রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সিল্ক্ক রোড ফোরাম ও মোদির মালদ্বীপ সফর


চীনের বহুল আলোচিত 'সিল্ক্ক রোড'-এর এক মহাপরিকল্পনা সামনে রেখে বাংলাদেশে একটি 'সিল্ক্ক রোড ফোরাম' গঠিত হয়েছে। এ উপলক্ষে সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ূয়াকে প্রধান করে একটি 'জাতীয় কমিটি'ও গঠিত হয়েছে; যে কমিটিতে বিএনপির প্রতিনিধিরাও রয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। উদ্যোক্তারা গত ১৮ মে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন; যেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। অনুষ্ঠানে ড. রিজভীর উপস্থিতি প্রমাণ করে, এ ধরনের একটি ফোরাম গঠনের ব্যাপারে সরকারের সমর্থন রয়েছে। এখানে বলা ভালো, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের একটি 'দর্শন' হচ্ছে, 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' (ওবিওআর) কর্মসূচি। তিনি স্থল ও সমুদ্রপথে বিশ্বের ৬৫টি দেশ চীনের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চান। এর মধ্য দিয়ে চীন একুশ শতকে এক ধরনের 'নয়া উপনিবেশবাদ'-এর জন্ম দিতে যাচ্ছে। যদিও চীন কখনোই স্বীকার করে না যে, ওবিওআরের মধ্য দিয়ে চীন নতুন এক ধরনের ঔপনিবেশিক শক্তি হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যে ওবিওআর নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। চীন ওবিওআরের আওতায় যেসব দেশ সংযুক্ত হচ্ছে, তাদের বিলিয়ন ডলার (মোট ব্যয় তিন ট্রিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে বলে অনুমান করা হচ্ছে) ঋণ দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই ঋণগ্রহীতা দেশ ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় ৯৯ বছরের জন্য ঋণের টাকায় তৈরি হওয়া সমুদ্রবন্দর (কেনিয়ার মোমবাসা, শ্রীলংকার হামবানতোতা, পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের গাওদার) চীনের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। বলা হচ্ছে, চীনা ঋণ এক ধরনের 'ঋণ ফাঁদ' তৈরি করছে এবং ঋণগ্রহীতা দেশগুলো ওই ফাঁদে অনেকটা না জেনেশুনেই পা দিচ্ছে! উল্লেখ করা প্রয়োজন, ৬৫টি দেশকে চীন ওবিওআরের আওতায় এনেছে। এই মহাপরিকল্পনার আওতায় চীনকে একদিকে মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকা এবং ইউরোপের সঙ্গে সড়ক, রেলপথ ও সামুদ্রিকপথে সংযুক্ত করছে। ফলে এর মধ্য দিয়ে চীন বৈশ্বিক বাণিজ্যে একটি বড় পরিবর্তন আনছে। এতে করে বিশ্ববাণিজ্যে চীনা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।

