রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

ভারতের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি এবং প্রণব মুখার্জির উপলব্ধি


 
প্রণব মুখার্জি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি। তিনি ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। এখন তিনি অবসরে। ভারতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দেশটি যখন বড় ধরনের বিক্ষোভের মুখে পড়েছে, তখন, গত ১৬ ডিসেম্বর নয়াদিল্লির ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের দফতরে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা মানে যা খুশি করা নয়।

ভারতে নানা ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় রয়েছে। গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদের এই পরিবেশ যেন লঙ্ঘিত না হয়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’ স্পষ্টতই তার ইঙ্গিত কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের প্রতি। তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা হল, ভারতে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যা হচ্ছে তা গণতন্ত্রের মূল স্পিরিটের পরিপন্থী। গণতন্ত্র পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার কথা শেখায়। গণতন্ত্র হচ্ছে অপরকে আস্থায় নেয়া। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠরা শাসন করে বটে; কিন্তু এ শাসন নিশ্চিত হয় বিরোধী পক্ষকে আস্থায় নিয়েই।
সারা বিশ্বের মানুষ ভারতের এ গণতান্ত্রিক চরিত্রই দেখে এসেছে গত প্রায় ৭২ বছর। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় জমানায় (২০১৯) এক ভিন্ন ভারতকে দেখছে বিশ্ব। সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামে উগ্র দলীয় চিন্তা-চেতনা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এ কথাটাই বলতে চেয়েছেন।
ভারতের রাজনীতিতে প্রণব মুখার্জির স্থান অনেক উঁচুতে। ভারতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিতে তিনি জড়িত থাকলেও সর্বভারতীয় মহলে তার একটি গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। অনেক শীর্ষস্থানীয় বিজেপি নেতাও তাকে সম্মানের চোখে দেখেন। সুতরাং ভারতের বর্তমান সংকটের সময় তিনি যখন এ ধরনের একটি কথা বলেন, তখন সে কথার গুরুত্ব রয়েছে বৈকি। সঙ্গত কারণেই তার এ বক্তব্যের পেছনে একটি ‘ইতিহাস’ রয়েছে- আর তা হচ্ছে, বর্তমান ভারতের কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার খোদ ভারতের মৌলিক আদর্শকে বদলে দিতে চাচ্ছে! এর শুরুটা হয়েছিল প্রথমে আসাম থেকে, যখন আসামের নাগরিকপুঞ্জির উদ্যোগ নেয়া হল।
অর্থাৎ আসামে দীর্ঘদিন ধরে যারা বসবাস করে আসছেন এবং যারা বাংলায় কথা বলেন, তারা আদৌ ভারতীয় নাগরিক কিনা, তা যাচাই-বাছাই করে দেখে একটা তালিকা তৈরি করা হয়। এ তালিকায় যাদের নাম থাকবে না বা নেই, তাদের ‘অবৈধ বসবাসকারী’ হিসেবে ঘোষণা করে বাংলাদেশে ‘পুশহীন’ করাই উদ্দেশ্য! এখানে টার্গেট করা হয়েছে বাঙালি মুসলমানদের এবং বলা হচ্ছে, এরা বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসে ‘অবৈধভাবে’ ভারতে বাস করছেন! এই নাগরিকপুঞ্জি বা এনআরসি বাংলাদেশে বড় ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একাধিকবার আশ্বাস দিয়েছেন এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আমরা নরেন্দ্র মোদির কথায় আস্থা রাখতে পেরেছি বলে মনে হচ্ছে না। আসামে এনআরসি নিয়ে বিতর্কের যখন অবসান হল না, তখন দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি নিল মোদি সরকার কাশ্মীরের সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করে দিয়ে সেখানে কেন্দ্রের শাসন ও জম্মু-কাশ্মীর থেকে লাদাখকে বের করে আলাদা কেন্দ্রের শাসনে পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে। ভারতের সংবিধানে ৩৭০নং ধারা নামে একটা ধারা ছিল।
ওই ধারা বলে কাশ্মীরের অধিবাসীরা ভারতীয় কাঠামোয় বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন। ভারতের সংবিধান প্রণেতারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, বিভিন্ন জাতি, উপজাতি, ধর্ম ও বর্ণে বিভক্ত ভারতকে এক রাখতে হলে কোনো কোনো অঞ্চলকে ও জনগোষ্ঠীকে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। কাশ্মীরসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো এ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। এখন কাশ্মীর থেকে সেই সুযোগ-সুবিধা সংসদে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাতিল করা হয়েছে।
এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুসলমানরা। তারা সেখানে শুধু চাকরি হারানোর ঝুঁকিতেই নেই, বরং নিজ এলাকায় ‘দ্বিতীয় শ্রেণির’ নাগরিকে পরিণত হওয়ার একটা আশঙ্কার মাঝে আছেন। একই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতেও।
ভারতের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত বিষয়টি সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট ১৯৫৫-এর সঙ্গে জড়িত। পরে ১৯৮৬, ১৯৯২, ২০০৩, ২০০৫ ও ২০১৫ সালে এতে কিছু কিছু পরিবর্তন আনা হয়। তবে এবার যে পরিবর্তন আনা হল, তা মূল কাঠামোকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে।
এখন ইসলাম ধর্মাবলম্বী কারও পক্ষে ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করতে পারাটা কঠিন হয়ে পড়বে। অথচ হিন্দু ধর্মসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন এবং তাদের নাগরিকত্বের আবেদন বিবেচনা করা হবে। সংবিধানের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত অনুচ্ছেদে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে ভারত সরকার মূলত ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের একটা ব্যবধান তৈরি করল। প্রশ্ন হচ্ছে- এ সংশোধনী ভারতের সংবিধানের পরিপন্থী কিনা?
সংবিধানের অনেকগুলো ধারা ও প্রস্তাবনা (preamble) সংবিধানের এ সংশোধনীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংবিধান পরিপন্থীও বটে। ভারতের সংবিধানের ১৪নং আর্টিকেলটি এ সংশোধনীর পরিপন্থী। এ আর্টিকেলে সমতার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বিভক্তি আনা যাবে না, সবাই সমান। এখানে বলা আছে, 'The state shall not deny to any person equality before law or the laws within the territory of India'. রাষ্ট্র কাউকে তার সমঅধিকর থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।
কিন্তু সংশোধনী এনে নাগরিকত্বের প্রশ্নে সমঅধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। আমরা সংবিধানের প্রস্তাবনার কথাও উল্লেখ করতে পারি। প্রস্তাবনায় ভারত সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘a welfare state committed to secure justice, liberty and equality for the people and for promoting fraternity, dignity of the individual, and unity and integrity of the nation'. এখানে unity ও integrity'র কথা, অর্থাৎ ঐক্য ও সংহতির কথা বলা হয়েছে।
এ ঐক্য ও সংহতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ওই সংশোধনী। আমরা সংবিধানের আরও কয়েকটি ধারা উল্লেখ করব। যেমন সংবিধানের ৫নং ধারায় বলা হয়েছে, ভারত হবে একটি Secular state- ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু সংবিধানের নাগরিকত্ব সংশোধনী ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের পরিপন্থী। এ ধারায় প্রতিটি ধর্মের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের সম স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে, যা সংবিধানের পরিপন্থী। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে ৬টি মৌলিক মানবাধিকারের (Fundamental Rights) কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র এ মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেবে। এখানে ৩নং উপধারায় আছে Right against exploitation, ৪নং উপধারায় আছে Right to freedom of religion-এর কথা।
কিন্তু এখন কোনো মুসলমান ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করলে সেটা গ্রাহ্য হবে না। অথচ সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদ তাকে সেই অধিকার দিয়েছে। সুতরাং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে সুপ্রিমকোর্টে যে রিট হয়েছে, তা যুক্তিযুক্ত বলে আমি মনে করি। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই ভিজয়ান বলেছেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সংবিধান পরিপন্থী। সুতরাং কেরালায় এটি কার্যকর হবে না বলেও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন।
আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এনআরসি রুখতে গণআন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। আসামে এনআরসি হলেও পশ্চিমবঙ্গে কোনো এনআরসি হবে না এটি জানাতেও তিনি ভোলেননি। পাঞ্জাব সরকারও এ আইন প্রত্যাখ্যান করেছে।
ফলে স্পষ্টতই এই এনআরসি কিংবা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ভারতকে বিভক্ত করে ফেলেছে। মজার ব্যাপার, আসাম ও ত্রিপুরায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার রয়েছে। মনিপুরেও রয়েছে বিজেপি সরকার। তাহলে এ অঞ্চলগুলো অশান্ত কেন? এর কারণ হচ্ছে, এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ মনে করেন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস হওয়ার ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিপুলসংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর পুনর্বাসন হবে।
বাংলা ভাষাভাষীদের সংখ্যা এতে করে বৃদ্ধি পাবে। ওই অঞ্চলে উপজাতীয়দের যে জমিজমা ছিল, তা হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা কিনে নেবে। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। এর মধ্য দিয়ে উপজাতীয়রা এ অঞ্চলে যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পেতেন, তা বাতিল হয়ে যাবে। আসামের ক্ষেত্রে ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এবং ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত ‘আসাম মুভমেন্টের’ মধ্যে যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেই সমঝোতা মুখ থুবড়ে পড়বে। বাংলাভাষীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে এ অঞ্চলের ভারসাম্য নষ্ট হবে। তাদের আপত্তিটা এ কারণেই।
পরিস্থিতি এখন কোন দিকে যাবে বলা মুশকিল। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতে গেছে। যারা আদালতে গেছেন, তারা যুক্তি দেখিয়েছেন, ধর্মের ভিত্তিতে কখনই নাগরিকত্ব প্রদান করা যায় না। তাদের যুক্তি, এই আইন সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী।
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বেঞ্চ এ রিটটি শোনেন। উচ্চ আদালতের এ বেঞ্চটি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটি বাতিল করার আবেদন খারিজ করে দিলেও কেন্দ্রীয় সরকারকে তারা নোটিশ দিয়েছেন। আগামী ২২ জানুয়ারি মামলার পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এ শুনানিতে কী হবে বলা মুশকিল, তবে আইনটি বাতিলের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন অমিত শাহ। গত ১৭ ডিসেম্বর এক সমাবেশে তিনি বলেছেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের রক্ষায় মোদি সরকার সবকিছু করবে। এসব শরণার্থীর জন্য ভারতের নাগরিকত্ব ও সম্মান নিশ্চিত করা হবে।
উচ্চ আদালত থেকে কোনো কিছু প্রত্যাশা করাও ঠিক হবে না বলে অনেকে মনে করেন। বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিতর্কে উচ্চ আদালত রামমন্দির নির্মাণের পক্ষে রায় দেয়ায় অনেকেরই উচ্চ আদালত নিয়ে এক ধরনের মোহভঙ্গ হয়েছে।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনেও এমনটি হতে পারে। তবে নিঃসন্দেহে যা বলা যায় তা হচ্ছে, এ আইনটি পুরো ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে ফেলছে। কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোকে সুযোগ করে দিয়েছে একত্রিত হওয়ার। এখন বিরোধী দলগুলো নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর কতটুকু চাপ প্রয়োগ করতে পারবে, সেটাই দেখার বিষয়।
Jugantor
21.12.2019

ভারতের গণবিক্ষোভের চূড়ান্ত পরিণতি কী





ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস হওয়ার পর এই আইনের প্রতিবাদে ভারতের সর্বত্র যে গণবিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা কি শেষ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদি সরকারের পতন ডেকে আনবে? ‘আরব বসন্ত’-এর মতো ভারতেও কি ‘ভারত বসন্ত’-এর একটি ক্ষেত্র তৈরি হতে যাচ্ছে? নাগরিক সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে শুধু পশ্চিমবঙ্গ প্রতিবাদী হয়েছে। সেই ‘চেনা-জানা’ মমতা ব্যানার্জি, সাধারণ একটি সুতির শাড়ি আর পায়ে চপ্পল পরে কর্মীদের নিয়ে কয়েক মাইল রাস্তা হেঁটে এই আইনের প্রতিবাদ জানালেন। মিছিলে তার সেই ছবি ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে তার বক্তব্য। সেখানে তিনি বলেছেন, নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন তালিকা (এনআরসি) বাস্তবায়ন করতে হলে তার মৃতদেহের ওপর দিয়ে তা করতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, যতদিন তিনি বেঁচে আছেন, পশ্চিমবঙ্গে তিনি নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি হতে দেবেন না। তিনি যখন এই আইনের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন, তখন হাজার হাজার মানুষ তার সঙ্গে পথে নেমেছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ কেন বলি? নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঢেউয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিসহ অন্তত ১০টি রাজ্যের ১৩টি শহর। আন্দোলন দমাতে পুলিশের গুলিতে কর্নাটকের মেঙ্গালুরুতে দুজন ও লক্ষেèŠতে একজন নিহত হয়েছেন। এছাড়া কারফিউ জারি করা হয়েছে মেঙ্গালুরুতে। আরও অবাক হওয়ার কথা মেঙ্গালুরুতে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে জমায়েত থেকে আটক হয়েছেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ। দিল্লিতে আটক হয়েছেন প্রখ্যাত সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি, বৃন্দা কারাট ও উমর খালেদের মতো নেতা। তবে বিক্ষোভ শািন্তপূর্ণ ছিল কলকাতা, চেন্নাই ও মুম্বাইয়ে। হাজার হাজার লোকের মিছিলে দাবি উঠেছে ‘আমরা কি সমান’? ‘আমরা কি ধর্মনিরপেক্ষ’? মিছিল থেকেই জবাব এসেছে, ‘হ্যাঁ’। ভারতের বিহারেও হিন্দু-মুসলমানরা একত্রিত হয়ে বিশাল মিছিল করেছে। গত ১১ ডিসেম্বর এই আইনটি কার্যকর হয়েছে। এর পর থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছে পুরো ভারত।

পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেলে মমতা ব্যানার্জির মতো নেতা বলতে পারেন ‘রাষ্ট্রপুঞ্জ গণভোট করাক ভারতে’। কত বড় কথা? মানুষ কোন পর্যায়ে গেলে এ ধরনের দাবি উত্থাপন করতে পারে? সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা (সিএএ) ভারতবর্ষে কার্যকর হবে কি না, সে ব্যাপারে জাতিসংঘকে একটি গণভোটের আয়োজন করার আহ্বান জানিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। যদিও জাতিসংঘ এটা পারে না এবং সংস্থাটির এই এখতিয়ারও নেই। তবুও মমতার এই দাবি প্রমাণ করে ভারতের বর্তমান সংকটের গভীরতা কত বেশি। মমতা ব্যানার্জির পাশাপাশি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা গ্রেগরি স্টানটন। তিনি বলেছেন, ‘ভারতে নিশ্চিতভাবেই গণহত্যার পূর্ব প্রস্তুতি চলছে। আসাম ও কাশ্মীরে যে নিপীড়ন চলছে, তা গণহত্যার ঠিক পূর্ববর্তী স্তর। এর পরের স্তরই হচ্ছে সম্পূর্ণরূপে নিধন, যাকে গণহত্যা বলা হয়।’ (দ্য উইক, ১৪ ডিসেম্বর)। তিনি ১২ ডিসেম্বরে ওয়াশিংটনে একটি অনুষ্ঠানে এ ধরনের মন্তব্য করেন। ড. স্টানটন একসময় যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন। তিনি বিখ্যাত তার  ‘Ten stages of Genocide’ তত্ত্বের জন্য (Sabrang, 14 December)। হয়ত অনেকেই ড. স্টানটনের সঙ্গে একমত হবেন না। ভারতে যা হচ্ছে, তাকে ‘গণহত্যা’ বলা যাবে কি না, তা বিতর্কের বিষয়।


তবে বলাবাহুল্য, ভারতে নরেন্দ্র মোদি একের পর এক যেমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তা তাকে শুধু বিতর্কিতই করেনি, বরং ভারতের ভাবমূর্তিও তাতে নষ্ট হচ্ছে। ভারতের সেন্টার ফর কনটেম্পোরারি সাউথ এশিয়ার পরিচালক আশুতোষ ভারশো ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে আন্তর্জাতিক ড়্গেত্রে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষণ্ন হবে।’ মিথ্যা বলেননি তিনি, ইতিমধ্যে মার্কিন সিনেটরদের কেউ কেউ যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা ভারতের গণতান্ত্রিক চর্চার সঙ্গে মানানসই নয়। গণতন্ত্রের নামে একদলীয় চিন্তাচেতনা সাধরণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। প্রসঙ্গক্রমে আমরা প্রণব মুখার্জির একটি মন্তব্য উল্লেখ করতে পারি। তিনি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি। তিনি ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। এখন তিনি অবসরে। ভারতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দেশটি যখন বড় ধরনের বিক্ষোভের মুখে পড়েছে, তখন গত ১৬ ডিসেম্বর নয়াদিল্লির ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের দপ্তরে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা মানে যা খুশি করা নয়। ভারতে নানা ধর্ম-বর্ণ সম্পªদায় রয়েছে। গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদের এই পরিবেশ যেন লিঙ্ঘত না হয়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’ স্পষ্টতই তার ইঙ্গিত কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের দিকে। তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা হচ্ছে– ভারতে সাম্পªতিক সময়গুলোতে যা হচ্ছে তা গণতন্ত্রের মূল স্পিরিটের পরিপন্থী। গণতন্ত্রে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার কথা শেখায়। গণতন্ত্র হচ্ছে অপরকে আস্থায় নেওয়া। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠরা শাসন করে বটে, কিন্তু এই শাসন নিশ্চিত হয় বিরোধী পক্ষকে আস্থায় নিয়েই। সারা বিশ্বের মানুষ ভারতের এই গণতান্ত্রিক চরিত্রকেই দেখে এসেছে গত প্রায় ৭২ বছর। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় জমানায় (২০১৯) এক ভিন্ন ভারতকে দেখছে বিশ্ব। সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামে উগ্র দলীয় চিন্তাচেতনা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার পরিপন্থী। সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এ কথাটাই বলতে চেয়েছেন।

ভারতের রাজনীতিতে প্রণব মুখার্জির স্থান অনেক উঁচুতে। ভারতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিতে তিনি জড়িত থাকলেও, সর্ব ভারতীয় মহলে তার একটি গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। অনেক শীর্ষ স্থানীয় বিজেপি নেতা তাকে সম্মানের চোখে দেখেন। সুতরাং ভারতের বর্তমান সংকটের সময় তিনি যখন এ ধরনের একটি কথা  বলেন, তা গুরুত্ব পায় বৈকি। সঙ্গত কারণেই তার এই বক্তব্যের পেছনে একটি ‘ইতিহাস’ রয়েছে– আর তা হচ্ছে বর্তমান ভারতের কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার খোদ ভারতের মৌলিক আদর্শকে বদলে দিতে চাচ্ছে! এর শুরুটা হয়েছিল প্রথমে আসাম থেকে। যখন আসামের নাগরিকপঞ্জির উদ্যোগ নেওয়া হলো, অর্থাৎ আসামে দীর্ঘদিন ধরে যারা শাসন করে আসছেন এবং যারা বাংলায় কথা বলেন, তারা আদৌ ভারতীয় নাগরিক কি না–তা যাচাইবাছাই করে দেখে একটা তালিকা তৈরি করা হয়; যারা ভারতের নাগরিক। এই তালিকায় যাদের নাম থাকবে না বা নেই, তাদেরকে ‘অবৈধ বসবাসকারী’ হিসেবে ঘোষণা করা। এখানে টার্গেট করা হয়েছে বাঙালি মুসলমানদের এবং বলা হচ্ছে এরা বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসে ‘অবৈধভাবে’ ভারতে বাস করছেন। ওই নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি বাংলাদেশে বড় ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করলেও, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একাধিকবার আশ্বাস দিয়েছেন এনআরসি নিয়ে বাংলাদেশের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আমরা নরেন্দ্র মোদির কথায় আস্থা রাখতে পারছি বলে মনে হচ্ছে না। আসামে এনআরসি নিয়ে বিতর্কের যখন অবসান হলো না, তখন দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি নিলেন মোদি সরকার কাশ্মীরের সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করে দিয়ে। সেখানে কেন্দ্রের শাসন এবং জম্মু ও কাশ্মীর থেকে লাদাখকে বের করে আলাদা কেন্দ্রের শাসনে পরিচালনা করা। ভারতের সংবিধানে ৩৭০ ধারা নামে একটা ধারা ছিল। এই ধারা বলে কাশ্মীরের অধিবাসীরা ভারতীয় কাঠামোয় বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন। ভারতের সংবিধান প্রণেতারা এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, বিভিন্ন জাতি-উপজাতি, ধর্ম ও বর্ণে বিভক্ত ভারতকে এক রাখতে হলে কোনো কোনো অঞ্চলকে ও জনগোষ্ঠীকে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। কাশ্মীরসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো এই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। এখন কাশ্মীর থেকে সেই সুযোগ-সুবিধা সংসদে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাতিল করা হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মুসলমানরা। তারা সেখানে শুধু চাকরি হারানোর ঝুঁকিতেই নেই, রবং মুসলমানরা নিজ এলাকায় ‘দ্বিতীয় শ্রেণির’ নাগরিকে পরিণত হওয়ার একটা আশঙ্কার মাঝে আছেন। একই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতেও।


নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটি পাস হওয়ার পর যেভাবে সারা ভারত উত্তাল হয়ে উঠেছে এবং বিক্ষোভ এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ছে, তাকে কি আমরা ‘ভারত বসন্ত’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি? অর্থাৎ এই বিক্ষোভ কি শেষ পর্যন্ত এক দফা, অর্থাৎ মোদি সরকারের পতনের ডাকে সীমাবদ্ধ হবে? এটা ঠিক ‘আরব বসন্ত’-এর সঙ্গে বর্তমানে ভারতে যে গণবিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তা মেলানো যাবে না। ভারতে সরকার পরিবর্তিত হয় গণতান্ত্রিক পন্থায়। অর্থাৎ জনগণের ভোটে সরকারের পরিবর্তন হয়। কিন্তু ২০১১ সালে সারা আরব বিশ্বে যে গণঅভু¨ত্থানের সৃষ্টি হয়েছিল, যাকে ‘আরব বসন্ত’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, সেখানে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে স্বৈরাচারী সরকার উৎখাত ছিল মূল লক্ষ¨। একজন বেকার কম্পিউটার গ্র্যাজুয়েট বউকুজিজি নিজের শরীর আগুন লাগিয়ে যে প্রতিবাদ করেছিলেন, তা পরিণামে তিউনেসিয়ায় বেন আলী, মিসরে হোসনি মোবারক, ইয়েমেনে আবদুল্লাহ সালেহর পতন ডেকে এনেছিল।

আরব দেশগুলোর রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসেরও মিল পাওয়া যাবে না। তবে, একটা মিল আছে– আর তা হচ্ছে জনঅস‡ন্তাষ। এই জনঅসন্তোষ আরব দেশগুলোতে ছিল, এখন ভারতেও এই অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। অর্থনীতিতে বড় ধরনের মন্দার  মুখে পড়তে যাচ্ছে ভারত। দেশটির প্রাক্তন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামানিয়ান সম্পªতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত একটি সেমিনারে বলেছেন, যে মন্দার মুখ দেখছে ভারত, তা কোনো সাধারণ মন্দা নয়। এটা হলো ভারতের অন্যতম বৃহৎ আকারের অর্থনৈতিক মন্দা। ভারতের অর্থনীতি এখন আইসিইউর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে (ie bangla, ১৮ ডিসেম্বর)। একজন বড় অর্থনীতিবিদ যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন এটাকে হালকাভাবে নেওয়া যায় না। ভারতের এই গণবিক্ষোভ শেষ পর্যন্ত মোদি সরকারের ওপর কতটুকু চাপ প্রয়োগ করতে পারবে, বলা মুশকিল। তবে তার সরকার যে খুব একটা স্বস্তিতে নেই, তা বলাই বাহুল্য।
Daily Desh Rupantor
21.12.2019

