। এই অ্যালায়েন্স আগামীতে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। ট্রাম্প প্রশাসন চাচ্ছে ভারত আগামীতে আফগানিস্তানের ব্যাপারে একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। ভারত কিরঘিজস্তানে তার এই স্ট্র্যাটেজি নিয়েই কাজ করছে। আগামী ১৩-১৪ জুন কিরঘিজস্তানে পরবর্তী  ‘এসসিও শীর্ষ সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হবে। মোদিও ওই সম্মেলনে যোগ দেবেন। পাকিস্তান এসসিও’র সদস্য বিধায় ইমরান খানও ওই সম্মেলনে যোগ দেবেন। মোদি-ইমরান বৈঠকের সম্ভাবনাও সেখানে রয়েছে।
মোদি আগামী ৫ বছর মধ্য এশিয়াকে তার পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম এজেন্ডা হিসেবে নেবেন। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কও বৃদ্ধি পাবে। এ ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়, সেদিকে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। অন্যদিকে মরিশাসের প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণের মধ্য দিয়ে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে যে ভারত তার প্রভাব বাড়াতে চায় তারও প্রমাণ রাখা হলো। মালদ্বীপসহ এ অঞ্চলে ভারত আগামী দিনে তার প্রভাব বাড়াবে। মোদির পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে এসব অঞ্চল।
Daily Desh Rupantor
02.06.2019

0 comments:

Post a Comment