বাংলাদেশে এই সিল্ক্ক রোড ফোরামটি যখন গঠিত হয়, তার ঠিক দুই সপ্তাহের মাথায় ভারতে নরেন্দ্র মোদি সরকার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সেখানে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছে। আরও যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, সরকার গঠনের ১০ দিনের মাথায় নরেন্দ্র মোদির মালদ্বীপ ও শ্রীলংকা সফর। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এই সিল্ক্ক রোড ফোরামের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির মালদ্বীপ-শ্রীলংকা সফরের কোনো মিল নেই। কিন্তু গভীরভাবে বিশ্নেষণ করলে দেখা যাবে, একটি মিল আছে। আর তা হচ্ছে, এ অঞ্চলে চীনের যে প্রভাব, তা কমানো ও চীনা কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করার লক্ষ্যেই নরেন্দ্র মোদির এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল। এ অঞ্চলের দেশগুলো ওবিওআরে যোগ দিক, এটা ভারতের কাম্য নয়। বাংলাদেশ ওবিওআরে যোগ দিলেও ভারত এতে যোগ দেয়নি। ওবিওআরের মহাপরিকল্পনার আওতায় চীন একদিকে সড়কপথে চীনের সঙ্গে ইউরোপের সংযোগ ঘটাতে চায় (সিআন থেকে হল্যান্ডের রটারডাম), অন্যদিকে সমুদ্রপথে চীনের ফুজইউ সমুদ্রবন্দরকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্য দিয়ে ইতালির ভেনিস পর্যন্ত 'কানেক্ট' করবে। ওবিওআর হচ্ছে প্রাচীন সিল্ক্ক রোডের আধুনিক সংস্করণ। ওবিওআরে মোট ৬টি অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। চীন ওবিওআরে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোকে ঋণ দিচ্ছে। এই ঋণে প্রতিটি দেশের সড়ক ও রেলপথের উন্নতি ঘটাতে চায় চীন, যা প্রকারান্তরে চীনের সঙ্গে দেশগুলোকে সংযুক্ত করবে। যেমন বলা যেতে পারে, বিসিআইএম করিডোরের কথা (বাংলাদেশ-চীনের ইউনান প্রদেশ-ভারতের পূর্বাঞ্চল ও মিয়ানমার)। এই করিডোরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে চীনের ইউনান প্রদেশ সংযুক্ত হবে। এতে করে অত্যন্ত সহজে চীনা পণ্য বাংলাদেশে পাওয়া যাবে এবং পণ্যের মূল্যমানও কমে যাবে। তবে ভারত এক পর্যায়ে বিসিআইএম করিডোরের ধারণা সমর্থন করলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এই প্রজেক্ট নিয়ে এগিয়ে যাবে বলে মনে হয় না। সূক্ষ্ণভাবে দেখলে দেখা যাবে, সমুদ্রপথে চীন যে 'মেরিটাইম সিল্ক্ক রোড'-এর কথা বলছে, তাতে চীনের ফুজইউ, গুয়াংজু বন্দরের সঙ্গে হ্যানয়, কুয়ালালামপুর, জাকার্তা, কলম্বো, কলকাতা এবং সেই সঙ্গে নাইরোবিকে সংযুক্ত করে গ্রিসের এথেন্স ও ভেনিসকে সংযুক্ত করেছে। এ জন্য চীনের কাছে ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব অনেক বেশি। বলা ভালো, দক্ষিণ এশিয়ান ৭টি দেশ (পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, আফগানিস্তান, নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটান) ওবিওআরে যোগ দিয়েছে। মালদ্বীপে বিপুল চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। মাথাপিছু এই ঋণের পরিমাণ এখন আট হাজার ডলার। মোট চীনা ঋণের পরিমাণ তিন বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। চীনা অর্থে মালদ্বীপ-চীন মৈত্রী সেতু চালু হয়েছে, যা হুলহুলে দ্বীপে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে রাজধানী মালের সঙ্গে সমুদ্রপথে সংযুক্ত করেছে। চীন ৮,৫৯,০০০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে 'বিশেষ অর্থনৈতিক জোন' প্রতিষ্ঠা করেছে। ওলহুভেলি দ্বীপে চীন রিসোর্ট তৈরি করছে, যেখানে বিদেশি পর্যটকদের জন্য ৫০৯টি অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি প্রায় শেষ করেছে চীন। শুধু তাই নয়, ২০১৫ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়েমিনের সময় সংবিধান সংশোধন করে বিদেশি ক্রেতাদের জন্য মালদ্বীপের জমি ক্রয় করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। ভারতের চিন্তার কারণ এখানেই- চীন এই সুযোগে মালদ্বীপে জমি ক্রয় এবং তাদের স্থাপনা নির্মাণ করবে। চীন যদি এটা করে, তাহলে তা হবে ভারতের স্বার্থের পরিপন্থি।