কোন পথে ভারত

 ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার পর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোসহ পুরো দেশে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে, তা একটি বড় প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। তা হচ্ছে কোন পথে এখন ভারত? আগস্টে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর আমরা যে প্রতিক্রিয়া দেখেছিলাম, সেই একই ধরনের প্রতিক্রিয়া আমরা দেখছি ভারতের আসাম আর মেঘালয়ে। গত শনিবারের খবরÑ উত্তাল আসামের অলিগলিতে সেনা। মেঘালয়ে কারফিউ। পুলিশের গুলিতে আসামে মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচ। আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে কেরালা ও পাঞ্জাব। বলা হয়েছে, এ দুটি রাজ্যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ব্যবহার হবে না। এ আইনের বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন গণআন্দোলনের ডাক দিয়েছেন, ঠিক তখনই জাপানের প্রধানমন্ত্রী তার ভারত সফর বাতিল করেন। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে কিছু রাজ্যে যে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা ছড়িয়ে গেছে পুরো ভারতবর্ষে। এ আন্দোলনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছেÑ
এক. ভারতের বিজেপি সরকার এই সংশোধনী বিলটি সংসদের উভয় কক্ষে (লোকসভা ও রাজ্যসভা) পাস করালেও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোয় (ত্রিপুরা, আসাম, মনিপুর) স্থানীয় জনগণ এই আইনের বিরুদ্ধে। অথচ এরাই স্থানীয় বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে বিজয়ী করেছিল। এরা লোকসভা নির্বানেও (মে ২০১৯) বিজেপিকে সমর্থন করেছিল। এখন তারা বিজেপির একটি নীতিগত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে।
দুই. ভারতে এই প্রথমবারের মতো ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। অতীতে এমনটা দেখা যায়নি। গত রবিবার দক্ষিণ দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছিল, তখন পুলিশ তাদের ওপর হামলা করে। ছাত্রদের মারধর করে। এর প্রতিবাদে দিল্লির জওহরলাল নেহরু, আলীগড়, আইআইটি বেঙ্গালুরু, মুম্বাইয়ের টিআইএমএস, বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়সহ নামকরা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ হয়েছে। এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে গেছে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে। সোমবার সমর্থকদের নিয়ে রাস্তায় মিছিল করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই সময় তিনি বলেছেন, নাগরিকত্ব আইন ও জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন তালিকা (এনআরসি) বাস্তবায়ন করতে হলে তার মৃতদেহের ওপর দিয়ে করতে হবে। মমতা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, যতদিন তিনি বেঁচে আছেন, পশ্চিমবঙ্গে তিনি নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি হতে দেবেন না। নাগরিকত্ব আইনবিরোধী অবস্থানের কারণে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জয়দীপ ধনগড়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। রাজ্যপাল তাকে বৈঠকে ডাকলেও তিনি উল্টো রাজ্যপালকে পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল করার অভিযোগ তুলে চিঠি দিয়েছেন। ইতোমধ্যে বিজেপির কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিনহা পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন চালু করার হুমকি দিয়েছেন। ভারতের বেশ কয়েকটি বড় দল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। কংগ্রেস, সিপিএম, আমআদমিসহ আঞ্চলিক দলগুলোও বিজেপির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। স্পষ্টতই ওই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পুরো ভারত কর্তৃক বিভক্ত করে ফেলেছে।
নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর ভারতের পরিস্থিতি পুরো পাল্টে যায়। বিশেষ করে কাশ্মীরের ব্যাপারে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করার পর পরিস্থিতি সেখানে অবনতি ঘটে। ৩৭০ অনুচ্ছেদ ছিল কাশ্মীরিদের জন্য আলাদা একটা রক্ষাকবচ। এই ধারাবলে কাশ্মীরিরা বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। সেই বিশেষ সুযোগ এখন বাতিল করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়। লাদাখকে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে আলাদা করা হয়েছে। লাদাখ এখন কেন্দ্রশাসিত একটি অঞ্চল। গত আগস্টে কেন্দ্র সরকার যখন কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনসংক্রান্ত সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদটি বাতিল করে, তখনই মোদি সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। বলা হচ্ছিল, মোদি সরকার ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। এর পরই সরকার সংবিধানের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি পাস করল।
ভারতের নাগরিকত্বসংক্রান্ত বিষয়টি সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট, ১৯৫৫-এর সঙ্গে জড়িত। পরে ১৯৮৬ সালে, ১৯৯২ সালে, ২০০৩, ২০০৫ ও ২০১৫ সালে তাতে কিছু কিছু পরিবর্তন আনা হয়। তবে এবার যে পরিবর্তন আনা হলো, তা মূল কাঠামোকে পরিপূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে। এখন মুসলমান ধর্মাবলম্বী কেউ ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করতে পারবেন না। অথচ হিন্দু ধর্মসহ অন্য ধর্মাবলম্বীরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন এবং তাদের নাগরিকত্বের আবেদন বিবেচনা করা হবে। সংবিধানের নাগরিকত্বসংক্রান্ত অনুচ্ছেদে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে ভারত সরকার মূলত ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের একটা ব্যবধান তৈরি করল। প্রশ্ন হচ্ছে এই সংশোধনী ভারতের সংবিধানের পরিপন্থী কিনা?
সংবিধানের অনেকগুলো ধারা ও প্রস্তাবনা (চৎবধসনষব) সংবিধানের এই সংশোধনীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংবিধান পরিপন্থীও বটে। ভারতের সংবিধানের ১৪নং আর্টিকেলটি এই সংশোধনীর পরিপন্থী। এই আর্টিকেলে সমতার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বিভক্তি আনা যাবে না, সবাই সমান। এখানে বলা আছে, ঞযব ংঃধঃব ংযধষষ হড়ঃ ফবহু ঃড় ধহু ঢ়বৎংড়হ বৎসড়ষরঃু নবভড়ৎব ষধি ড়ৎ ঃযব ষধংি রিঃযরহ ঃযব ঃবৎৎরঃড়ৎু ড়ভ রহফরধ। রাষ্ট্র কাউকে তার সমঅধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। কিন্তু সংশোধনী এনে নাগরিকত্বের প্রশ্নে সমঅধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। আমরা সংবিধানের প্রস্তাবনার কথাও উল্লেখ করতে পারি। প্রস্তাবনায় ভারত সম্পর্কে বলা হয়েছেÑ ধ বিষ ভধৎব ংঃধঃব পড়সসরঃঃবফ ঃড় ংবপঁৎব লঁংঃরপব ষরনবৎঃু ধহফ বয়ঁধষরঃু ভড়ৎ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ধহফ ভড়ৎ ঢ়ৎড়সড়ঃরহম ভৎধঃবৎহরঃু ফরমহরঃু ড়ভ ঃযব রহফরারফঁধষ ধহফ ঁহরঃু ধহফ রহঃবমৎরঃু ড়ভ ঃযব হধঃরড়হ। এখানে ঁহরঃু ও রহঃবমৎরঃু’র কথা, অর্থাৎ ঐক্য ও সংহতির কথা বলা হয়েছে। ওই সংশোধনী ঐক্য ও সংহতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা সংবিধানের আরও কয়েকটি ধারা উল্লেখ করব। যেমন সংবিধানের ৫নং ধারা যেখানে বলা হয়েছে, ভারত হবে একটি ঝবপঁষধৎ ংঃধঃব ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু সংবিধানের নাগরিকত্ব সংশোধনী ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের পরিপন্থী। এই ধারায় প্রতিটি ধর্মের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংবিধান সংশোধনী ইসলাম ধর্মের সমস্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের পার্থক্য সৃষ্টি করা হয়েছে, যা সংবিধানের পরিপন্থী। সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে পাঁচটি মৌলিক মানবাধিকারের (ঋঁহফধসবহঃধষ জরমযঃং) কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র এই মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেবে। এখানে ৩নং উপধারায় আছেÑ জরমযঃ ধমধরহংঃ ঊীঢ়ষড়রঃধঃরড়হ, ৪নং উপধারায় আছে জরমযঃ ঃড় ঋৎবফড়স ড়ভ জবষরমরড়হ-এর কথা। এখন একজন নাগরিক, যিনি ভারতের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করবেন, কিন্তু তিনি মুসলমান হলে পারবেন না। কিন্তু সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদ তাকে সেই অধিকার দিয়েছে। সুতরাং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে সুপ্রিমকোর্টে যে রিট হয়েছে, তা যুক্তিযুক্ত বলে আমি মনে করি। কেরালায় মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই ভিজয়ান বলেছেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সংবিধান পরিপন্থী। সুতরাং কেরালায় এটা কার্যকরী হবে না বলেও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এনআরসি রুখতে গণআন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। আসামে এনআরসি হলেও পশ্চিমবঙ্গে কোনো এনআরসি হবে নাÑ এটা জানাতেও তিনি ভোলেননি। পাঞ্জাব সরকারও ওই আইন প্রত্যাখ্যান করেছে।
ফলে স্পষ্টতই এই এনআরসি কিংবা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ভারতকে বিভক্ত করে ফেলেছে। মজার ব্যাপার, আসাম ও ত্রিপুরায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার রয়েছে। মনিপুরেও রয়েছে বিজেপি সরকার। তা হলে এই অঞ্চলগুলো অশান্ত কেন? এর কারণ হচ্ছে, এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ মনে করে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস হওয়ার ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক সংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর পুনর্বাসন হবে। বাংলা ভাষাভাষীদের সংখ্যা এতে বৃদ্ধি পাবে। এই অঞ্চলে উপজাতীয়দের যে জমিজমা ছিল, তা হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা কিনে নেবে। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। এর মধ্য দিয়ে উপজাতীয়রা এ অঞ্চলে যে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পেত, তা বাতিল হয়ে যাবে। আসামের ক্ষেত্রে ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ও ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত ‘আসাম মুভমেন্ট’-এর সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেই সমঝোতা মুখ থুবড়ে পড়বে। এ অঞ্চলে বাংলা ভাষীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে এ অঞ্চলের ভারসাম্য নষ্ট হবে। তাদের আপত্তিটা এ কারণেই।
প্রথমে ভারতের আসামে এনআরসি, এরপর কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার-সংবলিত সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল, এরপর নাগরিক আইন সংশোধন করে পুরো ভারতের রাজনৈতিক চরিত্র বদলে দিতে চাচ্ছে মোদি সরকার। একসময় ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের যে ‘চরিত্র’, সেই চরিত্র এখন বদলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে ভারত একটি হিন্দু রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে ভারতজুড়ে যখন বিক্ষোভ চলছে, ঠিক তখনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেছেন, চার মাসের মধ্যেই অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণকাজ শুরু হবে। ভারত যে কীভাবে বদলে যাচ্ছে, এটা তার বড় প্রমাণ। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিতর্কে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে বটে, কিন্তু ভারতের ২০ কোটি মুসলমান এই রায়ে তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এমনই এক পরিস্থিতিতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন করে ভারতের মুসলমানদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণি’র নাগরিকে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছে বিজেপি সরকর। এর মধ্য দিয়ে মোদি সরকার রাজনৈতিকভাবে ‘সুবিধা’ লাভ করতে পারবে বটে, কিন্তু বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হবে। এমনিতেই কাশ্মীরেও অসন্তোষ রয়ে গেছে। সেখানকার নেতৃবৃন্দ এখনো অন্তরীণ। উত্তর-পূর্ব ভারতও আশঙ্কা করছে ‘কাশ্মীরের মতো’ পরিস্থিতির। সংবিধানে তারা যে সুযোগ-সুবিধা পায়, তাও বাতিল হতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা। আবার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের কারণে আদিবাসীরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা করছে। ফলে ওই অঞ্চলের ক্ষমতায় বিজেপি সরকার থাকলেও স্থানীয় মানুষজন চলে গেছে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে। এ পরিস্থিতি কীভাবে মোদি সরকার সামাল দেবে কিংবা শেষ পর্যন্ত সংসদে পাস হওয়া বিলে (যা ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর আইনে পরিণত হয়েছে) কোনো সংশোধনী আনবে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
Daily Amader Somoy
19.12.2019