মোদির শাসনামলে ভারত মহাসাগরে চীন ও ভারতের দ্বন্দ্ব তাই বাড়বে। মোদির জমানায় ভারত 'মনরো ডকট্রিন'-এর ভারতীয় সংস্করণের জন্ম দিয়েছে। পাঠকদের একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই মোদির প্রথম জমানায় ওডিশার ভুবনেশ্বরে 'ইন্ডিয়ান ওসেন রিম'-এর (আইওআর) সম্মেলনের (মার্চ ২০১৫) কথা। ওই সম্মেলনে অংশ দিয়েছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। সুষমা স্বরাজ তার বক্তব্যে স্পষ্ট করেই তখন বলেছিলেন, ভারত মহাসাগরে অন্য কোনো দেশ 'কর্তৃত্ব' করবে, ভারতের এটা পছন্দ নয়। ভারত এটা সহ্যও করবে না। অজিত দোভাল তার বক্তব্যেও সুষমা স্বরাজের বক্তব্য সমর্থন করেছিলেন। অর্থাৎ মোদি ক্ষমতাসীন হয়ে ভারতের জন্য যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন, তাতে ভারত মহাসাগর পালন করছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। চীনের জন্য এই ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব অনেক। চীনের যে 'জ্বালানি ক্ষুধা' অর্থাৎ জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে চীন ভারত মহাসাগরের 'সি লাইন্স অব কমিউনিকেশন'-এর ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল। বিশ্ব জ্বালানি বাণিজ্যের অর্থাৎ জ্বালানি তেল রফতানির ৮৩ ভাগ এই সমুদ্রপথ ব্যবহার করে। এর মাঝে ৪০ ভাগ পরিবহন করা হয় ভারত মহাসাগরে অবস্থিত 'স্ট্রেইট অব হরমুজ', ৩৫ ভাগ 'স্ট্রেইট অব মালাক্কা' ও ৮ ভাগ 'বাব এল মানদেন' প্রণালি দিয়ে। চীনের জ্বালানি আমদানি এ পথ ব্যবহার করেই সম্পন্ন হয়। চীন তাই তার এই জ্বালানি সম্পদ আমদানি নিশ্চিত করতে চায়। আর এটা করতে গিয়ে চীন দুটি পরিকল্পনা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। 'মুক্তার মালা' (ঝঃৎরহম ড়ভ চবধৎষং) এবং 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' মহাপরিকল্পনা হচ্ছে চীনের স্ট্র্যাটেজির অংশ। চীনের এই স্ট্র্যাটেজি ভারতের স্বার্থের পরিপন্থি। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন তার নৌবাহিনীর তৎপরতা বাড়িয়েছে। জিবুতিতে চীন তার সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। এছাড়া মিয়ানমারের সিটওয়ে, পাকিস্তানের গাওদার আর মালদ্বীপের মারাও ঘাঁটিতে পোর্ট সুবিধা পায় চীনা নৌবাহিনী। হামবানতোতায় (শ্রীলংকা) চীনা জাহাজের আনাগোনা আছে। কেননা, শ্রীলংকা চীনা ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে ৯৯ বছরের জন্য পোর্টটি চীনকে লিজ দিয়েছে। একই সঙ্গে তাজিকিস্তানে অলিখিত চীনা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে। পাকিস্তানে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর রক্ষায় (বেলুচিস্তান) সেখানে চীনা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে। আফগানিস্তানের ওয়াকান করিডোরে যা তাজিকিস্তান ও পাকিস্তানকে আলাদা করেছে এবং যে করিডোরটি চীন সীমান্ত পর্যন্ত সম্প্রসারিত, এখানেও চীনা সেনাবাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে। চীনের এই উপস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ করে ভারতও ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন দেশে তার নৌঘাঁটি স্থাপন করেছে। সিসিলি ও মরিশাসে ভারতীয় নৌঘাঁটি রয়েছে। তাজিকিস্তানের ফারখোর বিমানঘাঁটিতে ভারতীয় বিমানবাহিনী তাদের ঘাঁটি স্থাপন করেছে। আরও একটা বিষয়, চীন যখন তার মহাপরিকল্পনা 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ভারত ইন্দোপ্যাসিফিক ইকোনমিক করিডোরের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে এক ধরনের 'দ্বন্দ্ব' তৈরি হয়েছে ভারত ও চীনের মাঝে। এই দ্বন্দ্বে দক্ষিণ এশিয়ান দেশগুলোও প্রভাবিত হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী আগামী মাসে চীন যাচ্ছেন। আমাদের জন্য তার এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ওবিওআরের আওতায় আমরা কিছু চীনা ঋণ নিয়েছি। আগামীতে হয়তো আরও নেব। শি জিনপিং-শেখ হাসিনা শীর্ষ বৈঠকে ওবিওআর নিয়ে আলোচনা হবে। এ ক্ষেত্রে চীনা ঋণের প্রশ্নটিও আসবে। আমরা যেন ভুলে না যাই, মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ায় চীনা ঋণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সুদহার কমানো ও পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য তিনি চীনে পর্যন্ত গিয়েছিলেন। 'চীনা ঋণের ফাঁদ' নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। গাওদার, মোম্বাসা কিংবা হামবানতোতা আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত। আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সাহায্য নিশ্চয়ই প্রয়োজন। কিন্তু তাতে যেন আমরা কোনো ফাঁদে না পড়ি!

ঢাকায় সিল্ক্ক রোড ফোরাম গঠিত হয়েছে। এই ফোরাম যদি শুধু চীনের এই মহাপরিকল্পনাটি প্রমোট করার জন্য ব্যবহূত হয়, তাহলে তা হবে দুঃখজনক। বরং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি 'ওয়ার্কিং গ্রুপ' গঠন করা, যারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করবে। ড. গওহর রিজভী নিজে গবেষক। তার নেতৃত্বে এ ধরনের একটি কমিটি গঠিত হতে পারে। চীনা ঋণ ও আমাদের জাতীয় স্বার্থ- এই দুটি বিষয় সামনে রেখেই গবেষণা কর্মটি পরিচালিত হতে পারে। এই চীনা ঋণ বড় ধরনের সংকট তৈরি করুক, আমরা তা চাই না।
Daily Samakal
13.06.2019

0 comments:

Post a Comment