তিনি এলেন, কিন্তু জয় করতে পারলেন না

 তিনি এলেন, কিন্তু জয় করতে পারলেন না। তিনি অং সান সু চি, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী, এক সময়ের গণতন্ত্রের নেত্রী। তিনি এসেছিলেন দ্য হেগে, ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস বা আইসিজেতে।
কোনো সাক্ষ্য দিতে নয়, বরং মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটে যে গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেছিল এবং সেখানে ওইসব ‘কর্মকাণ্ডের’ জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তিনি এসেছিলেন তাদের পক্ষে কথা বলার জন্য। সত্যকে স্বীকার করার জন্য অপর আটজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী যখন তাকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তখন নির্লজ্জের মতো কোর্টে মিথ্যাচার করে গেলেন তিনি।
একজন মানুষ, যিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, সংসারের সুখ পাননি, বছরের পর বছর দুই পুত্রসন্তানের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিলেন, ভালোবেসে যাকে বিয়ে করেছিলেন সেই মাইকেল এরিসের মৃত্যুশয্যায়ও (১৯৯৯) তার পাশে থাকতে পারেননি, তিনি, অং সান সু চি মিথ্যাচার করে গেলেন দ্য হেগে।
অথচ আজ থেকে ২৯ বছর আগে ১৯৯১ সালের ১০ ডিসেম্বর নরওয়ের অসলোতে তার অবর্তমানে তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। ওই সময় তিনি ছিলেন গৃহবন্দি। ২৯ বছর আগে নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটির চেয়ারম্যান সু চির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। কী বৈসাদৃশ্য!
২৯ বছর পর ঠিক এই দিনে, ১০ ডিসেম্বর তিনি এসেছিলেন আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে। আর তার ঠিক পরদিন তিনি নগ্নভাবে মিথ্যাচার করে গেলেন। ১০ ডিসেম্বর সু চি যখন আইসিজের আদালতে এসেছিলেন, তিনি ছিলেন ভাবলেশহীন; পাথরের মূর্তির মতো বসে ছিলেন। আর শুনছিলেন গাম্বিয়ার আইনজীবীদের বক্তব্য।
তারা বলছিলেন, সু চির দফতরের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে রোহিঙ্গা ধর্ষণের অভিযোগকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তার দফতর থেকে ‘ফেক রেপ’ (ভুয়া ধর্ষণ) নামে একটি ফেসবুক পেজ খোলা হয়েছে।
এর কোনো জবাব ছিল না সু চির কাছে। তিনি কি ইতিহাসের আরেক ‘খলনায়কে’ পরিণত হলেন? সেনাবাহিনীর বর্বরতার পক্ষে অবস্থান নেয়া সু চি নিজের নামের প্রতি সম্মান দেখাতে পারলেন না।
তিনি দীর্ঘদিন ছিলেন কারা অন্তরালে। এই সেনাবাহিনীই তাকে কারাগারে পাঠিয়েছিল। দীর্ঘদিন বিদেশে বসবাস করা এবং ১৯৭২ সালে এক বিদেশিকে বিয়ে করার পর ১৯৮৮ সালে দেশে ফিরে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল অসুস্থ মাকে দেখাশোনা করা। এরপরই তিনি রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন।
মিয়ানমারে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে তার একক সংগ্রাম এবং মিয়ানমারকে একটি গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যাপারে তার ভূমিকা প্রশংসিত হলেও রোহিঙ্গা গণহত্যায় নির্লিপ্ত থাকা এবং সেনাবাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেয়ার কারণে তিনি বিতর্কিত হন। যেখানে শান্তির জন্য তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন, সেখানে নিজ দেশে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হন। এমনকি দ্য হেগে তিনি যখন সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গান, তখন তার ‘সব অর্জন’ ম্লান হয়ে যায়। তিনি পরিণত হন নিন্দা ও ধিক্কারের পাত্রে।
তিনি আদালতে বলেছেন, রাখাইনে সামরিক বাহিনীর ওপর সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে সহিংসতার সৃষ্টি হয়েছিল এবং ‘কিছু লোক’ কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে! কী ভয়ংকর মিথ্যাচার! সত্য হল, সামরিক বাহিনীর ওপর কোনো হামলা হয়নি। কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়ির ওপর আরসা নামের একটি জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলার খবর মিয়ানমারের সরকারি মিডিয়া থেকে প্রচার করা হয়েছিল।
বাস্তবতা হচ্ছে, অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের তাদের ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা যে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে, এ ছবি স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা হয়েছিল। এখনও এসব ছবি ইন্টারনেটে পাওয়া যায়।
সুতরাং তিনি যখন ‘সেনাবাহিনীর ওপর সন্ত্রাসী হামলার কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা দেশত্যাগ করেছেন’ বলে মন্তব্য করেন, তখন তার সেই যুক্তি ধোপে টেকে না। আদালতে তিনি বলেছেন, ‘রাখাইনের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের (রোহিঙ্গা শব্দটি তিনি ব্যবহার করেননি) বিতাড়নের বিষয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধ হলেও গণহত্যা নয়। এটিও মিথ্যা কথা।
কারণ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে ৪৪৪ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে বলা হয়, হত্যা, গণধর্ষণ, শারীরিক লাঞ্ছনার ব্যাপক প্রমাণ রয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যাবিষয়ক বিচারের আওতায় পড়ে।
শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তাদের নাম উল্লেখ করে তদন্ত ও বিচারের কথা বলা হয়েছিল ওই প্রতিবেদনে। সু চি এখন সেই প্রতিবেদনকেও অস্বীকার করলেন! এটি মিথ্যাচার এবং সত্যকে অস্বীকার করার শামিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, যুক্তরাষ্ট্র সরকার সম্প্রতি চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য মিয়ানমারের চার জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
সু চি আদালতকে এ কথাও বলেছেন যে, মিয়ানমারে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার বিচার হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ১৯৪৮ সালের গণহত্যা সনদে মিয়ানমারের বিচার প্রযোজ্য নয়। এটিও ভুল ব্যাখ্যা ও মিথ্যাচার। মিয়ানমারে গণহত্যা হয়েছে এবং জাতিসংঘের অনুসন্ধানে তা প্রমাণিত হয়েছে।
সুতরাং ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশন এখানে প্রযোজ্য। কনভেনশনের ৩নং অনুচ্ছেদে কোন ধরনের অপরাধ শাস্তিযোগ্য তা উল্লেখ করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২-এ উল্লেখিত ‘অপরাধের’ ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘গণহত্যা’, ‘ষড়যন্ত্র করে হত্যা’, ‘উত্তেজনা সৃষ্টি করে হত্যা’, কিংবা ‘কু-কর্মের সহযোগিতায় হত্যা’ ইত্যাদি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং ‘জেনোসাইড কনভেনশনের’ ১নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সুতরাং রাখাইনে যে ‘অপরাধ’ সংঘটিত হয়েছে তা সু চি অস্বীকার করেন কীভাবে?
সু চি আদালতকে আরও বলেছেন, রাখাইনের সংঘাতকে আরও গভীর করতে পারে এমন কিছু আইসিজের করা উচিত নয়। এ বক্তব্য আদালতের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপের শামিল। আদালত ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের কথায় চলে না। আদালত চলে সত্য ঘটনার ওপর। রাখাইনে গণহত্যা হয়েছে। ধর্ষণ হয়েছে। বড় ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। তদন্তে তা প্রমাণিতও হয়েছে। ‘জেনোসাইড কনভেনশন’ অনুযায়ী তাই বিচার হচ্ছে।
সু চি আরেকটি মিথ্যাচার করেছেন, যখন তিনি আদালতকে বলেন, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করছে! কী চরম মিথ্যাচার!
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে বটে; কিন্তু তা লোক দেখানো। বিভ্রান্তিকর। একজন লোকও ওই ‘প্রত্যাবাসন চুক্তি’ অনুযায়ী মিয়ানমারে ফেরত যায়নি। উপরন্তু নানা ফন্দি-ফিকির করে এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করা হচ্ছে। প্রত্যাবাসনের জন্য যে ‘ফরম’ সরবরাহ করা হয়েছে, তা বিভ্রান্তিকর ও জটিল। রোহিঙ্গারা এই ‘ফরম’ প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফলে তারা ফেরত যেতে চাচ্ছেন না।
অথচ সু চি আদালতকে বললেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ রাজি হয়েছে! এটি ভুল তথ্য। চুক্তি হয়েছে বটে, তবে নিজ নাগরিকদের ফেরত নেয়ার দায়িত্ব মিয়ানমারের। বলা ভালো, গাম্বিয়া আইসিজেতে যে মামলা করেছে তাতে সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি। অভিযোগ আনা হয়েছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।
গাম্বিয়া প্রাথমিকভাবে যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছে, তাতে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। ১. সেখানে, অর্থাৎ রাখাইন স্টেটে, গণহত্যা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া; ২. সেনাবাহিনী কিংবা কোনো প্যারামিলিশিয়া বাহিনী সেখানে যাতে আর গণহত্যা না চালায়, তার ব্যবস্থা নেয়া; ৩. রাখাইনে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, সেই গণহত্যা সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ নষ্ট না করা; ৪. বর্তমান পরিস্থিতি আরও যাতে জটিল না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা।
গাম্বিয়া এ ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ চেয়েছে। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে, এর কোনো একটির ব্যাপারেও মিয়ানমার সরকারের আপত্তি থাকার কথা নয়। রাখাইনে ব্যাপক গণহত্যা হয়েছে, এটা মিয়ানমার স্বীকার না করলেও সেখানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, এটা তারা স্বীকার করে।
সু চি কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার বিচারের কথা বলে পরোক্ষভাবে গণহত্যার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি পরোক্ষভাবে আদালতে এটা বলার চেষ্টা করেছেন যে, সেখানে হত্যা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। এ কথা বলে আইসিজের বিচার বন্ধ করা যায় না। ২০১৭ সালের আগস্টের পর বড় ধরনের কোনো গণহত্যা হয়নি, এর আভাস দিয়েছেন সু চি।
গণহত্যার প্রমাণ ধ্বংস না করার কথা আবেদনে বলা হয়েছে। কিন্তু এটা কি অনেক দেরি হয়ে গেল না? মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তো সব প্রমাণ ইতিমধ্যে ধ্বংস করে ফেলেছে। রোহিঙ্গাদের আদি বাড়িঘরের কোনো অস্তিত্ব নেই। বুলডোজার দিয়ে তা ধ্বংস করা হয়েছে। ওইসব অঞ্চল এখন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
সুতরাং সু চি আদালতে কী বলবেন, তা সবারই জানা। কেউ তদন্ত করতে গেলেও সেখানে কোনো আলামত খুঁজে পাবে না। তবে সু চি আদালতকে আশ্বস্ত করেননি যে এ ধরনের ‘ঘটনা’ আর ঘটবে না। এ ক্ষেত্রে আইসিজের কিছু করার থাকবে কিনা, সেটাও একটা প্রশ্ন।
আইসিজেতে করা মামলার রায় কী হবে আমরা তা জানি না। মামলা করার সঙ্গে সঙ্গেই যে রায় পাওয়া যাবে তেমনটি নয়। চূড়ান্ত রায় পেতে আমাদের অনেক সময় লাগবে। তবে স্পষ্টতই এই মামলার রায় যাই হোক, এ মুহূর্তে আমাদের আশাবাদী হওয়ার মতো তেমন কিছু ঘটবে না। আইসিজে ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত নিতে বলতে পারে না। তাদের কর্মপরিধিতে এমনটি নেই। উপরন্তু গাম্বিয়ার উপস্থাপনায়ও এমনটি নেই।
দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারে ১৯৮২ সালে যে আইনটি পাস হয়েছে (1982 Citizenship Low), এর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করা হয়েছে। সংঘাতের মূল সমাধান এখানে নিহিত। কিন্তু আইসিজে এ ব্যাপারে কোনো মতামত দিতে পারে না। সব মিলিয়ে মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রশ্নে এক ধরনের ‘চাপে’ আছে।
অং সান সু চি নিজে দ্য হেগের আদালতে উপস্থিত থেকে এই ‘চাপ’ কমাতে পারেননি। বরং বিতর্কিত হলেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষমতাবান জেনারেল মিন আউং হ্লাইংয়ের স্বার্থরক্ষা করে ২০২০ সালের নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাচ্ছেন বটে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মিয়ানমারের সংবিধান সংশোধনীতে সেনাবাহিনী সায় দেবে না এবং তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তির সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
গাম্বিয়ার প্রতিনিধি আদালতকে ওই সময়কার রোহিঙ্গা হত্যা ও নির্যাতনের কথা আদালতকে বলেছেন। আদালতের ১৭ জন বিচারপতি এসব বিষয়ে অবগত আছেন। রায়ে যাই বলা হোক না কেন, আইসিজের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। আইসিজে নিজে কোনো ‘রায়’ বাস্তবায়ন করতে পারে না। রায় বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিতে হবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে। ফলে আইসিজেতে যে মামলাটি হয়েছে, তার রায় আমাদের সন্তুষ্ট নাও করতে পারে।
তবে নিঃসন্দেহে এটা বলা যায়, মামলা করার মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের নৈতিক পরাজয় হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমার আজ ‘অপরাধী’। আন্তর্জাতিকভাবে ধিকৃত ও শাস্তিযোগ্য অপরাধে অপরাধী মিয়ানমারের জেনারেলদের পক্ষাবলম্বন করায় অং সান সু চি আজ নিজেও অপরাধী। তার জন্য একটি ‘সুযোগ’ তৈরি হয়েছিল। তা তিনি নিতে পারলেন না।
Jugantor
14.12.2019

আইসিজেতে গাম্বিয়ার মামলা ও কিছু প্রশ্ন

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে দ্য হেগে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) যে মামলার শুনানি শুরু হয়েছে, সেই শুনানি চলবে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। অর্থাৎ আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আদালত উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনবেন। গাম্বিয়া ওআইসির পক্ষ হয়ে এই মামলাটি দায়ের করে। রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে গাম্বিয়া কোনোভাবেই জড়িত নয়। কিন্তু ওআইসির সদস্য হিসেবে ওআইসির পক্ষ থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল গাম্বিয়াকে এই মামলাটি করার। প্রথম দিকে মিয়ানমার এই মামলায় লড়বে না বলে জানিয়ে দিলেও পরে দেখা গলে সে দেশের স্টেট কাউন্সেলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চি নিজেই এই মামলার শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। তিনি বুধবার আদালতে তাঁর বক্তব্য পেশ করেছেন। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এই মামলা অনেক বিষয়কে এখন সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথমত, মামলা যখন হয়েছে তখন একটি রায় অবশ্যই পাওয়া যাবে। কিন্তু এই রায়ে বাংলাদেশের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হবে? দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে যে সব মিলিয়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে, তারা কি আদৌ নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে? তৃতীয়ত, মিয়ানমারের রাখাইনে গণহত্যার বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু আইসিজে কি গণহত্যার বিচার করতে পারবে? চতুর্থত, আইসিজেতে যে মামলাটি হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ কোনো পক্ষ নয়। তার পরও বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল সেখানে গেছে। পর্যবেক্ষণ ছাড়া প্রতিনিধিদলের করার কিছু নেই। বাংলাদেশের দূতাবাসের মাধ্যমেও এই কাজটি করা যেত।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ই আইসিজের সদস্য। জাতিসংঘ সনদের ৯৩ ধারায় জাতিসংঘের সদস্য প্রতিটি দেশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইসিজের সদস্য। আর ৯৪ ধারা মতে, আইসিজের রায় মানতে প্রতিটি দেশ বাধ্য। এর অর্থ হচ্ছে আইসিজে যে রায়ই দিক না কেন, উভয় দেশই তা মানতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে প্রথম দিনের শুনানিতে গাম্বিয়া তার বক্তব্য যোগ করেছে। প্রথম দিনের শুনানিতে গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবু বকর তামবাদো মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জেনোসাইডের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন। তিনি এসব হত্যাকাণ্ড ও বর্বরতা বন্ধের আহ্বান জানান। ওই সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন অং সান সু চি। সংবাদপত্রের ভাষায় তিনি ছিলেন ভাবলেশহীন। বুধবার তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা বক্তব্য দেন। এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারের প্রাথমিক ধাপ সম্পন্ন হলো। বলা ভালো, গাম্বিয়া আইসিজেতে যে মামলা দায়ের করেছে তাতে বলা হয়েছে, সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়ে মিয়ানমার জাতিসংঘের জেনোসাইড কনভেনশন (১৯৪৮) লঙ্ঘন করেছে। ৪৬ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রের নথি সংযুক্ত করে বলা হয়েছে, দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সামাজিক ভিত্তি ধ্বংস করেছে। হত্যা ও ধর্ষণও করেছে। আজ মিয়ানমার সব ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও বাস্তবতা হচ্ছে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে ৪৪৪ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়—হত্যা, গণধর্ষণ ও শারীরিক লাঞ্ছনার ব্যাপক প্রমাণ রয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা বিষয়ক বিচারের আওতায় পড়ে। শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তাদের নাম উল্লেখ করে তদন্ত ও বিচারের কথা বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। মিয়ানমার সরকার এই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনেও বানোয়াট বলেছিল। এখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা আইসিসি নিয়েও কথা বলা দরকার। রোম স্ট্যাটিটিউট অনুযায়ী আইসিসি গঠিত হয় ২০০২ সালে। ১৯৯৮ সালের ১৭ জুলাই ইতালির রাজধানী রোমে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠনের লক্ষ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এ পর্যন্ত ১২২টি দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। রোম স্ট্যাটিটিউটে চারটি অপরাধকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, genocide বা গণহত্যা, crime against humanity বা মানবতাবিরোধী অপরাধ, war crime বা যুদ্ধাপরাধ এবং crime of aggression বা আক্রমণসংক্রান্ত অপরাধ। মিয়ানমার রোম স্ট্যাটিটিউটে স্বাক্ষর করেনি। তবে আইসিজেতে স্বাক্ষর করেছে। রোম স্ট্যাটিটিউটে স্বাক্ষর না করায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের গণহত্যাকারীদের বিচার করা যাবে কি না—এটা একটা মৌলিক প্রশ্ন।
আইসিজে সাধারণত দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধের মীমাংসা করে থাকে। যেমন বলা যেতে পারে ক্যামেরুন বনাম নাইজেরিয়ার মধ্যকার বিরোধ কিংবা ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়ার মধ্যকার বিরোধের মীমাংসা করেছে আইসিজে। আইসিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে (২২ মে ১৯৪৭) ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত আইসিজে ১৭৭টি মামলার শুনানি শুনেছেন ও রায় দিয়েছেন। আইসিজে জাতিসংঘের একটি সংস্থা এবং সংস্থাটির যেকোনো সিদ্ধান্ত মানতে সদস্যভুক্ত দেশগুলো বাধ্য। এখানে স্পষ্টতই একটি বিষয় লক্ষণীয়—তা হচ্ছে গাম্বিয়া যে মামলা করেছে, তাতে সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে অভিযুক্ত করা হয়নি। অভিযোগ আনা হয়েছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। গাম্বিয়া প্রাথমিকভাবে যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছে, তাতে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। ১. সেখানে, অর্থাৎ রাখাইন স্টেটে গণহত্যা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া; ২. সেনাবাহিনী কিংবা কোনো প্যারামিলিশিয়া বাহিনী সেখানে যাতে আর গণহত্যা না চালায় তার ব্যবস্থা নেওয়া; ৩. রাখাইনে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, সেই গণহত্যাসংক্রান্ত কোনো প্রমাণ নষ্ট না করা; ৪. বর্তমান পরিস্থিতি আরো যাতে জটিল না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা। গাম্বিয়া এ ব্যাপারে একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ চেয়েছে। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে এর কোনো একটির ব্যাপারেও মিয়ানমার সরকারের আপত্তি থাকার কথা নয়। রাখাইনে ব্যাপক গণহত্যা হয়েছে, এটা মিয়ানমার স্বীকার না করলেও সেখানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, এটা তারা স্বীকার করে। যে কারণে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার বিচারের কথা মিয়ানমারের মিডিয়ায় প্রচারিতও হয়েছে। সুতরাং অং সান সু চি আদালতে এটা বলার চেষ্টা করবেন যে সেখানে গণহত্যা বন্ধ হয়েছে এবং দোষীদের বিচারের প্রক্রিয়ায় আনা হয়েছে! ২০১৭ সালের আগস্টের পর বড় ধরনের কোনো গণহত্যা হয়নি, এটাও বলবেন সু চি! গণহত্যার প্রমাণ ধ্বংস না করার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু এটা কি অনেক দেরি হয়ে গেল না? মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তো সব প্রমাণ এর মধ্যে ধ্বংস করে ফেলেছে। রোহিঙ্গাদের আদি বাড়িঘরের কোনো অস্তিত্ব নেই। বুলডোজার দিয়ে তা ধ্বংস করা হয়েছে। ওই সব অঞ্চল এখন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং সু চি আদালতে কী বলবেন, তা সবারই জানা। কেউ তদন্ত করতে গেলেও সেখানে কোনো আলামত খুঁজে পাবে না। তবে সু চি আদালতকে আশ্বস্ত করবেন এ ধরনের ‘ঘটনা’ আর ঘটবে না! এ ক্ষেত্রে আইসিজের কিছু করার থাকবে কি না সেটাও একটা প্রশ্ন।
অং সান সু চি নিজে মিয়ানমারের পক্ষে মামলা লড়ছেন। তাঁর এই ভূমিকাও বিতর্কিত। তিনি আইসিজেতে গেছেন শুধু সেনাবাহিনীর স্বার্থ দেখার জন্য। সারা বিশ্ব যেখানে জানে যে রাখাইনে গণহত্যা হয়েছে, সেখানে হত্যাকারীদের পক্ষ তিনি অবলম্বন করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনায় একটি মামলা হয়েছে। গেল সপ্তাহেই আর্জেন্টিনার একটি আদালতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর হুমকি সৃষ্টির অভিযোগে অং সান সু চি, সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লিয়াংসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো। এর মধ্য দিয়ে খোদ অং সান সু চির ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষুণ্ন হয়েছে। এটা সত্য, রোহিঙ্গা গণহত্যা চালানোর সময় সরকারের মূল ব্যক্তি ছিলেন সু চি। ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে অং সান সু চির দল বিজয়ী হয়। তিনি ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির মূল ব্যক্তি। তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সমমর্যাদায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা কিংবা আইসিসির প্রসিকিউটর ফাতুউ বেনসৌদার প্রতিবেদন—সব মিলিয়ে মিয়ানমারের শীর্ষ নেতৃত্ব এখন অনেকটা দিশাহারা। তিন দিনের ব্যবধানে আলাদা আদালতে তিনটি সম্পর্কহীন মামলা দায়ের করা হয়েছে। সবগুলোতেই ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর থেকে সামরিক অভিযানের সময় সংঘাতপীড়িত রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের জন্য মিয়ানমারের সরকার ও সামরিক নেতৃত্বকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। মামলা দায়ের করার সঙ্গে সঙ্গেই যে রায় পাওয়া যাবে, তেমনটি নয়। চূড়ান্ত রায় পেতে আমাদের অনেক সময় লাগবে। তবে স্পষ্টতই এই মামলার রায় যা-ই হোক, এ মুহূর্তে আমাদের আশাবাদী হওয়ার মতো তেমন কিছু ঘটবে না। আইসিজে ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত নিতে বলতে পারে না। তাদের কর্মপরিধিতে এমনটি নেই। উপরন্তু গাম্বিয়ার উপস্থাপনায়ও এমনটি নেই। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারে ১৯৮২ সালে যে আইনটি পাস হয়েছে (1982 Citizenship Low), এর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করা হয়েছে। সংকটের মূল সমাধান এখানে নিহিত। কিন্তু আইসিজে এ ব্যাপারে কোনো মতামত দিতে পারে না। সব মিলিয়ে মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রশ্নে এক ধরনের ‘চাপ’-এ আছে। অং সান সু চি নিজে দ্য হেগের আদালতে উপস্থিত থেকে এই ‘চাপ’ কমাতে পারবেন বলে মনে হয় না। অত্যন্ত ক্ষমতাবান জেনারেল মিন অং হ্লিয়াংয়ের স্বার্থ রক্ষা করে ২০২০ সালের নির্বাচনী বৈতরণী তিনি পার হতে চাচ্ছেন বটে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মিয়ানমারের সংবিধান সংশোধনীতে সেনাবাহিনী সায় দেবে না এবং তাঁর প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তির সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
গাম্বিয়ার প্রতিনিধি ওই সময়কার রোহিঙ্গা হত্যা ও নির্যাতনের কথা আদালতকে বলেছেন। আদালতের ১৭ জন বিচারপতি এসব বিষয়ে অবগত আছেন। রায়ে যা-ই বলা হোক না কেন, আইসিজের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। আইসিজে নিজে কোনো ‘রায়’ বাস্তবায়ন করতে পারে না। রায় বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিতে হবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে। ফলে আইসিজেতে যে মামলাটি হয়েছে, তার রায় আমাদের সন্তুষ্ট না-ও করতে পারে। তবে নিঃসন্দেহে এটা বলা যায়, মামলা দায়েরের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের নৈতিক পরাজয় হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমার আজ ‘অপরাধী’। মামলা একদিকে, আমাদের কূটনীতি অন্যদিকে। কূটনৈতিকভাবে আমাদের আরো কিছু করা দরকার। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যাতে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা যায়—এ লক্ষ্যেই আমাদের কাজ করে যেতে হবে। আর এটা যদি আমরা সাফল্যের সঙ্গে করতে পারি, তাহলে মিয়ানমার অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে। দ্য হেগে মামলা করে এ মুহূর্তে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যাবে বলে মনে হয় না।
Kalerkontho
12.12.2019


আরেকটি ‘কপ’ ও আরেকটি ব্যর্থতা

আরেকটি ‘কপ’ সম্মেলন এখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে। ‘কপ’ সম্মেলন হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন, যা জাতিসংঘ প্রতি বছর আয়োজন করে থাকে। এবারের সম্মেলন হচ্ছে কপ-২৫ বা  Conference of the Parties to the United Nations Fremework Convention on Climate change। জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত ২৫তম শীর্ষ সম্মেলন। চলবে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ফলাফল? এই সম্মেলন থেকে আমাদের প্রত্যাশা কী? কপ-২৪তম শীর্ষ সম্মেলন থেকেইবা আমরা কী পেয়েছিলাম? কপ-২৪ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল পোল্যান্ডের প্রাচীন রাজধানী কাটোভিচে। প্রায় ২৮ হাজার ব্যক্তি, যার অধিকাংশই এনজিও কর্মী, তারা জমায়েত হয়েছিলেন কাটোভিচে। ৪৫০ জন ছিলেন জাতিসংঘের স্টাফ। সাত হাজার ছিলেন অবজার্ভার। আর এবার যোগ দিচ্ছেন প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। বলা হচ্ছে, অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু ২৫ হাজার ব্যক্তি যখন মাদ্রিদে উপস্থিত হয়, তখন কী পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়, তার হিসাব কি কেউ করে? আরও একটা প্রশ্ন, লাখ লাখ ডলার খরচ করে যে শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করা হয়, তার ফলাফলইবা কী?
কপ-২৫-এর ব্যাপারে বেশ কয়েকটি বিষয় আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, গেল সেপ্টেম্বর মাসে (২০১৯) নিউ ইয়র্কে ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিট’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই ‘সামিটে’ প্যারিসে কপ-২১ সম্মেলনে (২০১৫) যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কপ-২১-এ সিদ্ধান্ত হয়েছিল বিশে^র তাপমাত্রা বৃদ্ধি দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হবে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে তাপমাত্রা বৃদ্ধি কমানো যাচ্ছে না। গবেষণায় ধরা পড়েছে, এই শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই তাপমাত্রা ৩ দশমিক ২ ডিগ্রি থেকে ৩ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে বৃদ্ধি পাবে। এই বৃদ্ধিতে পরিবেশগত সমস্যা বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘের Meteorological Agency (WMO)-এর মতে, বায়ুমণ্ডলে যে কার্বন ডাই-অক্সাইড ঘনীভূত রয়েছে (407.8 parts per million), তা বিপদসীমা (400 ppm) অতিক্রম করেছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বনের এই পরিমাণ যদি কমিয়ে আনা না যায়, তাহলে অধ্যাপক তালাসের মতে, উষ্ণতা ২-৩ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে ও সাগর-মহাসাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে ১০ থেকে ২০ মিটার (un nwes, ২৫ নভেম্বর, ২০১৯)। ফলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই। তৃতীয়ত, প্যারিস কপ-২১ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২০২০ সালের মধ্যেই গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। আগামী বছর (২০২০) কপ-২৬ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে গ্লাসগোতে। সুতরাং মাদ্রিদ সম্মেলনই সর্বশেষ সুযোগ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আর উদ্যোগ গ্রহণের।
এখানে বলে রাখা ভালো, ১৯৯৫ সালের কপ-১-এর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ছিল বার্লিনে। এরপর থেকে প্রতি বছর অন্তর কপ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে খুব যে অগ্রগতি হয়েছে, তা বলা যাবে না। জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত সম্মেলনের টার্গেট মূলত তিনটি : ১. ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শতকরা ৪৫ ভাগ কমান, ২. ২০৫০ সালের মধ্যে ‘Climate neutrality’ বা জলবায়ু নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা। অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণের মাত্রা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা, ৩. এই শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে স্থির রাখা। কিন্তু কাজটি যে খুব সহজ, তা বলা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র কপ-২১ চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও ট্রাম্প প্রশাসন কপ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের এখন আর কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে কোনো দায়বদ্ধতা নেই। কার্বন নিঃসরণকারী দেশের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র, পরিমাণ শতকরা ১৪ দশমিক ৬ ভাগ (৫২৬৯ মেট্রিক টন কার্বন ডাই-অক্সাইড সমতুল)। চীন রয়েছে এক নম্বরে। নিঃসরণ করে শতকরা ২৭ দশমিক ২ ভাগ (৯৮৩৯ মেট্রিক টন)। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো বড় দেশ যদি আন্তরিক না হয়, তাহলে জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়ন করা যাবে না।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন কপ সম্মেলনে তার উদ্বেগের কথা জানান, তখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে কিছু তথ্য দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গেল ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে প্রতি সাতজনে একজন উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। তারা হচ্ছেন জলবায়ু উদ্বাস্তু। আগামীতে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বিশ^বাসী জলবায়ু উদ্বাস্তুর সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয় ২০০৫ সালে, যখন বাংলাদেশে ভোলার চরাঞ্চল থেকে পাঁচ লাখ মানুষ চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ক্রিশ্চিয়ান পেনেনটি (Christian Penenti) তার একটি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন সে কথা। পেনেনটি আরও উল্লেখ করেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যেই ২২ মিলিয়ন, অর্থাৎ ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল থেকে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হবে। আইপিসিসির রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের কথা।
বাংলাদেশ যে আইলা ও সিডরে আক্রান্ত হয়েছিল, বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার এটা একটা বড় ফল। বিশে^র উষ্ণতা রোধকল্পে ২০১৫ সালে প্যারিসে কপ-২১ সম্মেলনে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ওই সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল (তাপমাত্রা বৃদ্ধি দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা), তা থেকে যুক্তরাষ্ট্র এখন সরে এসেছে। যদিও কপ-২১ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত ও ২০১৬ সালে ২২ এপ্রিল জাতিসংঘের সদর দপ্তরে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র স্বাক্ষর করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র বড় দেশ। যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় জলবায়ু চুক্তির ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নের মুখে। তবে জলবায়ু চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন যে নেই, তা নয়। প্রশ্ন আছে। প্রথমত, কার্বন নির্গমনকে আমরা পরিমাপ করব কীভাবে? জাতিসংঘ কর্তৃক দূষণ পরিমাপ করার জন্য একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা মোট আয়ের (জিডিপি) অনুপাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড উদগিরণের হারকে কার্বন ঘনত্ব না গ্রিন হাউজ গ্যাসের ঘনত্ব (প্রতি ১০ লাখ ডলার জিডিপি পিছু মেট্রিক টন গ্রিন হাউজ গ্যাস) হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ^ মনে করে, এ হার মাথাপিছু জনসংখ্যা ধরে করা উচিত। এটা নিয়ে একটা মতপার্থক্য রয়েই গেছে। দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, অর্থ জোগাবে কে? উষ্ণতা রোধ করার জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে, সেই অর্থ পাওয়া যাবে কোন সূত্র থেকে এটা একটা চিন্তার কারণ। অর্থের যে হিসাব করা হয়েছে, তার পরিমাণ প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার বছরে। যুক্তরাষ্ট্রের এ ফান্ডে দুই মিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন এই অর্থপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেনি। ফলে কপ-২১ চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই। তৃতীয়ত, প্রযুক্তি হস্তান্তরের কথাও আলোচিত হচ্ছে কপ শীর্ষ সম্মেলনগুলোতে। উন্নত বিশ^ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশে^র উষ্ণতা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশে^র পক্ষে এটি সম্ভব নয়। আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহের ব্যাপারেও উন্নত বিশ্বের এক ধরনের অনাগ্রহ রয়েছে। ফলে উন্নয়নশীল বিশে^ আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে না। ফলে জলবায়ু চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক।
আগামী ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত কপ-২৫ সম্মেলন চলবে। কপ-২৬ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে গ্লাসগোতে। প্রশ্ন হচ্ছে, জাতিসংঘ প্রতি বছর এ ধরনের সম্মেলন আয়োজন করে বটে; কিন্তু সিদ্ধান্তগুলো যদি বাস্তবায়ন করা না হয়, তাহলে এ ধরনের সম্মেলন আয়োজন করে কী লাভ? মাদ্রিদ সম্মেলনও (কপ-২৫) শেষ হবে ভালো ভালো কথা বলার মধ্য দিয়ে। এ থেকে উন্নয়নশীল বিশ্ব উপকৃত হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। আরও সম্মেলন হবে। মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে। আমাদের মতো দেশ থেকে প্রতিনিধিরা সরকারি খরচে যাবেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেও মাদ্রিদে দেখলাম। কিন্তু জানলাম না তার ভূমিকা কী ছিল। যদি ‘শুধু অংশগ্রহণের জন্য’ মাদ্রিদে যাওয়া হয়, তাহলে ভিন্ন কথা। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স-২০২০-এ বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি দশের মধ্যে সাত নম্বরে দেখানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শুধু সম্মেলনে অংশগ্রহণের মধ্যে কোনো সাফল্য নেই। অভ্যন্তরীণভাবে এ সমস্যা মোকাবিলায় আমরা কী কী কর্মসূচি হাতে নিয়েছি, সেটাই হচ্ছে বড় কথা। বাংলাদেশ থেকে যারা প্রতি বছরই সম্মেলনে যোগ দেন, তাদের কাছে সম্মেলনে যোগদানটাই যেন বড়! তাদের দেশের অভ্যন্তরে বড় কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশে জলবায়ু ফান্ডে প্রাপ্ত টাকা বরাদ্দ নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। একসময় বলা হয়েছিল, প্রাপ্ত টাকা বিলিবণ্টনের বিষয়টি দেখভাল করবে বিশ^ব্যাংক। পরে বিশ^ব্যাংক এখান থেকে সরে যায়। এখানে দুর্নীতির খবরও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কপ-২১ সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেখানে আইনি বাধ্যকতার বিষয়টিও অত কঠোর নয়। সাগর পাড়ের দেশগুলো, সারা বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে গেলে, তাদের বিশাল এলাকা সাগরগর্ভে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা হয়েছে, তারা কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবে না। ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নির্ভর করে বড় দেশগুলোর মর্জিমাফিকের ওপর। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে বড় দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি ‘পজিটিভ’ নয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মানেন না। অভিযোগ আছে, তিনি বড় বড় তেল কোম্পানির স্বার্থ দেখছেন। চুক্তি কার্যকর হলে বড় বড় তেল কোম্পানির তেল উত্তোলন ও বিপণন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্র নিজে প্রতিদিন ১৩ দশমিক ১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। সৌদি আরব করে ১২ মিলিয়ন। চীনের তেল উত্তোলনের পরিমাণ কম, মাত্র ৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন ব্যারেল প্রতিদিন। চীন জ্বলানই লানি আমদানি করে বেশি। তাই বড় দেশগুলোর উদ্যোগটাই হলো আসল। এই দেশগুলো উদ্যোগ না নিলে কপ-২১ চুক্তি বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদ্রিদ কপ-২৫ সম্মেলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা ব্যর্থ হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্ষমা করবে না।’ মিথ্যা বলেননি প্রধানমন্ত্রী। সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এখন বড় দেশ, তথা যুক্তরাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে চুক্তি বাস্তবায়নে। এটা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
Desh Rupantor
08.12.2019

অথ : ‘টুপি’ কাহিনী

হলি আর্টিজান মামলার রায় ঘোষিত হওয়ার পর সাজাপ্রাপ্ত দুজন জঙ্গি ইসলামিক স্টেটের লোগোসংবলিত টুপি পরে ও ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে ফটো সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণের ‘কাহিনী’ এখন বড় ধরনের আলোচনার নাম দিয়েছে। স্পষ্টতই এটা কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না এবং তারা যে সুপরিকল্পিতভাবে এ কাজটি করেছে, তা বলার আর অপেক্ষাও রাখে না। দৈনিক দেশ রূপান্তরের ২৮ নভেম্বরের প্রথম পাতায় প্রকাশিত ছবিতে স্পষ্ট দেখা গেছে, আসামি রিগ্যানকে প্রিজনভ্যান থেকে গারদে নেওয়ার সময় মাথায় তার কোনো টুপি ছিল না। কিন্তু গারদ থেকে এজলাসে হাজিরের সময় ও রায় ঘোষণার পর তার মাথায় আইএসের লোগোসংবলিত টুপি দেখা যায়। একই সময় অপর আসামি রাজীব গান্ধীর মাথায়ও আইএসের টুপি ছিল। একজন ধর্মভীরু মুসলমানের মাথায় টুপি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওই টুপিতে যদি আইএসের লোগো থাকে, তাহলে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার কাছেও একটি প্রশ্নের জন্ম হয়েছিল টুপিগুলো তারা কোত্থেকে সংগ্রহ করল? এবং এই টুপি পরার উদ্দেশ্যই-বা কী? এটা নিয়ে গত কয়েক দিন একাধিক বক্তব্য আমি পত্রপত্রিকায় দেখেছি। অনেকের মন্তব্যও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। নানাভাবে তারা এর বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। তবে বলতেই হবে, এটি কোনো সাধারণ ‘টুপি’ ছিল না। যেসব জঙ্গি ওই টুপি পরিধান করেছিল, তারা একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এ কাজটি করেছে। প্রধানত তারা এই জঙ্গিবাদী আদর্শ থেকে এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি। মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়ার পরও তাদের কর্মকাণ্ডে তারা এতটুকুও অনুতপ্ত নয়। বরং ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে তারা জানান দিতে চাইল, এই আদর্শকে ধারণ করে তারা কোনো অন্যায় করেনি। তাদের উপলব্ধিবোধে কোনো পরিবর্তন আসেনি। মৃত্যু জেনেও তারা ‘ভি’ চিহ্ন দেখাল। হলি আর্টিজানের ঘটনায় ২২ জন মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছিল। তিন বছর পরও তাদের মনমানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। আসামিরা যখন আইএসের টুপি মাথায় পরে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, তখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স’কে কোনো কোনো অপশক্তি নস্যাৎ করে দিতে চায় কি না? কেননা, ওই টুপি কোত্থেকে এলো? কারা সরবরাহ করল? কোন শক্তি এর পেছনে কাজ করছে? একটি তদন্ত কমিটি ইতিমধেই্য গঠিত হয়েছে। কমিটি জেলখানা ও সেই সঙ্গে কোর্ট-কাচারির সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ছবি যাচাই করে দেখতে পারে। জঙ্গি দমনে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথেষ্ট সাফল্য আছে। কিন্তু এই একটি ছোট্ট ঘটনায় তাদের সব অর্জন যেন মøান হয়ে না যায়। মনে রাখতে হবে, এটি কোনো ছোট্ট ঘটনা নয়। এর একটি ইমপ্যাক্ট আছে। যে ‘শক্তি’ হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল, সেই শক্তিই এই ‘টুপি’ সরবরাহের পেছনে আছে। হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে তারা বিশ্বের মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল, আজও আইএসের ‘টুপি’ দেখিয়ে একইভাবে তারা বিশ্বকে জানান দিল বাংলাদেশে এখনো জঙ্গি আছে! আমি এটাকে হালকাভাবে নিতে চাই না। সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, আইএসের কোনো টুপি নেই। কিন্তু টুপিতে যে লোগো ব্যবহার করা হয়েছে, তা আইএসের এটা তো অস্বীকার করা যাবে না? আইএস তাদের প্রচারকাজ চালানোর জন্য কিছু ‘সিম্বল’ ব্যবহার করে–যেমন কালো কাপড়, কালো পাঞ্জাবি, আরবি শব্দ ইত্যাদি। হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের সময় যে ভিডিওবার্তা প্রচারিত হয়েছিল, তাতে এসব সিম্বল ব্যবহার করা হয়েছিল। কল্যাণপুরের ঘটনায়ও আমরা তা দেখেছি। এমনকি শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডের হত্যাকাণ্ডের সময়ও একই ধরনের সিম্বল আমরা দেখেছি। ফলে এ ধরনের সিম্বল ব্যবহার করে তারা যে কৌশলে তাদের প্রচারকার্য চালায়, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েও তারা কি কৌশলে আইএসের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে গেল? একদিকে বাংলাদেশ যখন জঙ্গিবিরোধী তার অবস্থাকে শক্তিশালী করেছে ও বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে, সেখানে কৌশলে তারা কি আইএসের নামকে ব্যবহার করল? যদিও তাদের এই ‘কৌশল’ সাধারণ মানুষ গ্রহণ করে নেবে না। তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের ঘৃণা বেড়েছে বৈ কমেনি।
২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একটি কালো অধ্যায়। কিছু বিপথগামী তরুণ ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছিল নিরীহ মানুষদের। তাদের এই হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত। দীর্ঘদিন ধরে তারা এই পরিকল্পনা করেছিল। এ জন্য তাদের আগে প্রশিক্ষণ পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল। তারা হলি আর্টিজান বেকারিকে বেছে নিয়েছিল একটাই কারণে আর তা হচ্ছে এখানে বিদেশিদের যাওয়া-আসা ছিল। এখানে বিদেশিরা নিয়মিত ডিনার করতে যেতেন। বিদেশিদের জিম্মি করে ও তাদের হত্যা করে তারা অন্তত একটি মেসেজ দিতে চেয়েছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চরিত্র নষ্ট করা। বাংলাদেশ যে একটি শান্তিও সম্প্রীতির দেশ, তা তারা নষ্ট করতে চেয়েছিল। বিদেশিদের হত্যা করলে খুব সহজেই বিদেশি মিডিয়ায় স্থান পাওয়া যাবে, তাদের নাম ছড়িয়ে পড়বে, এ বিষয়টি তাদের বিবেচনায় ছিল। বিদেশিদের হত্যা করলে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে, তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এবং বাংলাদেশে আসতে চাইবেন না। ফলে জঙ্গিরা সুবিধা পাবে। এই তরুণরা (মোবাশ্বের, খাইরুল, সোহান, নিবরাস ও শফিকুল) ছিল নব্য জেএমপির সদস্য। তাদের সংগঠিত করেছিল তামিম চৌধুরী। উদ্দেশ্য পরিষ্কার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ। হত্যাকাণ্ড তারা সংঘটিত করেছিল বটে, কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের ঘৃণা করেছিল। ধর্মভীরু সাধারণ মানুষ ঘৃণাভরে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রত্যাখ্যান করেছিল। ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পর তদন্ত সম্পন্ন করে দোষীদের বিচারিক প্রক্রিয়ায় শাস্তি দিয়ে বাংলাদেশ জঙ্গিবিরোধী তার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করল। হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশে আর বড় ধরনের কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেনি। জঙ্গিবাদ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবশ্যই তাদের কৃতিত্ব দাবি করতে পারে। কিন্তু আমরা যেন আত্মতুষ্টিতে না ভুগি। জঙ্গিবাদকে বিস্তার হতে দেয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সিটিটিসিকে আমরা সেই কৃতিত্ব অবশ্য দেব। কিন্তু জঙ্গিবাদকে পরিপূর্ণভাবে আমরা নির্মূল করতে পেরেছি এ ধরনের বক্তব্য আমরা দেব না। আমাদের আরও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এই জঙ্গিরা সমাজে হয়তো বড় ধরনের ‘পেনেট্রেশন’ করতে পারেনি। সাধারণ মানুষ তাদের কর্মকাণ্ড সমর্থনও করে না। কিন্তু ছোটখাটো দু-একটি ঘটনায় এটা প্রমাণিত এই মতবাদের সমর্থকরা সমাজে এখনো ঘাপটি মেরে আছে। তাদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। হলি আর্টিজান হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্যের প্রাথমিক ধাপ যখন সম্পন্ন হয়েছে, তখন সংবাদপত্রে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, আইএস নেতার মৃত্যুর পর আইএস জঙ্গিরা দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের ঘাঁটি গড়ে তুলতে পারে। সম্প্রতি ব্যাংককে শেষ হওয়া আসিয়ান মন্ত্রীদের বৈঠকে তিনি এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন। অনেকেই মনে করেন, আইএস জঙ্গিগোষ্ঠীর মতাদর্শের মূলোৎপাটন করতে দীর্ঘ লড়াই করতে হবে। তারা মনে করেন, আইএস জঙ্গিদের ফেরত আসা, অনলাইনে উগ্রবাদ ঠেকাতে ও সম্ভাব্য হামলা মোকাবিলায় সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। এটাই হচ্ছে আসল কথা। বাগদাদির মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তিনি যে রাজনীতির বীজ বপন করে দিয়েছিলেন, তা রয়ে গেছে। সেখান থেকে ‘হত্যার রাজনীতি’ আবার শুরু হতে পারে! দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফিলিপাইনে আইএস ঘাঁটি গেড়েছে বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায়ও আইএসপন্থি জঙ্গিরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। শ্রীলঙ্কার মতো একটি বৌদ্ধপ্রধান দেশেও আইএস তাদের থাবা বিস্তার করেছিল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা অতটা উদ্বিগ্ন নই। কেননা, নব্য জেএমবি, যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল, তাদের কর্মকাণ্ড এক রকম নেই বললেই চলে। তাদের নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তারা আর নতুন করে সংগঠিত হতে পারছে না। কিন্তু জঙ্গিবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। কতগুলো বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। যেসব জঙ্গি বাংলাদেশ থেকে সিরিয়ায় ‘যুদ্ধ’ করতে গিয়েছিল, তাদের কোনো পরিসংখ্যান হয়তো আমাদের কাছে নেই। কিন্তু ওইসব অঞ্চল থেকে কারা ফেরত আসছেন, তারা কোথায় থাকছেন, কী করছেন, এ ব্যাপারে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো দরকার। গ্রামগঞ্জে মসজিদ, মাদ্রাসাগুলোতে নজরদারি বাড়ানো দরকার। জঙ্গিরা এই মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোকে টার্গেট করে তাদের অপতৎপরতা বাড়াতে পারে। অনলাইনে কী ধরনের বক্তব্য যায়, সেখানে জঙ্গি মতাদর্শের পক্ষে কোনো বক্তব্য থাকে কি-না তা নিয়মিত মনিটর করা প্রয়োজন। ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম এবং এই ধর্ম যে উগ্রবাদকে সমর্থন করে না এ ব্যাপারে দীর্ঘস্থায়ী প্রচারণা চালানো প্রয়োজন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন এই কাজটি করতে পারে। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডে কিছুটা শ্লথগতি এসেছে বলে মনে হয়। গ্রামগঞ্জে ওয়াজ মাহফিল আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ। এসব ওয়াজ মাহফিলে উগ্রবাদী রাজনীতি ছড়ানো হয় বলে অভিযোগ আছে। সুতরাং নিয়মিত ওয়াজ মাহফিল মনিটর করা প্রয়োজন।
জঙ্গিবিরোধী অবস্থানের একটা অধ্যায় পার হলো। এখন বাকি প্রক্রিয়াগুলোও দ্রুত সম্পন্ন হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। হলি আর্টিজানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও খর্ব হয়েছিল। এখন দোষীদের বিচার সম্পন্ন করে কিছুটা হলেও বাংলাদেশ তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারল। কিন্তু যেতে হবে আরও কিছুদূর। সমাজে বিভ্রান্তকারীরা এখনো আছে। তারা ধর্মভীরু সাধারণ মানুষের অনুভূতিকে ‘ব্যবহার’ করতে চায়। টুপিতে আইএসের লোগো ব্যবহার কোনো বড় ঘটনা নয়। কিন্তু ওই জঙ্গিরা তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য যে আদৌ অনুশোচনায় ভোগে না এটাই চিন্তার কারণ। তারা এখনো তাদের ভ্রান্ত মতাদর্শ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। আমাদের চিন্তার কারণ এখানেই।
Desh Rupantor
01.12.2019

‘কপ’ শীর্ষ সম্মেলন ও বাংলাদেশে পরিবেশগত সমস্যা

 মাদ্রিদে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কপ-২৫ শীর্ষ সম্মেলন যখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, ঠিক তখনই এশিয়া নিউজ নেটওয়ার্কে প্রকাশিত হয়েছে গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স ২০২০। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে সাত নম্বরে স্থান দেয়া হয়েছে।
এ তালিকার শীর্ষে রয়েছে পুয়ের্টোরিকো, মিয়ানমার ও হাইতির মতো দেশ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কপ-২৫ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। এ সম্মেলন চলবে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। বিশ্ব যে বড় ধরনের পরিবেশগত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, এবং বাংলাদেশ যে কত বড় ঝুঁকির মুখে রয়েছে, কিছুদিন আগে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ তার একটি উদাহরণ। বাংলাদেশের এ জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদের কথা বলতেই প্রধানমন্ত্রী মাদ্রিদে গিয়েছিলেন।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত কপ-২১ সম্মেলনে পৃথিবীর উষ্ণতা কমানোর জন্য বিশ্বের ১৯৫টি দেশ নীতিগতভাবে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্যারিস চুক্তিতে যে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল, তা শেষ হবে ২০২০ সালে। এ সময়ের মধ্যেই চুক্তির বাস্তবায়ন চূড়ান্ত করতে হবে। কিন্তু এখন অবধি তাতে কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না।
পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। উষ্ণতা বাড়ার কারণে সাগর-মহাসাগরের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তাতে করে বিশ্বের যেসব সমুদ্র পাড়ের দেশের ক্ষতি হবে, তার মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা কতটুকু সচেতনতা গড়ে তুলতে পেরেছি? সম্প্রতি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জানিয়েছেন, দেশটি ২০০ কোটি গাছ লাগাবে। নরওয়ে গাছ কাটা নিষিদ্ধ করেছে।
একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (Crowther Lab) জানিয়েছে, বিশ্বের ২২০ কোটি একর জমিতে যদি গাছ লাগানো যায়, তাহলে বিশ্বে যে কার্বন নির্গমন হয়, তার তিন ভাগের দুই ভাগ ধরে রাখা সম্ভব হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ করার জন্য ২০১৫ সালের কপ-২১ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এ ব্যাপারে উদ্যোগটা কম। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো আদৌ দায়ী নয়। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়নশীল বিশ্ব।
শিল্পোন্নত ১০টি দেশ বিশ্বের কার্বন নিঃসরণের ৬৭.৬ ভাগ নিজেরা নিঃসরণ করে। এ তালিকার শীর্ষে রয়েছে চীন। দুঃখজনক হচ্ছে, কপ-২১-এ যুক্তরাষ্ট্র স্বাক্ষর করলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হয়ে কপ-২১ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। সারা বিশ্ব যেখানে এটা স্বীকার করে নিয়েছে এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দায়ী, সেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ বৈজ্ঞানিক ও প্রমাণিত সত্যকে বিশ্বাস করতে চাইছেন না। বলা হচ্ছে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। মরু অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলে যাচ্ছে। এতে করে বাড়ছে সাগর-মহাসাগরের জলরাশি। World
Meteorological Organization (WMO)-এর সর্বশেষ রিপোর্টে ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে- কার্বন নিঃসরণের মাত্রা অতীতের চেয়ে ২০১৫-২০১৯ সময়সীমায় ২০ ভাগ হারে বেড়েছে। ১৯৯৩ সাল থেকে যেখানে সাগরের জলসীমার উচ্চতা বেড়েছে গড়ে ৩.২ মিলিমিটার, সেখানে ২০১৫-২০১৯ সময়সীমায় বেড়েছে ৫ মিলিমিটারের উপর (এবিসি নিউজ, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বারবার ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। দ্বীপাঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো আতঙ্কের মাঝে আছে। এ ক্ষেত্রে বড় রাষ্ট্রগুলোর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের যে দায়িত্ব পালন করার কথা, যুক্তরাষ্ট্র তা পালন করছে না। জাতিসংঘের ব্যর্থতা এখানেই যে, বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে জাতিসংঘ সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। সুতরাং ভয়টা এখানেই।
এ বিষয়ে কিশোরী গ্রেটা থানবার্গ যে সত্য উচ্চারণ করেছিলেন, তা কতটুকু আবেদন রাখতে পারবে? সম্প্রতি দি ইকোনমিস্টের একটি কভার স্টোরি ছিল ‘The climate issue’ (২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। এ প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে কীভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাময়িকীটি একটি তথ্য দিয়েছে। তাতে দেখা যায় কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দ্বিতীয়। ব্যক্তি পর্যায়ে এর পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রে ৫.৩ গিগাটন, মধ্যপ্রাচ্যে ২.৭ গিগাটন, ইউরোপে ৪.৯ গিগাটন, চীনে ৯.৮ গিগাটন, এশিয়া-প্যাসিফিকে ৫.১ গিগাটন, ভারতে ২.৫ গিগাটন ইত্যাদি (বিশ্বে গড় ৪.৬ গিগাটন, ২০১৭ সালের হিসাব)।
বিকল্প জ্বালানির অভাবে অথবা না থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বেশি মাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। দুঃখজনক হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটা উপলব্ধি করেন না। তাই তিনি যখন কপ-২১ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন, তখন বোঝা যায় তিনি বিষয়টিকে বিবেচনায় নেননি। অথচ বিকল্প জ্বালানি উৎপাদন, গবেষণা ইত্যাদির দিকে তিনি নজর দিতে পারতেন। এখন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা শিল্পোন্নত দেশগুলোর উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে যে ক্ষতি হবে, তা হয়তো তারা কাটিয়ে উঠতে পারবে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, সোলার বা বায়ু এনার্জির প্রসার ঘটিয়ে তারা এনার্জি চাহিদা পূরণ করতে পারবে।
কিন্তু বাংলাদেশসহ সাগর পারের দেশগুলো? অনেক দেশ এখন ঝুঁকির মধ্যে আছে। প্যারিস কপ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, উন্নত দেশগুলো পরিবেশ রক্ষায় উন্নয়নশীল, বিশ্ব বিশেষ করে সাগর পারের দেশগুলোকে সাহায্য করবে। কিন্তু তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি গত চার বছরেও। বলা ভালো, উন্নত বিশ্বের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিশ্ব জিডিপির ৭৫ শতাংশ, আর তারা কার্বন নিঃসরণ করে ৬৭.৬ শতাংশ।
এসব উন্নত দেশের কার্বন নিঃসরণের কারণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এটা মেনে নেয়া যায় না। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতি বছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গত ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় দ্বীপাঞ্চলের মানুষ ঢাকায় আসতে বাধ্য হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে প্রতি সাতজনে একজন মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। বাংলাদেশ কোপেনহেগেন কপ সম্মেলনে (২০০৯) এসব উদ্বাস্তু মানুষকে Universal Natural Person হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছিল।
কিন্তু এ দাবি গ্রহণ করা হয়নি। বাংলাদেশ জাতিসংঘে এ দাবি আবারও উত্থাপন করেছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলায় যে বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে (২০১৯) যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে এ উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টিও। প্রধানমন্ত্রী এবার মাদ্রিদেও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ে তার উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ অর্থায়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দিলেও অভ্যন্তরীণভাবে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে কম। প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেককে তিনটি করে গাছ লাগানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগটা কম। বন অধিদফতরের কোনো উদ্যোগও আমার চোখে পড়ছে না। পরিবেশ মন্ত্রণালয় একটি সমন্বিত পরিকল্পনার আওতায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের একটি কাজে জড়িত হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারত। কিন্তু পরিবেশ কিংবা বন মন্ত্রণালয়, কারও কোনো উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গাছের কোনো বিকল্প নেই।
গাছ লাগানোর ব্যাপারে যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে, তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। নিউজিল্যান্ড সরকার ১০০ কোটি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করছে পরিবেশ রক্ষার জন্য (Educate Inspire Change, ১৯ আগস্ট ২০১৯)। দেশটি ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে চায়। এ জন্যই গাছ লাগানোর এ পরিকল্পনা। ফিলিপাইন নতুন একটি আইন প্রণয়ন করেছে, যেখানে একজন শিক্ষার্থী ১০টি গাছ না লাগালে তাকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি দেয়া যাবে না। ইতিমধ্যে আইনটি ফিলিপাইনের আইনসভায় পাসও হয়েছে (Insider, ২৯ মে ২০১৯)।
ভারতের দৃষ্টান্ত দেই। উষ্ণতা রোধকল্পে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে স্কুল শিক্ষার্থীসহ সবাই একদিনে ২২ কোটি গাছ লাগিয়েছে। অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশের মোট বাসিন্দা ২২ কোটি, সবাই একটি করে গাছ লাগিয়েছেন ১৪ লাখ ৩০ হাজার ৩৮১টি জায়গায়, যার মধ্যে আছে ৬০ হাজার গ্রাম, আর ৮৩ হাজার জঙ্গল চিহ্নিত এলাকা। এ তথ্যটি দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ (USA Today, ৯ আগস্ট ২০১৯)।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বৈঠকে উল্লেখ করেছিলেন, ‘Climate change is a security threat. We must act now’- অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তন একটি নিরাপত্তা ঝুঁকি। এখনই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শেখ হাসিনা সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘The time to act on climate changes in now. If anyone still doubts climate change,
even slightly, I invite you to visit Bangladesh. I am ready to walk with you to shwo hwo climate change silently impacts the lives of million’ (WEFORUM.ORG, 26 March 2019)।
প্রধানমন্ত্রীর এ কথার পেছনে সত্যতা আছে। সারা বিশ্ব আজ স্বীকার করে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। এখন মাদ্রিদ সম্মেলনে সামগ্রিকভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে সত্য; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অনাগ্রহের কারণে এক্ষেত্রে আদৌ কোনো সমাধানে আসা যাবে না। ‘কপ’ সম্মেলনের ব্যর্থতা এখানেই।
Daily Jugantor
07.12.2019

একটি উদ্বেগজনক সংবাদ

 একটি উদ্বেগের খবর ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে গত ৩ ডিসেম্বর। গত ২ ডিসেম্বর স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে কপ-২৫ সম্মেলন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেগজনক এই সংবাদটিও ছাপা হয়েছে। দাতব্য সংস্থা অক্সফাম জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত এই রিপোর্টটি প্রকাশ করে। উদ্বেগের খবরটি হলো এই যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতি ২ সেকেন্ডে ১ জন করে মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন।
অর্থাৎ সাগরপারের দেশগুলো থেকে বছরে ২০ মিলিয়ন, অর্থাৎ ২ কোটি মানুষ নিজ বাসভূমি থেকে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে। ফলে তারা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
অক্সফামের ওই রিপোর্ট নিয়ে জার্মান মিডিয়া ‘ডয়েচে ভেলে’ একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদনে ১০টি প্যাসিফিক ও ক্যারিবীয় রাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা বড় ঝুঁকির মাঝে আছে। অক্সফামের রিপোর্টে উল্লেখ আছে, গেল শতকে এশিয়ার শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
ইন্দোনেশিয়ার কথা অনেকে স্মরণ করতে পারেন। সম্প্রতি সেখানকার সরকার রাজধানী জাকার্তাকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, সাগরের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় জাকার্তা এখন ঝুঁকির মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুধু যে সাগরের উচ্চতা বাড়ছে তেমনটি নয়, বরং অতিরিক্ত গরম, আর বারবার ঘূর্ণিঝড়ের জন্ম হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা উপকূলে বারবার ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনা একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
সাগর উত্তপ্ত হওয়ার কারণে বাড়ছে ঘূর্ণিঝড়। আবার আটলান্টিক উপকূলবর্তী শহরগুলোতে বাড়ছে শীতের প্রকোপ। গত কয়েক বছর নিউইয়র্ক কিংবা কানাডার টরেন্টোতে যে শীতের প্রকোপ বেড়েছে, তা সমসাময়িককালের ইতিহাসে তেমনটি আর দেখা যায়নি।
অক্সফামের রিপোর্টে যে উদ্বেগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটাই বাস্তব। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখেই গত ২ ডিসেম্বর স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে শুরু হয়েছে কপ-২৫ বা Conferance on the partiec to the united nation framework convention on climate change শীর্ষ সম্মেলন।
জাতিসংঘ প্রতিবছরই এই ‘কপ’ সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে। সম্মেলনের গুরুত্ব অনুধাবন করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ইতোমধ্যে দেশে ফিরেও এসেছেন। সম্মেলনটি চলবে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন ‘আমরা ব্যর্থ হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।’ মিথ্যা বলেননি প্রধানমন্ত্রী। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব দেশ বড় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, তার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বাড়ছে জলবায়ু শরণার্থীদের সংখ্যা। প্রধানমন্ত্রী তাই তার উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন কপ সম্মেলনে।
বিশ্বের উষ্ণতা যে বাড়ছে, তার জন্য কোনোভাবেই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো দায়ী নয়। বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের একটি পরিসংখ্যান আমরা দিতে পারি। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৬০ সালে বিশ্বে যেখানে কার্বন নিঃসরণ হয়েছিল ৯০১১ গঃপড়২ সেখানে ২০১৭ সালে এর পরিমাণ ৩৬১৫৩ গঃপড়২। অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে বেশি। আর দেশগুলোর (যারা বেশি কার্বন নিঃসরণ করে) দিকে যদি তাকাই তা হলে দেখা যাবে কার্বন নিঃসরণের শীর্ষে রয়েছে চীন।
২০১৭ সালে চীনের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ৯৮৩৮ দশমিক ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন (মাথাপিছু ৭.১ মেট্রিক টন)। এজন্য চীনও কার্বন দূষণকারী দেশগুলোর শীর্ষে। এর পরের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের, কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ৫২৬৯ দশমিক ৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন (মাথাপুছি ১৬ দশমিক ২ মিলিয়ন মেট্রিক টন। যদিও চীনের জসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি। জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় চীনে কার্বন নিঃসরণের হারও বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের পার্থক্য এখানেই, যুক্তরাষ্ট্র কপ-২১ চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে এবং জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে চীন কপ-২১ চুক্তির ব্যাপারে ‘কমিটেড’। চীন বিকল্প জ্বালানির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের ব্যাপারে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না।
তৃতীয় কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হচ্ছে ভারত। কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ (২০১৭) ২৪৬৬ দশমিক ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন (মাথাপিছু ১ দশমিক ৮ মেট্রিক টন)। চতুর্থ অবস্থান রাশিয়ার, কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ১৬৯২ দশমিক ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন, মাথাপিছু এর পরিমাণ ১১ দশমিক ৭ মেট্রিক টন। এই পরিসংখ্যানগুলো উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, কার্বন নিঃসরণের কারণে বিশ্বের উষ্ণতা যে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এর জন্য উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো দায়ী নয়। দায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলো। চীন ও ভারতে জ্বালানি ক্ষুধা বাড়ছে। ব্যাপক শিল্পায়নের কারণে তাদের জীবাশ্ম জ্বালানি দরকার। অর্থাৎ জ্বালানি তেল দরকার।
এই জ্বালানি তেলের ব্যবহারের কারণেই বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কীভাবে জ্বালানি তেলের ব্যবহার বাড়ছে এবং কীভাবে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়ছে, তারও একটি পরিসংখ্যান আমরা দিতে পারি। ১৯৯২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চীনে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বেড়েছে ২৭০ ভাগ, যুক্তরাষ্ট্রে বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৮ ভাগ, ভারতের বেড়েছে ২৫৩ ভাগ, শিল্পোন্নত প্রতিটি দেশেরই কার্বন নিঃসরণ বেড়েছে। মেক্সিকো কিংবা ইন্দোনেশিয়ার মতো উঠতি অর্থনৈতিক শক্তির দেশগুলোতেও কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ১৯৯২ সালের চেয়ে ২০১৭ সালে ন্যূনতম ১০০ গুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউএসএ টুডে তাদের এক প্রতিবেদনে (১৪ জুলাই ২০১৯) বিশ্বের ২৫টি দেশের কার্বন নিঃসরণের একটি চিত্র তুলে ধরেছে।
এতে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় জ্বালানি তেলের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। ফলে ওইসব দেশ কর্তৃক কার্বন নিঃসরণের পরিমাণও বাড়ছে। এখন কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনা ও বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি কমিয়ে আনার ব্যাপারে কপ-২১-এ যে সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়েছিল, তার ভূমিকা অনেক ব্যাপক। প্যারিসে স্বাক্ষরিত কপ-২১-এ সিদ্ধান্ত হয়েছিল, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কপ-২১ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ায়, ওই চুক্তির ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অভিযোগ উঠেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বহুজাতীয় তেল কোম্পানিগুলোর স্বার্থে কাজ করছেন। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল উত্তোলন ও বিপণনের সঙ্গে বহুজাতীয় তেল কোম্পানিগুলো জড়িত। এদের পক্ষ হয়ে ট্রাম্প কথা বলছেন। যেখানে বৈজ্ঞানিকভাবে এটা প্রমাণিত যে, বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে তিনি এটা মানতে নারাজ। ফলে চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে একটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন কপ সম্মেলনে তার উদ্বেগের কথা জানান, তখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আরও কিছু তথ্য দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের উপকূলে প্রতিবছর ১৪ মিলিমিটার করে সমুদ্রের পানি বাড়ছে। গেল ২০ বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ সেন্টিমিটার। সমুদ্রের পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে প্রতি ৭ জনে ১ জন উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। এরা হচ্ছেন জলবায়ু উদ্বাস্তু। আগামীতে বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে। বিশ্ববাসী উদ্বাস্তুর সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয় ২০০৫ সালে, যখন বাংলাদেশে ভোলার চরাঞ্চল থেকে ৫ লাখ মানুষ অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ক্রিশ্চিয়ান পেনেনটি (ঈযৎরংঃরড়হ চবহবহঃর) তার একটি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন সে কথা। পেননটি আরও উল্লেখ করেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যেই ২২ মিলিয়ন অর্থাৎ ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল থেকে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হবে। আইপিসিসির রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশের কথা।
বাংলাদেশ যে আইলা ও সিডরে আক্রান্ত হয়েছিল, বিশ্বের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার এটা একটা বড় কারণ। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে ২০১৫ সালে প্যারিস কপ-২১ সম্মেলনে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ওই সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল (তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা), তা থেকে যুক্তরাষ্ট্র এখন সরে এসেছে। যদিও কপ-২১ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত ও ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল জাতিসংঘের সদর দপ্তরে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র স্বাক্ষর করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র বড় দেশ। যুক্তরাষ্ট ওই চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় জলবায়ু চুক্তির ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নের মুখে।
তবে জলবায়ু চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন যে নেই, তা নয়। প্রশ্ন আছে। প্রথমত, কার্বন নির্গমনকে আমরা পরিমাপ করব কীভাবে? জাতিসংঘ কর্তৃক দূষণ পরিমাপ করার জন্য একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা মোট আয়ের (জিডিপি) অনুপাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড উদগিরণের হারকে কার্বন ঘনত্ব বা গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব (প্রতি ১০ লাখ ডলার জিডিপি কিছু মেট্রিক টন গ্রিনহাউস গ্যাস) হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্ব মনে করে এ হার মাথাপিছু জনসংখ্যা ধরে করা উচিত। এটা নিয়ে একটা মতপার্থক্য রয়েই গেছে।
দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, অর্থ জোগাবে কে? উষ্ণতা রোদ করার জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে, সেই অর্থ পাওয়া যাবে কোন সূত্র থেকে, এটা একটা চিন্তার কারণ। অর্থের যে হিসাব করা হয়েছে, তার পরিমাণ প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার বছরে। যুক্তরাষ্ট্রের এ ফান্ডে ২ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন এ অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিত করেনি।
ফলে কপ-২১ চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই। তৃতীয়ত, প্রযুক্তি হস্তান্তরের কথাও আলোচিত হচ্ছে কপ শীর্ষ সম্মেলনগুলোতে। উন্নত বিশ্ব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বের পক্ষে এটি সম্ভব নয়। আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহের ব্যাপারেও উন্নত বিশ্বের এক ধরনের অনাগ্রহ রয়েছে। ফলে উন্নয়নশীল বিশ্বে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে না। একটা দৃষ্টান্ত দিই। চীন এখন সোলার এনার্জির ব্যবহারের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে। চীনে ২০১৭ সালে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৬৪১২ ঞযি।
এর মাঝে ১১৮.২ ঞযি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে সোলার থেকে। যদিও পরিমাণের দিক থেকে কম। কিন্তু এর ব্যবহার বাড়ছে। ভারতেও সোলার পাওয়ারের গুরুত্ব বেড়েছে। ভারতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় উৎস কয়লা (৫৬ শতাংশ)। সোলার পাওয়ার থেকে পাওয়া যায় ৮ দশমিক ৬ ভাগ। বাংলাদেশ তুলনামূলক বিচারে অনেক পিছিয়ে আছে।
আগামী ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত কপ-২৫ সম্মেলন চলবে। কপ-২৬ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে গ্লাসগোতে। প্রশ্ন হচ্ছে, জাতিসংঘ প্রতিবছর এ ধরনের সম্মেলন আয়োজন করে বটে, কিন্তু সিদ্ধান্তগুলো যদি বাস্তবায়ন না হয়, তা হলে সম্মেলন আয়োজন করে কী লাভ? মাদ্রিদ সম্মেলনও (কপ-২৫) শেষ হবে ভালো ভালো কথা বলার মধ্য দিয়ে। এ থেকে উন্নয়নশীল বিশ্ব উপকৃত হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই।
Daily Amader Somoy
07.12.2019